অধ্যায় - ১০ আপনাকে মান্য করবো, আপনাকে?
যদিও মুহাম্মদের এক বিশাল সংখ্যক অনুসারী আবিসিনিয়ার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেছিল, কিন্তু মুহাম্মদের চাচা হামজা সহ প্রায় চল্লিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিশ্বাসী তখনও মক্কায় রয়ে গেছে। তাঁরা আরকামের বাড়িতে জমায়েত হয়েছিল এবং খুব কমই বের হতো। আক্রমণের ভয়ে তারা দরজা তালাবদ্ধ করে রাখত, এবং কেবল গোপন সংকেতটি জানে এমন লোকদেরই ঢুকতে দেয়া হতো। তবে মুহাম্মদের শক্তিশালী শত্রুদের মধ্যে অন্যতম উমর ইবনে খাত্তাবের ( Umar ibn Khattab) ধর্মান্তরের সাথে সাথে তাদের ভয় শীঘ্রই কেটে যায়।
আবুল হাকামের ভাগ্নে উমর পারস্য আর পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। উৎকট লম্বা গড়নের এবং সুঠাম দেহের অধিকারী উমর তাঁর বদমেজাজের জন্য পরিচিত ছিলেন। তরুণ বয়সে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া উমরকে, ইসলামিক গ্রন্থে এক জটিল মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বাবার হাতে মারধরের শিকার হবার কারণে তাঁর মাঝে অন্যদের হেয় করা ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। আবুল হাকামের উৎসাহে তিনি প্রায়শই মুহাম্মদের কিছু অরক্ষিত অনুসারীদের সাথে মারধরে অংশ নিয়েছিলেন। কথিত আছে যে, একবার এক ধর্মান্তরিত দাসীকে তিনি ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত চাবুক মেরে গিয়েছিলেন। এমনকি মুশরিক মক্কাবাসীরাও তাঁকে ভয় করত। একই সাথে তিনি বুদ্ধিমান, শিক্ষিত এবং বাকপটু ছিলেন। মক্কাবাসীদের মাঝে ঝগড়ায় মধ্যস্থতা করতে তাঁকে ডাকা হতো এবং বাইরের গোত্রের সাথে বিরোধে তিনি মক্কাবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করতেন।
ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থে যেমনটা বলা হয়েছে, উমর তাঁর মামা (আবুল হাকাম) ও মক্কার অন্যান্য নেতাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মক্কাকে বিভক্ত করার মূলে যে মুহাম্মদ দায়ী তাঁকে হত্যার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে পরিণতি যত ভয়াবহই হোক না কেন! কেউ একজন তাঁকে খবর দিল যে, মুহাম্মদ আরকামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। তলোয়ার কোমরে বেঁধে মুহাম্মদকে হত্যার জন্য উজ্জীবিত হয়ে উমর সেই বাড়ীর দিকে যেতে লাগলেন। ওখানে পৌঁছার আগে মুহাম্মদের এক সহানুভূতিশীল অনুসারীর সাথে পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেল। সে উমরকে তলোয়ার বেঁধে কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইল। সত্যবাদিতার জন্য পরিচিত উমর তাঁকে বললেন যে, তিনি মুহাম্মাদকে হত্যা করার জন্য আরকামের বাড়িতে যাচ্ছেন। গুপ্তচর অনুসারীটি সতর্কঘন্টা বাজিয়ে দিল আর হত্যা করার আগে তাঁকে দুইবার ভাবতে বলল, কারণ মুহাম্মদকে মেরে ফেলে ফিরে যেতে তিনি আর বেশি সময় পাবেন না। মুহাম্মদের হাশিমী বংশ অবশ্যই দ্রুত প্রতিশোধ নেবে। উমরকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রথমে তাঁর নিজের ঘর ঠিক করা উচিত, কারণ তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতিসহ তাঁর পরিবারের সদস্যরা মুহাম্মদের ধর্মের দিকে চলে গিয়েছে।
মুহাম্মদের অনুগত লোকটির সতর্ক করার পরেই মাঝ পথ থেকে উমর তাঁর পথ দ্রুত পাল্টে বোন ফাতিমার বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। ফাতিমা অব্রাহাম-ধর্মের সন্ধানকারী জায়েদের পুত্র সাইদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন, জায়েদ মুলত মুহাম্মদকে তাঁর খাঁটি আব্রাহামিক একেশ্বরবাদের আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত করেছিলেন। ফাতেমা ও সাইদ সম্প্রতি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, তবে উমরের কাছ থেকে তা গোপন রেখেছিলেন। তিনি যখন দরজার কাছে পৌঁছেছিলেন, উমর শুনতে পেলেন যে, কেউ উচ্চস্বরে কিছু একটা পড়ছে। তাঁর বোন এবং ভগ্নিপতি তখন খাব্বাবের (Khabbab) সাথে ছিলেন। খাব্বাব একজন শিক্ষিত দাস এবং প্রথমদিকের ধর্মান্তরিতদের একজন, যিনি বেশ শব্দ করে নবী মুসাকে নিয়ে মুহাম্মদের রচিত আয়াতগুলো পড়ছিলেন। ওমর দরজায় ধাক্কা দিলে ফাতেমা পাণ্ডুলিপিটি লুকিয়ে ফেলেন। ভেতরে যাওয়ার পরে উমর তাদের মুহাম্মদের ধর্মে যোগদানের জন্য দোষারোপ করলেন। তাঁরা যখন তা অস্বীকার করল, তখন তিনি তাঁর ভগ্নিপতির গলা চেপে ধরলেন এবং তাঁর বোন তাঁকে বাধা দিতে এলে তাঁর মুখেও ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিলেন। রক্ত দেখে উমর শান্ত হলেন, আর ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তারা কি পড়ছিল তিনি তা দেখতে চাইলেন, আর এরপর প্রথম দুই ডজন আয়াত পাঠ করলেন। নিজে কবি বলেই, আয়াতগুলোর সুচতুর প্রকাশভঙ্গি দেখে তিনি বিমোহিত হয়ে যান, আর ঈশ্বরের মহান কন্ঠ অনুভব করে স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। এর আগে তিনি আর কখনও এমনটা অনুভব করেননি। তিনি তাদের বললেন যে, এই রচনা পড়ে কেউও যে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে পারে এর কোন কারণ তিনি খুঁজে পাননি।
ইসলামিক সাহিত্যে বলা হয়ে থাকে, তিনি তাৎক্ষণিক ধর্মান্তরিত হয়ে যান আর মুহাম্মদদের উপর তাঁর বিশ্বাস স্থাপনের কথা জানাতে আরকামের বাড়িতে যাত্রা করেন। তবে তাঁর পূর্বের অভিপ্রায় সম্পর্কে জেনে আগে থেকেই মুহাম্মদ এবং তাঁর অনুসারীরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মুহাম্মদের চাচা হামজা (Hamza বললেন, “যদি তাঁর খারাপ উদ্দেশ্য থাকে, তবে আমরা তাঁকে নিরস্ত্র করব এবং তাঁকে তাঁর নিজের তলোয়ার দিয়ে হত্যা করব”। তারা একটি ফাঁদ পাতল। প্রবেশের পরে মুহাম্মদ উমরের হাত বেঁধে টেনেহিঁচড়ে ঘরের মাঝখানে নিয়ে যান, সম্ভবত যাতে হামজা ও অন্যরা তাঁকে পেছন থেকে ধরে রাখতে পারে। মুহাম্মদ উমরকে সাবধান করে বললেন যে, তিনি যদি ঝামেলা করেন তবে তিনি তা তাঁর ফল ভোগ করবেন এখনই। কিন্তু সবাইকে অবাক করে উমর বলে উঠলেন: “হে ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ, ঈশ্বর আর আপনি তাঁর নিকট হতে যা নিয়ে এসেছেন, তাঁর উপর আমি বিশ্বাস রাখতে আপনার কাছে এসেছি” (১)। মুহাম্মদ এতটাই শিহরিত হয়েছিলেন যে, তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলেন, “আল্লাহু আকবার!”
সারাজীবন উমর ধর্মান্ধ শক্তির দ্বারা চালিত হয়েছিলেন; দিক ঠিক করার জন্য তাঁর প্রয়োজন ছিল কেবল কারণ। এর আগে তিনি মক্কাবাসীদের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য তাঁর হিংস্র উদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়েছিলেন, আর এখন তিনি মুহাম্মদের ধর্মের প্রয়োজনে তা ব্যবহার করছেন। আরকামের বাড়িতে অনুপ্রেরণা ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তিনি ঘোষণা করলেন যে, মুহাম্মদের ধর্মকে আর অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে না রেখে প্রকাশ্যে প্রচার করার দরকার, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এই বলে : “আমরা কয়েকজনই আছি, আর আমাদের প্রতি কি করা হয়েছিল তা তুমি জানো”। উমরের ছিল তাঁর নিজস্ব ধারণা। তাঁর প্রথম পদক্ষেপটি ছিল তাঁর চাচা আবুল হাকাম সহ মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর নতুন বিশ্বাসের কথা সবাইকে জানানো। প্রতি ক্ষেত্রেই তাঁর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এরপরে ওমর তাঁর ধর্মান্তরের কথা ঘোষণা করতে মন্দিরে গেলেন, কিন্তু তিনি তা করার আগেই মক্কাবাসীদের একজন দৌড়ে গিয়ে মন্দিরের সিঁড়ির শীর্ষে উঠে চিৎকার করলেন, “হে কুরাইশ, উমর সাবিয়ান (Sabian) তথা মুসলমান হয়ে গেছে!” (২) জনতার জটলা তাঁকে ঘিরে রাখল। কেউ কেউ ঘুষি মারল, কিন্তু উমর একজন বৃদ্ধকে ধরে তাঁকে সামনে এনে মানবঢাল হিসেবে নিজের সামনে ধরে রাখলেন, যে তাঁর কাছে আসছিল বৃদ্ধকে সেইদিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। সহিংসতায় অতিষ্ঠ হয়ে তিনি তাঁর নতুন বিশ্বাস ঘোষণা করতে গোত্র ও গোত্রদের সভায় গেলেন এবং চ্যালেঞ্জ করলেন, কে তাঁকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে (আসুক)! বেশ কয়েক দফা কিলঘুষি, হাতাহাতির পর মক্কাবাসীরা তাঁকে একা ছেড়ে দেয়।
উমরের উগ্রতা অন্য বিশ্বাসীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং শীঘ্রই লোকেরা মক্কাবাসীর সবকিছুর কেন্দ্রস্থল সেই মন্দিরের সামনে কয়েকটি দলে এসে নিয়মিত লোকদেখানো প্রার্থনা আর কোরআন শরীফ পাঠ করা শুরু করল। তাঁর ধর্মান্তরিত হওয়ার পরে কিছু নিরপেক্ষ লোক তাদের বিশ্বাস ঘোষণা করে এবং সর্বসাধারণের প্রার্থনায় অংশ নেয়। যদিও মক্কার জনসংখ্যার তুলনায় ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা তখনো অল্প ছিল, মক্কাবাসীরাও নতুন ধর্মান্তরকে একটি বিরক্তিকর প্রবণতা হিসেবে দেখতে লাগল। তাদের উদ্বেগের আরো কারণ ছিল, মুহাম্মদের ধর্মের কথা উপত্যকা ছাড়িয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং বহেরাগতরাও এখন তাঁর ধর্মে আসার ইচ্ছে ব্যক্ত করছে। মুহাম্মদ তাদের স্বাগত জানালেন এবং আনন্দের সাথে তাঁর এই 'আত্মসমর্পনের ধর্ম' ও এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করলেন। কেউ কেউ ধর্মে যোগ দিয়ে শীঘ্রই কোরআনের আয়াত মুখস্থ করে ওযু ও নামাজের নিয়মাবলী শেখা শুরু করল। মুহাম্মদ নতুন এসব ধর্মান্তরিতদেরকে তাদের নিজ গোত্রে পাঠিয়ে দিলেন গোত্রবাসীদের মধ্যে ধর্মপ্রচারের জন্য। এ ঘটনাগুলি দেখে ভীত হয়ে মক্কাবাসীরা পুরো হাশিমী বংশকে শাস্তি দেয়ার চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করল আর মুহাম্মদকে বাঁচানোর দায়িত্ব দিল হাশিমী গোত্রের লোকদের। বেশিরভাগ হাশিমীরা মুহাম্মদের ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁরা বংশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে আবু তালিবের সাথে ছিলেন। মক্কাবাসীরা যুক্তি দেখিয়েছিল যে, তাঁরা যদি হাশিমীদের মনোবল ভাঙতে পারে এবং মুহাম্মদ থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করাতে পারে, তবে তারা মুহাম্মদকে গৃহযুদ্ধের ভয় ছাড়াই মোকাবেলা করতে পারবে। তাঁর ধর্ম এবং তাদের জীবনযাত্রায় যে সমস্যাগুলি সৃষ্টি করেছিল, তাঁর মৃত্যুই সেসবের অবসান ঘটাবে। এটি বাস্তবায়ন করতে নেতারা হাশিমীদের শহরব্যাপী সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করার বিষয়ে একমত হয়েছেন। মুহাম্মদ এবং তাঁর গোত্রের লোকজনদের অবাঞ্ছিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল এবং অন্য মক্কাবাসীদেরও তাদের সাথে কিছু করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাদের সাথে কুরাইশের বিবাহ-শাদি নিষেধ করা হয়েছিল। তাদের সাথে ব্যবসা করা নিষিদ্ধ ছিল, সেটা কেনা বা বেচা যাই হোক। মক্কার নেতারা একটি নিষেধাজ্ঞা আদেশ লিখেছিলেন এবং বিভিন্ন কুরাইশ বংশের প্রতিনিধিরা এবং তাদের সহযোগীরা এটিতে স্বাক্ষর করে বা তাঁর উপর তাদের চিহ্ন চাপিয়ে দেয়ার পরে এটি মন্দিরের ভেতরে লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই হুকুমনামায় মুহম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগের একটি তালিকা ছিল যা এমনঃ মুহাম্মদ বহু মক্কান পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধন ভেঙে ফেলছিলেন, তিনি মক্কার বিশ্বাস ও ঐতিহ্যকে অপমান করেছিলেন এবং তিনি তাদের যুবকদের একটি মনগড়া ধর্মের দ্বারা কলুষিত করছিলেন।
হাশিমীরা হতবাক হয়ে গেল! কথাবার্তা বলার সময় লোকজন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। এমনকি পুরনো হাশিমী বন্ধুদেরকেও তাদের বাড়িতে আসতে দিচ্ছিল না। মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা যখনই মন্দিরের সামনে প্রার্থনা করত, লোকজন কানে আঙ্গুল চেপে রাখত আর ওখান থেকে সরে যেত। অবশেষে, শত্রুতার ফলে আরও বড় ক্ষতি হতে পারে এই আশঙ্কায় হাশিমীরা নিজেদেরকে শহরটির একটা জায়গায় বন্দি করে ফেলল। জায়গাটি ছিল একটি খালের মুখ। তাদের বাড়িগুলি পাহাড়ের তীরে নির্মিত হয়েছিল এবং সরু এবং অনেকটাই খাড়া গলির ভেতর দিয়ে চলাচল করতে হতো। সবাই ওখানে গেলেও মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাব ছিলেন একমাত্র হাশিমী, যিনি তাদের সাথে যোগ দেননি।
মুহাম্মদ তাঁর পরিবারকে উমাইয়ার প্রতিকুল পাড়া থেকে হাশিমী অংশে স্থানান্তরিত করেছিলেন। মুহাম্মদের কিছু অ-হাশিমী অনুসারীরাও তাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য সেই উপত্যকায় বসবাস শুরু করেছিল। উমরের বর্বরতা সত্ত্বেও, মন্দিরের সামনে দলবেঁধে প্রার্থনাগুলি কমে আসছিল এবং শেষ পর্যন্ত তা আর তাঁরা করতেই পারেনি। কেবলমাত্র পবিত্র মাসগুলিতে হাশিমীরা তাদের পাড়া থেকে বেরিয়ে আসত, তবে তারপরেও তাদেরকে মানুষ এড়িয়ে যেত। নিষেধাজ্ঞা দুই বছরেরও বেশি সময় স্থায়ী হয়েছিল এবং মুহাম্মদের বংশধরদের উপর মারাত্মক পরিণতি নেমে এলো। তাদের খাদ্য সরবরাহ শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং লোকেরা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিল। মক্কার কিছু লোক তাদের দুর্দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করছিল, বিশেষত সেসব শিশুদের জন্য যারা ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদত, এবং তারা তাদের জন্য খাবার পাচার করত। সহানুভুতিশীলরা একটা উট বোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে গভীর রাতে ওদের এলাকার প্রবেশপথ দিয়ে যেত, তারপরে উটটির গায়ে চড় মারত যাতে এটি হাশিমীদের ঐ অংশে চলে যায়। উটগুলিও তাদের খাওয়ার জন্য দেয়া হয়েছিল। উপত্যকাগুলির পেছনের সরুপথের মধ্য দিয়েও সরবরাহের চোরাচালান ঘটত এবং এটি সেই জীবনপথ ছিল যা হাশিমীদের অনাহার থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তবে চোরাচালানকারীরা তাদের পণ্য ও পরিষেবার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করত, এবং হাশিমীরা যারা কাফেলার বাণিজ্যে জড়িত ছিল তারা নিজেদের ব্যবসায়ের মাধ্যমে অর্থ ফেরতের সম্ভাবনা ছাড়াই চোরাচালানের জন্য তাদের মূলধন খরচ করে ফেলত। খাদিজা ইতিমধ্যে তাঁর সম্পদের বেশিরভাগ অর্থ মুহাম্মদের সমর্থনে ব্যয় করেছিলেন; যা বাকি ছিল এই নিষেধাজ্ঞায় খরচ হয়ে গেছিল। শেষে তিনি নিঃশেষ হয়ে যান এবং তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কষ্ট সত্ত্বেও, হাশিমীরা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
মক্কাবাসীদের মধ্যে এই নিষেধাজ্ঞাকে কিছুটা শিথিল করার তাড়না দেখা যাচ্ছিল। সময়ের সাথে সাথে নেতারা দুইভাগে বিভক্ত হন - একদল রক্ষণশীল এবং আরেক দল উদার ঘরনার। আবুল হাকামের নেতৃত্বে রক্ষণশীলরা জোর দিয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ তাদের জন্য বিপজ্জনক, এবং যতক্ষণ না মুহাম্মদ তাদের কাছে ফেরত আসে এই নিষেধাজ্ঞা চালিয়ে যাওয়ার দরকার। চার বা পাঁচজনের প্রভাবশালী বণিকের নেতৃত্বে একটি উদারপন্থীরা বয়কটের প্রভাব সম্পর্কে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলন। তারা বুঝতে পারলেন যে, মুহাম্মদ একটি সমস্যা এটা সত্য, তবে তারা মনে করেন তাঁর কারণে তাঁর বংশধরদের আরও শাস্তি দেয়াটা অনুচিত হচ্ছে। এছাড়া নিষেধাজ্ঞাটিও আর কাজ করছে না, কারণ লোকেরা ক্রমশ তা অমান্য করছে আর হাশিমীদের তৈজসপত্রও সরবরাহ করছে। যখনই নিষেধাজ্ঞা বন্ধের প্রস্তাবনাটি সামনে এলো তখন বিক্ষুব্ধ আবুল হাকাম দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললেন, “এই বিষয়টি প্রত্যাখ্যানযোগ্য নয়!” (৩) মক্কা অবশ্য ঐক্যমতের ভিত্তিতে শাসিত হচ্ছিল এবং বেশিরভাগ নেতাদের মাঝে উদারপন্থী মনোভাবের অনুসারীরাই জয়লাভ করেছিল। নেতাগণ নিষেধাজ্ঞার আদেশটি ছিঁড়ে ফেললেন, হাশিমীরা আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করল এবং মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা আগের মতোই চলাফেরা শুরু করল। মুহাম্মদের পক্ষে এটি ছিল একটি স্বল্পকালীন বিজয় এবং তিনি নিজেকে তখন 'বিপজ্জনকভাবে উন্মুক্ত' ভাবতেন। এরই মধ্যে খাদিজা ও আবু তালিব উভয়েই মারা যান। আবু তালিব প্রথমে মারা যান। নিষেধজ্ঞার কারণে সম্ভবত তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। যখন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হল তিনি আর সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। যখন তাদের হাতে সুযোগ ছিল মক্কার নেতারা মুহাম্মদের ব্যাপারে সুরেহা করতে তাঁর কাছে এসেছিলেন। সমাধানের জন্য আগ্রহী হয়ে তারা মৃত্যুপথযাত্রী আবু তালিবকে অনুরোধ করতে আসেন, যাতে তিনি মুহাম্মদকে বুঝিয়ে নিজে বাঁচেন আর অন্যদেরও বাঁচতে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। “আপনি কি এখন তাঁকে ডেকে এমন সমঝোতায় আসতে পারবেন, যাতে তিনি আমাদের ক্ষতি না করেন, আমরাও তাঁর ক্ষতি করব না; তিনি আমাদের ধর্ম সহ্য করুক এবং আমরাও তাঁকে সহ্য করব" - বলছিলেন নেতারা (৪)। আবু তালিব মুহাম্মদকে ডেকে পাঠালেন এবং তিনি যখন সমাবেশে যোগ দিলেন, আবু তালিব সেখানে উপস্থিত লোকদের দিকে ইঙ্গিত করে মুহাম্মদকে তাদের সমঝোতার ইচ্ছের কথা জানালেন, কিন্তু মুহাম্মদ তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তাদের কাছ থেকে এই মর্মে একটি ঘোষণা চাইলেন যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, আর তাদের পৌত্তলিক দেবতাদের বাতিল করতে হবে। তাঁর অনমনীয়তা দেখে মক্কাবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। তিনি যা চেয়েছিলেন তা ছিল তাঁর প্রতি আনুগত্য, , কিন্তু তিনি এমন কোনও ব্যক্তি ছিলেন না যাকে তাদের মান্য করতে হবে। মক্কার এক নেতা বলেছিলেন, “আমরা যা চাই এই ব্যক্তি তাঁর কোনও অংশ আমাদের দিতে চাচ্ছেন না। আমাদের চলে যাওয়া উচিত এবং সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্ম পালন করা উচিত" (৫)।
মুহাম্মদ চাচাকে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আবু তালিব তাঁর পূর্বপুরুষদের বিশ্বাসকে ধারণ করে মারা যান। মুহাম্মদ নিশ্চিত ছিলেন যে, তাঁর চাচা জাহান্নামবাসী হবেন যেহেতু তিনি ঈমানের (বিশ্বাসের) পথে আসেননি। কিন্তু আবু তালিব রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন এই ঘোষণা দিলে তা শুধু মুহাম্মদকেই খুশি করা হত, মন থেকে তা আসত না। কিছু ইতিহাস অনুসারে, মুহাম্মদ চাচার জানাজায় অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান। অন্যান্য বিবরণে বলা হয়েছে যে, তিনি উপস্থিত ছিলেন, তবে বেশ দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন; তাঁর জন্য যেহেতু জাহান্নামের আগুন ধার্য করা ছিল তা যেন মুহাম্মদের উপস্তিতির দ্বারা কলুষিত না হয় (অর্থাৎ, চাচার নরকগমন যেন বাধাপ্রাপ্ত না হয়) (৬)।
খাদিজা প্রায় তাঁর প্রায় একমাস পর মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল পয়ষট্টি বছর। তাঁর মৃত্যুও সম্ভবত আবু তালিবের মতোই নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট কষ্টে হয়েছিল। তাঁর অর্থের যা অবশিষ্ট ছিল তা নিষেধাজ্ঞার সময় ব্যবহার করা হয়েছিল, যে কারণে তাঁর দাফন হয়েছিল সাদামাটাভাবে। তাঁর দেহটি সাধারণ সাদা কাফনের পরিবর্তে মুহাম্মদের চাদরে জড়িয়ে দেয়া হয়েছিল এবং তাঁকে মক্কার উঁচু কবরস্থানে একটি সাধারণ কবরে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তিনি মারা যাওয়ার আগে মুহাম্মদ তাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর জন্য ফেরেশতা জিব্রাইল শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন এবং এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তিনি জান্নাতে একটা, “মুক্তার খোলের তৈরি ঘরে বাস করবেন এবং সেখানে কোথাও গোলমাল বা ঝামেলা নেই” (৭)।
এখন যেহেতু মুহাম্মদ আর আবু তালিবের দেয়া সুরক্ষার অধীনে নেই, তিনি তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এটা তাঁর মনে আরও বেশি করে প্রগাঢ় হয় যখন তিনি মন্দিরে প্রার্থনা করার সময় কেউ একজন তাঁর মাথায় ময়লা ঢেলে দিয়েছিল। আবু লাহাব মুহাম্মদের বাড়িতে হঠাৎ হাজির হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ধরণের হেনস্তা চলছিল। আবু লাহাব এখন হাশিমীদের গোত্রপতি। তিনি এই হেনস্তা সম্পর্কে অবগত হন, আর মুহাম্মদকে বলেন যে গোত্রের সুরক্ষা নবায়ন করা তাঁর অবশ্যকর্তব্য। “আবু তালিব জীবিত থাকাকালীন তুমি যা যা করতে তেমনটাই করে যাও। আল-লাতের নামে শপথ করছি, আমার মৃত্যুর আগে তোমার কোন ক্ষতি হবে না” – বলেন আবু লাহাব। যদিও এর আগে তিনি ছিলেন মুহাম্মদের চিরশত্রুদের একজন, কিন্তু আবু লাহাব মুহাম্মদের সুরক্ষার একটি প্রকাশ্য ঘোষণা করেছিলেন এবং তিনি যা বলেছিলেন তা করে দেখিয়েছেন। যখন মুহাম্মদকে এক লোক অপমান করেছিল আবু লাহাব সেই লোককের উপর চড়াও হয়েছিলেন। লোকটি চিৎকার করে আবু লাহাবকে উদ্দেশ্য করে তখন বলে, তুমিও “একজন সাবিয়ান (ধর্মীয় বিশ্বাসঘাতক)”। তবে আবু লাহাব মক্কাবাসীদের আস্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি তা নন। আবু লাহাব বলেন - “আমি আব্দুল মুত্তালিবের বিশ্বাস ছেড়ে যাইনি। তবে আমি আমার ভাতিজাকে বিপদ থেকে রক্ষা করব এবং তাঁর নিজের কর্মের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করব" (৮)।
তবে আবু লাহাবের সুরক্ষা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মুহাম্মদের দুই শত্রু আবুল হাকাম ও উকবা মুয়াইত (Uqbah Muayt), আবু লাহাবের কাছে একটা গুজব নিয়ে আসেন। তাঁরা আবু লাহাবের দেয়া সুরক্ষা দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন এই বলে যে, আবু লাহাবের পিতা এবং মুহাম্মদের দাদু আব্দুল মুত্তালিবকে নাকি জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে এমন কথা তাঁরা মুহাম্মদকে বলে বলতে শুনেছেন। আবু লাহাব যখন এই গুজব নিয়ে মুখোমুখি হন, মুহাম্মদ প্রথমে মুল বিষয়টিতে না গিয়ে তাঁর আশেপাশে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন এই বলে যে, আব্দুল মুত্তালিব “তাঁর লোকদের সাথে” ছিলেন। কিন্তু যখন চাচা তাঁকে এই বিষয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলেন, মুহাম্মদ তখন অমোঘ বাণীটি দিলেন: “যে ব্যক্তি আব্দুল মুত্তালিবের মতো মারা গেছে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করেছে”। আবু লাহাব তাঁর দিকে তেড়ে আসলেন আর বললেন “আল্লাহর কসম, আব্দুল মুত্তালিব আগুনের মধ্যে আছেন বলে দাবি করার জন্য আমি তোমার চিরশত্রু হয়ে থাকব!” মন্দিরের বাইরে এসে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে আবু লাহাব মুহাম্মদের উপর তাঁর সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন (৯)।
মক্কায় থেকে গেলে তাঁকে হত্যা করা হবে, এই ভয়ে মুহাম্মদ তাঁর ধর্মের সুরক্ষা এবং সেটাকে আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য মক্কা থেকে পুর্বে তিনদিনের দুরত্বে পাহাড় ঘেরা শহর তায়েফের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন (১০)। তায়েফ একটা কৃষিপ্রধান এলাকা ছিল, যেখানে অন্যান্য জায়গার চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হতো। ছাকিফ ছিল সেখানকার প্রধান গোত্র যারা আঙ্গুরক্ষেত, ফলের বাগান এবং চারণভূমি সমৃদ্ধ অঞ্চলটি শাসন করতো। তারা মক্কাবাসীদের সাথে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, এবং অনেক ধনী মক্কাবাসীরা সেখানে দ্রাক্ষাক্ষেত্রের মালিক ছিল। ওখানের প্রধান দেবতা হলেন উর্বরতার দেবী আল-লাত, যার মন্দিরটি শহরের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে ছিল এবং পবিত্র মাসগুলিতে তা তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল।
মুহাম্মদ তাদের সুরক্ষা পাওয়ার আশা করেছিলেন, তবে প্রকৃতির উদারতার উপাসনাকারী লোকদের তাঁর প্রতি আগ্রহ জন্মানোর মতো এমন কিছু তাঁর কাছে ছিল না। তায়েফ ছিল তিন ভাইয়ের অধীনে, যে ভাইয়েরা তাঁকে তাদের সভাস্থলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। যেখানে তারা আমদানি করা কুশন এবং কার্পেটের উপরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে দাসদের পরিবেশন করা বাটি ভর্তি ফলাহার সহযোগে আলাপ করছিলেন। তায়েফ মক্কার কাছাকাছি হওয়ায় সম্ভবত মুহাম্মদ সম্পর্কে তারা আগেই শুনেছিলেন। তবে তারা ছিলেন খোলামনের মানুষ, আর তাই মুহাম্মদের মুখ থেকেই তারা কথা শুনতে ইচ্ছুক ছিলেন। মুহাম্মদ তাঁর উপস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন এই বলে যে, তিনি তাঁর গোত্রের লোকদের কাছে থেকেই অন্যায় আচরণের শিকার হচ্ছেন, কারণ তিনি তাদের কাছে ঈশ্বরের বাণী নিয়ে এসেছেন। তাদের মুক্তির বার্তা নিয়ে ঈশ্বর তাঁকে প্রেরণ করেছেন। তিনি কোরআন থেকে আয়াতসমূহ তেলওয়াত করলেন, আর তত্ত্বসমূহ ব্যাখ্যা করলেন। তিনি তাদেরকে তাঁর ধর্মে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন এবং মক্কার অত্যাচারীদের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করলেন। প্রথমদিকে ভাইয়েরা বিনম্রভাবে সাথে তাঁর কথা শোনেন, কিন্তু এরপর শীঘ্রই তারা সমালোচনা করা শুরু করলেন। একজন ভাই বলেছিলেন, “ঈশ্বর কি আপনার চেয়ে ভালো কাউকে পাঠাতে পারতেন না?” অন্য একজন বলেছিলেন, “ঈশ্বরের কসম, আমাকে কখনও আপনার সাথে কথা বলতে দিবেন না। আপনি যদি বলেন যে, আপনি ইশ্বরের কাছ থেকে আসা একজন প্রেরিত নবী, তবে আপনার জবাব দেয়া আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ, আর আপনি যদি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলেন, তবে আমার সাথে কথা বলা ঠিক নয়”।
বহেরাগত কারো জন্য গোত্রীয় সুরক্ষা প্রদানের বিষয়টি কখনও হালকাভাবে নেয়ার বিষয় ছিল না। তাদের কিছু লাভও হতে হবে, কিন্তু ভাইদের দিক থেকে মুহাম্মদকে সুরক্ষা দেয়া হলে তাতে তাঁরা লাভের কিছু দেখতে পেল না। মুহাম্মদ একজন গোত্রচ্যুত, নিশ্চিতভাবেই ঝামেলা সৃষ্টিকারী লোক, আর খুব সম্ভবত উন্মাদ। তাঁরা যদি তাঁকে তাদের বলয়ে নিয়ে আসে, তবে বন্ধু ও ব্যবসায়িক অংশীদার কুরাইশের বিরুদ্ধে তাদের যেতে হবে। দু'দিন আগে বা পরে এটা নিয়ে সংঘাত হয়ে যেতে
পারে।
মুহম্মদ তাদের বিদ্রুপে বেশ ধাক্কা খেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না, যে বাণীগুলো তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে বলে বিশ্বাস করছেন, কেন তারা সেগুলো গ্রহণ করল না! তারা বিমোহিত হওয়া তো দুরের কথা, বরং হিংস্র হয়ে উঠলো। তিনি যখন তাদের এই সভার বিষয়টি গোপন রাখতে বললেন, তারা তাঁকে বাইরে বের করে দেয়। তারা তাঁকে পাথর ছুঁড়ে মারতে রাস্তার বখাটেদের প্ররোচিত করে। জনতা তাঁকে প্রধান ফটক দিয়ে তাড়া করে গ্রামের দিকে নিয়ে গেল। একটি ফলের বাগানের মাঝে লুকিয়ে তাদের হাত থেকে তিনি রক্ষা পান ।
সেই ফলের বাগানটির মালিক ছিল মুহাম্মদ এর দু'জন কট্টর সমালোচক উতবা (Utba) এবং শায়বা রাবিয়ার (Shayba Rabia), যারা মুহাম্মদকে এক সময় হত্যার হুমকি দেয়া সেই লোকেদের অন্যতম। তাঁরা বাগানের গাছগুলি দেখাশুনা করার সময় কি হচ্ছে তা দেখছিলেন। তাঁকে দেখে তাদের মায়া হলো এবং আডাস (Addas) নামে তাদের এক খ্রিস্টান দাসকে মুহাম্মদের জন্য এক প্লেট আঙ্গুর দিতে বললেন। ভাগ্য তাড়া করে ফিরলেও, মুহাম্মদ নিজেকে ধর্মপ্রচার থেকে বিরত রাখতে পারলেন না। তিনি দাসের সাথে তাঁর নবীদের সম্পর্কে আলাপ করছিলেন এবং তাঁকে জোনাহর (ইউনুস) কথা বলে মুগ্ধ করেছিলেন। দাস এই জোনাহ নবী সম্পকে তাঁর নিজ শহর নিনেভায় (Ninevah) অনেক কথা শুনেছেন । মুহাম্মদ অবশেষে তাঁর কথা শুনার মতো একজনকে পেয়ে খুশি হলেন, আর বললেন, "তিনি (জোনাহ) একজন নবী ছিলেন এবং আমিও একজন নবী।" উতবা ও শায়বা তাদের এই আলাপ শুনে দাসকে বললেন, “তাঁকে তোমার ধর্ম ভোলাতে দিয়ো না, তোমার ধর্ম তাঁরটার চাইতে উত্তম” (১৩)। যদিও ভাইদ্বয়ের মুহম্মদকে অবজ্ঞা করার মতো কারণ ছিল, তবুও তাঁরা তাঁর বাহকটি ফেরত দেন এবং তাঁকে পথের খরচ দেন।
অবমাননাকর বহিষ্কারের ফলে মুহাম্মদ মনমরা হয়ে পড়েছিলেন। সফর শেষে ফিরে আসার পথে তিনি ভবিষ্যত নিয়ে হতাশা, ভীতসন্ত্রস্ত আর হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তায়েফে তাঁর সফরের কথা অবশ্যই মক্কাবাসীদের কাছে পৌঁছেছিল। তাঁরা এটাকে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে দেখবে, যা তাঁকে হত্যার করার জন্য আরও একটি কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তায়েফ থেকে একদিনের পথ আল-উজ্জার পবিত্র জায়গা নাখলা (Nakhla) নামে নারকেলের উপত্যকায় তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় যে, সেই অবমাননা গভীরভাবে তাঁকে আঘাত করেছিল। ইসলামিক সাহিত্যেও বলা হয়েছে, বিভ্রান্তিকর মানসিক অবস্থা মোকাবেলার চেষ্টা করতে তিনি গভীর রাতে প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতেন, এবং সেই সময়ে একটি মৃগীরোগজনিত খিঁচুনির শিকার হয়েছিলেন। কারণ ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, অদৃশ্য জ্বিনের একটি দল আল্লাহ্র কাছে তাঁর প্রার্থনা শোনার জন্য তাঁর চারপাশে জড়ো হয়েছিল। তিনি রাতের বাকি সময়টা এক সংক্ষিপ্ত অধ্যায় রচনা করে কাটিয়েছিলেন যা সুরা 'জিন (The Jinn )' নামে পরিচিত ছিল। এতে তিনি কল্পনা করেছেন যে, তিনি জিনদের ধর্মান্তর করেছেন এবং তাঁর ধর্মের কিছু রীতিনীতি করতে তিনি তাদের সাথে মতবিনিময় করেছেন। এই রচনাটি (সুরা জিন) একথা ঘোষণার দ্বারা শেষ হয় যেঃ তিনি নিজের লোকদের জন্য ঝামেলা সৃষ্টি করা এবং বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তায়েফের লোকদের কাছ থেকে প্রত্যাখিত হননি, বরং তিনি ঈশ্বরের নির্দেশনার বাহক ছিলেন বলেই তারা তাঁকে প্রত্যাখান করেছে। এটা করে তাঁরা মুলত ঈশ্বরের দিকনির্দেশনাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে, আর সেজন্য তাঁরা ঈশ্বরের আযাবের মুখোমুখি হবে। কোরআনে আছে, “আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে” ।
[তায়েফ হতে তাড়া খাওয়া। মক্কায় থাকা তাঁর পক্ষে অনিরাপদ হয়ে পড়ায়, মুহাম্মদ পার্শ্ববর্তী তায়েফে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি লোকদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর আসার কারণ অনুধাবন করার জন্য তাদেরকে রাজি করিয়েছিলেন। নেতারা প্রথমে তাঁর কথা বিনয়ের সাথে শোনেন, কিন্তু তারা যখন বুঝতে পারল যে তিনি তাদেরকে মক্কাবাসীদের সাথে তাঁর বিরোধে জড়াতে চাচ্ছেন, তখন তারা তাঁকে শহরের বাইরে তাড়িয়ে দেয়।]
তায়েফের লোকেরা চিরকাল জাহান্নামে জ্বলবে, এমন কল্পনা করে মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেয়ে মুহাম্মদ মক্কায় চলে যান। জীবনের জন্য এখনও ভীত হয়ে তিনি হেরা পাহাড়ের ভেতর লুকিয়ে ছিলেন, সম্ভবত তিনি যে গুহায় প্রথমে বিভ্রমজনিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি ঈশ্বরের সংস্পর্শে এসেছিলেন সেই গুহায়ই আশ্রয় নিয়েছিলেন। সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে তিনি আরও দূরে যাত্রা করার সাহস করেননি। মক্কায় পৌঁছার আগে, তিনি খুজা গোত্রের এক ব্যক্তির সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, যিনি মক্কার বিভিন্ন নেতাদের কাছে সাহায্য চেয়ে তাঁর পক্ষে থেকে একটি বার্তা নিতে রাজি হন, কিন্তু তাঁর অনুরোধগুলিও প্রত্যাখ্যান করা হয়। তবে মুহাম্মদের ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল যখন তিনি মুতইম আদি (Mutim Adi) নামে উদারপন্থী এক মক্কানের কাছে তাবু তৈরি করেছিলেন, যিনি মুহাম্মদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পবিত্র ধর্মযুদ্ধ সমুহে সামরিক নেতৃত্বদানকারী হিসেবে সর্বত্র সম্মান করা হতো বৃদ্ধ মুতইমকে। তিনি তাঁর ছেলেদের বর্ম এবং অস্ত্রধারণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। যুদ্ধের ঘোড়ায় চড়ে তাঁরা মুহাম্মদকে সাথে নিয়ে মন্দিরে গেলেন, যেখানে মুতইম ঘোড়ার উপর থেকে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “হে কুরাইশ! আমি মুহাম্মদকে আমার সুরক্ষায় নিয়ে এসেছি, সুতরাং কেউ যেন তাঁকে আক্রমণ না করে”। মুহাম্মদ এরপরে এগিয়ে গেলেন, কালো পাথরটিকে চুম্বন করলেন, দুই রাকাত নামায আদায় করলেন, আর মন্দিরের চারপাশে সাতবার প্রদক্ষিণ শুরু করলেন (১৫)। শেষ হয়ে গেলে তিনি মুতইমের গোত্রের লোকদেরকে সাথে নিয়ে খাদিজার বাড়িতে ফিরে এলেন।
মুহাম্মদ এই নতুন নিরাপত্তার সুযোগে পুনর্বিবাহ করেন। খাদিজার মৃত্যুর দু'মাসের মধ্যেই সাওদাকে (Sauda) তিনি বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মোহাম্মদের এক অনুসারীর স্ত্রী, যিনি হিজরতের ভূমিতেই মারা যান। সাওদা দেখতে লম্বা, স্বাস্থ্যবান ও ভালো স্বভাবের ছিলেন। মুহাম্মদের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রায় একই সময়ে তিনি আবু বকরের ছয় বছরের কন্যা আয়েশার সাথেও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সাহিত্য থেকে জানা যায় যে, মুহাম্মদ বিবাহের আয়োজন করতে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুহাম্মদের প্রাথমিক অনুসারীদের মাঝে একজনের স্ত্রী তাঁকে উভয়য়ের সাথেই বন্ধনে আবদ্ধ হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন - সাওদাকে, কারণ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন এবং আয়েশাকে, কেননা তিনি কুমারী ছিলেন। মুহাম্মদ যখন আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তখন এই মহিলা দুই পরিবারের মাঝে সম্পর্ক তৈরিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন। সাওদা এই প্রস্তাবে খুশি হন, কারন তিনি তাঁর সন্তান নিয়ে বৃদ্ধ বাবার সাথে থাকতেন, এবং মুহাম্মদকে কথা দিয়েছিলেন তাঁর সন্তানরা তাঁকে কখনওই বিরক্ত করবে না। যদিও তাঁর ভাই এই বিয়ের বিরোধিতা করেছিলেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে নিজের শরীর ময়লা দিয়ে ঢেকে ফেলেছিল। তবে সাওদার বাবা সাওদাকে মুহাম্মদের সাথে বিয়ে করিয়ে দেন। তিনি খাদিজার বাড়িতে চলে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সাওদার সাথে বিয়ের প্রস্তাবের বিষয়ে মুহাম্মদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা বিশ্বাসযোগ্য, তবে আবু বকরের কন্যার বেলায় তেমনটা নয়। আবু বকরের বাড়িতে ঘনঘন যাওয়া আসা করার সুবাদে, আয়েশার জন্মের পর থেকেই তাঁর সাথে চাচা-ভাতিজার সম্পর্ক ছিল মুহাম্মদের। তিনি আয়েশাকে ছোট্ট বাচ্চা অবস্থা থেকে বালিকা হয়ে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত দেখেছিলেন, যার সংগ্রহে বেশ কিছু কাপড়ের পুতুল ছিল। তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন এমনঃ আল্লাহ মুহাম্মদকে রেশমী পোশাক পরা বা রেশমের কাপড় জড়িয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় থাকা আয়েশাকে দু'বার স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন। তিনি একটি কন্ঠ শুনতে পেলেন, যাতে বলা হল, “এটি আপনার স্ত্রী, সুতরাং তাকে অবমুক্ত করুন”। তিনি রেশমী ওড়নাটি সরিয়ে ফেললেন, এবং ছোট্ট আয়েশার মিষ্টি মুখ এবং উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালেন (১৬)। সুতরাং আয়েশাকে বিবাহ করার ধারণাটি মুহাম্মদের, এবং মুহাম্মাদ-সাওদা বিবাহের ব্যবস্থা করতে যে মহিলা ছিলেন তিনিও আবু বকররকে সাথে এই বিয়ে নিয়েও ঘটকালি করেছিলেন। মুহাম্মদের আগ্রহ জানতে পেরে আবু বকর আপত্তি করেননি, তবে একটি জটিলতা ছিল। তিনি ইতিমধ্যে মুহাম্মদের রক্ষক, মুতইম আদির ছেলের সাথে আয়েশাকে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন। মুতইম মুহাম্মদকে যে সুরক্ষা দিয়েছিলেন তা যেন ক্ষতি না হয়, সেজন্য আবু বকর একজন দক্ষ কূটনীতিকের মতোই বিষয়টির ডিল করেন।
ইসলামিক ইতিহাসে পাওয়া যায়, তিন বছর পরে যখন মুহাম্মদ তাদের বিবাহকে ‘পরিপূর্ণতা' দিয়েছিলেন, ততদিন পর্যন্ত আয়েশা পিতৃগৃহে থেকে গিয়েছিলেন। এটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে, আবু বকর এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন কারণ তিনি মুহাম্মদের কাছ থেকে অদল-বদলের আশা করেছিলেন। তিনি প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সী মুহাম্মদের কনিষ্ঠ কন্যা ফাতিমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে অপেক্ষায় রাখতেন এই বলে যে, তিনি এই বিষয়ে আল্লাহর কাছ থেকে ‘ওহীর অপেক্ষায়' রয়েছেন (১৭)।
এর মাঝে আল্লাহ কখনোই আসেননি, এবং শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদ ফাতিমাকে তাঁর চাচাত ভাই আলীর সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন।