অনুবাদকের
অনুভূতি
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত এবং একইসাথে সবচেয়ে বেশি নিন্দনীয় মানুষ সম্ভবত মোহাম্মদ - ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ। এ বইটি তাঁরই জীবনের সকল ঘটনাবলী দিয়ে সাজানো। এ বইটি পড়ে “কী ভয়ানক! কী জঘন্য!” বলে আপনি পাশ কাটিয়ে যাবেন সে সুযোগ হয়তো নেই, যে কথাটা লেখক নিজেও তাঁর ভূমিকায় বলেছেন। আমাদের জানামতে শুধু বাংলায় কেন, ইংরেজিতেও মোহাম্মদের জীবন নিয়ে এমন প্রাঞ্জল ভাষায়, এত পুঙ্খানুপুঙ্খ এত রেফারেন্স দিয়ে এবং এত নিরপেক্ষভাবে আর কেউ লেখেনি। সে হিসেবে এ বইটিকে শুধুমাত্র 'মাস্টারপিস' বললেও বোধকরি কম বলা হবে। আমরা চেয়েছিলাম বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে এ বইটি পৌঁছে দিতে এবং দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর অবশেষে বইটি আলোর মুখ দেখছে আজ ।
২০২৩ সালের প্রথম দিনই পাঠকের হাতে এমন উপহার তুলে দিতে পেরে সত্যিই ভীষণ আনন্দবোধ করছি। আমরা অনুবাদক দুজনই ভীষণভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমাদের অতি প্রিয় এম. বিশ্বাসকে। তিনি না থাকলে বইটিকে এত সুন্দর কলেবরে তৈরি করা, বলা চলে প্রায় দুঃসাধ্যই ছিল। বইটিতে মুহাম্মদের জীবনকাহিনীর সাথে মিলিয়ে প্রচুর চিত্র দেয়া রয়েছে, এসব চিত্রের কোনটা মোহাম্মদের কোন কর্মকে ইঙ্গিত করছে, আবার কোনটা তৎকালীন আরবের মানচিত্র সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে, সে সম্পর্কে ছবিগুলিকে যথাস্থানে বসানো, সুচিপত্র ঠিক করা, যথাযথভাবে সম্পাদনা করা সোজা কথায় এটিকে বই আকারে তৈরি করার কৃতিত্ব এম. বিশ্বাসকে দিতেই হবে।
আবারো ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। একটু ভাবুন তো, সারা দুনিয়া জুড়ে 'আল্লাহু আকবার' বলে আত্মঘাতী হামলাকারী মানুষ খুন করছে যারা, কিংবা হঠাৎ ব্যস্ত রাস্তায় অচেনা কাউকে ছুরিকাঘাত করে খুন করছে যারা, কিংবা যে হাজার হাজার উন্মত্ত জনতা আল্লাহু আকবার বলে কোন নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ঘরবাড়িতে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে তাদের এসব করার কি কোন উৎস আছে? এসব কি কোন অনুপ্রেরণা থেকে উঠে আসছে? তাই যদি না হবে তবে আফগানিস্তানের মসজিদে হামলাকারী, শ্রীলংকার গির্জায় হামলাকারী, লন্ডনের পাতালরেলের হামলাকারী, বার্লিনে ট্রাক নিয়ে হামলাকারী এবং কেনিয়ার নাইরোবির মার্কিন দূতাবাসে হামলাকারী কিংবা ভারতের ২৬/১১ হামলাকারী এদের সবার মধ্যে এত মিল কেন খুঁজে পাওয়া যায়? কেন হামলার সময়ে তাদের সবার মুখে একই রকমের বাণী উচ্চারিত হয়? কেন সবার হামলার ধরনটা একই রকমের বীভৎস হয়? কিসে তাদের একত্র করছে? কিসে তাদেরকে উন্মত্ত বানাচ্ছে? কিসে তাদেরকে অন্যের জীবন হরণ করার জন্য প্রয়োজনে নিজেদের জীবনকেও বিলিয়ে দিতে উৎসাহিত করছে?
আমাদের সন্ধান করতে হবে, সেই উৎসটা কোথায়, সেই অনুপ্রেরণাটা কোথায়? কেন বাংলাদেশে, ভারতে, পাকিস্তানে, ইংল্যান্ডে, সোমালিয়ায়, স্পেনে, অস্ট্রেলিয়ায় একদল মানুষ, একইরকম আচরণ করছে, একইরকম ভাবে তারা ক্ষিপ্ত হচ্ছে? কেন একদল মানুষ, যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে ওটা আমার চয়েস, এটা আমার চয়েস এমন বলছে? কেন সেই 'আমার চয়েসটিই' শেষমেষ, আর আমার চয়েস না থেকে, 'তোমার জন্য আমার চয়েস' হয়ে যাচ্ছে? যে পোশাক ফ্রান্সের মুসলিম নারীদের জন্য তথাকথিত চয়েস হয়, সেটি কেন ইরানের মুসলিম নারীদের জন্য আর চয়েস থাকে না? সেটি কেন আফগানিস্তানের, সৌদি আরবের, কাতারের, কুয়েতের এবং তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের নারীদের জন্য আর চয়েস থাকছে না?
ঠিক কীসের কারণে, ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন, বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে, তাঁর তিনজন স্ত্রীকে নিয়ে আফগানিস্তানের দুর্গম পাহাড়ে, সন্ন্যাসীদের মতো, কিন্তু সন্ত্রাসকে সাথে নিয়ে আত্মগোপন করে থাকলেন? কেন তিনি কেবলমাত্র মানুষ খুন করার মিশন নিয়েই, নিজের জীবনের সমস্ত চেষ্টা, সাধনা ও মেধা ব্যয় করলেন? আপনি “অমুক দেশ এর পেছনে দায়ী, তমুক দেশ বিন লাদেনকে সৃষ্টি করেছে”, এসব কথা বললে সমস্যার কোনদিনই সমাধান হবে না। বিন লাদেন, কোনো দেশের সংবিধান পড়ে সন্ত্রাসবাদী হননি। বিন লাদেন সিআইএ, মোসাদ কিংবা কেজিবির হাতে পড়ে সন্ত্রাসবাদী হননি। আপনার বরং খুঁজতে হবে যে, বিন লাদেন কোন বইকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন? তিনি কোন পুস্তক আত্মস্থ করেছিলেন? তিনি কাকে অনুকরণ করে জীবনযাপন করেছিলেন? তিনি কার মতো পোশাক পরিধান করেছিলেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে, এই বইটি আপনার পড়তে হবে। বইটি পড়ার আগে কিংবা পরে, আপনার মনে হতেই পারে, বইটি ইসলামবিদ্বেষ থেকে লেখা, কিন্তু আপনার ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হবে, যখন আপনি রেফারেন্সগুলো মিলিয়ে দেখবেন। এখানে যত রেফারেন্স আছে, তার সবই প্রায় ইসলামিক বইসমূহ থেকে নেয়া, ইসলামের নবীর অনুসারীদের বই থেকেই নেয়া। ইসলামের অনুসারীদের লেখা সবকিছু তুলে ধরা, যদি ইসলামবিদ্বেষ হয় তাহলে ইসলাম-প্রেম কোনটি? যদিও একথা সত্যি যে, এ বইটি মুসলিম কিংবা অমুসলিম সকলকে ভালবাসা, তথা বিশ্বমানবতার প্রতি ভালোবাসার জায়গা থেকেই লেখক এই বইটি লিখেছেন । আবার একইভাবে আমরা অনুবাদকেরাও সেই জায়গা থেকেই বইটি অনুবাদ করেছি।
ওয়াফা সুলতান তার, ‘এ গড হু হেটস' বইতে বলেছিলেন, ইসলামের প্রধান ভিকটিম মুসলিমরাই। আমরা অবশ্য মনে করি ইসলামের প্রধান ভিকটিম মৌলবাদীরা, মাদ্রাসার হুজুররা। ইসলামের প্রধান ভিকটিম সেই মানুষেরাও, যারা আল্লাহু আকবার বলে অন্যদেরকে হত্যা করার মধ্যে বেহেস্ত খোঁজে, জীবনের কামিয়াবি বা সফলতা খোঁজে। আর তাই অনুবাদক হিসেবে, আমরা দুজন এটিকে উৎসর্গ করছি পৃথিবীর সকল বিশ্বাসী মুসলিমদের জন্য যারা নিজেরাই ইসলামের ভিকটিম।
ঘৃণা বহনের একটি সমস্যা আছে। ঘৃণার বহনকারীকে, অন্যেরা ব্যবহার করার সুযোগ পায়। ঘৃণার বহনকারীকে খুব সহজেই, পণ্য বানিয়ে ফেলা যায়। ঘৃণার বাহককে খুব সহজে ক্ষিপ্ত করে তোলা যায় এবং বিনামুল্যে বা স্বল্পমূল্যে খাটানো যায়। আর এজন্যই ঘৃণামুক্ত একটি পৃথিবী আমরা চাই। আর ঘৃণামুক্ত একটি পৃথিবী পাওয়ার জন্যেই পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত- সমালোচিত ব্যক্তি, মুহাম্মদের জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে আমাদের জানার প্রয়োজন। যারা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিন্তু মুসলিমরা সন্ত্রাসী তাঁরা এবং যারা বলেন বর্তমান সময়ের মুসলিমরা শ্রেষ্ঠ ধর্মের, নিকৃষ্ট অনুসারী তাঁরা দয়া করে এই বইটি পড়ুন। এই বইটি পড়লে, হয়তো আপনি সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হবেন, তখন হয়তো আপনি বলবেন, বর্তমান সময়ে মুসলিমরা নিকৃষ্ট নবীর উৎকৃষ্ট উম্মত। কারণ এখনকার সময়ের বিশ্বাসী মুসলিমরা, ইসলামের মধ্যে থেকেও বহুবিবাহ, জিহাদ, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে গণহত্যা করে মেরে ফেলা, কিংবা খুবই ছোট ছোট শিশুদের বিয়ে করা ও ধর্ষণ করা থেকে বিরত থাকছে । অর্থাৎ ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদের সময়ে যা ছিল তার কৃতকর্মের তুলনায় অনেক কম। উন্মাদনার শুরু কোথা থেকে হয়েছিল বা উন্মাদনার শুরু কে সে বিষয়টি আমাদের জানার প্রয়োজন, ঠিক যেমন চিকিৎসা করতে গেলে চিকিৎসকের জানার প্রয়োজন হয় রোগের উৎস কোথায়।
এ বইটিতে ব্যবহৃত কিছু শব্দ ও পরিভাষা সম্পর্কে, আলোকপাত করা জরুরি। মুহাম্মদের নামের কয়েকটি বানান হয়, আমরা এখানে মুহাম্মদ বানানটাকে ব্যবহার করেছি। কোরান/কোরআন দুটো বানানই চলে। বইটিতে ঈমানদারগণ, মুমিন, বিশ্বাসী, মুসলিম, সাহাবি প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ এবং পার্থক্য জেনে নেয়া জরুরি। ঈমানদার এবং মুমিন মুলত একই অর্থ প্রকাশ করে; অর্থাৎ বিশ্বাসী। আর মুসলিম বলতে এখনকার সময়ের মুসলিম বা যেকোন সময়ের মুসলিম, তথা ইসলামের অনুসারীকে বোঝায়। সাহাবি শব্দের অর্থ সঙ্গী। ইসলামিক পরিভাষা অনুযায়ী, মোহাম্মদের এমন অনুসারীদের সাহাবী বলা হয়, যারা তাঁকে জীবদ্দশায় দেখেছে, তার হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং মুসলিম অবস্থায়ই মারা গেছে। মক্কার নাগরিকদেরকে কোথাও মক্কান, আবার কোথাও মক্কাবাসী বলা হয়েছে। এই বইয়ে ইব্রাহিম এবং আবরাহাম দুটো শব্দকেই আমরা ব্যবহার করেছি, যদিও ইংরেজিতে আব্রাহাম শব্দটাই আছে। জেনে নেয়া ভালো, আব্রাহাম এবং ইব্রাহিম একই ব্যক্তি; পার্থক্য কেবল ইংরেজি এবং কোরানিক আরবিতে।
পরিশেষে বলি, এই বইটির অপরিসীম গুরুত্বের কথা ভেবে, আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও বইটিকে সম্পূর্ন বিনামূল্যে, আপনাদের হাতে তুলে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। এই বইটি সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ এর কৌতুহলই পারে আমাদের পরিশ্রমকে সার্থক করতে।