অধ্যায় ৫ গুহামানব
মুহাম্মদ তৎকালীন মক্কার বহুশ্বরবাদী সমাজে বেড়ে উঠেছিলেন। জীবনের চল্লিশ বছর অব্দি এসেও সবধরনের ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকি তিনি দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলিও মেনে নিয়েছিলেন। এ এমন এক জীবনধারা, যা পরবর্তী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছিল, অন্তত দেড় হাজার বছর ধরে। মুহাম্মদের বহু আগেই, উত্তর ও দক্ষিণ আরবের প্যাগান রাজ্যসমূহের উত্থানপতনের সাথে খুব সামান্যই এর ব্যত্যয় ঘটেছিল। কাবা মন্দিরকে ঘিরে এই সংস্কৃতি এখন বেশ পাকাপোক্ত অবস্থানে এসেছে, পশ্চিম আরবে তীর্থযাত্রীদের আচার-অনুষ্ঠানে অগ্রগতির সূচনা করেছে। অন্যান্য আরবদের মতো আচার-অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত হলেও মুহাম্মদ এসবের সত্যতা নিয়ে ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেন।
হাত ও হাঁটু অবনত করে প্রার্থনারত ভঙিতে মুহাম্মদের জন্ম হয়েছিল বলা হয় যে ইসলামিক সাহিত্যে, পরবর্তীতে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিরূপণ কঠিন হয়ে যায়। এটার নেপথ্যে আবেগ ও যুক্তির প্রভাব রয়েছে। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল, তার প্রথম ছেলে কাসিমের মৃত্যু। ইসলামিক ইতিহাসে এই মৃত্যুর কারণ উল্লেখ না থাকলেও, দ্বিতীয় জন্মদিনের আগেই তার মৃত্যুর বর্ণনা আছে। আকস্মিক হারানোর বেদনায় প্রচন্ড এই মানসিক আঘাত, মুহাম্মদের বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। অসুস্থ বাচ্চাটি বাঁচার জন্য ছটফট করছিল, তা দেখতে থাকা মুহাম্মদ ও খাদিজার কষ্ট সহজেই অনুমান করা যায়। তাদের হাতের মাঝে এই শিশুর বাঁচার তীব্র আকুতি ছিল, আর মাত্র একদিনের ব্যবধানেই সে লাশ হয়ে গেল। এরপর তাঁকে মাটিচাপা দেয়া হলো, শোকার্ত মানুষের ভীড়ে। কবরে সমাহিত করার পর পুত্র হারানোর শোকে কাতর মা-বাবা বাসায় ফিরে এলো। ছেলেকে হারিয়ে তারা কাঁদছিল। এই দৃশ্যটা কল্পনা করলে দেখা যাচ্ছে, ঘরের এককোণে একটা পাথরের দেবতা আছে, যার আছে নাক, দুটো আয়তাকার বা গোল পাথরের চোখ, আর মুখে স্বস্তির হাসি।
বেদির উপর এটা উপবিষ্ট, যাতে মনে হচ্ছে নিচে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। অশ্রুসজল চোখে মুহাম্মদ কি ঐ দেবতার দিকে ফিরে তাকিয়েছে? তাঁর কন্ঠ বেয়ে কি অভিশাপ দানা বেঁধে উঠেছে?
মক্কাবাসীরা যতই দরিদ্র হোক, অধিকাংশের ঘরেই দেবদেবীর নানা মূর্তি থাকত। সেগুলোর একটি থাকত প্রধান দেবতার, আর বাকিগুলো বিভিন্ন গোত্র বা ব্যক্তিগত। খাদিজার ঘরটিও ব্যতিক্রম ছিল না। তিনি আল উজ্জা (al Uzza) দেবীর উপাসক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এমনকি, এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, তিনি তাঁর সন্তানের নাম রেখেছিলেন আবদ আল উজ্জা (Abd al-Uzza) তথা উজ্জার ভৃত্য। (1) কাসিম ছিল ডাকনাম, যার মানে "যে সবার সাথে মিলেমিশে থাকে"। তার জন্মের পর তিনি ও মুহাম্মদ দেবীর উদ্দেশ্যে দুটি পশু উৎসর্গ করেন, খুব সম্ভবত মক্কা মন্দিরের বাইরের মাঠের বেদীতে। আল উজ্জা দেবী ছিলেন প্রধান দেবী। তাঁর উপাসনা করার অর্থ ছিল জীবনের সকল শক্তির উপাসনা করা। যীশুর মাতার জন্য খ্রিস্টানদের যেরকম ভক্তি, উজ্জার প্রতিও সবার তেমনই ভক্তি ছিল। মক্কা হতে পুর্বে কয়েকদিনের দূরত্বে, পাহাড়ের পাদদেশ সংলগ্ন বাবলা গাছের মাঝে নাখলায় (Nakhla) একটা সাদামাটা মন্দিরে তাঁর উপাসনা হতো। প্যাগান রীতি অনুযায়ী, রক্ত উৎসর্গের মাধ্যমে মিনতি করাই ছিল দেবতাদের তুষ্ট করার উপায়।
কিছু পাওয়ার জন্য কিছু দেয়া। খাদিজা যখন তাঁর নবজাতক শিশুকে কাপড়ে মুড়ে রেখেছিলেন, মুহাম্মদ তখন পশুদের গলা কেটে কোরবানি দিয়েছিলেন, দেবতার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। পশু কোরবানির পর, তাদের রক্ত যখন বেদী গড়িয়ে মাটিতে এসে পড়ত, খাদিজা ও মুহাম্মদ তখন নবজাতক শিশুকে উপহার হিসেবে পাওয়ায় কাতর হয়ে মিনতি করে কৃতজ্ঞতা জানালেন, প্রার্থনার মাধ্যমে। সন্তানের নিরাপত্তার জন্য, তারা তাদের সন্তানকে মক্কার সর্বশক্তিমান ঈশ্বর পরম করুণাময় আল্লাহর মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আল উজ্জা দেবীর কাছে সমর্পণ করেছিলেন। প্রচলিত রেওয়াজ মেনে, মুহাম্মদকে নাক দিয়ে দেবীর পাথরের প্রতিকৃতির গায়ে লেগে থাকা রক্তের গন্ধ শুঁকে নিতে হতো, দেবীর শক্তির সান্নিধ্য পেতে।
[ছবি ছবির বর্ণনা: মক্কার মন্দিরটার নাম ছিল কাবা; এর অর্থ 'ঘনক' (Cube)। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর 605 খ্রিস্টাব্দে এটি পুনর্নির্মাণ করা হলে এই নাম দেয়া হয়। 35 বছর বয়সী মুহাম্মদ এটির নির্মাণকাজে নতুন শ্রমিক হিসেবে অংশ নেন। মেরামতের আগে এটি ছিল পাথরের স্তুপ করে বানানো নিচু দেয়ালে ঘেরা, ছাদবিহীন আয়তাকার একতলা দালান। মূল মন্দিরটি কয়েকশত বছর আগে চন্দ্রপুজায় নিবেদিত ছিল, যার এক কোণে কালো উল্কা পাথরটা বসানো ছিল।
কিন্তু এখন আল উজ্জা দেবীর সদ্যোজাত মানব শিশুটি মাটির নিচে। তাঁরা তার নিরাপত্তা কামনা করেছিল, অথচ সে মারা গেল। কেন? তাদের এই সন্তান যদি মারাই যাবে, তবে এই দেবীর শক্তিটা কোথায়? তারা কি প্রতারিত হয়েছে? যে কেউ মুহাম্মদের ভেতরকার উস্কে উঠা ক্রোধ বুঝতে পারবে, যেখানে তিনি আল উজ্জাকে জিজ্ঞেস করছেন, কেন সে তাঁর প্রিয় ছেলেকে রক্ষা করল না। কিন্তু দেবীমা তাঁকে উত্তর দেয়নি, আর মুহাম্মদ ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। তাঁর বারবার মনে পড়তে লাগল মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর বুক কিভাবে খালি হয়ে গিয়েছিল। সে তাকিয়ে দেখেছিল, মক্কায় তাঁর দাদা আর আল আবওয়ায় (al-Abwa) তাঁর মাকে কিভাবে কবরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছিলেন। এতিম বলে তাঁকে কিভাবে পরিত্যাগ করা হয়েছে, তাঁর দুর্ভাগ্যের কারণে দারিদ্র্য ও নিচু সামাজিক অবস্থান তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। সে চিৎকার করে আরো জানতে চাইলো : "তুমি আর অন্য দেবতারা তখন কোথায় ছিলে? সবাই কেন কষ্ট পাচ্ছে? এসবের অর্থ কি? বলো আমাকে"।
কিন্তু, উত্তর মিলল না, কেবলই নীরবতা!
তাঁর মাঝে চিন্তার উদ্রেক হয়েছিল, সম্ভবত যখন যে আবু তালিবের সাথে সিরিয়া ভ্রমণে গিয়ে বিদেশি সংস্কৃতি ও বিভিন্ন ধর্মের সংস্পর্শে এসেছিল। ঐ সফরের প্রভাব তাঁর মনে দাগ কেটেছিল, অন্যান্য আরো সূত্র আর সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করার আগ পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, খাদিজার পক্ষ থেকে সিরিয়া সফরে মুহাম্মদ দ্বিতীয়বারের মতো বিদেশি ধর্মের সংস্পর্শে আসে; এতোটা উত্তরে তাঁর আর যাওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে যা কিছু তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, তা বোঝার মতো প্রস্তুতি তাঁর হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধিমান আর অনুসন্ধিৎসু মুহাম্মদ তাঁর সান্নিধ্যে আসা সবাইকেই নানা প্রশ্ন করত। তারা কেন এটা বলে? ওরা কেন এরকম ভাবে? মক্কায় ফিরে এসেও বহু ঈশ্বরে বিশ্বাসী মুহাম্মদ তাঁর আর অন্যান্য ছেলেদের জন্মের পর দেবতাদের উদ্দেশ্যে কোরবানি দিতে দেখে।
সম্ভবত খাদিজার সাথে বিয়ে তাঁর ভেতরে এসব নিয়ে সবচেয়ে বড় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর মাধ্যমে প্যাগান সহ বেশ কিছু ধর্মভ্রষ্ট, ছোট দলের সংস্পর্শে মুহাম্মদ এসেছিল। তাঁরা সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, সমাজের এসব বিশ্বাস, রীতিনীতি অর্থহীন। এদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদের বয়োবৃদ্ধ চাচা ওয়ারাকা (Waraqa), যিনি তাঁকে পাঁচবছর বয়সে যখন তিনি পালক বাবা-মাকে ছেড়ে তায়েফে (Taif) পালিয়ে যান ঐ পথে মুহাম্মদকে খুঁজে পেয়েছিলেন। ওয়ারাকা ছিলেন শিক্ষিত ও জ্ঞানী। তিনি জুদাইজম (Judaism) এবং খ্রিস্টধর্মের একটা ধারা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি তাঁর নিজের মতো করে খ্রিস্টধর্মকে ব্যবহার করতেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনিই নতুন টেস্টামেন্টের (New testament) আরবি অনুবাদ করেছিলেন। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে, ওয়ারাকা এসব ব্যাপারে মুহাম্মদ আর খাদিজার সাথে আলোচনা করেননি, যখন তারা সবাই তাদের ঘরের প্রধান কক্ষে, দাস দাসীর উপস্থিতিতে চামড়ার বালিশে হেলান দিয়ে আরাম করতেন তখন।
খাদিজা একপর্যায়ে খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাস আনেন, যদিও মুহাম্মদ এতটা আশ্বস্ত ছিলেন না। প্রথম দিককার কোরআনের রচনাসমূহে মুহাম্মদকে যীশুর প্রশস্তি করতে দেখা যায়। মুহাম্মদের চাচাত ভাইদের একজনও এই ছোট দলে ছিলেন। একজন ছাড়া সবাইই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিল। সবার এভাবে প্যাগান ধর্ম ত্যাগ করার ঘটনা, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে মুহাম্মদকে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন হতে সাহায্য করেছিল।
মুহাম্মদের উপর যিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তিনি হলেন জায়েদ ইবনে আমর (Zayed ibn Amr)। কর্কশ স্বভাবের ইবনে আমর কারো তোয়াক্কা না করে, সবার মতামতের একেবারে বিরুদ্ধে নিজের সোজাসাপটা মত জানাতেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে অবজ্ঞা করায়, তিনি মক্কাবাসীদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। জায়েদ ছিলেন ওয়ারাকার সমবয়সী, মানে মুহাম্মদের চেয়ে ত্রিশ বছরের বড়। অন্যান্য অন্বেষকদের মতোই, জায়েদ প্যাগান ধর্মের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, আর নতুন কোন ধর্মের খোঁজ করেছিলেন। ওয়াকার মতো তিনিও খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বিশ্বাস নিয়ে পড়াশোনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অন্যান্য উৎসুকদের মাঝে একমাত্র তিনিই সেগুলোকে পরিত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলতেন, "আমি খ্রিস্ট আর জুদাইজম (Judaisam) এর ঘ্রাণ নিয়েছি, কিন্তু তাদের আমি পছন্দ করিনি"। (2) জায়েদ সত্যিকার ধর্মের সন্ধানে খ্রিস্টধর্মে রূপান্তরিত সিরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন। সাধু, সন্ন্যাসী, তান্ত্রিক, যাদুকর - কাউকেই তিনি বাদ দেননি। সবাইকে জিজ্ঞেস করতেন, "তোমরা কি বিশ্বাস করো? কেন করো? তোমরা যা বিশ্বাস করো তা কেন করো?"
সেই সফরে উনি কি শিখেছিলেন তা অনুমান করা না গেলেও, তিনি নিশ্চিতভাবেই যীশু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বৈচিত্র্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিলেন। এসব অভিজ্ঞতাই পরবর্তীতে থাকে খ্রিস্টীয় মতবাদের প্রতি বিতৃষ্ণা এনে দিয়েছিল; আর তাদের বিশ্বাসীরা বেশ বিভক্ত আর ঝগড়াটেও ছিল। তাদের ছিল পবিত্র গ্রন্থ তোরাব (Torah ), যাতে তাদের জীবনযাত্রার সব নিয়মনীতি ছিল। ইহুদিরা আব্রাহামের উত্তরসুরী দাবি করার ব্যাপারটা জায়েদকে সবচেয়ে বেশি উৎসুক করে তুলেছিল। আব্রাহাম ছিল মুর্তিভঙ্গকারী, যে তাঁর পিতার তৈরি সব মূর্তি ধ্বংস করে ফেলেছিল, আর এক ঈশ্বরের উপাসনা শুরু করেছিল। উত্তরে সফরের আগ পর্যন্ত, জায়েদ এই ধারণায় দৃঢ় ছিলেন যে, ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের আগে থেকেই একেশ্বরবাদের একটা বিশুদ্ধ রূপ আছে, যাকে তিনি আব্রাহামের ধর্ম বলে অভিহিত করতেন। এটা এমন এক ব্যক্তির ধর্ম, যে দৃঢ়ভাবে এক ঈশ্বরেই বিশ্বাস করতো; আর তা প্রমাণের জন্য সে নিজের ছেলেকে পর্যন্ত কোরবানি দিতে প্রস্তুত ছিল।
পশ্চিমা বোদ্ধারা মোটামুটি ধরে নেন যে, মুহাম্মদের জন্মের বহু আগে থেকেই আব্রাহাম আর অন্যান্য ইহুদিদের কাহিনীসমূহ আরবে প্রচলিত ছিল। যদিও তাঁরা সেই বিষয়ের পরিধি ও গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পশ্চিম আরবের মরূদ্যানে ইহুদি উপনিবেশ সমুহ হাজার বছর ধরেই গড়ে উঠেছিল, কাজেই সেখানকার প্যাগান প্রতিবেশীর পক্ষে ইহুদিদের নানান গল্প জেনে থাকাটাই স্বাভাবিক।
খ্রিস্টধর্ম প্রচারকেরা ইয়েমেনে প্রচার করে আসছিল যে, আরবরা ছিল আব্রাহামের পরিবারের অংশ, কারণ তাঁর অন্যতম পুত্রের হাত ধরেই তাদের আগমন। মক্কা ও অন্যান্য প্যাগান শহরে আর গ্রামে এরকম গল্পের ভাসাভাসা প্রচলন ছিল, যদিও তারা তা নিশ্চিতভাবেই জানত। জায়েদের সবচেয়ে আকর্ষণের বিষয় ছিল বাইবেলে বর্ণিত দুটো বংশপরম্পরার কাহিনী : একটি সারার (Sarah) পুত্র ইসাক বা আইজ্যাকের (Isaac) মাধ্যমে, অপরটি হাগারের (Hagar) পুত্র ইসমাইলের (Ishmael) পথ ধরে। প্রত্যেকেরই বারোজন করে ছেলে ছিল, যাদের বংশধরেরা বিশাল গোত্রের গোড়াপত্তন করেছিল। জায়েদের ইহুদি ধর্ম বাতিল করার অন্যতম কারণ ছিল, তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসাকের বংশধরেরা আব্রাহামের মূল ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে। ইসমাইলের বংশধরেরা আলাদাভাবে গড়ে উঠেছিল, আর সেকারণেই তাঁরা মূল ও বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদী আব্রাহামের ধর্মের অনুশীলন করতে পেরেছিল; অথবা জায়েদ সেরকমই বিশ্বাস করতেন। তিনি যদি আব্রাহামের বিশুদ্ধ ধারার অনুসারীদের খোঁজে বের হতেন, তাঁকে মক্কায় খালি হাতে ফিরতে হতো। এটা শুধুমাত্র বিলুপ্তই হয়নি, বরং ইসমাইলের একেশ্বরবাদের বিশুদ্ধতা শুরুতেই বিনষ্ট হয়েছিল।
ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে, উত্তর মরুভূমির নিকটবর্তী পূর্ব-পশ্চিম কাফেলার পথটিতে যাযাবর হিসেবে ইসমাইলী উত্তরসূরিদের বসবাস ছিল। তারা প্রতিবেশী গোত্রদের কাছ থেকে প্যাগান রেওয়াজ, রীতিনীতি আয়ত্ত করেছিল। (৩) পরবর্তীতে তারা কাফেলা বাণিজ্যে অভ্যস্ত হয়ে যায়; প্রথমে অস্ত্রবাহী যোদ্ধা ও দারোয়ান, আর পরে ব্যবসায়ী। একটি শক্তিশালী প্যাগান ইসমাইলী জোটের বিকাশ ঘটে, কিন্তু অ্যাসিরীয় (Assyrians) আর ব্যবিলনীদের হাতে এই দলবদ্ধতার অবসান ঘটে। প্যাগান সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত ইসমাইলীদের অবশিষ্ট অংশ নাবাতিয়ান (Nabatean) রাজ্যে একীভূত হয়ে যায়। ইয়েমেন হতে সিরিয়া অভিমুখী বাণিজ্য কাফেলার উপর নিয়ন্ত্রণ, আর রাজধানী পেট্রা (Petra) শহরের বাইরে বালিপাথরের তৈরি বাঁধের বাঁকে কবর খুঁজে পাওয়ার মাধ্যমে এই সভ্যতা নজরে আসে।
কিন্তু ১০৫ খ্রিস্টাব্দে বাণিজ্যের উপরে নাবাতিয়ান নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটল যখন রোম সাম্রাজ্য তার একটি প্রদেশ একে হিসেবে অধিগ্রহণ করে নেয়। চতুর্থ শতাব্দীতে একটি ভূমিকম্পের ফলে নাবাতিয়ানদের মন্দিরগুলি ভেঙে গিয়েছিল, যার মধ্যে মক্কাবাসীদের দ্বারা উপাসনা করা একই দেবদেবীদের জন্য উৎসর্গীকৃত মন্দিরগুলিও ছিল। জায়েদের সময়ে, পেট্রা একটি বিধ্বস্ত ভূতের শহর ছিল এবং নাবাতিয়ান বংশধররা খ্রিস্টধর্মে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এরপরে, ইসমাইলীরা কেবলমাত্র তায়মা (Tayma) ও ডুমার (Duma) মতো জায়গাতেই বাস করত। জায়েদ যে ভিক্ষুদের মুখোমুখি হয়েছিল তাদের একজন তাঁকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল যে, তিনি যা খুঁজছেন তা আর নেই (৪)। সেখানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ইসমাইলী গোত্র থাকতে পারে, যারা তাদের আব্রাহামিক বিশ্বাস বজায় রেখেছিল। তবে পঞ্চম শতাব্দীর ধর্মতত্ত্ববিদ ঐতিহাসিক যাজক সোজোমেন (Sozomen) মনে করেন, ইসমাইলীরা অবশেষে তাদের বহু আগে হারিয়ে ফেলা ইহুদি ভাইদের সাথে চুক্তিতে এসেছিল এবং ইহুদিদের আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি গ্রহণ করেছিল। জায়েদের সময়কালে এরাও এদের ইসমাইলী পরিচয় হারিয়ে ফেলেছিল (৫)।
মক্কায় ফিরে আসার পরে জায়েদ আব্রাহামের পৌরাণিক ধর্মের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। যদিও এই ধরণের বিশ্বাস কি ধারন করে, তা তিনি জানতেন না। জায়েদিজম হল ঈশ্বরের স্বতন্ত্রতা এবং একাকীত্বের প্রতি বিশ্বাস এবং ইব্রাহিমের উদাহরণ অনুসরণ করে ঈশ্বরের প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ। তিনি এতে আরও কিছু যুক্ত করতে অক্ষম ছিলেন যার জন্য হতাশ হয়েছিলেন এবং চিৎকার করে বলেছিলেন: “হে ঈশ্বর, আমি যদি জানতাম যে আর কি উপায়ে তোমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে, তবে আমি সেই অনুযায়ী তোমার উপাসনা করব; তবে আমি তা জানি না” (৬)।
বাইবেলের নবীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে জায়েদও মূর্তিপূজা করার জন্য মক্কাবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিলেন এবং তাদের অবিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে কন্যাশিশুদের জীবিত কবর দেয়ার একটি রেওয়াজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থে কখনোই এই নির্দিষ্ট ঘটনাসমূহ উদ্ধৃত করা হয়নি, তাই এটি প্রকৃত ঘটনা হলেও সম্ভবত খুব কমই ঘটেছিল। মুহাম্মদ পরে তাঁর কোরানের একটি আয়াতে কন্যাশিশু হত্যার নিন্দা করেছিলেন, কিন্তু দুর্ভিক্ষ থেকে উদ্ভূত হতাশার কারণে হয়তো তারা এই নিষ্ঠুর কাজটি করত (৭)। বলা হয় যে, জায়েদ যদি এমন কোন ঘটনার কথা শুনতে পেতেন, তবে তিনি পিতামাতার কাছে গিয়ে সেই সন্তানকে নিজেই ভরনপোষণের প্রস্তাব দিতেন। একমাত্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ছাড়া, মক্কাবাসীদের অন্যান্য দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি দেয়াকে তিনি জঘন্য মনে করতেন। আব্রাহামের ঈশ্বর কেবল পশুই সৃষ্টি করেননি, তিনি বৃষ্টিও সৃষ্টি করেছেন যা পেয়ে মাটিতে ঘাসসমূহ বৃদ্ধি পায়, পশুরা সেগুলো খায়।
“আর তোমরা তাঁর আল্লাহ ছাড়া অন্যদের নামে তাদের জবাই কর” (৮)। তিনি কালো প্রস্তরকে চুমু দেয়ার অভ্যাসকেও উপহাস করেছিলেন। এটা ছিল অর্থহীন। কালো পাথরটি একটি পাথর ছাড়া আর কিছুই নয়। হতে পারে, তাদের বিশ্বাসমতে এটি বেহেশত থেকে ছিটকে এখানে এসে পড়েছে, তা সত্ত্বেও এটি নিছক পাথরই, এবং কোনোভাবেই এটির আর অন্য কোন প্রভাব নেই। মক্কাবাসীদের পাথর ও কাঠের মূর্তি উপাসনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। মক্কা তখনও জায়েদের জন্য নিরাপদ ছিল, তাঁকে মন্দিরের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীকে বলতে দেখা গেছে: “হে কুরাইশের লোকেরা! আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে আমি ব্যতীত ইব্রাহিমের ধর্মের কেউ নেই” (৯)।
খোলামেলা স্বভাব এবং উদ্যোগের কারণে জায়েদ এমনকি তাঁর নিজের পরিবারের মধ্যেও শত্রু হয়েছিলেন। তাঁর সৎ ভাই খাত্তাব (Khattab) তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। খাত্তাব তাঁর বদমেজাজের জন্য পরিচিত ছিলেন। মুহাম্মদের চাচী সাফিয়ার মতো, যিনি তাঁর ছেলে জুবায়েরকে মারতেন, খাত্তাবও তেমনই তাঁর পুত্র উমরের উপর নির্দয় ছিলেন। উমর ছিলেন মুহাম্মদের কাছের একজন, যিনি পরে খলিফা হয়েছিলেন (১০)। একপর্যায়ে খাত্তাব তাঁকে পৌত্তলিক ধর্মত্যাগী সাব্যস্ত করে ঘুষি মেরেছিলেন। এই বৈরিতার পেছনে পারিবারিক সমস্যাও থাকতে পারে, যেহেতু আকর গ্রন্থে এই দিকটায় খুব একটা আলোকপাত করা হয় নাই। জায়েদ ও খাত্তাবের মা একই, কিন্ত জায়েদের বাবা ছিলেন খাত্তাবের ছেলে৷ ফলে, খাত্তাব একাধারে জায়েদের চাচা ও ভাই ছিলেন (১১)। খাত্তাব ঘটনাক্রমে জায়েদকে মক্কা থেকে বের করে দেন, আর জায়েদ হেরা পর্বতের একটা গুহায় বাস করতে থাকেন। হেরা শহরের একটু উত্তর দিকে পাথরে গড়া আলাদা একটা পর্বত।
তিনি কেবল রাতেই মক্কায় প্রবেশ করতেন। অনুমান করা যায়, তিনি মুহাম্মদ, খাদিজা, ওয়ারাকা এবং এই ধর্ম- অনুসন্ধানকারীদের ছোট দলটির অন্যদের সাথে গোপন বৈঠকের জন্য অন্ধকারের আড়ালে খাদিজার বাড়িতে যেতেন। একপর্যায়ে এই সফরগুলিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ খাত্তাব জানতে পেরেছিলেন যে জায়েদ রাতে মক্কায় প্রবেশ করছেন। আর তাই তিনি জায়েদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে মক্কাবাসীদের বলে রেখেছিলেন। তিনি নির্বাসিত ছিলেন, তবে সহানুভূতি দেখিয়ে মুহাম্মদ তাঁকে খাবার দিতেন এবং পৌত্তলিক ধর্মের বিপরীতে আব্রাহামের ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে বয়ান শুনতেন।
জায়েদের সমর্থকদের মধ্যে যে মুহাম্মদ ছিলেন তা পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন মুহাম্মদ জায়েদের জন্য রান্না করা মাংস নিয়ে গেছিলেন, কিন্তু তাঁকে তাড়া করা হয়েছিল। জায়েদ সে মাংস স্পর্শ করতে অস্বীকার করেছিলেন, যখন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে এটি এমন একটি পশু থেকে আনা হয়েছিল, যা সম্ভবত পৌত্তলিক দেবদেবীদের উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ উৎসর্গ করেছিলেন। জায়েদ বলেছিলেন, “তোমার প্রতিমাগুলির সামনে তুমি যা কোরবানি দাও, তা আমি কখনও খাই না। আমি কেবল ঈশ্বরের নামে যা বলা হয়েছে তা খাই” (১২)।
জায়েদ তাঁর মতামত প্রকাশের জন্য কবিতা রচনা করতেন। জায়েদের সংগ্রহে থাকা স্বরচিত কবিতাগুলির মধ্যে একটি এমন কিছু ধারণা প্রকাশ করেছিল, যেগুলো মুহাম্মদ পরবর্তীতে ভিন্ন কাব্যিক আঙ্গিকে বিশদ বর্ণনা করেছিলেনঃ
আমি কি এক ঈশ্বরের উপাসনা করব নাকি হাজার?
যদি আপনি দাবি করেন এমন অনেকগুলি থাকে,
আমি আল-লাত এবং আল-উজ্জা উভয়কেই ত্যাগ করি,
কোনও দৃঢ় মনের মানুষ হিসেবে সেটাই করবে।
আমি আল-উজ্জা এবং তাঁর দুই মেয়েকে উপাসনা করব না, (১৩)
আমি বনু আমরের দুটি ছবিও দেখতে যাব না।
আমি হুবালকে উপাসনা করব না, যদিও তিনি আমাদের ঈশ্বর ছিলেন,
যে দিনগুলিতে আমার বুদ্ধি কম ছিল।
আমি ভাবলাম (রাতে অনেককিছুই অদ্ভুত,
দিবালোকের মধ্যে যা সহজেই বোধ্য),
ঈম্বর বহু মানুষকে ধ্বংস করেছিলেন,
যার আমল সম্পূর্ণ মন্দ ছিল,
এবং জনগণের তাকওয়া দ্বারা অন্যকে রক্ষা করেছিল,
যাতে একটি ছোট্ট শিশুটি পুরুষত্ব নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে।
একজন মানুষ কিছু সময়ের জন্য শিথিল হয়ে যায় আর পুনরুদ্ধার করতে পারে
বৃষ্টির পরে যেমন গাছের ডাল আবার সঞ্জীবিত হয়।
আমি আমার পালনকর্তার করুণাময়ের সেবা করি
যাতে ক্ষমাশীল প্ৰভু আমার পাপ ক্ষমা করেন,
সুতরাং তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর।
আপনি যখন ধরে রাখেন তবে আপনি বিনষ্ট হবেন না।
আপনি পুণ্যবানদের উদ্যানগুলিতে বাস করতে দেখবেন,
কাফেরদের জন্য জাহান্নাম আগুন জ্বলছে।
যখন তারা মারা যায়
লজ্জায় তাদের স্তনগুলি যন্ত্রণায় সঙ্কুচিত হবে (১৪)।
জায়েদ মারা যাওয়ার পর তাঁর বয়স সম্পর্কে কিছু জানা যায় না, তবে জানা গেছে যে মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের কিছু পরে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। একটি সংস্করণে জানা যায়, সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় দক্ষিণ ইরাকে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার সন্দেহভাজন বা হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। আরেকটা সূত্র তাঁর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে না বললেও, ইঙ্গিত দেয় যে তাঁকে হেরা পর্বতে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। ওয়ারাকা তাঁর স্মরণে একটি স্মৃতিগাঁথা রচনা করেছিলেন এবং মুহাম্মদ পরে তাঁর গুণকীর্তন করেছিলেন।
এটা সম্ভব যে মুহাম্মদ তাঁর পুত্রদের মৃত্যুতে, বিশেষত তাঁর প্রথম পুত্রের জন্মের সময়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেটাই প্রথমে তাঁকে জায়েদবাদের (Zaydism) প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। তাঁকে হারানোর ফলে যে তীব্র বেদনা মুহাম্মদ পেয়েছিলেন, তারই ধারাবাহিকতায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন প্রিয় পুত্রকে ঈশ্বরের নামে জবাই করার সময় আব্রাহামের কেমন লেগেছিল, যদি না শেষমুহূর্তে ফেরেশতা এসে তাঁকে নিবৃত্ত করতেন। ঈশ্বরে বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে আব্রাহাম যে আদেশ পালন করেছিলেন, তা নিজের পুত্রের প্রাণ নেওয়ার মতো ভয়াবহতাকে কমাবে না, পুত্রশোকের গভীরতাও কমাবে না। নিজের জীবনের মূল্যের চেয়েও, ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর আব্রাহামের সমর্পণ ছিল সম্পূর্ণ এবং অবিচল।
জায়েদের মৃত্যুতে, মুহাম্মদ বৌদ্ধিক এবং মানসিক অস্থিরতার সময়কালে প্রবেশ করেছিলেন। জায়েদ ও অন্যান্য উৎস থেকে আসা বিকল্প ধর্মীয় ধারণাগুলি ছিল তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গির উপর হাতুড়ি মারার মতো, যা এখন সম্পূর্ণ ধ্বংসের কাছাকাছি। একই সময়ে, তিনি ছিলেন স্নায়বিক এবং মানসিক সমস্যায় ভোগা একজন মানুষ যার মিশ্রণ ঘটছিল, আর সেই সাথে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের সময়, তাঁর মৃগীরোগজনিত খিঁচুনির কারণে হেনস্তা তাঁকে প্রচন্ড আঘাত দিয়েছিল, বিশেষত তা যদি জনসম্মুখে প্রথমবার তাঁর এই অসুস্থতার প্রদর্শন হয়ে থাকে। অনেক মক্কাবাসী সেই মুহূর্তে তাঁকে শান্ত করত। তারা মনে করত, মৃগীরোগ আর শয়তানের আছর হাত ধরে চলে। কমপক্ষে, তারা সেই থেকে তাঁকে এক অদ্ভুত সহযোগী হিসেবে দেখবে। অতি সংবেদনশীল মুহাম্মদ, তখন তাদের তিরস্কারকারী দৃষ্টি থেকে নিজেকে দুরে রাখেন। তাঁর অসুস্থতার প্রকাশ্য প্রদর্শন তাঁর আত্মমর্যাদার ক্ষতি করে, তাই দেখতে পাওয়া যায় তাঁর মধ্যে থাকা আহত ছোট্ট বালকটিকে বারবার আশ্বস্ত করতে হচ্ছিল এই বলে তাঁর ওজন কেবল দশ বা একশো বা এক হাজার লোকের নয়, বরং সম্মিলিত সবার চেয়েই বেশি।
মৃগীরোগ ছাড়াও, তিনি তীব্র মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছিলেন বলে মনে হয় যা মৃগীর সাথে যুক্ত ছিল, তবে সম্ভবত প্রাথমিক জীবনের ট্রমা থেকে উদ্ভূত একটি পৃথক মানসিক অসুস্থতাও ছিল। তাঁকে ওষুধ খাওয়ানোর দরকার ছিল, তবে এ জাতীয় ব্যাধি মোকাবেলার জন্য কোনও ওষুধ ছিল না, কারণ অনুসন্ধানের জন্য চিকিৎসক এবং সেবাদানকারীও কেউ ছিল না তখন। বারবার ও নিখুঁতভাবে করা শারীরিক কসরত সহকারে জটিল প্রার্থনার রীতিনীতি বর্ণনা ও অনুশীলন করে তিনি শেষপর্যন্ত দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।
জায়েদ এবং অন্যান্য মতবিরোধীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি ধর্মীয় প্রশ্নে মগ্ন হয়েছিলেন। মুহাম্মদের আধ্যাত্মিক আকাঙ্ক্ষা সঠিক হওয়া উচিত ছিল, যেহেতু সেটা তাঁর পৌত্তলিক ঐতিহ্য সম্পর্কে বৈধ সন্দেহের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। তবে সেটা তাঁর স্নায়বিক ব্যাধির কারণে আবেশের স্তরে উন্নীত হয়েছিল। স্নায়বিক শক্তি তাঁর বৈধ পূর্ব ধারণাকে বড় করে তুলে উদ্বেগকে আরও খারাপ করে দিচ্ছিল, কারণ সে তাঁর পুরনো বিশ্বাসগুলি প্রতিস্থাপন না করেই সরিয়ে দিচ্ছিল। তা সত্ত্বেও, নতুন কিছুর নিরাপত্তা তাঁকে আবদ্ধ করে রেখেছিল প্রতিনয়ত, যাকে আজকের দিনে 'অস্তিত্ব সংকট' হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় (১৫)।
সর্বদা অসামাজিক হয়ে মুহাম্মদ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে শুরু করলেন। কথিত আছে, তিনি হেরা পর্বতের চূড়ার নিকটে একটি গুহায় ধ্যান করে একাকী দিন কাটিয়েছিলেন, সম্ভবত একই গুহায় জায়েদও বাস করতেন। গুহার প্রবেশপথ থেকে নিচে মক্কার একটি উঁচু দৃশ্য এবং এর বাইরে বাদামি পর্বত এবং শুকনো উপত্যকা দৃশ্যমান ছিল। কিছু ইসলামিক সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি রমজান মাসে রোজা রাখার অনুশীলন শুরু করতে হেরা পাহাড়ে গিয়েছিলেন। তবে এটি অসম্ভব ছিল, কেননা রমজানের রোজা পরবর্তী সময়কার আবিষ্কার ছিল। অন্যান্য সূত্রসমুহে বলা হয় যে, তিনি কয়েকদিন পরপর খাবার মজুদের উদ্দেশ্যে বাসায় ফিরে আসতেন, যাতে ধরে নেয়া যায় যে তিনি উপবাসে নিয়োজিত ছিলেন না, তবে তিনি একাকী সময় কাটানোতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। এটি তাঁর জন্য মানসিকভাবে যন্ত্রণাদায়ক সময় ছিল। নিজের কাছে উত্থাপিত প্রতিটি প্রশ্নই তাঁকে আরও প্রশ্নের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তাঁর মনে প্রশ্নের উদয় হতে থাকে - অস্তিত্বের বাস্তবতা এবং এর মধ্যে থাকা সমস্ত অভিজ্ঞতা, ভালো-মন্দ কীভাবে তুমি ব্যাখ্যা করবে? চাঁদ বা সূর্য কীভাবে এটির ব্যাখ্যা করতে পারে যার উপাসনা মক্কাবাসী করে? চাঁদ, সূর্য কি তোমাকে সাহায্য করতে পারে? উত্তর যদি পূর্বপুরুষদের দেবদেবী এবং অন্যান্য উপাসনার উপাদানসমূহে পাওয়া না যায়, তবে কি ইব্রাহিমের ঈশ্বরের মধ্যে পাওয়া যাবে, যিনি চাঁদ ও সূর্য সহ সবকিছুর স্রষ্টা? এই ঈশ্বরের প্রকৃতি কি ছিল? মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্ক কী ছিল? এটি নিরর্থকতার একটি অনুশীলন ছিল, শক্ত কিছু নিয়ে আসার আশায় বাতাস দখল করার মতো। তিনি কিছু প্রশ্ন চিন্তা করে যাচ্ছিলেন, যেগুলোর নিশ্চিত কোন উত্তর নেই বিশ্বাস করা ছাড়া, কিন্তু কিসের উপর বিশ্বাস? পুরষ্কার ও শাস্তির ঈশ্বর, স্বর্গ আর নরকের ঈশ্বর? পরলোক বলে কি কিছু আছে, এবং সেটা কি জায়েদের কবিতার সেই বাগান? একটি বস্তু-সর্বস্ব বেহেশত? তাইলে বস্তু-সর্বস্ব নরকও থাকবে, আগুন আর জলন্ত মাংসের স্থানও? এই দুনিয়ার দুঃখকষ্ট কি যথেষ্ট না? না জানার কারণে তিনি যত বেশি যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন, ততই তিনি বোঝার দিকে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি যতই বুঝতে পারছিলেন যে উত্তরগুলি তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, উত্তরগুলির জন্য তিনি ততই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি এ্যাডভার্ড মঞ্চের (Advard Munch) আঁকা ছবির বেদনাময় চরিত্র হয়ে উঠলেন। তাঁকে নিশ্চয়তার স্থিতিশীল অবস্থায় পৌঁছতে হবে, অথবা তিনি পাগল হয়ে যাবেন, যা অনেকেই ইতিমধ্যে তাঁকে নিয়ে মনে করে।
আবেগময় ও বৌদ্ধিক উত্থানের এই সময়কালে, সন্দেহ ও যন্ত্রণায় আবদ্ধ মুহাম্মদের অতি সচল মস্তিষ্ক-উদ্ভুত আকর্ষণীয় কিন্তু ভ্রমজনিত অভিজ্ঞতা যেন মুক্তির স্বাদ নিয়ে এলো; যা তাঁকে প্রবোধ দিয়েছিল এই বলে যে, তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত বিশেষ অতুলনীয় একজন। এটি হয়েছিল ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, মুহাম্মদের চল্লিশ বছর বয়সে। এগুলি আলোর ঝলকপুর্ণ স্বপ্ন হিসেবে শুরু হয়েছিল যা, 'ভোরের উজ্জ্বল আলোর মতো এসেছিল'। তিনি হেরা পর্বতের গুহায় নির্জনে নিজেকে রেখে দিন পার করে দিতে লাগলেন, মাঝেমাঝে সেখানে খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত টানা কয়েকদিন কাটিয়ে দিতেন। একসময় তিনি স্বপ্নে স্পষ্ট দেখতে পেলেন, ভোরের আলোতে এক ফেরেশতা আসলেন, আর তাঁকে কারুকার্য খচিত পোষাক দেখালেন যার উপর কিছু লেখা ছিল। ফেরেশতা তাঁকে সেই লেখাগুলো দেখিয়ে আদেশ দিলেন, “পড়”; কিন্তু মুহাম্মদ বললেন “আমি পড়তে পারিনা”, তাঁর মানে তিনি লেখাপড়া জানেন না। স্বর্গদূত তাঁকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেলেন যে, তিনি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলেন না। তারপর তাঁকে ছেড়ে দিলেন এবং তাঁকে আবার বললেন, কাপড়ে যা আছে তা পড়ে শোনাতে। যখন তিনি প্রতিবাদ করলেন যে তিনি পড়তে পারবেন না, তখন স্বর্গদূত তাঁকে এত জোরে চেপে ধরলেন, তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি মারা যাবেন। নিজেকে মুক্ত করার জন্য মুহাম্মদ শেষপর্যন্ত বলেছিলেন, “আমি কি পড়ব?” ফেরেশতা কিছু আয়াত তেলাওয়াত করলেন এবং মুহাম্মদ সেগুলি পুনরাবৃত্তি করলেন। এতে ফেরেশতা অদৃশ্য হয়ে গেল এবং মুহাম্মদ আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি চেতনা ফিরে পেলেন। তিনি বিশ্বাস করতে লাগলেন যে, তিনি পাগল হয়ে গেছেন বা তাঁকে শয়তান আছর করেছে। তিনি নিজেকে উপর থেকে থেকে ফেলে দেয়ার ইচ্ছে করে গুহা থেকে ছুটে বের হয়ে গেলেন। সে সময়ে পাগল হওয়ার চেয়ে খারাপ আর কিছুই ছিল না। এভাবে মারা গেলে মক্কাবাসীরা তাঁকে তেমন পাগলই ভাববে। যখন তিনি দুরারোহ পাহাড়টির সুবিধাজনক জায়গায় উঠছিলেন, তখন তিনি একটি আওয়াজ শুনতে পেলেন: “হে মুহাম্মদ, আমি জিব্রাইল (Gabriel) এবং আপনি এবং আল্লাহর নবী”। দিগন্তে একটি বিশাল অবয়ব দেখতে পেলেন মুহাম্মদ, যা পুরো আকাশকে ছেয়ে ফেলেছিল। মুহাম্মদ আটকে গেলেন। মনে হচ্ছিল যেন তাঁকে সেই জায়গায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে, তবুও তিনি ঘাড় ফেরাতে পারলেন। তিনি যেদিকেই তাকালেন সেদিকেই দেখতে পেলেন, ফেরেশতাটি তাঁর ছয়শ ডানা মেলে পুরো আকাশ ঢেকে রেখেছেন। একটি সংস্করণে বর্ণিত হয়েছে যে, মুহাম্মদ প্রথমে মানবরূপে ফেরেশতাঁকে খুব কাছাকাছি দেখেছিলেন, যেন তাঁকে স্পর্শ করা যায়। মুহাম্মদের অনুরোধে ফেরেশতা কেবল তাঁর মহিমাপুর্ণ আকারটি ধারণ করেছিলেন, কিন্তু তিনি যখন তাঁকে তার আসল রূপে পুরো দিগন্তের ওপরে উঠতে দেখেন, মুহাম্মদ তখন অজ্ঞান হয়ে যান (১৬)। জিব্রাইল (Gabriel) তখন মানব আকারে নেমে আসে, মুহম্মদকে জাগিয়ে তোলেন এবং “মুখ থেকে ঝরা লালা মুছে ফেলেন” (১৭)।
ইসলামিক ইতিহাসে দেখা যায়, মুহাম্মদ আতঙ্কিত হয়ে বাড়িতে ছুটে আসেন। মারলির ভূত দেখার মতো তিনি বিছানার চাদরের নিচে লুকালেন, আর স্ত্রীকে কেঁদে বলতে লাগলেন, “আমাকে জড়িয়ে রাখো! আমাকে জড়িয়ে রাখো!” ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তিনি তাঁকে ঘটনার কথা জানিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি কোনও ভূত বা জিন দেখেছেন। “খাদিজা, আমার মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি!” এবং, “আমার জীবন সঙ্কটাপন্ন”। ইতিমধ্যে তাঁর এরকম বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারে, কারণ খাদিজা তাঁকে একবার বলেছিলেন, “তোমার এই বন্ধু” আবার কখন আসবে? পরেরবার যখন এটি ঘটল, তিনি মুহাম্মদের সাথে ছিলেন এবং নিচের পরীক্ষাটি চালিয়েছিলেন : খাদিজা তাঁকে তাঁর বাম উরুতে বসিয়ে দিয়েছিলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি এখনও ভূত বা জিনকে দেখতে পাচ্ছেন কিনা। তিনি যখন বলেছিলেন যে দেখতে পাচ্ছেন, খাদিজা তাঁকে তাঁর অন্য উরুতে বসিয়েছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তা দেখতে পারেন।
তারপর খাদিজা তাঁর শরীরের উপরের পোশাকটি খুলে ফেলে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি যেন তা দেখেন। এবার দেখা গেল যে, তিনি আর কাউকে দেখছেন না। খাদিজা তখন বুঝে নিলেন যে, এটি কোন দৈত্য নয় বরং ফেরেশতা; কেননা, ফেরেশতা মহিলার শালীনতার প্রতি শ্রদ্ধা রাখবেন, যা ভূত কখনো করবে না। “আনন্দ কর, ভাই বোনেরা, উঠে দাঁড়াও” - তিনি বললেন। “ঈশ্বরের কৃপায় যার হাতে খাদিজার প্রাণ, আমি আশা করি আপনি এই সম্প্রদায়ের নবী”। সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত না হলেও, তিনি তাঁর চাচা ওয়ারাকার কাছ থেকে আরেকটা মতামত চেয়েছিলেন। বয়স্ক ও অন্ধ ওয়ারাকা নিশ্চিত করেন যে, মুহাম্মদ সত্যই একজন নবী ছিলেন, কারণ যদি মুহাম্মদ যা বলেছিলেন তা সত্য হয়, তবে মুসার (Moses) সামনে যে ফেরেশতা উপস্থিত হয়েছিল, তাঁকেও সে-ই দেখা দিয়েছিল।
স্ত্রীর উৎসাহ দেখে মুহাম্মদ বিশ্বাস করেছিলেন যে, গুহার অবস্থানের মধ্য দিয়ে তিনি একক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নবী হিসেবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাঁর স্নায়বিক অভিজ্ঞতার শক্তি এমন ছিল যে, তিনি সত্যই বিশ্বাস করেছিলেন, ফেরেশতারা তাঁকে দেখা দিয়েছেন। তাঁর এই বিশ্বাস অবিচল হয়, তাঁর অনুগামীদেরও, কোরানের অধিকাংশ বিষয়বস্তু বিরক্তিকর হওয়া সত্ত্বেও। “ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ” হিসেবে হত্যাযজ্ঞ, খুন, নির্যাতন, দস্যুতা, ধর্ষণ, পুরুষ-মহিলা এবং শিশুদের দাসত্ব এবং অন্যান্য নৃশংসতা, তাঁর এই বিশ্বাসকে চরম হাস্যকর করে তোলে।
আধ্যাত্মিকের চেয়ে কম নাটকীয় হলেও, মুহাম্মদের গুহা-অভিজ্ঞতার স্নায়বিক ব্যাখ্যা ভালো গ্রহণযোগ্যতা পায়। তিনি যে মৃগীরোগে ভুগছিলেন তা অষ্টম শতাব্দীতেই পশ্চিমা সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে, যখন বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিক থিওফেনিস (Theophanes) এক সুদৃঢ় দাবি করেছিলেন যে, একজন মৃগীরোগীর সাথে বিয়ে দেয়ায় খাদিজা ঘ্যানঘ্যান করত (১৮)। এরপর থেকে পশ্চিমা ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় পণ্ডিতরা বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করেছেন। আজ, মুহাম্মদের মৃগীরোগের প্রশ্নটি উচ্চ শিক্ষার স্তর থেকে স্নায়ুবিজ্ঞানে (Neuroscience) স্থানান্তরিত হয়েছে। মৃগীরোগ সম্পর্কিত বইগুলি তাঁকে এই রোগে আক্রান্ত বিখ্যাত ব্যক্তিদের কেস স্টাডির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ইসলামিক গ্রন্থে বর্ণিত তাঁর লক্ষণগুলি ক্লিনিকাল বিচার- বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। 1976 সালে, নিউরোলজিস্ট এফ আর ফ্রিম্যান (F R Freeman) একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্ত প্রদান করেছিলেন যে, “সবচেয়ে সম্ভাব্য নির্ণীত রোগ” হলো, মুহাম্মদ টেম্পরাল লোব উদ্ভুত মৃগীরোগের শিকার হয়েছিলেন (১৯)।
সাম্প্রতিককালে, নিউরোসাইকোলজিস্ট ডেদে কোরকুট (Dede Korkut) মুহম্মদের স্নায়বিক রোগের একটি বই লিখেছেন। তিনি এই খিঁচুনিগুলিকে মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব হতে উদ্ভূত মৃগীরোগের বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করেছেন; যা মুহাম্মদ তাঁর মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন বলে তিনি মনে করেন। টেম্পোরাল লোবের মাঝে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের বিচ্ছুরণের ফলে এই খিঁচুনির শুরু, যা বজ্র-বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বিদ্যুতের ঝলকের মতো অনিয়ন্ত্রিত বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ দ্বারা ঐ লোব সংলগ্ন মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে ক্রমেই বিস্তার লাভ করে। টেম্পোরাল লোব দৃষ্টি ও শ্রবণে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করে। এই ধরনের খিঁচুনি দৃষ্টি, শ্রুতি এমনকি ঘ্রাণেরও ভ্রম ঘটাতে পারে, যার বিষয়বস্তু স্বপ্নের মতোই আক্রান্ত ব্যক্তির মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। কোরকুট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুহাম্মাদের “ধর্মীয় এবং ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর অসুস্থতা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, যা তাঁর মাঝে আত্মপ্রবঞ্চনামূলক এই ধারণা দেয় যে তিনি নবী” ।
গুহাটি প্রতীকী হিসেবে দেখা যায়। গুহাটি একটি সুতিকাগার ছিল এবং সেখান থেকে নতুন মুহাম্মদের জন্ম হয়েছিল। তিনি তাঁর পুরনো স্বত্ত্বাকে আমুল পরিবর্তন করেছেন, এবং এখন তিনি কোন দুঃখবোধ ছাড়াই কুঁকড়ে যাওয়া অতীতের দিকে তাকাচ্ছেন। হারিয়ে গেছে দরিদ্র এতিম, ছাগল পালক, বিয়ে হওয়া ধনী মহিলার উপর যার মর্যাদা নির্ভর করত সেই মুহাম্মদ। দশজন ব্যক্তির ওজনের তুলনায় ঈশ্বর তাঁকে ভারি করেছিলেন, সে তাঁর মতো আরো একশজনের ওজনের চেয়েও ভারি। তেমনিভাবে দেখতে পেলেন, একাই তিনি সহস্র লোকের ওজনের চেয়ে ভারি। নিঃসন্দেহে মুহাম্মদ তাদের সবাইকে পরাভূত করেছিলেন। তিনি আকারে আর উচ্চতায় বেড়ে উঠলেন; তিনি এখন সবচেয়ে উঁচু পর্বতমালার চেয়েও লম্বা, (Adam) আদমের মতো লম্বা যার মাথাটি স্বর্গে প্রবেশ করল এবং তিনি শুনতে পেলেন স্বর্গদূতদের মধ্যে কথা। অবলোকন করলেন ঈশ্বরের সিংহাসন।
তাঁর অর্ধনগ্ন স্ত্রী গদগদ করে বলেছেন: “মুহাম্মদ, তুমি একজন নবী”।