মুহাম্মদের ধর্ম ছিল আইন আর মুহাম্মদ ছিলেন সেই আইনের প্রণেতা। তিনি আলো-ঝলকিত পাহাড় থেকে নেমে আসা মুসা নবীকে কল্পনায় আনেন, যিনি পাথরের পাতে খোদাই করা ঈশ্বরের আদেশ নিয়ে এসেছিলেন; কিন্তু মুহাম্মদ ছিলেন মুসার আরও বিস্তৃত পরিসরের প্রতিকৃতি। মুসা যেখানে কেবলমাত্র ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ নিয়ে এসেছিলেন, মুহাম্মদ সেখানে নিজেকে পুরো পৃথিবীর জন্য প্রভুর বার্তাবাহক হিসেবে দেখেছিলেন। নিজের সম্পর্কে তার মহিমান্বিত ধারণাটি এমন পর্যায়ে প্রসারিত হয়েছিল যে, তিনি বিশ্বাস করতেন অদৃশ্য জিন জাতির জন্যেও সমন্বিত একগুচ্ছ নিয়ম (শরিয়া) আনার জন্য তাকে মনোনীত করা হয়েছে, যাতে জিনদেরকেও বেহেশতে নেয়া সম্ভব হয়। মদিনায় মুহাম্মদের ভূমিকা শুরুই হয়েছিল বিচারক হিসেবে, একজন আইনপ্রণেতা ও বিধানকর্তা হিসেবে। তিনি ইয়াছরিবে স্থায়ী হওয়ার পরে লোকেরা তাদের নানান বিরোধ নিষ্পত্তি করতে তার কাছে আসত। একজন বহেরাগত হিসেবে তাকে সেই উপত্যকায় নিরপেক্ষ হিসেবে দেখা হতো, যেখানে অন্য আর কেউ নিরপেক্ষ ছিল না। প্রথমে, তিনি নাগরিক নানান বিষয়ে বিচার করতেন এবং পারস্পরিক বিবাদের সমাধানের জন্য লোকদেরকে একত্রিত করতেন। লোকেরা যেসব সমস্যার সমাধানের জন্য তার নিকট এসেছিল তার মাঝে প্রথমটি ছিল জল নিয়ে বিরোধের নিষ্পত্তি করা। উপত্যকার (ইয়াছরিব) ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্টী বাণিজ্যের চেয়েও কৃষিকাজের উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। কিছু ভু-পতি শুকনো মওসুমে পানি ধরে রাখতে খালের পাড়ে বাঁধ দিয়েছিল, কিন্তু তা করতে গিয়ে তারা নিম্নভুমির কৃষকদের বঞ্চিত করেছিল। ক্ষতিগ্রস্থরা সমাধান খুঁজে পেতে মুহাম্মদের শরণাপন্ন হলো। তিনি কীভাবে বিষয়টি মীমাংসা করেন তা জানা যায়নি, তবে তিনি সকল পক্ষকে নিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন (১)
বহু বছর আগে বুয়াতের (Buath) যুদ্ধের শেষ হওয়া আন্তগোত্রীয় সংঘর্ষের সালিশই-বিচারের জন্যও মুহাম্মদের শরণাপন্ন তারা হয়েছিল। আউসের বিরুদ্ধে তখনও খাজরাজীদের অভিযোগ ছিল, আবার খাজরাজের বিরুদ্ধেও আউসীদের অভিযোগ ছিল। পৌত্তলিক গোত্রের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে বেশ কয়েকটি ইহুদি গোত্রও নানান দাবিদাওয়া পেশ করেছিল। এই বিষয়গুলির বেশিরভাগ ছিল রক্তের মূল্য নিয়ে, তবে জব্দকৃত সম্পত্তিও ছিল তাদের অভিযোগের বিষয়বস্তু। কার কিসে অধিকার ছিল এই ব্যাপারে তিনি সবাইকে একটা ঐক্যমতে পৌঁছাতে সক্ষম হন । লোকেরা পারিবারিক বিষয়, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যা, চুক্তির বিরোধ এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কেই সমাধান পেতে তার কাছে আসত।
মসজিদটি
নির্মাণের মাধ্যমে মুহাম্মদ
তার আল-কায়েদা
বা নিয়মকানুন (আইন-আদালতও
বলা যেতে পাড়ে)
প্রতিষ্ঠার
পর সালিশের ভূমিকা পালন করা
বাদ দিয়ে বরং সমাধানকল্পে
আইন জারি করতে শুরু করেন। তিনি
মসজিদে আদালত স্থাপন করেছিলেন
এবং ছোট,
বড়
নানান বিষয়ের বিচারক হয়েছিলেন।
তিনি তার কর্তৃত্ব কোরআনের
আয়াত আকারে জাহির করেছিলেন,
যা
সেগুলোকে আবার ঐশ্বরিক
কর্তৃত্বের অবয়ব প্রদান
করেছিল। এই আয়াতগুলি অসংখ্য
অধ্যায়ে (সুরায়)
ছড়িয়ে
আছে এবং বারবার নিগূঢ় অর্থসহ
তার পুনরাবৃত্তি হয়,
আইন
সম্পর্কে সাধারণ ধারণা দেয়;
এবং
সেই সময় হতেই বিভিন্ন ঘটনা
মোকাবিলা করার পদ্ধতি সমুহ
পরবর্তীতেও নজির বা উপমা
হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে (২)।
নাগরিক বিষয়গুলি প্রায়শই
ব্যক্তিগতভাবে শোনা হতো,
কারণ
লোকেরা তাদের বিষয়ে প্রকাশ্যে
বলতে অনিচ্ছুক ছিল। এই ধরনের
বিষয়গুলি সাধারণত আয়েশার
ঘরে অনুষ্ঠিত হতো। লোকেরা
পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবেশ
করত, এই
পর্দা মূলত মসজিদের মিম্বার
(পাটাতন)
থেকে
ঘরকে পৃথক করেছে। তারা সেখানে
পা গুটিয়ে মুহাম্মদের মুখোমুখি
বসত। ব্যক্তিগত শুনানির চাহিদা
এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে,
একপর্যায়ে
তিনি দাতব্য অনুদানের আকারে
কিছু পারিশ্রমিকও ধার্য করেন।
যাদের পারিশ্রমিক দেয়ার
সামর্থ্য ছিল না তারা অতিরিক্ত
নামাজ পড়ার মাধ্যমে মুহাম্মদকে
পুষিয়ে দিতেন।
তিনি নাগরিক বিষয়ে যেসব রায় দিয়েছিলেন তার উপাখ্যানগুলি বেশ মজাদার, আবার কিছু অত মজাদার নয়। মজাদার বিষয়গুলির মধ্যে একটি এমন - এক নারী মুহাম্মদের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, পুরুষাঙ্গের আকারের কারণে সে তার দ্বিতীয় বরের কাছ থেকে তালাক (বিবাহ-বিচ্ছেদ) নিয়ে প্রথম বরের কাছে ফিরতে অপারগ হয়ে যাচ্ছে। সেই নারী অভিযোগ করে, “তার (বরের) পুরুষাঙ্গটি কাপড়ের সুতার মতো চিকন”। নারীটি তার পোশাক থেকে একটি সুতো বের করল মুহাম্মদকে দেখানোর জন্য যে, পুরুষাঙ্গটি কতটা ছোট ছিল! তার পরিস্থিতি বেশ জটিল ছিল। সে তার পূর্বের বর যে তাকে (নারীকে) তালাক দিয়েছিল তার কাছেই এখন ফিরে যেতে চাইছে। মুহাম্মাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিবাহবিচ্ছেদের নিয়মানুসারে তালাকপ্রাপ্তা (ডিভোর্সড) নারী তার বরের কাছে আবার ফিরতে চাইলে তাকে আগে অন্য কারো ঘরণী (প্রচলিত অর্থে, হিল্লা বিয়ে) করতে হবে এবং সেখানেও বিবাহটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে, অর্থাৎ সহবাস হতে হবে। যদি দ্বিতীয় বিবাহটিও টিকে না থাকে তথা সেখানেও যদি নারীটি তালাকপ্রাপ্তা হয়ে যায় তবে সে তার প্রথম বরর সাথে পুনরায় বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু এই নারীটি তার দ্বিতীয় বরের লিঙ্গের আকারের কারণে তার আগের প্রিয়তম বরের সাথে পুনরায় মিলিত হতে পারছে না, কারণ তার সাথে তার (উত্থানরহিত লিঙ্গওয়ালা) দ্বিতীয় বরের সহবাস সম্ভব হয়নি। নারীটি ডিভোর্স চাইলে দ্বিতীয় বরও অমত করেনি, তাই মুহাম্মদ বিবাহবিচ্ছেদ মঞ্জুর করেছিলেন, কিন্তু আশ্চর্জনকভাবেই তিনি রায় দিয়েছিলেন যে, দ্বিতীয় বিয়েতে যৌনমিলন না হওয়ায় সে তার আগের বরর কাছে ফিরে যেতে পারবে না (৩)! এই ঘটনাটি উদ্ভট একটি দিকে মোড় নিয়েছিল, বিশেষ করে পুরুষদের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদকে আরও জটিল করে তুলেছিল। আগে কেবল “আমি তোমাকে তালাক দিলাম” এটা বললেই তালাক হয়ে যেত, তবে পুরুষরা আবার প্রায়শই তাদের মন পরিবর্তন করত এবং তাদের স্ত্রীদের ফিরে পেতে চাইত, এবং রাগের বশে স্ত্রীকে আবারও তালাক দিত। পুরুষদের তালাক দেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য মুহাম্মাদ একটি তিন-তালাকের বিধি নিয়ে এসেছিলেন। তৃতীয়বার তালাক দিলে স্ত্রীকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিয়ে হবে, এবং সেই বিয়ে থেকে তালাকপ্রাপ্ত হলেই কেবল তার প্রথম বর তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে (8) তবে এই বিধিটি তার কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারেনি। কারণ যেসব পুরুষেরা তাদের প্রাক্তন স্ত্রীদেরকে ফিরে পেতে চাইত, তারা মাঝেমাঝে অন্য কোন পুরুষকে জোগাড় / ভাড়া করে আনত, তাকে দিয়ে স্ত্রীকে বিয়ে করাতো, স্ত্রীর সাথে ঘুমোতে দিত এবং তারপরে তাকে দিয়ে স্ত্রীকে আবার তালাক দেয়াতো। এভাবেই স্ত্রী ফিরে পাবার পন্থা আবিষ্কার করেছিল তারা। কিন্তু যারা এই কাজ করছিল মুহাম্মদ তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং জাহান্নামের আগুনের হুমকি দিয়েছিলেন। তবে দোষীদের (আসল বর এবং ভাড়াটে বর) শাস্তি দেয়া কঠিন ছিল, কারণ ঘটনার সাক্ষী জোগাড় করা ছিল আরো কঠিন।
খাওলা
নামের এক নারীকে নিয়ে আরেকটা
মজার ঘটনা আছে। খাওলার বর
পৌত্তলিকদের তালাকের রীতি
মেনে তাকে তালাক দিয়েছিলেন,
যেখানে
তিনি তুলনা করেছিলেন যে,
খাওলার
সাথে সহবাস করার মানে হচ্ছে
তিনি যেন তার নিজের মায়ের
সাথেই সহবাস করছেন। এই ঘোষণার
খুব অল্পক্ষণ পরেই বর তার মন
পরিবর্তন করেছিল,
কারণ
সে স্ত্রীকে পেতে এবং তার সাথে
সহবাস পুনরায় শুরু করতে
চেয়েছিল। কিন্তু খাওলা তাকে
স্পর্শ করতে দিতে রাজি হলেন
না এবং এই ব্যাপারে তিনি
মুহাম্মদের কাছে আসলেন সমাধান
চাইতে। খাওলা কেঁদে কেঁদে
বললেন,
“হে
আল্লাহর রাসুল,
সে
আমার সম্পদ ব্যয় করেছে,
আমার
যৌবন ক্ষয় করেছে এবং আমার
গর্ভে তার অনেক সন্তান ধারণ
করেছি। যখন আমি বুড়ো হয়ে
গিয়েছি,
বাচ্চা
জন্ম দিতে পারছি না,
তখন
সে আমার উপর তালাকে যিহার
উচ্চারণ করল!”
(৫)
তার
সমস্ত ঘটনা শোনার একপর্যায়ে
মুহাম্মদ সবার সামনে মুর্ছা
যান এবং এরপর স্বাভাবিক অবস্থায়
ফিরে এসে বললেন,
“হে
খাওলা!
আল্লাহ
আপনাকে এবং আপনার বর সম্পর্কে
কিছু আয়াত অবতীর্ণ করেছেন”।
মুহাম্মদ খাওলাকে জানালেন
যে, তার
বর যদি সত্যিই তাকে ফিরে পেতে
চায় তবে তার অপমানজনক কথার
প্রায়শ্চিত্ত করতে একটি
দাসকে মুক্ত করতে হবে। খাওলা
জবাবে বলেছিলেন যে,
তার
বর কোনও দাসের মালিক নয়।
মুহাম্মদ তখন একটি বিকল্প
পন্থা দিলেন :
বরকে
দুই মাস রোজা রাখতে হবে,
কিন্তু
এবারও খাওলা মাথা নেড়ে বললেন
যে, তাতে
কাজ হবে না কারণ তার বর বৃদ্ধ;
এত
দিন রোযা রাখলে সে মারা যাবে।
মুহাম্মদ তখন বললেন, “তাকে বলুন গরিবদের মাঝে এক উট বোঝাই করে খেজুর বিলিয়ে দিতে। খাওলা বললেন, “কিন্তু আমরা তো গরিব। আমার বর বিয়ের সময় তার সব টাকা খরচ করে ফেলেছে”। মুহাম্মদ তখন খাওলাকে কিছু নির্দিষ্ট পরিমাণ খেজুর হাতে তুলে দেন, আর সেগুলোর সাথে মিলিয়ে আরো কিছু খেজুর যুক্ত করে গরিবদের মাঝে ভাগ করে দিতে বলেন। তাতে তার বর তাকে আবারো ফিরিয়ে নেবার অধিকার পাবে। খাওলা খুশিতে শিহরিত হয়েছিলেন, কিন্তু তার খুশির কারণ এটি নয় যে তিনি বরের কাছে ফিরে আসতে পারছেন, বরঞ্চ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তিনি আল্লাহর সাথে মুহাম্মদের যোগাযোগের মুহুর্তের সাক্ষী হয়েছেন! সারাজীবন তিনি গর্ব করেছিলেন যে, তার বৈবাহিক বিরোধের কারণে স্বয়ং আল্লাহ কোরআনের একটি সুরার শুরুর আয়াত নাজিল করে ফেলেছিলেন যা “ফরিয়াদী নারী ( pleading women ) " হিসেবে পরিচিতি লাভ করে (৬)।
বড়
ও ছোট বিষয়ে মুহাম্মদের
রায়গুলির বিপরীতে আপিলের
কোন সুযোগ ছিল না,
তাই
একলোকের কাছে তা বেশ কঠিন মনে
হয়েছিল। ইসলামের ইতিহাসে
বলা হয়েছে যে,
লোকটি
নাগরিক বিরোধের সমাধানে
মুহাম্মদ যে রায় দিয়েছিলেন
তাতে বিরক্ত হয়েছিল। মামলার
প্রকৃতি জানা যায়নি। যে লোকটি
বিচারে হেরে গিয়েছিল সে
মুহাম্মদের সাথে একমত হয়নি
এবং সেই রায় নিয়ে সে আবু
বকরের কাছে যায়। আবু বকর
জবাবে বলেছিলেন যে,
মুহাম্মদের
বাণী আল্লাহর বাণী এবং এটিই
চুড়ান্ত। তারপরও সন্তুষ্ট
না হয়ে সে উমরের বাড়িতে
গিয়ে তার কাছে অভিযোগ জানায়।
উমর অভিযোগ শোনার পর রেগে
গেলেন। সে আল্লাহর রাসুল নিয়ে
প্রশ্ন করার সাহস কী করে পেল?
মুহাম্মদ
পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি
ছিলেন। তার বিধান সম্পর্কে
প্রশ্ন করা ছিল সর্বশক্তিমানকে
প্রশ্ন করা। উমর দ্রুত আপিল
পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি ছুটে তার নিজের বাড়িতে
ঢুকলেন এবং তলোয়ার নিয়ে
ফিরে এলেন। কয়েক সেকেন্ডের
মধ্যে অভিযোগকারীর মাথাটা
মাটিতে পড়ে গেল (9)।
মুহাম্মদ ছিলেন মনে থেকে একজন নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী ব্যক্তি। এবং কোরআনের রচনাবলীর মাধ্যমে তিনি নিজেকে যে কর্তৃত্ব দিয়েছিলেন তা ব্যবহার করেই তিনি বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন – যেমন, মদ্যপান ও জুয়ার মতো জনপ্রিয় ক্রিয়াকলাপকে তিনি নিষিদ্ধ করে দেন। মদ সবার পছন্দনীয় পানীয় ছিল এবং মদের দোকানগুলোতে সহজেই কাপে করে বা বড় জগে করে মদ কিনতে পাওয়া যেত। লোকেরা বার্লি এবং যবের মন্ড থেকে তৈরি অশোধিত বিয়ারও পান করত। গাঁজানো খেজুর থেকে মধু জাতীয় উদ্ভূত একটি পানীয়ও ছিল জনপ্রিয়। মদের অপব্যবহারে কতটা সামাজিক সমস্যা হয়েছিল তা জানা যায় না, যদিও একটি গোত্রের গল্প থেকে অনুমান করা যায় যে, সেখানে মদ্যপান ছিল ব্যাপক। প্রথম দিকে মুহাম্মদ মদের ব্যাপারে অসম্মতি জানান যখন হামজা মাতাল হয়ে আলীর লুট করা উটকে জবাই করে খেয়ে ফেলেছিল। উহুদ যুদ্ধের পরে তিনি তার যোদ্ধাদের ধমক দিয়েছিলেন যখন তিনি জানতে পারেন যে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ভয় কমানোর জন্য যুদ্ধের আগে মদপান করেছিল। প্রথমত, মদ নিয়ে তার প্রধান উদ্বেগ ছিল এটি মনকে মোহাচ্ছন্ন করে এবং লোকদেরকে আল্লাহর ভাবনা থেকে বিরত রাখে, তবে উমরের চাপের ফলে তিনি নিন্দা থেকে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার দিকে চলে যান। উমরের পিতা খাত্তাব মাতাল হলে হিংস্র হয়ে যেতেন এবং প্রায়শই তাকে মাতাল হয়ে বর্বরভাবে মারতেন, যার ফলে উমর মদ ও মদ্যপায়ীদের ঘৃণা করতে করতে বেড়ে ওঠেন। তবে তিনি নিজেও মাতাল হয়ে ঘরে বসে থাকতেন, কিন্তু মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণের পরে মদ্যপান বন্ধ করে দেন। তিনি যে মুহাম্মদকে মদ নিষিদ্ধ করার জন্য এবং জুয়া খেলা নিষিদ্ধ করার আবেদন করেছিলেন তা ইসলামিক গ্রন্থতে স্পষ্ট, যাতে দেখা যায় যে, মুহাম্মদ তাকে একদিন এই বিষয়ে আল্লাহর কাছ থেকে একটি লিখিত বার্তা পাঠ করার জন্য মসজিদে ডেকে পাঠালেন যেখানে বলা হয়েছে : “তারা আপনাকে নেশা এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, উভয়ের মধ্যেই একটি বড় পাপ এবং উপকারিতা রয়েছে, এবং তাদের পাপ তাদের উপকারিতার চেয়ে বেশি” (৮)।
উমর
চেয়েছিলেন যে আল্লাহ কঠোরভাবে
এটি নিষেধ করুক এবং পুরোপুরি
অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করুক।
কথিত আছে যে,
উমর
বলেছিলেন,
“হে
আল্লাহ!
মাদক
সম্পর্কিত একটি সুস্পষ্ট
রায় দিন” (৯)।
মুহাম্মাদ তার আল্লাহকে
তৃতীয়বারের মতো নিষেধাজ্ঞার
আয়াত রচনা করার জন্য ডেকেছিলেন,
যা
মদকেও অতিক্রম করেছিল:
“হে
মুমিনগণ,
নিশ্চয়
মদ, জুয়া,
প্রতিমা-
বেদী
ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমুহ তো
নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং
তোমরা তা পরিহার কর,
যাতে
তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু
মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের
মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ
সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়)
আল্লাহর
স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের
বাধা দিতে। অতএব,
তোমরা
কি বিরত হবে না?”
(১১)।
এটি
কোন পরামর্শ ছিল না,
এটি
ছিল আদেশ। এরপর থেকে যে কেউ
মদপান করলে তার সাথে কঠোর আচরণ
করা হতো। মুহাম্মদ বা অন্য
যে কোনও বিচারিক কর্তৃত্বের
আদেশে তাদের শাস্তির জন্য
জনতার হাতে তুলে দেয়া হতো।
আগেকার দিনগুলিতে তাদের খোঁচা
দেয়া হতো,
চড়
মারা হতো,
স্যান্ডেল
দিয়ে পেটানো হতো এবং খেজুরের
ডালপালা দিয়ে মারা হতো।
অবশেষে তাদেরকে প্রকাশ্যে
বেত্রাঘাত করা হয়েছিল,
চল্লিশটি
দোররা মারা ছিল তাদের জন্য
নির্ধারিত শাস্তি। এই ধরনের
ঘটনায় আইন অমান্যকারীদের
মুহাম্মদের সামনে যেখানেই
আনা হতো,
সেখানেই
আদালত বসত। একটি বহুল শ্রুত
গল্পে বলা হয় যে,
তিনি
কারও বাসায় গেলে এক মাতাল
সেখানে ঢুকে পড়ে। তিনি সেই
মাতালকে মারতে বাড়ির সমস্ত
পুরুষকে আদেশ দেন (১২)।
যদিও মারধর করার বেদনা ও অপমান
করা যথেষ্ট শাস্তি হিসেবে
বিবেচিত হয়েছিল,
তবে
আরেকটি ঘটনায় মুহাম্মদ
একাধিকবার পানকারীকে মৃত্যুদণ্ডের
হুমকিও দিয়ে বলেছিলেন :
“যদি
সে চতুর্থবার আবার তা করে তবে
তাকে হত্যা কর” (১৩)।
চুরি করাকে তিনি আরও কঠোরভাবে দমন করতেন। হাতের কব্জির উপরে কেটে দেয়া হতো, যাতে অপরাধী যে হাত দিয়ে অপরাধটি করত সেটা আর ব্যবহার করতে না পারে। আরবে পূর্বেও চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা হতো, কিন্তু মুহাম্মদ এটিকে বিধিবদ্ধ করেন এবং সবক্ষেত্রে প্রয়োগের প্রচলন করেন। যদিও একপর্যায়ে তিনি সতর্ক করেছিলেন যে, এমনিকি একটি ডিম চুরির জন্যও হাত কেটে ফেলা হবে! তবে সাধারণত একটি সোনার মুদ্রার এক চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি বা তিনটি রৌপ্যমুদ্রার চেয়ে বেশি মূল্যবান কোন জিনিস যা দিয়ে একটি ঝালর বা শরীরের বর্ম কেনা যেত, তেমন জিনিসের চুরির জন্য এই শাস্তি প্রযোজ্য ছিল। অন্যদের মধ্যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতেও এই শাস্তি প্রদান করা হত। এটি অন্যদের জন্য একটি সতর্কতা হিসেবে কাজ করত, কারণ শাস্তিপ্রাপ্ত লোকেরা তাদের খণ্ডিত অঙ্গটি আড়াল করতে পারত না (১৪)।
জাবালে
নূর (আলোকিত
পাহাড়)
থেকে
নেমে আসার পর,
মুহাম্মদ
যৌনতা সম্পর্কিত বিস্ময়কর
বিধিবিধান ও নিষেধাজ্ঞা সমূহ
জারি করেন। কে কাকে বিয়ে করতে
পারবে সে সম্পর্কে নিয়মকানুন
নিয়ে এসেছিলেন;
তিনি
অবিবাহিতদের উপর কৌমার্য
চাপিয়ে দিয়েছিলেন;
সহবাসের
পর শরীর শুদ্ধ করার রীতিনীতি
নির্ধারণ করেন এবং যতক্ষণ না
সেগুলো মানা হবে,
তাদের
জন্য প্রার্থনা নিষিদ্ধ করেন।
তিনি নারী ও পুরুষকে আলাদা
করার উপর জোর দেন,
নারীদের
উপর পর্দা চাপিয়ে দেন এবং
বাড়ির বাইরে নারীদের চলাচল
নিয়ন্ত্রণ করেন। ব্যভিচারের
জন্য তিনি মৃত্যুদণ্ড এবং
বিয়েবহির্ভূত যৌন সম্পর্কের
জন্য মারাত্মক দোররা মারার
বিধান চালু করেন। তবে তার
পক্ষে লড়াই করার জন্য পুরুষদের
উৎসাহ দিতে তিনি তাদের জন্য
দাসীদের সাথে সহবাসের অনুমতি
দিয়েছিলেন এবং তার জন্য লড়াই
করে মারা যাওয়া পুরুষদের
জন্য তিনি জান্নাতে অনন্তকালীন
সহবাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
মুহাম্মদ
পর্বত থেকে ওহী নিয়ে নেমে
আসার আগে আরবের পুরুষ ও নারীরা
নগ্নতার বিষয়ে বিশেষভাবে
সচেতন ছিল না। মক্কার মন্দির
প্রদক্ষিণ করার সময় নির্দিষ্ট
ধর্মীয় পোশাক পরতে না পারলে
নরনারীরা তাদের পরিধেয় পোশাক
খুলে ফেলে পশুর চামড়া গায়ে
দিত। অল্পবয়সী মেয়েরা কখনও
কখনও গ্রাম বা শহরে ঘুরে বেড়াত
কেবল কোমর থেকে নিচে পর্যন্ত
পোশাক পরে,
আর
তাদের স্তনযুগল তারা লম্বা
চুল দিয়ে ঢেকে রাখত। তারা
কানের দুল,
চুড়ি
এবং গোড়ালিতে নুপুর পরে
নিজেকে সাজাতো এবং তারা খুব
সুন্দর সুগন্ধি গায়ে মাখাত
যার সুবাস তাদের পেছনে চলে
যাওয়ার পরও অনেক দুর পর্যন্ত
পাওয়া যেত (১৫)।
এমনকি
মুহাম্মদও সুন্দরী নারীদের
দিকে তাকিয়ে থাকতেন। তবে
তার জন্য এটি একটি ধাক্কা ছিল
যখন তার হারেমের একটা অংশ
সুন্দরী যুবতীদের দিয়ে ভরে
গিয়েছিল। তার নিজের লোকেরা,
যারা
এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বস্ত
এবং জাহান্নামের আগুনের ভয়ে
ভীত থাকত তারাও মুহাম্মদের
হারেমের মেয়েদের দিকে লোলুপ
দৃষ্টি দিত। দেবে না-ইবা
কেন? মোটেলের
কক্ষের সারির মতো,
তাদের
কুঁড়েঘরের দরজা মসজিদের
আঙ্গিনার সাথে লাগানো এবং
খোলা ছিল,
এবং
সবাই তাদের আসা-যাওয়া
দেখতে পেত।
প্রাক্তন পালকপুত্রের প্রাক্তন স্ত্রী জয়নবকে বিয়ে করার সময়ই মানুষের কৌতুহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে মুখ ঢাকার পর্দাপ্রথাটা মুহাম্মদ নিয়ে আসেন। শেষ পদক্ষেপটা এসেছিল যখন বিবাহ-অনুষ্ঠানের পরে বেশ কয়েকজন অতিথি জয়নাব- মুহাম্মদের ঘরে বসে গল্প করতে থাকে, এবং মুহাম্মদ সন্দেহ করেছিলেন যে আসল কারণ হচ্ছে ওরাও তার মতো করে জয়নবকে কামনা করছে। আর তারা জয়নাবের রূপে মুগ্ধও ছিল। মদ ও জুয়ার মতো তিনি তখন থেকে সমস্ত বিশ্বাসী নারীদের মুখমন্ডলের পর্দা পরতে বাধ্য করে দেন যাতে কোন পরপুরুষ তাদের দেখে মন্ত্রমুগ্ধ না হতে পারে। এবং তাদের মুখমণ্ডলের উপরেই কেবল এই পর্দা বাধ্যতামূলক করলেন না, বরং পুরো শরীরের আচ্ছাদনেরও বিধানও নিয়ে এলেন, যাতে নারীদের স্তন এবং নিতম্বের বাঁক দেখে কারও মনে কামনা জাগ্রত না হয়! আল্লাহপাক পাহাড়ের উপর থেকে মুহাম্মাদকে ডাকলেন: “হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীদেরকে, কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে বল, 'তারা যেন তাদের জিলবাবের (চেহারা, মাথা ও বুক ঢেকে রাখা যায় এমন চাদর) কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়, তাদেরকে চেনার ব্যাপারে এটাই সবচেয়ে কাছাকাছি পন্থা হবে। ফলে তাদেরকে কষ্ট দেয়া হবে না। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (১৬)।
সবকিছুর
মতোই মুহাম্মদ এটিকে চরমাবস্থার
দিকে নিয়ে যান। ঘরে থাকা
অবস্থায়ও মেয়েদের আচ্ছাদন
ছাড়াই কারা করা দেখতে পারবে,
মুহাম্মদ
তা সংজ্ঞায়িত করেন। সুতরাং
নারীরা রক্তের সম্পর্কের
স্বজন এবং শ্বশুরবাড়ির
উপস্থিতিতে সাধারণ পোশাক
পরার অনুমতি পেয়েছিল,
তবে
অন্য কেউ যদি বাড়িতে আসে তবে
পর্দার পেছন থেকে তাদের কথা
বলতে নির্দেশ দেয়া হয়। তারা
পুরো পোশাক পরিহিত থাকলেই
কেবল পর্দার আড়াল থেকে সামনে
আসতে পারত। মুহাম্মদের সমস্ত
স্ত্রীরাই এই ঢেকে রাখার
নিয়মের অধীনে চলে এসেছিল,
যখন
তিনি অভিযানের সময় তাদের
সঙ্গে নিতেন এমনিকি সেই সময়েও।
উটের উপর পর্দায় ঢাকা পালকিতে
তাদের চড়তে হতো। শিবির স্থাপন
করা হলে,
নানান
বিষয়ে মুহাম্মদের সাথে
পরামর্শ করতে আসা পুরুষদের
দৃষ্টি থেকে নিজেদের আড়াল
করতে নারীরা তাঁবুর মাঝে
পর্দার আড়ালে থাকত।
পুরুষদের
উপর থেকে পুরনো যৌন রীতিনীতি
বাতিল করাও মুহাম্মদের জন্য
কঠিন ছিল। পূর্বে আরব পুরুষরা
উন্মত্ত যৌনতা উপভোগ করত,
তবে
সেখানে একমাত্র জটিলতা ছিল
পিতৃত্ব। একটি গল্পে মক্কার
এক সম্ভ্রান্ত সুন্দরীর কথা
বলা হয়েছে যার একটি পুত্রসন্তান
ছিল এবং সে পরবর্তীতে একজন
বিখ্যাত কবি হয়েছিল। কয়েক
ডজন মক্কাবাসী সেই পুত্রের
পিতৃত্ব দাবি করেছিল।
এ
জাতীয় বিষয়গুলি সাধারণত
গোত্রীয় পরিষদগুলোর সামনে
জোড়াতালির মাধ্যমে নিষ্পত্তি
করা হতো। পুরুষ ও নারীরা
স্বল্পমেয়াদী চুক্তিতে
অস্থায়ী বিবাহে আবদ্ধ হতো
যাতে যৌতুকের দরকার পড়ত।
কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের
পর তারা যে যার মতো চলে যেত।
যৌনলালসা অবাধ জীবনাচরণের
মাঝে জটিলতা এনে দিয়েছিল,
তবে
এর ফলে রক্তপাতের কোন ঘটনার
কথা জানা যায় না। নতুন শাসন
ব্যবস্থায়,
অবিবাহিত
পুরুষদের এখন কৌমার্য ধরে
রাখতে হচ্ছে,
যা
বিবাহের জন্য অনুপ্রাণিত
করে, কিন্তু
অনেকেরই বিবাহের জন্য যৌতুক
প্রদান করার অর্থ ছিল না।
এভাবেই তারা জিহাদের মাধ্যমে
প্রাপ্ত লুটের মাল থেকে
অর্থোপার্জন করতে বা আরও বেশি
লোভে নিজেদের যৌনতা চরিতার্থ
করতে ডাকাতিতে অংশ নিতে আগ্রহী
হয়ে পড়েছিল।
মুহাম্মদের
মতে বিবাহবহির্ভূত সহবাসে
যেকোনও অবিবাহিত পুরুষ বা
নারী লিপ্ত থাকলেই তাকে “অবৈধ
যৌনাচার” বলা হতো এবং ধরা
পড়লে শাস্তিস্বরূপ একশো
চাবুক মারা হতো এবং এক বছরের
নির্বাসনে পাঠানো হতো। বিবাহিত
ব্যভিচারীদের মসজিদের মূল
ফটকের বাইরে শাস্তি প্রদানের
একটা স্থানে নিয়ে যাওয়া
হতো এবং পাথর মেরে হত্যা করা
হতো, তবে
তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
করার আগে একশো দোররা মারা হত।
কিভাবে চাবুক মারতে হবে সেটিও নিয়ন্ত্রিত ছিল। শাস্তি প্রদান করা চাবুকটি চামড়ার তৈরি মাঝারি আকারের এক মাথাবিশিষ্ট গিটবিহীন হতে হবে। পুরুষদের পোশাক খুলে ফেলা হতো, কারণ পোশাকের কারণে চাবুক মারায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে, এবং তাদের সমস্ত শরীরের উপরে চাবুক মারা হতো। নারীদের ক্ষেত্রে দোররা কেবল পেছনে এবং কাঁধে মারা হতো। চাবুকগুলি এত জোরে মারা হতো না যাতে চামড়া ফেটে যায় বা জীবন বিপন্ন করে, তবে এত আস্তেও মারা হতো না। পরিণতির কথা ভেবে মুহাম্মদ জেনার জন্য জোরালো প্রমাণের বিধান করলেন। চারজন ধর্মপ্রাণ, খাঁটি সাক্ষীর প্রয়োজন হতো এবং যে কেউ মিথ্যা অভিযোগ আনলে বা এমন কোন অভিযোগ করলে যা প্রমাণ করার জন্য যাচাই করা যায় না তখন উল্টো অভিযোগদাতাকেই চাবুক মারা হতো। মুহাম্মদ অভিযোগকারীদের সতর্ক করেছিলেন, “প্রমাণ দাও, নয়ত তোমার পেছনে দোররা মারা হবে” (১৭)। সাক্ষীর এই নিয়মটি আয়েশার ব্যাপারে ওঠা গুজব (ব্যভিচারের) থেকে অনুপ্রাণিত। সে ঘটনার কোন সাক্ষী ছিল না; সবটাই পারিপার্শ্বিক অবস্থার আলোকে ছড়িয়েছিল। আয়েশা যখন মুস্তালিক অভিযান থেকে ফেরার পথে পেছনে পড়ে যান; সাফওয়ান তাকে উদ্ধার করে পুরো সেনাদলের সামনে দিয়ে নিয়ে আসেন, তারপরও কিছু মানুষ অবিশ্বাস করেছিল। যে সকল পুরুষ ও নারী গুজব ছড়িয়ে দিয়েছিল, তাদেরকে শাস্তি দিয়ে মুহাম্মদ নজির স্থাপন করেছিলেন। মিথ্যা অভিযোগ করলে, বা প্রমাণ করা যায় না এমন অভিযোগ করলে তার পরিণতিও একই হবে।
তবে
চারজন সাক্ষীর প্রয়োজনীয়তার
একটা খারাপ দিক ছিল। একলোক
যে তার স্ত্রীর কেলেঙ্কারি
ধরেছিল,
মুহম্মদের
কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে,
সাক্ষীর
খোঁজ করার মতো তার পর্যাপ্ত
সময় নেই। মুহাম্মদ তাকে চাবুক
দিয়ে হুমকি দিলে লোকটি আকাশের
দিকে হাত তুলে আল্লাহর কাছে
সাহায্যের জন্য আবেদন করে।
মুহাম্মদ এমন পরিস্থিতি
মোকাবেলায় একাধিক আয়াত
নিয়ে এসেছিলেন এবং লোকটিও
তার পিঠ বাঁচাতে পেরেছিল (১৮)।
তবে মুহাম্মদ সমাধান করেছিলেন
শপথ দিয়ে :
লোকটিকে
মুহাম্মদের সামনে তার স্ত্রীকে
আনতে বলা হলো এবং বরকে তার
স্ত্রীর মুখের উপরে চারবার
তার অভিযোগ বলতে মুহাম্মদ
আদেশ দিলেন এবং তারপরে এর
সত্যতা সম্পর্কে আল্লাহর
নামে কসম করতে বললেন। তারপর
সেই নারী যিনি জানতেন যে,
তিনি
যদি অভিযোগ স্বীকার করেণ তবে
পাথর মেরে তাকে হত্যা করা হবে,
তিনি
তার বরকে মিথ্যাবাদী বলে
চারবার দৃঢ়তার সাথে কসম
করেছিলেন এবং তিনি যা বলছেন
তার সত্যতার জন্য আল্লাহর
নামে শপথ করেছিলেন। এভাবে
মুহাম্মদ ব্যাপারটির সমাধান
করেছিলেন। এরপর তিনি বললেন
: “যে
এখানে মিথ্যা বলেছে তাকে
আল্লাহ মৃত্যুর পর শাস্তি
দেবেন” (১৯)।
কেবল
চাবুক এবং পাথর ছুঁড়ে হত্যা
করার নতুন আইন তাদেরকে মুহাম্মদের
হুকুম মেনে চলতে উৎসাহিত
করেছিল তা নয়,
সাথে
জাহান্নামের হুমকিও ছিল।
মুহাম্মাদ বিবাহের বাইরের
সহবাসকে মারাত্মক পাপ মনে
করতেন,
এটি
ছিল আল্লাহর বিরুদ্ধে অপরাধ
এবং আল্লাহ এমন পাপীদের প্রতি
ভীষণ ক্রুদ্ধ!
আল্লাহ
দুষ্কৃতিকারীদের জাহান্নামের
গর্তের মধ্যে ফেলে দেবেন এবং
চুল্লির দরজা চিরকালের জন্য
বন্ধ করে দেবেন। বিস্তারিত
আকারে মুহাম্মদ অভিশপ্ত
পাপীদের জন্য জাহান্নামে
প্রস্তুত রাখা শাস্তির করুণ
বর্ণনা দিতেন। দৃশ্যগুলি এত
বীভৎস ছিল যে,
মুমিনরা
তা শুনে মাঝেমাঝে প্রকাশ্যেই
কেঁদে দিতেন। তিনি তাদের
বলেছিলেন যে,
পার্থিব
জীবনের এই শাস্তি হচ্ছে শুদ্ধির
জন্য, তবে
এটি আখেরাতের (পারলৌকিক
জীবনের)
শাস্তির
চেয়ে অনেক কম কঠোর। যদি তারা
তওবা করে ইহলৌকিক শাস্তি গ্রহণ
করে, তবে
আল্লাহ পরকালে তাদের ক্ষমা
করে দেবেন।
ব্যভিচার
এবং বিবাহ-পূর্ব
সহবাসকে শয়তানের কাজের
সমতুল্য বানিয়ে মুহাম্মদ
যৌন অপরাধবোধ ও উন্মাদনা তৈরি
করতে সক্ষম হয়েছিলেন,
আরবে
যেটি এর আগে ছিল না। পর্যবেক্ষণে
দেখা যায় যে,
লোকেরা
মুহাম্মদের কাছে তাদের যৌনপাপ
স্বীকার করত এবং আশা করত,
এই
জীবনে শাস্তি ভোগ করার মাধ্যমে
পরিশুদ্ধ হয়ে পরবর্তী জীবনের
চিরন্তন আগুন তারা এড়াতে
পারবে। ইসলামিক বর্ণনাগুলোতে
মাইজ নামের এক ব্যক্তির কথা
বলা হয়,
যে
ব্যভিচারের কথা স্বীকার করার
জন্য মুহাম্মদের সামনে আসে।
সে বলে,
“আমি
আন্তরিকভাবে চাই যে আপনি আমাকে
শুদ্ধ করুন” (২০)।
প্রথমদিকে মুহাম্মদ তার কাছ
থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন,
সম্ভবত
এটি নিয়ে তিনি আর কথা বলতে
চাননি। তবে,
যতবার
তিনি লোকটির কাছ থেকে নিজেকে
সরিয়ে নিচ্ছিলেন লোকটি ততই
তার সামনে চলে আসে। এবং তার
নিজের অভিযোগের পুনরাবৃত্তি
করতে থাকে। চতুর্থবারের মতো
এরকম করার পরে মুহাম্মদ তাকে
বললেন,
“তুমি
কি পাগল?”
যখন
সে উত্তর দিল যে সে পাগল নয়,
মুহাম্মদ
তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার
জন্য লোক পাঠান। যখন জানা গেল
যে, সে
মানসিকভাবে সুস্থ,
মুহাম্মদ
তখন তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিলেন।
কথিত আছে যে,
তাকে
যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার
নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া
হয়, সেখানে
জনতারা তাকে লক্ষ্য করে পাথর
ছুঁড়ে মারে,
তখন
সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং
মুক্ত হয়ে দৌড় দেয়। উগ্র
জনতা তাকে উপত্যকার পশ্চিম
পাশে বালির মাঠে ধাওয়া করে।
বিশ্বাসী জাবির আবদুল্লাহ
(Jabir abdullah)
বলেন,
“তাকে
পাথর মারার দলে আমিও অংশ
নিয়েছি। যখন পাথর মারার কারণে
সে পালিয়ে যায়,
তখন
আমরা তাকে বালির মাঠে পাকড়াও
করলাম, আর
পাথর মেরে হত্যা করলাম” (২১)।
একই
ধরনের মামলায় একজন নারী জড়িত
ছিলেন। তিনি একজন বিবাহিত
নারী ছিলেন যিনি একটি সম্পর্কের
কথা স্বীকার করেন,
কিন্তু
মুহাম্মদ প্রথমে তাকে প্রত্যাখ্যান
করেন। তিনি আবার একদিন ফিরে
আসেন এবং বলেন যে তিনি গর্ভবতী,
এবং
পাপের শাস্তির মাধ্যমে তিনি
পবিত্র হতে চান। মুহাম্মদ
শুধু বললেন “যদি তুমি জোর কর”।
তবে তার বাচ্চা ভুমিষ্ঠ না
হওয়া পর্যন্ত তার মৃত্যুদণ্ড
বিলম্বিত হয়,
কিন্তু
বাচ্চা জন্মের পরেও মুহাম্মদ
তাকে শিশুটিকে পরিচর্যা করার
জন্য আরও দুই বছর সময় দেন।
যখন বাচ্চার দুধপান করানোর
সময় তিনি পার করলেন,
তখন
তার সামনে শিশুটিকে নিয়ে
এলেন,
বাচ্চাটি
তার হাতে একটি রুটি ধরে ছিল।
মুহাম্মদ শিশুটিকে একজনের
হাতে দিয়ে দিলেন এবং তার
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ
দিলেন। তার মৃত্যুদণ্ড ভিন্নভাবে
সম্পন্ন করা হয় -
তাকে
তার বুক পর্যন্ত মাটির নিচে
গাড়া হয় যাতে সে পালিয়ে
যেতে না পারে। তার জীবনপ্রদীপ
নিভে না যাওয়া পর্যন্ত জনতা
তার মাথায় পাথর ছুঁড়তে থাকে।
(২২)
মুহাম্মদের আইনের বেশিরভাগ অংশই ছিল প্রতিশোধের সাম্যতা সম্পর্কিত, চোখের বদলে চোখ এবং দাঁতের বদলে দাঁত - আরব রীতিনীতির পুনঃস্থাপন। এই বিষয়গুলি সহিংসতা বা দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের অপরাধের সাথে জড়িত। লোকেদের রক্তের বদলে অর্থ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিশোধ বা নিষ্পত্তি ছিল একমাত্র বিকল্প উপায়। মুহাম্মদের বেশিরভাগ মীমাংসার ঘটনায় জীবনহানি বা অঙ্গহানির ক্ষতি নিষ্পত্তি জড়িত ছিল এবং তিনি এ জাতীয় বিষয়ে মোকদ্দমার জন্য কোরআনের বহু আয়াত সৃষ্টি করেছিলেন। ইচ্ছাকৃত সহিংসতার ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমাকে বিকল্প হিসেবে উৎসাহিত করেন, কিন্তু প্রতিশোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না। যেমন এক নারীর হত্যার ঘটনাই, যেখানে এক নারী অন্য নারীকে বেলন দিয়ে মারতে মারতে মেরে ফেলেছিল। যে নারী মারা গিয়েছিল সে গর্ভবতী ছিল এবং তার সাথে তার ভ্রূণও মারা যায়। মুহাম্মদ ভ্রূণের মৃত্যুর জন্য একটি উটকে ক্ষতিপুরণ দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য সেই নারীকে ভুক্তভোগীর পরিবারের হাতে তুলে দেন। পরিবারটি সম্ভবত তাকেও বেলন দিয়ে হত্যা করে।
দুর্ঘটনাজনিত
হত্যাকাণ্ড বা বিপর্যয় সমাধান
করা হতো রক্তের বদলার অর্থ
প্রদানের মাধ্যমে। মুহাম্মদ
এক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এমন যে,
নগরবাসী
কাউকে হত্যা করলে মূল্য দিতে
হবে চারশো স্বর্ণের মুদ্রা
বা তার সমমানের রূপা। বেদুইনরা
মূল্য পরিশোধ করবে গবাদি
পশুদের দান করে -
দু'শো
উট বা দুই হাজার ভেড়া বা ছাগল।
কারো পুরো নাক কাটা পড়লে একশো
উটের জরিমানা ছিল,
তবে
যদি নাকের ডগা কাটা যেত তবে
অর্ধেক দিতে হতো। হাত বা পা
হারালে পঞ্চাশটি উট ক্ষতিপূরণ
দিতে হবে।
কম আঘাতের জন্য কম পরিমাণের ক্ষতিপুরণ। আঙুল বা দাঁতের বেলায় প্রত্যেকটি আঙুলের জন্য দশটি উট এবং প্রতিটি দাঁতের জন্য পাঁচটি করে উট ক্ষতিপুরণ দিতে হয়েছিল।
মুহাম্মদ
তাঁর সামনে উপস্থিত কিছু মামলা
আদালতের বাইরে হাসতে হাসতে
সমাধান করতেন,
যেমন
লড়াইয়ের সময় কাউকে কামড়
দেয়ার সময় সামনের দাঁত
হারানো এক ব্যক্তি বদলা হিসেবে
দাঁতের বদলে দাঁত বা পাঁচটি
উট দাবি করে। মুহাম্মদ বললেন,
“আপনি
কি তার মাংস খাওয়ার চেষ্টা
করছেন?”
তিনি
আবেদন খারিজ করে দেন এবং
বিবাদীকে দায়মুক্তি দেন
(২৩)।
[“পাথর
ছুঁড়ে মার!”
ব্যভিচারীদের
জন্য এটাই মুহাম্মদের হুকুম
ছিল। ইয়াছরিব পৌঁছানোর এক
বছরের মধ্যেই তিনি ব্যভিচারে
ধরা পড়া দুজন ইহুদিকে পাথর
ছুঁড়ে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তারা স্পষ্টতই ধর্মান্তরিত
ছিল, যারা
মুহাম্মদের বিধিবিধান মেনে
চলা আরব গোত্রসমূহের অন্যতম
একটি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
রাব্বিগণ ক্ষমা করে দেয়ার
পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল,
কিন্তু
কোন ফল হয়নি। তাদেরকে মুহাম্মদের
মসজিদের বাইরে নিয়ে যাওয়া
হয়েছিল এবং জনতা তাদের পাথর
মেরে হত্যা করেছিল। কথিত আছে
যে, পুরুষটি
তার নিজের শরীর দিয়ে নারীকে
ঢেকে পাথর থেকে রক্ষা করেছিল।]
একটি অপরাধ মুহাম্মদ কখনোই ক্ষমা করতেন না, তা হলো একজন মুমিনের হাতে আরেকজন মুমিনের হত্যা। উহুদের যুদ্ধের পরে তিনি এর নজির দেখিয়েছিলেন, যখন তিনি এক দশক আগে এক বিশ্বাসীর পিতাকে হত্যা করার বদলা স্বরূপ যুদ্ধের সময়কে কাজে লাগিয়ে আরেকজন বিশ্বাসীকে হত্যা করা এক ব্যক্তির শিরোশ্ছেদ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সামরিক অভিযানগুলোর একটির সময়ে আরেকজন বিশ্বাসী-বিশ্বাসীর হত্যার ঘটনাও ঘটেছিল যা এরূপ :
মুহাল্লিম
(Muhallim) নামের
একজনকে অন্যদের সাথে মিশনে
পাঠানো হয়েছিল। পথিমধ্যে
তার সাথে এমন একজনের দেখা হলো
যার সাথে মুহাম্মদের ধর্ম
গ্রহণ করার আগে থেকেই তার
ব্যক্তিগত ঝামেলা ছিল। যদিও
সাক্ষাতের সময়ে লোকটি একজন
মুমিনের মতোই মুহাল্লিমকে
সালাম দেয়,
কিন্তু
মুহাল্লিম তাকে একটি তীর দিয়ে
হত্যা করে এবং তার উট এবং সাথে
থাকা জিনিসপত্র চুরি করে।
খুনিকে মুহাম্মদের সামনে
টেনে আনা হলো। মুহাম্মদ তখন
একটি বাবলা গাছের ছায়ায়
বসে ছিলেন। মরুভূমি তখনই আদালত
চত্বরে পরিণত হলো এবং ক্ষতিগ্রস্থ
গোত্রের (নিহত
ব্যক্তির গোত্রের)
অসংখ্য
যাযাবররা শালিসটি দেখার জন্য
মুহাম্মদের সামনের সারিতে
পা ভাঁজ করে বসে রইল। সাক্ষীরা
উঠে দাঁড়িয়ে যা জানত তা তাকে
বললেন। মুহাল্লিমের গোত্রের
সদস্যরা তার গুণাবলী বর্ণনা
করে তার পক্ষ হয়ে ক্ষমা
প্রার্থনা করল;
আর
মৃত ব্যক্তির গোত্রের সদস্যরা
মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানাল।
মুহাল্লিমের গোত্রের একজন
হুমকি দিল যে,
তিনি
পঞ্চাশজন লোককে জোগাড় করে
নিয়ে আসবেন যারা শপথ করে বলবে
ঐ মৃত ব্যক্তি সত্যিকারের
বিশ্বাসী (মুমিন)
ছিল
না, সে
কখনও নামাজও পড়েনি -
এককথায়,
সে
ছিল মোনাফেক। এক্ষেত্রে তার
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না,
কারণ
কাফেরদের হত্যা করার জন্য
বিশ্বাসীদের হত্যা করা যায়
না, পরিস্থিতি
যাই হোক না কেন। মুহাম্মদ মৃত
ব্যক্তির পরিবারের জন্য
ক্ষতিপুরণ দেয়ার প্রস্তাব
দিয়েছিলেন এই বলে যে,
তারা
এক্ষুনি পঞ্চাশটি উট,
আর
বাড়ি ফিরে যাওরার পর আরও
পঞ্চাশটি উট পাবে। এটি ছিল
একজন কাফেরকে হত্যা করার
শাস্তি। তবে ভুক্তভোগীর পরিবার
রক্তের বদলে রক্ত দাবি করেছিল।
অভিযুক্তকে মুহাম্মদের সামনে
দাঁড়ানোর আহবান না করা পর্যন্ত
তিনি তার পেছনেই বসে ছিল। সে
ছিল বয়সে তরুণ,
লম্বা
এবং তার চোখে পানি ছিল। সে তার
অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইল।
মুহাম্মদ আকাশের দিকে হাত
তুললেন,
আকাশ
থেকে নির্দেশনা চলে এলো এবং
উচ্চস্বরে সবাইকে মুহাম্মদ
শুনিয়ে বললেন :
“আল্লাহ
তোমাকে ক্ষমা করবেন না!”
মুহাম্মদ তিনবার বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করলেন। এটি ছিল তার মৃত্যুদণ্ড, যার কোন পুনর্বিবেচনার সুযোগ ছিল না। দোষী লোকটিকে একটি পাহাড়ের শৃঙ্গ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো এবং পাথরের স্তূপের নিচে তাকে দাফন করা হলো (২৪)।
মুহাম্মদ ভিন্নমত বরদাশত করতেন না। কেবলমাত্র ঠাট্টা, তামাশা বা সমালোচনা করার জন্যও তিনি মানুষকে হত্যা করতেন, তবে তার নিকট আত্মসমর্পণ করলে বা ক্ষমা চাইলে ভিন্ন কথা। বদর যুদ্ধের পরে কবিদের হত্যা করার মধ্য দিয়ে তিনি হত্যালীলা শুরু করেন। এমনকি তার অনুসারীরা যখন তাদের নিজস্ব উদ্যোগে মুহাম্মদের সমালোচকদের লোকদের হত্যা করে ফেলত, তখন তিনি তা অনুমোদনও করতেন। ইতিহাসে মুহাম্মদের একজন অন্ধ সাহাবির (অনুসারী) একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে নিন্দা করার দোষে তার ইহুদি শয্যাসঙ্গিনীকে খুন করে ফেলে। সেই নারী প্রায়শই মুহম্মদের সমালোচনা করত, কিন্তু অন্ধ বর তাকে থামার নির্দেশ দেয়া সত্বেও এক রাতে সে মুহাম্মদের নামে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছিল। এর ফলে অন্ধ সাহাবি তার স্ত্রীকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এই কথা চারদিকে ছড়িয়ে পরে এবং পরদিন একটি মসজিদের সমাবেশে মুহাম্মদ অপরাধীকে উঠে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে বলেন। অন্ধ লোকটি দাঁড়িয়ে বলল, “আল্লাহর রাসুল! সে আপনাকে গালাগালি করত এবং আপনাকে অস্বীকার করত। আমি তাকে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু সে থামেনি। আমি তাকে ধমক দিয়েছি, কিন্তু সে অভ্যাসটি ছাড়েনি। তার গর্ভ থেকে মুক্তোর মতো আমার দুটি ছেলে পেয়েছি এবং সে আমার সঙ্গিনী ছিল। গতরাতে সে আপনাকে গালি দিতে থাকে এবং অস্বীকার করতে শুরু করে। তাই আমি একটি ছোরা নিয়ে তার পেটে ঢুকিয়ে দিই এবং মৃত্যু নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ছুরিটি চেপে ধরে রাখি”। মুহাম্মদ এই ব্যাখ্যাটা গ্রহণ করলেন। তিনি সমাবেশে বললেন, “সাক্ষ্য দাও, তার রক্তের জন্য কোনও প্রতিশোধ গ্রহণযোগ্য নয়”। এভাবেই তিনি এক নির্মম হত্যাকে বৈধতা দিলেন এবং এই বললেন যে, “আমার সমালোচনাকারীদের হত্যা করা বৈধ” (২৫, ২৬)।
আরবের অগ্রবর্তী ধর্ম হিসেবে মৃত্যুর আগে মুহাম্মদ জীবনের প্রায় সকল বিষয়ে বিধিবিধান তৈরি করে যান, যেমন : জায়গা জমির ব্যবসা, ঋণ দেয়া, উত্তরাধিকার, শেয়ার ক্রপিং, খেজুর, খেজুর গাছ এবং প্রাণীদের কেনাবেচা এমন সব বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দিতে থাকেন। কীভাবে মলত্যাগ করবে, কীভাবে ধোবে, কীভাবে পোশাক পরবে, কীভাবে মানুষকে সম্বোধন করবে, কী খাবে এবং কী খাবে না তিনি সে সমস্ত বিষয়ে তার নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। বিবাহ, জন্ম এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমস্ত কিছুই তার বিধিবদ্ধ নিয়মের স্বাক্ষর বহন করে। মিউজিক, গান গাওয়া এবং নাচকে অলস কার্যকলাপ হিসেবে তিনি নিষিদ্ধ করেছিলেন, কেননা এসব কিছু লোককে আল্লাহর পথ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। তিনি প্রার্থনার অনুষ্ঠান, তীর্থযাত্রা এবং পশু কুরবাণীর বিষয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন, এ সমস্তই ছিল ঈমানদার মুমিনের বিশ্বাসের পরিচায়ক। কোরআনের আয়াত এবং তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের রীতিনীতি তথা সুন্নাহ, এ দুটির সংমিশ্রণই মুহাম্মদের আইন হয়ে উঠল। মূলত, তিনি নিজে প্রতিটি পরিস্থিতিতে কী করেছিলেন, সেটি হতে পারে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা নিছক তার আচরণের উদাহরণ, তাইই সুন্নাহ। এই সংমিশ্রণটিকে তখন ডাকা হতো এবং আজও ডাকা হয় শরিয়া বা ‘পথের নির্দেশক' বলে। বিশ্বাস করা হয়, মুহাম্মদের আয়াতসমূহ আর তার দৈনন্দিন জীবনের উদাহরণ তথা সুন্নাহর দেখানো পথে চললে নিশ্চিত বেহেশত লাভ হবে।
খিঁচুনির
সময়কার সেই কাব্যিক আয়াতগুলো
লিপিবদ্ধ করে রাখার জন্য
মুহাম্মদ একজন লিপিকার নিয়োগ
করেন। তিনি ছিলেন অর্ধশিক্ষিত,
সম্ভবত
মৃগীরোগের সাথে সম্পর্কিত
dyslexia (লিখতে
ও পড়তে না পারার মতো এক ধরনের
স্নায়বিক অক্ষমতা)
এর
কারণে তার ভালোমত লেখাপড়া
শেখা হয়ে ওঠেনি। তবে তার অনেক
অনুসারীই শিক্ষিত ছিল,
আর
মুহাম্মদ তাদের সেই দক্ষতাকে
কাজে লাগিয়েছিলেন। গভীর
ঘুমের ঘোর থেকে বিছানায় জেগে
উঠে বা এক জায়গা থেকে আরেক
জায়গায় ভ্রমণের সময় মুহাম্মদ
যখন ওহী লাভ করতেন,
চিৎকার
করে বলে উঠতেন,
“এটি
লিখে নাও,
লিখে
নাও”। এরপরেই বিশ্বস্ততার
সাথে তার কথাগুলি লুফে নিয়ে
লিপিকার তার দোয়াত-কলম
হাতে নিয়ে কাব্যিক ঢংয়ে
আয়াতগুলো লিখে নিত। মক্কায়
তার তড়িঘড়ি করে নিয়ে আসা
ছোট ছোট ছান্দসিক আয়াতগুলোর
তুলনায় ইয়াছরিবে নাজিল করা
আয়াতগুলি অনেক বড়,
ঝাঁজালো
ও আইন সংক্রান্ত ছিল। যেমন
এই আয়াতে শপথ ভঙ্গ করার বিষয়ে
বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ তোমাদেরকে
পাকড়াও করেন না তোমাদের
অর্থহীন কসমের ব্যাপারে,
কিন্তু
যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে কর সে
কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াও
করেন। সুতরাং এর কাফফারা হচ্ছে
দশজন মিসকীনকে খাবার দান করা,
মধ্যম
ধরনের খাবার যা তোমরা স্বীয়
পরিবারকে খাইয়ে থাক,
অথবা
তাদের বস্ত্র দান করা,
কিংবা
একজন দাসকে মুক্ত করা। কিন্তু
যে সামর্থ্য রাখে না সে তিনদিন
রোজা রাখতে পারে। এটা তোমাদের
কসমের কাফফারা,
যদি
তোমরা কসম কর;
আর
তোমরা তোমাদের কসম হেফাযত
কর। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের
জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বর্ণনা
করেন যাতে তোমরা শোকর আদায়
কর।” (২৭)।
তার এক সাহাবি, এই আয়াতগুলো প্রস্ততির নাড়িনক্ষত্র টের পেয়ে ধর্মত্যাগ করে পালিয়ে গেলেন। তার পুরো নাম আবদুল্লাহ ইবনে সাদ ইবনে সারহ সংক্ষেপে আবদুল্লাহ সারহ। তিনি মক্কা থেকে এসেছিলেন এবং প্রথমদিকের ধর্মান্তরিত ছিলেন যিনি মুহাম্মদের সাথে ইয়াছরিবে পালিয়ে গিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন, পড়তে এবং লিখতে জানতেন, তিনি মুহাম্মদের অন্যতম প্রিয় সহায়ক হয়ে ওঠেছিলেন। তার দক্ষতা চিঠি লেখায়, সমঝোতা স্মারক তৈরিতে এমনকি চুক্তির প্রতিলিপি তৈরিতেও কাজে লাগত। কোরআন রচনার সময় মুহাম্মদ তাকে তার কাছে রাখতেন। বলা হয়ে থাকে যে, মুহাম্মদের আকস্মিক আয়াত বলে ওঠার সময়ে, আবদুল্লাহ মাঝে মাঝে শব্দের মাঝে কিছুটা পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিতেন। এমনই একদা মুহাম্মদ যখন “এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী” বলে একটি আয়াত শেষ করেছিলেন তখন আবদুল্লাহ সম্ভবত কাব্যগুণের কারণে বা কবিতার ছন্দ মেলাতে সেই স্থলে 'বুদ্ধিদীপ্ত এবং জ্ঞানবান' লেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ তার পরামর্শতে আপত্তি করেননি।
একপর্যায়ে আবদুল্লাহর কাছে এমন মনে হতো যেন একজন নিছক লেখকের কথা মুহাম্মদ আল্লাহর বাণী বলে দাবি করা করছে। মুহাম্মদের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকার কারণে তিনি মুহাম্মদের “ওহী” নাযিলের মুহুর্তগুলি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হতেন এবং এটি তাকে স্মরণ করিয়ে দিত, কিভাবে তার পরিচিত মক্কাবাসী কবিগণ তাদের কাব্য-প্রতিভার সর্বোত্তম প্রকাশের জন্য লড়াই করে যেত। তিনি উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি, এসেছে মুহাম্মদের কাছ থেকেই। তার বিশ্বাস ভেঙে যায়, তিনি পালিয়ে মক্কায় ফিরে যান এবং মুহাম্মদের সাথে আল্লাহ কথা বলে মুহাম্মদের এই দাবিকে অবান্তর বলে মক্কাবাসীদের সামনে হাসতে হাসতেই তিনি খারিজ করে দেন। তিনি বলেন “মুহাম্মাদ জানতেন না তিনি কি বলছেন! আসলে, আমি যা চাইতাম তার পক্ষ থেকে সেটাই লিখতাম। যা আমি লিখেছি, তা আমার কাছে নাজিল হওয়ার মতো, যেভাবে মুহাম্মদের কাছে নাজিল হতো (২৮)।
মুহাম্মদ
আবদুল্লাহকে অনন্তকাল আগুনে
পুড়িয়ে ফেলার চেয়েও বেশি
কিছু করেছিলেন। এর বছরখানেক
পরে যখন তিনি মক্কা বিজয়
করেছিলেন,
তখন
তিনি তার সাথে একটি তালিকা
রাখতেন যেখানে এমন লোকদের
নাম ছিল যাদেরকে তিনি দেখামাত্রই
হত্যা করতে চেয়েছিলেন। সেই
তালিকার শীর্ষে ছিলেন আবদুল্লাহ
ইবনে সাদ ইবনে আবি সারহ।