ইসলামের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি যে, যৌথবাহিনী চলে যাওয়ার পর ফেরেস্তা জিব্রাইল মুহাম্মদের কাছে হাজির হন এবং তাকে বানু কুরাইযাইহুদিদের আক্রমণ করার আদেশ দেন। এই ফেরেস্তা দেখতে লক্ষণীয়ভাবে কালব গোত্রের (Kalb tribe) খলিফার ছেলে দিহইয়ার (Dihya) মতো সুদর্শন যুবক ছিলেন। এমব্রয়ডারি করা পাগড়ি পরে চমৎকারভাবে সজ্জিত ফেরেস্তা একটি গাধার উপর ভর করে মসজিদের উঠোনে নামলেন এবং মুহাম্মদ তার সাথে কথা বলতে মসজিদের বাইরে গেলেন। ফেরেস্তা শীঘ্রই চলে গেল, কিন্তু মুহাম্মদের একজন স্ত্রী উম্মে সালামা তাদেরকে (দিহইয়ার সাথে মুহাম্মদকে) কথা বলতে দেখেছিলেন এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, এটি দিহইয়া ছাড়া আর কেউ হবে না। ইয়াছরিবের সকল নারীরা সুদর্শন দিহইয়াকে চিনত (১)। মুহাম্মদ তার ভুল ভাঙলেন, তিনি বললেন : উনি আসলে দিহইয়া না, বরং ফেরেস্তা জিব্রাইল যাকে দেখতে অনেকটা আসল দিহইয়ার মতোই লেগেছে। জামাতে এবং ব্যক্তিগত কথোপকথনে মুহাম্মদ প্রায়ই নবী ও ফেরেস্তাদের উপস্থিতিকে তার জামাতের শরিক হওয়া অনুসারীদের শারীরিক গঠনের সাথে তুলনা করতেন। এটা ছিল বিশ্বাসীদের প্রশংসা করার একটি কৌশল, এবং এর ফলে তারাও ফেরেস্তাদের সম্পর্কে ধারণা করতে পারত এবং নিজেদের এই বর্ণনা শুনে আনন্দিত হতো। মুহাম্মদ গাধার উপর দিহইয়ার মতো দেখতে ফেরেস্তার সাথে তার সাক্ষাতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে যে, দিহইয়ার রূপ ধরে ফেরেস্তা জিব্রাইল তাকে জানায় যে, সদ্যই মুহাম্মদ দক্ষিণে মক্কাবাসীদের রেড লায়ন (হামরাউল আসাদ) পর্যন্ত অনুসরণ করে ফিরে এসেছেন। মুহাম্মদ সেই ফেরেস্তাদের একটি সৈন্যদলের কমান্ডার ছিলেন, কিন্তু বর্ম খুলে ফিরে আসার জন্য মুহাম্মদকে ফেরেস্তারা তিরস্কার করেছে, কারণ তার হয়ে যুদ্ধ করার জন্য ফেরেস্তারা তাদের যুদ্ধের পোশাকে তৈরি ছিল, অথচ তিনি তাদের ফেলে চলে এসেছেন। এখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুহাম্মদকে সাহায্য করাই তাদের কাজ। ফেরেস্তাদের প্রধান জিব্রাইল বললেন, “আল্লাহ আপনাকে আদেশ দিয়েছেন বানু কুরাইযার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে। আমি নিজে ওদের দিকেই যাচ্ছি এবং তারা আমাদের দেখে নিশ্চিতভাবেই আঁতকে উঠবে!” (২)।
মুহাম্মদের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত লোকেরা ইতিমধ্যেই তাদের নিজ নিজ ঘরে চলে গেছে। মুহাম্মদ যখন বর্ম পরিহিত হয়ে বানু কুরাইযার এলাকায় দিকে যেতে যুদ্ধ-ঘোষককে তাদের কাছে পাঠালেন, ঘোষণা শুনে তারা আর্তনাদ করে উঠল। এমনকি তিনি ইহুদি দুর্গের মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে বিকেলের নামাজ (আছরের নামাজ) বিলম্বিত করার নির্দেশ দিলেন। ইসলামিক গ্রন্থ থেকে আরো জানা যায় যে, উম্মে সালামার সৌভাগ্য হয়েছিল ফেরেস্তা জিব্রাইলকে দেখার, কারণ তিনি (জিব্রাইল) নিজেকে সাধারণত এমনভাবে প্রকাশ করতেন যে, শুধুমাত্র মুহাম্মদই তাকে দেখতে পেতেন। শুধু উম্মে সালামাই সেইদিন ভাগ্যবতী ছিলেন তা নয়, নিকটবর্তী নাজ্জার গ্রামের ( Najjar village) যোদ্ধারাও জিব্রাইলকে সেদিন দেখতে পেয়েছিলেন। দিহইয়ার মতো দেখতে সুদর্শন যুবক তাদের বলেছিল যুদ্ধের সরঞ্জাম নিয়ে তৈরি হতে এবং মুহাম্মদের কাছ থেকে আরও নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে, যিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কাছে এসে পৌঁছাবেন (৩)।
মুহাম্মদ ঘোড়ায় চড়ে এবং অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে গ্রামে পৌঁছলেন, যেখানে যুদ্ধে সক্ষম সকল পুরুষরা একত্রিত হয়েছে। তিনি তাদের সামনে ঘোড়া থামিয়ে বললেন, “কাউকে কি তোমাদের পাশ দিয়ে যেতে দেখেছ”? তারা বলল, “হ্যাঁ, দিহইয়া আল কালবি একটা খচ্চরের উপর চড়ে যাচ্ছিল। মুহাম্মদ তাদের চমকে দিলেন এই বলে যে, “সে ছিল জিব্রাইল; তাকে বানু কুরাইযা গোত্রে পাঠানো হয়েছে তাদের মনে কম্পন ধরানো ও তাদের ভেতর ভয়ের সঞ্চার করার জন্য (৪,৫)। মুহাম্মদ নাজ্জার যোদ্ধাদের বানু কুরাইযা অঞ্চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। মুহাম্মদ নিজেও তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে অশ্বের গতিতে এগিয়ে গেলেন। তার সাথে তখন ছিল তার তিন ডজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি (৬)। বলা যেতে পারে একটি তারকা খচিত দল যার মধ্যে ছিলেন চারজন ভবিষ্যৎ খলিফা - আবু বকর, উমর, ওসমান এবং আলী; এবং আউস নেতা সাদ বিন মুয়ায যার হাতে তীরের ক্ষত থাকা সত্ত্বেও তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। আরো সাথে ছিলেন মুহাম্মদের প্রথম চাচাতো ভাই জুবায়ের (Zubayr) ও সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, মাসলামা যিনি ইহুদি কবি কাব বিন আশরাফকে হত্যা করেছিলেন। ছিলেন আবু নায়লা, সেই আততায়ী দলের অন্যতম সদস্য যারা কাব বিন আশরাফকে হত্যা করেছিল। ছিলেন তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (৭) যিনি মক্কার প্রথম দিককার ধর্মান্তরিত; আবু বকরের চাচাতো ভাই যিনি উহুদে মুহাম্মদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি আঙ্গুল হারিয়েছিলেন; আবু উবাইদা মক্কী ধর্মান্তরিত যিনি উহুদে মুহাম্মদের মুখ থেকে রক্ত চেটে খেয়েছিলেন এবং মুহাম্মদের গাল থেকে লোহার খন্ড বের করে আনার সময় দাঁত হারিয়েছিলেন; ছিলেন অপমানিত খাজরাজ নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের ছেলে আবদুল্লাহ; বদরে নিহত মক্কাবাসী নেতা উতবা ইবনে রাবিয়ার ছেলে আবু হুযাইফা সহ আরও কুড়ি বা ততোধিক উল্লেখযোগ্য যোদ্ধারা তার এই দলে ছিলেন যারা সকলেই বদর ও উহুদের গর্বিত যোদ্ধা।
শক্তিশালী ঘোড়সওয়ার দিয়ে ঢাল, তলোয়ার, ও বর্শা নিয়ে তারা মুহাম্মদের চারপাশে একটি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন প্রহরীদল গঠন করা হলো। মুহাম্মদ আলী এবং প্রহরীদের একটি অংশকে অগ্রে পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে। আলী সেখানে পৌঁছেই ইহুদি দুর্গের অদুরে একটি কুয়োর গায়ে যুদ্ধ-ব্যানার সাঁটিয়ে দিলেন। ইহুদিরা আলীকে দেখতে পেয়েই বুঝে গিয়েছিল যে, যুদ্ধ শুরু হবে। বানু কুরাইযার লোকেরা জানত যে, অবরোধ শুরু হতে যাচ্ছে সুতরাং তারা মুহাম্মদের সাহাবিদের উদেশ্যে অপমানজনক কথা এবং বিভিন্ন হুমকিধামকি ও চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করে। তারা মুহাম্মদ ও তার স্ত্রীদের অপমান করেও কথা বলছিল। সেসব শুনে মুমিনদের (ইসলামে বিশ্বাসী) মধ্য হতে একজন চিৎকার করে বলল, “হে আল্লাহর শত্রুরা! অনাহারে তোমরা মারা না যাওয়া পর্যন্ত আমরা দুর্গ ছেড়ে যাব না” (৮)।
পরবর্তী
কয়েক ঘন্টার মধ্যে মুহাম্মদের
শত শত যোদ্ধারা অকুস্থলে পৌঁছে
যায় এবং শীঘ্রই মোট তিন হাজার
যোদ্ধাকে সশস্ত্র যুদ্ধ
(জিহাদ)
করার
জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
যখন মুহাম্মদ ও তার অশ্বারোহী
প্রহরীরা সেখানে পৌঁছে গেল
তখন ইহুদি সৈন্যরা তাকে নিশানা
করে তীর ছুঁড়ল,
কিন্তু
সে তীর মুহাম্মদকে ছুঁতে পারল
না, কারণ
তিনি অনেক দুরে ছিলেন। তিনি
তার লাল রঙের তাঁবুটি কুয়োর
কাছে স্থাপন করলেন যেখান থেকে
তিনি বানু কুরাইযার দুর্গ
দেখতে পেতেন,
কিন্তু
সেটি বানু কুরাইযা যোদ্ধারের
তীরের নিশানার বাইরে ছিল।
যখন আলী মুহাম্মদকে বললেন যে
ইহুদিরা মুহাম্মদকে অপমান
করেছে,
তখন
মুহাম্মদ রেগে চিৎকার করে
বললেন “হে বানর,
শুকর
ও অশুভ উপাসকদের ভাইয়েরা,
তোমরা
কি আমাকে অপমান করেছ?”
(৯)।
ইহুদিরা সমস্বরে অস্বীকার
করে উঠল। দুর্গের চারপাশে
অবস্থান নেবার আগে মুহাম্মদের
সৈন্যরা দেখিয়ে দেখিয়ে
নামাজের জন্য জড়ো হলো এবং
কোরআনের আয়াত পাঠ করল। নামাজ
শেষ হবার পরেই মুহাম্মদ ৫০
জন তীরন্দাজকে তাদের উদেশ্য
করে তীর ছুঁড়তে পাঠালেন।
ইহুদিরাও পাল্টা তীর ছুঁড়ল।
এই তীর ছোঁড়াছুড়ি চলতে থাকে
রাতের অন্ধকার নেমে না আসা
অবধি। ততক্ষণে একটি খাজরাজী
বাগান থেকে এক খেজুর বাগানের
মালিক তাদের জন্য কিছু খেজুর
পাঠায়,
এবং
মুহাম্মদের যোদ্ধারা সেগুলো
খেয়ে রাত পার করে। পরদিন
সকালে অবরোধ আবার শুরু হয়
এবং তিন সপ্তাহ ধরে এই অবরোধ
চলতে থাকে।
ইহুদিরা একটি হতাশাজনক পরিস্থিতিতে ছিল। তারা ভালোভাবে সবকিছু নিয়ে প্রস্তুত ছিল না। মুহাম্মদের সৈন্যরা সংখ্যায় তাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল, এবং এটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র যে, হয় তারা অনাহারে মরবে নয়তো আত্মসমৰ্পণ করবে। অবরোধের কুড়ি দিনের মাথায় তারা তাদের মধ্যে থেকে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি নাব্বাশকে (Nabbash) আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে পাঠান এই শর্তে যে, মুহাম্মদ যেন তাদের চলে যাওয়ার অনুমতি দেয়, ঠিক যেমন তিনি অনুমতি দিয়েছিলেন কাইনুকা এবং বানু নাযীর গোত্রকে।
মুহাম্মদ
তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করলেন। যখন নাব্বাশ দুঃসংবাদ
নিয়ে দুর্গে ফিরে আসেন,
তখন
কাব বিন আসাদ সহ অন্যান্য
নেতারা বিভিন্ন বিকল্প অপশন
বিবেচনা করতে লাগল। আর মধ্যে
ছিল মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ
করে তলোয়ারের নিচ থেকে রক্ষা
পাওয়া। যদি তারা মুহাম্মদকে
নবী হিসেবে মেনে নেয় তবেই
বাঁচতে পারবে,
এমন
একটি প্রস্তাব দেয়া হলো।
কিন্তু কুরাইযার লোকেরা এই
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল।
তারা তাদের পূর্বপুরুষদের
প্রতি বিশ্বস্ত হয়ে মরতে
রাজি আছেন,
তবুও
মুহাম্মদ নিজের সম্পর্কে যা
দাবি করেছে তাতে বিশ্বাস
স্থাপন করতে তাঁরা নারাজ।
তাঁরা হতাশ ছিল। একটি ঘটনার
মাধ্যমে তাদের হতাশার গভীরতা
বোঝা যায়। ঘটনাটি এমন :
কাব
বিন আসাদ পরামর্শ দিয়েছেন
যে, রোমানদের
দ্বারা জেরুজালেমে ধ্বংসযজ্ঞ
চালানোর পর মাসাদার পাহাড়ের
(fortress of
Masada) চুড়ায়
ইহুদি বিদ্রোহেরা যা করেছিল
তারাও তা করতে পারে। বিদ্রোহী
ইহুদিরা তাদের শত্রুদের
(রোমানদের)
হাতে
একজন একজন করে মৃত্যুবরণের
মাধ্যমে রোমানদের তৃপ্তি
দেয়ার চেয়ে বরং গণ-আত্মহত্যার
সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কাব
বললেন,
“আসুন
আমরা আমাদের সন্তানদের ও
আমাদের নারীদের আগে হত্যা
করি এবং তারপর আমাদের তলোয়ার
নিচু করে মুহাম্মদ ও তার
অনুসারীদের কাছে যাই। তাহলে
আর আমাদের পেছনে কোন দায়িত্ব
থাকবে না,
পিছুটানও
থাকবে না এবং ঈশ্বরই তখন আমাদের
মাঝে ও মুহাম্মদের মাঝে
সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি আমরা
ধ্বংস হয়ে যাই,
তাহলে
আমরা ধ্বংস হয়ে যাব কোন সমস্যা
নেই; কিন্তু
আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা
করার জন্য কোন পরিবার বা সন্তান
আমরা রেখে যাবো না। আর যদি
আমরা বিজয়ী হয়ে যাই,
তাহলে
আমরা অবশ্যই অন্য নারী লাভ
করব এবং শিশুদের জন্ম দিতে
পারব। কিন্তু অন্যান্য ইহুদি
নেতারা এই বিকল্পটাকে ভালোভাবে
নিল না,
তারা
বলল: “আমরা
কি এই হতভাগাদের মেরে ফেলব?
তাদের
মেরে ফেলে আমরা বেঁচে থেকেই
বা কি করব?"
(১০)
তাদের এই আলোচনা দুর্গের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল; এমনকি সাহসী পুরুষরাও তা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠল এবং নারী ও শিশুরা কাঁদতে লাগল। নেতারা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয় যে, একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজেদেরকে মুহাম্মদের কাছে দয়া ভিক্ষার জন্য আত্মসমর্পণ করা, কিন্তু এটি একজন বিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে করলে ভালো হবে, যিনি তাদের পক্ষ হয়ে সুপারিশ করতে পারেন। তারা মুহাম্মদের কাছে বার্তা পাঠালো যে, তারা আব্দুল মুনযিরের (Abdul Mundhir) সাথে কথা বলতে চান যিনি আউস গোত্রের প্রাক্তন মিত্র, যার ডাক নাম ছিল আবু লুবাবা (Abu Lubaba)। মুহাম্মদ তাকে ইহুদি দুর্গে যেতে দিলেন এবং যখন তিনি দুর্গে ঢুকলেন তখন ইহুদি নেতারা লাফ দিয়ে উঠে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। নারী ও শিশুরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। তিনি ছিলেন তাদের শেষ ভরসা। তিনি গভীরভাবে আপ্লুত হলেন, কিন্তু তিনি এ-ও জানতেন যে, তিনি তাদের জন্য কিছুই করতে পারবেন না। যখন ইহুদিরা তাকে জিজ্ঞেস করল যে তারা কি মুহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে কিনা, তখন তিনি বলেন যে, তাদের তাই করা উচিত। এছাড়া একমাত্র বিকল্প ছিল অনাহারের কষ্ট ভোগ করে বেদনাদায়ক মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া। তারা জিজ্ঞেস করল, মুহাম্মদের কাছ থেকে কি ধরনের আচরণ আশা করা যায়? আবু লুবাবা তার আঙ্গুল দিয়ে গলা চেপে ধরে ইঙ্গিত দিলেন।
ইসলামিক
গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে,
আবু
লুবাবা তাদের সাথে সৌজন্য
সাক্ষাৎ করার পর ভয় এবং অনুতাপে
আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। মুহাম্মদ
স্পষ্টতই পরিষ্কার করে
দিয়েছিলেন যে,
তিনি
ইহুদিদের সাথে কী করার পরিকল্পনা
করেছিলেন তা আঙ্গুল দিয়ে
গলা চেপে ধরে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে
দেয়ার মাধ্যমে আসলে আবু
লুবাবা তাদের কাছে মুহাম্মদের
উদ্দেশ্যই ফাঁস করেছিলেন।
এটুকু দেখানোই মুহাম্মদের
কাছে বিদেশি শত্রুর কাছে
রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস
করে দেবার বিষয় হতে পারে এবং
এ কারণে আবু লুবাবা বিশ্বাসঘাতকতার
শাস্তির (শিরোচ্ছেদ)
সম্মুখীন
হতে পারেন। আবু লুবাবা নিশ্চিত
ছিলেন যে,
তিনি
মুহাম্মদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
করেছেন,
এবং
এখন তিনিই ভয় পাচ্ছেন যে,
তাকেও
হয়তো বানু কুরাইযা গোত্রবাসীর
মতই ভাগ্যবরণ করতে হবে!
সুতরাং
মুহাম্মদের কাছে ফিরে এসে
বিস্তারিত জানানোর পরিবর্তে
তিনি প্রচণ্ড আতঙ্ক নিয়ে
মদিনার প্রধান মসজিদে পালিয়ে
যান এবং সেখানে তিনি একজনকে
দিয়ে তাঁর নিজের দেহকে একটি
স্তম্ভের সাথে বেঁধে রাখতে
বলেন। এরপর তিনি জানিয়ে দিলেন
যে, যতক্ষণ
না আল্লাহ তাঁর জঘন্য
বিশ্বাসঘাতকতাকে ক্ষমা করে
দিচ্ছেন,
ততক্ষণ
তিনি মুক্তি চাইবেন না!
(১১)।
[বানর ও শুকরের ভাইয়েরা! ইহুদি গোত্র তার ধর্মে যোগ দিতে অস্বীকার করলে এবং তাকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে তিনি এই অপমানসুচক কথাবার্তা বলে তাদের দুর্গ অবরোধ শুরু করেন। অবরোধ তিন সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং তাদের আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে শেষ হয়। তারা মুহাম্মদকে তাদের ইয়াছরিব থেকে চলে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দেয়ার জন্য আহবান করে, কিন্তু তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান এবং সমস্ত পুরুষ ও ছেলেদের হত্যা করেন।]
ইহুদিরা
পরদিন হাল ছেড়ে দিল। তাঁরা
বুঝতে পারল যে,
তাদের
জন্য সবচেয়ে করুণ পরিণতিই
অপেক্ষা করছে। যখন ইহুদিরা
তাদের দুর্গ থেকে বের হয়ে
আসছিল তখন তাদের হাত বাঁধা
ছিল। তাদেরকে উত্তপ্ত রোদে
দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা
হল। মুহাম্মদের তাঁবুর ভেতরে
অনুষ্ঠিত সভায় আউস গোত্রের
কিছু নেতা তাকে তাদের প্রাক্তন
মিত্রদের সাথে কিছুটা নমনীয়
আচরণ করার জন্য অনুরোধ করেন।
তারা যুক্তি দেখান যে,
বানু
কুরাইযা নবীর বিরুদ্ধে অবস্থান
নেয়ার জন্য অনুতপ্ত। তাছাড়া
বানু নাযীর নেতা হুয়াই ইবনে
আখতাব মুহাম্মদকে বানু নাযীর
গোত্রের জন্য সুপারিশ করেছিলেন
যার ফলে তিনি বানু কাইনুকা ও
বানু নাযীরের প্রতি কিছুটা
নমনীয় ছিলেন,
সুতরাং
তিনি হয়তো এবারও বানু কুরাইযার
প্রতি সমান দয়ালু হবেন।
তাদেরকে হয়তো তিনি ইয়াছরিব
থেকে বিতাড়িত করবেন,
ঠিক
যেমন তিনি অন্যদের বেলায়
করেছেন। মুহাম্মদ এমন চাপ
অনুভব করছিলেন যে,
নিজের
কাঁধ থেকে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব
সরানোর একটি উপায় খুঁজছিলেন,
তবে
তিনি তার মনমতো ফলাফলই পেতে
চাচ্ছিলেন। আর তাই,
তিনি
আউসদের মধ্যে থেকেই একজনকে
বানু কুরাইযার ভাগ্য নির্ধারণ
করার প্রস্তাব করে বসেন।
যখন
তারা রাজি হলেন,
তিনি
সাদ বিন মুয়াযকে বেছে দিলেন।
সাদের ততক্ষণে খন্দকের যুদ্ধের
সময় বিদ্ধ হওয়া তীরের আঘাতের
ক্ষতে প্রায় মরেই যাচ্ছে
অবস্থা!
তীরটি
তার কব্জির ঠিক উপরে আঘাত
করেছিল,
এবং
মুহাম্মদ একটি গরম লোহার রড
তার ক্ষতের উপর ধরেছিলেন। সে
সময়ে তলোয়ার এবং তীরের
ক্ষতের জন্য এই পদ্ধতিটিকে
আদর্শ চিকিৎসা বলে মনে করা
হতো। মনে হচ্ছিল যে,
তার
হাত আরোগ্য লাভ করছে। সাদ সেই
অশ্বারোহীদের মধ্যে ছিলেন
যারা মুহাম্মদের সাথে বানু
কুরাইযার উপর হামলার জন্য
এসেছিল,
কিন্তু
অবরোধের সময় তার হাত ফুলে
গিয়েছিল,
সে
কোনো কিছু করতেও অক্ষম ছিল।
সে ছিল একজন লম্বা,
শক্ত
পেশীর অধিকারী,
যার
গায়ে ষাঁড়ের মতো শক্তি ছিল।
যখন মুহাম্মদ বুঝতে পারলেন
যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে
এবং তিনি মারা যাবেন,
তখন
মুহাম্মদ তাকে প্রধান মসজিদে
পাঠিয়ে দিলেন যাতে সে সেবা-শুশুষা
পেতে পারে। রুফায়দা (Rufayda)
নামের
একজন নারীকে উঠানে একটি তাঁবু
স্থাপন করে জোটবাহিনীর হামলার
সময়ে আহতদের এবং এখন বানু
কুরাইযার হামলায় আহতদের
পরিচর্যা করার জন্য রাখা হয়।
মুহাম্মদ যখন বানু কুরাইযার
ভাগ্য নির্ধারণের জন্য সাদের
নাম বললেন তখন তার গোত্রের
লোকেরা তাকে ধরে ধরে মসজিদ
থেকে বের করল এবং তারা তাকে
একটা গাধার উপর চড়িয়ে এবং
উপত্যকার পথ দিয়ে নিয়ে
আসলো।
সাদ প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিল। সে নিজেকে সোজা ধরে রাখতে পারছে না। সে যখন সেখানে পৌঁছল তখন তার গোত্রবাসীরা উঠে দু'পাশে দাঁড়িয়ে সারি তৈরি করল যাতে সে মাঝখান দিয়ে যেতে পারে। মুহাম্মদ সেই সারির শেষের মাথায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাকে শুভেচ্ছা জানালেন। আউস নেতা সত্যিকারের বিশ্বাসীদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিল। সে ইয়াছরিবী ধর্মান্তরিতদের মধ্যে প্রথমদের একজন ছিল, এবং গোত্রের নেতা হিসেবে সে তার লোকেদেরও এই দলে (ইসলামে) নিয়ে এসেছিল। সে বদরে মুহাম্মদের সাথে ছিল এবং তাকে বিশাল মক্কাবাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিল। উহুদে পরাজয়ের রাতে সে মুহাম্মদকে পাহারা দিয়েছিল, তার দরজার সামনে ঘুমিয়ে ছিল। সে ধীরস্থির এবং নির্ভরযোগ্য ছিল। তদুপরি সে পৌত্তলিক-বিরোধী আন্দোলনকারী ছিল, এবং ছিল একজন ভালো পরামর্শদাতা। যখন পাহারা দেয়ার (মুহাম্মদকে) দরকার হতো তখন সে হয়ে যেত একজন দক্ষ প্রহরী, একইসাথে যুদ্ধের (জিহাদের) সময়ে একজন যোদ্ধা, এবং গলা কাটার প্রয়োজন হলে গলা কাটার জন্য একজন স্বেচ্ছাসেবক! মুহাম্মদ ঘটনাস্থলে আসার আগে সে বনু বানু কুরাইযার প্রতিবেশী এবং বিশ্বস্ত মিত্র ছিল।
সে
তাদের রাব্বিদের চিনত এবং
সবসময় তারা তাকে সম্মান
জানাত। কিন্তু এই ইহুদিরা
মুহাম্মদকে তাদের নবী হিসেবে
গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে
এবং সাদ যখন মুহাম্মদের বিরুদ্ধে
জোটে যোগ দেয়া থেকে তাদের
বিরত রাখতে গেল তখন তাঁরা তাকে
অপমান করেছে। সুতরাং এরা হচ্ছে
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শত্রু
(সাদের
চোখে) এবং
তাদের জন্য জাহান্নামের জায়গা
নির্ধারিত। সাদ একবার বলেছিল,
“অন্য
সব মানুষের চেয়ে আল্লাহর
রাসুলকে বিশ্বাস করতে
অস্বীকারকারীদের সাথে যুদ্ধ
করতেই আমি বেশি আগ্রহী” (১২)।
সাদ জানত, মুহাম্মদ আসলে তার কাছে কী সিদ্ধান্ত চাইছেন, সুতরাং মুহাম্মদ যা চেয়েছিলেন সে-ও তাই-ই চাইল। সাদ যখন পথ ধরে যাচ্ছিল তখন তার গোত্রের লোকেরা তাকে অনুরোধ করল সে যেন সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে নমনীয় হয়, দয়া দেখায়। এমনকি গোত্রের একজন তো বললেন : “আপনার পুরাতন বন্ধুদের দয়ার সাথে মোকাবেলা করুন, কারণ রাসুল আপনাকে সেই উদ্দেশ্যেই সিদ্ধান্তদাতা বানিয়েছেন” (১৩)।
কিন্তু
সাদ পুরনো দিনের পাথরের মূর্তির
মতই অনড় ছিল। জনবহুল সৈন্যভর্তি
তাঁবুর ভেতরে গোত্রের সব
লোকেরা উপস্থিত ছিল। সাদ
সেখানে তাদের এবং মুহাম্মদকে
জিজ্ঞেস করে যে,
তার
সিদ্ধান্তই কী সবার উপর
বাধ্যতামূলক হবে কিনা?
যখন
খাজরাজ ও আউসের বিভিন্ন শেখগণ
এবং সবশেষে মুহাম্মদ যখন বললেন
যে, “হ্যাঁ”,
সাদ
তখন ঘোষণা করলঃ “তাহলে আমি
হুকুম করছি যে,
তাদের
মধ্যে সকল পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করা হবে”। এরপর সে
নারী ও শিশুদের দাসদাসী হিসেবে
বিক্রি করে দেয়ার আদেশ দেয়
এবং তাদের সমস্ত সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করে গনিমত হিসেবে
বিতরণ করার নির্দেশনা দেয়
(১৪)।
এই আদেশ শুনে মুহাম্মদের
মুখমন্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল
এবং এমন সিদ্ধান্তের জন্য
সাদকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন
: “নিশ্চিতভাবেই
তুমি সাত আসমানের উপরে থাকা
আল্লাহ্র রায়ের মতোই রায়
দিয়েছ”(১৫)।
রায় ঘোষণার পর বানু কুরাইযার বন্দিদের একত্রিত করে বেঁধে ইয়াছরিবের কেন্দ্রস্থলের নিকটবর্তী একটি দুর্গের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় এক হাজার নারী ও শিশুকে মসজিদের কাছাকাছি একটি প্রাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হলো। ইহুদি দুর্গ এবং তাদের এলাকার অন্যান্য সম্পত্তিগুলো ভবিষ্যতে গনিমতের মাল হিসেবে বিতরণের জন্য একত্রিত করে রাখা হলো। মূল দুর্গের ভেতর তাঁরা (মুমিনরা) ১৫০০ তলোয়ার, ৩০০ বর্ম, ১০০০ বল্লম এবং ১৫০০ ঢাল খুঁজে পায়। বাসস্থানে কারুকাজ করা আসবাবপত্র এবং রূপার পাত্র পায়। বিজয়ীরা এছাড়াও মদ সম্বলিত মদের জার খুঁজে পায়। মদগুলো ফেলে দেয়া হয়, কিন্তু বিশাল পাত্রগুলো গনিমতের মালের জন্য রাখা হয়। এছাড়াও বানু কুরাইযা অঞ্চলের জায়গাজমি ছিল তাদের অন্যতম প্রাপ্তি। তাদের খামার, বাড়ি, গ্রাম, যবের ক্ষেত এবং খেজুর বাগান; এবং কয়েক প্রজন্মের সঞ্চিত সম্পদ সবই এখন মুহাম্মদের সাহাবিদের দখলে।
যখন
মুহাম্মদ মসজিদে ফিরে আসেন
তখন নাজ্জারদের প্রধান বাজারে
একটি গর্ত খননের আদেশ দেন যা
ছিল বেশ দীর্ঘ,
যথেষ্ট
গভীর এবং সকল অভিযুক্ত মানুষের
মৃতদেহ রাখার জন্য যথেষ্ট
চওড়া। ঐ বাজারের একটি খাবারের
দোকানে তিনি সকালের নাস্তা
করার পরই এই খনন কাজ শুরু হয়
(১৬)।
খনন কাজ শেষ হয় বিকেলের আগে
আগেই। তিনি সাধারণত যেভাবে
তার 'বিশিষ্ট
সাহাবিদের'
দ্বারা
সৃষ্ট ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা-পরিমণ্ডলে
বসেন সেভাবেই তখনো বসে ছিলেন
ঠিক যেমনটা ওয়াকিদি (Waqidi)
লিখেছেন
যে, মুহাম্মদ
“এরপর বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর করার জন্য তাদেরকে
কারাগার থেকে বের করে আনার
নির্দেশ দেন”। বানু কুরাইযা
গোত্রের লোকেরা প্রার্থনা
করে, তওরাত
আবৃত্তি করে এবং একে অপরকে
তাদের বিশ্বাসের মধ্যে শক্তি
খুঁজে পেতে উৎসাহিত করার মধ্য
দিয়ে নির্ঘুম রাত পার করে।
যখন তাদের হত্যাকাণ্ডের সময়
ঘনিয়ে এলো তখন মুহাম্মদের
সঙ্গীরা তাদের একবারে পাঁচজন
বা ছয়জন করে করে বের করে আনলো।
হাত বাঁধা অবস্থায় তাদেরকে
বাজারের দিকে আনা হলো এবং আলী
অথবা জুবায়ের তাদের ধরে একে
একে শিরোচ্ছেদ করে ফেলল (১৭)।
বানু
নাযীর নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের
মাথা প্রথমে কাটা হয়। তিনি
একটি দামী লাল রঙের পোশাক
পরেছিলেন এবং শিরোচ্ছেদের
আগেই এটার অনেক জায়গায় তিনি
ছিঁড়ে ফেলেছিলেন যাতে গনিমতের
মাল হিসেবে এর কোন মূল্য না
থাকে। তাকে মুহাম্মদের সামনে
যখন আনা হয়,
মুহাম্মদ
তাকে বিদ্রুপ করে বলেন যে,
আল্লাহ
তাকেই বিজয়ী করেছেন,
ইহুদিদের
নয়। এবং এর মানে হচ্ছে মুহাম্মদ
সত্যের দ্বারা পরিচালিত
হয়েছেন,
আর
ইহুদিরা 'মিথ্যার
পথে' ছিল।
উত্তরে হুয়াই বললেন,
“আপনার
বিরোধিতা করার জন্য নিজের
উপর আমার কোন খেদ নেই” (১৮)।
মুহাম্মদ তাঁকে নিয়ে যাওয়ার
ইঙ্গিত দিলেন। হুয়াইকে খাদের
কিনারায় নিয়ে যাওয়া হলো,
জোর
করে হাঁটু গেড়ে বসানো হলো,
এবং
তার মাথাটা কেটে ফেলা হলো।
যখন বানু কুরাইযার নেতা কাব
বিন আসাদকে সামনে আনা হয়,
মুহাম্মদ
তাঁকে বিদ্রুপ করে বলেন যে,
তুমি
আমাকে গ্রহণ করার সুযোগ
পেয়েছিলে,
শুধু
যদি স্বীকার করে নিতে যে আমিই
প্রকৃত নবী এবং আমার ধর্ম
গ্রহণ করতে তবে বাঁচতে পারতে।
কিন্তু সেটা তুমি করলে না,
আর
এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে!
বানু
কুরাইযার নেতা বললেন,
“যদি
ইহুদিরা তলোয়ারের ভয়ে ধর্ম
গ্রহণ করাকে তিরস্কার না করত,
তাহলে
আমি তোমার অনুসরণ করতাম।
কিন্তু আমার কাছে ইহুদি ধর্মই
ধর্ম”। এই কথা শুনে মুহাম্মদ
তাঁকে হত্যার আদেশ দিয়ে বললেন
: “তাকে
সামনে নিয়ে যাও,
তার
মাথাটা কেটে ফেলো” (১৯)।
নাব্বাশ
নামের একজন ইহুদি নেতা যিনি
মুহাম্মদের কাছ সাথে আত্মসমর্পণ
চুক্তি করতে চেয়ে ব্যর্থ
হয়েছিলেন,
তাকে
খাদের নিয়ে যাবার সময় তিনি
পালিয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি
শুরু করেন। এজন্য তার মুখে
আঘাত করা হয়,
যার
ফলে মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।
নাব্বাশকে আঘাত করার জন্য
মুহাম্মদ তার রক্ষীকে তিরস্কার
করেন। উত্তরে রক্ষী বলল যে,
তার
বন্দী পালানোর চেষ্টা করেছে।
কিন্তু নাব্বাশ বলেছে,
“তওরাতের
কসম, ও
মিথ্যা বলছে!
যদি
আমাকে সে ছেড়ে দিত তাহলে আমি
সেই জায়গায় চলে যেতাম যেখানে
আমার লোকজনকে হত্যা করা হয়েছে
এবং আমিও দেরি না করে তাদের
একজন হতাম”। মুহাম্মদ বন্দিদের
সাথে ভালো ব্যবহার করতে রক্ষীদের
আদেশ দেন। “তাদের বিশ্রাম
নিতে দাও;
তাদের
তৃষ্ণা দূর করতে সময় দাও,
যতক্ষণ
না তারা ঠান্ডা হয়। ততক্ষণে
যারা অবশিষ্ট আছে তাদের মেরে
ফেলো”-
মুহাম্মদ
বললেন
( 20 ) ।
বানু কুরাইযার কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। আত্মসমর্পণের আগে বেশ কয়েকজন ইহুদি এবং তাদের পরিবার দুর্গ থেকে পালিয়ে তাদের ধর্মান্তরের ঘোষণা দিয়ে এই মৃত্যুদণ্ডের থেকে বাঁচতে পেরেছিল। হত্যাকাণ্ডের দিন, মুহাম্মদের এক খালা তাকে অনুরোধ করেছিল তার পরিবারের সদস্যের মতো একজন ইহুদির জীবনটা ভিক্ষা দিতে। মুহাম্মদের খালা চেয়েছিলেন ওই ইহুদিটি তার সুরক্ষার অধীনে আসুক এবং তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, শেষপর্যন্ত তাকে তিনি ধর্মান্তরিত করে ফেলবেন। তাই তাকে না মেরে মুহাম্মদ তাঁর খালাকে বললেন, “সে আপনার জন্য”। আরেকজনকে মুহাম্মদ ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন যিনি একজন বৃদ্ধ রাব্বি ছিলেন, যিনি ক্ষীণদৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। কিন্তু এই বৃদ্ধ চেয়েছিলেন তার লোকদের সাথে তাকেও যেন হত্যা করা হয়; তাই তাকেও হত্যা করা হয়েছিল। এই বৃদ্ধ রাব্বি এক দশকেরও বেশি সময় আগে আন্তঃউপজাতীয় যুদ্ধের সময় আউস গোত্রের এক ধর্মান্ধরিতের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।
আউসের
ধর্মান্তরিত ব্যক্তিটি এই
ইহুদি রাব্বির কাছে ঋণী ছিলেন
এবং তাই তিনি মুহাম্মদের কাছে
তার জীবন ভিক্ষা চান,
এবং
তিনি তাকে তার সুরক্ষার আওতায়
আসার অনুমতি দেয়ার জন্য
মুহাম্মদের কাছে আবেদন করেন,
কিন্তু
বৃদ্ধ রাব্বি তার পরিবর্তে
তার স্ত্রী,
পুত্র
এবং তার সম্পত্তি তার (ধর্মান্তরিত
সেই মুসলিমের)
সুরক্ষার
অধীনে নিতে বললেন। এই বৃদ্ধলোকটি
বাকি ইহুদিদের সাথে মরতে রাজি
হলেন, তবে
তার বিনিময়ে তার ছেলের জীবন
ভিক্ষা চাইলেন। মুহাম্মদ
তাতে রাজি হলেন। তখন বৃদ্ধ
লোকটি জুবায়েরের কাছে গেলেন
এবং হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন।
জুবায়ের তার মাথায় তরবারির
আঘাত করে তা আলাদা করে দিল।
এই
সময়ে কুরাইযার এক তরুণীর
শিরোচ্ছেদ করা হয়। দুর্গ
অবরোধের সময়ে মুহাম্মদের
এক সদস্য উপর থেকে ছুঁড়ে
দেয়া পাথরের আঘাতে নিহত
হয়েছিল। বানু কুরাইযার
আত্মসমর্পণের পর জানা যায়
যে, কাজটি
(পাথর
ছুঁড়ে মারা)
এই
তরুণী করেছিল। তার নাম ধরে
ডাকা হলো। সে এলো। যখন তাকে
গর্তের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছিল,
তখন
সে উন্মাদের মত হাসছিল (২১)।
বয়োসন্ধিতে পা দেয়া সব
ছেলেগুলোকে হত্যা করা হয়।
যদি তাদের বয়স সম্পর্কে মনে
কোন প্রশ্ন জাগত,
তবে
তাদের নিমাঙ্গের চুল (Pubic
hair) পরীক্ষা
করা হতো। যদি সঠিক মনে হতো
তাহলে তাদের পাঠানো হত (শিরোচ্ছেদ
করার জন্য)।
যে সমস্ত লোকেরা দামি বা ভালো
পোশাক পরিধিত ছিল যেগুলো
সংরক্ষণযোগ্য ছিল,
তাদেরকে
বাধ্য করা হয়েছিল কাপড় খুলে
ফেলতে,
তাই
তাদের মধ্যে কেউ কেউ নগ্ন
অবস্থায় নিহত হয়।
যদিও ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থে এটির উল্লেখ করা হয়নি, তবে সম্ভবত তখন মুহাম্মদের মিম্বারটি মসজিদ থেকে সরিয়ে বাজারে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। শিরোশ্ছেদের প্রাথমিক বর্ণনাগুলোর মধ্যে একটি থেকে বোঝা যায় যে, মুহাম্মদ মিম্বারে বসে বসে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন। কর্তৃত্ব দেখানোর জন্য হয়তো তিনি তার মিম্বারটি হত্যা করার স্থানে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অথবা কর্মীদের উৎসাহ দেয়ার জন্যেও মুহাম্মদ এমনটি করতে পারেন, যেহেতু শিরোশ্ছেদের ঘটনা রাত পর্যন্ত চলে। এটা একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ ছিল। ইসলামের আদিগ্রন্থে বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ পাওয়া যায় - কোথাও সংখ্যাটা চারশো থেকে নয়শত পুরুষ এবং বালক ছিল। প্রতি মিনিটে যদি একটি শিরোশ্ছেদ হয়, তাহলে চারশো মানুষকে হত্যা করতে সময় লাগবে সাত ঘন্টা এবং নয়শোত হলে সাত ঘন্টার দ্বিগুণেরও বেশি সময় লেগেছিল (২২)। মুহাম্মদের সাহাবিরা সমাবেশে আসা ভলান্টিয়ারদের মতো দক্ষতার সাথেই তাদের কাজ সম্পাদন করেছিল। প্রতি পাঁচ মিনিটে পাঁচজন বা ছয়জন পুরুষকে জেলখানা থেকে বের করে তাদের বাজারে নিয়ে যাওয়া হতো। একবার তারা গর্তের কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসলে আলী আর জুবায়ের তাড়াতাড়ি মাথাটা কেটে ফেলত। সহকারীরা ধড়গুলোকে এমনভাবে গর্তে ফেলত যাতে তা সমানভাবে ভর্তি হয়। গর্তের মধ্যে ঘাড়, পা এবং বাহু সবকিছু এমনভাবে ফেলছিল যে, মাঝখানে মাথাগুলো স্যান্ডউইচের মতো ছিল। কোনটার মুখ উপরে, কোনটার মুখ নিচে, কোনটা পাশে, সব কাটা ঘাড় উন্মুক্তভাবে সমান করা ছিল। যদিও পুরুষরা মৃত্যুর মুহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন, কিন্তু তাদের ঘাড় কেটে ফেলার পর পেশিসমূহ শিথিল হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল তারা ঘুমিয়ে আছে, যেন তারা ঘুমাতেই গিয়েছিল।
সম্ভবত
যেটা হয়েছিল যে,
আলী
এবং জুবায়ের তাদের শিকারদের
হয়তো তাদের ঘাড় সামনের দিকে
ঝুঁকতে বলেছিলেন যাতে কল্লা
কাটা তাদের জন্য সহজ হয়। এটা
হয়তো বন্দিদের সুবিধার চেয়ে
নিজেদের কাজকে সহজ করার জন্য
হতে পারে,
যেহেতু
তারা একাধিকবার কোপ দিয়ে
মাথা কাটতে চাননি। যদি তারা
প্রথমবার কল্পাটা ফেলে দিতে
না পারেন তবে তাতে এই ইহুদিরা
ব্যথায় কাঁপাকাঁপি এবং চিৎকার
করতে থাকবে,
তাদেরকে
আবার হাঁটু গেড়ে বসাতে হবে
অথবা শোয়াতে হবে,
যাতে
ঘাড়ে পোচ দেয়ার সময়ে
তলোয়ারটি মাটিতে ঘষা লাগার
কারণে ধার কমে বা ভেঙে না যায়।
অনেক মানুষের শিরোশ্ছেদ করতে
হবে, তাই
নষ্ট করার মতো সময়ও হাতে ছিল
না।
ইসলামের আদি গ্রন্থের কোথাও লেখা নেই তারা যখন শিরোচ্ছেদের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন কোন ইহুদি কেঁদেছে বা তাদের জীবন ভিক্ষা চেয়েছে, অথবা অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। তবে এটা ধরে নেয়া যায় যে, তলোয়ারের নিচে কোপ খাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে তাদের কারো কারো পায়খানা-প্রস্রাব হয়ে থাকবে। যখন তারা খাদের কিনারায় হাঁটু গেড়ে বসে তাদের বাবা, ভাই, ছেলে এবং চাচাদের কর্তিত দেহাবশেষের দিকে তাকিয়েছিল, তখন তারা নিশ্চয়ই শোকে কেঁদেছিল এবং কেউ কেউ অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল।
এটা
পরিষ্কার নয় যে,
মুহাম্মদ
পুরো এই ঘটনার তদারকি করেছেন
কিনা। ওয়াকিদির ভাষ্যমতে,
তিনি
সাদ বিন মুয়াযকে বাদবাকিদের
গলা কাটার দায়িত্ব গ্রহণ
করার আদেশ দিয়ে অন্য কাজে
চলে গিয়েছিলেন। সাদ মৃত্যু-পথযাত্রী
ছিল এবং সেবা নেয়ার তাঁবু
থেকে একটি আবর্জনা বহনকারী
স্ট্রেচারে তাকে বহন করে মসজিদ
প্রাঙ্গণে,
যেখানে
শিরোশ্ছেদ করা হচ্ছিল সেখানে
নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে
সে কোনমতে উঁকি দিয়ে দিয়ে
শিরোচ্ছেদ দেখছিল। মুহাম্মদ
যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকেন
তাহলে তিনি জবাইয়ের শেষের
দিকে আবার ফিরেও এসেছিলেন।
ততক্ষণে অনেক রাত হয়ে গেছে।
বাজারে মশাল জ্বালানো হয়,
এবং
মশালের সেই হলদে আলোয় ডজন
খানেক ইহুদিকে হত্যা করা হয়।
শিরোশ্ছেদের শুরুতে মুহাম্মদ
দেখেছিলেন,
খাজরাজীরা
ইহুদিদের মাথা কেটে ফেলা উপভোগ
করছে,
অন্যদিকে
তাদের (বানু
কুরাইযার ইহুদিদের)
সাবেক
মিত্র আউস গোত্রের মধ্যে
অসন্তোষের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
তাই তিনি এই হত্যাকাণ্ডে তাদের
অংশগ্রহণও বাধ্যতামুলক করার
সিদ্ধান্ত নেন। অবশিষ্ট বারোজন
ইহুদির প্রত্যেকের জন্য দুজন
করে আউসকে একত্রিত করে তিনি
আলী ও জুবায়েরের পরিবর্তে
তাদের শিরোশ্ছেদ করার আদেশ
দেন। কেউ কেউ আগ্রহী ছিল,
কিন্তু
বেশিরভাগই এই কাজে আগ্রহী
ছিল না,
কিন্তু
তাদের বিরুদ্ধে হয়তো অভিযোগ
উঠতে পারে তাই তারা বাদবাকি
ইহুদিদের হত্যা করতে বাধ্য
হয়েছিল (২৩)।
পরদিন সকালে গর্ত ভরাট করা হলো। কাদামাটি দিয়ে আশপাশ থেকে একটু উঁচু স্তুপাকার করা হয়েছিল। গর্তটি দেখতে উঁচু একটি তাজা কবরের মতো মনে হচ্ছিল, এবং অবশেষে মৃতদেহ পচতে থাকার সাথে সাথে কবরের উচ্চতাও নিচের ২৩১
দিকে নামতে থাকে। মৃতদেহের গন্ধ অনেকদিন ধরেই ছিল। গর্ত খননের সময়সীমা ধরলে এটির ঘভীরতা বেশি ছিল না, এবং মিথেন ও অন্যান্য গ্যাস ভেসে বেড়াচ্ছিল। এই দুর্গন্ধ কুয়াশার মতো বাজারের চারিধারের এলাকায় অনেকদিন পর্যন্ত রয়ে গিয়েছিল।
[বানু কুরাইযা গোত্রের ইহুদিদের গণহত্যা। মুহাম্মদ চারশো থেকে নয়শত পুরুষ ও ছেলের শিরোশ্ছেদের তদারকি করেন।
ইসলামের
আদি গ্রন্থ অনুসারে,
তাদের
একবারে পাঁচজন বা ছয়জন করে
বের করে আনা হয় এবং মুহাম্মদের
মসজিদের কাছের বাজারে একটি
গর্তের পাশে হাঁটু গেড়ে বসতে
বাধ্য করা হয়। শিরোশ্ছেদগুলো
বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত
চলে প্রতি মিনিটে একজন করে
হত্যা করা হয়,
যেটা
সাত থেকে পনেরো ঘন্টা ধরে চলে।
মুহাম্মদের প্রথম চাচাতো ভাই
(First cousin) আলী
ও জুবায়ের বেশিরভাগ শিরোশ্ছেদ
করেন।]
যখন হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়, মুহাম্মদ নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করেন এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ তিনি অস্ত্র ও ঘোড়া কেনার জন্য ব্যয় করেন। বেশিরভাগ প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, সাদ বিন মুয়ায এই হত্যাকাণ্ডের পরপরই মারা যান।
বেশ
কিছু সংস্করণে পাওয়া যায়
- প্রতিটির
বিস্তারিত বর্ণনা আছে -
স্কলারদের
সবাই একমত যে,
সাদ
মসজিদ প্রাঙ্গণে চিকিৎসার
তাঁবুতেই মারা যায়। একটি
সংস্করণে দেখা যায়,
মুহাম্মদ
রাতে তার মৃত্যু সম্পর্কে
জানতে পারেন যখন জিব্রাইল
তার কাছে এসে তাকে ঘুম থেকে
জাগিয়ে এই সংবাদটি প্রদান
করেন। এরপর মুহাম্মদ তাঁবুতে
ছুটে গিয়ে তার সঙ্গীকে মৃত
অবস্থায় দেখতে পান। আরেকটি
বর্ণনায় পাওয়া যায়,
সাদ
যখন মারা যায় মুহাম্মদ তার
বিছানার পাশে বসে ছিলেন। তার
মৃত্যুটি দ্রুত ঘটল -
তার
ফোলা হাত বেলুনের মত ফেটে গেল,
সেই
বেলুন ফেটে গিয়ে মুহাম্মদের
মুখে এবং দাড়িতে রক্ত ছিটিয়ে
দিয়েছিল যার ফলে রক্তক্ষরণের
কারণে সাদের মৃত্যু হয়।
তৃতীয় এবং সম্ভাব্য সঠিক
সংস্করণে দেখা যায়,
মুহাম্মদকে
সাদের মৃত্যুর সংবাদটি জিব্রাইল
দেয়নি,
বরং
অন্য একজন দিয়েছে। মুহাম্মদের
বাসস্থানের কাছে মসজিদের
উঠোনের এক কোণে চিকিৎসার
তাঁবুটি টানানো হয়েছিল,
তাই
তাঁবুতে পৌঁছতে মুহাম্মদের
বেশি সময় লাগেনি। তিনি সাদের
জামার ভিতর হাত দিয়ে দেখলেন
যে সে মারা গেছে কিনা,
এবং
যখন এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন
যে সে মারা গেছে,
তখন
মুহাম্মদ তার লাশ দাফনের আদেশ
দিলেন। মৃতদেহটি সাধারণ
কবরস্থানে একটি কাফনের কাপড়ে
মোড়ানো ছিল,
এবং
তার মৃতদেহকে একটি খাটিয়ায়
করে কবরেস্থানে নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল যেখানে তাকে শেষবারের
মতো দেখার জন্য মুমিনদের সামনে
রাখা হয়। এরপর সাদের মৃতদেহ
কবরে নামানো হয় এবং মুহাম্মদ
তার জন্য প্রার্থনা করতে
সবাইকে নির্দেশ দেন (২৪)।
[নারী এবং শিশুরা তাদের প্রিয়জনদের শিরোশ্ছেদের সাক্ষী হয়েছিল। কেউ কেউ, এমনকি সব নারী এবং শিশুদের সেই দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল। বানু কুরাইযা দুর্গ অবরোধের সময়, মুহাম্মদের একজন সৈন্য হত্যার দায়ে এক তরুণীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।]
সবার কবরের কাজ শেষ করে ফেলার পর মুহাম্মদ এখন সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজে, সবাইকে খুশি করতে গনিমতের মাল বিতরণে মনোনিবেশ করেন। জায়গাজমি, গবাদিপশু, লুণ্ঠিত অস্ত্র, এবং মানুষ এই সবকিছুর ভাগ করা তার জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এই লুণ্ঠিত মালের পরিমাণ বানু নাযীর এবং বানু কায়নুকার লুণ্ঠিত মালের চেয়ে অনেক বেশি। এখানে লুণ্ঠিত মাল হিসেবে রয়েছে এক হাজারের অধিক নারী ও শিশু। মুহাম্মদ নিজের জন্য জায়গাজমির একটি অংশ ধরে রাখেন, এবং বাকি অংশটুকু যৌথ মালিকানার সম্পত্তি ভাগ করে দেয়ার মতো করে তিনি আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেন। এরপরও অবশিষ্ট থাকা কিছু মালামাল নিলামে তোলা হয় এবং তার আয় থেকে মুহাম্মদের অংশ কেটে রেখে বাকিটা যোদ্ধাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল তিন হাজার।
নারী ও শিশুদের নিয়ে তিনি জটিল লেনদেনের দেনদরবারে জড়িত হয়ে পড়লেন। কেননা, তাদের তো আর টুকরো করে তিন হাজার পুরুষের মধ্যে বিতরণ করা যাবে না। সুতরাং তাদের অধিকাংশকেই বিক্রি করা হয় এবং বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত অর্থ একজন দায়িত্বশীলের হাতে তুলে দেয়া হয় বিতরণ করার জন্য। মুহাম্মদ বন্দিদের দুইশো করে পাঁচটি অংশে বিভক্ত করেন এবং নিজের জন্য দুইশো দাসী রাখেন। ইসলামিক ঐতিহাসিক গ্রন্থ নির্দেশ করে যে, তিনি অনেককে উপহার হিসেবে দাসী দিয়েছেন অথবা বকেয়া ঋণ নিষ্পত্তি করতে দাসীদের ব্যবহার করেছেন। তিনি তার ধর্মগ্রহণ করতে সম্মত হওয়া কয়েকজনকে মুক্ত করলেন এবং অন্যদের ক্রীতদাসী হিসেবে ধরে রাখলেন। অবশিষ্ট আটশো জনের মধ্যে তার দুই প্রধান ব্যক্তি - ভবিষ্যৎ খলিফা উসমান ইবনে আফফান এবং প্রথমদিকের ধর্মান্তরিত মক্কান আব্দুর রহমান - যারা পুরো অংশ (আটশো দাসদাসী), অথবা একেকজন দুইশোজন ক্রীতদাসী কিনতে সক্ষম ছিলেন। দাসী কেনার ক্ষেত্রে উসমান বয়স্ক নারীদের বেছে নেন, কারণ কমবয়সী নারী ও শিশুদের চেয়ে তাদের মূল্য বেশি ছিল। তারা উভয়ই দক্ষ ব্যবসায়ী ছিলেন। সময়ের সাথে সাথে কেনা দাসদাসী পুনঃবিক্রয়ের মাধ্যমে একটি উল্লেখযোগ্য মুনাফা তাঁরা লাভ করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে দাসী বিক্রি করে যে অর্থ পাওয়া গেছিল তা মাল বন্টনের দায়িত্বপ্রাপ্তের কাছে হস্তান্তর করা হয়, যে অর্থ পরে আবার যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হয়।
তখনও আরও চারশো নারী ও শিশু নিষ্পত্তি করার বিষয় ছিল। মুহাম্মদ তাদের সশস্ত্র প্রহরীর অধীনে উত্তর আরব ও সিরিয়ার ক্রীতদাস বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের বিক্রয় করা থেকে প্রাপ্ত অর্থ অস্ত্র এবং ঘোড়া কেনার জন্য ব্যয় করা হয়, কিন্তু যারা তাদের ন্যায্য অংশ পেতে বানু কুরাইযা আক্রমণে অংশ নেয়, তাদের জন্য ঘোড়া এবং অস্ত্রগুলোকে ইয়াছরিবে পুনরায় বিক্রি করেন। এই বিক্রয় থেকে টাকা তারপর বন্টনের দায়িত্বপ্রাপ্তের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ঘোড়াগুলোর জন্য চড়া মূল্য পাওয়া যাচ্ছিল। ঘোড়ায় বিনিয়োগকে লাভজনক ব্যবসা হিসেবেও দেখা হয়েছে, কারণ ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করলে তাতে সাফল্য বেশি ছিল। আর তাই পায়ে হেঁটে যুদ্ধ করলে যেখানে গনিমতের মালের (Booty) একটি শেয়ার পাওয়া যায় সেখানে চেয়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করলে গনিমতের মালের তিনটি শেয়ার পাওয়া যেত।
মুহাম্মদের ভাগে পড়া বন্দিদের মধ্যে একজন ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী এক নারী, খুব সম্ভবত সে সময় সে কিশোরী ছিল, যার নাম রায়হানা। তার বরর শিরোচ্ছেদ করা হয়েছিল। বানু কুরাইযা আত্মসমর্পণ করে তাদের দুর্গ থেকে বের হয়ে এলে নারীদের বন্দি করে তখনই মুহাম্মদের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল। আল্লাহর রাসুল ও মুমিনদের সেনাপতি হিসেবে মুহাম্মদ প্রথমেই নিজের ভাগের মাল বেছে নিয়েছিলেন। এবং মুহাম্মদকে রায়হানাকে দেখানো হলে সব নারীদের মধ্যে থেকে মুহাম্মদ তাকে বাছাই করে নিলেন। মুহাম্মদ রায়হানাকে প্রস্তাব দিলেন যদি সে তাঁকে বিয়ে করে এবং ইসলাম ধর্মে যোগ দেয়, তাহলে তিনি তাকে মুক্ত করে দেবেন, কিন্তু সে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। বরং সে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিল যে, মালিকানার ব্যাপারে তার কোন পছন্দ নেই, কিন্তু মুহাম্মদের ধর্ম তার অপছন্দ, এবং সে ইহুদিই থাকতে চায়। সুতরাং সে মুহাম্মদের যৌনদাসী হয়ে থাকল এবং মুহাম্মদের স্ত্রীদের কক্ষসমূহের ভেতরে তাকেও একটি কক্ষ দেয়া হলো। ইসলামের আদিগ্রন্থে বলা হয় যে, মুহাম্মদ তার থেকে দূরে থাকতেন, কিন্তু সম্ভবত সত্যি হচ্ছে রায়হানাই তার থেকে দূরে থাকত। মসজিদ থেকে মাত্র একশো গজ দুরে ছিল গণকবর, যেখানে তার বর এবং তার প্রিয়জনের সবাইকে কবর দেয়া হয়েছে যাদেরকে মুহাম্মদ হত্যা করেছিল। এবং মুহাম্মদ যে তাদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার করেছিল ওই কবরগুলোই ছিল তার চিরন্তন স্মারক।
ইসলামিক
গ্রন্থে এ সম্পর্কিত বর্ণনায়
লেখা আছে যে,
একদিন
একজন দাসী মুহাম্মদকে জানায়
যে রায়হানা তার ধর্ম গ্রহণ
করেছে,
এবং
“এই সংবাদে মুহাম্মদ আনন্দিত
হয়েছেন” (২৫)।
গণহত্যার চার বছর পর,
এবং
মুহাম্মদের মৃত্যুর এক বছর
আগে সে মারা যায়। তার মৃত্যুর
কোনো কারণ লেখা পাওয়া যায়
না, কিন্তু
এটা অস্বীকার করা যায় না যে
এটি সম্ভবত দীর্ঘ বিষন্নতার
পরিণতি ছিল। তার বিষন্নতা
ছিল হয়তো তাকে তার প্রিয়জনের
হত্যাকারীর সাথে থাকতে বাধ্য
করার পরিণতি। তার আত্মা হয়তো
আগেই মরে গেছিল,
তারপর
তার শরীরটি মারা যায়।