অধ্যায় ৭ আগুন ও গন্ধক
মুহাম্মদের প্রকাশ্যে আসাটা ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মুহাম্মদের সাথে যে ফেরেশতারা কথা বলেন, এমন গুজব ইতোমধ্যেই মক্কায় প্রচার হয়ে গেছে। নেতৃস্থানীয় মক্কাবাসীরা তাঁকে অস্বাভাবিক ভাবতে শুরু করে এবং তাঁকে নিয়ে কটু মন্তব্য করতেও ছাড়ে না। তারা রীতিমত তাঁকে তাড়া করে ফিরতেন। মুহাম্মদ তাঁর পূর্বপুরুষের মন্দির প্রদক্ষিণ করার অভ্যাসটি ধরে রেখেছিলেন। তবে তাঁর জন্য এটি আর মন্দির না, এটি এখন আল্লাহর ঘর। মন্দিরটিতে অর্ধবৃত্তাকার পাথরের তৈরি পাটাতন ছিল, যেখানে শহরের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা জড়ো হতেন। প্রতিবার প্রদক্ষিণের সময় যখনই তিনি সেই জায়গায় এসে পৌঁছতেন, তখনই লোকেরা তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে, মন্তব্য করত এই বলে, “দেখো দেখো, হাশিমী বংশের লোক, যিনি ঈশ্বরের সাথে কথা বলেন!”। অথবা তাঁকে উপহাস করে বলত, “তো মুহাম্মদ, ঈশ্বর এইবার কী বললো?”
পরিবারের কাছেও তাঁর দাবি আর গোপন থাকল না। খাদিজা, আলী, জায়েদ এবং জুবায়ের বাদে, তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বহুশ্বরবাদের ভক্ত ছিল, এবং মুহাম্মদের বিরোধী ছিল। একদিন আবু তালিবের বাড়িতে যাবার পর, তিনি যখন জানতে পারেন যে, তারা মক্কার কোন এক দেবতার উপাসনার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন তাদের সাথে মুহাম্মদ তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আবু তালিব এই তীর্থযাত্রার আয়োজন করছিলেন, যার জন্য তাদেরকে বেশ কয়েকদিন ধরে রাস্তায় থাকতে হবে। এরপর তাদের কোরবানির উট ও অন্যান্য পশু আনতে হবে, তাঁবু ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে উট বোঝাই করতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে, যাতে তারা সবাই একত্রে যাত্রা শুরু করেত পারে। পূর্বে মুহাম্মদ, তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানরা তাদের সাথে যেতেন, কিন্তু এবার তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন, ফলে এক বিরাট গোলযোগ সৃষ্টি হয়েছিল।
তিনি তাদের জানিয়ে দিলেন যে, তিনি বহুশ্বরবাদিতা থেকে বের হয়ে এসেছেন, আর সেখানে ফিরে যাবেন না। সম্ভবত তিনি প্রতিমা পূজার নিন্দা করার জন্য এবং এক ঈশ্বরের ধারণাটিকে, তাদের মাঝে প্রচার করার জন্য, এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করেছিলেন। সেখানে থাকা তাঁর চাচা, চাচী, চাচাত ভাই সহ সবাই, যারা আবু তালিবকে সহযোগিতা করছিলেন, তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে যেতে, তাঁর আবিসিনীয় মুক্ত দাসী বারাকাকে ডেকেছিলেন (১)।
তবে মুহাম্মদ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন, কারণ এখন তাঁর সমর্থক পুরুষ এবং মহিলা মিলে দুই ডজনের মতো অনুসারী তৈরি হয়েছে। আর সেজন্য তিনি তাঁর ধর্মপ্রচার প্রকাশ্যে করা শুরু করেছিলেন। ইসলামিক ইতিহাসের অনেক সূত্রে, তাঁর প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার শুরু করার বিবরণ দেয়া আছে। সেখানে উল্লেখ আছে যে, তেরো বছরের উঁচু বুকওয়ালা এবং সরু পায়ের অধিকারী আলীকে, তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁর বংশধরদের জন্য একটি নৈশভোজের ব্যবস্থা করতে। তিনি আলীকে বলেন যে, ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁকে বলেছেন, তিনি যদি তাঁর বার্তা নিয়ে জনসম্মুখে না যান, তাহলে “প্রভু আমাকে শাস্তি দেবেন”। (২) আবদুল মুত্তালিবের বেঁচে থাকা সকল পুত্রদয় এবং মুহাম্মদের প্রথম চাচাত ভাইদের সহ চল্লিশজন লোক, যথাযথভাবে তাঁর বাসায় আসেন। আলী কেবল সামান্য খাসির মাংসের টুকরো এবং কিছু দুধ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা শুধু একজন মানুষের জন্য পর্যাপ্ত ছিল। অতিথিদের চোখের সামনেই খাবারগুলো বহুগুণ বেড়ে গেল। অলৌকিকতার এই দৃশ্যটি সবাইকে অভিভূত করেছিল। কিন্তু ঠিক তখনই মুহাম্মদের অন্যতম পিতৃতুল্য চাচা, আবু লাহাব মুহাম্মদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন, তারা যা দেখছেন, তা এই জাদুকরের কাজ। আবু লাহাবের মন্তব্যের পর, সবাই মুহাম্মদকে ছেড়ে চলে যায়, আর মুহাম্মদ তাদের কাছে নিজের নবী হবার দাবি ও তাদেরকে তাঁর ধর্মগ্রহণের আহ্বান করার সুযোগ, এভাবেই হাতছাড়া করেন।
জানা যায়, মুহাম্মদ আরও একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন, তবে এইবার খাবার বহুগুণ হবার মতো, অলৌকিক কিছু ঘটেনি। মোহাম্মদ অভ্যাগতদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে আবদুল মুত্তালিবের পুত্রসন্তানরা, আমি আরবদের মধ্যে এমন কোন যুবককে চিনি না, যিনি আপনাদের জন্য আমার চেয়ে ভালো কিছু নিয়ে এসেছিল”।
৮ তিনি বলেন, ”আমি আপনাদের জন্য দুনিয়ার ও পরকালের শ্রেষ্ঠ উপহার নিয়ে এসেছি, আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনাদের কাছে তাঁর প্রতি আনুগত্যের জন্য। এখন বলুন, আপনাদের মধ্যে কে কে আমাকে সাহায্য করবেন?” চাচাত ভাইয়েরা হাঁটু ভাঁজ করে চামড়ার মাদুরের সামনে বসেছিলেন, যেটাকে অনেকটা কাপড় দিয়ে ঢাকা টেবিল বলা যেতে পারে। তারা আড়চোখে একে অন্যের দিকে তাকচ্ছিলেন, কিন্তু সবাই শান্ত ছিলেন। আলী অবশেষে মুহাম্মদের পায়ে পড়লেন এবং বললেন, “হে আল্লাহর নবী, আমি আপনার সাহায্যকারী হব”।
মুহাম্মদ তাঁর হাত আলীর কাঁধের উপর রাখলেন, “সে আমার ভাই, তাই তাঁর কথা শোনো এবং তাঁর অনুগামী হও”। মুহম্মদ কর্তৃক তাঁর অতি উৎসাহী ভাইকে সমর্থন করার দৃশ্য দেখে, সবাই হেসে ওঠে এবং চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। অনেকেই মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যায়। অনেকেই আবু তালিবকে কনুই দিয়ে, একটু ধাক্কা দিয়ে বলে, “আপনি বিশ্বাস করতে পারেন এটা? ও আপনাকে আপনার নিজের পুত্রের আনুগত্য করার আদেশ দিচ্ছেন!” (৩)
প্রকাশ্যে তাঁর নবুয়াতের ঘোষণা দেয়ার গল্পের মধ্যে, সবচাইতে বিশ্বাসযোগ্য একটি হচ্ছেঃ, তিনি কুরাইশদের অনেককেই সাফা পর্বতে আসতে বলেন, তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা শোনার জন্য। দুটো অল্প উচ্চতার গ্রানাইট পাথরের পর্বতের মধ্যে সাফা ছিল একটি, যার উচ্চতা পঞ্চাশ ফুটের কাছাকাছি। এটি মন্দিরের নিকটে ছিল। অপরটি ছিল নদীতীরের অপর পাড়ে, মারওয়া পর্বত। দুটোই ছিল পবিত্র জায়গা। দুর্যোগের আভাস পেলে লোকে সাফা পর্বতের চূড়ায় উঠে “দুৰ্যোগ! বিপর্যয়!” বলে চিৎকার করে মানুষকে সাবধান করতেন। এই চিৎকার সবদিকে শোনা যেত। মুহাম্মদ সাফার চুড়ায় আরোহন করেছিলেন, তাঁর সতর্কবাণী চিৎকার করে ঘোষণা দেয়ার জন্য। তিনি আলীকে পাঠান, হাশিমি পাড়ায় গিয়ে লোকজনকে ডেকে, সাফা পর্বতে জড়ো করতে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সেখানে জড়ো হন, তবে তাদের মধ্যে উদ্বেগের চেয়ে কৌতূহল বেশি ছিল। যখন পর্যাপ্তসংখ্যক লোক একত্রিত হয়েছিল, মুহাম্মদ বলেছিলেন: “হে আবদুল মুত্তালিবের গোত্র, হে ফিহর (Fihr), গোত্র, হে কাব (Kab) গোত্র!” তিনি জাতি এবং গোত্রদের নাম ধরে ধরে সম্বোধন করতে থাকেন এবং বলেন “আমি যদি আপনাদের বলি যে, পাহাড়ের উঁচুতে ঘোড়সওয়ারী আছেন, যিনি আপনাদের আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছেন, আপনারা কি তা বিশ্বাস করবেন?” কেউ একজন চিৎকার করে বললেন, “হ্যাঁ, আমরা আপনাকে সত্যবাদী মানুষ বলে জানি, হে মুহাম্মদ!” তারপর মুহম্মদ বলেন, “ঠিক আছে, আমি আপনাদের ভয়াবহ শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করতে এসেছি”। তিনি কিয়ামতের দিন এবং জাহান্নামের শাস্তির বর্ণনা চালিয়ে যাওয়ার আগে, আবু লাহাব তাঁর পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেঁচিয়ে বললেন, “ধিক্কার! ধিক্কার! সারাদিন যেন তোমার ধ্বংস হয়! তুমি আমাদের এইজন্য এখানে ডেকেছ?” মুহাম্মদ আরো দ্ব্যর্থ কণ্ঠে সতর্ক করে বলতে থাকেন, “যারা আল্লাহর নবীর নির্দেশকে প্রত্যাখ্যান করবে, তাদের জন্য আছে জাহান্নামের আগুন”। তিনি জানেন কবরের আজাব সম্পর্কে, আল্লাহ তাঁকে জানিয়েছেন, এবং তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন সেই সত্যকে তাঁর লোকদের কাছে পৌঁছে দেন। “হে কুরাইশ, জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাও! হে বনু কালব (Banu Kalb) গোত্র, জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে বাঁচাও”। তারপর তাঁর পরিবারের মধ্যে ধর্মে দীক্ষিত হতে নারাজদের মধ্যে ফাতিমা এবং তাঁর ফুফু সাফিয়ার নাম ধরে ডাকেন। “হে মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমা, নিজেকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো”, অথবা “আমি আল্লাহর নামে কসম করছি, আমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যতীত তোমাকে আল্লাহর কাছ থেকে রক্ষা করার কিছুই থাকবে না”। (৫)
আবু লাহাবের ঠাট্টাবিদ্রূপ ছাড়াও অনুমান করা যায় যে, এর পরে সেথায় কি ঘটেছিল। সম্ভবত এই ঘটনাটি মুহাম্মদ এবং তাঁর প্রতিবাদকারীদের মধ্যে হট্টগোলের খেলায় পরিণত হয়েছিল। জে সি ভি বডলির (J. CV Bodley) মতে, মুহাম্মদের "highly developed ideals about turning the other cheek" (৬)।
তিনি হয়তো আবু লাহাবকে আরো বিক্ষুব্ধ করে তোলেন এই বলে যে, তাঁর জন্য অনন্ত শাস্তি অপেক্ষা করছে। মক্কায় তাঁর শত্রুদের তালিকা শীঘ্রই দীর্ঘতর হতে থাকে। এর শীর্ষে ছিল তাঁর এই চাচা আবু লাহাব এবং তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, যারা খাদিজার বাড়ির অপর পাশের গলিতে বাস করতেন। প্রথমদিকের দিনগুলিতে তাদের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, তাই মুহাম্মদ তাঁর দুই কন্যাকে আবু লাহাবের ছেলের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। আবু লাহাবের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শিকড় ছিল অনেক পুরাতন। পালকমাতা হালিমা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার আগে আবু লাহাবের দাসী ছুয়াইবা (Thuwaiba) ছিলেন মুহাম্মদের প্রথম দুধমাতা। কিন্তু তাদের সম্পর্কের মধ্যে ভাটা পরে তাঁর গুহার অভিজ্ঞতা এবং তাঁর সাথে আল্লাহর সাক্ষাতের বিষয়ে জনসম্মুখে বলার কারণে। যৌবনকালে আবু লাহাব দেখতে একজন সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল উজ্জা (Abd al-Uzza), যার অর্থঃ আল-উজ্জার সেবক। কিন্তু আকর্ষণীয় চেহারার কারণে তিনি ডাকনাম পেয়েছিলেন আবু লাহাব, যার অর্থ 'উজ্জ্বলতার জনক' (father of radiance)। গুটিবসন্তের কারণে তাঁর মুখে গভীর ক্ষত ছিল, বয়সের কারণে চামড়া কিছুটা কুঁকড়ে গিয়েছিল এবং তাঁর মুখমন্ডল শুকিয়ে গিয়েছিল। চাচার সাথে সম্পর্কের ফাটল ধরা এবং তাঁকে অস্বীকার করার পর ক্ষুব্ধ হয়ে মুহাম্মদ তাঁর চাচাকে নিয়ে কয়েক লাইন আয়াত রচনা করেছিলেন। এই রচনাগুলো কোরানের শুরুর দিকের এবং কোরানের সব চাইতে ছোট সুরাদের মধ্যে একটা- “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু'হাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কাজে আসবে না। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে। আর তার স্ত্রী লাকড়ি বহনকারী, তার গলদেশে খেজুর বাকলের রজ্জু রয়েছে” (৭)।
আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিলের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে শেষের দু'লাইনে, আবু লাহাবের সাথে, তাঁকেও জাহান্নামে নিক্ষেপ করার কথা বলা আছে। এই আয়াতগুলো দ্রুতই শহরের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। যখন উম্মে জামিল এবং আবু লাহাব এগুলি জানতে পারলেন, তখন আবু লাহাব তাঁর বাড়ির সীমানা থেকে মুহাম্মদকে লক্ষ্য করে ক্রোধ প্রকাশ করেন। উম্মে জামিল একটি পাথরখন্ড হাতে নিয়ে মুহাম্মদকে খুঁজতে থাকেন, এবং ঠিক সে সময়ে মুহাম্মদ আবু বকরের সাথে মন্দিরে অবস্থান করছিলেন।
ইসলামিক আকর গ্রন্থে পাওয়া যায়, আল্লাহ অদৃশ্য চাদরে মুহাম্মদকে জড়িয়ে রেখে তাঁকে উম্মে জামিলের ক্রোধ থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তিনি যাতে মুহাম্মদকে দেখতে না পারেন। কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে গালাগালিও শুনতে পারছিলেন। সম্ভবত যেটি হয়েছিল সেটি হচ্ছে, চাচীকে আসতে দেখে মুহাম্মদ নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন, এবং তাঁর বন্ধুকে ব্যাপারটা মোকাবেলা করার জন্য বলেন। উম্মে জামিলের রাগ কিছুটা প্রশমিত হলে তিনি শেষে কালো পাথরটি চুমো দেন, এবং হুবাল, আল উজ্জা এবং আল-লাত দেবতার প্রতি তাঁর বিশ্বাসের প্রমাণ হিসেবে সাতবার মন্দিরটি প্রদক্ষিণ করে, কক্ষপথে এসেই মুহম্মদকে অভিশাপ দিতে থাকেন (৮)।
মুহম্মদ ও খাদিজা উমাইয়াদের পাড়ায় ঠিক ওপর অংশে বাস করতেন, সেখানকার ঘরগুলোই তখনকার মক্কাবাসীদের মানদণ্ড অনুসারে মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত বলে বিবেচিত হতো। এই পাড়াটির নামকরণ করা হয়েছিল ধনী ব্যবসায়ীর নামে, যারা উমাইয়াদের বংশ থেকে এসেছিল, যিনি মক্কার নিয়ন্ত্রণের জন্য মুহাম্মদের দাদা হাশিমকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আবু বকরের একই পাড়ায় একটি বাড়ি ছিল, যিনি কাপড় ব্যবসায়ী হিসেবে, চল্লিশ হাজার রৌপ্যমুদ্রার মালিক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। খাদিজার বাড়িটি মন্দির থেকে দু'শ গজ দুরে অবস্থিত ছিল। পাড়ার একপ্রান্তে খাদিজার পাশের বাড়িতে ছিলেন আবু সুফিয়ান নামে এক উমাইয়া ব্যবসায়ী ( ৯)। তিনি ছিলেন উমাইয়ার নাতি এবং মক্কার বাণিজ্যিক ও নাগরিক বিষয়ের একজন উদীয়মান নেতা। যদিও হাশিমী ছিলেন, আবু লাহাব এই পাড়ায় আসতে পারতেন কারণ উম্মে জামিল ছিলেন আবু সুফিয়ানের বোন।
এটি একটি শান্তিপূর্ণ পাড়া ছিল, কিন্তু মুহাম্মদ যখনই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে, নতুন ধর্ম নিয়ে আসলেন, ঠিক তখন থেকেই এটি শত্রুভাবাপন্ন অঞ্চল হয়ে উঠল। একাধিকবার তাঁর দরজার সামনে দুষ্ট লোকেরা, মলমূত্র নিক্ষেপ করে রেখে যেতেন, বা উঠোনে রান্নার পাত্রে, মৃত প্রাণী রেখে যেতেন। মাঝেমাঝে আক্রান্ত করার জন্য তাঁকে লক্ষ্য করে, পাথর নিক্ষেপ করা হতো। আঘাত এড়াতে তিনি বাড়িতে ঢুকে যেতেন, তিনি প্রচন্ড চিৎকার করে জোরে জোরে বলতেন, “প্রতিবেশীর সাথে এই হচ্ছে তোমাদের সৌজন্যবোধ?” (১০)। তিনি খুব জোরে চিৎকার করতে পারতেন যার আওয়াজ গলির সকলে শুনতে পেত। এই অপমানের সাথে আরও যোগ হয় -আবু লাহাব মুহাম্মদের মেয়েদের সাথে তাঁর ছেলেদের যে বিয়ের কথা হচ্ছিল, তা তাঁর ছেলেদের প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য করেন।
মুহাম্মদ অনেকটাই নিজের উপর এই বৈরিতা ডেকে এনেছিলেন। ইসলামিক ইতিহাস ভিন্নভাবে এই ঘটনাগুলোর যৌক্তিক ব্যাখা দাঁড় করিয়ে এর সত্যতা স্বীকার করে নেয় (১১)। মুহাম্মদের আগে, জায়েদ প্রকাশ্যে মক্কাবাসীদের ধর্মকে গালি দিয়েছিলেন। তিনি তাদের মূর্তি ও ভাস্কর্য নিয়ে উপহাস করতেন। তিনি বলতেন, প্রত্যেক মুশরিক জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তিনি এটাও বলতেন যে, তাদের পূর্বপুরুষরাও মিথ্যা বিশ্বাসে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ার জন্য চিরকাল আযাবে (শাস্তিতে) থাকবেন। তাঁর জন্য এটি ছিল সহজ, অনম্য যুক্তি। তিনি বলতেন, “মুশরিকরা এক সত্য ইশ্বরের জায়গায় মিথ্যা দেবতাদের পূজা করেছে, সুতরাং এটি ক্ষমার অযোগ্য পাপ; হয় তারা এক ইশ্বরের উপাসনা করবে, নয়তো জাহান্নামে আগুনে জ্বলবে”। ঐতিহ্যগতভাবে অন্যদের নিজস্ব ঈশ্বর ধারণার উপর সহনশীল মক্কাবাসীদের কাছে, জায়েদের এই সংকীর্ণ মতবাদ আপত্তিকর ছিল। তারা অসহিষ্ণুতা ছাড়া বাকি সবকিছু সহ্য করেছিল। এটিই মক্কাবাসীদের সাথে জায়েদকে সমস্যায় ফেলেছিল এবং এখন মুহাম্মদও জায়েদের মতো অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, মুহাম্মদ এখন আরেক জায়েদ হয়ে উঠেছে। অনমনীয় একই বার্তা নিয়ে মুহাম্মদ গোত্রসমূহের সবাবেশ ছাড়াও, মন্দিরের অপরপাশে প্রশাসনিক ভবনে বয়োজ্যেষ্ঠদের সমন্বয়ে গঠিত যে গোত্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পরিষদ ছিল, তাতেও তিনি যোগদান শুরু করেছিলেন। তিনি তাঁর একই বার্তা নিয়ে ব্যক্তিগত মজলিশেও যেতেন (১২)।
মুহাম্মদ যত বেশি প্রতিরোধের মুখোমুখি হতেন, তত বেশি তাঁর কোরআনের আয়াত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠত। সেই রচনা জাহান্নামে অত্যাচারের বর্ণনায় পরিপূর্ণ থাকত, যেমন এই আয়াতগুলো : “নিশ্চয়ই জাহান্নাম ওঁৎ পেতে রয়েছে। সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য প্রত্যাবর্তন স্থল। সেখানে তারা যুগ যুগ ধরে অবস্থান করবে। সেখানে তারা কোন শীতলতা আস্বাদন করবে না এবং না কোন পানীয়” (১৩)। তিনি তাঁর প্রথম বর্ণনায় জান্নাতকে কাম চরিতার্থ করার স্থান হিসেবেও অভিহিত করেছিলেন, যদিও তিনি তখনও এই রচনাগুলোকে তাঁর পক্ষে লড়াইয়ের এবং এর ফলে মৃত্যুবরণের পুরষ্কার হিসেবে যুক্ত করেননি : “নিশ্চয় মুত্তাকীদের জন্য রয়েছে সফলতা। উদ্যানসমূহ ও আঙ্গুরসমূহ। আর সমবয়স্কা উদ্ভিন্ন যৌবনা তরুণী” (১৪)।
মক্কাবাসীরা তাদের কবিতাঁর মধ্য দিয়ে তাদের বংশমর্যাদা ধরে রাখত, কবিতা নিয়ে তারা গর্ব করত। মুহাম্মদের অপমান ছিল তাদের কাছে বিরক্তির। মুহাম্মদের ধর্মপ্রচার শুরু করার এক বছরের মধ্যে মক্কাবাসীরা সিদ্ধান্ত নেন যে, হয় তাঁর মুখ বন্ধ করতে হবে, না পারলে তাঁকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু গোত্রের মধ্যে কাউকে হত্যা করা ছিল খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। যদিও তাঁর উপর তারা বিরক্ত ছিল, গোত্রের রীতি অনুযায়ী মুহাম্মদকে রক্ষা করতে তাঁরা বাধ্য ছিল। বেশিরভাগ লোক তাঁর বিপক্ষে ছিল, তবুও তারা দাঁতে দাঁত চেপে, গোত্রের রীতি অনুযায়ী তাদের সম্মান রক্ষার্থে প্রস্তুত ছিল।
শুধুমাত্র একটি উপায়ে এই ঝামেলা শেষ করা যেত, সেটি হচ্ছে হাশিমী গোত্রের নেতা, মোহাম্মদের চাচা আবু তালিবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে নিলে। তিনি যদি মুহাম্মদের উপর থেকে গোত্রের প্রতিরক্ষা সরিয়ে ফেলতে রাজি হন, মক্কাবাসীরা তবে তাঁর কাছ থেকে মুক্তি পেতে পারে।
মক্কার নেতারা আবু তালিবের কাছে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান এটা বলার জন্য যে, মুহাম্মদ ঝামেলার সৃষ্টি করছে, একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, যা এই সম্প্রদায়ের একাত্মতা বিনষ্ট করছে। আবু তালিবের সাথে দেখা করতে আসা লোকেরা ছিলেন সেই সময়ের মক্কার নেতা। উতবা (Utba), শাইবা রাবিয়া (Shayba Rabia), উভয় ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী; তারা তায়েফে বাগান এবং কুপের মালিক ছিলেন; আবু সুফিয়ান ( Abu Sufyan), মুহাম্মদের প্রতিবেশী যিনি উতবার কন্যা হিন্দকে বিবাহ করেছিলেন; আমর ইবনে হিশাম, যাকে মক্কাবাসীরা আবুল হাকাম তথা জ্ঞানী পরামর্শদাতা হিসেবে অভিহিত করতেন, যাকে মুহাম্মদ অভিহিত করেছিলেন আবু-জাহেল বা মূর্খতার বাপ The Spawner of Madness হিসেবে; ওয়ালিদ বিন মুগীরা (Walid Mughira), আবুল হাক্কামের চাচা যিনি মন্দির পুনর্নির্মাণের নেতৃত্বদানকারী ছিলেন এবং আরো কিছু মক্কার অধিবাসী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসেন। এটা জানা যায় না, তাদের মধ্যে কে আবু তালিবকে সম্বোধন করেছিলেন, তবে কি বলেছিলেন সেটা জানা যায়। বলা হয়েছিলঃ “হে আবু তালিব, আপনার ভাতিজা আমাদের দেবতাদের অভিশাপ দিয়েছে, আমাদের ধর্মকে অপমান করেছে, আমাদের পূর্বপুরুষের জীবনযাত্রা নিয়ে ঠাট্টা করেছে। হয় আপনি তাঁকে থামান অথবা তাঁকে আমাদের কাছে দিয়ে দেন, আমরা তাঁর তাঁকে নির্মূল করবো”। (১৫)
মুহাম্মাদের চাচা তাদের কথা চালিয়ে যেতে দিলেন, তিনি তাদের ক্ষোভ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি নিজেও মুহাম্মদ যে ঝামেলা করছে তা প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর নিজের পুত্র আলী মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। আবু তালিব মক্কার বিশ্বাসকে সমর্থন না করে মুহাম্মদকে সমর্থন করেছিলেন, তবে ভাতিজা মুহাম্মদের প্রতি তাঁর স্নেহের জালেও তিনি আটকা পড়েছিলেন। তিনি তাদের সাথে একমত হয়ে বলেছিলেন যে, ব্যাপারটা দেখবেন যে মুহাম্মদের ব্যাপারে কি করা যায়। কিন্তু হতাশাজনকভাবে কিছুই আসলে পরিবর্তন হয়নি, মুহাম্মদ পূর্বের মতই তাঁর কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছিলেন, এবং যতই মাস যেতে থাকে মুহাম্মদ মক্কার যুবকদের ধর্মান্তরিত করতে থাকেন। মক্কাবাসীরা আবারও আবু তালিবের কাছে তাদের নেতাদের প্রেরণ করেছিল, তবে এবার তারা যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল যদি না তিনি মুহাম্মদ সমস্যার সমাধানা করেন। “ঈশ্বরের কসম, আমরা আর সহ্য করতে পারবো না, পিতৃপুরুষদের যেভাবে নিন্দা করছে, আমাদের রীতিনীতি নিয়ে উপহাস করছে, আমাদের দেবতাদের অপমান করেছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি তাঁকে নির্মূল করবেন, আমরা আপনাদের দুইজনের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবো, যতক্ষণ না এক পক্ষের ক্ষতি হয়” – বলছিলেন নেতৃস্থানীয়রা (১৬)।
ইসলামিক ইতিহাস থেকে জানা যায়, আবু তালিব অসন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মদকে ডেকে পাঠান এবং অনুরোধ করেন তাঁর উপর যেন তাঁর সাধ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপিয়ে না দেয়া হয়। মুহাম্মদ ভেবেছেন যে তাঁর চাচা তাঁর উপর থেকে হাশিমী গোত্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুলে নেয়ার ইঙ্গিত করছেন, যেটা তাঁর জন্য একটি মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু মুহাম্মদ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর তাঁর সাথে কথা বলেন, তাই পরিণতি যাই হোক তিনি তাঁর কাজ চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, “ওহে চাচা, তাঁরা যদি এমন পরিস্তিতি সৃষ্টি করে আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাঁ হাতে চন্দ্র তুলে দেয়, তবুও আমি এই পথ ত্যাগ করতে পারব না”। হয় তিনি এইভাবে ধর্ম প্রচার করে বিজয়ী হবেন, নয়তো বিনষ্ট হয়ে যাবেন। এই সময়ে তিনি হাঁটু ভেঙ্গে আবু তালিবের মুখোমুখি বসে ছিলেন। তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং চাচার পা জড়িয়ে ধরলেন। আবু তালিব কান্না দেখতে পারতেন না। মুহাম্মদ যখন দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন চাচা তাঁকে আবার ডেকে বলেন, “তোমার ঈশ্বরের জন্য তুমি যা খুশি তাই বল, আমি তোমাকে কখনই ছেড়ে দেব না” (১৭)।
ইসলামিক ইতিহাসে দেখতে পাওয়া যায়, মক্কাবাসীরা আবু তালিবের কাছে তৃতীয়বারের মত প্রতিনিধি পাঠান। এইবার আবু তালিবের কাছে তাঁরা ঘুষের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তারা ওয়ালীদের (Walid) পুত্র ওমারাকে (Umara) নিয়ে আসেন এবং বলেন, মুহাম্মদের পরিবর্তে একে পালকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, তবুও মুহাম্মদকে তাদের হাতে ছেড়ে দেন৷ যদিও ওয়ালীদের জন্য ওমারার মতো পুত্রকে বিসর্জন করা কঠিন ছিল। মক্কাবাসী যে কেউ তাঁকে তাদের পুত্র বলে গ্রহণ করতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। তিনি দেখতে লম্বা, সুদর্শন, মল্লবিদ এবং দারুণ কাব্যিক প্রতিভার ছিলেন। এই ছেলে নিশ্চিত তাঁর বৃদ্ধকালে পিতার সাহায্যকারী হবে। আবু তালিব এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের প্রস্তাবকে 'শয়তানী' বলেন। তিনি বলেন, “আমি আপনার ছেলেকে নেব, তাঁকে খাইয়ে বড় করব, যার বিনিময়ে আপনি আমার একজনকে হত্যা করবেন। ঈশ্বরের কসম, তা হবে না!” (১৮)।
তাদের এই ঝগড়া সভাকক্ষ পেরিয়ে শহরের মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। আবু তালিব মক্কার প্রস্তাবকে উপহাস করে কবিতা রচনা করেছিলেন এবং গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর হাশিমী গোত্রকে, দৃঢ়ভাবে মুহাম্মদের সমর্থনে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানান। পুরো গোত্রটি এখন অন্য গোত্রদের সাথে. মুহাম্মদকে কেন্দ্র করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে।
উপহাসের বিষয় হচ্ছে, হাশিমী গোত্রের উপর তীর্থযাত্রীদের জন্য খাবার ও জল সরবরাহের অফিশিয়াল দায়িত্ব ছিল, অথচ মুহাম্মদ তাদের দেবদেবীকে নিয়েই বঙ্গ বিদ্রুপ করছে। বেশিরভাগ হাশিমীরা বিভিন্ন দেবতাদের উপাসনা অব্যাহত রেখেছিল, কিন্তু বংশের সম্মান রক্ষার্থে মুহাম্মদের পেছনে তাদের না দাঁড়িয়ে উপায় ছিল না।
ওয়ালিদের ছেলের প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ায়. মক্কার নেতারা বিকল্প নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পবিত্র মাসের বার্ষিক মেলা শুরু হয়ে গেছে, হাজার হাজার তীর্থযাত্রীরা মক্কায় আসা শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছে যে, মুহাম্মদ তাঁর ধর্মের বাণী নিয়ে তীর্থযাত্রীদের সাথে রাস্তায় দেখা করছেন। তিনি এতটাই আক্রমণাত্মক হয়েছেন যে, অনেকের পেছন অনুসরণ করতে করতে. তাদের তাঁবু পর্যন্ত চলে যাচ্ছেন। সম্ববত যারা তাঁকে শুনতে চায়নি তারা তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নেতারা আবার ভাবতে বসলেন, মুহাম্মদকে কিভাবে থামানো যায়। ওয়ালিদ পরামর্শ দিলেন, সবচাইতে ভালো প্রতিরক্ষা হচ্ছে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে বাজে কথা রটিয়ে দেয়া। তাতে করে তীর্থযাত্রীরা তাঁর কথা শুনবে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে গুরুত্বের সাথে নেবে না। ওয়ালিদ প্রস্তাব করেছিলেন, তাঁকে কবি, জাদুকর বা জ্যোতিষী বলে তকমা লাগিয়ে দিতে। মক্কাবাসী নেতারা প্রতিটি উপায় নিয়ে আলোচনা করে পরে, জ্যোতিষী এবং কবি উপাধিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মুহাম্মদ যা করছিলেন, তাতে তিনি একজনকে আরেকজনের পেছনে দাঁড় করে দিচ্ছিলেন, সুতরাং জাদুকর নামটি তাঁর জন্য সবচাইতে বেশি যুক্তিযুক্ত বলে তাঁরা মনে করলেন। তীর্থযাত্রা শুরু হওয়ার পরে, মক্কার নেতারা মক্কায় তীর্থযাত্রা শেষ হবার পর তাদের পোশাক পরিবর্তন করে মেলায় ঢোকার আগে, তাদের জন্য বিভিন্ন রুটে পাহারা চৌকি বসিয়েছিলেন।সেখান দিয়ে পার হওয়ার সময়ে, তাঁরা লোকদেরকে মুহাম্মদ সম্পর্কে সাবধান করেছিলেন যে, মুহাম্মদ তাদেরকে ছলনা করে মিথ্যা ধর্মে ডাকবে, তাদেরকে ফাঁসানোর চেষ্টা করবে, তিনি আসলে একজন জাদুকর। মুহাম্মদ এ বিষয়টি জানতে পেরে, আল্লাহকে বেহেশত থেকে নামিয়ে নিয়ে আসেন এবং আল্লাহ প্রচন্ড রাগে বিস্ফোরিত হন। বিরলভাবে এই আয়াতে আল্লাহকে দেখা যায়, এককভাবে কথা বলতে, যদিও ওয়ালিদ বিন মুগীরা, যার পুত্রকে সমর্পন করা হয়েছিল আবু তালিবের কাছে, তাঁর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
তবে এই লাইনগুলো তাঁকে উদ্দেশ্য করেই রচিত :
“আমাকে এবং যাকে আমি সৃষ্টি করেছি তাকে একাকী ছেড়ে দাও। আর আমি তাকে দিয়েছি অঢেল সম্পদ, আর উপস্থিত অনেক পুত্র। আর তার জন্য (জীবনকে) সুগম স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছি। এসবের পরেও সে আকাংখা করে যে, আমি আরো বাড়িয়ে দেই!” (১৯)
মুহাম্মদ ওয়ালিদকে আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হবার কারণে এবং নবীর বিরুদ্ধে আগ্রাসনের জন্য আল্লাহর মাধ্যমে, তাঁর উপর, ‘মর্মান্তিক বিপর্যয়’ নেমে আসবে বলে হুঁশিয়ার করেন।
এই রচনাগুলো শিহরিত কণ্ঠে আবৃত্তি করার উদ্দেশ্যে তিনি চালিয়ে যান:
“নিশ্চয় সে চিন্তা ভাবনা করল এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। অতঃপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে ধ্বংস হোক! কীভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? তারপর সে তাকাল। তারপর সে ভ্রূকুঞ্চিত করল এবং মুখ বিকৃত করল। তারপর সে পিছনে ফিরল এবং অহংকার করল। অতঃপর সে বলল, 'এ তো লোক পরম্পরায়প্রাপ্ত যাদু ছাড়া আর কিছুই নয়” (২০)।
ক্রমশই মুহাম্মদ কোরআনকে বিতর্কের মাধ্যমে পরিণত করলেন। মক্কাবাসীরা নিঃসন্দেহে তাদের নিজস্ব কবিতার মাধ্যমে, তাঁর ক্রোধের প্রতিউত্তর দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময়কালের কবিতা টিকে থাকেনি। তবে তাঁর রচনাবলী থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে করা অভিযোগগুলির গভীরতা পরিষ্কার বোঝা যায়। মুহাম্মদের আচরণের জন্য মানুষের মধ্যে তাঁর প্রতি যে ঘৃণার আগ্নেয়গিরি জ্বলছিল তা বোঝা যায় তাঁরই করা সাধারণ রচনাগুলোর কিছু ছত্র দিয়ে, যেমনঃ তোমাদের সঙ্গী (মুহাম্মাদ) পাগল নয়। সেতো তাকে স্পষ্ট দিগন্তে অবলোকন করেছে। আর সে তো গায়েব সম্পর্কে কৃপণ নয়। আর তা কোন অভিশপ্ত শয়তানের উক্তি নয় (21), এবং এই আয়াতটিও "নিশ্চয় যারা অপরাধ করেছে তারা মুমিনদেরকে নিয়ে হাসত। আর যখন তারা মুমিনদের পাশ দিয়ে যেত তখন তারা তাদেরকে নিয়ে চোখ টিপে বিদ্রূপ করত। আর যখন তারা পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসত তখন তারা উৎফুল্ল হয়ে ফিরে আসত” (২২)।
মক্কাবাসীরা যেই সময় তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে ব্যস্ত, মুহাম্মদ সেই সময়টিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন মানুষকে ধর্মান্তরিত করছিলেন। প্রায় কয়েক বছর ধরে প্রতিমাসে একজন করে মানুষকে তাঁর ধর্মে দীক্ষিত করেছেন, তবে বেশিরভাগ সময়ই এই রূপান্তর আবু বকরের প্রচেষ্টাতেই হয়েছে বলা যেতে পারে। তাঁর প্রতি বৈরিতা যখন বাড়তে থাকে, তিনি গোপনে তাঁর ধর্মান্তরিত যুবকের বাড়িতে চলে যান, যার নাম ছিল আরকাম (Arqam)। সেখানেই তিনি বিশ্বাসীদের নিয়ে গোপন বৈঠক করতেন। তাঁর বাড়িটি ছিল হাশিমী পাড়ার কাছে সাফা পর্বতের পাদদেশে। তাঁকে যাতে সনাক্ত করতে না পারে সেজন্য বিশ্বাসীরা রাতের অন্ধকারে আসতেন। দরজায় তাদের বিশেষ সংকেতে টোকা দিলে প্রবেশের জন্য দরজা খুলে দেয়া হতো। আবু বকর প্রতিশ্রুতিশীল লোকদেরকে সেখানে নিয়ে আসতেন মুহাম্মদের বয়ান শোনানোর জন্য। প্রথমদিকে ধর্মান্তরিতদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কৈশোর বয়সের। এদের পরিবার প্রায়শই তাদের ধর্মান্তরিত সন্তানদের বিচার দিতে মুহাম্মদের কাছে আসতেন। আবু বকর খালিদ সাঈদ (Khalid Said) নামে এক যুবককে নিয়ে আসেন যিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।
খালিদ সম্ভবত দুঃস্বপ্ন দেখেছিল, তাঁকে কে যেন জ্বলন্ত আগুনে ঠেলে দিচ্ছে, কিন্তু পেছন থেকে কেউ তাঁকে ধরে ফেলে, শেষমেশ সে বেঁচে যায়। খালিদ আবু বকরের কাছে আসে তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাইতে। আবু বকরের খ্যাতি ছিল স্বপ্ন-বাখ্যাকারী হিসেবে। তিনি খুব সহজেই তাঁর বাখ্যা দেন, যিনি খালিদকে ওই আগুন থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি আসলে ছিলেন মুহাম্মদ, আল্লাহ তাঁকে স্বপ্নের মাধ্যমে ধর্মের পথে ডাকছেন। আরকামের বাড়িতে মুহাম্মদের কথা শোনার পর তিনি ধর্মে বিশ্বাস এনেছিলেন এবং ওযু, সালাত এবং আয়াত মুখস্থ করেন। তিনি যদিও তাঁর ধর্মান্তরিত হবার ঘটনা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটি আর রাখতে পারেননি। যখন খালিদের বাবা এটি জেনে যায়, তাঁর মাথায় একটি লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। আর সাবধান করেন, তিনি যদি তাঁর পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে না আসেন, তাহলে তাঁকে হত্যা করবে। এ কথা শুনে খালিদ দৌড়ে পালান এবং মুহাম্মদের সাথে অবস্থান করেন (২৩)।
আরেকজনের ধর্মান্তরিত হবার কারণে পরিবারে দুঃখ নেমে এসেছিল, তিনি ছিলেন উমাইরের (Umayr) পুত্র মুসআব (Musab)। মুসআব উচ্চবিত্ত পরিবাবের ছেলে ছিল, তাঁকে সবসময়ই সর্বশেষ কেতাদুরস্ত পোশাকে দেখা যেত। তাঁর মা ব্যতীত বিশ্বে আর কারো জন্য তাঁর ভাববার দরকার ছিল না, কারণ তাঁর মা ছিলেন মক্কাবাসী সমাজে খুবই প্রভাবশালী এবং রক্ষণশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি আবু বকরের কাছ থেকে মুহাম্মদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে পেরে একদিন তাঁর সাথে আরকামের বাড়িতে যান মুহাম্মদের কথা শুনতে। মুহাম্মদের কথা শুনে দ্রুতই তিনি মোহাম্মদের প্রতি বিশ্বাসের ঘোষণা করলেন। খালিদের মতো মুসআবও এটিকে গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাঁর মায়ের কাছে ধরা পরে যায়। সে যখন মুহাম্মদের মতো করে প্রার্থনা করে, তাঁর মা জানতে পারেন। মা তাঁর চাকরকে নির্দেশ দেন তাঁকে বেঁধে একটি ঘরের কোণে রেখে দিতে এবং পাহারা দিতে। খালিদ নিজের বাড়িতে বন্দি হয়েছিল। অবশেষে সে অন্যান্য ধর্মান্তরিতদের সাথে পালিয়ে লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে আবিসিনিয়ায় চলে গিয়েছিল, আর সেখান থেকে ফিরে এসেছিল বেশ কয়েক বছর পর। তাঁর মা তাঁকে আবার বন্দি করার হুমকি দিলে, সে শপথ করেছিল যে-ই তার মাকে সহায়তা করবে তাকেই সে মেরে ফেলবে। সে বরঞ্চ তার ধর্মে যোগদানের জন্য তার মাকেই প্ররোচিত করে। তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ছেলেকে জানিয়েছিলেন যে তাঁর মস্তিষ্ক শিহরিত হতে পারে তবে বুদ্ধি এখনো লোপ পায়নি যে তিনি মুহাম্মদের ধর্মে ধর্মান্তরিত হবেন। এবার তিনি মুসআবকে তাড়িয়ে দেন এবং তাকে ত্যাজ্য করেন। মুসআব শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের যুদ্ধে জড়িত হয় এবং যুদ্ধেক্ষেত্রেই মারা যায় (২৫)।
মুহাম্মদ কল্পনা করতেন, তাঁকে যারা স্বীকার বা তাঁর আনুগত্য করছে না, তাদের জন্য আছে দোজখের আগুন। কোরআন ভয়াবহ সব নির্যাতনের বর্ণনায় পরিপূর্ণ। যেমনঃ মানুষ আগুনের হ্রদে জ্বলছে, ফুটন্ত জল বা গলিত ধাতব গলা দিয়ে ঢালছে, মহিলাদের জিহ্বা হুক লাগিয়ে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। তাঁর এই কল্পিত নির্যাতনের চিত্রগুলো দান্তের (Dante) মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মে প্রবেশ করেছিল, যিনি মুহাম্মদের এই নিষ্ঠুর কল্পনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন (২৪)।
এই নতুন ধর্মের কারণে সাদের (Sad) পরিবারও ছিন্ন হয়েছিল। সেটি ছিল জুহুরা গোত্রের আবু ওয়াক্কাসের পরিবার। এটি ছিল মুহাম্মদের মায়ের গোত্র, যারা আসলে কুসাইর এক ভাইয়ের বংশধর ছিলেন। যদিও সাদ মুহাম্মদের চেয়ে ছোট ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন মুহাম্মদের দুরসম্পর্কীয় মামা। তাঁর মা যখন তাঁর ধর্মান্তরের বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন তখন তিনি তাঁর সাথে আলাদা থাকার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে অনাহারে রেখে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন, এবং দুর্বল না হয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত কিছু খাবেন না বলেছিলেন। সাদ তাঁকে উত্তর দেন এভাবে যে, তিনি যদি হাজারবারও মরতে রাজি কিন্তু মোহাম্মদের ধর্ম ছাড়তে রাজি নন। সাদই প্রথম মুহাম্মদের কাজের কারণে অন্যের রক্ত ঝরিয়েছিল। ঘটনাটি ছিল এরকমঃ বিশ্বাসীদের মধ্যে ছোট্ট একদল মক্কার বাইরের উপত্যকায় গিয়ে ওযু ও নামাজ আদায় করছিল। তাঁরা ভেবেছিল যে, তাঁরা দৃষ্টিসীমার বাইরে রয়েছে, কিন্তু একদল মক্কাবাসী সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের তিরস্কার ও বিদ্রূপ করতে শুরু করেছিল।
সাদ তখন তাঁর দল নিয়ে তাদের উপর আক্রমণ করে বসে। কারো হাতেই তলোয়ার ছিল না, কারণ তাঁরা তখনও মক্কার অভয়ারণ্যের সীমানার মধ্যেই ছিলেন যেখানে রক্তপাত বা সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল। এটি শুরুতে শুধু ঝগড়াতেই সীমিত ছিল। এটি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে যখন সাদ একটি উটের চোয়াল তুলে নিয়ে মক্কাবাসীদের একজনের মাথায় আঘাত করে রক্তাক্ত করে ফেলেন (২৬)।
সাদ শেষ পর্যন্ত অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং তিনি গর্বের সাথে সারাজীবন তাঁর এই রক্তক্ষরণের বর্ণনা দিতেন। যা শুরু হয়েছিল সামান্য ফিনকি দিয়ে রক্তের মাধ্যমে, তা-ই একদিন রক্তের নদীতে পরিণত হয়েছিল।