অধ্যায় - ১ জিহাদ সম্পর্কে বিতর্ক
‘প্রত্যেক মুসলিমকে বছরে অন্তত একবার অবশ্যই জিহাদে যেতে হবে.... দুর্গের ভিতরে যদি নারী এবং শিশুরাও থাকে, তবুও তাদের বিরুদ্ধে ভারী পাথর বা তীর নিক্ষেপের যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে । তাদেরকে আগুনে পুড়িয়ে কিংবা ডুবিয়ে মারা যেতে পারে। মোহাম্মদের পরে যিনি ইসলামের সর্বোচ্চ পণ্ডিত)
(ইমাম আল গাজ্জালী,
‘শক্তি প্রয়োগে অথবা বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রত্যেককে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা ও মুসলিম মিশনের সর্বজনীনতার কারণে (এর প্রসারের জন্য) যুদ্ধে যাওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় দায়িত্ব । -- (ইবনে খালদুন, দ্য মুকাদ্দিমা, নিউইয়র্ক, পৃষ্ঠা ৪৭৩)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১'র মর্মান্তিক হামলা বিশ্বে নাটকীয় পরিবর্তন এনেছে, যা বহুদিন অব্যাহত থাকবে। বিশ্বব্যাপী ইসলামে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধের নামে আল-কায়েদা ও তার সমমনা মুসলিম দলগুলোর বেপরোয়া হিংস্রতা ইসলামিক-অনৈসলামিক উভয় বিশ্বকেই নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও আচারসর্বস্ব ইসলামের পুনরুত্থানের একটা জোয়ার বয়ে চলছে। উভয় প্রবণতাই পশ্চিমা ও অন্যত্র ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশসমূহের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটা মারাত্মক হুমকি । হিংস্র জিহাদী দলগুলো বিশ্বব্যাপী ইসলামি ধর্মীয় আইন (শরীয়া)-ভিত্তিক কঠোর ইসলামি শাসন কায়েমের লক্ষ্যে বেপরোয়া হিংস্রতা, মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা চালানোর মাধ্যমে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বিশ্বব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে চায়। বর্তমানে ইসলামের পুনরুজ্জীবনের যে অহিংস জোয়ার চলছে, মুসলিমদের মধ্যে তার একটা ব্যাপক আবেদন রয়েছে এবং তারাও ঠিক একই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়, তবে ভিন্ন পন্থায় । পশ্চিমা সমাজের রীতি ও সামাজিক আচরণ যেমন বাক স্বাধীনতা, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে মেলামেশা এবং সমকামিতা ইত্যাদি – যা ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত, সেগুলোকে ক্রমশ দমনের দাবির মাধ্যমেও তারা সেখানে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে চলছে ।
২০০৬ সালের এক জরীপে দেখা যায়, শতকরা ৪০ ভাগ ব্রিটিশ মুসলিমরা শরীয়া আইন দ্বারা শাসিত হতে চায়। পক্ষান্তরে, শতকরা ৬০ ভাগ মুসলিম নিজস্ব সম্প্রদায়ের আইনগত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য শরীয়া কোর্ট দেখতে চায়। 'সেন্টার ফর সোশ্যাল কোহিশন ইন দ্য ইউ.কে.'-র সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মুসলিম ছাত্রদের শতকরা ৪ ভাগ ইসলামকে রক্ষা ও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ‘হত্যাকাণ্ড' (আল-কায়েদা ইত্যাদি পরিচালিত) সমর্থন করে; ৩২ ভাগ মনে করে ইসলামের রক্ষায় হত্যাকাণ্ড ন্যায়সঙ্গত । ব্রিটেনে শতকরা ৪০ ভাগ মুসলিম চায় শরীয়া আইন প্রবর্তন; এর বিরোধিতা করে ৩৭ ভাগ। বিশ্বব্যাপী মুসলিম খিলাফত শাসন প্রতিষ্ঠা সমর্থন করে প্রায় ৩৩ ভাগ; এ ধারণার বিরোধী মাত্র ২৫ ভাগ। সমীক্ষায় এও জানা যায় যে, মুসলিমদের মধ্যে উগ্রবাদ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং তরুণ মুসলিমরা ধর্মীয়ভাবে তাদের পিতামাতার প্রজন্মের চেয়ে বেশি মৌলবাদী। বর্তমান সময়ে ব্রিটিশ জনসংখ্যার মাত্র ৩.৫ ভাগ মুসলিম হলেও তারা নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বিষয়ে বেসরকারিভাবে শরীয়া আইনের ব্যাপক চর্চা করে চলছে । অবস্থা এ রকম যে, ক্যান্টারবেরির আর্চ- বিশপ রোয়ান উইলিয়ামস্ ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে বলেন: ব্রিটেনে শরীয়া আইনের প্রবর্তন অবশ্যম্ভাবী । তিনি একে বৈধ করে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান । 2
মুসলিম গণদাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার তালাক, আর্থিক বিবাদ, এমন কি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ব্যাপারগুলো মীমাংসায় একটি বৈধ শরীয়া আদালত প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছে । 'দ্য ডেইলি মেইল' জানায়, গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত এ আদালত ১০০টিরও বেশি মামলা নিষ্পত্তি করেছে বলে দাবি করেছে। শুধু তাই নয়, এর সঙ্গে তারা ৬টি অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ফৌজদারি মামলাও নিষ্পত্তি করেছে । আদালতটি ভবিষ্যতে আরও বেশি সংখ্যক ছোট ছোট মামলা হাতে নেওয়ার আশা পোষণ করে। এটা যুক্তরাজ্যে শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ ।
ইসলামিক ‘জিহাদ' কিংবা 'ধর্মযুদ্ধ'-এর অর্থ হলো আল্লাহর পথে লড়াই করা, যা কোরানের বহু আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ স্বয়ং ইসলামের ধর্মতত্ত্বে সন্নিবেশিত করেছেন। যেমন বলা হয়েছে ২:১৯৩ নং আয়াতে। কোরানে জিহাদ সম্পর্কে ২০০-টিরও বেশি ঐশীবাণী (আয়াত) রয়েছে । বর্তমান সময়ের সহিংস জিহাদের সুবিখ্যাত নায়ক ওসামা বিন লাদেন অবিশ্বাসীদের (অমুসলিমদের) বিরুদ্ধে তার জিহাদী প্রচারণার যে ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা হলো:
মুসলিম ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপারে আল্লাহর সংক্ষিপ্ত ভাষ্য: ‘আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি । এক আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমাদের ও আমাদের মধ্যে অনন্তকাল ঘৃণা ও শত্রুতা বিরাজ করবে। সুতরাং (মুসলিমদের) অন্তরে (অমুসলিমদের প্রতি) একটা প্রচন্ড বিদ্বেষমূলক শত্রুতা রয়েছে। আর এ প্রচণ্ড শত্রুতা অর্থাৎ লড়াই নিবৃত্ত হবে যদি অবিশ্বাসীরা ইসলামের কর্তৃত্বের কাছে নত হয়, অথবা যদি তাদের শরীর থেকে রক্তঝরা বন্ধ হয়ে যায়, অথবা যদি মুসলিমরা সে সময় দুর্বল ও অসমর্থ হয়ে পড়ে। কিন্তু কোন সময় যদি (মুসলমানদের) হৃদয় থেকে এ ঘৃণা অন্তর্হিত হয়, সেটা হবে স্বধর্ম ত্যাগের শামিল। অবিশ্বাসীদের সম্পর্কে নবির প্রতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর বাণীর সত্যিকার মর্মকথা হচ্ছে: ‘ও নবি! অবিশ্বাসী ও ভণ্ডদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; তাদের প্রতি নির্মম হও । তারা দুর্ভাগা, তাদের স্থান নরকে। অতএব এটাই হচ্ছে অবিশ্বাসী ও মুসলিমদের মধ্যকার সম্পর্কের মূল ভিত্তি। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে মুসলিম পরিচালিত যুদ্ধ, বিদ্বেষ এবং ঘৃণাই আমাদের ধর্মের ভিত্তি । আমরা একে তাদের প্রতি ন্যায়বিচার ও দয়া বলেই মনে করি।
------------------------
1. Gardham D, Muslim students back killing in the name of Islam, Telegraph (UK) 27 July 2008
2. Sharia Law in UK in unavoidable', BBC, News, 7 February 2008.
3. Matthew Hickley, Islamic sharia courts in Britain are now legally binding', Dailymail1, 15 September 2008.
4. Quran 2:190: Fight in the cause of Allah those who fight you, but do not transgress limits; for Allah loveth not transgressors (tis, Yusuf Ali).
5. Raymond Ibrahim, the tow Faces of Al Qaeda, Chronicle Review, 21 September 2007.
------------------------
অপরদিকে জিহাদের ধর্মীয় ভিত্তি যে অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের এ একমুখী ও লাগামহীন বিদ্বেষ, সে মতবাদের বিরোধিতা করেন। অনেকে । বহু মধ্যপন্থী মুসলিম ও ইসলামের পন্ডিত বলেন যে, আল-কায়েদা ও তার সমমনা ইসলামি দলগুলোর দ্বারা সংঘটিত বেপরোয়া সহিংস কর্মকাণ্ডকে অবশ্যই জিহাদ বলা যায় না । তাঁরা মনে করেন, জিহাদ হলো শান্তিপূর্ণ আধ্যাত্মিক সংগ্রাম, সহিংসতার সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই । প্রেসিডেন্ট বুশের মত তাঁরাও মনে করেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং এর সাথে সহিংসতার কোন সম্পর্ক নেই । অনেক অমুসলিম ইসলামি পণ্ডিতও দাবি করেন যে, ইসলামের ইতিহাসের উৎকর্ষ বা বিশুদ্ধতার চিহ্ন হলো সহনশীলতা, শান্তি ও সমতা, যা খ্রিষ্টানরা তাদের মুসলিম (যেমন স্পেনে) ও অন্যান্য অখ্রিষ্টান প্রজাদের (যেমন ইউরোপ ও আমেরিকার প্যাগান ও ইহুদি) প্রতি দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে ।
ব্রাসেসে ১৯-২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ ইস্ট-ওয়েস্ট ইনস্টিটিউট আয়োজিত একটি সন্ত্রাসবিরোধী সম্মেলনে বক্তারা দাবি করেন যে, আল- কায়েদার সহিংসতা থেকে 'জিহাদ' শব্দটিকে আলাদা করতে হবে । কারণ অধিকাংশ মুসলিমের মতে 'জিহাদ' মানে আধ্যাত্মিক একটা সংগ্রাম । অপশক্তির দ্বারা ‘জিহাদ' শব্দটির আরও ছিনতাই হোক, সেটা তা তাঁরা চান না । সম্মেলনে ইরাকি পণ্ডিত শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, 'নিজ আআর ভিতরের সকল অশুভ প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামই হলো জিহাদ; ইসলামে কোনো জিহাদী সন্ত্রাসবাদ নেই ৷
জিহাদ দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা বিস্তার অথবা জীবনে অত্যন্ত ইতিবাচক কিছু করার জন্য সংগ্রাম হতে পারে এ কথার উপর জোর দিয়ে পাকিস্তানের জয়েন্ট চীফস অব আর্মি স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যান জেনারেল এহসান উল হক বলেন: 'সন্ত্রাসবাদীদেরকে জিহাদী বলে আখ্যায়িত করা হল ইসলামের উপলব্ধির ঘাটতির প্রতিফলন' অথবা দুর্ভাগ্যবশত, 'একটি ইচ্ছাকৃত অপব্যবহার । ৯/১১'র পর থেকে আল- কায়েদা জিহাদের নামে কোরাস গাওয়া শুরু করার পর মুসলিম তথা অনেক অমুসলিম পণ্ডিত ও শিক্ষাবিদ জিহাদের অহিংস ধারণার সপক্ষে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন । ড্যানিয়েল পাইপ্স জিহাদ অর্থের ইতিবাচক চিত্র সম্পর্কে সে সব পণ্ডিতদের বেশ কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, যা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো ।
জিহাদ সম্পর্কে হার্ভার্ড ইসলামিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জায়েদ ইয়াসিন (বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত) ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধি প্রদান অনুষ্ঠানে ‘মাই আমেরিকান জিহাদ' শিরোনামে এক বক্তৃতায় বলেন, 'জিহাদের সত্য ও বিশুদ্ধ রূপ, যা সকল মুসলিম কামনা করে, তা হলো নিজের স্বার্থের বিরুদ্ধে হলেও যা সঠিক, যা ন্যায়সঙ্গত, তা-ই করা । নিজস্ব নৈতিক আচরণের জন্য এটা একটি ব্যক্তিগত সংগ্রাম । সে অনুষ্ঠানে হার্ভার্ডের ডীন মাইকেল শিনাজেল, ইসলাম ধর্মের উপর বিশেষ কোন জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও, জিহাদকে ন্যায় বিচারকে এগিয়ে নেওয়া এবং নিজেদেরকে ও সমাজকে জানার জন্য ব্যক্তিগত সংগ্ৰাম আখ্যা দিয়ে জিহাদ সম্পর্কে ইয়াসিনের ব্যাখ্যাকে স্বীকৃতি দেন। এবং হার্ভার্ড ইসলামিক সোসাইটির উপদেষ্টা প্রফেসর ডেভিড মিটেন সত্যিকারের জিহাদকে মুসলিমদের সহজাত প্রবৃত্তিকে জয়, ঈশ্বরের পথ অনুসরণ ও সমাজে ভাল কাজ করার সংগ্রাম হিসেবে বর্ণনা করেন ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে অনেকেই জিহাদের এ ধারণা প্রচার করছেন । উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জো এলডার জিহাদকে ‘ধর্মীয় সংগ্রাম হিসাবে দেখেন, যা ধর্মের গভীর ব্যক্তিগত সংগ্রামকে ঘনিষ্ঠরূপে প্রতিফলিত করে।' ওয়েলসৃলি কলেজের অধ্যাপক রোক্সেন ইউবেন-এর কাছে জিহাদের অর্থ হল 'আবেগ প্রতিহত করা ও একজন শ্রেয়তর মানুষে পরিণত হওয়া' । এদিকে জর্জিয়া-সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পার্সেলস্ জিহাদকে দেখেন ‘নিজের ইচ্ছা ও প্রবৃত্তির সঙ্গে সংগ্রামরূপে' । আর্মস্ট্রং আটলান্টিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক নেড রিনালডুসি'র কাছে জিহাদের লক্ষ্য হলো, 'ভিতরে ভাল মুসলিম হওয়া ও বাহিরে একটা ন্যায় সমাজ সৃষ্টি করা' । নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরিদ ইসেক-এর কাছে জিহাদের অর্থ 'বর্ণবাদ প্রতিরোধ ও নারী অধিকারের জন্য কাজ করা'। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের বিশিষ্ট অধ্যাপক ব্রুস লরেন্স-এর কাছে জিহাদের অর্থ হল 'একজন ভাল ছাত্র, একজন ভাল সহকৰ্মী, একজন ভাল ব্যবসায়িক অংশীদার হওয়া। সর্বোপরি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা'। তাঁর মতে, এমন কি অমুসলিমরাও জিহাদের নৈতিক উৎকর্ষ অর্জনের চেষ্টা করতে পারে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অন্যায়পূর্ণ পৃথিবীতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের মাধ্যমে জিহাদের উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে।
জিহাদের এ অহিংস ও মঙ্গলমুখী ধারণার বিরুদ্ধে আল-কায়েদাসহ অসংখ্য মৌলবাদী ইসলামি দল উল্লসিত চিত্তে দাবি করে যে, অবিশ্বাসীদের, বিশেষ করে পশ্চিমা ও পশ্চিম-ঘেঁষা মিত্র ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাদের পরিচালিত সহিংস কর্মকাণ্ডই হলো জিহাদ । অনেক সময় তারা তাদের যুক্তির সপক্ষে কোরান থেকে উদ্ধৃতি ও নবি মোহাম্মদের জীবনের উদাহরণ তুলে ধরে। স্পষ্টতঃ জিহাদের এ উগ্রবাদী মতবাদের ব্যাপারে যথেষ্ট মতানৈক্য বা অস্বীকৃতি রয়েছে ।
একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভুল ধারণা বশত হোক বা নাই হোক, সহিংস ইসলামি দলগুলো ‘আল্লাহ্র রাহে যুদ্ধের' অকাট্য বিশ্বাসে ভবিষ্যতে নারী-শিশুসহ নিরীহ মানুষের উপর সহিংসতা ও সন্ত্রাস অব্যাহত রাখবে। এজন্য মানব জীবন ও সমাজ ভোগ করবে অবর্ণনীয় ক্ষতি ও ধ্বংসযজ্ঞ । আজকের বিশ্বে প্রতিটি জাতির মধ্যে মুসলিমরা যে যথেষ্ট শক্তিশালী ও প্রতিষ্ঠিত, সে ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই । পশ্চিমা দেশগুলোতে মুসলিমদের মধ্যে উচ্চ জন্মহারের কারণে ও অতি-জনবহুল ইসলামি বিশ্ব থেকে জনপ্রবাহ বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে, জনসংখ্যার বর্তমান প্রবণতা অনুযায়ী, মুসলিমরা চলতি শতাব্দীর মধ্যভাগেই অনেক পশ্চিমা দেশে প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায় হতে পারে । আর বর্তমান সহিংস মৌলবাদী উত্থানের জৌলুস যদি মুসলিমদের মধ্যে অব্যাহত থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে সহনশীল সভ্য বিশ্বের স্থিতিশীলতা বিপন্ন হতে পারে । বিশ্বের আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ভবিষ্যতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হলে সকল জাতিকে এসব মৌলবাদী ইসলামি দলগুলোর আদর্শ ও কর্মকাণ্ডকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে হবে সামরিক ও আদর্শিক উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে।
------------------------
6. What is jihad? Language still hinders terror fight, Reuters, 20 Feb, 2008.
7. Pipes D (2003) Militant Islam Reaches America, WW Norton, New York, p. 258-68
------------------------
বিশ্বব্যাপী, বিশেষত মুসলিম দেশগুলিতে, জিহাদের নামে জঙ্গি মুসলিমদের দ্বারা যে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তার প্রেক্ষাপটে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, এবং সেজন্যে মুসলিম ও অমুসলিম সকলেরই 'জিহাদের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করা জরুরি হয়ে পড়েছে । জিহাদের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি ব্যতীত কর্তৃপক্ষ ও জনগণের পক্ষে জিহাদের নামে মুসলিমদের মাঝে গড়ে ওঠা উত্তরোত্তর সহিংস প্রবণতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিকার অসম্ভব ।
এ বইটি জিহাদের প্রকৃত অর্থ কী পাঠকদের সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার জন্য সামান্য একটা প্রয়াস মাত্র । এতে নবি মোহাম্মদের জীবনী আলোচিত হয়েছে, যেভাবে তিনি খোদার (আল্লাহর) নিকট থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রত্যাদেশ গ্রহণ করেন পবিত্র কোরানে সন্নিবেশিত করার জন্যে । বইটি ব্যাখ্যা করবে কখন ও কী পরিস্থিতিতে আল্লাহ ইসলামি ধর্মতত্ত্বে জিহাদের ধারণা সংযোজন করেন। কোরান, খাঁটি নবুয়তি ঐতিহ্য ও নবি মোহাম্মদের মূল জীবনীর ভিত্তিতে বইটি প্রদর্শন করবে ইসলামের নবি কিভাবে জিহাদের মতবাদ প্রয়োগ করেছিলেন তাঁর জীবনের শেষ তেইশ বছরে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকালে (৬১০-৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ)। এভাবে জিহাদের ধর্মীয় ভিত্তি ও নবি-কর্তৃক স্থাপিত তার কৌশলগত নকশা উপলব্ধির পর ইসলামের কর্তৃত্বকালে মুসলিমরা কিভাবে যুগ যুগ ধরে জিহাদের আদর্শ প্রয়োগ করেছে – এ বইয়ে তা দেখানোর চেষ্টা করা হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ইসলামের প্রতিষ্ঠালগ্নে নবি মোহাম্মদ আল্লাহ'র মতবাদরূপে জিহাদের ব্যাপক ব্যবহার করেন, যার মাধ্যমে জিহাদী তত্ত্বের তিনটি প্রধান ঐতিহাসিক কর্মধারা প্রতিষ্ঠা করে যান ।
তা হলো:
১. ইসলাম প্রচারের জন্য সহিংসতার প্রয়োগ
২. ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ
৩. ইসলামি দাসত্ব
এ বইয়ের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়ে জিহাদ-তত্ত্বের এ কর্মধারাগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আলোচিত হবে।