অধ্যায় ২ পূর্বপুরুষেরা - সবটুকুই মুহাম্মদ
পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে মক্কার বাণিজ্যের জন্য ভালো একটা সময়ই ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই অঞ্চলটি অনেকটাই পরিত্যক্ত থাকার পর, আরবের পশ্চিম সীমান্ত হিজাজে কাফেলা বাণিজ্যের মাধ্যমে, আবার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হয়। এই কাফেলার কারণে, ইয়েমেন ব্যবসায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল এবং আরবের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি উন্নত ছিল। এর ফলে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীরা এই অঞ্চলে এসে বসতি গড়ে তোলে, যার ফলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে!
নতুন সহস্রাব্দের প্রথম শতাব্দীতে ইয়েমেনে, অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা ধ্বস নামে, যার ফলে এই অঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত বাসিন্দারা, আরবের দক্ষিণ অঞ্চলে সরে যেতে থাকে। দ্বিতীয় শতাব্দীতে লোহিত সাগরের জলদস্যুদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যায়, আর সাগরপথে বাণিজ্য চালুর পর থেকে, আরবের কাফেলা বাণিজ্যের পতন শুরু হয়।
এই
পতনের কারণ ছিল মৌসুমী বায়ু
ও আবহাওয়া সম্পর্কে নাবিকদের
সম্যক জ্ঞান না থাকা। তারা
লোহিত সাগরের উপর দিয়ে ভারতে
যেতে পারতেন,
এতে
পথিমধ্যে তাদের আর কোথাও
থামারও দরকার হতো না। ফলস্বরূপ,
আরবের
এই ট্রানজিট রুটটি পরিত্যক্ত
হয়ে উঠল এবং মরুভূমিতে বালিচাপা
পড়ে গেল। আরবের এক সময়ের
এই বাণিজ্য-গমন
পথটি পড়ে ইতিহাসে স্থান করে
নেয়।
দক্ষিণ
আরবের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের
আরও একটি কারণ ছিল খ্রিস্টধর্মের
উত্থান। মিশরীয়,
রোমান,
গ্রিক
এবং পার্সিয়ান এই বিখ্যাত
সভ্যতাসমূহের ব্যবসায়ীরা,
নির্দিষ্ট
পরিমাণ সোনার বিনিময়ে,
পৌত্তলিক
পূজা-অর্চনার
উপকরণ হিসেবে ইয়েমেন থেকে,
বিশেষ
এক ধরণের সুগন্ধি ক্রয় করতেন,
এগুলির
সবই উটের পিঠে করে,
(ইয়েমেনের)
উত্তর
দিকে পাঠানো হতো।
কিন্তু খ্রিস্টধর্মের বিস্তারের সাথে সাথে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সুগন্ধীর ব্যবহারকে নিষিধ করা হলো, যার ফলে খ্রিস্টান ধর্মালম্বীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো ঠিকই, কিন্তু সুগন্ধির বাজার হ্রাস পেতে থাকলো।
একই
সময়ে রোমানরা সমুদ্রের পথকে
উন্মুক্ত করে এবং সমুদ্রপথের
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর উপর
নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে,
যার
ফলে ভূ-রাজনীতি
এবং খ্রিস্টান ধর্মীয়
অনুষ্ঠানাদি পালনের রীতিনীতি
উভয় ক্ষেত্রেই নাটকীয়
পরিবর্তন ঘটে।
পঞ্চম
এবং ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে রোমান
শক্তি তীব্রভাবে হ্রাস পেয়েছিল,
জলদস্যুরা
সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার
করেছিল। সমুদ্রপথে জাহাজ
চালানো বিপজ্জনক এবং ব্যয়বহুল
হয়ে পড়েছিল। একই সময়ে
খ্রিস্টানরা আবার ধর্মীয়
উপাসনায় ধুপের ব্যবহার শুরু
করে এবং ধুপের জন্য সুগন্ধীর
বাজারে আবারো বিশাল চাহিদা
তৈরি হয়। এবং সেই সাথে রেশমি
কাপড় এবং অন্যান্য বিলাসবহুল
সামগ্রীর চাহিদা,
আগের
তুলনায় বাড়তে থাকে,
তবে
বাজারে বিক্রি করতে গেলে,
পণ্য
পরিবহনের জন্য তাদের উটের
দরকার ছিল। মক্কাবাসীরা এই
পরিবহনের ভবিষৎ দেখতে পেরে
এই ব্যবসায় এগিয়ে আসেন।
ব্যবসার ভালো ভবিষৎ দেখে,
পরিবহন
ব্যবসার সাথে কুসাইর সন্তানরা
যুক্ত হন। তাঁর অসংখ্য
নাতি-নাতনিদের
অনেকেই এই ব্যবসাকে সাফল্যের
সাথে পরিচালিত করেন। সেই
সময়ের আরবে অন্যান্য শাসকের
মত কুসাই অনেকগুলো বিয়ে
করেননি। তাঁর একজনমাত্র স্ত্রী
ছিল এবং তাঁদের চার পুত্র ও
দুই কন্যা ছিল।
মক্কাবাসী
বণিক পরিবারগুলির মধ্যে
সবচেয়ে ভালো করেছিলেন কুসাইর
বড় পুত্র,
মুগিরা
আবদ আল মানাফ ইবনে কুসাই
(Mughira
Abd al-Manaf ibn Qusay)।
মুগিরা মানাফ দেবতাঁর একনিষ্ঠ
ভক্ত ছিলেন। তাঁর চেহারা
গোলাকৃতির ছিল এবং সবসময়
প্রফুল্ল থাকতেন,
এজন্য
তাঁর ডাকনাম হয়েছিলেন
চন্দ্রমুখী (Moonface)।
মুগিরার চার পুত্র সন্তান
ছিল :হাশিম,
নওফাল,
মুত্তালিব
এবং আবদ শামস (সূর্যের
দাস)।
এই চারজন ভাই-ই
মূলত মক্কার কাফেলা বাণিজ্যের
সাথে যুক্ত ছিলেন।
বাণিজ্য পথের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য মুগিরার পুত্রদেরই মক্কাবাসীরা বিশ্বাস করতেন। বাণিজ্য পরিচালনার সকল কর্তৃত্ব তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য চুক্তি এবং বাণিজ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও তাদের দায়িত্বে ছিল! হাশিমকে পাঠানো হয় সিরিয়ার বাইজেন্টাইন শাসক এবং খ্রিস্টান আরবদের কাছে। নওফাল যান ইয়েমেনের শাসকের কাছে বাণিজ্য চুক্তির জন্য। মুত্তালিব যান আবিসিনিয়ানদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করতে। চুক্তি সম্পাদনের সুসংবাদ নিয়ে মক্কায় ফিরে আবদুল শামস যান আরবের পূর্বের দিকের লোকেদের চুক্তি করতে। এর ফলে মক্কাবাসীদের ইরাক এবং পারস্যের বাণিজ্যিক অঞ্চলে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করে হয়ে যায়। (১)
প্রথমদিকে
মক্কাবাসীরা অন্যদের পরিবহনের
জন্য পরিবহন সেবা দিয়ে আসছিল,
কিন্তু
শেষপর্যন্ত তারা যখন অর্থনৈতিকভাবে
শক্তিশালী হয়ে উঠল তখন তারা
নিজেরাই পণ্যদ্রব্য কেনাবেচা
শুরু করল। তারা বিভিন্ন অঞ্চল
থেকে বিদেশি পণ্য কিনে লাভের
জন্য পুনরায় বিক্রয় করা
শুরু করে। হাশিম ছিল মুহাম্মদের
দাদার নাম,
তিনি
এত বিখ্যাত ছিলেন যে তাঁর
নামেই একটি বংশের নামকরণ করা
হয়!
হাশিম
নামের অর্থ 'রুটি
সরবরাহকারী'।
হাশিমের প্রকৃত নাম আম (Amr),
কিন্তু
তাঁকে ডাকনামেই ডাকা হতো,
যখন
থেকে তিনি মক্কাবাসী অনাহারিদের
রুটি সরবরাহ করতেন। প্রচন্ড
খরায় এই অঞ্চলটি পুড়ে
গিয়েছিল। খাবারের অভাব দেখা
দিয়েছিল,
লোকেরা
ক্ষুধার্ত হয়ে মারাও যাচ্ছিল।
খাবারের জন্য হাশিম নিজে টাকার
নিয়ে বস্তা নিয়ে সিরিয়ায়
দিকে রওনা দেন এবং সেখান থেকে
উটের তৈরি পরিবহনের মাধ্যমে
প্রচুর পরিমাণে গম মক্কায়
নিয়ে আসেন। মক্কায় ফিরে
এসে তিনি গমগুলো অনাহারী
মানুষের মধ্যে বিতরণ করেন,
এবং
মক্কাবাসীরা অনেকদিন পর টাটকা
রুটি ভাপে সেদ্ধ উটের মাংসে
ডুবিয়ে তৃপ্তি সহকারে আহার
করে।
তাঁর এই মহানুভবতা মক্কাবাসীদের যথেষ্ট নাড়া দেয় যার ফলশ্রুতিতে তারা একটা গোত্রের নামই দেন হাশিমী, যার অর্থ রুটি সরবরাহকারী বা ব্রেডমান! তারপর থেকে হাশিমকে তাঁকে সেই নামেই ডাকা হতো। পর্বতীতে তিনি মক্কার নেতা হয়েছিলেন, যদিও তাঁকে ক্ষমতাঁর জন্য নিজের চাচাতো ভাইয়ের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হতে হয়েছিল। সে সংঘাতের জন্য মূলত দায়ী ছিলেন কুসাই নিজে । কুসাই তাঁর চার সন্তানদের মধ্যে শুধু এক সন্তানের কাছেই সমস্ত ক্ষমতা হস্তান্তর করে, যার নাম ছিল আবদ আল-দার (Abd al-Dar) যিনি মূলত কুসাইর দেখভাল করতেন! কুসাইর অন্য পুত্ররা তাদের বাবার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে তাঁর সিদ্ধান্তকে মেনে নিলেও তাঁর নাতি-নাতনিরা তাঁর ভাগ চাওয়া শুরু করেন।
যতই
সময় গড়াতে থাকে তারা দুটো
পক্ষে ভাগ হয়ে যেতে থাকেন -
একদল
আবদ আল দার বংশের উত্তরাধিকারসূত্রে
প্রাপ্ত অধিকারের পক্ষে,
আরেকদল
বিভিন্ন গোত্রের সদস্য যারা
মনে করতেন তারাও ক্ষমতাঁর
ন্যায্য ভাগিদার। তারা দাবি
করতেন “আমাদেরও নায্য অধিকার
আছে”। ঝামেলা নিরসনে এক
ভদ্রমহিলা মন্দিরের সামনে
একটি সুগন্ধির বাটি এবং একটি
রক্তের বাটি রেখে দেন এবং
লোকজনকে বলেন,
তারা
যদি এই সুগন্ধির বাটিতে হাত
ডুবান তাঁর মানে তারা হাশিমের
নেতৃত্ব স্বীকার করে নিলেন,
আর
যদি রক্তের বাটিতে হাত ডুবান
তাহলে অপর পক্ষের আনুগত্য
স্বীকার করে নিলেন। যারা এই
রক্তের পাত্রে হাত ডুবিয়েছিলেন
তাদের সবাইকে পরবর্তীতে
রক্তচোষা বলে ব্যঙ্গ করা হতো।
এরপর
উভয়পক্ষই ক্ষমতাঁর জন্য
পবিত্র সীমানার বাইরে যুদ্ধের
জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
যখন মাথা কিছুটা ঠান্ডা হলো
তারা বুঝতে পারলেন ভাই-ভাইদের
মধ্যে একে অন্যকে হত্যা করে
কোনো ফায়দাই তারা অর্জন করবেন
না। তখন তাদের মধ্যস্থতা করার
জন্য এলাকার একজন খ্যাতিমান
লোককে ডেকে আনা হয়। তিনি
তাদের মধ্যে দায়িত্ত ভাগ
করে দেন। হাশিমকে তীর্থযাত্রীদের
খাবার ও জল সরবরাহের দায়িত্ব
দেয়া হয়,
যার
ফলে তিনি পশুপালকদের কাছ করে
শুল্ক আদায় করতে পারতেন।
আবদ আল দার বংশের উপর পড়ে
পৌরবিষয়ের দেখভাল করার ভার
এবং বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ
করার দায়িত্ব;
মন্দিরের
দ্বাররক্ষীর নিয়ন্ত্রণও
ছিল তাদের হাতে,
অর্থাৎ
তারা মন্দিরের রাজস্ব দেখাশুনা
করতেন (২)।
আব্দুল
মানাফের পুত্র এবং পরিবারের
নেতা হিসেবে হাশিম তাঁর
তীর্থযাত্রার দেখভালের
দায়িত্ব খুবই আনুষ্ঠানিকতাঁর
সাথে পালন করতেন। শরতের পবিত্র
মাস আসলেই হাশিম পশুপালকের
কাছ থেকে পশুপাল সংগ্রহ করতেন
এবং মন্দিরের জন্য বার্ষিক
চাঁদা আদায় করতেন। তীর্থযাত্রীরা
যখন আসতে শুরু করতেন তিনি
হাজার হাজার লোককে খাবার
সরবরাহের জন্য পশু জবাই ও
রান্নার তদারকি করতেন। তাঁর
দায়িত্ব ছিল বাবুর্চি জোগাড়
করা,
হাঁড়ি
জোগাড় করা এবং আগুনের জন্য
কাঠের ব্যবস্থা করা যাতে এই
কাজ তিনি কোন রকম বিশৃঙ্খলা
ছাড়াই সম্পাদনা করতে পারেন।
সবচেয়ে চ্যালেঞ্জপূর্ণ কাজ
ছিল জলের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
তিনি তাঁর গোত্র থেকে কর্মীদের
নিযুক্ত করতেন,
যারা
গভীর কূপগুলি থেকে জল তুলে
চামড়ার পাত্র ভর্তি করে
রাখতেন যাতে করে সবাই জল পেতে
পারেন। এসব কিছুর সবই তিনি
তদারকি করতেন। নেতৃত্ব এবং
দক্ষতাঁর গুণের কারণে হাশিম
দ্রুতই তাঁর অবস্থান শক্ত
করে ফেলেন এবং পৌরবিষয়ক অনেক
দিকও তিনি দেখাশুনার দায়িত্ব
পান।
হাশিমের
এক ভাইপো তাঁর নেতৃত্বকে
চ্যালেঞ্জ করেন। তিনি মনে
করতেন তিনি হাসিমের চেয়ে
বেশি যোগ্য। এর ফলে আবার বিরোধের
সৃষ্টি হয়। তাঁর নাম ছিল
উমাইয়া,
যার
নামেই মুহাম্মদ-পরবর্তী
শাসকদের একটি বংশের নামকরণ
করা হয়। উমাইয়া ছিলেন হাশিমের
যমজ ভাই আবদ শামসের (Abd
Shams ) পালক
পুত্র। হাশিম ও আবদ শামস যমজ
ভাই ছিলেন,
জন্মের
সময় আবদুল শামসের ডান হাতের
আঙ্গুলগুলি হাশিমের মাথার
সাথে সংযুক্ত ছিল। কথিত আছে
যে তাদের পিতা তাঁর তলোয়ার
ব্যবহার করে তাদের পৃথক
করেছিলেন। যার ফলে লোকজন
ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে
ওদের দুইজনের মধ্যে খারাপ
সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে!
উমাইয়া
সাদা কেশের অধিকারী ছিলেন
এবং তাঁর চোখ ছিল নীল। ছোটবেলায়
আবদ শামস তাঁকে যখন পালকপুত্র
হিসেবে নিয়ে আসেন,
তখন
তিনি আসলে বাইজেন্টাইনে দাস
হিসেবে ছিলেন। কথিত আছে,
একদিন
দাস ব্যবসায়ীরা মক্কার উপর
দিয়ে যাচ্ছিলেন ঠিক এমন সময়
উমাইয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে
আবদ শামসের পিতা দাস ব্যবসায়ীদের
কাছ থেকে তাঁকে কিনেছিলেন।
যদিও তিনি প্রথমে তাঁকে ইয়েমেনে
বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছিলেন,
তবে
পরে উমাইয়াকে তাঁর পুত্র
আবদুল শামসের হাতে তুলে
দিয়েছিলেন এবং নিঃসন্তান
আবদ শামস তাঁকে পুত্রের স্নেহে
বড় করে তোলেন। পরিবারের
সহায়তায় উমাইয়া বণিক হিসেবে
সফল হয়েছিল,
তবে
মক্কার কালো চুলওয়ালা এবং
বাদামী চোখের অধিকারী লোকেদের
সাথে খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা
হচ্ছিল ।
সম্ভবত
বহিরাগত চেহারার জন্য এবং
পার্থক্য ঘোচাতে,
তিনি
আপ্রাণ চেষ্টা করতেন অন্য
গোত্রকে সাহায্য করতে। যার
ফলশ্রুতিতে মক্কার দুর্ভিক্ষের
সময় তিনি উদারতার সাথে হাশিমকে
অর্থ সাহায্য করেছিলেন,
এবং
হাশিমের এই উদারতাই হাশিমকে
সর্বাধিক পরিচিতি দিয়েছিল।
উমাইয়া দানের দিক থেকে তাঁর
চাচাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি যে তাঁর চাচার চেয়ে বেশি
যোগ্য তা প্রমাণ করতে তাঁর
চাচাকে একটি প্রতিযোগিতার
চ্যালেঞ্জ জানান (৩)।
হাশিম তাতে রাজি হন,
তবে
এই শর্তে যে,
যিনি
হেরে যাবেন তাঁকে দশ বছরের
জন্য নির্বাসনে যেতে হবে এবং
পঞ্চাশটি উট দান করতে হবে।
এক জায়গায় (বইয়ে)
পাওয়া
যায়,
মধ্যস্থতার
জন্য একজন গণ্য ব্যক্তিকে
আনা হয়। আরেক জায়গায় পাওয়া
যায় বিচারকের জন্য একটি
প্যানেল নির্বাচিত করা
হয়েছিল।
এই
জাতীয় প্রতিযোগিতার নিয়ম
ছিল:
প্রত্যেক
প্রতিযোগী তাঁর অভিজ্ঞতা,
ব্যক্তিগত
গুণাবলী,
সাফল্য
এবং তাঁর পরিবারের যোগ্যতা
এবং তাদের অর্জনগুলি সম্পর্কে
সভায় সবার সামনে বলবেন।
প্রতিপক্ষ চাইলে তা প্রত্যাখ্যানের
সুযোগও দেয়া হবে সাক্ষীদের।
বিচারকরা প্রতিযোগীদের
চারিত্রিক সনদ দিয়ে তাদের
কথার সত্যতার প্রমাণ দিবেন।
এটি অনেকটা রাজনৈতিক প্রচারের
মতোই,
পার্থক্য
যেমন ভোট গণনা হতো হাতের সংখ্যা
দিয়ে। বিচারকরা হাশিমের
পক্ষে রায় দেয়। শর্ত অনুযায়ী
উমাইয়াকে সিরিয়ায় নির্বাসনে
চলে যেতে হয়েছিল। তাঁর চলে
যাওয়ার পরে হাশিম একটি বিশাল
ভোজের আয়োজন করেন এবং হেরে
যাওয়ার শর্ত অনুযায়ী প্রাপ্ত
উট জবাই করে মাংস মক্কার
দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করলেন।
মক্কায় হাশিমের সবচাইতে বড় অবদান মক্কাকে কেবল একটি ট্রানজিট রুট থেকে রফতানির জায়গা হিসেবে পরিণত করা। এর আগ পর্যন্ত মক্কার স্থানীয়ভাবে ছোট ছোট কাফেলা ছিল, তারা স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করত। কিন্তু হাসেম ছিলেন কুসাইর মতই স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনি এবং তাঁর ভাইয়েরা বিভিন্ন সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি করার পরে তিনি সমগ্র সম্প্রদায়কে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সকল পণ্য সংগ্রহ করার জন্য সংগঠিত করেন যাতে বেশি লাভে সেইসব পণ্য অন্য অঞ্চলে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করতে পারে।
পণ্যদ্রব্যের
মধ্যে ছিল আকরি (silver
ore), ধূপ,
আতর,
গুল্ম,
অস্ত্রশস্ত্র,
পশু
ইত্যাদি। তিনি সমবায় প্রতিষ্ঠা
করেন,
অথবা
তাঁর ধারণাগুলি পরে রূপান্তরিত
হয়ে একটি রফতানি সমবায়
সংগঠনে রূপ নেয়,
যেখান
থেকে বাণিজ্য কাফেলার অর্থায়নের
সংস্থান করা হয়েছিল এবং
প্রতিটি বিনিয়োগকারী তাঁর
অংশের অনুপাতে বিনিয়োগের
লভ্যাংশ পেতেন।
মক্কা থেকে দূরবর্তী গোত্রদের মূর্তিগুলিকে মক্কার মন্দিরের অভ্যন্তরে অথবা তাঁর আশপাশে স্থাপন করার মাধ্যমে সবার প্রতিমাকে স্বাগত জানানোর যে ঐতিহ্য তাঁর বাবা কুসাই শুরু করেছিলেন, হাশিম তা চালু রাখেন। এর ফলে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার লোকেদের সাথে তিনি খুব ভালো সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, যা চুক্তি সম্পাদন করতে তাঁকে সুবিধাজনক অবস্থান দেয়।
মক্কায়
নিয়ে আসা প্রতিটি প্রতিমাকে
একটি কুটনৈতিক বিজয় বলে গণ্য
করা হতো। প্রতিটি প্রতিমা
একটি চুক্তিতে স্বাক্ষরের
মতোই বিষয় ছিল,
যা
দুরবর্তী গোত্রদেরকে আধ্যাত্মিক
এবং বাণিজ্যিকভাবে মক্কার
সাথে আবদ্ধ করে। উপাসনার মাস
শেষ হলে হাশিম তখন কাফেলা
বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতেন। ঠিক
এমনই এক ভ্রমণের সময় তিনি
মুহাম্মদের দাদা আবদুল
মুত্তালিবের জন্ম দেন (Abdul
Muttalib)।
মক্কা থেকে প্রায় দু'শো
ত্রিশ মাইল উত্তরে উর্বর কৃষি
এলাকার ইয়াছরিব নামক এক
জায়গায় হাশিম তাঁর কাফেলা
থামান,
যেখানে
তিনি সালমা নামক এক বর পরিত্যক্তা
রূপবতী নারীর রূপে মুগ্ধ হন।
কথিত আছে যে,
সালমাকে
তিনি বাজারে দেখতে পান,
তিনি
তাঁর ভৃত্যকে কিছু ক্রয়ের
বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন
তখন। এরপরই হাশিম তাঁর সম্পর্কে
খোঁজখবর নিতে লেগে পড়েন।
সালমা
খাজরাজ (Khazraj)
গোত্রের
নাজ্জার (Najjar)
বংশের
মেয়ে ছিলেন। দুটি সন্তানসহ
তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়। সালমা
জানিয়েছিলেন যে,
তিনি
পুনরায় কাউকে বিয়ে করতে
রাজি হবেন কেবল এই শর্তে যে,
তিনি
যদি তাঁকে পছন্দ না করেন তবে
বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার
পাবেন। যেহেতু হাশিম মক্কাবাসীদের
মধ্যে একজন খ্যাতনামা শেখ
ছিলেন সেহেতু সালমার শর্ত
বিয়ের আয়োজন করাটা তাঁর
পক্ষে কঠিন ছিল না। কাফেলায়
সাথে থাকা হাশিমের আত্মীয়-স্বজনরা
বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। কনের
পক্ষে নাজ্জার (Najjar)
গোত্রের
লোকেরা উপস্থিত ছিল।
কথিত
আছে,
কাফেলা
সিরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা
দেয়ার আগেই,
সালমা
গর্ভবতী হয়েছিলেন। গল্পে
পাওয়া যায়,
ব্যবসার
উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার সফরে,
হাশিম
তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে ফিরিয়ে
সঙ্গে নেন,
কিন্তু
পরে তিনি আরেকটি কাফেলাকে
দিয়ে,
তাঁর
স্ত্রীকে ফেরত পাঠান,
যাতে
বাচ্চা জন্মের সময়,
তিনি
পরিবারের সাথেই থাকতে পারেন।
তিনি তাদেরকে বলেন বাণিজ্য
থেকে ফেরার পথে,
মা
এবং বাচ্চাকে মক্কার উদ্দেশ্যে
তুলে নিয়ে যাবেন। তবে তা আর
সম্ভব হয়নি। গাজা নামক
জায়গায়,
কাফেলা
থামার পরই তিনি মারা যান।
বাল্যকালে মুহাম্মদের দাদা
দেখতে হাশিমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ
ছিলেন,
এবং
এটিও জানা ছিল যে,
তিনি
তাঁর মতো সুঠামদেহী ও নেতৃত্বগুণের
অধিকারী হবেন। তাঁর মা তাঁকে
শাইবা (Shayba)
বলে
ডাকতেন যার অর্থঃ বুড়ো,
কারণ
তিনি জন্ম নিয়েছিলেন কিছু
সাদা চুল নিয়ে। তিনি জীবনের
প্রথম দশবছর তিনি ইয়াছরিবে
কাটিয়েছেন। তাঁরপরে মুত্তালিব
নামে হাশিমের একভাই তাঁকে
দেখতে আসেন এবং তাঁকে কুরাইশ
গোত্রের ছেলে হিসেবে দাবি
করেন।
তিনি সালমাকে চাপ দেন যেন শাইবাকে মক্কায় নিয়ে যান, যাতে করে এই বাচ্চার চরিত্রটি কুরাইশ বংশের আর সবার মতই হয়। সালমা রাজি হলে মুত্তালিব উটের পেছনে বসিয়ে, ছেলেটিকে নিয়ে মক্কায় আসেন। কুরাইশরা যখন তাদের দেখল, তারা ভেবেছিল মুত্তালিব হয়ত তাঁকে ক্রয় করেছে দাস হিসেবে। তারা তাঁর নাম দিয়েছে আবদুল মুত্তালিব, মানে মুত্তালিবের দাস। এই কথা শুনে তিনি তাদেরকে বলেন, “তোমরা বাজে বলছো, ও আমার ভাতিজা, নাম শাইবা। ও হাশিমের পুত্র, আমি ইয়াছরিব থেকে ওকে নিয়ে এসেছি” ।
তবে
'মুত্তালিবের
দাস'
নামটিই
শেষমেশ থেকে যায়,
কারণ
মুত্তালিব তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন
এবং সর্বদা তাঁকে সাথে রাখতেন।
হাশিমের ভাই হিসেবে মুত্তালিবও,
তীর্থযাত্রীদের
খাবার ও জল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে
বেশ সফল হয়েছিলেন এবং তিনি
তাঁর ভাতিজাকেও উত্তরসূরি
হিসেবে প্রস্তুত করছিলেন।
আব্দুল মুত্তালিবের চাচা
মুত্তালিব ইয়েমেনে বাণিজ্য
করতে যাওয়ার পথে মারা যান।
তখন আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন
খুবই ছোট এবং প্রাপ্তবয়স্ক
না হওয়া পর্যন্ত তিনি চাচার
পদ ও দায়িত্ব গ্রহণ করতে
সক্ষম ছিলেন না।
চাচা
মুত্তালিবের মৃত্যুর পরে,
আব্দুল
মুত্তালিবের আরেক চাচা নওফাল
আব্দুল মুত্তালিব,
প্রাপ্তবয়স্ক
না হওয়া পর্যন্ত তাঁর ভাই
হাশিম ও মুত্তালিবের,
এই
তীর্থস্থান দেখভালের পবিত্র
দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন,
কিন্তু
মুত্তালিব প্রাপ্তবয়স্ক
হবার পর,
তিনি
দায়িত্ব ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি
জানান। চাচা মুত্তালিব তাঁর
ভাতিজা আব্দুল মুত্তালিবের
জন্য কিছু সম্পত্তি রেখে যান,
সেখান
থেকে নওফাল কিছু সম্পত্তি
দখলও করে নেন।
আবদুল
মুত্তালিব প্রাপ্তবয়স্ক
হবার পরও,
তাঁর
উত্তরাধিকারিসূত্রে পাওয়া
ক্ষমতা হাতে পেলেন না এবং
কুরাইশের সমর্থন পেতেও ব্যর্থ
হলেন,
তাই
তিনি সামরিক সহায়তার জন্য
ইয়াছরিবে,
তাঁর
মামাদের সাহায্যর জন্য ডেকে
পাঠান,
ঠিক
যেমন কুসাই ক্ষমতা পেতে তাঁর
সৎ ভাইদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
মামাদের নেতৃত্বে প্রায়
আশিজনের সশস্ত্র ঘোড়সওয়ারের
একটি দল মক্কায় পৌঁছেছিল।
তাঁরা মন্দিরের সামনে নওফালকে
কোণঠাসা করে পরিষ্কার বলে,
সালমার
পুত্রকে তাঁর ন্যায্য অধিকার
ফিরিয়ে না দিলে রক্তের বন্যা
বইয়ে দিবে। সম্ভবত এটি ফাঁকা
হুমকি ছিল,
কারণ
তারাও জানতেন,
পবিত্র
ভূখণ্ডের ভেতরে নওফালকে হত্যা
করলে,
এটি
অবশ্যই গোত্রে গোত্রে গৃহযুদ্ধের
সূচনা করবে। কিন্তু নওফালের
পিঠ দেয়ালে ঠেকেছিল,
তাই
তাঁর ক্ষমতা হস্তান্তর করা
ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
ফলে আবদুল মুত্তালিব তার
সম্পত্তি ও তীর্থযাত্রার
নিয়ন্ত্রণ হাতে
পেলেন যা বরাবরই
হাসিমের দ্বারা পরিচালিত
হয়েছিল ।
ক্ষমতা হাতে পাওয়ার পর তিনি দ্রুতই মক্কাবাসীদের নেতা হয়ে ওঠেন। আবদুল মুত্তালিব জন্মগ্রহণ করেন ৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে, সময়টা ছিল ভূরাজনীতির সংঘাতের সময়, যে কারণে মক্কা ছিল অশান্ত। এই অস্থিরতা ছিল মূলত ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে। ইয়েমেনে বারবার বিদেশি শক্তির এবং সামরিক শক্তির অভ্যুত্থান ঘটছিল। এই সংঘাতের সূচনা হয় একজন শাসকের উত্থানের মাধ্য দিয়ে, তাঁর নাম দু নুওয়াস (Dhu Nuwas), যিনি ইহুদি ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তিনি নাজরান এলাকায় যে বৃহত্তর খৃস্টান সম্প্রদায় শিকড় গেড়ে বসেছিল তাতে খুশি ছিলেন না। কথিত আছে, দু নুওয়াস ইহুদিধর্ম গ্রহণ করার পর বিশ হাজার নাজরান খ্রিস্টানকে জবাই করেছিলেন, যারা ধর্ম পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। যদিও সংখ্যাটি সম্ভবত অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়, তবে এই নৃশংসতাই পরবর্তীতে ইয়েমেনে খ্রিস্টান শক্তির হস্তক্ষেপের কারণ হয়েছিল। দুরত্বের কারণে বাইজেন্টাইনরা সরাসরি এই সংঘাতে অংশগ্রহণ করতে অসমর্থ ছিল, তবে দূর থেকে আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসককে, ইয়েমেন দখল করতে সবধরণের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিল। এ কারণে আবিসিনিয়ানদের সত্তর হাজার সেনা, লোহিত সাগর পেরিয়ে ইয়েমেনে আক্রমণ করে বসে। কথিত আছে, (যুদ্ধে পরাজিত) দু নুওয়াস হয় খুন হয়েছেন বা আত্মহত্যা করেছেন, এবং আবিসিনীয় বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে। কিন্তু এরপর শুরু হয় নতুন ঝামেলা - আবিসিনীয় বাহিনীর দুজন সেনাপতির মধ্যে ক্ষমতার জন্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর সমাধান হয়েছিল হয়েছিল কেবল তখনই, যখন সেনাপতি দুজন সম্মুখ সমরে নামে, একে অন্যের সাথে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করে যতক্ষণ না একজন নিহত হয়। এই লড়াইয়ে আব্রাহা (Abraha) নামে একজন জেনারেল বিজয়ী হয়েছিলেন, তবে তলোয়ারের আঘাতে আব্রাহার গালে গভীর ক্ষত তৈরি হয়, যার ফলশ্রুতিতে তাঁকে 'দ্বিখণ্ডিতমুখ' নাম ডাকা হতো ।
আব্রাহা
রাজত্বকালে তিনি একজন শক্তিশালী
ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে ওঠেন,
যিনি
খ্রিস্টধর্ম এবং আবিসিনিয়ার
সামাজ্য প্রসারিত করার জন্য
নিবেদিত হন। তিনি স্পষ্টতই
পশ্চিম আরবের গোত্রদের খ্রিস্টান
ধর্মে দীক্ষিত করার ছক কষেন,
যার
ফলে সানায় একটি বিশাল গির্জা
নির্মাণ করেছিলেন। তিনি
ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে,
এই
গির্জা পবিত্র মাসে মক্কার
ঐতিহ্যবাহী পৌত্তলিক মন্দিরে
তীর্থযাত্রার অব্যাহতি ঘটাবে।
কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন,
আরবরা
এই মন্দিরের সাথে এতই নিবেদিতপ্রাণ
যে তিনি ওদের পৌত্তলিক বিশ্বাসের
ফাটল ধরাতে ব্যর্থ। শুধুই
তাই-ই
না,
মন্দিরের
অনুরাগী কোনো একজন রাতে তাঁর
সেই গির্জাটিতে গোপনে ঢুকে
বেদীটির ঠিক সামনে মলত্যাগ
করে রেখে যায়। এই ঘটনায়
আব্রাহা অপমানিত বোধ করেন
এবং খুবই রাগান্বিত হন। আব্রাহা
মক্কা আক্রমণের সিদ্ধান্ত
নেন। এই আক্রমণের জন্য তিনি
হাত মিলান প্রভাবশালী আরব
শেখের সাথে যিনি ছিলেন খুজা
গোত্রের লোক। কুসাই তাঁকে
মক্কা থেকে ক্ষমতাচ্যুত
করেছিলেন।
অতঃপর
আব্রাহা সশস্ত্র হস্তিবাহিনী
নিয়ে বিধর্মী মন্দির ধ্বংস
করার অভিপ্রায়ে মক্কা অভিমুখে
রওয়ানা দেন (৭)।
এই হামলার আগাম সংবাদ আবদুল
মুত্তালিব জানার পর তিনি তাঁর
লোকদের পাহাড়ের আড়ালে
লুকিয়ে থাকার নির্দেশ
দিয়েছিলেন। আব্রাহার বাহিনী
মক্কার দক্ষিণে পৌঁছানোর পরই
ছোট ছোট গোত্রদের দ্বারা
পরিচালিত প্রতিরোধের সামনে
পড়েন!
তবে
মন্দিরকে আব্রাহার বাহিনীর
হাত থেকে এবং মক্কাকে দখল করা
থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়
কেবলমাত্র গুটি বসন্তের
প্রাদুর্ভাবের কারণে।
যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এই রোগটির
বিস্তার হঠাৎ দ্রুতগতিতে
ছড়িয়ে পড়ে যা আব্রাহার
সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে
দিয়েছিল। অবস্থা বেগতিক
দেখে আব্রাহা তাঁর সেনাবাহিনীর
বাকী সবাইকে নিয়ে সানার
প্রাসাদে ফিরে আসেন,
কিন্তু
তারপর খুব শীঘ্রই গুটি বসন্তে
আক্রান্ত হওয়ার কারণে তিনি
মারা গিয়েছিলেন (৮)।
আব্রাহার এই পরাজয়কে মক্কাবাসীরা
দেবতার আশীর্বাদ হিসেবে দেখেন
এবং জনমুখে বলতে থাকে যে
আবিসিনিয়ানদের পরাজিত হবার
কারণ হচ্ছে পাখিদের একটি বিশাল
ঝাঁক তাদের উপর পাথর মেরেছিল,
যার
ফলে ক্ষতের কারণে জীবানু
সংক্রমণ হয়ে তাঁরা মারা যান।
মুহাম্মদ পরবর্তীকালে এই
ঘটনাকে আল্লাহর শক্তির প্রমাণের
উদহারণ হিসেবে ব্যবহার করতেন।
এমনকি কোরানে এই ঘটনার বর্ণনা
দিয়ে সুরার অবতারণাও করেন।
পৌরাণিক
কাহিনীগুলোকে তিনি সত্য হিসেবে
উপস্থাপন করার প্রবণতা ছিল
মুহাম্মদের। এর উদাহরণ হচ্ছে
নিচের এই সুরাটি :
“তুমি
কি দেখনি তোমার রব হাতীওয়ালাদের
সাথে কী করেছিলেন?
তিনি
কি তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায়
পর্যবসিত করেননি?
আর
তিনি তাদের বিরুদ্ধে ঝাঁকে
ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেছিলেন।
তারা তাদের ওপর নিক্ষেপ করে
পোড়ামাটির কঙ্কর। অতঃপর
তিনি তাদেরকে করলেন ভক্ষিত
শস্যপাতার ন্যায়”।
আবদুল
মুত্তালিবের পাঁচ স্ত্রী
ছিল। আর তিনি দশ ছেলে ও ছয়
কন্যা সন্তানের বাবা ছিলেন।
এর মাঝে মুহাম্মদের পিতা
আব্দুল্লাহ ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ
এবং স্বভাবতই তাঁর প্রিয়।
সত্তরের মাঝামাঝি বয়সে
মুত্তালিব তাঁর চব্বিশ বছর
বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহর বিয়ে
ঠিক করেন আমিনার সাথে। আমিনা
ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের
মেয়ে এবং তিনি নিজেও একই
গোত্রে শেষ বিয়ে করেন।
কিছু
সূত্র দাবি করেছে যে,
একই
সময়ে দুটো বিবাহ সম্পন্ন
হয়। আব্দুল্লাহর ঘরে জন্ম
নেয় মুহাম্মদ,
আবদুল
মুত্তালিবের ঘরে জন্ম নেয়
হামজা এবং সাফিয়া। তারা তিনজন
একই সময়ে জন্ম এবং বেড়ে ওঠার
কারণে হামজা এবং সাফিয়া শেষ
পর্যন্ত মোহাম্মদের গুরুত্বপূর্ণ
সমর্থক হয়ে ওঠেন। মুহাম্মদের
পিতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা
যায় না। শুধু এটুকু জানা যায়
যে,
তিনি
পঁচিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন,
ঠিক
যে বছর আমিনা মুহাম্মদকে জন্ম
দিয়েছিলেন। বলা হয় অন্যান্য
মক্কাবাসীদের মতোই তিনি দীর্ঘ
দূরত্বে কাফেলা ভ্রমণের সময়
মারা গিয়েছিলেন। ফলে,
আমিনা
বিধবা হন এবং মুহাম্মদ এতিম
হন। মুহাম্মদের জন্মের সূত্র
ধরে আবদুল্লাহকে নবীর পিতার
উপযোগী করে তুলতে সাহিত্যের
মধ্যে কিংবদন্তী সব গল্প জুড়ে
দেয়া হয় পরবর্তীতে। তন্মধ্যে
সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল বাইবেলের
বিবরণ,
আব্রাহাম
যে তাঁর ছেলেকে ঈশ্বরের
সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে
উদ্যত হন,
সেই
কাহিনী।
এই
গল্পের সাথে মিল রেখে বর্ণিত
আছে,
আবদুল
মুত্তালিবও ঈশ্বরকে খুশি
করতে আবদুল্লাহর গলা কাটতে
চেয়েছিলেন। ঈশ্বর আব্রাহামকে
বিশ্বাসের পরীক্ষা করতে তাঁর
পুত্রকে হত্যা করতে বলেছিলেন,
অন্যদিক
আবদুল মুত্তালিব তীর্থযাত্রীদের
জন্য জল সরবরাহ করার জন্য কূপ
খনন করতে এই প্রতিশ্রুতি করেন
যে,
যদি
তিনি দশ পুত্রের জনক হন তবে
সেখান থেকে এক পুত্রকে ঈশ্বরের
উদেশ্যে উৎসর্গ করবেন। সে
সময় তাঁর একটামাত্র ছেলে
ছিল,
তাই
হজ্বযাত্রীদের জন্য জল সরবরাহ
করা খুবই কষ্টকর ছিল। যেহেতু
এই কাজের জন্য হাজীদের থেকে
প্রাপ্ত সকল অর্থ তাঁর পকেটে
ঢুকত তাই মক্কাবাসীরা তাঁকে
সাহায্য করতে অস্বীকৃতি
জানায়। একটা সময় ঘাম মুছতে
মুছতে আকাশের দিকে তাকিয়ে
মনের দুঃখে তিনি এই প্রতিজ্ঞা
করেন। শেষমেশ তিনি সত্যিই দশ
সন্তানের জনক হন। কথিত আছে,
সন্তানরা
বড় হবার পর তিনি তাঁর এই
প্রতিশ্রুতির কথা তাদেরকে
বলেন। বাবার এই সিদ্ধান্তের
প্রতি সম্মান জানাতে তাঁর
সকল সন্তানরা হুবাল দেবতার
সামনে উপস্থিত হন। সেখানে
একজন ভবিষৎদ্রষ্টা ধর্মযাজক
ছিলেন। তিনি দশটি তীর হুবাল
দেবতাকে ছুঁড়ে মারেন এবং
বারবার সেই তীর তাঁর একজন
ছেলের দিকেই এসে পরে। আর সেই
একজনই হচ্ছেন মোহাম্মদের
বাবা আব্দুল্লাহ ।
আব্রাহাম
যেমন তাঁর পুত্রকে মারওয়া
পাহাড়ে নিয়ে যায় হত্যা
করতে,
আবদুল
মুত্তালিবও অনিচ্ছাকৃতভাবে
তাঁর একটি ছুরি বের করেছিলেন,
কিন্তু
তবে এইবার বাইবেলের গল্পের
মতো ঈশ্বরের তরফ থেকে ঐশ্বরিক
উট পাঠানো হয় না। এক্ষেত্রে
মুত্তালিবের কন্যারা কাঁদতে
কাঁদতে তাদের বাবার হাতকে
নিবৃত্ত করেছিলেন এবং অনুরোধ
করেছিলেন যেন তিনি আব্দুল্লাহকে
হত্যা না করেন। অবশেষে দেবতাদের
সাথে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল
যে,
আব্দুল
মুত্তালিব তাঁর পুত্রের বদলায়
একশো উট বলি দেবেন। তিনি তাই
করেছিলেন।
আরেক
গল্প আছে এমনঃ আবদুল্লাহকে
এক মহিলা প্রস্তাব করেছিলেন
তাঁর সাথে শোবার জন্য,
যার
বিনিময়ে এই নারী তাঁকে একশো
উট উপহার দেবেন। ইসলামের
ইতিহাসে বিভিন্ন গল্পেরই
উল্লেখ পাওয়া যায়,
তবে
একটি গল্প প্রায় সবখানে
পাওয়া যায়,
যা
এরকম আব্দুল্লাহ এবং তাঁর
পিতা যখন আব্দুল্লাহর হবু
বৌয়ের গোত্রের উদ্দেশ্যে
রওনা দিয়েছেন বিয়ে করার
জন্য (উল্লেখ্য,
বাবা
এবং ছেলে দুই চাচাতো বোনকে
বিয়ে করেছিলেন)
পথিমধ্যে
এই নারীরই (উট
প্রস্তাবকারিনী)
প্রস্তাবে
আবদুল্লাহ আগ্রহী হলেও পরক্ষণেই
তিনি ভদ্রমহিলাকে বলেন “আমি
আমার বাবার সাথে আছি,
এবং
আমি তাঁকে ছেড়ে আসতে পারি
না”। এরপর তিনি আমিনাকে বিয়ে
করেন। আমিনা গর্ভবতী হন,
ঠিক
তারপরেই আব্দুল্লাহ সেই নারীর
কাছে যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু
এবার তিনি আব্দুল্লাহর উপর
ঠান্ডা জল ছুঁড়ে মারেন আর
প্রতিবাদ করে বলেন “আমি খারাপ
মহিলা নই”। তিনি শুধু আব্দুল্লাহর
সাথে শুতে চেয়েছিলেন সেদিনই,
কারণ
তিনি তাঁর চোখে জ্বলজ্বলে
সাদা আলো দেখতে পেয়েছিলেন
এবং ভেবেছিলেন তিনি হয়তো
ভবিষৎ নবীর বাবা হবেন,
তাই
তিনি সেই ভবিষ্যৎ নবীর মা হতে
চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর
সে আলো নেই,
সেটা
চলে গেছে অন্যের কাছে (১২)।
এর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই, আবদুল্লাহ সিরিয়ার উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য একদল কাফেলার সাথে একটি চুক্তি সই করেছিলেন। তবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় কাফেলা তাঁকে ইয়াছরিবে রেখেই রওনা দেন যাতে তাঁর নাজ্জার (Najjar) গোত্রীয় আত্মীয়রা তাঁর সেবা-শুশ্রূষা করতে পারে। আব্দুল মুত্তালিব যখন জানতে পারলেন তাঁর ছোট ছেলে অসুস্থ, তিনি তাঁর খোঁজ খবর নেয়ার জন্য তাঁর বড় পুত্র আল- হারিছকে ইয়াছরিবে পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আব্দুল্লাহ তাঁর ভাই পৌঁছার একমাস আগেই মারা যান। তাঁকে তাঁর আত্মীয়দের উঠানেই কবর দেয়া হয়।
মৃত্যুকালে
আবদুল্লাহ আমিনার জন্য রেখে
গিয়েছিলেন :
একটি
আবিসিনীয় দাসী,
পাঁচটি
উট এবং একটি ভেড়ার পাল। বাবার
মৃত্যুর বেশ কয়েক মাস পর
মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন।
ছেলের জন্মের পর আমিনা আবদুল
মুত্তালিবের কাছে সুসংবাদ
পাঠান,
মুত্তালিব
মুহাম্মদকে দেখতে আসেন। তিনি
শিশুটিকে তুলে নিয়ে মন্দিরে
যান এবং হুবাল দেবতাকে ধন্যবাদ
জানান।
মোহাম্মদের
জন্ম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে,
হাতির
বছর। যে বছর খ্রিস্টান যোদ্ধারা
পৌত্তলিক মন্দিরটি ধ্বংস
করার জন্য মক্কায় যাত্ৰা
করেছিলেন কিন্তু পাখিদের
ঝাঁক দ্বারা আক্রমণের শিকার
হয়ে ফিরে যান।