অধ্যায় - ১২ বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
মুতইমের (Mutim) নিরাপত্তা সত্ত্বেও, মুহাম্মদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। মুতইম বৃদ্ধ ছিলেন; তিনি যেকোন সময় মারা যেতে পারেন। তাঁর কিছু ছেলে ও নাতিরা মুহাম্মদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন, এবং গোত্র থেকে তিনি অব্যাহতভাবে সুরক্ষা পাবেন সেটাও অনিশ্চিত ছিল। এদিকে মক্কাবাসীরা মুতইমের মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল না, বরং মুতইমকেই মুহাম্মদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন অভিযোগের একটি ফর্দ তৈরি করছিল। সম্প্রদায়ের ভেতরের ঐক্য খর্ব করা এবং তাদের তরুণদের ধর্মের মাধ্যমে কলুষিত করার মত গতানুগতিক অভিযোগ ছাড়াও, এবার যোগ করা হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মত অপরাধ। রাবিয়ার ভাইয়েরা এবং অন্যান্যরা মুহাম্মদের তায়েফ ভ্রমণের সংবাদ নিয়ে আসেন এবং বলেন তাদের কাছে সংবাদ আছে যে, মুহাম্মদ তায়েফের জনগণকে মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছিলেন। একটি ডানাওয়ালা খচ্চরে চড়ে জেরুজালেমে (Jerusalem) উড়ে যাওয়া এবং স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার মুহাম্মদের দাবির পর, মক্কাবাসীরা এখন তাঁর অনুসারীদের বলতে পারবে যে, তিনি আসলেই পাগল হয়ে গেছেন।
মুহাম্মদ আবুল হাকামকে ছাড়া আর কাউকে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানাননি। স্বর্গীয় উচ্চ আসনে পরিভ্রমণের সম্মান নিয়ে উম্মে হানির বাড়ি থেকে বের হয়ে তিনি মন্দিরে চলে যান, কিন্তু ততক্ষণে তিনি বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। আবুল হাকাম মুহাম্মদের কি হয়েছে জানতে চান, এবং মুহাম্মদ তাঁকে জেরুজালেমের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন। সবসময় মুহাম্মদকে অপমান করার উপায় খুঁজতে থাকা আবুল হাকাম ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমি যদি তোমার লোকজনকে তোমার কাছে ডেকে আনি, তাহলে তুমি আমাকে যা বলেছ তা কি তাদেরকেও বলবে?” উত্তরে মুহাম্মদ বললেন “হ্যাঁ, আমি বলব”। সম্ভবত মুতইম সহ সকল গুরুত্বপূর্ণ মক্কাবাসীকে মন্দিরের মঞ্চে ডেকে পাঠানো হয় এবং মুহাম্মদ আবুল হাকামকে যা বলেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করেন (১)।
মুতইম মুহাম্মদের সমর্থনে অনড় ছিলেন, কিন্তু তাঁর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে দেখে মুহাম্মদ একটি নতুন বাড়ির খোঁজ করতে থাকেন। যখন পবিত্র মাস শুরু হল, তিনিও ধর্মপ্রচারের জন্য রাস্তায় বের হলেন এবং বেদুইন গোত্রদের মধ্যে থেকে একজন রক্ষক খুঁজতে লাগলেন। আবু বকর, আলী, উমর এবং তাঁর অন্যন্য ঘনিষ্ঠদের সাথে নিয়ে তিনি বিভিন্ন মেলায় গোত্রের শিবির পরিদর্শন করতে লাগলেন। মক্কা ছাড়ার আগে তিনি আবুল হাকাম এবং অন্যান্য মক্কাবাসী শত্রুদের সতর্ক করে দেন “শীঘ্রই তাদের উপর গজব পড়বে”, আর তখন তাঁরা “হাসবে কম কিন্তু কাঁদবে বেশি” (২)।
মুহাম্মদ মক্কা থেকে দুই দিনের দুরত্বে থাকা প্রধান বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক মেলা উকাজে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন এবং তাঁর শেষ করেন মক্কার কাছাকাছি দুটি ছোট মেলা, মাজানা (Majanna) এবং দু আল-মাজাজ (Dhu al-Majaz) ফুল মাজাজের মেলা ঘুরে। আশেপাশের তীর্থযাত্রীদের শিবিরের সামনে মুহাম্মদের লোকজন নানান পসরা সাজিয়ে বসতো, যাতে শিবিরগুলোতে মুহাম্মদের প্রবেশ সহজ হয়ে যায়। তার মধ্যে অগ্রগামী লোকটি তাঁর উট নিয়ে তীর্থ শিবিরে চক্কর দেবে, তারা কোথা থেকে এসেছে এবং তাদের নেতাদের নাম জিজ্ঞাসা করবে, তারপর তারা একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে: “আপনি কি ভালো কিছু অর্জন করতে চান?” তাঁরা প্রত্যুত্তরে বলত “সেটা কিভাবে সম্ভব?” জবাব আস্ত – “আপনারা সাক্ষ্য দেবেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এরপর প্রার্থনায় যোগ দেবেন এবং ঈশ্বরের বাণীতে বিশ্বাস করবেন” (৩)।
যদি তাদের মধ্যে আগ্রহ দেখতে পেতেন তবেই মুহাম্মদ ঘটনাস্থলে আসতেন এবং তাদের প্রধানদের সাথে তাঁবুতে বসতেন, অথবা সেখানে জ্বালানো আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে আড্ডা দিতে থাকা লোকজনের সাথে বসতেন। এই দলগুলোর অনেকেরই খুব সামান্য জিনিসপত্র এবং মোটামুটি রকমের তাঁবু ছিল। অন্যান্য যেসব আঞ্চলিক গোত্রের লোকেরা একটু ভালো অবস্থার ছিলেন তাঁরা অনেক বড় তাবু খাটাতেন, সঙ্গে করে কার্পেট এবং কুশন নিয়ে আসতেন। তাদের শেখ'রা ভালো পোশাক পরতেন এবং দর্শনার্থীদের প্রচুর খাবার ও পানীয় দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। যে গোত্রের নেতারা অন্য গোত্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতার বা ভালো অবস্থার ছিলেন মুহাম্মদ অধীর আগ্রহে তাদের মনোযোগ পেতে চাইতেন। যখনই এই ধরনের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো, তখন মুহাম্মদও তাঁর সবচাইতে ভালো পোশাকটি পরে তাদের মধ্যে বসতেন। সাধারণত ধর্মপ্রচারকের প্রথম কাজটি শুরু করতেন আবু বকর, তিনি একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে মুহাম্মদকে সবার মাঝে পরিচয় করিয়ে দিতেন।
প্রথমে মুহাম্মদ আদিবাসী নেতা এবং তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে চাটুকারিতাপূর্ণ মন্তব্য দিয়ে শুরু করতেন, তারপর তিনি মূল লক্ষ্যে চলে যেতেন। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে তিনি ধর্মতত্ত্ব এড়িয়ে যেতেন, বরঞ্চ তাঁর বিপরীতে প্রথমে সমাজের নানা অবিচারের কথা তুলে ধরতেন। আরবরা অন্যায়, অবিচারকে ঘৃণা করত, তিনি তাদের তা মনে করিয়ে দিতেন। হাতে তলোয়ার নিয়ে তারাই প্রথম প্রতিরক্ষাহীনদের রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত। তারা নির্যাতিতের সাহায্যেও সবার আগে এগিয়ে আসতেন। এটি আরব্য সংস্কৃতি ছিল, এবং সেরা কবিতার মাধ্যমে এই ধরনের কাজের প্রশংসা করা হতো। তিনি তাদের জানান, তিনি অবিচারের শিকার হয়েছেন। তিনি কেবলমাত্র তাঁর লোকদের উপকার চেয়েছিলেন, একমাত্র সত্য ঈশ্বরের বাণী তাদের কাছে নিয়ে আসার মাধ্যমে, আর এর জন্য তাঁকে তারা বিতাড়িত করেছে। এটি কি ন্যায়? তাঁর কথা শেষ করে তিনি তাদেরকে প্রতিরক্ষা শাখার অধীনে আসার জন্য আবেদন করতেন। তিনি বলেন, “আমি আপনাদের কাউকে কিছু করতে বাধ্য করতে চাই না। আপনাদের মধ্যে যার ইচ্ছে আমার সাথে একত্রিত হবেন, কিন্তু আমি কাউকে আমার সাথে সম্মত হতে বাধ্য করব না। আমি শুধু যারা আমাকে হত্যা করতে চায় তাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাই, যাতে আমি আমার উপর অর্পিত প্রভুর দায়িত্ব পালন করতে পারি এবং তিনি (ঈশ্বর) আমার নিজের বা যারা আমাকে সমর্থন করবে তাদের ব্যাপারে যাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যেন মেনে চলতে পারি (৪)।
বরাবরের মতই তিনি তাঁর শ্রোতাদের পড়তে দক্ষ ছিলেন। তিনি যদি দেখতেন মানুষ আগ্রহ সহকারে তাঁর কথা শুনছেন, তাহলে কোরআন থেকে কিছু আয়াত আবৃত্তি করে এবং ধর্মের সারসংক্ষেপ তুলে ধরতেন। কোরআন দেখিয়ে তিনি তাদের ব্যাখ্যা করতেন যে, এই 'বিস্ময়কর বইটির' শব্দের পেছনের কর্তৃত্ব সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের, যিনি তাঁর শাশ্বত বাণী এক ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁর রাসুলের কাছে প্রচার করার জন্য পাঠিয়েছেন। “আমি আপনাদের আল্লাহর রাসুল। আমি আপনাদের এক ঈশ্বরের এবাদত করতে বলছি এবং তাঁর সাথে যেন অন্য কাউকে শরীক না করেন এবং তিনি ছাড়া অন্যদেরকে পরিত্যাগ করেন; আর আমার প্রতি আপনাদের বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং আমাকে সুরক্ষা দেন যাতে ঈশ্বর আমাকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন তা আমি দৃশ্যমান করতে পারি” (৫)।
আরবদের জন্য মুহাম্মদের ধর্মতত্ত্ব ছিল এক জিনিস, আর বাস্তবতা ছিল ভিন্ন জিনিস। তাঁর সুরক্ষার অনুরোধটি রাখতে গেলে এটির স্পষ্ট প্রভাব তারা দেখতে পাচ্ছেন। এর দ্বারা অন্যান্য গোত্রগুলোর সাথে সংঘাতের সৃষ্টি হবে, বিশেষ করে কুরাইশদের সাথে যারা পবিত্র এলাকা এবং সকলের প্রার্থনার কেন্দ্রবিন্দু মন্দিরের অভিভাবক ছিলেন। ফলাফল কি হতে পারে তা ভেবে তারা আগ্রহ হারাচ্ছিল, কিন্তু তারা খুব নম্র ভাষায় কেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারবেন না তা জানিয়ে দেন। তবে কিছু গোত্র মুহাম্মদকে বলেছিল যে, তারা সেই মুহূর্তে জবাব দিতে পারবে না, কারণ বিষয়টি নিয়ে গোত্রীয় বৈঠকে আলোচনা করতে হবে। তারপর মুহাম্মদ আর তাদের কাছ থেকে কিছু শোনেননি। অন্যরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, তাঁকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে হলে নিজেদের গর্দান দিতে হবে, এবং তিনি তাদেরকে রেখে পালাবেন। আরেকজন জিজ্ঞেস করেন তাদের জন্য কি আছে? তিনি বলেন, “জান্নাত!” বস্তুত, এই প্রস্তাব তাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল না।
কখনও কখনও এই প্রস্তাবের প্রত্যাখান ছিল সোজাসাপ্টা। ইয়েমেনের এক গোত্র তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, “আপনি আমাদেরকে আমাদের দেবতাদের থেকে দূরে রাখতে এসেছেন, আর আপনি আমাদেরকে নিয়ে আরবদের সাথে যুদ্ধে যেতে চান? আপনি আপনার লোকদের সঙ্গে থাকেন, আপনাকে আমাদের প্রয়োজন নেই” (৬)। কখনও কখনও তীর্থ শিবিরে প্রবেশের সময় লোকে তাঁর দিকে আঙুল তুলে বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়দের বলত : “সাবধান কুরাইশের এই লোকটা যেন তোমাদের নষ্ট না করে” (৭)।
পরিশেষে তাঁর প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হতে দেখা গেল যখন উত্তর দিকের আমির গোত্রের (Amir tribe) একটি গোষ্ঠী তাঁর ধর্মের প্রতি অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেও মেলা এবং তীর্থযাত্রা শেষ হওয়ার পর তাঁকে তাদের এলাকায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। তাদের নেতা বলেন, “যতক্ষণ না আপনি আপনার উপর প্রভুর অর্পিত দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আপনাকে সুরক্ষা দেবো”। এটি সম্ভব হয়েছিল কারণ, সেই গোত্রের এক নারী মক্কায় তাঁর ধর্মে যোগ দিয়েছিল। অন্যদের ধর্মান্তরিত করতে আগ্রহী মুহাম্মদ তখন গোত্রীয় মেলার মাঠে চলে আসেন এবং ধর্মপ্রচারে শ্রম দিতে লাগলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সেটা পন্ডশ্রমই হয়ে যায়। যখন একজন ঊর্ধ্বতন আদিবাসী নেতা জানতে পারলেন যে, মুহাম্মদ সেই গোত্রের একটি পরিবারের সাথে থাকছেন তখন তিনি সেই পরিবারের উপর ক্ষিপ্ত হন এবং সেখানে গিয়ে মুহাম্মদকে চলে যাওয়ার আদেশ দেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “ওনার লোকেরা ওনাকে খুব ভালো করে চেনে। যদি তারা ওনার মাঝে ভালো কিছু পেত, তাহলে তারা ওনাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হত। আপনারা কি করে এমন একজন মানুষকে সমর্থন করবেন যাকে ওনার নিজের লোকেরাই অস্বীকার করছে আর গোত্রছাড়া করেছে? আর আপনারা ওনাকে কেনই বা আশ্রয় দেবেন ও সাহায্য করবেন?” তিনি গর্জন দিয়ে মুহাম্মদকে বললেন, “উঠুন, নিজের লোকদের কাছে যান। আমি কসম খেয়ে বলছি, আপনি যদি এই মুহূর্তে আমার আত্মীয়দের মধ্যে না থাকতেন, তাহলে আমি আপনাকে আঘাত করতাম”!
এই ঘটনাটি মুহাম্মদকে একটু বিচলিত করে তোলে। তিনি যখন উটের পিঠে আরোহণ করে স্থান ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঐ শেখ তাঁর সাথে থাকা বর্শাটি দিয়ে উটটির পেছনে আঘাত করেন, যার ফলে উটটি অস্থির হয়ে যায় এবং মুহাম্মদকে পিঠ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই দৃশ্য দেখে ধর্মান্তরিত মহিলা যিনি তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন, রেগে গিয়ে বলে উঠলেন, “সত্যিই কি আল্লাহর রাসুলের সাথে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এখানে তোমাদের মধ্যে কেউ ওনাকে সুরক্ষা দিচ্ছে না?” এই মহিলার এই কথা শুনে শেখের সাথে বসে থাকা লোকদের সাথে অন্যান্যদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। তারা শেখকে মাটিতে ফেলে ধরে রাখেন, আর মহিলার এক আত্মীয় তাঁর বুকে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর মুখে চড় মারেন। অনুকুলে থাকা লোকজনের শক্তি দেখে মুহাম্মদ আনন্দিত হয়ে বলেন, “আল্লাহ এদের মঙ্গল করুন এবং অন্যদের বিনষ্ট করুন” (৮)!
এই ধরনের ধারাবাহিক প্রত্যাখ্যান ও বিপর্যয়ের মুখেও মুহাম্মদ তাঁর বিশ্বাসে অনড় ছিলেন। তাঁর দৃঢ় অবস্থা শেষমেশ সফলতার মুখ দেখল যখন তিনি উত্তরে কৃষি উপনগরী ইয়াছরিবের দুটি আরব গোত্রের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন। এরা ছিল খাজরাজ (Khazraj) এবং আউস (Aws) গোত্র। এই দুটো গোত্র বহুশ্বরবাদীদের একটি অংশ, যারা প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করত অথবা ইহুদি গোত্রদের সাথে যুদ্ধ করত, যাদের সাথে তারা কৃষি জমির জল ভাগাভাগি করতেন। কয়েক বছর আগে মুহাম্মদ তাঁর ধর্মের বাণী নিয়ে আউস গোত্রের নেতাদের সাথে মক্কায় দেখা করে কুরাইশদের সাথে জোট বেঁধে খাজরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে লড়তে আহ্বান করেছিলেন। তবে তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে একজন বলেছিলেন, “আমরা এইজন্য এখানে আসিনি”। এবার উভয় গোত্রের লোকেরা হজ্ব চূড়ান্ত করার পর মক্কার বাইরে মিনায় তীর্থশিবিরে অবস্থান করেন এবং তাঁরা যখন উপাসনার শেষ নিয়ম অনুযায়ী মাথা কামাচ্ছিলেন, মুহাম্মদ তাদের নিকট আসেন। মুহাম্মদ তাঁর পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে তাঁর কথোপকথন শুরু করেন।
মুহাম্মদের পিতামহ আব্দুল মুত্তালিবের মা সালমা খাজরাজ গোত্রের ছিলেন। তাঁর বক্তৃতা ছিল স্বাভাবিকভাবেই একই বিষয়ে। "তিনি ঈশ্বরের প্রেরিত রাসুল, তাঁকে সত্য ধর্মের বার্তা দিয়ে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু এর জন্য তাঁকে নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তাঁর মিশন সম্পন্ন করার জন্য সুরক্ষার প্রয়োজন'। নবুয়তের দাবির সাথে তারা পরিচিত ছিল। তারা ইয়াছরিবে ইহুদিদের কাছ থেকে একজন নবী আসার ভবিষ্যদ্বাণী শুনেছিলেন, যিনি আসলে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে দাঁড়াবেন। আউস এবং খাজরাজরা প্রতিবেশী হিসেবে ছিল প্রায় ঝগড়াটে প্রকৃতির। তাঁরা ইয়েমেন থেকে এক শতাব্দীরও বেশি সময় আগে ইয়াছরিবে চলে আসেন, এবং তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তারা আউস ও খাজরাজ, দুটো গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। যদিও ইয়াছরিব একটি বিশাল মরুদ্যান ছিল, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমি এবং জল নিয়ে তারা ইহুদি এবং অন্যদের সাথে প্রায়ই সংঘাতে জড়িয়ে পড়তেন। অবশেষে ইহুদিদেরকে পূর্বদিকের উচ্চভূমিতে যেতে বাধ্য করা হয়। ইহুদিরা প্রায়ই ইয়াছরিবের দুই গোত্রকে হুমকি দিতেন যে, তাদের জন্য একজন দূত পাঠানো হবে যিনি রাজনৈতিক নেতা হবেন, তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে। “শীঘ্রই একজন নবীকে পাঠানো হবে। তাঁর দিন গণনা শুরু হয়েছে, আমরা তাঁকে অনুসরণ করব, তাঁর সাহায্য নিয়ে তোমাদের হত্যা করব” এই বলে তাঁরা সতর্ক করেন (৯)।
মুহাম্মদ ততদিনে ইহুদি নবীদের সম্পর্কে যা জানার তা জেনে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, ইহুদিরা এখনো ত্রাণকর্তা মেসিয়াহর (Messiah) আগমনে বিশ্বাস করে এবং তিনি তাঁর সুবিধার জন্য এই বিষয়টিকে ব্যবহার করেছেন। তিনি ইয়াছরিব তীর্থযাত্রীদের মধ্যে ছোট একটি দলকে বলেন, তিনিই সেই নবী যার কথা তাদেরকে বলা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে ইহুদিদের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পাঠানো হয়নি, বরং তাঁকে পাঠানো হয়েছে ঈশ্বরের সত্য বার্তাকে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে। এটি ইহুদিদের মিশন ছিল, কিন্তু তারা তা নষ্ট করে ফেলেছে। তাই মিশনটি এখন নাজ্জারে (Najjar) অবস্থিত, খাজরাজ গোত্রে জন্মগ্রহণকারী সালমার পুত্র তথা আব্দুল মুত্তালিবের নাতি, একজন আরব নবী মুহাম্মদ গ্রহণ করেছেন!
মুহাম্মদের সাথে বৈঠকে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে ছয়জন ছিল খাজরাজের, এবং কিছু কিছু সূত্র লিখেছে সেখানে আউসের দুজন লোকও ছিল। মুহাম্মদ যা বলেছিলেন তা তারা আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন, কিন্তু তিনি যে সুরক্ষা চেয়েছিলেন তা তাঁরা দিতে সক্ষম ছিলেন না। তাদের সেই কর্তৃত্ব ছিল না, এবং যদি তাঁকে তাদের সাথে এই সুরক্ষা ছাড়া ইয়াছরিব যেতে হয়, তাহলে আন্তঃগোত্রীয় লড়াইয়ের ফলে তাদের দুই গোত্রের মধ্যে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল, মুহাম্মদ হয়তো সেই কলহের মাঝখানে পড়ে যেতেন, এবং তিনি অরক্ষিত থাকতেন। কয়েক বছর আগে খাজরাজ এবং আউস গোত্র একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ লিপ্ত হয়, এই যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ববর্তী দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটে এবং এতে তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোকজন মারা যায়। বহুঈশ্বরবাদীদের সাথে এক ধরণের জোটের কারণে ইহুদিরা অনেক সময়ই যুদ্ধে জড়িয়ে যেত। উপত্যকার সমস্ত গোত্র, বহুঈশ্বরবাদী ও ইহুদিদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ইয়াছরিবে বসবাসকারীরা একজন নেতা খুঁজছিলেন, কিন্তু তাঁকে তারা এখনো খুঁজে পাননি। ইয়াছরিবের সাথে মুহাম্মদের পারিবারিক সম্পর্ক দেখে মুগ্ধ হয়ে এই স্বঘোষিত নবীকে তাদের মধ্যে পেতে তাঁরা আগ্রহী ছিল। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে, তাদের গোত্রের লোকদের কাছে তাঁর এবং তাঁর ধর্ম নিয়ে কথা বলবে এবং পরবর্তী তীর্থযাত্রার সময় এসে তাঁর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবে।
পরের বছর ১২ জনের একটি দল তাদের মধ্যে দশজন খাজরাজ এবং দুইজন আউসের - মুহাম্মদের কাছে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর ধর্ম গ্রহণ করে। এই সভাটি আকাবার (Aqaba) একটি খাঁড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনাটি ঘটেছিল পাহাড়ের পাশ ঘিরে মিনায় যাওয়ার পথে, যেখানে পশু উৎসর্গ করা হতো এবং পাথর মারার স্তম্ভ ছিল। ধর্মগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছু লোক ছিল যাদের সাথে মুহাম্মদ আগের বছরও আলোচনা করেছেন, তবে তারা তাঁর ধর্মগ্রহণ, নিয়ম-কানুন মেনে চলার অঙ্গীকার করলেও তাঁকে সুরক্ষা দেয়ার মত অবস্থায় ছিলেন না। কিন্তু সংখ্যায় খুব কম হলেও, তাদের ধর্মান্তরিত হওয়া মুহাম্মদকে ইয়াছরিবে পায়ের নিচে শক্ত ভীত গড়ে দিল, যা শীঘ্রই এক নিরাপদ স্বর্গে পরিণত হবে। নতুন নিয়োগকারীরা চলে যাওয়ার পর নতুনদের কোরআন, ওযু এবং নামাজের নিয়ম শেখাতে মুহাম্মদ মুসআব বিন উমায়েরকে (Musab bin Umayr) সেখানে পাঠান। এই সেই ব্যাক্তি যিনি হুমকি দিয়েছিলেন যে, যদি কেউ তাঁকে মুহাম্মদের ধর্ম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে তবে তিনি তাঁকে হত্যা করবেন।
এদিকে মক্কায় মুহাম্মদের অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। মুতইমের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হচ্ছিল, আর মুহাম্মদ নিশ্চিত ছিলেন তিনি মারা গেলে মক্কাবাসীরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করবে না। মক্কাবাসীরা তাঁকে ও তাঁর লোকদের ক্রমাগত নজরদারিতে রেখেছিল। মুহাম্মদের নিজস্ব সংবাদদাতা, সহানুভুতিশীল বা গোপন অনুসারী ছিল, যারা শহরে তাঁকে নিয়ে মানুষ কি বলছে এবং তাঁকে নিয়ে গোত্রীয় সভায় কি আলোচিত হয়েছিল তা নিয়মিতভাবে হালনাগাদ তথ্য দিতেন। এর ফলে তিনি জানতেন সামনে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হবে, কিন্তু পালানোর আগে তাঁকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করতে হবে।
ইয়াছরিবে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক ঘটনা ঘটতে লাগলো। স্বভাবে আক্রমণাত্মক এবং একইসাথে ভালো গল্প বলিয়ে মুসআব (Musab), স্বল্প সময়ের মধ্যে মুহাম্মদের বারো বছরে করা ধর্মান্তরিত মানুষের চেয়েও বেশি মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ধর্মান্তরিতদের মধ্যে ছিলেন আউস গোত্রের দুইজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, যারা অন্যদের এই ধর্মে যোগদান করতে প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সাফল্যের পেছনে বেশকিছু কারণও ছিল। প্রথমত, মক্কার তুলনায় ইয়াছরিবে বহুত্ববাদের চর্চা অনেকটা দুর্বল ছিল। মক্কার মতো পবিত্র মন্দিরকে কেন্দ্র করে ইয়াছরিবে কোন ঐক্যবদ্ধ মন্দির বা সাম্প্রদায়িক আচার- অনুষ্ঠানের জায়গা ছিল না। ইয়াছরিবের বহুঈশ্বরবাদীরা ছিলেন ভাগ্যের দেবী মানাতের ভক্ত, যিনি ছিলেন আল্লাহর তিন কন্যার মধ্যে তৃতীয়। কিন্তু তার অবস্থান ছিল বেশ কিছুটা দুরে, লোহিত সাগরের পশ্চিমে, যেখানে যেতে দু'দিনের মত সময় লাগত। তাদের প্রার্থনার নিয়মে, বহুঈশ্বরবাদীরা মানাত সহ আদিবাসী ও পারিবারিক দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতেন, যাদের মূর্তিগুলো তাদের বাড়িতেই রাখা হতো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, ইহুদিদের একেশ্বরবাদী ধর্মের খুব নিকটে তারা বাস করত, কারণ তারা ছিলেন প্রতিবেশী এবং ব্যবসায়িক সহযোগী। সুতরাং তারা ইহুদি ধর্মবিশ্বাস সমন্ধে কিছু না কিছু জানত। বেশিরভাগ সময় তারা তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখত, কারণ তারা মনে করত এই মতবাদটি ভিনদেশ থেকে আনা, কিন্তু মুহাম্মদ যে আরব্য একেশ্বরবাদ প্রচার করছিলেন তা তারা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল।
মুসআবের মতো লোককে ব্যবহার করে মুহাম্মদ তাঁর ক্রমবর্ধমান ইয়াছরিব সমর্থকদের সাথে সমঝোতা করেছিলেন, যাদের তিনি- “সাহায্যকারী” বলে অভিহিত করতেন; যাদের মাধ্যমে তিনি তাঁর ভবিষ্যতের সুরক্ষার বাবস্থা নিশ্চিত করবেন। তিনি দ্রুত কাজ শুরু করতে উদগ্রীব ছিলেন, কিন্তু এটা হতে হবে তাঁর দেয়া শর্ত মতে। তাঁর নিরাপত্তার জন্য লোহার মতো শক্ত নিশ্চয়তার দরকার ছিল, কিন্তু তাঁর চেয়েও বড় কথা, তাদেরকে এমন একটা চুক্তিতে অঙ্গীকার করতে হবে যে, তারা তাঁকে যুদ্ধেও সাহায্য করবে। তাঁর শত্রুদের প্রতি তাঁর ঘৃণা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তাঁর ধর্ম গ্রহণ করতে যারা অস্বীকার করেছিল, তিনি তাদেরকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলেন এবং যারা তাঁর উপর অত্যাচার করেছিলেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি যা বলেছিলেন সেটাই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময় তিনি শুধু হুমকি দিয়েছিলেন, কারণ তা করার মত সক্ষমতা তখন তাঁর ছিল না। তাঁর জন্য লোকবল দরকার ছিল। তিনি যদিও সেই সময় স্পষ্টভাবে কাউকে তাঁর পক্ষে লড়াই করতে বলেননি। তাঁকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য তিনি যে জোট খুঁজছিলেন, সেটা বেশ স্পষ্ট ছিল; সেই ইঙ্গিত গোত্র এবং গোত্ররা বুঝতে পেরেছিল বলেই তারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু এখন তিনি প্রকাশ্যে যুদ্ধাভাবাপন্ন মনোভাব প্রকাশ করছেন। তিনি মুসআবকে নতুন ধর্মান্তরিতদের মধ্যে যুদ্ধের ধারণাটি ঢুকিয়ে দিতে নির্দেশ দেন, এবং যখন মুসআব দেখলেন অনুসারীরা যুদ্ধ করতে সম্মতি দিলেন, তিনি মুহাম্মদের কাছে এই খবর পাঠালেন। এই খবর শুনে মুহাম্মদ আবু বকরকে ঘোষণা করলেন যে, তিনি এইমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে একটি নতুন নির্দেশিকা পেয়েছেন: “আমাকে যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে!” এটিকে ঐশ্বরিক ছাপ দিতে, তাড়াতাড়ি কোরআনে রচিত হয়ে গেল “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদের, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম" (১০)।
মুহাম্মদ একটি আনুষ্ঠানিক ও বাধ্যতামুলক অঙ্গীকার চেয়েছিলেন। পরবর্তী তীর্থ মৌসুমে ৭৩ জন পুরুষ এবং দুইজন নারীসহ মোট ৭৫ জন ব্যক্তিগতভাবে তাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার করতে মক্কায় গিয়েছিলেন। সন্দেহ এড়াতে তারা ইয়াছরিবের বহুঈশ্বরবাদীদের সাথে তীর্থযাত্রার অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, যারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। মুসআবের সাথে আগেই সব ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কোরবানির পশু বলির আগের রাতেই তারা মুহাম্মদের সাথে যোগ দেয়। এটি এক আদর্শ সময়, কারণ বলিদানের পর তীর্থযাত্রীরা তিনদিন পর্যন্ত খাওয়াদাওয়া, মদ্যপান, ঘুম এবং যৌনমিলনে ব্যস্ত থাকত। আর তাই তারা সম্পূর্ণ ক্লান্ত অবস্থায় রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যেত। এইভাবে মধ্যরাতে যখন বাকি সবাই গভীর ঘুমের মধ্যে ছিল, তখন ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের শিবির থেকে উঠে ছোট ছোট দলে আকাবার (Aqaba) খাঁড়িতে চলে যায়, যেখানে মুহাম্মদ এক বছর আগে বারোজন ইয়াছরিবীকে ধর্মান্তরিত করেছিলেন।
মুহাম্মদের সাথে ছিলেন তাঁর এক চাচা আব্বাস। যদিও তখনও তিনি ধর্মান্তরিত হননি, তবে আব্বাস মুহাম্মদের সাথে অনেকটা সময় অতিবাহিত করেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন। মুহাম্মদের শত্রুদের সাথে আব্বাসের ব্যবসায়িক সম্পর্কের কারণে তিনি মুহাম্মদের সেরা সংবাদদাতা ছিলেন, যিনি তাঁকে তাদেরই একজন হিসেবে গণ্য করতেন। ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে অথবা তাঁর লোকজনকে অনুসরণ করার ভয়ে মুহাম্মদ অন্য কারো কাছে এই সাক্ষাতের কথা প্রকাশ করেননি, এমনকি আবু বকর বা আলীর কাছেও নয়। ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতরা একত্রিত হওয়ার পর আব্বাস একটি পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন, যেখানে তাদের সমাবেশের কারণ বর্ণনা করেন। প্রয়োজনে মুহাম্মদের পক্ষে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মুহাম্মদের প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকারের কথা বলেন এই বলে যে, “আপনারা যদি মনে করেন যে, তাঁকে বিরোধীদের হাত থেকে রক্ষা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাহলে ধরে নিন আপনি সেই বোঝা ইতিমধ্যেই বহন করছেন। কিন্তু যদি আপনি মনে করেন, আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এবং আপনাদের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁকে পরিত্যাগ করবেন, তাহলে তাঁকে এখনই ছেড়ে যান। কারণ তিনি যেখানে আছেন, সেখানেই নিরাপদে আছেন” (১১)।
তাদের মধ্যে একজন মুহাম্মদকে কিছু কথা বলার জন্য চিৎকার করে উঠলেন। মুহাম্মদ এগিয়ে এলেন, কিছু সূচনা বক্তব্য রাখলেন, কোরআনের আয়াত আবৃত্তি করে বললেন, “আমি আপনাদের আনুগত্যের আহ্বান জানাচ্ছি; আপনারা আমাকে ঠিক সেই রকমভাবে সুরক্ষা দেবেন, ঠিক যেইভাবে আপনারা নারী ও সন্তানদের রক্ষা করেন”।
খাজরাজের এক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন যে, তাঁর গোত্রের ধর্মান্তরিতরা মুহাম্মদের শর্ত মেনে নিয়েছে। “আমরা আমাদের আনুগত্য প্রকাশ করছি, এবং আমরা সেই অস্ত্রধারী যোদ্ধা, যাদের অস্ত্র ঐতিহ্যগতভাবে পিতা থেকে পুত্রের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে” বললেন তিনি। তবে আউসের একজন নেতা সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে মনে করিয়ে দিলেন : মনে রাখতে হবে, জলাধারের (oasis) পাশে বসবাসরত তিনটি ইহুদি গোত্রের সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের জোট ছিল। যদি আমরা মুহাম্মদকে অনুসরণ করি, তাহলে আমাদের পূর্ববর্তী বন্ধন ছিন্ন করতে হবে, সাবেক মিত্রদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে এবং তাঁর ফলে হয়তো অপ্রত্যাশিত পরিণাম ভোগ করতে হতে পারে। তিনি মূলত মুহাম্মদের কাছ থেকে একটি নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ যদি আল্লাহ'র সাহায্য নিয়ে শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে যান, তাহলে যেন তাদের পরিত্যাগ না করেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি আপনার লোকদের কাছে ফিরে যাবেন এবং আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন?”
তাদের আশ্বস্ত করে মৃদু হেসে মুহাম্মদ বললেন, “আমি আপনাদের এবং আপনারা আমার একজন। আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব যারা আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং যারা আপনাদের সাথে শান্তিতে থাকবে, আমিও তাদের সাথে শান্তিতে থাকব” (১২)।
আরেকজন ব্যক্তি দলটিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, তাদের যেন ভ্রম ভাঙ্গে যে তারা কিসের সাথে জড়াচ্ছে, এবং তিনি বললেন : “হে খাজরাজের লোকেরা, আপনারা কি বুঝতে পারছেন যে, এই লোকটির প্রতি আপনার সমর্থনের অঙ্গীকার করার জন্য আপনাদের কি কি অঙ্গীকার করতে হচ্ছে? এটা হচ্ছে সকলের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার”। যার মানে হচ্ছে অনন্তকালের যুদ্ধ, সমগ্র মানবজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, যতদিন না পুরো বিশ্ব অধীনে আসে (১৩)।
মুহাম্মদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জান্নাতে একটি স্থান দেয়া হবে। এই কথা শুনে একজন ধর্মান্তরিত ব্যক্তি এতটাই উৎসাহী হয়ে ওঠেন যে, তিনি পরামর্শ দেন যে তাঁরা সকালেই মিনার নিকটবর্তী তীর্থ শিবিরে তীর্থযাত্রীদের জবাই করবে। মুহাম্মদ অবশ্য তাঁর উত্তেজনা প্রশমিত করেন এই বলে যে, আল্লাহ এখনও তাদের তা করতে নির্দেশ দেননি। জান্নাতের প্রতিশ্রুতিই এই চুক্তিতে সিলমোহর দিয়েছিল। একের পর এক তাঁরা এগিয়ে এসে মুহাম্মদের হাত ধরে এবং তাঁকে রক্ষা করার, তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করে তাঁর ধর্ম প্রতিষ্টা করার এবং তাঁর ধর্মের নির্দেশ মেনে চলবে বলে অঙ্গীকার করেন। তিনি প্রতিজ্ঞারত প্রত্যেক পুরুষকে তাঁর হাত ধরতে দিলেন, কিন্তু তিনি দুই নারীকে তাঁকে স্পর্শ করা থেকে বিরত রাখলেন। অনুষ্ঠান শেষ হলে মুহাম্মদ তাঁর প্রথম আদেশ জারি করলেন যে, অঙ্গিকারকারীরা বারোজন নেতা নির্বাচন করবে। এই নেতারা হবেন অনেকটা 'যীশুর বারো জন শিষ্য' (হাওয়ারী) বা ইহুদিদের বারো গোত্রের মতই। যেমন বারোজন শিষ্য যীশুর কাছে ও বারোটি গোত্র মুসার কাছে জবাবদিহি করতেন, তেমনি এই বারোজন নেতাও মুহাম্মদের কাছে জবাবদিহি করবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর মুহাম্মদ অঙ্গিকারকারীদের ইয়াছরিবে ফিরে যেতে বলেন এবং পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দেন।
এত সতর্কতা সত্ত্বেও, মক্কাবাসীরা এই বৈঠকের কথা জানতে পারে এবং পরেরদিন সকালে তাদের একদল নেতা যুদ্ধের ঘোড়ায় চড়ে খাজরাজ শিবিরে ঢুকে ব্যাখ্যা দাবি করে। “হে আল-খাজরাজের জনগণ, আমাদের কাছে তথ্য এসেছে যে, আপনারা গতরাতে আমাদের লোকের সাথে দেখা করেছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছেন” অভিযোগ ছুঁড়ে দেয়া হল (১৪)। খাজরাজের তীর্থযাত্রীদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে কিছুই জানত না, তাই এই অভিযোগে শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যারা জানত তাঁরা মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। মক্কাবাসীরা পিছিয়ে যায়, কিন্তু তাঁরা নিশ্চিত ছিল যে একটি ষড়যন্ত্র চলছে। আর তাই তাঁরা অন্যান্য গোত্র এবং গোত্রের লোকেদের সাথে এই বিষয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ হলেও একটি চুক্তি যে হয়েছিল সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন।
ইয়াছরিব তীর্থযাত্রীদের প্রধান যারা ছিলেন তারা তখন মিনায় (mina) একটি শিবিরে অবস্থান করেছিলেন, কিন্তু খাজরাজ এবং আউস গোত্রের ভেতর যারা ষড়যন্ত্র করে তীর্থযাত্রায় প্রবেশ করেছিল তাঁরা ইতোমধ্যেই শহর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এই কথা জানতে পেরে মক্কাবাসীরা তাদের পিছু নেয়। তাঁরা ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে দুজনকে আটক করে। একজন হচ্ছে সাদ বিন উবাদা, ইয়াছরিবের একজন ব্যবসায়ী এবং খাজরাজের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং অন্যজন মুনযির বিন আমর, তবে তিনি পরে পালাতে সক্ষম হন। মক্কাবাসীরা সাদকে তাঁর ঘাড়ের পেছনে হাত বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়, কিন্তু তিনি দাবি করেন তাঁকে এভাবে আটক করা অনুচিত, কারণ তিনি মুহাম্মদের রক্ষক মুতইম বিন আদির অন্যতম পুত্র জুবায়ের ইবনে মুতইমের সাথে সুরক্ষার চুক্তি করেছেন। এদিকে তিনি আবার তিনি ছিলেন আবু সুফিয়ানের এক ঘনিষ্ঠজন হারিছের (Harith) আত্মীয়। তিনি তাদের কাছে নিরাপত্তার প্রাপ্য, কারণ সাদ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন যখনই তাঁরা ব্যবসার জন্য ইয়াছরিবে যেতেন। দু'জন মক্কাবাসী সাদের দাবির সত্যতা নিশ্চিত করেছে এবং সাদকে ঠিক সময়মতই মুক্তি দেয়া হয়, যখন তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে মুক্ত করার জন্য মক্কায় হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সাদের সঙ্গীরা পালিয়ে বেঁচে যাওয়া মুনযিরের কাছ থেকে সাদের আটক হবার কথা জানতে পেরেছিলেন এবং তাঁকে উদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন (১৫)।
ইয়াছরিবে ধর্মান্তরিতদের আনুগত্যে উৎসাহিত হয়ে মুহাম্মদ তাঁর মক্কাবাসী অনুসারীদের হিজরত করার আদেশ দিয়েছেন। অলৌকিকতার প্রমাণ হিসেবে তিনি তাদের বলেন: “আমাকে হিজরতের স্থানটি দেখানো হয়েছে; আমাকে দুই পাথরের মাঝখানের একটি লবণাক্ত সমভূমি দেখানো হয়েছে, যার দুই পাশে খেজুর গাছ দিয়ে ভরা”। তিনি আসলে প্রাচীন লাভার বিছানার কথা বলেছেন, যা ইয়াছরিবকে পূর্ব এবং পশ্চিমে ঘিরে রেখেছিল (১৬)। এইভাবে মক্কা থেকে দ্বিতীয়বার নির্বাসন শুরু হয় এবং বিশ্বাসীরা আগের অভিবাসীদের মতই একই কৌশল ব্যবহার করেন - তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে যাত্রা করেন। ইয়াছরিবে ঢুকেই তাঁরা 'সাহায্যকারীদের' সাথে যোগ দেন। মুহাম্মদ এখন তাঁর নতুন মিত্র এবং ধর্মান্তরিতদের নাম দিয়েছেন সাহায্যকারী (আনসার)। এই নির্বাসিতদের মধ্যে অনেকেরই মুহাম্মদের রচিত কোরানের কিছু অংশ বা পুরোটা মুখস্থ ছিল, তাই তারা নতুনদের সাথে যোগ হয়েই তাদেরকে কোরআন শেখাতে থাকেন। পরবর্তী দুই মাসে সত্তর থেকে একশজনের মতো অনুসারী উত্তরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। মুহাম্মদও আবিসিনিয়াতে অবস্থানরত অনুসারীদের বার্তা পাঠান যে, তাদের এখন ইয়াছরিবে আসার জন্য 'আল্লাহর অনুমতি' আছে। কিছুদিনের মধ্যেই আবিসিনিয়ায় থাকাদের কেউ কেউ ইয়াছরিবে আসতে শুরু করেন। মুহাম্মদ তাঁর মক্কাবাসী অনুসারীদেরকে ইয়াছরিবী সাহায্যকারীদের থেকে পার্থক্য করার জন্য একটি নাম দিয়েছিলেন। যাদের নাম হয়েছে মুহাজির বা 'হিজরতকারি'।
এই হিজরত সবার জন্য মসৃণভাবে হয়নি। যখন মক্কাবাসীরা আবিষ্কার করে যে সোহাইব (Sohayb) নামের ধর্মান্তরিত মুক্ত ক্রীতদাস, যার ডাকনাম ছিল ‘রোমান’, হিজরতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন তারা তাঁকে অকৃতজ্ঞ বলে। তাঁর জন্য তাদের অবদান ভুলে যাওয়ার জন্য তাঁকে তিরষ্কার করে, এবং বন্দি করে। বাইজান্টিয়ামের (Byzantium) কোথাও তিনি শিশু হিসেবে ধরা পড়েন, তাঁকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য মক্কায় আনা হয়, কিন্তু পরে তাঁকে স্বাধীন করে দেয়া হয় এবং তাঁর প্রাক্তন মালিকের সুরক্ষার অধীনে থেকে তিনি উন্নতি লাভ করেন। মক্কাবাসীরা শুধু তখনই তাঁকে চলে যাওয়ার (হিজরতের) অনুমতি দেয়, যখন তিনি তাঁর কাছে জমা রাখা টাকা ফিরিয়ে দিতে সম্মত হন (১৭)। প্রথমদিকের ধর্মান্তরিতদের একজন এবং আবুল হাকামের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আয়াশ (Ayyash) উমরের সাথে গোপনে ইয়াছরিবের পথে যাত্রা করেন, কিন্তু আবুল হাকামের সহযোগীরা তাঁকে অপহরণ করে মক্কায় ফিরিয়ে আনে, এবং তাঁকে বন্দি করে রাখা হয় যতক্ষণ না তিনি মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করেন। আবুল হাকাম মক্কাবাসীদের উপদেশ দেন, “আপনারা আপনাদের মূর্খদের সাথে মোকাবেলা করুন, যেমনটা আমরা আমাদের এই নির্বোধদের মোকাবেলা করেছি” (১৮)। আয়াশ পরে ইয়াছরিবে পালিয়ে যান, কিন্তু তিনি ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, তিনি মুহাম্মদের নিন্দা করার জন্য হয়ত জাহান্নামের আগুনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, যদিও তা জোরপূর্বক করানো হয়েছিল। মুহাম্মদ তাঁকে এটা নিয়ে চিন্তা না করতে বলেন; কারণ চাপের মুখে ধর্মত্যাগী হওয়ার ভান করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা তা জানতেন এবং অনুমোদন দিয়েছিলেন।
আকাবার বৈঠকের পর মুহাম্মদ তিন মাসের মতো মক্কায় অবস্থান করেন, ব্যক্তিগত বিষয়যদি গুছিয়ে নিতে, বিশেষত থেকেছেন বিশ্বাসীদের হিজরতের তত্ত্বাবধান করার জন্য। তিনি তাঁর অনুসারীদের বললেন যে, ঈশ্বর এখনও তাঁকে চলে যাওয়ার আদেশ দেননি। তিন মাসের শেষে মক্কায় আর কোনো অনুসারী ছিল না। শুধুমাত্র তিনি, আবু বকর, আলী এবং তাদের পরিবার, মুষ্টিমেয় কর্মচারীরা এবং অল্প কিছুসংখ্যক বিশ্বাসী রয়ে গেলেন, যারা হয় বন্দি হয়েছিলেন অথবা মক্কা ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে অসহায় বোধ করছিলেন।

[আকাবার অঙ্গীকারঃ মুহাম্মদ ইয়াছরিবের সমর্থকদের কাছ থেকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি লাভ করেন; এবং এই ইয়াছরিব পরে মদিনা নামে পরিচিতি পায়। ছয় ডজন লোক তীর্থযাত্রী হিসেবে ছদ্মবেশ ধরে তাঁর ধর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, যারাই তাঁকে অস্বীকার করবে তাদের সকলের বিরুদ্ধে লড়াই করবে এই শপথ করে। এই অঙ্গীকার মুলত মানবজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা, যা স্থায়ী হবে যতক্ষণ না বিশ্বের সকল মানুষ তাঁর ধর্ম গ্রহণ করবে এবং তাঁকে আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হিসেবে বিশ্বাস করবে। এ সময়ের মধ্যে মুহাম্মদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। মুতইম মারা যান এবং মুহাম্মদ যেমনটা ভেবেছিলেন, তাঁর ছেলেরা সুরক্ষা প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও সে এখন উন্মোচিত হয়ে গেছে, সুরক্ষাহীন, তবুও মক্কাবাসীরা তাঁকে মেরে ফেলার জন্য গড়িমসি করছিলেন।]
সেই সময়ে মুহাম্মদের নিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়েছিল। মুতইম মারা যান, আর মুহাম্মদের আনুমান মতোই তাঁর ছেলেরা তাদের প্রতিরক্ষা তুলে নেন। এমনকি যদিও তিনি এখন উন্মুক্ত হয়ে পড়েছেন, তবু মক্কাবাসীরা তাঁকে হত্যা করতে ইতস্তত করছিল। কিছু নেতারা তাঁকে হত্যা করার বিরোধিতাও করছিলেন গৃহযুদ্ধের ভয়ে এবং প্রতিহিংসার চক্রে হয়তো আটকে যাবেন, এই যুক্তিতে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের পরিস্থিতি ডুবতে শুরু করেছিল। বছরের পর বছর ধরে তাদের নিষ্ক্রিয়তার ছাতার তলায়, মুহাম্মদ এখন ইয়াছরিবে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতার একটি কেন্দ্রীভূত গোত্র তৈরি করেছেন, যাদের যুদ্ধবাজের খ্যাতি ছিল, মক্কাবাসীরা এটাই ভয় পাচ্ছিলেন। যার ফলে তারা শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত হতে পারে এবং তাদের বাণিজ্যও বিপন্ন হতে পারে। তাদের কাফেলারা হয় ইয়াছরিবের ভেতর দিয়ে, বা তাঁর আশেপাশে চলাফেরা করত। তারা যে পথেই থাকুক না কেন, তারা ইয়াছরিবের আওতার মধ্যেই থাকতেন। এই উপলব্ধি তাদের মেরুদণ্ডকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তাদের অস্তিত্ব বাণিজ্যের উপর নির্ভর করত। পশুপালকদের মাংস এবং দুধ ব্যতিরেকে তাদের সমস্ত খাদ্য আমদানি করতে হত। তার মানে পণ্য কেনার জন্য টাকা দরকার। মন্দির এবং তীর্থযাত্রার রাজস্ব ছাড়াও, তাদের অর্থ আসত বৃহত্তর সিরিয়ার সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে। যদি বাণিজ্যের সেই পথ হারিয়ে যায়, তাহলে শহরটি ধীর গতিতে মরে যাবে। তবে অনেক দেরি হওয়ার আগেই তাদের মুহাম্মদের বিহিত করতে হবে।
মক্কাবাসীরা একটি জরুরি মিটিংয়ের আহ্বান জানায়। তাতে রাবিয়া ভ্রাতৃদ্বয়, আবু সুফিয়ান, আবুল হাকাম, নাদের আল- হারিছ, উমাইয়া বিন খালাফ, উকবাহ ইবনে মুয়াইত এবং আরও ডজনখানেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, যার মধ্যে মুতইম আদির এক ছেলে এবং এক ভাইও ছিলেন। মুহাম্মদের প্রতি তাদের ক্ষোভ জোরালো হয়ে উঠল যখন তাঁরা বিগত দশকে তাঁর সৃষ্ট সকল বিঘ্ন এবং সংঘাতের কথা স্মরণ করলেন। তাঁরা জানত যে, তাদের একটা কিছু করতে হবে, কিন্তু কি করতে হবে তাতে তাঁরা একমত হতে পারছিল না। কেউ কেউ তাঁকে ঘরে বন্দি রেখে চাবি দূরে ফেলে দেয়ার পরামর্শ দিল। তারা অন্যান্য ঝামেলাকারীদের সাথে এমনটাই করছেন, কিন্তু এই ধারণাটি গ্রহণ করা হলো না, কারণ তাঁর অনুসারীরা সম্ভবত তাঁকে মুক্ত করার জন্য মক্কা আক্রমণ করবে। তারপর তাঁকে নির্বাসিত করবে। অন্য আরেকজন পরামর্শ দিল, “সে যদি চলে যায় তাহলে আমরা তাঁর থেকে মুক্তি পেয়ে যাব এবং আমরা আগের মতই আমাদের কাজে মনোনিবেশ করতে সক্ষম হব” (১৯)। সেই পরামর্শটিও খারিজ হয়ে যায়। তাহলে এটি ইয়াছরিবের লোকজনকে দিয়ে মক্কার বিরুদ্ধে ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য সুযোগ করে দেবে, যেটা মুহাম্মদ চাচ্ছিলেন। আবুল হাকাম যুক্তি দেখান, একমাত্র উপায় হচ্ছে মুহাম্মদকে হত্যা করা, কিন্তু একজন এই কাজটি করতে পারবে না, তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া উচিত। তিনি প্রত্যেক গোত্রের একজন পুরুষ বেছে নিলেন - যারা বয়সে তরুণ, শারীরিকভাবে শক্তিশালী। তারা একসাথে তাঁকে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেবে এবং একইভাবে হাশিমি গোত্র বাদে সকল মক্কাবাসী গোত্র মুহাম্মদের রক্তের জন্য দায়ী থাকবে। আব্দুল মুত্তালিবের বংশধরদের কি সবার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাহস হবে? তখন রক্তের টাকা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না, এবং অংশগ্রহণকারী সকল গোত্রই এই অর্থ প্রদানে অবদান রাখবে। এই কথামতেই আলোচনা শেষ হল। মক্কাবাসী আবুল হাকাম যেভাবে মুহাম্মদকে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেইভাবে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করতে রাজি হয়েছিলেন। মক্কায় এই কথা গোপন রাখা কঠিন ছিল। খাদিজার বাড়িতে অবস্থান নেয়া মুহাম্মদ এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেই পালানোর পরিকল্পনা করেন। তিনি মনে করেছিলেন আততায়ীরা সম্ভবত রাতে বাড়িতে ঢুকে সে যখন ঘুমিয়ে থাকবে তখন আক্রমণ করবে। তিনি আলীকে আদেশ দিলেন চামড়ার চাদরের নিচে বিছানায় শুয়ে থাকতে। হয় মুহাম্মদ তাঁর চাচাত ভাইকে তাঁর ধর্মের জন্য উৎসর্গ করতে চেয়েছে, অথবা তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, মক্কাবাসীরা তাদের তলোয়ার হঠাৎ কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে দেবে না। তারা অবশ্যই কম্বলটা টেনে দেখবে, নিচে কে শুয়ে আছে। ইতোমধ্যে মুহাম্মদ, সম্ভবত মহিলাদের পোশাক পরে নেন এবং একটি পর্দা পরেন, যাতে তাঁর বাড়ির আশপাশের লোক চিনতে না পারে, সেখান থেকে লুকিয়ে তিনি আবু বকরের বাড়িতে চলে গেলেন।
সম্ভবত সরল মুখে মুহাম্মদ তাঁর বন্ধুকে জানান যে, ঈশ্বর তাঁকে ইয়াছরিবে হিজরত করার আদেশ দিয়েছেন এবং আবু বকরকে তাঁর সঙ্গী হতে হবে। যখন মুহাম্মদ তাঁকে বললেন যে, ঈশ্বর তাঁর নাম সঙ্গী হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তখন আবু বকর এতটাই অভিভূত হয়ে গেলেন যে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
তাদের নষ্ট করার এত সময় ছিল না। মক্কাবাসীরা এই প্রতারণা আবিষ্কার করার সাথে সাথে তল্লাশি শুরু করবে। মুহাম্মদ এটা ভেবেছিলেন, তাঁর শত্রুরা জানত যে তিনি ইয়াছরিবের দিকে যাচ্ছেন, তাই তারা প্রথমে উপত্যকার উত্তর অংশ এবং ইয়াছরিবের দিকে যাওয়ার রাস্তায় তল্লাশি করবে। মুহাম্মদ ও আবু বকর তাই পায়ে হেঁটে প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিণে চলে গেলেন এবং একটা গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। শুধুমাত্র আবু বকরের কিশোরী কন্যা আসমা (Asma), তাঁর ছেলে আবদুল্লাহ এবং তাঁর ব্যক্তিগত দাস আমির ফুহায়রা (Amir Fuhayra) তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতেন। গোপন আস্তানায় যাওয়ার আগে আবু বকর একজন বেদুইন পথ প্রদর্শককে ভাড়া করেন, যিনি দুটি অশ্বারোহী উট নিয়ে তাদের কাছে সময়মত আসেন এবং এই বেদুইন পাহাড় ও উপত্যকার পেছনে দিয়ে তাদের ইয়াছরিবে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
[মুহাম্মদ ইয়াছরিবে পালিয়ে গেলেন। মুহাম্মদের ধর্মপ্রচারের প্রচেষ্টায় উদ্বিগ্ন হয়ে মক্কাবাসী নেতারা তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন এবং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু আবু বকরের সাথে মক্কা থেকে পালিয়ে যান। তাঁরা দুজন তিনদিন একটি গুহায় লুকিয়ে ছিলেন এবং উটের পিঠে সাওয়ার হয়ে মরুভূমি দিয়ে রওনা দেন এবং রাতে রওনা দেয় সনাক্তকরণ এড়াতে। দুই সপ্তাহের যাত্রার পর ইয়াছরিবে পৌঁছে যান, যেখানে তিনি পরবর্তী দশ বছর থাকবেন।]
যখনই মক্কাবাসীরা বুঝতে পারল যে, তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে, তখনই মুহাম্মদের মাথার দাম ধার্য করা হলো - যে কেউ তাঁকে ধরে নিয়ে আসবে, তাঁর জন্য থাকবে একশোটি উট। প্রচন্ড সূর্যের তাপের মধ্যেও তাঁরা মক্কার চারিপাশে প্রতি মাইল খুঁজতে থাকে। কিছু জানতে পারে এমন সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। মুহাম্মদ ও আবু বকর গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পরেরদিন আবুল হাকাম আবু বকরের বাড়িতে এসে আসমার কাছ থেকে তাঁর অবস্থান জানতে চান। আসমা বলেন তিনি জানেন না। এই কথা শুনে আবুল হাকাম তাঁর মাথার একপাশে আঘাত করেন, কিন্তু কোন লাভ হয়নি, সে তবুও কথা বলেনি। মুহাম্মদ ও আবু বকর তিনদিন গুহায় ছিলেন। আসমা তাদের খাদ্য ও জল নিয়ে আসেন যা তাদের যাত্রাপথের জন্য দরকার ছিল। যাওয়া-আসার সময় তিনি একটি ছাগলের পালের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেন, যাতে কেউ তাঁর পদচিহ্ন খুঁজে না পায়। ছাগলগুলোর দেখাশুনা করা সেই মেষপালক নিজেও পালাচ্ছিলো। মক্কায় আবু বকরের ছেলে আবদুল্লাহ শহরবাসীর সাথে মিশে জানার চেষ্টা করতেন তাঁরা কি করতে চাচ্ছে এবং প্রতিরাতে মুহাম্মদের কাছে তথ্য দিতেন। একপর্যায়ে একটি অনুসন্ধানকারী দল গুহার কাছাকাছি চলে আসে, কিন্তু প্রবেশপথটি উপেক্ষা করে চলে যায়। তৃতীয়দিনে যখন অনুসন্ধানকারীরা সব জায়গা দেখা শেষ হয়েছে বলে ভেবে নেয়, তাঁরা হাল ছেড়ে দেয়। তখন বেদুইন পথপ্রদর্শক ও আবু বকরের দাস আমির ফুহায়রা তাদের উট নিয়ে হাজির হয় এবং এই চারজন ইয়াছরিবের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
পথপ্রদর্শক তাদের প্রথমে আরো দক্ষিণে নিয়ে গেল, এবং পরে পশ্চিমে ফিরে যাত্রা শুরু করল। উত্তর দিকে মোড় নেয়ার আগে তারা লোহিত সাগরের দিকে অর্ধেকটা পথ পাড়ি দিলেন। সমস্ত পথ আঁকাবাঁকা চলতে থেকে তাঁরা প্রায় দুই সপ্তাহ সফর করলেন। তাদের যাতে কেউ খুঁজে না পায় এজন্য তাঁরা মূলত মানববসতিহীন এলাকা দিয়ে যাচ্চিলেন। অবশেষে তাঁরা ইয়াছরিব পৌঁছলেন; ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কিন্তু বিপদমুক্ত। আবু বকর তাঁর সর্বশেষ সম্বলটুকু নিয়ে এসেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে মুহাম্মদের ধর্মের জন্য মূল্য দিতে গিয়ে তাঁর সম্পদ চল্লিশ হাজার দিরহাম থেকে ছয় হাজার দিরহামে নেমে আসে। জল, চামড়ায় মোড়ানো জিনিসপত্রের মাঝে মোটামুটি পঞ্চাশ পাউন্ড রূপার মুদ্রা গুজে উটে বোঝাই করে নিয়ে আসেন। মুহাম্মদ পরবর্তীতে তাঁর রচিত কুরানে পালিয়ে আসার এই ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করেন। ওনার ঈশ্বরের কন্ঠে উনি বললেনঃ “আর যখন কাফিররা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দি করতে অথবা তোমাকে হত্যা করতে কিংবা তোমাকে তাড়িয়ে দিতে। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম” (20)।
হেরা পর্বতের গুহার অভিজ্ঞতা লাভের পর তেরোটি বছর পার হয়ে গেছে। সেই সময়ে তিনি আরো বেশি উজ্জ্বল আলো ঝলমলে আকৃতি, এবং আরো অদ্ভুদ সব শব্দ শুনেছিলেন (২১), তিনি সেসবের অর্থ নিয়ে ভুল সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। সংঘাতের সময়কালীন রচিত আয়াতের অর্ধেকের বেশি পরে তাঁর কুরানে সন্নিবেশিত হয়েছিল, আর সেই আয়াতসমূহ আর সেগুলোর বিরোধিতাকারীদের প্রতি সংঘর্ষ উস্কে দেয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ধর্মের ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন। মুহাম্মদের মাঝে বিগলিত ঘৃণা দিয়ে পূর্ণ, উত্তপ্ত লাভার একটি প্রকোষ্ঠ তৈরি হয়েছিল। এটি ক্রমশ উপরদিকে বেরিয়ে আসতে চাপ দিচ্ছিল। এমনকি তেপ্পান্ন বছরের পুরোনো বাড়িঘর ফেলে আসার পরেও, স্বর্গ থেকে মক্কাবাসীদের উপর বর্ষিত অভিশাপের মাঝে তাঁর এই ঘৃণার লাভা টের পাওয়া যাচ্ছিল। হাতের তালুতে দুই কান ঢেকে, উটের মত হাঁটু গেড়ে বসে, দুই বাহু দুই পাশে মেলে দিয়ে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে, কপাল মাটিতে স্পর্শ করার ভঙ্গিতে, তিনি মক্কাবাসী আর তাদের প্রথম সন্তানের মৃত্যুর জন্য প্রার্থনা করতেন; তিনি তাদের উপর প্লেগ, গুটিবসন্ত আর দুর্যোগের শাস্তির জন্য প্রার্থনা করতেন। “হে ঈশ্বর, তুমি তাদের উপর যোসেফের (Joseph) মতো আমার জন্য সাতটি বছর প্রদান করো” (২২)।
এটা ছিল খ্রিস্টীয় ৬২২ সাল, কিন্তু মুহাম্মদের অনুসারীরা ইয়াছরিবে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তাদের বর্ষপঞ্জিকার গণনা শুরু করে। তারা এটাকে হিজরতের বছর বলে থাকে। এটাই হল মুহাম্মদের ঈশ্বরের ধারণার উপর নিজেকে সমর্পণের প্রথম বছর। এটিই ছিল সেই বছর, যখন মুহাম্মদ তাঁর ঈশ্বরের ধারণার কাছে মাথানত করতে অস্বীকার করা সবার উপর এবং বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। এটি ছিল পুরো বিশ্বের উপর যুদ্ধের বছর।