অধ্যায় ১১ এটাকে পেতেই হবে
এক রাতে মুহাম্মদের মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব হতে মৃগীরোগ সৃষ্টিকারী স্নায়বিক উত্তেজনা বিস্ফোরিত হয়। সে সময়ে তিনি আবু তালিবের মেয়ে উম্মে হানির (Umm Hani) বাড়িতে ছিলেন, যার ফলে মৃগীরোগের কারণে হেলুসিনেশনে চলে যান এবং স্পষ্ট স্বপ্নে দেখেন যে, ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁকে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছেন। মুহাম্মদ এটির নামকরণ করেছিলেন 'রাতের যাত্রা' (The Night Journey), এবং এই অভিজ্ঞতার সময় তিনি বিশ্বাস করতেন জিব্রাইল তাঁকে ইহুদি কিংবদন্তিদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে হাজির করেছিলেন।
মুহাম্মদের কল্পনার এই স্নায়বিক ঘটনাটি ‘এক হাজার এক আরব্য রজনী' (A Thousand and One Arabian Nights) গল্পের মতো বিনোদনমূলক গল্পে রূপান্তরিত করে। মৌলিক গল্পটি ছিল একটি ভিনগ্রহী প্রাণীর হাতে অপহরণের দৃশ্যের মতো। তাঁকে ছাদ দিয়ে ঢুকে উম্মে হানির ঘর থেকে বের করে আনা হয় এবং মন্দিরের পাশের একটি কুয়োর (জমজম কুপ) কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ফেরেশতা জিব্রাইলের হাতে তুলে দেয়া হয়। ফেরেশতা তাঁকে গলা থেকে কোমর পর্যন্ত কেটে তাঁর অস্ত্র, হৃৎপিণ্ড জল দিয়ে পরিষ্কার করে আবার সেলাই করে দেয়। একই অভিজ্ঞতা হালিমার কাছে থাকাকালীনও পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। এবারের পরিশুদ্ধতা বিশেষ শুদ্ধি, চুড়ান্ত পরিশুদ্ধি, কারণ তাঁকে জেরুজালেমের মধ্য দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সামনে নেয়া হয়েছিল। তাঁকে একটা ডানাওয়ালা পশুর পেছনে বসিয়ে পাহাড়, উপত্যকা এবং বাতাসে চাবুক মেরে মেরে মরুভূমির উপর দিয়ে হাজার মাইল দূরে উড়িয়ে নিয়ে জেরুজালেমের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি জিব্রাইলের সাথে স্বর্গের বিভিন্ন স্তরে আরোহণ করেন, সেখানে প্রতিটি স্তরে একজন করে নবীর বাসস্থান ছিল। অবশেষে তাঁকে ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে নেয়া হয়। স্বর্গ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শেষে, মুহাম্মদকে উম্মে হানির বাড়ির বিছানায় ফিরিয়ে আনা হয় (১)।
যখন তিনি উম্মে হানিকে তাঁর সাথে কি ঘটেছে তা বললেন উম্মে হানি তখন তাঁকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলেন, কিন্তু মুহাম্মদ নিশ্চিত ছিলেন যে তিনি আসলেই জেরুজালেমে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে ঈশ্বরের সামনে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা গোপন রাখতে পারলেন না। উম্মে হানি তাঁর পোশাক ধরে দরজা থেকে বের হতে বাধা দেয়, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে দূরে সরিয়ে দেন। বলাই যায়, মক্কাবাসীরা তাঁর এই গল্প শুনে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। এমনকি কয়েকজন অনুসারী তাঁকে ছেড়েও চলে গেলেন। তবে অধিকাংশই তাঁর খুব বিশ্বস্ত ছিলেন এবং আবু বকর ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, “যদি তিনি (মুহাম্মদ) এই কথা বলে থাকেন, তাহলে তিনি সত্য কথাই বলছেন”। আবু বকরের এই কথার সাথে অন্যরাও একমত পোষন করলেন (২)।
যখনই মুহাম্মদকে আল্লাহর সিংহাসনের সামনে নেয়ার এই গল্পটি ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন প্রকৃত বিশ্বাসীরা অনেক উল্লসিত হয়ে গিয়েছিলেন, এবং তা শোনার জন্য অস্থির ছিলেন। মুহাম্মদ তাদেরকে আরকামের বাড়িতে জড়ো হতে বললেন। তাঁর শ্রোতারা ঘোড়া এবং উটের অনুরাগী ছিল, এবং তারা প্রথমে চমৎকার ডানাওয়ালা ঘোড়ার গল্প, যার উপর সওয়ার হয়ে জেরুজালেমে নেয়া হয়েছিল, সেই বর্ণনা শুনতে চাইলেন। মুহাম্মদ ছিলেন জাদুকরী গল্পকে বাস্তবতার রূপ দিতে ওস্তাদ। তিনি শুরু করলেন এভাবে : তার নাম ছিল বোরাক (Buraq), দেখতে সাদা রঙের একটি চমৎকার প্রাণী! আকারে এটি একটি খচ্চর ও গাধার মাঝামাঝি আকৃতির ছিল এবং বিশাল ডানাওয়ালা ছিল। মুখ ছিল দেখতে মানুষের মতো; তাঁর কান ছিল হাতির কানের মতো; এটা ততদূর ভ্রমণ করতে পারে যতদূর কারো চোখ যায়। এটা ছিল নবীদের বাহক। কেননা, যে কোন সময় এই বাহকটিকে তাঁর পূর্বসুরিরা তাদের দাপ্তরিক কাজে ব্যবহার করেছেন, সেখান থেকে পরিবহন সেবা নিয়েছেন।
আব্রাহাম মরুভূমির দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ইসমাইলকে দেখতে উড়ে গিয়েছিলেন মক্কায়, এবং পরিবহনটি দ্রুত চলার কারণে ইসমাইলও উত্তর সূর্যের দেশে তাঁর বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হতে পেরেছিলেন। এখন ছিল মুহাম্মদের বোরাকে রওনা হওয়ার পালা। স্বর্গীয় এই পরিবহন এখন তাঁর সামনে হাজির হয়েছিল এবং তাঁকে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কিন্তু বাহনটি ছিল অত্যন্ত উত্তেজিত এবং বিদ্রোহী মেজাজে। কারণ যীশুর পর তাঁকে আর কাউকে সেবা দেবার প্রয়োজন পড়েনি, এবং মুহাম্মদ যখন বাহনটির দিকে এগিয়ে এলেন জিব্রাইল তখন বোরাকের লাগাম ধরে ছিলেন এবং কঠোর তিরস্কার করে বলেন: “এখন বোরাক, আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন না? আমি শপথ করে বলছি, মুহাম্মদের চেয়ে মহান কোন বান্দা আপনার উপর কখনো চড়েনি” (৩)। মুহাম্মদ এটির উপর আরোহণ করেন এবং তারা বিখ্যাত মন্দির মাউন্টের (Temple mount) দিকে রওনা হয়ে সেখানে পৌঁছলেন যেখানে নবীদের বাহন বেঁধে রাখার জন্য সংরক্ষিত জায়গা ছিল। সেখানে তাঁর বসার জন্য একটি ব্যবস্থা রাখা ছিল (8)। সেখানে তিনি দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন এবং জিব্রাইল তাঁর জন্য নানারকম খাবার নিয়ে আসেন যার মধ্যে ছিল মদ, মধু এবং দুধ। সেখান থেকে খাবার বেছে নেয়ার জন্য মুহাম্মদকে বলা হলো। মুহাম্মদ দুধ বেছে নিলেন। জিব্রাইল এর জন্য প্রশংসা করলেন। মূলত এটি ছিল একটা পরীক্ষা। যদি তিনি মদ বেছে নিতেন, তার মানে তিনি তাঁর অনুসারীদের পথভ্রষ্ট করতেন; যদি তিনি মধু বেছে নিতেন, তাহলে তারা জগতের সুখ দ্বারা প্রলুব্ধ হতো। বাস্তবতা হচ্ছে যে তিনি দুধ বেছে নিয়েছিলেন, তা থেকে বোঝা যায় যে নবী হিসেবে তাঁর অনুসারীরা সঠিকভাবে পরিচালিত হবে এবং নিশ্চিত জান্নাতের পথে থাকবে।
যে কোন প্রতিভাবান গল্পকারের মতোই, মুহাম্মদ তাঁর শ্রোতাদের পড়তে পারতেন, এবং তিনি তাদের পড়ছিলেন। তাঁর সামনে পূর্ণ দাড়িওয়ালা, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শক্তভাবে মোড়ানো পাগড়ি পরিহিত শান্ত পুরুষেরা বসা ছিলেন। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই এই ধর্ম ছড়িয়ে দিতে এরাই হয়ে উঠবেন আততায়ী, গণহত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী, ডাকাত, ধর্ষক, দাস-দাসীর মালিক এবং সভ্যতার ধ্বংসকারী এক একজন ভয়ঙ্কর চরিত্র! এরাই তখন মুহাম্মদের সামনে রূপকথা শুনতে বড় উৎসুক চোখে শিশুর মতো বসে ছিল। তাঁরা যেহেতু দৃঢ়ভাবে মুহাম্মদকে বিশ্বাস করত, তাই যা তা গল্প বলেও পার পেয়ে যেত মুহাম্মদ। তারা এতোটাই বিস্মিত হয়েছিল শুনে যে, তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে দর্শন করার পর মক্কায় ফিরে এসেছেন! তারা তাঁর কাহিনী বিশ্বাস করত, কারণ তিনি নিজেই এই গল্প বিশ্বাস করতেন। শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া দেখে স্বর্গে আরোহণের বর্ণনাটি অব্যাহত রেখেছিলেন। এক সংস্করণে পাওয়া যায়, তিনি একটি সিঁড়ি বেয়ে উঠলেন; আরেকটিতে জিব্রাইল তাঁকে হাত ধরে প্রথম এবং সর্বশেষ বেহেশতে আরোহণ করিয়েছিলেন, যেখানে ভেতরে ঢুকতে জিব্রাইলকে অনুমতি চাইতে হয়েছিল (৫)।
ফটকের পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর শোনা গেল, - “কে আপনি?”
- “জিব্রাইল”।
-
- “আপনার সাথে কে আছে?”
- “মুহাম্মদ”
- “তাঁর সফর কি শুরু হয়েছে?”
“তাঁর সফর শুরু হয়েছে”(৬)।
মুহাম্মদ জিব্রাইলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বর্গে প্রবেশ করলেন এবং দেখলেন একজন লোক তাঁর ডান এবং বাঁ দিকে অনেক লোক নিয়ে বসে আছেন। লোকটি যখন তাঁর ডান দিকে তাকালেন তখন তিনি হাসলেন এবং বাঁ দিকে তাকিয়ে তিনি কাঁদতে লাগলেন। তিনি মুহাম্মদকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন: “প্রেরিত রাসুল, ধর্মপ্রাণ পুত্র, আপনাকে স্বাগতম!” মুহাম্মদ জিব্রাইলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কে উনি?”, তিনি উত্তর দিলেন “তিনি হচ্ছেন আদম ( Adam) এবং তাঁর ডান ও বাঁ দিকে
এই লোকগুলো তাঁরই বংশধরদের আত্মা। তাদের মধ্যে যারা ডান দিকে রয়েছে তারা জান্নাতের বাসিন্দা আর বামপাশে থাকা লোকগুলো জাহান্নামের বাসিন্দা।
মুহাম্মদ ফেরেশতাদের সৈন্যদল চারপাশে দেখতে পেলেন। তিনি তাদের সেনাপতির পরিচয় জানতে চাইলেন। বলা হল, তাঁর নাম ইসমাইল, যার অধীনে বারো হাজার ফেরেশতা ছিলেন, যাদের প্রত্যেকের অধীনে আবার আরও বারো হাজার ফেরেশতা আছে। তিনি যেসব ফেরেশতাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তারা সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসেছিলেন, একজন বাদে। তিনি জাহান্নামের রক্ষক - মালিক। যখন মুহাম্মদ মালিকের ভুমিকা জানতে পারেন তখন তিনি জাহান্নমের শাস্তির স্থান দেখার অনুমতি চাইলেন। জিব্রাইল অনিচ্ছাসত্ত্বেও মালিককে সেই ভয়ানক জাহান্নাম দেখাতে নির্দেশ দিলেন, এরপর মালিক জাহান্নামের আবরণ সরিয়ে নিলেন এবং বাতাসে আগুন জ্বলে উঠল। মুহাম্মদ একটু দম নিয়ে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাঁর সামনে বসে থাকা লোকদের জাহান্নাম দেখার কথা বললেন। ঈশ্বর তাঁকে নিজের চোখে জাহান্নাম দেখতে দিয়েছিলেন, যাতে তারা যদি ঈশ্বর ও তাঁর রসুলের অবাধ্যতা করে, তবে তাদের জন্য যা আছে সে সম্পর্কে তিনি তাদের সতর্ক করতে পারেন। এ পর্যায়ে মুহাম্মদ তাঁর শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করলেন, তারা সত্য জানার জন্য প্রস্তুত কী না? অনুসারীরা ভীতি সহযোগে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। মুহাম্মদ বর্ণনা করলেন তিনি কি ভয়াবহতার সাক্ষী ছিলেন যা পাপীদের জন্য অপেক্ষা করছে! আর শাস্তি নির্ভর করবে পাপের পরিমাণের উপর। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে পেছনে কথা বলা এবং নিন্দাকারীদের নখ তামায় রূপান্তরিত হয়েছে, যা দিয়ে তাদের মুখ এবং বুক কাটা হচ্ছিল। এইভাবে তাদের কষ্ট দেয়া হয়, কারণ তারা অন্যদের কষ্ট দিয়েছে। “আমি উটের মত ঠোঁটওয়ালা মানুষকে দেখেছি। তাদের হাতে ছিল পাথরের আগুনের টুকরো, যা তাদের মুখে ঢুকিয়ে দিত এবং তা তাদের পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে আসত। আমাকে বলা হয়েছিল যে এরাই এতিমদের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে” (৭)। তিনি সকল সুদখোর এবং ব্যভিচারীর ভাগ্য দেখেছেন এবং তাদের নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি সেখানে এত কিছুর সাক্ষী হয়েছেন যে পুরোটা বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন তাদের যথেষ্ট সময় আছে কি না?
মুহাম্মদ একজন দক্ষ বক্তা ছিলেন, তিনি জানতেন কখন তাঁর কণ্ঠস্বরকে বজ্রপাতের মতো উন্নীত করতে হবে, আর কখন ফিসফিস করে বলতে হবে। কখন চোখ ক্রোধে ঝলসে উঠবে, অথবা কখন চোখে দয়ার নহর দেখা যাবে। অনুসারীদেকে নারকীয় বর্ণনাগুলো উপলব্ধি করিয়ে তাদের আবার স্বর্গীয় আরোহণে ফিরিয়ে আনলেন। তিনি জানালেন তারা যদি নবীর দেখানো সঠিক পথ অনুসরণ করে তাহলে তাদের জন্য ভালো কিছু রয়েছে। তারা স্বর্গে যাবেন, শুধু তাঁর কথামতো সব মেনে চলতে হবে!
মুহাম্মদ বর্ণনা করেছেন, কিভাবে প্রতিটি আকাশে প্রবেশের জন্য জিব্রাইলকে অনুমতি নিতে হয়েছিল। দ্বিতীয় আকাশে তিনি যীশু (ঈসা) ও জন বাপ্তাইজের (ইয়াহিয়া) সাথে দেখা করলেন। তৃতীয় আকাশে তাঁকে জোসেফের (ইউসুফ) সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। চতুর্থ আকাশে ছিল ইদ্রিসের (Enoch) বাসস্থান। পঞ্চম আকাশে ছিলেন হারুন (Aaron) এবং ষষ্ঠ আকাশে মুসা (Moses) ছিলেন। তাদের বাসস্থানে গিয়েই মুহাম্মদ তাদের শুভেচ্ছা জানালেন এবং উত্তরে তাঁরা বলেছেন, “স্বাগতম, হে ধর্মভীরু ভাই ও প্ররিত নবী!” মুহাম্মদ নবীদের বর্ণনাও দিয়েছেন : যীশু ছিলেন মাঝারি আকারের যার গায়ের রং কিছুটা লালচে ছিল, দেখে মনে হয়েছে তিনি কেবল গোসল করে নিজেকে শুকিয়ে নিয়েছেন। জোসেফের মুখ পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল ছিল। হারুন দেখতে সাদা দাড়িওয়ালা ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ লোক ছিলেন। মুসারও সাদা দাড়ি ছিল, কিন্তু তিনি দেখতে তরুণ খেলোয়াড়ের মতো সুঠামদেহের অধিকারী ছিলেন এবং তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো আর লম্বা নাক ছিল। হাসতে হাসতে এবং মাথা নাড়িয়ে প্রশংসা করতে করতে মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের একজনের চেহারার সাথে যীশুকে তুলনা করেছিলেন। আব্রাহামকে বর্ণনা করা সবচেয়ে সহজ ছিল, নিজেকে আয়নায় দেখার মতই। মুহাম্মদ বলেন: “তাঁর সন্তানদের মধ্যে তাঁর সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি মিল আছে”।
তিনি সপ্তম স্বর্গে তাঁর নায়ক অব্রাহামের মুখোমুখি হলেন। মুহাম্মদের পিতৃপুরুষ আল্লাহর মন্দিরের দিকে ঝুঁকে ছিলেন। আবারও সম্ভাষণ : “স্বাগতম, হে ধার্মিক ভাই ও ধার্মিক নবী!” সেখান থেকে জিব্রাইল তাঁকে স্বর্গীয় মন্দিরের দিকে নিয়ে যান যেটা ছিল জান্নাতের একপ্রান্তে (কোনে), সেখানে একটি বিশাল গাছ ছিল। একপর্যায়ে তিনি কলমের শব্দ শুনতে পেলেন, এবং যখন তিনি এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তাঁকে বলা হল যে ফেরেশতা লেখকেরা আল্লাহের হুকুম লিখছে। এরপর মুহাম্মদ স্রষ্টার উপস্থিতি খুঁজে পেলেন। মুহাম্মদের জন্য ঈশ্বরের নির্দেশ এলো : মুহাম্মদ ও অনুসারীদের দিনে পঞ্চাশবার সালাত আদায় করতে হবে।
মুহাম্মদের শ্রোতারা স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে বলে উঠলেন, পঞ্চাশবার? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? তাদের তো দিনরাত প্রার্থনা করেই কাটাতে হবে! মুহাম্মদ আসলে উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য এই কথাটি বললেন। তিনি তাঁর শ্রোতাদের বললেন, , তিনি ঈশ্বরের আদেশ নিয়ে তাঁর সাথে বিতর্ক করতে পারলেন না। স্রষ্টার সাথে কে তর্ক করতে পারে? ঈশ্বর যদি পঞ্চাশবার বলেন, তিনি পঞ্চাশবারই বুঝিয়েছেন। ঈশ্বরের সংগে তর্ক না করে তিনি বিনীতভাবে যেখানে থেকে এসেছিলেন সেখানেই ফিরে গেলেন, কিন্তু তিনি পথে মুসাকে অতিক্রম করলেন। মুসা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনাকে কি আদেশ দেয়া হয়েছে?”
তিনি উত্তর দিলেন “আমাকে প্রতিদিন পঞ্চাশবার প্রার্থনা করতে বলা হয়েছে”
তিনি ঠাট্টা করে উঠলেন, “আপনার অনুসারীরা দিনে পঞ্চাশবার প্রার্থনা করতে পারবে না। কসম, আমি মানুষকে আপনার আগেই পরীক্ষা করেছি। আমি ইস্রায়েলের লোকদের জন্য কিছু কঠোর নিয়মকানুন তৈরি করেছিলাম, কিন্তু তারা তা সামলাতে পারেনি। আপনার পালনকর্তার কাছে ফিরে যান এবং তাঁর কাছে গিয়ে আপনার জাতির জন্য প্রার্থনা কিছুটা কমিয়ে আনুন”। মুসার কথা শুনে মুহাম্মদ আল্লাহর কাছে ফিরে গেলেন। প্রার্থনা কমানোর জন্য উনি বারবার আল্লাহর কাছে যেতে থাকলেন। মুহাম্মদ ও আল্লাহ অবশেষে একটি চুক্তিতে আসলেন - দিনে মাত্র পাঁচবার সালাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হলো। এখন থেকে বিশ্বাসীদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হবে খুব ভোরে সূর্যোদয়ের আগেই, আর চার রাকাত নামাজ পড়তে হবে অপরাহ্নে এবং বিকেলেও। আর রাতেও পড়তে হবে চার রাকাত নামাজ, এবং তিন রাকাত নামাজ পড়তে হবে সূর্যাস্তের সাথে সাথে। কিন্তু এই বাধ্যতামুলক প্রার্থনার সময় যেসব চিরন্তন রচনাগুলো জিব্রাইলের মাধ্যমে মুহাম্মদের কাছে পাঠানো হয়েছে, এগুলো জোরে জোরে আবৃতি করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুহাম্মদের বিশ্বস্ত শ্রোতাদের মধ্যে স্বস্তির ছাপ দেখা গেল। আল্লাহ তাদের জন্য মুক্তির খরচ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁর চমৎকার সমঝোতার দক্ষতার মাধ্যমে তা কমিয়ে এনেছিলেন।
এরপর শ্রোতারা জানতে পারেন যে, মুহাম্মদকে সম্মানিত এবং সর্বোচ্চ মর্যাদা দিতে আল্লাহ তাঁকে অন্যান্য নবীদের নিয়ে নামাজের নেতৃত্ব দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই সম্মান তাঁকে প্রদান করা হয়েছিল, কারণ তিনি শুধু নবীদের মধ্যে শেষজন ছিলেন তাই-ই না বরং তাদের মধ্যে তিনি ছিলেন সেরা। মুহাম্মদ তাঁর আঙ্গুলের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন কিভাবে তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে মাউন্ট মন্দিরে (Temple Mount) ফেরত আনা হয়েছিল। অন্যন্য নবীরাও সেখানে হাজির হন এবং প্রার্থনার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যান। মুহাম্মদ সেখানে নেতৃত্বের আসনে ছিলেন। যীশু, ইয়াহিয়া, মুসা, হারুন, ইদ্রিস, জোসেফ ও আব্রাহাম তাঁর পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। নবীদের তাদের স্থান নির্বাচন করা ছাড়া অন্য কিছু শেখানোর প্রয়োজন ছিল না, কারণ মুহাম্মদ মাত্র এক দশকআগে ফেরেশতা জিব্রাইলের কাছ থেকে যে একই প্রার্থনা নিখুঁতভাবে শিখেছিলেন। তাই অন্যন্য নবীদের হাতে পর্যাপ্ত সময় ছিল এ বিষয়ে শিখে নিতে। যীশু ছয়শত বছর ধরে সেখানে ছিলেন, অন্যদিকে আব্রাহাম দু'হাজার বছরেরও বেশি সময় পেয়েছিলেন প্রার্থনার নিয়ম শিখে নিতে। তা সত্ত্বেও তাদের কেউই মুহাম্মদের সাথে নিখুঁতভাবে প্রার্থনা করতে পারেনি। কেউ তাঁর মতো কানের কাছে হাত উঠিয়ে উটের মত হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর উরুর উপর হাত রাখার নিয়ম অনুসরণ করতে পারল না। কেউ তাঁর কনুই রাখার নিখুঁত নৈপুন্যের সাথে তাল মেলাতে পারেনি বা পারেনি মাটিতে হাত স্পর্শ করে সেজদা করতে। মুহাম্মদ ছিলেন অনবদ্য। তিনি ছিলেন অননুকরণীয়, প্রার্থনার আদি বিশুদ্ধ রূপ তিনিই শুধু মান্য করলেন এবং ঈশ্বরের প্রতি তিনি ছিলেন অসামান্য আত্মসমর্পণকারী। মুহাম্মদকে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা নিশ্চিত করেন যে, সকলেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তাঁকে সকলের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে স্থাপন করেন।
নামাজ শেষ, মুহাম্মদের বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে। মক্কায় তাঁর স্থান ছিল তাঁর লোকদের মধ্যে, যারা এখন আরকামের ঘরে বসে বা হাঁটু গেড়ে তাঁর গল্প শুনছে। ডানা ঝাপটিয়ে, বোরাক তাঁকে ভোরের নামাজের সময় হবার আগে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু ফেরার পথে, তিনি তৃষ্ণার্ত হয়ে আরো একটি দু:সাহসিক কাজ করেন। যখন তাঁরা বাতাসে ভেসে যাচ্ছিলেন, মুহাম্মদ বোরাকে সওয়ার ছিলেন এবং ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁর পাশাপাশি উড়ছিল, মুহাম্মদ একটি কাফেলা দেখতে পেলেন। যা মক্কা থেকে রওনা দিয়েছিল একদিনেরও কম হবে। কাফেলার লোকেরা রাতের জন্য বিছানা করে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু একটা জলের পাত্র বাইরে রেখে গিয়েছিল। বোরাকটি দ্রুত অবতরণ করল; মুহাম্মদ লাফ দিয়ে নেমে জল পান করলেন, তারপর ঝাঁপিয়ে বোরাকে উঠে পড়ে তাঁর শেষ গন্তব্য মক্কায় এসে পৌঁছালেন।
মুহাম্মদের শ্রোতারা হতবাক এবং বিস্মিত হয়ে গেল। তিনি তাদের কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সভাটি শেষ করলেন। সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্নটি এসেছিল আবু ঘরের (Abu Dharr) কাছ থেকে। তিনি দাউস (Daws) গোত্রের নেতা ছিলেন ওটা উপকূলীয় এক গোত্র ছিল, যাদের ডাকাতির খ্যাতি রয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন?” মুহামদ উত্তর দেন, “আমি একটি আলো দেখেছি”। তিনি আরও বলেন যে, তিনি ঈশ্বরকে সরাসরি দেখতে পাননি। কারণ সর্বশক্তিমান প্রভু আলো দ্বারা আবৃত ছিলেন, তাই তাঁর কাছ থেকে তিনি কেবল আলো নিঃসৃত হয়েছে তাই দেখেছেন (৮)।
সেদিন মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের মন্দিরে নিয়ে যান, যেখানে তারা দলবদ্ধ হয়ে প্রার্থনা করেন এবং মক্কাবাসীদের অভিশাপ দেয়া হয়। নামাজের নেতৃত্ব মুহাম্মদ দিয়েছেন তাই তিনি সবার সামনে ছিলেন এবং বিশ্বাসীরা তাঁর পেছনে বেশ কয়েকটি সারিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি তাঁর মাথা পর্যন্ত হাত উঠালেন, হাঁটু গেড়ে বসলেন এবং সেজদায় গেলেন। মুহাম্মদের নেতৃত্ব অনুসরণ করে বিশ্বাসীরা চারবার সিজদা করেন, তিনি যে কোরআন তেলাওয়াত করলেন তারাও তা পুনরাবৃত্তি করলেন। যখন প্রার্থনা শেষ হল তখন বিশ্বাসীরা বিস্মিত হল এই কথা শুনে যে, মুহাম্মদ আসলে নামাজের নেতৃত্বে ছিলেন না। তিনি তাদের জানালেন যে, ফেরেশতা জিব্রাইল সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং তিনি এই প্রার্থনার নেতৃত্ব দিয়েছেন। যদি তাদের ঐশ্বরিক চোখ থাকত তাহলে তারা এই ফেরেশতাঁকে দেখতে পেতেন।
কিন্তু আফসোস, তাদের দেখার জন্য সেই চোখ ছিল না! ঈশ্বর শুধু তাঁর রাসুলকে একচেটিয়াভাবে সমস্ত ক্ষমতা দিয়েছিলেন