ইয়াছরিবের
ভেতরে ও বাইরে বিরোধীদের প্রতি
মুহাম্মদের প্রথমদিকের
সহিংসতার মূল উদ্দেশ্য তার
ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য
ছিল না,
বরঞ্চ
তার নিজেকে জীবিত রাখাই ছিল
মূল উদ্দেশ্য। তার ধর্মের
সম্প্রসারণ ছিল তার সহিংসতারই
উপজাত (by
product), এবং
তিনি যত আক্রমণাত্মক হয়ে
ওঠেন এবং যত বেশি বেশি লুণ্ঠন
ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন ততই
তার শত্রু বাড়তে থাকে যারা
তাকে পাল্টা আঘাত করতে উদ্বুদ্ধ
হয়। এদিকে আবার তারা যত বেশি
মুহাম্মদকে পাল্টা আঘাত করতে
উদ্বুদ্ধ হয়,
ততই
মুহাম্মদও তাদের উপর পাল্টা
হামলা চালানোর প্রয়োজনীয়তা
অনুভব করতে থাকেন। তিনি তার
নিজের সৃষ্ট শত্রুদের সক্রিয়
এবং দৃষ্টান্তমূলক সহিংসতার
মাধ্যমে দূরে ঠেলে দিতে সক্ষম
ছিলেন। কাল্পনিক ঈশ্বর তার
সাথে কথা বলেন বলে তার মধ্যে
এক ধরনের বিভ্রমের সৃষ্টি
হয়েছিল,
আর
তাই তার সহিংসতা ছিল প্রতিপক্ষের
চেয়ে বেশি হিংস্র এবং অভিনব।
তিনি তাদের এমনভাবে অভিভূত
করতে সক্ষম হলেন যে,
অবশেষে
মুহাম্মদ নামটিই তাদের মধ্যে
এক আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে। যদিও
তার শত্রুরা তার উপর মাঝেমাঝে
আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিল,
কিন্তু
পরিশেষে তারা তার ধর্ম আলিঙ্গন
করাকেই তাদের বেদনা এবং দুর্দশা
থেকে মুক্তির একমাত্র আশ্রয়স্থল
হিসেবে দেখতে বাধ্য হয়। যত
বেশি মানুষ তার ধর্মে স্বেচ্ছায়
যোগদান করেছে,
তার
থেকে অনেক বেশি মানুষ ধর্মগ্রহণের
মাধ্যমে নিজেদের রক্ষা করতে
চেয়েছিলেন। কারণ,
তিনি
এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন
যে তিনিই একমাত্র নিরাপদ
আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেছিলেন।
আর এইভাবে তার ধর্মটা বিস্তার
লাভ করে।
বানু
কুরাইযার গণহত্যার পর মুহাম্মদের
আর ইয়াছরিব নিয়ে চিন্তা
করার মত কিছুই রইল না। একসময়কার
প্রায় কুড়ি হাজার জনসংখ্যার
ইহুদিদেরকে বিতাড়িত করে এবং
হত্যা করার মাধ্যমে সংখ্যাটা
অর্ধেকে নামিয়ে এনেছিলেন।
অন্যদিকে নতুন ধর্মান্তরিত
এবং সুযোগসন্ধানীদের একটি
দল বিভিন্ন বেদুইন গোত্র থেকে
গনিমতের মালের লোভে তার ধর্ম
গ্রহণে প্রলুব্ধ হয়েছিল।
আউস এবং খাজরাজ গোত্র,
জনসংখ্যার
সিংহভাগই তাদের এবং প্রায়
সবাই ধর্মান্তরিত হয়েছে,
যদিও
অনেকেই শুধুমাত্র নামমাত্র
ধর্মে যোগ দেয় যাতে তারা
নির্যাতন থেকে বাঁচতে পারে।
এই সুরক্ষিত ঘাঁটি – পুরো
ইয়াছরিবই এখন মুহাম্মদের
আল-কায়েদা;
মুহাম্মদ
এর উত্তর,
দক্ষিণ,
পূর্বদিকের
শত্রুদের উপর আসন্ন বছরের
মধ্যেই প্রায় ডজনখানেক হামলা
শুরু করবেন। আগের মতই মুহাম্মদ
লুণ্ঠনের উপর বেশি জোর দিয়েছিলেন,
এবং
যত বেশি হামলা তত বেশিই লুন্ঠিত
মাল। এই ধরনের হামলা থেকে
প্রাপ্ত সম্পত্তিই তার আয়ের
প্রধান উৎস ছিল,
এবং
এগুলো ছিল একধনের শক্তিশালী
গাম বা আঠার মতো যা তার অনুসারীদের
তার সাথে এঁটে থাকতে সাহায্য
করছে। 'লুণ্ঠনের
ঘুষ' ছাড়াও
তিনি তার নিজের সম্পর্কে যা
দাবি করেছেন,
যেই
অলৌকিকতা দাবি করেছেন তার
উপর ভিত্তি করে তিনি হয়তো
খুব বেশি দূর যেতে পারতেন না।
ম্যুর (Muir)
যেমন
বলেছেন,
সমৃদ্ধির
সম্ভাবনাই মুমিনদের মাঝে তার
প্রতি “সক্রিয় সেবার উৎসাহ”
সৃষ্টি করেছে (১),
অন্যথায়
জনমানুষ তার লড়াইয়ের আহ্বান
উপেক্ষা করতেন।
এই
ধরনের বাড়তি আয়ের প্রয়োজনেই
মুহাম্মদের আক্রমণকারীরা
সর্বদা রাস্তায় থাকতেন।
বেশিদিন হয়নি,
বানু
কুরাইযার ইহুদিদের শেষ মৃতদেহের
উপর মাটিচাপা দেয়া শেষ হবার
পরেই তিনি মুহাম্মদ বিন
মাসলামাকে -
যিনি
ইহুদি কবি কাব বিন আশরাফকে
হত্যা করেছিলেন -
একটি
বেদুইন গোত্রকে আক্রমণ এবং
মাল লুণ্ঠনের অভিযানের দায়িত্ব
দিয়েছিলেন। এই গোত্রটি
ইয়াছরিব থেকে ষাট মাইল পূর্বে
মরুভূমির উচ্চভূমিতে ঘোরাফেরা
করত এবং তাদের অসংখ্য গবাদিপশু
ছিল বলে জানা যায়। মাসলামা
ত্রিশজন লোকের এক বাহিনী নিয়ে
রওনা দিলেন এবং তাদের গন্তব্যে
পৌঁছাতে এবং আক্রমণের জন্য
নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নিতে
বেশ কয়েকদিন সময় লেগে
গিয়েছিল। মুহাম্মদ ভোরবেলা
আকস্মিক হামলার কৌশল প্রণয়ন
করেছিলেন। সম্ভবত এটি করেছিলেন
আপাতদৃষ্টিতে তাদের শিকারদের
অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে যে,
তারা
মুসলিম হয়েছে নাকি হয়নি।
যদি তারা ভোরে নামাজ পড়তে বের হত তবে ধরে নেয়া হতো যে, এরা ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে। আর যদি নামাজ না পড়ত বা নামাজের জন্য বের না হতো তার মানে তারা কাফের বা অবিশ্বাসী। সুতরাং মুহাম্মদের প্রেরিত দুষ্কৃতিদের জন্য তারা তখন ন্যায্য খেলনায় পরিণত হয়ে যেত, যার ফলে দুষ্কৃতিরা অবাধে চুরি করতে পারত এবং ইচ্ছেমতো হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারত। এই নীতি অনুসরণ করেই, মাসলামা এবং তার লোকেরা ভোরের আলো ফোটার আগেই বেদুইন শিবির ঘিরে ফেলে, এবং যখন তারা নামাজের প্রার্থনার আহ্বান শুনল না তখন তারা “হত্যা করো, হত্যা করো” বলে চিৎকার করে মরুভূমির মানুষগুলোকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরে ফেলল। নিজেদের রক্ষা করতে লোকগুলি যখন তাদের শিবির থেকে দৌড়ে মরুভূমির চারপাশে দিগ্বিদিগ ছুটছিল, মাসলামা ও তার লোকেরা তাদের যেভাবে পারে হত্যা করছিল। বাকি বেদুইনরা তাদের দেড়শত উট, তিন হাজার ছাগল এবং তাদের সমস্ত তাঁবু ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রেখে পালিয়ে গেল। হামলাকারীরা পরিবহনযোগ্য সবকিছু দখল করে নেয় এবং গবাদি পশুসহ সবকিছু ইয়াছরিবে নিয়ে আসে। মুহাম্মদ সেই লুটের মাল নিজের জন্য কুড়ি শতাংশ রাখেন এবং বাদবাকি সবার মধ্যে ভাগ করে দেন (২)।
প্রায়
একই সময়ে মুহাম্মদ মক্কাবাসীদের
এক কাফেলার উপর হামলা চালান
যে কাফেলাটি লুকিয়ে মুহাম্মদের
অবরোধ করে রাখা লোহিত সাগরের
দিককার পথ পার হতে চেষ্টা
করেছিল। মক্কাবাসী তাদের
অর্থের প্রয়োজনীয়তার কথা
মাথায় রেখে সিরিয়ার বন্দরের
দিকে বা উত্তপ্ত মরুভূমি
পেরিয়ে ইরাকের দিকে ছোট ছোট
কাফেলা পাঠাতে শুরু করে,
তবে
মুহাম্মদের হাতে ধরা পড়া
এড়ানোর জন্য তারা রাতের
অন্ধকারে ভ্রমণ করত। মুহাম্মদ
এমন এক কাফেলার সম্পর্কে জানতে
পেরেছিলেন যেটা সিরিয়া থেকে
ফিরছিলো। তিনি তার প্রাক্তন
পালকপুত্র জায়েদকে প্রধান
করে এই কাফেলাকে আক্রমণ করতে
১৭০ জনের এক বাহিনী পাঠান।
ইয়ানবু ও রাবিগের মধ্যবর্তী
ইয়াছরিবের দক্ষিণের একটি
উপকূলীয় আল-ইস
(Al- Is) নামক
গ্রামে কাফেলাটিকে তারা আটক
করে ফেলেন। আক্রমণকারীরা
(মুহাম্মদী
সেনা)
কাফেলার
উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,
প্রতিরোধকারী
সৈন্যদের হত্যা করে এবং তাদের
মালপত্র বাজেয়াপ্ত করে। উট
এবং কার্গো,
যার
মধ্যে রৌপ্যমুদ্রা,
বাণিজ্য
থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ভর্তি
করা বস্তা ছিল। কিছু মক্কাবাসী
পালিয়ে যায়,
কিন্তু
অন্যদের আটক করা করে ইয়াছরিব
ফিরিয়ে আনা হয় যেখানে তাদের
আবার মুক্তিপণের জন্য আটকে
রাখা হয়।
মুহাম্মদ
আয়েশাকে একজন বন্দির উপর
নজর রাখার আদেশ দেন। তার হাত
তার মাথার পেছনে বাঁধা ছিল,
কিন্তু
আয়েশা যখন আরেকজনের সাথে
কথা বলছিলেন তখন এই বন্দী
নিজের বাঁধন খুলে পালিয়ে
যেতে সক্ষম হয়। এই ঘটনায়
মুহাম্মদ খুবই ক্রুদ্ধ হলেন
এবং বলেন,
“আল্লাহ
যেন তোমার হাত কেটে নেয়!”
মুহাম্মদ
আয়েশার উপর রাগ করে,
চেচামেচি
করে তারপর একটি অনুসন্ধান দল
সংগঠিত করার জন্য ঘরের বাইরে
চলে যান। যখন তিনি ফিরে এলেন,
আয়েশা
যিনি সম্প্রতি দেখেছেন মুহাম্মদ
কিভাবে শত শত ইহুদিদের মাথা
কেটে ফেলেছেন,
ভয়ে
কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল।
সে তার নিজের হাত দেখিয়ে
মুহাম্মদকে বলল,
সে
তার নিজের হাত হারাতে প্রস্তুত
আছে। কিন্তু মুহাম্মদ ইতোমধ্যেই
তার রাগারাগির ঘটনা ভুলে
গেছেন,
তাই
উল্টো জিজ্ঞেস করলেন,
“তোমার
কি হয়েছে?”
যখন
আয়েশা তাকে সেই কথা মনে করিয়ে
দিলেন তখন তিনি আকাশের দিকে
হাত তুলে বললেন,
“হে
আল্লাহ,
আমি
নিশ্চয়ই একজন মানুষ। আমিও
রেগে যাই এবং অন্য যেকোন মানুষের
মতো আমিও আফসোস করি। আমি যে
বিশ্বাসী পুরুষ বা নারীদের
বিরুদ্ধে প্রার্থনা করি,
আমার
সেই বিরুদ্ধ-
প্রার্থনাকে
(বদদোয়া)
আপনি
আশীর্বাদে রূপান্তরিত করুন”
(৩)।
কয়েক
মাস পরে,
খাইবারের
উত্তরে অবস্থিত ইহুদিদের
একটি মরুদ্যান ফাদাকের (Fadak)
একটি
বেদুইন গোত্রের বিরুদ্ধে
অভিযান চালানো হয়,
যেখান
থেকে তিনি ৫০০ উট এবং ১,০০০
ভেড়ার পাল জব্দ করেন। এই
আক্রমণের ঘটনা ঘটে যখন মুহাম্মদের
কাছে খবর আসে যে,
তার
বিরুদ্ধে বেদুইনরা খাইবারের
খেজুর বাগানের বিনিময়ে
খাইবারে বসবাসরত ইহুদিদের
সাহায্য করার ষড়যন্ত্র করছে।
মুহাম্মদ তাদের শায়েস্তা
করতে আলীকে একশো সেনাদলের
নেতৃত্ব দিয়ে পাঠান যেন তাদের
দেখে ভয়ে ওরা আর মুহাম্মদের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ
দিতে সাহস না করে। আলী বেদুইন
শিবিরে পৌঁছানোর আগেই তারা
খবর পেয়ে যায় এবং ততক্ষণে
মরুভূমির সেই বাসিন্দারা
তাদের গবাদিপশু এবং শিবিরের
সরঞ্জাম রেখে পালিয়ে যায়।
আলী সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে
ইয়াছরিবে ফিরে আসেন,
এবং
মুহাম্মদ তার স্বাভাবিক (নিজের
জন্য নির্ধারিত)
এক
পঞ্চমাংশ দখল করে বাদবাকি
আক্রমণকারীদের মধ্য ভাগ করে
দেন(৪)।
এই
সময়ের মধ্যে একমাত্র দখলদারি
অভিযান চালানো হয়েছিল
ইয়াছরিবের পাঁচশো মাইল উত্তরে
সিরিয়ার সীমান্তবর্তী
খ্রিস্টীয় শহর দুমায় (Duma),
এবং
এটি পূর্ব-পশ্চিম
কাফেলা পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ
বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। মক্কাবাসীর
জোট ইয়াছরিবের দিকে সদলবলে
আসার ছয়মাস আগেই মুহাম্মদ
নিজেই অল্প সময়ের মধ্যে শহরটি
দখল করে নেন। সন্দেহভাজন
বাহিনী যাদের মনে হয়েছে যে
তারা মক্কাবাসী বাহিনীর সাথে
যোগ দেয়ার সম্ভবনা আছে তাদের
দলভঙ্গ করার জন্য এই হামলা
চালানো হয়েছিল। এখন উত্তরের
দিকে একটি নতুন জোট গঠিত হচ্ছে
যার মধ্যে রয়েছে ইহুদি,
খ্রিস্টান
এবং আরব পৌত্তলিকরা। দুমা
জয় করার মাধ্যমে মুহাম্মদ
খ্রিস্টানদের তার শত্রুদের
সাথে যোগদান থেকে বিরত রাখতে
চেয়েছিলেন। তিনি আব্দুর
রহমানকে সাতশো লোকের প্রধান
করে দুমার লোকদের বিরুদ্ধে
বিশুদ্ধ জিহাদ করার নির্দেশ
দিয়ে বললেন :
“আল্লাহর
পথে সকলের সাথে যুদ্ধ কর এবং
যারা আল্লাহতে অবিশ্বাস পোষণ
করে তাদেরও হত্যা কর” (৫)।
এই আক্রমণের আগে আব্দুর রহমান
দুমার জনগণকে মুহাম্মদের
ধর্মে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ
জানান,
যদি
তারা প্রত্যাখ্যান করে তাহলে
এর পরিণাম সম্পর্কে তাদের
সতর্ক করে দেন। শহরটিকে চারপাশ
দিয়ে ঘিরে ফেলার পর রহমান
খ্রিস্টান শাসকের কাছে একটি
বার্তা পাঠান যে,
তাদের
ধর্মান্তরিত হবার জন্য তিনদিন
সময় আছে। ধর্মান্তরিত হলে
ভালো, নতুবা
তারা তাদের হাতে তলোয়ার তুলে
নেবে। ঐ বছরের শুরুতে মুহাম্মদ
বানু কুরাইযার ইহুদিদের হত্যা
করেছিলেন যা এই খ্রিস্টানরা
জানত, তাই
এই হুমকিকে তারা গুরুত্বের
সাথেই গ্রহণ করে। তবে ধর্মান্তরিত
হওয়ার পরিবর্তে তারা একটি
পরাধীন (জিজিয়া)
কর
পরিশোধ করার প্রস্তাব করে।
আব্দুর রহমান এই প্রস্তাবটির
কথা জানাতে ইয়াছরিবে এক
বার্তাবাহককে পাঠান এবং
মুহাম্মদ তাদের শাসকের মেয়েকে
বিয়ে করার মাধ্যমে আব্দুর
রহমানকে এই চুক্তি নিষ্পত্তির
আদেশ দিয়ে বার্তাবাহককে
আব্দুর রহমানের কাছে ফেরত
পাঠান। রহমান তার নববধূকে
সঙ্গে নিয়ে ইয়াছরিবে ফিরে
আসেন, সঙ্গে
করে আরো আনেন প্রথম কিস্তির
জিজিয়া কর ।
এই
সময়ের মধ্যে মুহাম্মদ নিজে
দক্ষিণের লিহিয়ান (Lihyan)
গোত্রের
বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা
করেন যারা দুই বছর আগে তারা
মুহাম্মদের দশজন ধর্মপ্রচারককে
হত্যা করেছিল,
এবং
তারই প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।
লিহিয়ানরা নতুন ধর্ম সম্পর্কে
জানতে চাওয়ার অজুহাতে তার
প্রচারকদের প্রলুব্ধ করেছিল,
কিন্তু
এটি ছিল তাদের অন্যতম মিত্র
খালিদ বিন সুফিয়ানের হত্যার
প্রতিশোধ নেয়ার একটি ফাঁদ
মাত্র।
কিন্তু
সব প্রধান যুদ্ধে হস্তক্ষেপের
মতোই মুহাম্মদ সম্ভবত খুব
দ্রুতই এই অভিযান পরিচালনা
করতে চেয়েছিলেন,
কারণ
তিনি তার অনুসারীদের হত্যার
প্রতিশোধ নিতে এই অভিযানটিকে
অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে
দেখছিলেন। তিনি এতটাই ক্ষুদ্ধ
ছিলেন যে,
তিনি
লিহিয়ানদের পিষে ফেলতে আগ্রহী
ছিলেন। তিনি তাদেরকে হতচকিত
করার জন্য দুর্ধর্ষ পদক্ষেপ
গ্রহণ করেছিলেন। তারা ছিল
হুযাইল গোত্রের (Hudhayl
tribe) একটি
শাখা যারা মক্কার উত্তর-পূর্ব
দিকের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে
ঘোরাফেরা করত। কিন্তু ইয়াছরিবের
দক্ষিণে সহজ পথে যাওয়ার
পরিবর্তে তিনি পশ্চিমে লোহিত
সাগরের পথ ধরে এগোলেন যে কারণে
একদিন বেশি সময় লেগেছিল।
তিনি দুইশত পেশাদার সৈন্যের
একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেন।
দক্ষিণের উপকূল বরাবর ভ্রমণের
পর তিনি লিহিয়ান ভুমিতে ঢুকে
তাদের শিবিরের উদ্দেশ্যে
অগ্রসর হন। এটি ছিল একটি
কুটকৌশল। এই রুট নেয়া হয়েছিল
মূলত এজন্য যাতে এই অভিযানের
কথা ফাঁস না হয়ে যায়,
যদিও
এভাবে আসার কারণে অতিরিক্ত
২০০ মাইল রাস্তা যোগ হয়েছিল,
কিন্তু
তাতেও কোন লাভ হয়নি। লিহিয়ানরা
কোন না কোনভাবে এই অভিযানের
কথা জেনে যায় এবং পাহাড়ে
পালিয়ে যায় ও সঙ্গে করে
তাদের পশুর পাল ও সহায়-সম্পত্তি
নিয়ে যায়। মুহাম্মদ তাদের
খুঁজে বের করার জন্য একটি দল
পাঠালেন,
কিন্তু
তারাও খালি হাতে ফিরে এলো।
কিন্তু মুহাম্মদ একেবারে
খালি হাতে অভিযান থেকে ফিরে
না গিয়ে তিনি কিছু সুবিধা
পেতে তার সৈন্যদের নেতৃত্ব
দিয়ে আরো দক্ষিণে উসফান
(Usfan) গ্রামে
নিয়ে যান,
যেটার
দুরত্ব ছিল মক্কা থেকে একদিনের
যাত্রাপথের দুরত্বের সমান।
তবে এই অভিযানটি পরিচালনা
করেন মক্কাবাসীদের তার ক্ষমতার
প্রদর্শন এবং ভয় দেখানোর
উদ্দেশ্যেও। মক্কাবাসীরা
তখন খালিদের নেতৃত্বে একটি
অশ্বারোহী সেনাদল পাঠায়
(৬)।
খালিদ
ছিলেন সেই অশ্বারোহী নেতা
যিনি উহুদের যুদ্ধে মুহাম্মদকে
চ্যালেঞ্জ করে সৈন্যদের সারি
ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
এই সংঘর্ষের ফলে অচলাবস্থার
সৃষ্টি হয়,
কারণ
মুহাম্মদ বা খালিদ কেউ এই
যুদ্ধে জয়লাভের ব্যাপারে
যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী ছিল না।
উভয় বাহিনীই (খালিদের
দল এবং মুহাম্মদের দল)
পিছিয়ে
যায় এবং মুহাম্মদ প্রতিশোধ
না নিয়েই বাড়ি ফিরে আসেন।
এই অভিযান থেকে মুহাম্মদ না
কোন গনিমতের মাল আনলেন,
না
প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হলেন।
এই হামলায় একমাত্র ক্ষতি
হয়েছিল লিহিয়ানদের সুনামের
ক্ষতি,
যাদেরকে
মুহাম্মদের একজন ভাড়াটে কবি
যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাওয়ার
জন্য “মামুলি নেউলে” বলে
অভিহিত করেছিলেন (৭)।
যদিও মুহাম্মদ সেই অভিযান
থেকে খালি হাতে ফিরে আসেন,
কিন্তু
তার লুণ্ঠন কার্যকম তখনো
ইয়াছরিবে ঠিকই প্রবাহিত
হচ্ছিল,
এবং
সাম্প্রতিক অন্যান্য অভিযানের
লুণ্ঠিত জিনিসপত্রও ইয়াছরিবে
ঠিকই আসছিল।
সম্প্রতি
কয়েকটি অভিযানের একটি থেকে
পনেরো শত প্রাণী,
আরেক
জায়গা থেকে পাঁচ হাজার,
আরেকটি
অভিযান থেকে আরও দুই হাজার
পশুপাল ঠিকই এনেছিলেন -
গতানুগতিকভাবে
মুহাম্মদ সবসময় তার কুড়ি
শতাংশ কেটেই রাখতেন। এই সাফল্যের
ফলে ইয়াছরিব গবাদিপশুতে
সমৃদ্ধ হয়ে উঠল ঠিকই,
কিন্তু
চারণভূমির স্বল্পতা দেখা
দিল। অতিরিক্ত পশুখাদ্যের
জন্য জমির প্রয়োজন ছিল,
যা
একটি সংকটের সৃষ্টি করল। তাজা
ঘাসের একমাত্র উৎস ছিল ইয়াছরিবের
বাইরে,
বিশেষ
করে পূর্বদিকে,
কিন্তু
দূরত্বের কারণে রাখালদের
জন্য ভেড়াগুলোকে রক্ষা করা
কঠিন হয়ে উঠল। মুহাম্মদ
যাযাবরদের সাথে এবং চরাঞ্চলের
লোকদের সাথে চুক্তি করেছিলেন
যারা এই অঞ্চলগুলি নিয়ন্ত্রণ
করত; এবং
মুহাম্মদ তার রাখালদের পশুর
পাল সহ সেখানে প্রেরণ করেন।
তার
উপর হিংস্র প্রতিশোধ নেয়া
হতে পারে ভেবে তিনি তার রাখাল
বালককে পশুপাল সহ সবসময় দূরে
রাখার চেষ্টা করতেন,
তবে
এই প্রতিরোধ সবসময় কার্যকরী
ছিল না। লিহিয়ান অভিযান থেকে
ফিরে আসার মাত্র কয়েকদিন পর
তিনি খবর পান যে,
ইয়াছরিব
থেকে অর্ধদিনের দুরত্বের এক
চারণভূমিতে একদল বেদুইন
অভিযানকারী আক্রমণ করে তার
কুড়িটি উট নিয়ে যায়। তারা
রাখালকে হত্যা করে এবং উটসহ
রাখালের স্ত্রীকেও সাথে নিয়ে
যায়। এই উটগুলোর মধ্যে ছিল
মুহাম্মদের অন্যতম প্রিয়
আল আবদা (al
Abda) উট,
যেটি
বিখ্যাত ছিল দৌড় প্রতিযোগিতার
জন্য এবং উক্ত উটটি সাম্প্রতিক
এক অভিযান থেকে গনিমত হিসেবে
তিনি পেয়েছিলেন। তিনি সবসময়
গনিমতের মাল প্রথম বাছাই করতেন
এবং তার চোখকে কোনভাবেই এটি
এড়িয়ে যাওয়ার কথা না,
কারণ
তীর্থ মৌসুমের বিভিন্ন মেলায়
দৌড় প্রতিযোগিতায় উটটি
অনেকবার বিজয়ী হয়েছিল।
দৌড় প্রতিযোগিতার উট এবং
ঘোড়া ছিল আরবদের আবেগের
বিষয়,
সেই
আবেগ মুহাম্মদের মধ্যেও ছিল,
এবং
তার নিজস্ব উট কাসওয়া (Qaswa)
ছিল
গনিমতের মাল ছিল। আল-আবদা
(al-Abda) তার
অতি প্রিয় ছিল। লিহিয়ান
অভিযানের সময় তিনি অন্যান্য
উটের সাথে এই দুটোকেও চারণভূমিতে
নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এই
অভিযানের খবর পেয়ে মুহাম্মদ
আক্রমণকারীদের তাড়া করতে
অশ্বারোহীদের একত্রিত করলেন
এবং দ্রুত তাদের ধাওয়া করতে
পাঁচশো সৈন্য জড়ো করলেন। যে
লোকটি এই খবরটি নিয়ে এসেছিল
সে হলো আল-আকওয়ার
(al-Akwa ) ছেলে
সালামা (Salama),
যে
সবসময় মুহাম্মদকে খুশি করার
উপায় খুঁজত। সে চারণভূমির
দিকে যাচ্ছিল সব ঠিক আছে কিনা
পর্যবেক্ষণ করতে,
অথবা
ঐ দিনের দুগ্ধ উৎপাদন আনতে -
এগুলোর
বেশিরভাগই ছিল দুধের উট।
প্রতিদিনের দুধ ইয়াছরিবে
যখন নিয়ে যাওয়া হতো,
সে
ঠিক সেই সময় দুর থেকে এই আক্রমণ
দেখে। গাতফান এলাকা থেকে
চারণভূমিকে উত্তর-পূর্ব
দিকে আলাদা করা পাহাড় থেকে
চল্লিশজন হামলাকারী নেমে
এসেছিল,
এবং
তারা ইতোমধ্যেই মুহাম্মদের
গবাদিপশু এবং রাখালের স্ত্রীকে
পাহাড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
সালামা একজন ক্রীতদাসকে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছিল। এই দৃশ্য দেখে মুহাম্মদকে সতর্ক করতে সে দাসকে ঘোড়া দিয়ে পাঠিয়ে দিল। শুধু ধনুক হাতে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে সে হামলাকারীদের তাড়া করল। পর্বতের পথ সংকীর্ণ ও এবড়ো-থেবড়ো হওয়ায় তা পাড়ি দিতে গতি কমে গিয়েছিল। সালামা তখন একটি গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে সেটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদের উদ্দেশ্যে তীর ছুঁড়ে মারতে লাগল। প্রতিটি তীর ছুঁড়ে মারার সময় সে চিৎকার করে বলল, “আমি আকওয়ার ছেলে সালামা। আজ দুষ্টুরা মারা পড়বে” (৮)। তার নিরলস আক্রমণে হামলাকারীদের চলার গতি কিছুটা মন্থর হয়ে গেল, ইতিমধ্যে মুহাম্মদ যে অশ্বারোহী পাঠালেন তারাও ইতিমধ্যে লড়াইতে যোগ দিল। মুহাম্মদের একজন হামলাকারীসহ আক্রমকারীদের চার-পাঁচজন নিহত হলো। লুট হয়ে যাওয়া কুড়িটি উটের মধ্যে অর্ধেক উদ্ধার করতে পেরেছিল তারা, তবে সেসবের মধ্যে মুহাম্মদের প্রিয় উট আল-আবদা ছিল না। জানা গেল যে, বেদুইন হামলাকারীদের প্রধান ছিলেন আর কেউ নন, তিনি হচ্ছেন উয়াইনা (Uyayna)। তিনি ছিলেন গাতফান নেতা, যিনি মাত্র কয়েকমাস আগে মক্কাবাসী জোটের সাথে মিলে ইয়াছরিবে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি সেই ব্যক্তি যাকে মুহাম্মদ ইয়াছরিব এক তৃতীয়াংশ খেজুর ফসল দিয়ে কেনার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে মুহাম্মদ পিছু হটেন যখন তার অনুসারীরা তাদের কোন পণ্য কাফেরের সাথে ভাগ করে নেয়ার ব্যাপারটি ভালো চোখে দেখেনি। ইয়াছরিবের উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকের একটি বৃহৎ অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানো গাতফান গোত্রের একটি শাখার প্রধান ছিলেন উয়াইনা। তার গুরুত্ব অনুমেয় করা যায় কারণ তিনি দুই হাজার যোদ্ধাকে একত্রিত করে মক্কাবাসী জোটের সাথে মিলে যুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্ভবত এই শক্তিই তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল যে, তিনি যেকোন সময় মুহাম্মদের উটের পাল ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারবেন। মুহাম্মদ পাহাড়ের উপর দিয়ে উয়াইনাকে অনুসরণ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কারণ ততক্ষণে গাতফান (Ghatafan) নেতা তার নিজের এলাকায় ঢুকে যাবেন এবং তাকে প্রতিহত করার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শক্তি একত্রিত করতে সক্ষম হবেন।
দস্যুদের
পেছনে তাড়া করার পরিবর্তে
তিনি কিছু উদ্ধার করা উটকে
জবাই করে সৈন্যদের ভোজনের
আয়োজন করেন এবং আগুন জ্বালিয়ে
তার চারপাশে বসে সবাই সংঘর্ষের
কাহিনী উপভোগ করতে থাকে এবং
জেনে আনন্দিত হয় যে,
তারা
উয়াইনার এক ছেলেকে হত্যা
করতে সমর্থ হয়েছে। যখন সালামা
দুষ্কৃতিদের দিকে তাঁর ছোঁড়ার
গল্প করল এবং এ-ও
বলেছিল যে সে তাদের বলেছে “আমি
আল-আকওয়ার
ছেলে সালামা,
এবং
দুষ্টরা আজ মারা পড়বে” মুহাম্মদ
তখন মুখ হা করে হাসতে হাসতে
গড়াগড়ি যাচ্ছিলেন এবং
সালামাকে ওইদিনের জন্য নায়ক
ঘোষণা করে দিলেন। ইয়াছরিবে
ফিরে আসার সময় মুহাম্মদ তাকে
তার সাথে উটের পিঠে চড়ার
অনুমতি দিয়ে সম্মানিত করেন।
সালামার জন্য এটা ছিল সপ্তম
স্বর্গ ছোঁয়ার মতো বিষয়।
সৈন্যরা সবাই ফুরফুরা মেজাজে
ছিলেন। তাদের লুট করা গনিমতের
মাল নিয়ে তৎক্ষণাৎ রচিত
আনকোরা আয়াত নিয়েও সৈন্যরা
বেশ উল্লসিত ছিল। যখন তারা
ইয়াছরিবের কাছাকছি ফিরল,
তারা
উটের দৌড় প্রতিযোগিতার
প্রস্তাব করল। আর নতুন মর্যাদার
জন্য ধন্যবাদ স্বরূপ সালামাকে
একটি দ্রুতগতির উট পুরস্কৃত
করা হলো। দৌড়ের শুরু হয়েছিল
বালির মধ্যে একটি লাইন কেটে।
মুহাম্মদের বিশেষ অনুগ্রহ
অর্জন করতে পেরে তার মাথা তখন
আনন্দে ঘুরছে,
সালামা
তার বিজয় উদযাপনের জন্য তার
উটের পিঠে উঠে বসল।
এদিকে
রাখালের বন্দি স্ত্রী রাতের
আঁধারে আল-আবদা
উটের উপর চড়ে পালিয়ে যেতে
সক্ষম হলো,
কারণ
সে জানত যে উটটি অশ্বারোহীদের
সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এবং
সে দ্রুত পালাতে পারবে। সে
প্রতিজ্ঞা করেছিল যে,
যদি
জীবিত অবস্থায় ইয়াছরিবে
পৌঁছতে পারে তাহলে সে আল্লাহকে
ধন্যবাদ জানানোর জন্য এটিকে
উৎসর্গ করবে। মুহাম্মদের চলে
আসার দু'দিন
পর সে মুহাম্মদের প্রিয় উটে
চড়ে ইয়াছরিবে সুস্থ এবং
নিরাপদে পৌঁছে গেল। মুহাম্মদও
তার প্রিয় উটটি ফিরে পেয়ে
খুশি হলেন,
কিন্তু
যখন নারীটি তাকে আল্লাহর পথে
এই উটটি উৎসর্গের প্রতিজ্ঞার
কথা জানালেন,
মুহাম্মদ
তাকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন
: “আল্লাহর
প্রতি অবাধ্যতার কোন মানত
করা বৈধ নয়,
তেমনি
অবৈধ কিছু যা নিজের নয় এমন
কিছু মানত করাও বৈধ নয়”।
সম্ভবত মুহাম্মদের রেগে যাওয়ার আসল কারণ ছিল উটটি তার প্রিয় ছিল যেটা তিনি সম্প্রতি এক অভিযান থেকে পেয়েছেন, আর এই নারী তাকেই (উট) উৎসর্গ করতে চেয়েছে! (৯)
শুধু
যাযাবরদের অভিযান মোকাবেলাই
তার অন্যতম চিন্তার কারণ ছিল
না, সঙ্গে
চোরদের নিয়েও তিনি বেশ ঝামেলায়
ছিলেন। ইতিহাসে পাওয়া যায়,
দক্ষিণের
উরাইনা গোত্রের (Urayna
tribe) আটজন
লোক ইয়াছরিবে তার কাছে এসেছিল
তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার
করতে,
কিন্তু
প্রথম সুযোগে তারা তার উট
নিয়ে পালিয়ে যায়। তারা
এসেছে দক্ষিণের উন্মুক্ত
জায়গা থেকে। থাকার মতো কোন
ঘর বা তাঁবু তাদের ছিল না।
দেয়াল হিসেবে ছিল পাহাড়
এবং আকাশ ছিল তাদের ছাদ। তারা
ছিল গৃহহীন,
এবং
তারা দেখতে রোগাপটকা ছিল।
তারা রোগে আক্রান্ত হলে সেটা
ঘনবসতিপূর্ণ ইয়াছরিবের
সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে,
বিশেষ
করে গরম মাসগুলোতে মাছি এবং
মশার উপদ্রব বাড়তে থাকে এবং
রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভবনা
বেশি থাকে। এই চিন্তা করে
তাদের সুস্থ এবং স্বাস্থ্যবান
করার জন্য মুহাম্মদ তাদের
শহরের বাইরে তার এক মুক্ত
দাসের সাথে থাকার জন্য পাঠিয়ে
দিলেন। দাস সেখানে দুধ দেয়া
উটগুলো দেখভাল করত। এটা সেই
এলাকা যেখানে গাতফানীরা এর
আগেও অভিযান চালিয়েছিল।
মুহাম্মদ এদের শক্তিবান হতে
প্রচুর দুধ পান করার নির্দেশ
দিলেন,
এবং
সাথে উটের প্রস্রাবও পান করতে
বললেন,
কারণ
তিনি উটের মুত্রকে সবচেয়ে
ভালো ওষুধ হিসেবে বিবেচনা
করতেন।
তাদের কংকালসার শরীর মাংসে পূর্ণ হলো। সুস্থবোধ করার পরই এই আট বেদুইন মুহাম্মদের রাখালকে হত্যা করল এবং মুহাম্মদের গনিমতের মাল সাথে করে নিয়ে পালিয়ে গেল। ইসলামিক গ্রন্থ অনুসারে, তারা প্রথমে রাখালের হাত ও পা কেটে দিয়েছিল এবং তারপর তার জিহ্বা ও চোখ দিয়ে কাঁটা ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল। মুহাম্মদ শীঘ্রই তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানতে পারেন এবং কুর্জ (Kurz) নামের একজন প্রাক্তন উটচালককে তাদের ধরে আনার জন্য পাঠান। ছয় বছর আগে কুর্জ মুহাম্মদের কিছু গবাদিপশু চুরি করতে সফল হয়েছিল, কিন্তু পরে সে ধর্মান্তরিত হয় এবং একজন নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। কুড়িজনের একটি দল পাঠিয়ে তিনি সেই চোরদের ধরে ইয়াছরিবে ফিরিয়ে আনেন। মুহাম্মদ তাদের হাত-পা কেটে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাদের চোখ উপড়ে ফেলা হলো। একটি বর্ণনায় আছে, তাদের চোখে উত্তপ লোহা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তারপর তাদেরকে উত্তপ্ত বালির ক্ষেতে ফেলে দিয়ে আসা হয় এবং তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মারা যায়। বলা হয় যে, তারা পান করার জন্য একটু জল চাইতে চাইতেই মারা যায় (১০)।
এই
ঘটনাটি মুহাম্মদকে আয়াত
রচনা করতে অনুপ্রাণিত করে যা
পরবর্তীতে কোরআনের পঞ্চম
অধ্যায়ের অংশ হয়ে ওঠে। একটি
আয়াতে চুরির শাস্তি কি হবে
তার বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে
এভাবে :
“আর
পুরুষ চোর ও নারী চোর তাদের
উভয়ের হাত কেটে দাও তাদের
কর্মের প্রতিফল ও আল্লাহর
পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি হিসেবে,
এবং
আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী,
প্রজ্ঞাময়।”
(১১)।
তবে এই জঘন্য অপরাধ যেটা এই
আটজন বেদুইনের দ্বারা সংঘটিত
হয়েছিল,
এই
ধরনের অপরাধের জন্য তিনি কঠোর
শাস্তির আয়াত রচনা করেন:
“যারা
আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে
যুদ্ধ করে এবং জমিনে অশান্তি
সৃষ্টি করে বেড়ায়,
তাদের
শাস্তি কেবল এই যে,
তাদেরকে
হত্যা করা হবে অথবা শূলে চড়ানো
হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে
তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে
অথবা তাদেরকে দেশ থেকে বের
করে দেয়া হবে। এটি তাদের জন্য
দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং তাদের
জন্য আখিরাতে রয়েছে মর্মন্তুদ
শাস্তি” (১২)।