অধ্যায় ৯ আমাকে মান্য কর
নবী, নবী এবং আরও অনেক নবী, পুরো দুনিয়া যেন নবীতে ছেয়ে গিয়েছিল! এক লক্ষ চব্বিশ হাজার সংখ্যাটি নিয়ে মুহাম্মদ এসেছিল। তাদেরকে মানব সম্প্রদায়ের কাছে আল্লাহর ক্রোধের সতর্কতাসহ প্রেরণ করা হয়েছিল, যাতে তারা পথভ্ৰষ্ট না হয়; কিন্তু লোকেরা তাদের কথায় কান দেয়নি যেমন মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের কথা শুনছিল না। তারা আল্লাহর মুখপাত্রের বার্তা মানেনি; সুতরাং তারা ধ্বংস হয়েছিল। মুহাম্মদ তাদের মধ্যে এসব শোচনীয় কাহিনী সম্পর্কে কিছু বলার জন্য আল্লাহকে নিয়ে এসেছিলেনঃ “মুসার গল্পটি কি এখনও তোমার কাছে পৌঁছেনি?” (১)। এবং নূহ (Noah), জন (Jonah), ইব্রাহিম (Abraham), লুত (Lot) এবং জোসেফ (Joseph) প্রমুখদেরও।
মুহাম্মদ তাঁর প্রথমদিকের কোরআন রচনায় মুহাম্মদ বাইবেলের চরিত্রগুলো উল্লেখ করেছিলেন, তবে অতিরিক্ত বিশদ বিবরণ দিয়েছিলেন। তাঁর অনুসারীরা যখন আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে শুরু করল তখন তিনি আরও বিশদ সংস্করণের সূচনা করেছিলেন। ইহুদি ধর্মগ্রন্থের প্রধান নায়কদের কিংবদন্তিগুলিকে পরিশুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের কাহিনীগুলো পুনরায় এমনভাবে পুনরুল্লেখ করেছিলেন যেন তাঁরা স্বর্গ থেকে মুহাম্মদের কাছে একেবারে নতুনভাবে হস্তান্তরিত হয়েছিল।
কোরানের নবী-কাহিনীর বেশিরভাগ গল্পেই দেখায় যে, মুহাম্মদ বাইবেলের বিবরণীর চেয়ে ইহুদি কিংবদন্তির নবীদের সাথে বেশি পরিচিত ছিলেন। এই কিংবদন্তিগুলির গল্প মুহাম্মদের সময়কালে ইহুদিদের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ছিল, যা পরবর্তীতে বাইবেলের লৌকিক ইহুদি সংস্করণ হিসেবে ইহুদি যাজকদের ধর্মোপদেশের অনুপ্রেরণা হয়েছিল। আব্রাহামের গল্পের মাধ্যমেই বোঝা যায় যে, মুহাম্মদের উপর সেগুলোর প্রভাব স্পষ্টতই ছিল । ইহুদি কিংবদন্তিতে তাঁকে পৌত্তলিক- বিরোধী সংগ্রামী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। যৌবনে তিনি ঈশ্বর-রাজা নমরুদের (Nimrod) মূর্তিগুলি ধ্বংস করে দেন এবং তাঁর শাস্তি হিসেবে তাঁকে জন্য জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হয়; কিন্তু তিনি অদৃশ্যভাবে বেঁচে যান। আব্রাহামের মূর্তিবিরোধী কর্মকাণ্ড তুলে ধরার জন্য মুহাম্মদের আল্লাহ এই কথাগুলো বর্ণনা করেছেন এভাবে :
“অতঃপর সে মুর্তিগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিল তাদের বড়টি ছাড়া, যাতে তারা তাঁর দিকে ফিরে আসে। তারা বলল, ‘আমাদের দেবদেবীদের সাথে কে এমনটি করল? নিশ্চয় সে জালেম'। তাদের কেউ কেউ বলল, 'আমরা শুনেছি এক যুবক এই মুর্তিগুলোর সমালোচনা করে। তাকে বলা হয় ইবরাহীম'। তারা বলল, 'তাহলে তাকে লোকজনের সামনে নিয়ে এসো, যাতে তারা দেখতে পারে”। (২)
ইহুদি কিংবদন্তির ইব্রাহিমের মতো মুহাম্মদের ইব্রাহিমকেও পুড়িয়ে মারার চেষ্টার নিন্দা করা হয়েছে - “তারা বলেছিল, 'তাঁকে একটি চুল্লি তৈরি কর, এবং তাঁকে জ্বলন্ত আগুনে ফেলে দাও!” (৩)। জেনেসিসে (Genesis) এ ঘটনার উল্লেখ নেই। কেবলমাত্র ইহুদি কিংবদন্তিতে এটির উল্লেখ পাওয়া যায়, এবং মুহাম্মদের এই কিংবদন্তির গল্প ব্যবহারের এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এ থেকে বোঝা যায় যে, মুহাম্মদের উৎসগুলো বাইবেল অপেক্ষা ইহুদি নবীদের কিংবদন্তীর সাথে বেশি সাবুজ্যপূর্ণ।
কোরানের উপর এই ইহুদি রূপকথার প্রভাব এতই বিস্তৃত যে, ইতিহাসবিদ ডব্লু সেন্ট ক্লেয়ার টিসডাল (w. St. Clair Tisdall) এই মন্তব্য করেছিলেন – “মুহাম্মদ মনে হয় ওল্ড টেস্টামেন্টের (Old Testament) নীতিগত গ্রন্থগুলিতে নবীদের সম্পর্কিত সত্য ইতিহাস জানত না” (৪)। তবুও পরে যখন তাঁকে এই বিভ্রান্তগুলির সাথে মোকাবিলা করতে হয়েছিল, মুহাম্মদ সাহসের সাথে দৃঢ়ভাবে জোর দিয়েছিলেন যে, তাঁর সংস্করণগুলিই সঠিক ছিল, কারণ সেগুলি স্বয়ং ঈশ্বর ফেরেশতার মাধ্যমে তাঁকে নির্দেশ করেছিলেন। অন্যদেরগুলো ছিল ঈশ্বরের কথার বরখেলাপ।
ধর্মগুলি সর্বদা একে অপরকে প্রভাবিত করে, তবে ভিনদেশী ধর্মীয় ধারণা এবং অনুশীলনগুলি আত্তীকরণের প্রক্রিয়াটি সাধারণত সময়ের সাথে সাথে ঘটে এবং তা সমগ্র সংস্কৃতিকেই গ্রাস করে নেয়। মুহাম্মদের ক্ষেত্রে ‘ধার করার' কাজটি এতটাই দ্রুত আর নির্লজ্জভাবে ঘটেছে যে, ঐতিহাসিকগণ একে রীতিমতো জোচ্চুরি বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইহুদিদের কাছে মূল্যবান কিছু ছিল। তিনি এটি চেয়েছিলেন, এবং নিয়েছিলেন। নিজেকে নবী হিসেবে দেখার নিজস্ব ধারণাকে আঁকড়ে রাখার জন্য তাঁর ইহুদি গল্পগুলির প্রয়োজন ছিল। তাঁর গল্পের পুনর্নির্মিত সংস্করণগুলিতে তাই দেখা যায়, নবীগণ তাঁর লোকদের কাছ থেকে যেমন প্রত্যাখানের শিকার হয়েছিলেন তেমনি মক্কাবাসীদের দ্বারা তাঁর প্রত্যাখানের ঘটনাকে মুহাম্মদ প্রমাণ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন যে, তিনি নিজেকে যা বলে দাবি করেছেন তিনি আসলে তাই-ই।
মুহাম্মদ এবং মক্কাবাসীদের মধ্যকার ধর্মীয় বিতর্ক অব্যাহত ছিল, কিন্তু এর তীব্রতা অন্তত সাময়িকভাবে হলেও কমে গিয়েছিল। এটি ঘটেছিল যখন মুহম্মদ শত্রুতা দ্বারা জর্জরিত হয়ে তাঁর প্রথম দিককার ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের দেশত্যাগের দিকে পরিচালিত করেছিলেন এবং সমঝোতার উপায় গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মক্কার দেবদেবীদের উপর সরাসরি আক্রমণ করা থামিয়ে দিলেন, এবং এর পরিবর্তে তিনি তাঁর মতবাদের ব্যাখ্যা ও তা রক্ষা করার দিকে মনোনিবেশ করলেন। মক্কাবাসীদের কাছে মুহাম্মদ তখনও এক বিভ্রান্ত ধর্মচ্যুত হাশিমী, যিনি চাচাত ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরেক ভাই এবং ছেলের বিরুদ্ধে বাবাকে দাঁড় করিয়েছিলেন, কিন্তু নতুন করে ধৈর্যশীল সাধুর বেশ তাঁর জন্য স্বস্তি নিয়ে এসেছিল।
মন্দিরের ছাউনির নিচের অর্ধবৃত্তাকার মেঝেতে, কিংবা মন্দিরের মুখোমুখি নগর ভবনে জড়ো হয়ে সভা করার সময় এবার মুহাম্মদকে মক্কার নেতা এবং মতামত প্রদানকারীদের মাঝে বসতে দেয়া হয়েছিল; এবং তিনি শহরের চারপাশে অনুষ্ঠিত ছোট গোত্রসমূহের সভায় অংশ নিয়েছিলেন। এই জাতীয় সমাবেশে বক্তৃতা না দিলে সবাই হাঁটু ভাঁজ করে বসে থাকত; কারো কিছু বলার থাকলে সে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য পেশ করত। মুহাম্মদকে যখন কথা বলার সুযোগ দেয়া হতো, তিনি তাঁর কথা বলতেন; মক্কাবাসীরা শুনত এবং বিনম্রভাবে সাথে বিতর্ক করত।
এখন ধৈর্যশীল ধর্মপ্রচারক মুহাম্মদ নবী কাহিনী চালু করলেন। নবীদের সতর্কবার্তা সহ প্রেরণ করা হয়েছিল কিন্তু তারা সেই কথায় কান দেয়নি, সে কথাটাই বারবার বলে যাচ্ছিলেন । অস্বীকারকারীদের কি পরিণতি হয়েছিল, তাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হতো। মুহাম্মদ তাঁর উদ্ভাবিত নবীদের গল্পের একটিতে বলেছেন, “সামুদ সম্প্রদায়কে (Thamudites) দেখো, যাদের প্রতি আরবের নবী সালেহকে প্রেরণ করা হয়েছিল”। সামুদ সম্প্রদায় তাদের নবী সালেহকে মানেনি, যখন তিনি তাদের বলেছিলেন যে, তারা যদি পরিত্রাণ কামনা করে তবে তাদের অবশ্যই ঈশ্বরের ইচ্ছার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। যদি তারা তাঁর নির্দেশনা অনুসরণ না করে, তবে তারা পরের জীবনে আগুনের শাস্তির মুখোমুখি হবে; এবং তারা এই ইহজীবনেও ঈশ্বরের ক্রোধের শিকার হবে। মুহাম্মদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাথরের শহর মাদাইন সালেহের (Madain Saleh) চিত্রগুলি একসাথে করেছিলেন। মুহাম্মদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, ঈশ্বরের নবীকে না মানার জন্যই তাদের শাস্তি পেতে হয়েছিল।
মক্কাবাসীরা শুনছিল, কিন্তু তারা মুগ্ধ হল না। তাদের মধ্যে অনেকেই সফরের সময়, বালি-পাথরের পর্বতমালায় খোদাই করা পেট্রার (Petra) নাবাতাইনদের একটি শাখা, সামুদীয়দের পরিত্যক্ত সমাধিসৌধ এবং মন্দিরগুলি পরিদর্শন করত। তারা সেই ইতিহাস জানত। বহু শতাব্দী আগে, পশ্চিম আরব জুড়ে যখন কাফেলা বাণিজ্যের প্রসার হচ্ছিল। তখন মাদাইন সালেহ (Madain Saleh) একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল, কিন্তু রোমানরা আরব ব্যবসার বেশিরভাগই ছিনিয়ে নিয়েছিল, যখন তারা লোহিত সাগর থেকে সরাসরি ভারতে আসা যাওয়া করতে শিখেছে। ঈশ্বর নয়, বরং বাণিজ্যের প্রতিযোগিতাই মাদাইন সালেহের মতো কাফেলা শহরগুলিকে ধ্বংস করেছিল। এরপর কাফেলা বাণিজ্য মক্কায় ধন-সম্পদ বৃদ্ধিতে আবারো গুরুত্ব ফিরে পেল। মক্কা যদি কখনও সামুদ জাতির পরিণতি ভোগ করে, তবে তা হবে অন্য কারও দ্বারা তাদের ব্যবসার দখল নেয়ার ফল, মুহাম্মদের আল্লাহ্র অগ্নিশ্বাসের কারণে নয়।
নাদের নামের একজন ছিলেন যিনি ইয়াছরিবের ইহুদি পন্ডিতদের কাছ থেকে কৌতূহলমূলক নানা প্রশ্ন নিয়ে আসতেন। তিনি প্রায়ই এই সভাগুলিতে মুহাম্মদকে অনুসরণ করে আসতেন। শুধুমাত্র গোত্রীয় নেতাদের তাঁর জায়গায় বসতে দেয়ার জন্য তিনি মুহাম্মদকে বাধা দিতেন, অথবা অপেক্ষা করতেন যতক্ষণ না মুহাম্মদ ঘোষণা দিতেন যে, তাঁর কাছে পারস্যের রাজা ও বীরদের নিয়ে খাঁটি ও উত্তম গল্প আছে। তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, মুহাম্মদের নবী বিষয়ক গল্পগুলি প্রাচীন লোকদের কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিছুই নয়, যা তিনি বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে জেনেছেন। নাদের ছিলেন একজন শিক্ষিত, ভালো ভ্রমণকারী এবং মেধাবী 'গল্পবলিয়ে'। তিনি পার্সিয়ান উপসাগরের উপরের দিকে, পার্সিয়ানদের অধীনস্থ রাজ্য লখমিদদের (Lakhmids) দরবারে সময় কাটিয়েছিলেন যেখানে তিনি এই গল্পগুলি শুনেছিলেন। তিনি ফার্সি বই এবং পাণ্ডুলিপিগুলি নিয়ে এসেছিলেন এবং সেগুলি কীভাবে পড়তে হয় সম্ভবত তা তাঁর জানা ছিল। লোকেরা অধীর আগ্রহে নাদেরের কথা শুনত, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিতে মুহাম্মদ কোরআনে আয়াত নিয়ে আসলেন : “তারা বলে, ‘এটি প্রাচীনকালের উপকথা যা সে লিখিয়ে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যায় তার কাছে পাঠ করা হয়। বল, যিনি আসমান ও যমীনের রহস্য জানেন তিনি এটি নাযিল করেছেন; নিশ্চয় তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু” (৫)।
নাদের ক্রমেই মুহাম্মদের সার্বক্ষনিক পীড়ার কারণ হয়ে ওঠেন, এবং মন্দিরের ছায়াঘেরা পাটাতনে ওয়ালিদ বিন মুগিরা, আবুল হাকাম এবং মক্কার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের সাথে কথা বলার সময় মুহাম্মদ একবার তাঁর মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। মুহাম্মদ নবীদের বিষয়ে কথা বলার সময়ে নাদের এসেছিলেন এবং তিনি যথারীতি পারস্য গল্প বলার প্রস্তাব দিয়ে মুহাম্মদকে বাধাদান করেন। নাদের চুপ না হওয়া পর্যন্ত মুহাম্মদ উচ্চবাচ্য করে যেতে থাকেন। অতঃপর আল্লাহ তায়ালার একটি আয়াত তেলাওয়াত করলেন, যাতে জাহান্নামের আগুনের হুমকির কথা বলা হয়েছিল: “নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদের পূজা কর, সেগুলো তো জাহান্নামের জ্বালানী। তোমরা সেখানে প্রবেশ করবে।” (৬)।
জাহান্নামের এই ধারণাটি মক্কাবাসীদের কাছে অর্থবহ হয়নি এবং আবুল হাকাম রসিকতা করে বলেছিলেন, 'মুহাম্মদ পরকালের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির বর্ণনা দিয়ে ভয় দেখিয়ে তাঁর আনুগত্য করাতে চাইছে; যেমন, সে জাক্কুম গাছের কথা বলছে যা নাকি অভিশপ্তদের জন্য জলন্ত খাবার জাহান্নামে দেয়া হবে'। মুহাম্মদ তাদেরকে যাক্কুম গাছের ফল সম্পর্কে আয়াত তেলাওয়াত করেছিলেন: “গলিত তামার মতো, উদরসমূহে ফুটতে থাকবে। ফুটন্ত জলের মতো” (৭)।
আবুল হাকাম দাবি করেছিলেন, মুহাম্মদ ইহুদিদের কাছ থেকে দোজখের এই গাছটির ধারণা পেয়েছিলেন। তিনি বলতেন, “তুমি কি জানো এই আল-যাক্কুম (al-zaqqum) কি? এটি মাখন মাখানো খেজুর। এটিকে সাথে আনো, আমরা এটি উপভোগ করব!” (৮)।
মক্কাবাসীদের কাছে দেহের পুনরুত্থান সম্পর্কে মুহাম্মদের কথাবার্তা, জাহান্নাম সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের মতোই অবান্তর ছিল । একবার মরে যাওয়ার পরে দেহ পচে যায় এবং সময়ের ব্যবধানে ধুলো ছাড়া আর কিছুই তাঁর অবশিষ্ট থাকেনা। তবুও মুহাম্মদ ঘোষণা করে বলে যেতেন যে, শেষ বিচারের দিন সেই মৃতদেহটি পুনরুত্থিত হবে। মুহম্মদের দাবি যে হাস্যকর তা প্রমাণ করার জন্য মক্কার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উমাইয়া ইবনে খালাফের ভাই উবাই ইবনে খালাফ একবার তাঁর কাছে ক্ষয়প্রাপ্ত একটি হাড় নিয়ে আসেন এবং বলেন, “মুহম্মদ, আপনি কি দাবি করছেন যে, ক্ষয় হওয়ার পরেও ঈশ্বর এটিকে পুনরুত্থিত করতে পারবেন?” এরপর উবাই হাড়টিকে গুড়িয়ে ধুলায় মিশিয়ে দিলেন আর মুহাম্মদের মুখে ধুলাগুলো উড়িয়ে দিলেন। মুহাম্মদের জবাব ছিল আযাবের সতর্কবাণী: “হ্যাঁ, আমি এটি বলি। ঈশ্বর আপনাকে আর এটিকে উত্থাপন করবেন, যখন আপনি এটার মত হয়ে যাবেন। অতঃপর তিনি আপনাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন”(৯)।
একপর্যায়ে মুহাম্মদ এবং মক্কাবাসীদের মধ্যেকার তর্কটি খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকল, তবে এই বিষয়ে এক অন্ধ যেন আরেক অন্ধকে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। মক্কাবাসীরা একটি অস্পষ্ট ধারণা পোষণ করত যে, ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে যীশুকে এবং ঈশ্বরের পুত্রের মা হিসেবে মরিয়মকে স্থান দিয়ে প্রকারান্তরে খ্রিস্টানরা একপ্রকার বহু ঈশ্বরের চর্চাই করেছিল। খ্রিস্টানরা উভয়েরই উপাসনা করত, যেমন মক্কাবাসীরা আল-উজ্জা, আল-লাত, মানাত, হুবাল এবং তাদের সর্বদেবতার মন্দিরের অন্যান্যদের কাছে প্রার্থনা করত। তাদের কাছে মরিয়ম (Mary) ছিলেন মক্কাবাসীদের প্রিয় মাতৃদেবী আল-উজ্জার মতোই। মরিয়মের প্রতি খ্রিস্টানদের ভক্তিমূলক ভালবাসা তাঁরা বুঝতে পারে। অতএব, একটা সময়ে মুহাম্মদ যখন যীশুকে নবী হিসেবে উপরে তুলে ধরলেন, মক্কাবাসীরা চরম হাসিতে ফেটে পড়েছিল। যীশুর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি কি তাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বহুশ্বরবাদী ধর্মের বিশ্বাসকেই সমর্থন করলেন না?
যীশু সম্পর্কে মুহাম্মদের ধারণা নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা দ্বারা আবর্তিত হয়েছিল। যদিও তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যীশু ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন এবং খ্রিস্টীয় বিশ্বাস অনুসারে রক্ত-মাংসের-ঈশ্বর হিসেবে নয়, তিনি বরং যীশুকে নশ্বর একজন মানুষ হিসেবেই দেখেছেন (১০)। প্রয়োজনের খাতিরেই মুহাম্মদ এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করেছিলেন। সর্বশেষ এবং চুড়ান্ত নবী হিসেবে তাঁর আত্মম্ভরী ধারণার কারণেই, তিনি নিজেকে অন্য কারো চেয়ে কম বলে সমর্থন করতে পারতেন না। যীশু যদি প্রকৃতই ঐশ্বরিক হয়ে থাকেন, মুহাম্মদের গুরুত্ব তবে তাতে বেশ কমে যায়। তিনি মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে সরাসরি বলেন, “খ্রিস্টানরা যীশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে উন্নীত করে যীশুর ধর্মকে বিকৃত করেছিল। খ্রিস্টানরাই যীশুর ধর্মকে মুশরিক ধর্ম হিসেবে পরিণত করেছিল, যীশু তা করেননি – দাবি করেন মুহাম্মদ। সত্য এক ঈশ্বরের পরিবর্তে তাঁরা নাকি যীশু এবং মরিয়মের উপাসনা করেছিল" (১১)।
মুহম্মদের সাথে মক্কার নাগরিকদের সংলাপের এই সময় তাঁকে আরও একটি প্রস্তাব দিতে মক্কাবাসীদের উদ্ধুদ্ধ করে। একদিন মুহাম্মদ মন্দিরের পাশে হেঁটে যাওয়ার সময়, ওয়ালিদ মুগীরা, উমাইয়া খালাফ এবং অন্য আরেকজন ব্যক্তি তাঁকে থামিয়ে বললেন, “মুহাম্মদ আসুন, আপনি যা উপাসনা করেন আমরাও তাঁর উপাসনা করি এবং আমরা যার উপাসনা করি আপনিও তাঁর উপাসনা করেন। আপনি এবং আমরা বিষয়টি একসাথে করব। আপনার উপাসনা যদি আমাদের উপাসনার চেয়ে ভালো হয়, তবে আমরা তার অংশ নেব, আর আমাদের উপাসনা যদি আপনার করা উপাসনার চেয়ে ভালো হয় তবে আপনিও তার অংশ পাবেন” (১২)।
কন্টকময় সমস্যা সমাধানের জন্য এটি ছিল যুক্তিসঙ্গত মানুষদের একটি যুক্তিসঙ্গত পন্থা, যারা তাদের জীবনযাত্রার সাথে অন্যান্য ধর্মীয় অভিব্যক্তিগুলির সমন্বয় করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাঁরা মুহাম্মদের দ্বারা সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটাতে এবং তাদের সম্প্রদায়কে স্বস্তি দিতে চেয়েছিলেন। প্রথমে মুহাম্মদ এই বলে যেকোনো সহাবস্থান অস্বীকার করলেন যে, তাদের কাছে তাদের ধর্ম এবং তাঁর ধর্ম তাঁর কাছে; দুইদিকে যোগ দেয়ার উপায় নেই। যাই হোক, মক্কাবাসীদের প্রস্তাবের খুব অল্প সময়ের পর তিনি আবৃত্তি করে শুনালেন তাই যা শয়তানের আয়াতসমূহ (Satanic Verses) হিসেবে পরিচিত। মন্দিরের পাটাতনে তিনি মক্কার নেতাদের সাথে বক্তৃতা দেয়ার সময় এ ঘটনাটি ঘটেছিল। তিনি একটি নতুন সুরার কিছু অংশ পাঠ করেছিলেন, তবে এর পরের লাইনগুলিতে যে বাক্য যুক্ত করেছিলেন তাতে মক্কাবাসীদের তিনটি দেবদেবীকে আল্লাহর সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্বীকার করার কথা বলা হয়েছিলঃ “তোমরা কি লাত ও উযযা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ? আর তৃতীয় আরেকটি মানাৎ সম্পর্কে? তাঁরা তো মহৎ পাখি, আর তাদের সুপারিশ আসলেই কাম্য!” (১৩)
মক্কাবাসীরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মুহাম্মদের কি অবশেষে হুঁশ এলো? সাম্প্রতিক বছরগুলির সমস্ত সমস্যা কি এখন শেষ হতে যাচ্ছে? তিনি কেবল তাদের তিনটি দেবীর বৈধতা এবং আল্লাহ্ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ঐ দেবদেবীর উপাসনা করার চর্চাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তারা এতটাই আনন্দিত হয়েছিল যে, মুহাম্মদ যখন তাদেরকে প্রার্থনার জন্য তাঁকে অনুসরণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, তারা পাটাতন থেকে নেমে মন্দিরের প্রবেশদ্বারের নিকটবর্তী একটি জায়গায় আসলো। তারা তাঁর প্রার্থনার রীতিগুলো উদ্ভটভাবে অনুকরণ করছিল, এবং কপাল মাটিতে স্পর্শ করার মাধ্যমে এর শেষ হয়েছিল। এই ধরনের উপাসনার জন্য সেই সাদা দাড়িওয়ালা ওয়ালিদ (Walid) যার শরীরের হাড়সমূহ একেবারেই নড়বড়ে, এই দলের মধ্যে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছিলেন এবং এক মুঠো মাটি নিয়ে কপালে স্পর্শ করে নিজেকে সন্তুষ্ট করেছিলেন।
মুহাম্মদের মতো এমন অনমনীয় একজন ব্যক্তির দ্বারা এ ধরনের ছাড় কি করে দেয়া হলো, তা অনুমান করার বিষয়। নিজের বলয়ে তাদের নিয়ে আসতে সম্ভবত এটি ছিল মুহাম্মদের এক ধরণের কৌশলগত ছাড়। এটাও সম্ভব যে, তিনি মক্কাবাসীদের মতোই এই সংঘাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। অন্য একটা সময়ে, এত ঝামেলা সৃষ্টি করেছিলেন বলে মুহাম্মদ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, “আমার ইচ্ছা, আল্লাহ যেন তাদের প্রতি বিরক্তিজনক কোন কিছু আমার কাছে প্রকাশ না করেন” (১৪)। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের আপোস করার প্রস্তাবটি শ্রদ্ধার ও হৃদয় থেকে ছিল। তিনি কি তাতে সাড়া দেবেন না?
মক্কাবাসীদের শিহরিত হতে দেখে মুহাম্মদের অনুসারীরা হতবাক হয়ে গেল। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া আর কোনও উপাস্য নাই, আর ঈশ্বরের সাথে তাদের দেবতাদের শরীক করা ছিল সবচেয়ে বড় পাপ, তাদের নিজেদের আধ্যাত্মিক নেতা (মুহাম্মদ) তাঁর ধর্মের এরকম মৌলিক শিক্ষাগুলো পরিত্যাগ করার মাধ্যমে নিজের ধর্ম থেকে সরে এলেন! বলা হয়ে থাকে যে, তাঁর কিছু অনুসারী তাঁকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল, আবার কেউ কেউ তাঁকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও তাঁর বিশ্বাস পুনর্বিবেচনার জন্য চাপ দিয়েছিল। গ্রন্থে রয়েছে যে, ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁকে তীব্রভাবে তিরস্কার করেছিল। কিছুদিনের মধ্যে মুহাম্মদ তাঁর রচনাটি সংশোধন করলেন এবং তাঁর অনুগামীদের মধ্যে এই কথা ছড়িয়ে দিলেন যে, এটি দুষ্টু ও ছলনাকারী শয়তানের কাজ। শয়তান এই নিকৃষ্ট কথাগুলি তাঁর মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এবং তিনি ফেরেশতা জিব্রাইলের ঐশ্বরিক প্ররোচনার সাথে এটি গুলিয়ে ফেলেছিলেন (১৫)।
দু'পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনার পর্ব শেষ হয়ে গেল। মক্কাবাসীরা যখন এই সংশোধনটির ব্যাপারে জানতে পারে, তারা ক্ষুব্ধ হয় । তারা মুহাম্মদের প্রতি তাদের শত্রুতা আবার নতুন করে শুরু করেছিল এবং তাঁর অনুসারীদের হয়রানি করা শুরু করে। অন্যদিকে মুহাম্মদও পুনরায় তাদের বিশ্বাসের উপর আক্রমণ শুরু করেছিলেন এবং তাদেরকে জাহান্নামের আগুনের হুমকি দিয়েছিলেন। “যদি মুক্তি চাও তবে আমার আনুগত্য করো!” এটি ছিল তাঁর বার্তা।
প্রায় চার মাস ধরে আবিসিনিয়ায় থাকা, লোহিত সাগরের ওপারে মুহাম্মদের অনুসারীরা সংবাদ শুনেছিল যে, মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু শেষটা জানতে পারেনি। আগ্রহের সাথে তারা তাদের জিনিসপত্রগুলি গুটিয়ে নিয়ে আরবে ফিরে গেলেন, কিন্তু মক্কায় পৌঁছার আগে পথে মক্কা থেকে আগত এক ঘোড়সওয়ার তাদের নতুন করে সংঘাতের কথা জানিয়েছিল। বাহু প্রসারিত করে স্বাগত হওয়ার প্রত্যাশায় প্রবাসীরা মক্কায় বিজয়ী হয়ে পদযাত্রার পরিকল্পনা করেছিলেন, তবে তারা এখন চুপিসারে অন্ধকারের আড়ালে শহরে ঢুকে পড়েছিল, এবং জনসমক্ষে তাদের মুখ দেখানোর আগে সুরক্ষার নিশ্চয়তা চেয়েছিল। তারা দেখতে পেল যে, তাদের চলে যাওয়ার আগে পরিস্থিতি যেমন ছিল, ঠিক তেমনই রয়ে গেছে। তাদের পরিবারগুলি তাদের প্রতি বৈরী ছিল তবে দাস ও নিচু শ্রেণির মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়া অব্যাহত ছিল। প্রত্যাবর্তনকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ওয়ালিদের ভাগ্নে উসমান ইবনে মাজউন (Uthman ibn Mazun)। তিনি সুরক্ষার জন্য তাঁর চাচাকে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু পরে তিনি যখন কিছু অরক্ষিত ধর্মান্তরিত লোকদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে দেখেন, তখন তিনি সেই অনুরোধ থেকে সরে আসেন। অন্যান্য সকলের প্রতি তাঁর সংহতি জানাতে তিনি তাঁর মুশরিক চাচার সুরক্ষা ছাড়াই থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং তখন থেকেই আল্লাহর উপর ভরসা রাখেন। সমর্থন প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাঁর চাচা মন্দিরে একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। দেখা গেল, ওয়ালিদের চেয়ে আল্লাহ নিজেকে কম নির্ভরযোগ্য প্রমাণ করলেন। এর খুব অল্প সময়ের পরে, উসমান একটি কবিতা পাঠে অংশ নিয়েছিলেন, যা বিখ্যাত আরব কবি লাবিদের (Labid) আয়োজন ছিল । আবৃত্তি চলাকালীন সময়ে, লাবিদের কয়েকটি শ্লোকের পৌত্তলিক দর্শনের দ্বারা উসমানের মুসলিম সংবেদনশীলতা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। লাবিদের প্রতি মিথ্যাচারের অভিযোগে তিনি তাঁকে বাধা প্রদান করেন এবং মুহাম্মদের অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি চেঁচামেচি হয়ে শুরু করেন। বিখ্যাত কবি আঘস্ত (Aghast) বললেন যে, “এর আগে কেউ তাঁর (লাবিদের) কবিতায় অপমানিত বোধ করেনি, তাহলে আজ কীভাবে এটি হলো?” সেখানে থাকা এক ব্যক্তি বললেন, “মুহম্মদের সাথে জোটবদ্ধ এমন বোকাদের মধ্যে সেও একজন; তারা আমাদের বিশ্বাস ত্যাগ করেছে। সে কী বলে তাতে মনে কিছু করবেন না”। অন্য আরেক শ্রোতা মুখে ঘুষি মেরে চোখের নিচে কালো করে না দেয়া পর্যন্ত উসমান এমন বাধা দেয়ার কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওয়ালিদ সেখানে উপস্থিত হয়ে ঠাট্টা করে বলল, “ভাগ্নে, তোমার চোখের এমন ক্ষতি কিভাবে হলো। আগে তো তুমি সম্পূর্ণরূপে সুরক্ষিত ছিলে!” (১৬)।
খুব বেশিদিন হয়নি মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের আবারো আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন, এবং এবার প্রায় একশত পুরুষ, নারী এবং শিশুরা চলে গিয়েছিলেন যাদের বেশিরভাগই আগেরবারের হিজরত থেকে ফিরে এসেছিল। তারা রাতে ছোট ছোট দলে চলে যায় এবং আবিসিনিয়ায় একটি ছোট্ট সম্প্রদায় শুরু করে। মুহাম্মদের কাছ থেকে তারা তাদের সাথে পুনরায় যোগদান নিয়ে কথা শুনার অপেক্ষায় ছিল। তিনি তাদের বিদায় দেয়ার সময় বলেছিলেন যে, তাঁকেও দেশত্যাগ করতে হতে পারে, তবে তা করার আগে তিনি ঈশ্বরের আদেশের অপেক্ষায় থাকবেন।
মুহাম্মদের উৎসাহী বিনিয়োগকারী আবু বকরও হিজরত করতে চেয়েছিলেন। অন্যান্য বিশ্বাসীদের মতো তিনিও প্রথমে মুহাম্মদের অনুমতি লাভ করেছিলেন, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সাথে মুহাম্মদ যোগাযোগ রাখছেন এই অন্ধবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। যদি মুহাম্মদ তাঁকে যাওয়ার অনুমতি দেন, সেটা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হবে। কিন্তু মুহাম্মদের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও আবু বকরের ক্ষেত্রে আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। লোহিত সাগরের বন্দরে পৌঁছার একটু আগে স্বল্প পরিচিত গোত্রপতি ইবনে দাগিনার (ibn Daghina) সাথে আবু বকরের সাক্ষাৎ হলো। মক্কাবাসীদের থেকে তিনি যে খারাপ ব্যবহার পেয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তিনি শাইখের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। দাগিনা তাঁকে সুরক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কুরাইশ না হলেও, একটি বহেরাগত গোত্রের সাথে তাঁর ক্ষমতার নিজস্ব একটা ঘাঁটি ছিল, এবং তাঁর দেয়া সুরক্ষার নিশ্চয়তাটিকে মক্কাবাসী নিশ্চয়ই সম্মান করবে। তিনি আবু বকরকে সাথে নিয়ে মক্কায় গেলেন এবং তাঁর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করার জন্য মন্দিরে প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়ার আগে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শাইখকে ডেকে সৌজন্য সাক্ষাত করলেন। মন্দিরে তিনি বলেছিলেন, “হে কুরাইশ, আমি আবু কুহাফার (Abu Quhafa) পুত্রকে আমার সুরক্ষার অধীনে রেখেছি। কেউ যেন তাঁর মঙ্গল ছাড়া আর কিছু না করে”(১৭)। তবে, শীঘ্রই দাগিনা তাঁর সুরক্ষা প্রত্যাহার করার প্রয়োজনীয়তা খুঁজে পেয়েছিলেন। আবু বকর তাঁর বাড়ির উঠোনে একটি প্রার্থনা করার জায়গা স্থাপন করার পরে এবং তাঁর বাড়িতে জনসাধারণের উপদ্রব বেড়ে গেলে তাঁর উপর থেকে সুরক্ষা তুলে নেন দাগিনা। দিনে পাঁচবার তাঁর উচ্চকন্ঠে আয়াত তেলাওয়াত প্রতিবেশীদের বিরক্ত করত, বিশেষত ভোরবেলা। নির্দিষ্ট কিছু আয়াত তেলাওয়াত করার সময় তাঁর কান্নার প্রবণতাও মানুষকে রাগান্বিত করত। তিনি নিজেকে দর্শনীয় করে তুলেছিলেন, এবং তাঁর প্রতিবেশীরা তাঁকে মুহাম্মদের নিয়োগকৃত লোক জেনে, তাদের মহিলা, শিশু এবং দাসেদের উপর এর খারাপ প্রভাব পরবে ভেবে ভয়ে থাকতেন। আবু বকর সম্পর্কে তারা শহর জুড়ে অভিযোগ করেছিল এবং শীঘ্রই এ কথাটি তাঁর রক্ষকের কাছেও পৌঁছে গেছিল। ইবনে দাগিনা তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং তাঁকে তাঁর বাড়ির ভেতরে নামায পড়তে বললেন, সেখানে তিনি যা খুশি তাই করতে পারবেন। কিন্তু আবু বকর যখন তা মানতে অস্বীকার করলেন, দাগিনা মন্দিরে গিয়ে ঘোষণা করলেন যে, তিনি তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করেছেন। কথা শোনার জন্য জড়ো হওয়া লোকদের তিনি বললেন, “আপনারা তাঁর সাথে যা ইচ্ছে হয় করুন” (১৮)। সুরক্ষা হারিয়ে ফেলার পর আবু বকরের সাথে সবচেয়ে খারাপ যা ঘটল তা হলো, একদিন মন্দিরের দিকে যাওয়ার পথে কেউ একজন তাঁর মাথায় ময়লা ছুঁড়ে মেরেছিল। চুল থেকে ময়লা পরিষ্কার করে তিনি অপরাধীর বিরুদ্ধে ওয়ালিদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। বর্ষীয়ান নেতা তাঁকে কোনও সহানুভূতি দেখালেনই না, বরং তিনি বললেন: “আপনি নিজেই এটি আপনার উপর নিয়ে এসেছেন” (১৯)।
অনেক নওমুসলিম যুবক মক্কাবাসীদের নাগালের বাইরে গিয়ে মক্কাবাসীদের বিরক্ত করা শুরু করল। মক্কাবাসী চেয়েছিল যে, ওদেরকে মক্কায় ফিরিয়ে এনে তাদের উপর মুহাম্মদকে ত্যাগ করার জন্য চাপ অব্যাহত রাখবে। শয়তানের আয়াত উচ্চারণ করার পরে মুহাম্মদের অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁকে অস্বীকারও করেছিল এবং তাঁরা বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যেতে পারে। আবিসিনীয় সাম্রাজ্যে পৌঁছানোর ঐতিহাসিক তাগিদ থেকেও তারা তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। পারস্যদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার আগ পর্যন্ত পূর্ববর্তী শতাব্দীর বেশিরভাগ সময় ধরে আবিসিনিয়ানরা ইয়েমেনকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল। মক্কায় এখনো বেঁচে থাকা বহু লোকের স্মৃতিতে রয়েছে পাঁচ দশকেরও কম সময় আগের আব্রাহার (Abraha) নেতৃত্বে আবিসিনিয়ার সেনাবাহিনী কর্তৃক মক্কা অভিযানের ঘটনা। সম্ভবত মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন করার জন্যই, তবে সাম্রাজ্যকে প্রসারিত করার সম্ভাবনাই এতে বেশি দায়ী ছিল। এখন মক্কাবাসীদের নিজেদেরই অনেকে দলচ্যুত হয়ে আবিসিনিয়ায় চলে যাওয়ার ব্যাপারটা মক্কাকে দুর্বল এবং বিভক্ত করে দেয়। মক্কাবাসীদের ইচ্ছে ছিল তাঁরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করবে।
তাঁরা (মক্কার নেতারা) মুহাম্মদের অনুগামীদের বহিষ্কারের জন্য দুজন দূতকে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। দূতরা খ্রিস্টান রাজা এবং তাঁর পরামর্শদাতাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে সূক্ষ্ম লাল চামড়া উপহার হিসেবে এনেছিলেন – আজ যাকে মরোক্কান চামড়া বলা হয়। প্রচলিত বিবরণীতে, তারা প্রথমে মুরতাদদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে সমর্থন পেতে পরামর্শদাতাদের ঘুষ দিয়েছিল। দূতদের তাদের বক্তব্য পেশ করার জন্য রাজার সামনে আনা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আমর আল- আস (Amr al-As), যিনি মক্কাবাসীদের মধ্যে উঁচু অবস্থান সম্পন্ন একজন স্পষ্টবাদী এবং সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, দলত্যাগীরা তাদের সাথে একটি নতুন আবিষ্কারকৃত ধর্ম নিয়ে এসেছে যা আবিসিনীয়দের ধর্মের সাথে বা মক্কাবাসীদের ধর্মের সাথেও কোনভাবে খাপ খায় না। তিনি বলেছিলেন, “তাঁরা আমাদের ধর্ম ত্যাগ করেছে এবং তাঁরা আপনাদেরটাও গ্রহণ করবেন” (২০)। তিনি তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাদশাহ নেগাসকে (Negus) অনুরোধ করলেন, যাতে তারা তাদের পরিবারের সাথে আবার মিলতে পারে।
ঘুষগ্রহণকারী পরামর্শদাতাদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যারা রাজাকে তাদের অনুরোধের প্রতি সম্মানের জন্য মিনতি করেছিলেন, নেগাস প্রথম শুনানি ছাড়াই মক্কাবাসীদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মুহাম্মাদের দুজন লোককে তাঁর সামনে আনা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল আবু তালিবের ছেলে জাফর (Jafar)। তিনি তাদের মতবাদের একটা সারাংশ বর্ণনা করেছিলেন, এবং কিছু আয়াত আবৃতি করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মদের কাছে আয়াত হিসেবে এই ঐশ্বরিক বাণী এসেছে। যখন নেগা জানতে চাইলেন, “আপনি মরিয়মের পুত্র যীশু এবং তাঁর মায়ের বিষয়ে কী বলছেন?” জাফর সেই আয়াতগুলো আবৃত্তি করে শুনিয়ে খ্রিস্টান কার্ডটি খেলল, যেখানে নিষ্কলুষ গর্ভধারণের গল্পটির পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। তবে চালাকি করে তিনি যীশু সম্পর্কে মুহাম্মদের যেকোন তাত্ত্বিক বিশ্বাস প্রকাশ করার আগেই থেমে গিয়েছিলেন।
“আমরাও ঈশ্বরের মতোই বলি: তিনি তাঁর বাক্য এবং তাঁর আত্মা যা তিনি কুমারীর মধ্যে নিক্ষেপ করেছেন যাকে কোন মানুষ স্পর্শ করেনি এবং কোন শিশুও ভেতরে ছিল না” (২১,২২)।
মক্কার দূতরা মোটেও ধর্মতত্ত্ববিদ ছিল না, তাই এই আয়াতের বিরুদ্ধে একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তিখণ্ডন প্রদান করতে অক্ষম ছিল। মুহম্মদের অনুগামীরা তাদের হাতের খেলাটি ভালভাবে কাজে লাগিয়েছিল যে কারণে নেগাস তাদেরকে এমন একটি খ্রিস্টান সম্প্রদায় মনে করেছিল, যারা পৌত্তলিকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তিনি মুহম্মদের লোকদের আবিসিনিয়ায় রাজকীয় সুরক্ষার অধীনে থাকতে দিয়েছিলেন। তিনি মক্কাবাসীদের চামড়ার উপহার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাদের রাজ্য ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এভাবে লজ্জা পেয়ে, দূতেরা তাদের ব্যর্থতার কথা জানাতে মক্কায় ফিরে গেলেন।