বদরের যুদ্ধের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিয়ে এবং একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ছিল মোহাম্মদের মেয়ে রুকাইয়ার জন্য। বদরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে রুকাইয়া অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার বর ও ভবিষ্যতের খলিফা উসমান বিন আফফান তার দেখাশোনার জন্য ইয়াছরিবে অবস্থান করেন। মোহাম্মদ যুদ্ধ থেকে ফিরে আসার আগে রুকাইয়া মারা যান, এবং জায়েদ যখন উটের পিঠে করে ইয়াছরিবের নিচু অংশে তাদের বিজয়ের সংবাদ নিয়ে আসছিলেন, তখন রুকাইয়ার কবরের মাটি সমান হয়ে গেছে। তিনি কিভাবে মারা গেছেন ইসলামের আদি গ্রন্থে তা নিয়ে কোন ইঙ্গিত নেই, কিন্তু জানা যায় যে, তার বয়স বিশের কোঠায় ছিল এবং তার কোন জীবিত সন্তান ছিল না। মক্কায় তার একটি ছেলে সন্তান হয়েছিল, কিন্তু বলা হয় যে একটি ঈগল পাখি সেই বাচ্চাটির চোখ উপরে ফেলে, যার ফলশ্রুতিতে বাচ্চাটি মারা যায়। মোহাম্মদ রুকায়ার কবরের গিয়ে শোকাহত হয়ে পড়েন এবং প্রার্থনা করেন। কয়েক মাস পরে, উসমান রুকাইয়ার বোন উম্মে কুলসুমকে (Umm Kulthum) বিয়ে করেন।
কিছুদিনের মধ্যে ৫৪ বছর বয়সী মোহাম্মদের সাথে উমরের মেয়ে হাফসার দ্বিতীয় বিয়েটি সম্পন্ন হয়, যখন হাফসার বয়স বিশ বছর এবং বিধবা ছিলেন। তিনি এবং তার স্বামী খুনাইস (Khunais) আবিসিনিয়া অভিবাসীদের মধ্যে ছিলেন এবং মোহাম্মদ ইয়াছরিবে আসার পর তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। খুনাইস বদরের যুদ্ধের কিছুদিন পরেই মারা যান, হয়ত যুদ্ধের ক্ষত থেকে কিংবা রোগে আক্রান্ত হয়ে। মোহাম্মদ এর কয়েক মাস পরে হাফসাকে বিয়ে করেন এবং তাঁকে মসজিদের পাশে নির্মিত একটি ছোট কক্ষে স্থানান্তর করেন। তিনিও সাওদা এবং আয়েশার সাথে একই গৃহে যোগ দেন। আয়েশার বয়স তখন প্রায় বারো বছর।
তৃতীয় বিয়েটি ছিল আলী ও মোহাম্মদের ছোট মেয়ে ফাতিমার মধ্যে। আলী ছিলেন চব্বিশ বছরের যুবক এবং ফাতেমা ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন-চার বছরের ছোট। তিনি বদরের যুদ্ধের ঠিক আগে ফাতেমাকে বিয়ে করার জন্য মোহাম্মদের অনুমতি চেয়েছিলেন, কিন্তু সে সময়ে তিনি ছিলেন অর্থবিত্তহীন মানুষ এবং ফাতিমাকে মোহরানা দেয়ার মতো কিছুই তার কাছে ছিল না। মোহাম্মদ আলীকে বলেছিলেন যে, আলী যদি ফাতিমাকে তাঁর যুদ্ধের বর্মটি দেন সেটাই যথেষ্ট রোমান্টিক হবে, যার মূল্য ছিল প্রায় চার দিরহাম। আসলে উদ্দেশ্যই এখানে মুখ্য। বর্মটি দেখতেও তেমন ছিল না। এটি একটি সস্তা হুটামি স্যুট যার মধ্যে একটি হুড পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল, যেটি থার্টি ফাইভ পাউন্ড লোহার চেইন দিয়ে বানানো হয়েছিল। এটিকে মরীচিকা থেকে দূরে রাখতে তেল মাখতে হতো, কিন্তু তেল দেয়ার পরও একটু ভিজে গেলে পোশাকে মরীচিকার দাগ লেগে যেত। তিনি এটা ফাতিমাকে দিয়েছিলেন, কিন্তু সম্ভবত আবু সুফিয়ানের কাফেলায় হামলার সময় আবার তিনি তা ধার নিয়েছিলেন।
বদর
থেকে ফিরে আসার পর আলী বিয়ের
প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁর
তলোয়ারটিতে তখন কুড়িটির
মত দাগ ছিল এবং যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে প্রাপ্ত গনিমতের মাল
ছিল তার গর্বের বিষয়। তিনি
পেয়েছিলেন দুটি উট এবং কিছু
অস্ত্র আর বর্ম। তবে এই আনন্দ
অনুষ্ঠানে কিছু ধাক্কা তাঁকে
পেতে হয়েছিল, যখন
হামজা তার গনিমতের মালও খেয়ে
ফেলেছিল। আলি চেয়েছিলেন
ইয়াছরিবের নিচু জলাভুমি
থেকে মিষ্টি গন্ধযুক্ত গুল্ম
নিয়ে আসতে, যা
কায়কার কলাকুশলীদের কাছে
বিক্রি করে তিনি টাকা সংগ্রহ
করতে পারবেন (১)।
তিনি যুদ্ধ থেকে গণিমতের মাল
হিসেবে প্রাপ্ত দুটি উটকে
ইয়াছরিবের এক ধর্মান্ধরিত
লোকের বাড়ির বাইরে বেঁধে
রেখেছিলেন, যে
ধর্মান্তরিত লোকটি হামজার
বিজয়ে আনন্দ আয়োজন করেছিলেন
। কিন্তু আলী যখন আরো গুল্ম
সংগ্রহ করতে নিচু ইয়াছরিবের
দিকে যান তারপর ফিরে এসে তাঁর
উটগুলোকে মৃত অবস্থায় দেখতে
পান। তাঁর উটগুলো শুধু মৃতই
ছিল না, তাদের
আসলে জবাই করা হয়েছিল। তাদের
পিঠের দিকের কুঁজটা কেটে ফেলা
হয়েছিল এবং তাদের কলিজাও
সরিয়ে ফেলা হয়েছে। হামজাকে
সন্দেহ করে আলী ছুটে যান
মোহাম্মদের কাছে। হামজা ছাড়া
আর কেউ এটা করতে পারত না,
আলী নিশ্চিত!
আলীর মাথা
খারাপের জোগাড় - এখন
কিভাবে তিনি তাঁর বিয়ের জন্য
টাকা তুলবেন?
আলী এবং জায়েদের পর মোহাম্মদ হামজার রঙ্গশালায় যান এবং দেখেন হামজা তার সুন্দরী ক্রীতদাসীকে পাশে বসিয়ে মদ্যপ হয়ে আছেন। ওখানে যাওয়ার পর জানা গেল এই তরুণী (দাসী) হামজার কানে ফিসফিস করে বলেছিল যে, উটের কুঁজের রোস্ট ছাড়া আর কিছুই তাঁকে (মেয়েটিকে) খুশি করতে পারবে না। কথা শুনে হামজা তড়িঘড়ি করে বাইরে গিয়ে হাতের কাছে যেই উট পায় সেটিকেই জবাই করে। সম্ভবত মদ্যপ থাকায় ঈর্ষান্তিত হয়েই সে উটটিকে আলীর মালিকানাধীন জেনেই হত্যা করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে এই, সবাই জানত যে আলী বদরের যুদ্ধে হামজার চেয়ে চারগুন বেশি মানুষ খুন করেছে, তবুও হামজা “সিংহ” নামে পরিচিত ছিল। সে হয়তো সিংহ ছিল, কিন্তু আলী এখন সিংহের রাজা ।
[কাব আশরাফ হত্যা। একজন ধনী ইহুদী সুগন্ধি ব্যবসায়ী কাব বিন আশরাফ মোহাম্মদের সমালোচনা করে কবিতা লেখার জন্য মোহাম্মদ তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। আশরাফ একটি দুর্গবেষ্টিত কক্ষে বাস করতেন এবং তাঁকে বাইরে আনতে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। মোহাম্মদের পাঠানো হত্যাকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন আশরাফের প্রতিপালিত ভাই আৰু নাইলা (Abu Naila) । তিনি খাবার কেনার জন্য টাকা ধার নেয়ার অজুহাতে আশরাফকে তার দুর্গের কক্ষ থেকে বের করে আনতে সক্ষম হন।]
মদ্যপ
থাকার কারণে হামজার চোখ ছিল
রক্তাক্ত, তিনি
অনুতপ্ত ছিলেন না। মোহাম্মদকে
দেখে হামজা তার দিকে তাকিয়েছিলেন
এবং মাদকতার ঢেঁকুর তুলে তাকে
বললেন, “তুমি
আমার বাবার দাস ছাড়া আর কিছুই
নও”। সম্ভবত মাতাল অবস্থায়
হামজা কি করতে সক্ষম তা জেনে
মোহাম্মদ সাবধানতা অবলম্বন
করে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলেন
(২)।
এই ঝামেলা সত্ত্বেও বিয়ের
অনুষ্ঠান এগিয়ে গেল। বিয়ের
উপহার হিসেবে, মোহাম্মদ
ফাতিমাকে একটি নরম গাউন,
একটি পানির
চামড়ার পাত্র, এবং
একটি মিষ্টি গন্ধের গুল্মে
ভরা চামড়ার বালিশ দেন,
এবং বিয়ের
ভোজের জন্য একটা ছাগলের ভুনা
বরাদ্দ ছিল। ইসলামের আদি
গ্রন্থে হামজা সেই বিয়ের
অতিথিদের মধ্যে ছিলেন কিনা,
তা উল্লেখ করা
হয়নি। আলী ও ফাতিমার দুই
সন্তান ছিল, হাসান
ও হুসাইন। তাদের পিতার মতো
তাঁরাও পরবর্তী সময়ে ইসলাম
ধর্মের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ
ভুমিকা পালন করেন এবং পরবর্তীতে
দুটো প্রধান দল সুন্নি এবং
শিয়ায় বিভক্ত হওয়ার জন্য
অনুঘটক হয়ে উঠেন। এই তিনটি
বিয়ে এবং আয়েশার সাথে
মোহাম্মদের বিয়ে করার ব্যাপারটা
কতিপয় শীর্ষ ব্যক্তিদের
সাথে মোহাম্মদের পারিবারিক
সম্পর্ককে আরো মজবুত করে তোলে।
এই ব্যক্তিরা ছিলেন আবু বকর
(Abu Bakr), আলী
(Ali), উমর
(Umar) এবং
উসমান (Uthman)।
পরবর্তীতে দেখা যাবে,
তারা প্রত্যেকেই
অবশেষে ধর্মের নেতৃত্ব গ্রহণ
করবে, এবং
আবু বকর বাদে সবাইকে হত্যা
করা হবে।
বদরের পরাজয় শুধু অভিজ্ঞ মক্কান নেতৃত্বকেই সরিয়ে ফেলেনি, ইয়াছরিবের পশ্চিমে আদিবাসী অঞ্চলের মধ্য দিয়ে সিরিয়া যাওয়ার ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য পথও এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, যা মক্কানদের জীবন ও জীবিকার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলীয় আদিবাসীদের সাথে মক্কানদের দীর্ঘদিনের চুক্তি ছিল, যার মাধ্যমে কাফেলা বাণিজ্য নিরাপদে যাতায়াত করতে পারত। মোহাম্মদ এইসব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে বৃদ্ধাগুলি দেখিয়ে উপকূলীয় আদিবাসীদের প্রলুব্ধ করেন, যদি তারা মক্কান কাফেলাদের সম্পর্কে তাকে সতর্ক করে দেয়, তাহলে গনিমতের মালের কিছু অংশ তাদেরও দেবেন। এই গোত্রের একজন সংবাদদাতাই মোহাম্মদকে উত্তর দিকে যাওয়া আবু সুফিয়ানের কাফেলা সম্পর্কে খবর দিয়েছিল এবং কাফেলা সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করার এই সময়ে আরেকটি আদিবাসী মোহাম্মদের গুপ্তচরদের আশ্রয় দিয়েছিল। বদরের বিস্ময়কর বিজয়ের মাধ্যমে মোহাম্মদ এখন ইয়াছরিব ও উপকূলের মধ্যবর্তী অবশিষ্ট আদিবাসীদের ভেতরেও জায়গা করে নিতে সক্ষম হন, এর মাধ্যমে তিনি কার্যকরভাবে লোহিত সাগরকেন্দ্রিক মক্কান বাণিজ্যপথ বন্ধ করে দেন।
উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করতে মক্কানরা পূর্ব ইয়াছরিবের মরুভূমির প্রধান যাযাবর আদিবাসীদের প্ররোচিত করে মোহাম্মদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে এবং একটি কুটনৈতিক প্রচারণা শুরু করে, এবং পূর্ব অঞ্চলের মধ্য দিয়ে একটি নিরাপদ কাফেলা পথও তাঁরা তৈরি করেন। তাঁরা মোহাম্মদকে শুধু মক্কাবাসীর জন্যই না বরং পুরো আরবের জন্যই বিপজ্জনক হিসেবে চিত্রিত করেন। আবু সুফিয়ানের কাফেলার বিরুদ্ধে মোহাম্মদের অভিযান সফল হবার পরে মক্কাবাসীরা পুর্বাঞ্চলের কিছু আদিবাসীকে ইয়াছরিব আক্রমণে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়, কিন্তু এবার মোহাম্মদ প্রাচীন এক পন্থা অবলম্বন করলেন।
যখনই
তিনি জানতে পারলেন তার বিরুদ্ধে
এ ধরনের প্রস্তুতি (রণপ্রস্তুতি)
নেয়া হচ্ছে
তিনি তখন আগেই আক্রমণ করার
জন্য একটি বাহিনী একত্রিত
করলেন এবং আক্রমণ করে বসলেন।
এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল যতটা
সম্ভব বেশি মানুষকে হত্যা
করা, চরম
রকমের ভাংচুর করা,
স্থানীয়দের
মূল্যবান গবাদিপশু লুট করা
এবং ত্রাস ছড়ানো। এমনই একটি
অভিযানের পর তিনি যখন জানতে
পারলেন যে, ইয়াছরিব
থেকে ষাট মাইল দক্ষিণের সুলাইম
বেদুইনরা (Sulaym Bedouins ) তার
বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনা
করছে তখনই মোহাম্মদ দুইশো
লোককে সঙ্গে নিয়ে তড়িৎ গতিতে
এগিয়ে যান। মোহাম্মদ বেদুইনদের
নিকটে আসার আগেই তাঁরা তাদের
পাঁচশত উট এক রাখাল বালকের
কাছেই রেখেই দিগ্বিদিক পালিয়ে
যায়। মোহাম্মদ সেই রাখাল
বালক এবং পাঁচশত উট সঙ্গে করে
নিয়ে আসেন। ইয়াছরিব ফিরে
গনিমতের মাল শহরের ঠিক বাইরে
ভাগ করে দেন। মোহাম্মদ তার
নিজ অংশ হিসেবে একশটি উট রাখেন
এবং তার অভিযানের সঙ্গীরা
প্রত্যেকে দুটি করে উট পান।
মোহাম্মদ মেষপালককে দুটো
পছন্দ দেন, হয়
সে ধর্মান্তরিত হবে নয়ত তার
মাথা হারাবে। রাখাল বালক
ধর্মান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল।
বদর
বিজয়ের চার মাস পর ইয়াছরিবের
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের
গাতফান যাযাবররা (Ghatafan
nomads ) মোহাম্মদের
পরবর্তী অভিযানের লক্ষবস্তুতে
পরিণত হয়। এই অভিযানের জন্য
মোহাম্মদ সাড়ে চারশত লোক
নিয়ে ইয়াছরিব ত্যাগ করেন,
কিন্তু এগারো
দিন পরে খালি হাতে ফিরে আসেন।
ইতিহাসে পাওয়া যায়,
তার আগমনের
খবর পেয়ে গাতফানরা আগেই
পাহাড়ের দিকে দৌড়ে পালায়
এবং তিনি চলে না যাওয়া পর্যন্ত
লুকিয়ে থাকে।
কাফেলা
আক্রমণের মধ্যে সবচেয়ে
উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল এমন –
তাঁরা যাত্রাপথে ছোট একটি
মক্কান কাফেলা আক্রমণ করেন,
যারা তখন তাদের
পূর্ববর্তী রুট ছেড়ে নতুন
করে ইস্টার্ন রুটে (পূর্ব
দিককার পথে) কাফেলা
পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
বদরের ছয়মাস পরে, মক্কানরা
উমাইয়া খালাফের ছেলে সাফওয়ানের
(Safwan) নেতৃত্বে
একলাখ দিরহাম মুল্যের পণ্য
বহনকারী একটি কাফেলা পাঠায়।
ধারণা করা হয় রৌপ্য মুদ্রাগুলো
কার্গোর অংশ ছিল, কিন্তু
সম্ভবত রৌপ্যমুদ্রাকে গলিয়ে
রূপার পাত বানিয়ে সিরিয়ার
শোধনাগারগুলোর কাছে তাঁরা
বিক্রি করতে চেয়েছিল (৩)।
সাফওয়ান তাদেরকে অচেনা এলাকার
মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার
জন্য একজন পথপ্রদর্শক ভাড়া
করেছিল। কাফেলাটি সিরিয়ায়
ঠিকই যেতে পারত যদি না একজন
ঠোঁট পাতলা মক্কান ব্যবসায়ী
ইয়াছরিব ভ্রমণ করতেন এবং এই
বিষয়ে কথা না বলতেন। এই মক্কান
লোকটি নাদির গোত্রের কিনানা
(Kinana) নামের
এক রাব্বির দুর্গে এক সন্ধ্যা
অতিবাহিত করেন। তিনি যখন
অন্যান্য অতিথিদের সাথে খাবার
খাচ্ছিলেন ঠিক তখনই মুখ ফস্কে
মক্কানদের সম্পত্তি এবং কাফেলা
নিয়ে কথা বলে ফেলেন। কিনানা
বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ছিলেন,
কিন্তু সেখানে
থাকা একজন অতিথি বিশ্বাসযোগ্য
ছিল না। সেই লোকটি দৌড়ে মসজিদে
গিয়ে মোহাম্মদকে এই কাফেলার
কথা জানায়। মোহাম্মদ কালবিলম্ব
না করেই ১০০ জনের একটি বাহিনী
একত্রিত করেন আক্রমণের জন্য,
এবং তাঁর পালক
পুত্র জায়েদকে সেই বাহিনীর
সেনাপতি করেন।
জায়েদ কাফেলাটিকে পথিমধ্যে আটকে দিল। সঙ্গে থাকা সেই পথপ্রদর্শক ছাড়া কাফেলার সকল সদস্য পালিয়ে যায়, আর পণ্যবোঝাই উট এবং তাদের মালপত্র হামলাকারীদের হাতে পড়ে যায়। জায়েদ লুটের মাল সব ইয়াছরিবে ফিরিয়ে আনেন এবং মোহাম্মদ উল্লসিত হয়ে মসজিদের উঠোনেই তা বিলিবন্টন করে দেন। প্রায়ই মোহাম্মদ বিবিধ লুটের মাল স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে নিলামে উঠাতেন এবং তারপর যারা ঝুঁকি নিয়ে এই অভিযান চালাতেন তাদের মধ্যে স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রাগুলো ভাগ করে দিতেন। এই লুটের জন্যও, সম্ভবত তিনি একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন; যেমন তাঁর নিজের জন্য এক পঞ্চমাংশ, সেই হিসেবে তিনি বিশ হাজার দিরহাম রেখেছিলেন। আগের অভিযানের সময় ধরা পড়া মেষপালকের সাথে তিনি যেমন করেছিলেন, এই পথপ্রদর্শকের সাথেও একই আচরণ করেছিলেন। তাঁকে ধর্মান্তরিত হওয়া বা মৃত্যু এ দুটির মধ্যে যেকোনো একটিকে বেছে নেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। এক্ষেত্রে সেও ধর্মান্তরিত হবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছিল যে, মক্কান ও মোহাম্মদের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে এবং সমস্ত আরবরা তা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছিলে। একদিকে মোহাম্মদের রাস্তা অবরোধ এবং অন্যদিকে মক্কান কাফেলার উপর উপর্যপুরি হামলা মক্কানদের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছিল।
মক্কাবাসীদের
শস্য এবং অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য
কেনার প্রয়োজন ছিল, এবং
শুধুমাত্র তাদের বাণিজ্য
মিশন থেকে প্রাপ্ত মুনাফার
অর্থ দিয়েই তাঁরা খাদ্যশস্য
কিনতে পারত। তাদের উত্তর দিকের
বাণিজ্য পথ একেবারে কেটে ফেলা
হয়েছে, আর
যা মুলধন ছিল খাদ্যের ক্রয়ে
তাও তাঁরা খরচ করে ফেলল।
সাফওয়ানের কাফেলা ডাকাতি
হবার পর মক্কানরা আর্থিকভাবে
যে বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল
সেটিকে অস্বীকার করার উপায়
নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ঝুঁকির
চাইতে তাদের প্রাণের ঝুঁকিটাও
এখন নেহাত কম না। আরবদের মধ্যে
মক্কার লোকদের অবস্থান নড়বড়ে
হয়ে গিয়েছিল, এবং
পৌত্তলিক সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু
হিসেবে তাদের জীবনযাত্রাও
হুমকির মুখে পড়েছিল।
বদর যুদ্ধে পরাজয়ের পর আবু সুফিয়ানের কাফেলা মক্কায় ফিরে আসার পরপরই নতুন এক যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। মক্কানরা তাদের ব্যবসায়িক মুনাফার ভাগবাটোয়ারার একটি অংশ দিয়ে নতুন একটি সেনাদল সজ্জিত করার ব্যাপারে একমত হয়। পরবর্তী বারোমাস ধরে এই প্রস্তুতি চলতে থাকে যেন পরের বছরের মার্চ মাসের মধ্যেই আবু সুফিয়ারের নেতৃত্বে ইয়াছরিবের উপর হামলা চালাতে পারে। এটা বদরে পাঠানো সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। তিন হাজার সৈন্য, তীক্ষ্ণ তলোয়ার এবং বর্শা তৈরি করা হয়েছে। শক্ত কাঠের ধনুক, ধারালো পিতলের মাথা সহ প্রচুর তীর এবং ছুরি এবং আংটা তৈরি করা হয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনী এবং সামনের সারির যোদ্ধারা যুদ্ধের পোশাক এবং চামড়ার বর্ম সেলাই করা ধাতব পাতের বর্ম বানিয়ে নিয়েছিল। এই বাহিনী মক্কান এবং তাদের আঞ্চলিক মিত্রদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তায়েফের ছাকিফ গোত্র তাদের তিনশত যোদ্ধা সরবরাহ করে। এছাড়া মক্কার আশপাশের বিভিন্ন বেদুইন আদিবাসীরা আরো শতশত যোদ্ধা সরবরাহ করে এবং আবিসিনিয়ান ভাড়াটেদের একটি দলকেও প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য তৈরি রাখা হয়। ডজনখানেক ক্রীতদাস, যাদের ভূমিকা ছিল ক্যাম্পের জন্য তাঁবু খাটানো, প্রয়োজনে তাঁবু ভেঙ্গে ফেলা, আনুষঙ্গিক কাজকর্মে সাহায্য করা ও বাহিনীর সাথে থাকা।
ক্রীতদাসদের মধ্যে একজন ছিলেন ওয়াহশি (Wahshi) নামের একজন আবিসিনিয়ান, যিনি বর্শা ছুঁড়ে মারার দক্ষতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। মোহাম্মদকে তায়েফ থেকে পালিয়ে আসার পর সুরক্ষা দানকারী মক্কান এক নেতার পুত্র জুবায়ের বিন মুতিম (Jubayr ibn Mutim) ওয়াহশিকে বলেছিলেন, তিনি যদি হামজাকে হত্যা করতে পারেন তাহলে তাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা হবে। বদরে হামজা জুবায়েরের চাচা তুয়াইমাকে (Tuayma) হত্যা করেছিল, জুবায়ের এর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ তার প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেছিল, “যাও আবু দাসমা (Abu Dasma), আমাদের হয়ে প্রতিশোধ নাও এবং নিজের দিকে খেয়াল রেখো” (8) ।
যখন সেনাদল বেরিয়ে পড়ল মক্কার সমগ্র জনতা তখন তাদের জন্য উল্লাস করতে লাগল। কিছু যোদ্ধা আল-উজ্জা এবং হুবাল দেবতার মূর্তি খুঁটিতে বেঁধে তা বহন করে চিৎকার করে বলতে লাগল, “আল-উজ্জার গৌরব! হুবালের গৌরব!” অন্যরা তাদের গোত্রীয় ও বংশীয় যুদ্ধপতাকা বহন করছিল। সেনাদল আস্তে আস্তে আগাতে থাকল, আর তাদের সাথে হাতির পিঠে ছিল দুই ডজন নারী - কয়েকজন যোদ্ধার স্ত্রী, মা এবং কন্যা। সেনাদল শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নারীরা খঞ্জনি বাজিয়ে তাদের জয়গান গাইতে থাকে।
মোহাম্মদ
তার চাচা আব্বাসের মাধ্যমে
সেনাদলের মক্কা ছাড়ার কথা
জানতে পারেন। আব্বাস ছিলেন
মোহাম্মদের মক্কার খবর প্রাপ্তির
চোখ ও কান। বদরে বন্দি হবার
পর আব্বাস নিজেকে একজন সত্যিকারের
বিশ্বাসী হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন,
কিন্তু ইয়াছরিবে
না থেকে তিনি মক্কায় ফিরে
গিয়েছিলেন। তিনি অর্থনৈতিকভাবে
মক্কার সাথে এত ওতপ্রোতভাবে
জড়িত ছিলেন যে, তার
পক্ষে সবকিছু ছেড়ে চলে আসা
সম্ভব ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে,
তিনি মুক্তিপণের
জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রদান
করেছিলেন আর সেজন্য মক্কাবাসীরাও
বিশ্বাস করে ফেলে যে,
আব্বাস মক্কার
অনুগত। পক্ষান্তরে আব্বাস
মোহাম্মদকে সাধারণভাবে
মক্কাবাসীদের কার্যকলাপ এবং
বিশেষ করে যুদ্ধের প্রস্তুতি
সম্পর্কে জানাতে শুরু করেন।
মক্কান সেনাদল শহর থেকে রওনা
হওয়ার ঠিক আগেই আব্বাস একজন
বেদুইনকে বেশ অর্থকড়ি দিয়ে
একটি গুপ্ত চিঠি মোহাম্মদকে
পৌঁছে দিতে বলেন, যেখানে
তিনি ঐ সেনাদলের শক্তি এবং
নেতৃত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত
বিবরণ প্রদান করেন। বেদুইনটি
কুবার উচ্চভূমির মসজিদে (মসজিদ
আল কুবা) দেখা
করে মোহাম্মদের হাতে চিঠিটি
তুলে দেন, যেখানে
একজন শিক্ষিত বিশ্বাসী তাঁর
কাছে তা পাঠ করে শোনান। মোহাম্মদ
এই বিষয়ে নিরব থাকার আদেশ
দেন যতক্ষণ না তিনি সিদ্ধান্ত
নিতে পারেন কি করতে হবে,
কিন্তু ইয়াছরিবের
কেন্দ্রস্থলে যে প্রধান মসজিদ
ছিল সেখানে ফিরতে না ফিরতেই
সংবাদটি ছড়িয়ে পরে।
সবাই বিতর্ক জড়িয়ে পড়ল কিভাবে মক্কানদের মুখোমুখি হতে হবে। আবদুল্লাহ বিন উবাই প্রথম উপদেশটি প্রদান করেন, এই সেই লোক যিনি এক বছর আগে কায়কা ইহুদিদের গণহত্যা থেকে বাঁচাতে মোহাম্মদের সাথে কথা বলেছিলেন। উবাই মসজিদের সমাবেশে হাজির হলেন এবং মোহাম্মদ তাঁকে কথা বলার অনুমতি দিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে এই বলে মত দিলেন যে, “ইয়াছরিবকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে নিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয়”। তিনি দেখিয়েছেন যে, সুদুর অতীতের যখনই ইয়াছরিবীরা আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে গেছে তখনই তারা হেরে গেছে। বরঞ্চ যখন তারা রক্ষণাত্মক যুদ্ধ করেছে তখনই সফল হয়েছে। তারা তাদের ভবনগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য চারপাশে দেয়াল তৈরি করেছিল যাতে ইয়াছরিবে সবদিক থেকে দুর্গের মতো প্রাচীর গড়ে ওঠে। শত্রুপক্ষ যখনই তা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছে তখনই ছাদ থেকে তীর ছুঁড়ে তাদের হটিয়ে দিত, আর শহরে ঢুকে গেলে তলোয়ারধারীরা রাস্তায়ই তাদের শেষ করে দিত।
উবাই যুক্তি দেখিয়ে বলেন, আমাদের উচিত পূর্বপুরুষদের উদাহরণ অনুসরণ করা। মোহাম্মদও তাতে একমত হন, কারণ তিনিও একটি স্বপ্নে দেখেছিলেন যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিল যে তাঁর সামনে বিপদ আছে এবং ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করা তাঁর পক্ষে অনুকুল হবে না। উমর এবং তাঁর দলের অভ্যন্তরীণ অন্যান্যরাও একমত হয়েছেন, কিন্তু কিছু পদমর্যাদা সম্পন্নরা একমত হতে পারেননি। বেশ কয়েকজন লোক মোহাম্মদের পায়ে পড়ে যুক্তি দেখায় যে, যদি তাঁরা দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে থাকে তাহলে তাদের দুর্বল এবং কাপুরুষ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। মক্কাবাসীরা বাইরের এলাকা লুট করবে, তাদের খেজুর গাছ ও ক্ষেত পুড়িয়ে ফেলবে এবং ভবিষ্যতে তাদের আবার আক্রমণ করতে উৎসাহিত হবে। বাইরে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ শক্তি দেখিয়ে তাদের মুখোমুখি হতে হবে। অন্যরা তার কাছে করজোড়ে আবেদন জানায়, মোহাম্মদ যেন এইরকম যুদ্ধ করার সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত না করে, যা তাদের শহীদ হবার সুযোগ করে দেয় যে বিষয়ে মোহাম্মদ তাদের বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
মোহাম্মদ প্রতীকীভাবে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আবু বকর ও উমরকে নিয়ে তিনি প্রার্থনা মঞ্চের পিছনের ঘরে ফিরে গেলেন এবং তাদের সাহায্য নিয়ে তিনি তার বর্ম (যুদ্ধপোশাক) পরিধান করলেন। যখন তিনি তার প্রার্থনার জায়গায় ফিরে এলেন, তখন তিনি একজন যোদ্ধা হয়ে ফিরে এলেন এবং তা ইঙ্গিত দিল যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মক্কানদের মোকাবেলা করতেই যাচ্ছেন। কিছু অনুসারী যারা কিছুক্ষণ আগেও যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানিয়েছে, এখন তারা অনুতপ্ত হচ্ছেন। কারণ তারা দেখেছে যে, তারা তাদের প্রিয় নেতাকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তারা তাকে পিছনে থাকতে অনুরোধ করে, কিন্তু উত্তরে মোহাম্মদ বলেন, "যে নবী তার বর্ম পরেছেন, তার পক্ষে যুদ্ধ না করে ঘরে বসে থাকা সমীচীন হবে না”(৫)।
মক্কান সেনাবাহিনীর ইয়াছরিব পৌঁছাতে দশদিন লেগেছিল। মোহাম্মদ তাদের গতিবিধির উপরে নজরদারি করার জন্য গুপ্তচর পাঠান, এবং তাদের মধ্যে দুজন মক্কান বাহিনীতে অনুপ্রবেশ করতেও সক্ষম হয়। গোয়েন্দারা মক্কানদের সাথে উহুদ পর্বতের পাদদেশ থেকে শিবির পর্যন্ত ছিল, যা ইয়াছরিব উপত্যকার উত্তর প্রান্তে আটকে ছিল। আবু সুফিয়ানের উত্তর দিক দিয়ে প্রবেশ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, কারণ উপত্যকাটি অন্য যেকোন দিক থেকে অপ্রতিরোধ্য ছিল। পাহাড় এবং লাভাক্ষেত্র এমনিতেই প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল। তার সাথে ছিল ভবন এবং ঘন খেজুরের বাগান যেগুলো আরো বেশি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। উপত্যকার পশ্চিম পার্শ্বে লাভাক্ষেত্রের ভিতর, যেটা উহুদ পর্বতের পাদদেশে বয়ে সমতল সমভূমিতে ঠেকে, আর যেখান দিয়ে কাফেলা যাওয়া আসা করত, আবু সুফিয়ান তার বাহিনীকে সেদিক দিয়ে নিয়ে যায়।
মোহাম্মদ সাতশত লোকের একটি শক্তিশালী বাহিনী একত্রিত করতে সক্ষম হন। আরও তিনশত যোদ্ধা আবদুল্লাহ বিন উবাইর অধীনে ছিল। দুই বাহিনী পৃথকভাবে তৈরি হয়, কিন্তু একত্রিত হয়ে উপত্যকার উত্তর প্রান্তে যোগ দেয়। মোহাম্মদের তখনও কোন পরিকল্পনা ছিল না। উত্তরের শেষ বসতি ছিল দুই স্তম্ভবিশিষ্ট শায়খাইন (Shaykhayn) নামের একটি দুর্গ। একটি স্তম্ভ থেকে মোহাম্মদ চারপাশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং উহুদ পর্বতের দিকের ভূখণ্ড দেখতে সক্ষম ছিলেন। দুর্গের ওপারের মাটি সমতল ও বন্ধ্যা ছিল। তার মধ্য দিয়ে একটা শুকনো নদীতট বয়ে গেছে। বদরের মত এইখানে পাথর ছিল না, যার মানে মক্কানরা তাদের অশ্বারোহী বাহিনীর পূর্ণ ব্যবহার করতে সক্ষম হবে। তিনি আব্বাসের চিঠি এবং তার গুপ্তচরদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, মক্কাবাসীরা তাদের সঙ্গে দু'শত ঘোড়া নিয়ে এসেছে। সুতরাং শায়খাইন বসতির এলাকা জুড়ে তার যুদ্ধের সারি গঠন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ এটি অবস্থিত ছিল ইয়াছরিবের স্বল্প জনবহুল প্রান্তে এবং চারপাশে খোলা জমি দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। সেখানে থাকলে তাকে চারপাশ দিয়ে তীরন্দাজদের আক্রমণের করার ঝুঁকি থেকে যাবে। সমভূমি থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে, উহুদ পর্বতের পাদদেশ। একমাত্র প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান হতে পারে শায়খাইনের সোজা উত্তরে, যেখানে সাগরের তীরে পাথুরে দ্বীপের মত উহুদ পর্বত ভিতরের দিকে বেশ বাঁক নিয়েছে। মোহাম্মদ এটাকে লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত অবস্থান হিসেবে বেছে নিলেন। যদি মোহাম্মদ সেই পাহাড়ের বাঁক ঘেঁষে তার সেনাবাহিনীকে অটসাঁট রেখা তৈরি করে সন্নিবেশ করতে পারেন তাহলে তিনি পাহাড়কে পিছনে নিরাপত্তা হিসেবে পাবেন। আর সেটা তাঁকে প্রতিপক্ষের তীর আক্রমণের হাত থেকেও বাঁচাবে।
তিনি যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখন আবদুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশত সৈন্য নিয়ে ফিরে চলে যায়, ফলে মোহাম্মদ মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছিলেন। উবাই মোহাম্মদকে একজন আইনজীবীর মত ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন: মোহাম্মদ ইয়াছরিবে আসার কয়েকদিন পর তার সাথে মোহাম্মদের চুক্তি হয়েছিল, তা ছিল যদি ইয়াছরিব আক্রান্ত হয় তবে একে অন্যকে সাহায্য করবে, যেটা ছিল পারস্পরিক সুরক্ষা চুক্তি। কিন্তু যে মুহূর্তে মোহাম্মদ শায়খাইনের বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সেই মুহূর্তে তিনি ইয়াছরিবের বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাই সৈন্যরা ইয়াছরিব সীমানার বাইরে যুদ্ধ করতে বাধ্য নয়, কারণ তখন সেটি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠবে। রক্ষণাত্মকভাবে যুদ্ধ না করার জন্য তার উপদেশ মোহাম্মদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আর তাই উবাই তার সৈন্যদের জন্য এমন ঝুঁকি নেয়াটা উচিত মনে করছেন না। উবাই কোন কারণ খুঁজে পেলেন না যে, কেন তার উত্তম উপেক্ষা করা হয়েছে! মোহাম্মদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “আমরা তাকে ছাড়াই করতে পারি”। বদরের মত মোহাম্মদও তার সুবিধার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র গঠন করেন। শায়খাইন দুর্গের পশ্চিমে এক মাইলেরও কম দূরে মক্কান বাহিনী তার গতিবিধির উপর কড়া নজর রেখেছিল, কিন্তু এখনো তারা মুখোমুখি হওয়ার জন্য অগ্রসর হয়নি। কিন্তু মোহাম্মদের বাহিনীর সেই যুদ্ধমুখে আসতে বেশি সময় লাগেনি। তিনি দ্রুত তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে সোজা দাঁড়াতে বললেন, কিন্তু দেখলেন যে তার বাম পাশ ঢেকে রাখার মত যথেষ্ট লোকবল নেই, যার ফলে তার অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার সময় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থেকে যায়। তাই তিনি পঞ্চাশজন তীরন্দাজকে বিস্তৃত পাহাড় থেকে আরেকটি ছোট পাহাড়ে পাঠালেন এবং তাদের কঠোর আদেশ দিলেন: "আপনারা সেখানে থাকুন এবং আমাদের পিছনে পাহারা দিন। আপনারা যদি দেখেন যে আমরা গনিমতের মাল সংগ্রহ করছি, তা হলেও আমাদের সাথে যোগ দেবেন না, এবং যদি আমাদের নিহত হতে দেখেন, তাহলেও আমাদের সাহায্য করতে আসবেন না” (৬)।
মক্কাবাসীরা শীঘ্রই মোহাম্মদের সারিবদ্ধ সৈন্যদের বিপরীতে নিজেদের সাজানো শুরু করে। আবু সুফিয়ানের সৈন্যরা মোহাম্মদের চেয়ে চারগুন বেশি ছিল, তার একজনের বিপরীতে চারজন সৈন্য ছিল এবং তারা খালি পায়ে, উটের পিঠে এবং ঘোড়ার পিঠে সারিবদ্ধ হয়ে যুদ্ধের জন্য একটি শক্তিশালী প্রাচীর নির্মাণ করেছিল। হিন্দ এবং অন্যান্য মক্কান নারীরা রণবাদ্য বাজিয়ে বদরে নিহত আত্মীয়দের জন্য প্রতিশোধ নেয়ার জন্য চিৎকার করতে থাকে।
এসবের
বিপরীতে মোহাম্মদের অনুসারীদের
উৎসাহ ছিল চরম পর্যায়ে।
মক্কাবাসীদের কেউই মৃত্যু
কামনা করেনি, কিন্তু
মোহাম্মদের অনুসারী মুমিনদের
মাঝে সবচেয়ে গোঁড়ারা মৃত্যুর
জন্য প্রস্তুত ছিল এবং তাই
মৃত্যুর আগে যত বেশি সম্ভব
অবিশ্বাসীকে হত্যা করতে
উদগ্রীব ছিল। সেদিন মোহাম্মদের
যুদ্ধের আর্তনাদ ছিল,
“হত্যা করো,
মেরে ফেলো”
(৭)।
এবং এ ব্যাপারে তিনি একেবারেই
আপোষহীন ছিলেন। এই হত্যাযজ্ঞকে
উৎসাহিত করার জন্য তিনি বদর
থেকে প্রাপ্ত ধারালো এক তলোয়ার
তার একজন অনুসারীর হাতে তুলে
দেন এবং বলেন, “যতক্ষণ
না তা ভেঙ্গে যায় ততক্ষণ
তাদের মুখে আঘাত কর”। তলোয়ার
নেয়ার পর লোকটি তার যুদ্ধের
শিরস্ত্রাণের উপর ‘মৃত্যুর
পাগড়ি' বলে
পরিচিত লাল পাগড়ি পেঁচিয়ে
মোহাম্মদের সৈন্যদের সারির
সম্মুখে বুক ফুলিয়ে আসা
যাওয়া করতে থাকে এবং মক্কানদের
দেবতাদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে
শুরু করে (৮)।
বদর যুদ্ধের মতই এই যুদ্ধের শুরু দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের মাধ্যমে হয় এবং বদরের মতই, আলী ও হামজা যে সমস্ত মক্কানদের একা মুখোমুখি হয়েছে তাদেরকেই হত্যা করে ফেলে। প্রতিটি হত্যার সাথে সাথে মোহাম্মদ “আল্লাহু আকবর" বলে চিৎকার করতে থাকেন, এবং তার সাথে সাথে পুরো সেনাদল সেটি বারংবার আওড়াতে থাকে। এরপর যেই দুই পক্ষ একে অপরের দিকে অগ্রসর হলো সাথে সাথে তারা একে অন্যকে লক্ষ করে তীর ছুঁড়তে লাগল। মুখোমুখি যুদ্ধ একপর্যায়ে হাতাহাতি লড়াইয়ে রূপ নিলে যোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা গেল। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ যখন তুঙ্গে তখন মক্কানরা তাদের নেতা ওয়ালিদের পুত্র খালিদের নেতৃত্বে মোহাম্মদের বাম দিকে আক্রমণ করে, কারণ সেই পাশটি ছিল উন্মুক্ত। কিন্তু পাহাড়ের চুড়ায় থাকা মুহম্মদের তীরন্দাজরা তীর ছুঁড়ে কিছু ঘোড়া এবং তাদের আরোহীদের নামিয়ে নিয়েছিলেন। মোহাম্মদ শত্রুদের পতাকাগুলোকে নিশানা করেন, সেগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন; যতক্ষণ সেগুলোকে উপরে তুলে ধরে রাখা হবে, বুঝে নিতে হবে যে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। যুদ্ধের শুরুতে জুবায়ের মক্কান যোদ্ধার উটের উপর ঝাঁপিয়ে উঠে, তাকে মাটিতে ফেলে দেয়, তারপর উট থেকে লাফ দিয়ে নেমে তাকে হত্যা করে। মোহাম্মদ, যিনি পঞ্চাশ গজের বেশি দুরত্বে থেকে এই দৃশ্য দেখছিলেন, তিনি তার অনুসারীদের কানে পৌঁছে দেয়ার মতো জোরে জোরে চিৎকার করে বলেন : “প্রত্যেক নবীরই শিষ্য আছে, আর আমার শিষ্য হচ্ছে জুবায়ের!” (৯)
হামজা
যখন যুদ্ধের একেবারে মাঝখানে
এবং সে বুঝতে পারেনি তাকে পিছন
দিক থেকে ঘিরে ফেলা হচ্ছিল।
হামজাকে সিংহের মত শিকার করার
জন্য জুবায়ের বিন মুতিম
কর্তৃক নিযুক্ত আবিসিনীয়
ক্রীতদাস ওয়াহশিকে পাঠানো
হয়েছিল। হাতে বর্শা নিয়ে
সে সিংহের মত শিকার ধরতে ওঁৎ
পেতে ছিল। হামজা এক মক্কানের
দিকে তলোয়ার চালাতেই ওয়াহশি
শিকারের কাছাকাছি চলে আসে।
হামজা তার দিকে ফিরতেই আবিসিনীয়
দাস ওয়াহশি তার দিকে বর্শা
ছুঁড়ে মারল। বর্শাটি হামজার
পেট কেটে লেজের মত তার নিচের
পিঠ দিয়ে বেরিয়ে এলো। হামজা
ওয়াহশির দিকে বেশ কয়েক ধাপ
এগিয়ে গেলেন ঠিকই, কিন্তু
তারপর পাশ ফিরে পড়ে গেলেন
এবং প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মারা
গেলেন। অভিযান সম্পন্ন হয়,
ওয়াহশি হিন্দের
কাছে তার সাফল্যের কথা জানান
এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মুক্ত
হয়ে ফিরে যান (১০)।
মোহাম্মদের
সৈন্যরা মক্কান পতাকা বাহকদের
উপর হামলা চালিয়ে যায়। সব
মিলিয়ে নয়জনকে হত্যা করা
হয়েছে। শেষের জন ছিল একজন
ক্রীতদাস, যে
মক্কান পতাকা উঁচু করে ধরে
রেখেছিল যতক্ষণ না তার কপাল
কেটে ফেলা হয়। তার মৃত্যু
ঘটে যখন মোহাম্মদের সবচেয়ে
হিংস্র যোদ্ধাদের একটি দল
মক্কান বাহিনীর সাথে ধস্তাধতি
করে তাদের শিবিরে ঢুকে নারীদের
ছত্রভঙ্গ করে। আবু সুফিয়ানের
স্ত্রী হিন্দ এবং অন্যান্য
মক্কান নারীরা তাদের পরিধেয়
স্কার্টের প্রান্ত ধরে দ্রুত
পাহাড়ের দিকে দৌড়ে পালাতে
সক্ষম হন। যখন তারা দেখল যে
তাদের সারি ভেঙ্গে গেছে এবং
তাদের পতাকা পড়ে গেছে,
তখন মক্কানরা
আতঙ্কিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র
থেকে পালিয়ে যায়। তাদের
তাড়া করার বদলে মোহাম্মদের
অনুসারীদের মধ্যে কম
প্রতিশ্রুতিবদ্ধরা মক্কান
শিবিরের দিকে দৌড়ে গনিমতের
মাল দখল করে নেয়। মোহাম্মদের
তীরন্দাজরা এই কর্ম দেখছিল,
এবং যখন তারা
দেখল তাদের নিজস্ব লোকজন
লুটপাটের জন্য দৌড়ে যাচ্ছে,
দশজন তীরন্দাজ
ছাড়া সবাই তাদের অবস্থান
ছেড়ে পাহাড়ের নিচে ঝাঁপিয়ে
পড়ল গনিমতের মালের ভাগ নিতে,
যাতে তাদের
ভাগে মাল কম না পড়ে। এটা ছিল
একটা মারাত্মক ভুল! একশো
অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে
ছিলেন খালিদ এবং আরও একশত
অশ্বারোহী বাহিনীর নেতৃত্বে
ছিলেন আবুল হাকামের পুত্র
ইকরিমা (Ikrima), তারা
পাহাড়ের চূড়ায় আক্রমণ করে
বসেন। তারা সেখানে অবশিষ্ট
তীরন্দাজদের হত্যা করে এবং
পিছন থেকে মোহাম্মদের সৈন্যদের
আক্রমণ করেন।
দুর্ধর্ষ এই অশ্বারোহী বাহিনী যুদ্ধের প্রকৃতি বদলে দেয়। মক্কী সৈন্যদের অশ্বারোহী বাহিনীর লাঠি এবং তলোয়ার দ্বারা মোহাম্মদের লোকেরা মারা পড়ছিল। এখন মুমিনদের পালানোর পালা, তাদের অধিকাংশই দক্ষিণের পথ দিয়ে পালিয়ে ইয়াছরিবের দিকে যাচ্ছিল। জুবায়েরের মা সাফিয়া ছিলেন অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন যারা পিছু হটতে অস্বীকার করে। তিনি পলায়নরত মোহাম্মদের অনুসারীদের দিকে একটা বর্শা তাক করে এই পালানোর স্রোত উল্টা পথে নিতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। যখন জুবায়ের তার কাছে দৌড়ে এসে বলল, “মা, ফিরে এসো! ফিরে এসো!” তখন তিনি তার ছেলের দিকে বর্ণা তাক করে বললেন, “আমার কাছ থেকে দুরে সরে যাও! তোমার কোন মা নেই!”(১১)
তীরন্দাজরা
তাদের অবস্থান ধরে রাখতে
ব্যর্থ হওয়ায় মোহাম্মদের
জীবন প্রায় বিপন্ন হয়ে
পড়েছিল। মক্কানদের আক্রমণে
তিনি এবং একদল যোদ্ধা অন্যদের
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
জীবনের ভয়ে চিৎকার করে তাকে
রক্ষা করতে বললেন, “কেউ
কি আমাকে রক্ষা করার জন্য
নিজেকে উৎসর্গ করবে যার বিনিময়ে
সে পরকাল পেয়ে যাবে?”
(১২) পালিয়ে
যাওয়া লোকদের অনেকেই আতঙ্কে
ছিল এবং তারা ছুটে যাওয়ার
সময় তাকে উপেক্ষা করে নিরাপত্তার
জন্য কাছাকাছি একটি খাঁড়ির
কাছে চলে আসে। তবে অন্যরা তার
চারপাশে জড়ো হয় এবং মৃত্যুর
সাথে লড়াই করে মোহাম্মদকে
আগলে রেখে পাহাড়ের দিকে
দৌড়াতে দেয়। তবে পাহাড়ে
পৌঁছানোর আগেই নিহত মক্কান
নেতা উমাইয়া ইবনে খালাফের
ভাই উবাই ইবনে খালাফ সোজা তার
দিকে তলোয়ার উচিয়ে এগিয়ে
আসেন। তার ছেলে বদরে বন্দিদের
একজন ছিল, এবং
যখন সে তার ছেলের মুক্তিপণ
পরিশোধ করতে ইয়াছরিব গিয়েছিল,
তখন তিনি
মোহাম্মদকে সতর্ক করে দিয়েছিল
তারও একদিন আসবে যেদিন তিনি
তাকে হত্যা করবেন। এর জবাবে
মোহাম্মদ বলেছিলেন, “না,
আমিই তোমাকে
হত্যা করব” (১৩)।
উবাই যখন খুব কাছে চলে আসছিলেন,
তখন মোহাম্মদের
বেশ কয়েকজন যোদ্ধা তার ঘোড়াকে
আটকে দিল। যখন তিনি ঘোড়ার
পিঠে থেকে তাদের সাথে যুদ্ধ
করছিলেন, তখন
মোহাম্মদ তার গলায় একটি বর্শা
ঢুকিয়ে দিলেন যার ফলে তিনি
ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। মক্কান
সৈন্যরা যদি চারপাশে ঘিরে না
থাকতো, তাহলে
হয়তো তিনি তার মাথা কেটে
ফেলতেন। মোহাম্মদ এবং তাঁর
সাথে থাকা একটি ছোট দল খাদের
ভিতর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাথরের
পেছন থেকে তীর ছুঁড়তে থাকে।
অন্যদিকে তাঁর কিছু অনুসারী
মক্কানদের দৌড়ানির উপর রাখে
যাতে তারা মোহাম্মদের দিকে
যেতে না পারে। মোহাম্মদ তাদের
উৎসাহ দেয়ার জন্য চিৎকার
করে বলতে থাকেন, “যে
কেউ তাদেরকে আমাদের কাছে আসা
হতে প্রতিহত করবে সে জান্নাতে
আমার সঙ্গী হবে” (১৪)।
মক্কানদের মধ্যে কয়েকজনের হাতে গুলতি ছিল, তারা ছোট ছোট দলগুলোকে পাথর ছুঁড়ে মারতে থাকে। একটি পাথর মোহাম্মদের মুখের পাশ ঢেকে রাখা লৌহবর্মের উপর আঘাত করে, যার ফলে ওর লোহার কিছু অংশ গভীরভাবে তাঁর গালে আঘাত করে। এই পাথরের আঘাতে তিনি মাটিতে পরে যান এবং পাথরের উপরে মুখ থুবড়ে পড়েন, যার ফলে তার নিচের একটি দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং তার ঠোঁট কেটে যায়। মক্কান সৈন্যরা তখনও তার দিকে ছুটে আসতে লাগল এবং তাদের মধ্যে একজন এত কাছে চলে এসেছিলেন যে, তার তলোয়ার দিয়ে মোহাম্মদের শিরস্ত্রাণের উপর আঘাত করে বসেন। এর ফলে শিরস্ত্রাণটি মোহাম্মদের মাথায় ভেঙে গিয়ে আঘাত করে, যার ফলে প্রচুর রক্তপাত হয়। এত রক্ত দেখে মক্কানরা নিশ্চিত হয়ে গেছিল যে, আঘাতকারী ব্যক্তি মোহাম্মদের মাথা দুই খন্ড করতে পেরেছে। আনন্দের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে গেল, “মোহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে!”
প্রাথমিক
উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয়েছে
ভেবে মক্কানরা পিছিয়ে গেল।
যখন তারা চোখের সামনে থেকে
চলে গেল, তখন
রক্তাক্ত মোহাম্মদকে তাঁর
দলের সদস্যরা নিরাপদে লুকিয়ে
রাখার জন্য গিরিখাত বেয়ে
উঠে একটি গোপন আস্তানার খোঁজ
করতে লাগল। আবু বকর ও উমর সহ
তার আরেকদল যোদ্ধা ইতিমধ্যেই
একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছে।
রক্তাক্ত মোহাম্মদকে না চিনতে
পেরে গুহার ভিতর থেকে একজন
তাকে লক্ষ্য করে তাঁর তাক করে
ধরে, কিন্তু
মোহাম্মদ চিৎকার করে বললেন,
“মারবেন না!
এটা আমি,
আল্লাহর রাসুল
(১৫)!
আবু বকর ও উমর তাকে দেখে উল্লসিত ছিলেন। তারা শত্রুদের বিজয়ের ধ্বনি শুনছিল যে, মোহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে এবং এটি শুনে তারা হতাশ হয়ে পড়েছিল। মোহাম্মদ আসার আগে তারা পরস্পর আলোচনা করছিলেন যে, তারা আবদুল্লাহ বিন উবাইকে আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠাবেন যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করতে। এখন তারা আনন্দের সাথে চিৎকার করে উঠল যে, তাদের নেতা বেঁচে আছেন, কিন্তু মোহাম্মদ তাদের চুপ থাকতে বললেন। কারণ তখনও মক্কানরা সেখানে ঘোরাফেরা করছিল, আর তাই মোহাম্মদ চিন্তিত ছিলেন – না জানি ওরা তাঁর অবস্থান জেনে যায়! এরপর মোহাম্মদ তাঁর সাথে থাকা লোকেদেরকে অন্যান্য আহতদের কাছে যেতে আদেশ দিলেন এবং নিজের ক্ষত দেখতে লাগলেন। তিনি তার ভাঙ্গা দাঁতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “যারা এই কাজ করেছে তাদের উপর ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হোক” (১৬)। সেখান থেকে একজন লোক তার গাল থেকে লোহার খন্ডটি বের করতে তাকে সাহায্য করেন। ইনি ছিলেন আবু উবাইদা, তিনি বদরের যুদ্ধে তার নিজের বাবাকে হত্যা করেছিলেন। তিনি তার দাঁত দিয়ে এই লোহার টুকরোটি বের করে আনেন, যার ফলে তার নিজের সামনের দাঁত ভেঙে যায়। তারপর তিনি মোহাম্মদের মুখের রক্ত চাটতে লাগলেন, যেন এটা তার কাছে ঐশ্বরিক সুধা। মোহাম্মদও তাতে আপত্তি করেননি, তিনি বরং বললেনঃ “যার নিজের রক্ত আমার রক্তকে স্পর্শ করেছে, তাকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না” (১৭)।
নিচে যুদ্ধক্ষেত্র মৃতদেহে ভরা ছিল। প্রকৃত হিসেব অনুযায়ী বাইশজন মক্কাবাসী নিহত হয়, অন্যদিকে মোহাম্মদের সত্তর জনেরও বেশী অনুসারী নিহত হয়। মক্কাবাসীরা মোহাম্মদের বাহিনীদের মধ্যে নিহতদের অস্ত্র ও বর্ম খুলে ফেলে এবং মক্কান ধর্মান্তরিতদের মধ্যে সবচেয়ে ঘূর্ণিতদের কান ও নাক কেটে ফেলে। হিন্দ, যিনি হামজার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার শপথ নিয়েছিলেন, তিনি হামজার পেট কেটে তার কলিজা কেটে ফেলেন। বলা হয় যে, তিনি আসলে তার কলিজাতে কামড় দেন এবং চিবিয়ে খান, এবং তারপর থুথু ফেলে তার ঘৃণা প্রকাশ করেন। হামজা তাঁর (হিন্দের) পরিবারের অনেক সদস্যকে হত্যা করেছে।
আবু
সুফিয়ান মোহাম্মদের মৃতদেহ
অনুসন্ধান করতে লাগলেন,
কিন্তু যখন
তিনি তা খুঁজে পেলেন না তখন
তিনি সন্দেহ করতে লাগলেন যে,
মোহাম্মদ হয়তো
মারা যাননি। যে লোকটি তাকে
হত্যা করেছে বলে দাবি করেছে,
তিনি তার কাছ
থেকে বর্ণনা শোনেন কি ঘটেছে।
সে আবু সুফিয়ানকে সেই খাড়ার
কাছে নিয়ে যায়, যেখানে
বেশ কিছু মৃতদেহ পরে ছিল,
কিন্তু মোহাম্মদ
তাদের মধ্যে ছিলেন না। তিনি
এটাও ভাবতে লাগলেন, সম্ভবত
বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা তার
মৃতদেহ লুকিয়ে
রেখেছেন।
এদিকে,
মোহাম্মদ তিনি
একটু দোদুল্যমান অবস্থায়
পড়ে গেলেন। তিনি আশঙ্কা
করছিলেন যে, মক্কানরা
এখন ইয়াছরিবকে আক্রমণ করতে
পারে, কিন্তু
তিনি পাহাড়ে আটকে আছেন এবং
আক্রমণ থেকে বিরত করার জন্য
কিছুই করতে পারবেন না। উত্তর
দিকে উহুদকে ইয়াছরিবের কাছ
থেকে পৃথক করা আধা মাইল খোলা
ভুখণ্ড আছে, কিন্তু
সেখানে ভারি অস্ত্রশস্ত্রে
সজ্জিত মক্কান বাহিনীর মুখোমুখি
হওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত
হবে। কিন্তু আবু সুফিয়ান
ইয়াছরিবকে আক্রমণ না করার
সিদ্ধান্ত নেন, কারণ
তিনি ভেবেছিলেন ঘরে ঘরে সংঘাত
ছড়িয়ে পড়ার বিপদ বাড়তে
পারে। তবে প্রধান কারণ ছিল
তিনি মনে করেছেন যে, তার
যুদ্ধ মোহাম্মদের সাথে ছিল,
ইয়াছরিবের
লোকদের সাথে নয়। তাই তাদের
নিহত যোদ্ধাদের কবর দেয়ার
পর মক্কানরা তাদের তাঁবু ও
মালপত্র উটের উপর বেঁধে চলে
যাবার প্রস্তুতি নেয়।
যাওয়ার
আগে আবু সুফিয়ান তার ঘোড়াকে
খাদের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন,
যেখানে মোহাম্মদের
সাথে শেষ যোগাযোগ হয়েছিল।
তিনি পাহাড়ের দিকে চিৎকার
করে বললেন হুবাল বিজয়ী হয়েছে
এবং মোহাম্মদ, আবু
বকর ও উমরের নাম উল্লেখ করে
চিৎকার করে বলেন, “আর
আবু কাবশার (Abu Kabsha) ছেলে
কোথায়? আর
আবু কুহাফার (Abu Kabsha) ছেলে
কোথায়? আল-খাত্তাবের
(al-Khattab) ছেলে
কোথায়?” (১৮)
তিনি বেশ
কয়েকবার চেঁচিয়ে উঠলেন।
পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা
মোহাম্মদ উমর ও আবু বকরকে
উত্তর দেয়া থেকে বিরত রাখেন,
এই ভয়ে যে
মক্কানরা তাদের খুঁজে পাবেন।
কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে যখন
আবু সুফিয়ান চিৎকার করে বলেন,
“আচ্ছা বুঝেছি,
এদের হত্যা
করা হয়েছে; যদি
তারা বেঁচে থাকত, তাহলে
তারা সাড়া দিত”। উমর আর নিজেকে
আটকাতে পারলেন না। তিনি জবাব
দিলেন, “তোমরা
মিথ্যা বলছ, তোমরা
আল্লাহর শত্রু! আল্লাহ
তোমাদের দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি
প্রদান করুন” (১৯)!
মক্কান বণিক
নেতা তাকে বিদ্রুপ করে বলেন
যে হুবালই বিজয়ী,
মোহাম্মদের
আল্লাহ নয়। মোহাম্মদের
প্ররোচনায় উমর চিৎকার করে
বলেন, “আমাদের
মৃতরা জান্নাতে আছে এবং তোমাদের
মৃতরা জাহান্নামে আছে"
(২০)।
ধর্মতাত্ত্বিক পাল্টাপাল্টি আলাপের পরিসমাপ্তি ঘটে যখন আবু সুফিয়ান উল্লেখ করেন যে, এটি শুধুমাত্র উমরের বিশ্বাস এবং মোহাম্মদ জীবিত কিনা তিনি তা জানতে চেয়েছিলেন। উমর বললেন, “তিনি তোমার কথা শুনছেন”। এতে আবু সুফিয়ান মোহাম্মদের অঙ্গহানির কথা স্মরণ করিয়ে বলেন, “এটা আমাদের নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত ছিল না। তারপরও যদি আমরা ইচ্ছে করেই এটি করে থাকতাম, তাতে আমাদের আপত্তি থাকত না” (২১)। তিনি পরের বছর বদর উপত্যকায় মোহাম্মদকে পুনরায় মুখোমুখি হওয়ার চ্যালেঞ্জ জানান। উমর মোহাম্মদের দিকে ফিরে তাকালেন, তিনি কি করতে চান জানতে। মোহাম্মদ যখন মাথা নাড়লেন, তখন উমর চিৎকার করে বললেন, “আমরা সেখানে তোমাদের সাথে দেখা করব”।
মক্কাবাসীরা
চলে যাওয়ার পর মোহাম্মদ আলী
ও অন্যান্যদের নির্দেশ দিলেন
দেখতে যে, তারা
কোথায় যাচ্ছে। তিনি বলেন,
“যদি তারা উটে
চড়ে আর তাদের ঘোড়ার নেতৃত্ব
দেয়, তাহলে
তারা মক্কার দিকে যাবে। যদি
তারা ঘোড়ায় চড়ে উটের নেতৃত্ব
দেয়, তাহলে
তারা ইয়াছরিবের দিকে যাবে।”
তিনি শপথ করে বলেন, তারা
যদি ইয়াছরিবের দিকে যায়,
তিনি তাদের
সাথে যুদ্ধ করবেন যতক্ষণ না
তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়
(২২)।
আলী উৎসাহব্যঞ্জক সংবাদটি
নিয়ে এলেন, মক্কানরা
তাদের উট চালাচ্ছিল এবং তারা
দক্ষিণে যাচ্ছিল।
যখন
মোহাম্মদ নিশ্চিত হলেন যে,
তিনি এখন নিরাপদ
তখন উহুদ থেকে বের হলেন। তার
সাথে যারা ছিল তাদের সকলকে
নামাজের জন্য পাহাড়ে নিয়ে
গেলেন। ক্ষত থেকে হওয়া
যন্ত্রণার কারণে তিনি সিজদা
করা থেকে বিরত থাকলেন,
কিন্তু পা
দুখানা জোড়া করে বসে আয়াত
আবৃত্তি করলেন। প্রার্থনা
শেষ হলে তিনি হামজার মৃতদেহ
খুঁজতে লাগলেন। হামজাকে চেনাই
যাচ্ছিল না। তার নাক এবং কান
কেটে ফেলা হয়েছে, তার
পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে
নেয়া হয়েছে। তার কলিজা কেটে
ফেলা হয়েছে এবং কলিজাটি তার
শরীরের পাশেই মাটিতে পরে আছে,
তাতে গভীর
কামড়ের চিহ্ন আছে। মোহাম্মদ
সাফিয়াকে দূরে রাখতে জুবায়েরকে
বলেন, যাতে
সে তার ভাইকে এই অবস্থায়
দেখতে না পারে, কিন্তু
যাই হোক না কেন সাফিয়া এসে
ভাইয়ের মৃতদেহের উপর কাঁদতে
থাকে। মোহাম্মদ জানতে পারলেন
যে, হিন্দই
(Hind) হামজার
কলিজা কেটে ফেলেছে এবং তাতে
কামড় বসিয়েছে। এটি ক্রোধে
ফুঁসতে থাকেন যখন তাঁর ধারণা
হয়, হিন্দ
হয়তো হামজার কলিজার কিছুটা
গিলে ফেলেছে বা হজম করে ফেলেছে।
কেয়ামতের দিন আল্লাহ ও তার
রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করার
জন্য হিন্দকে চিরন্তন আগুনে
জ্বালানো হবে। কিন্তু যে
চিন্তা তাকে আতংকিত করে তুলেছিল
সেটি হলো, তিনি
মনে করেছিলেন হিন্দ হয়তো
হামজার কিছু অংশ শুষে তার
শরীরে ভিতর নিয়েছে, যার
ফলে হামজার শরীরের অনু-পরমাণুও
জাহান্নামের চিরস্থায়ী
আগুনের তাপ অনুভব করবে!
(২৩)
শোকার্ত
পরিবারের অনেকেই ইয়াছরিব
থেকে আসেন মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে
গিয়ে কবর দিতে, কিন্তু
একডজন বা ততোধিক মৃতদের
যুদ্ধক্ষেত্রেই সমাহিত করা
হয়। হামজাকে একটি কবরে কবরস্থ
করা হয়। অন্য মৃতদেহগুলিকে
দুই বা তিনজন করে একই কবরে
সমাধিস্থ করা হয়, তবে
তার আগে দেহগুলোকে আশীর্বাদের
জন্য মোহাম্মদের পাশে রাখা
হয়। তারপর তাদেরকে মাটি দেয়া
হয়। মোহাম্মদ বলেন,
তারা সবাই
কিয়ামতের দিন তাদের ক্ষত
নিয়েই জেগে উঠবে। সেই ক্ষত
থেকে চমৎকার সুগন্ধি বের হবে,
এই সুগন্ধি
দ্বারা আল্লাহর প্রতি তাদের
ভক্তির প্রমাণ হবে।
ইয়াছরিবে
নিহত কিছু ধর্মান্ধরিতদের
মা-বাবা
তাদের সন্তানদের মৃত্যুতে
ক্ষুব্ধ হয় এবং অভিযোগ করে
যে, তাদেরকে
মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে এখানে
এনে হত্যা করা হয়েছে। ইয়াজিদ
(Yazid) নামে
এক অল্প বয়সের এক যুবক এর
মধ্যে ছিলেন। মারাত্মক আহত
অবস্থায় তাকে তার বাবা হাতিবের
(Hatib) বাড়িতে
নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি
গালিচায় রাখা হয়, এবং
সেখানেই তিনি মারা যান। যারা
তার ক্ষতবিক্ষত দেহকে নিয়ে
এসেছিল তারা শোকার্ত পিতার
পাশে বসে বলেন যে, ইয়াজিদ
শহীদের মর্যাদা ও জান্নাত
যাবেন, যেখানে
তিনি কালো চোখের কুমারিদের
পুরস্কার হিসেবে পাবেন।
ইয়াছরিবের অনেকের মত,
হাতিবও (Hatib)
নির্যাতন থেকে
বাঁচতে নামমাত্র ধর্মে যোগ
দিয়েছিলেন, কিন্তু
একপর্যায়ে তিনি এই সমস্ত
কথা আর নিতে পারেননি। তিনি
তাদের দিকে রাগান্বিত হয়ে
বলেন : "আল্লাহর
শপথ, তোমরা
তার সাথে এই কাজ করেছ!
তোমরা তাকে
এইভাবে প্রলুব্ধ করেছ যতক্ষণ
না সে তোমাদের সাথে যায় এবং
তাকে হত্যা করা হয়। তোমরা
তাকে কথা দিয়েছিলে যে,
সে জান্নাতে
প্রবেশ করবে। জান্নাত একটা
বিভ্রম!” হাতিব
তাদের ঘর থেকে বের হয়ে যেতে
বলেন। যেতে যেতে তারা হাতিবকে
মুনাফিক ডাকলেন এবং বললেন,
“আল্লাহ তোমাকে
ধ্বংস করুন!” (২৪)
মসজিদের
বাসভবনে ফেরার পথে মুখে
ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায়
সাদ বিন মুয়াযের গোত্র আউসের
দুর্গের পাশে মোহাম্মদকে
থামানো হয়। সাদের ভাই আমর
সহ এই গোত্রের বারোজন মারা
পড়েছে এবং আরও ত্রিশজন লোক
বিভিন্ন মাত্রায় গুরুতর আহত
হয়েছিল। ঘোড়ায় পিঠে বসেই
মোহাম্মদ ঘোষণা করেন যে,
তার কাছে আহতদের
জন্য সুখবর আছে : তাদের
ক্ষত ঈশ্বরকে খুশি করবে,
তাদের ক্ষত
পুনরুজ্জীবিত করা হবে,
তা দেখতে “গভীর
লাল, রক্তের
রঙ, এবং
তা থেকে কস্তুরির সুগন্ধ
ছড়াবে”। মৃতদের পরিবারের
জন্য তিনি প্রার্থনা করলেন:
“হে আল্লাহ,
তাদের অন্তর
থেকে দুঃখ দুর করুন এবং তাদের
দুর্দশা থেকে পুনরুদ্ধার
করুন।” তিনি এছাড়াও প্রতিশ্রুতি
দিয়েছেন যে, নিহতরা
তাদের প্রিয়জনদের জন্য
বেহেস্তের সুপারিশ করবে।
তিনি বলেন, “আনন্দিত
হও এবং পরিবারকে জানিয়ে দাও
যে, মৃতরা
তাদের পরিবারের সাথে একসাথে
জান্নাতে থাকবেন - তারা
বারোজন পুরুষ - এবং
তারা তাদের পরিবারের জন্য
সুপারিশ করবে” (২৫)।
-
সারাদিনের
ভয়াবহ ঘটনা এবং তার আঘাতের
মাত্রা বিবেচনা করলে,
মোহাম্মদ তার
ঘোড়ার উপর সোজা হয়ে থেকে
অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি প্রদর্শন
করেন। তার সেনাবাহিনী হতাশাজনক
পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিল;
তার আর শৌর্যবীর্য
দেখানোর প্রয়োজন ছিল,
কিন্তু মসজিদে
পৌঁছতে পৌঁছতে ততক্ষণে ঘোড়া
থেকে তার পড়ে যাওয়ার উপক্রম
হয়েছিল। তিনি তার মেয়ে
ফাতিমার হাতে তলোয়ার তুলে
দিয়ে বললেন, “এটা
থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলো,
বাছা। আমি
ঈশ্বরের কসম খেয়ে বলছি,
আজকে এটা আমার
কাছে সত্য ছিল!” (২৬)।
বেশ কয়েকজন লোক মোহাম্মদকে
ঘোড়া থেকে নামতে সাহায্য
করে এবং একটি ঘরে নিয়ে যায়
যেখানে তার স্ত্রীরা তার বর্ম
খুলে তার ক্ষত পরিষ্কার করে।
বিলাল যখন সন্ধ্যায় নামাজের
আহ্বান জানালেন, তখন
সাদ বিন মুয়াযের কাঁধে ভর
দিয়ে তিনি নামাজে গেলেন।
তিনি প্রার্থনায় নেতৃত্ব
দিলেন, তবে
পুরো সময়টা বসে, শেষ
করে বিছানায় গেলেন। ভোর
হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি গভীর
ঘুমিয়ে ছিলেন, এবং
শোকার্ত নারীদের কান্না শুনে
জেগে উঠেছিলেন। তিনি ঘরের
বাইরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা
করছিলেন ব্যাপারটা কি। দেখা
গেল, মোহাম্মদ
হয়তো সন্তুষ্ট হবেন এই ভেবে
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা
বিভিন্ন গোত্রের কিছু নারীদের
নিয়ে এসে হামজার মৃত্যুর
জন্য শোক প্রকাশ করার জন্য
কাঁদতে বলেন। তারা কাঁদছিল,
চিৎকার করছিল
এবং মাতম করে নিজেদের মাটিতে
ফেলে দিচ্ছিল। আবদুল্লাহ
ইবনে রাওয়াহা এই কাজ করেছিলেন,
কারণ তিনি
মোহাম্মদকে বলতে শুনেছেন,
হামজার মৃত্যুতে
শোক প্রকাশ করার জন্য কোন নারী
ছিল না শুধু তার বোন সাফিয়া
ছাড়া। রাওয়াহার কাছে
মোহাম্মদের ওই কথাকে ইঙ্গিতপূর্ণ
আদেশের মত মনে হয়েছিল,
কিন্তু মোহাম্মদ
এই কান্নাকাটির মাতম দেখে
রেগে গেলেন। এক কথায়,
এটা ছিল ভুয়া,
ঠিক যেমন পেশাদার
শোকসন্তপ্তদের শোক জানানোর
জন্য অর্থ প্রদান করা। এই
মহিলাদের একজনও সত্যিকারে
হামজাকে পরোয়া করে না।
তারচেয়েও বড় কথা, তিনি
কান্নার আওয়াজকে ঘৃণা করতেন।
এটা শারীরিকভাবে তাকে আঘাত
করত, এটা
তার মস্তিষ্কে গিয়ে বিধত;
যেমন সঙ্গীত
এবং কুকুর ঘেউ ঘেউ করা এবং হাত
হাততালি, আর
অন্যান্য তীক্ষ্ণ শব্দ যা
তার মস্তিষ্কের গভীরে স্নায়বিক
বিস্ফোরণের মত অনুভুত করাত।
তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে
ক্রন্দনরতদের কান্না থামানোর
আদেশ দিলেন। এর পাশাপাশি তিনি
তাদের ধন্যবাদ জানালেন এবং
বললেন আমি বুঝতে পারছি তোমাদের
উদেশ্য ভালো, কিন্তু
“আমি মাতম করে কান্নাকাটি
পছন্দ করি না!” (২৭)।
তারপর থেকেই, তিনি
কাঁদতে নিষেধ করেন, তা
যত আন্তরিক শোকের প্রকাশ হোক
বা পেশাদার শোক হোক না কেন।
তবে তিনি শব্দ না করে কাঁদার
অনুমতি দিলেন।
মোহাম্মদ
ছিলেন একজন বিচক্ষণ নেতা।
তিনি জানতেন পরাজয়ের জন্য
তার অনুসারীদের কাছ থেকে তিনি
প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন:
আল্লাহ কোথায়
ছিলেন? আল্লাহ
কেন তাদেরকে মুশরিকদের কাছে
হেরে যেতে দিলেন? আল্লাহর
অসন্তোষ অর্জনের মতো তারা
দোষ কি করেছে? এমন
ধরনের প্রশ্ন মনের মধ্যে
সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে।
মোহাম্মদ আল্লাহকে ব্যাখ্যা
করার সুযোগ দিতেন কোরআনে,
কিন্তু কি বলা
উচিত সেই আয়াত তৈরি করতে সময়
লাগবে। কিন্তু এখনই তাকে কিছু
পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি
মক্কাবাসীদের বোঝাতে চান যে
তার হাতেই সকল ক্ষমতা ছিল।
ফজরের নামাজের পর মোহাম্মদ
বিভিন্ন গোত্র থেকে সেনাদল
গঠনের আদেশ দেন, কিন্তু
যারা আগের দিন উহুদে যুদ্ধ
করেছিল কেবল তাদেরই যেতে
দেওয়া হবে। ঘোষকরা ছিল গোত্রের
নেতা। তাদের একদল মোহাম্মদকে
সুরক্ষা দিতে মসজিদের উঠোনে
ঘুমিয়ে ছিল এবং তারা বিভিন্ন
এলাকায় ঘুরে ঘুরে যোদ্ধাদের
উত্তেজিত করে তুলেছিল। যারা
তাদের ক্ষতের কারণে তাদের
ছেড়ে দিতে মাফ চাইলেন মোহাম্মদ
তখন তার ক্ষতের দিকে ইঙ্গিত
করলেন। যতটা সম্ভব পুরুষদের
একত্রিত করার পর, তিনি
আবু সুফিয়ানের সৈন্যবাহিনীর
ঘোড়া ও উটগুলি যেই পথ ধরে
গিয়েছে সেই পথের অনুসরণ করে
হামরা আল-আসাদ
বা লাল সিংহ (Hamra al-Asad) নামের
একটি জায়গায় যান যা ইয়াছরিব
থেকে প্রায় আট মাইল দক্ষিণে
এবং সেখানে তিনি শিবির স্থাপন
করেন।
[মোহাম্মদ
উহুদ যুদ্ধের সময় আহত হন,
যখন একজন
মক্কাবাসী তার হেলমেটে তলোয়ার
দিয়ে আঘাত করে এবং আরেকজন
গুলতি দিয়ে পাথর ছুঁড়ে মারে
তার মুখের পাশে আঘাত করে। যার
ফলে তার হুডের কিছু অংশ তার
গালে ঢুকে যায়। মক্কানরা
প্রথমে ভেবেছিল যে তাকে হত্যা
করা হয়েছে, কিন্তু
তিনি উহুদ পর্বতে তার লোকের
সাথে লুকিয়ে ছিলেন।]
মক্কানরা আগের রাতে শিবিরে অবস্থান করেছিল, কিন্তু আবু সুফিয়ানের নেতৃত্ব নিয়ে কমান্ডারদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। মোহাম্মদ তার হাতের মুঠোয় ছিল, পাহাড়ের ধারে আটকে ছিল কিন্তু সে তার পিছু নিতে ব্যর্থ হয়। তারচেয়েও বড় কথা, তিনি ইয়াছরিবকে আক্রমণ করতে নারাজ ছিলেন যা মোহাম্মদের অনুসারীদের উপর মারাত্মক আঘাত হতে পারত। তিনি এমন পরিস্থিতিতে আরবের পুরনো নিয়ম মানতে চেয়েছেন, কিন্তু এখন আর পুরনো নিয়ম প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। আবু সুফিয়ানের একজন সমালোচক বললেন, “আপনি কিছুই অর্জন করতে পারেননি। আপনি তাদের নেতৃত্ব এবং তাদের অভিজাতদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন, কিন্তু আপনি তাদেরকে একেবারে শেষ না করেই ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও তাদের নেতা আছে যারা আপনার বিরুদ্ধে লোক জড়ো করবে” (২৮)। তাদের অনেকেই ফিরে গিয়ে কাজ শেষ করতে চেয়েছিল (অর্থাৎ মদিনায় আক্রমণ করা)। আবু সুফিয়ান অবশেষে এ ব্যাপারে রাজি হলেন।
মোহাম্মদ
একজন ভ্রমণকারী ব্যবসায়ী,
দক্ষিণ উপকূলীয়
আদিবাসীদের একজন নেতার কাছ
থেকে তাদের পরিকল্পনা জানতে
পারেন, যিনি
উভয় পক্ষেই খেলতেন। আবু
সুফিয়ান তাকে কিছু অর্থ দিয়ে
মোহাম্মদের কাছে একটি বার্তা
দিতে বলেন যে, মক্কানরা
ফেরত আসছে এবং তারা চলে যাবে
না যতক্ষণ না তিনি নিহত হন এবং
তাঁর অনুসারীরা একেবারে ধ্বংস
হয়। মোহাম্মদ সেই ব্যবসায়ীকে
ফিরতি বার্তা দিয়ে ফেরত পাঠান
যে, তিনি
তাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী
সৈন্য নিয়ে তাদের স্বাগত
জানাবেন। মোহাম্মদের বাহিনী
সংখ্যায় পাঁচশোর বেশি হবে
না, কিন্তু
তারা মনস্তাত্ত্বিকভাবে
যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে হিসেব করা
শক্তির চেয়ে প্রদর্শিত শক্তিই
মুখ্য হয়ে উঠে। মোহাম্মদ
বললেন - “যুদ্ধে
প্রতারণা সিদ্ধ” এবং সে রাতে
তার সৈন্যরা পার্শ্ববর্তী
পাহাড়গুলোতে শত শত আগুনের
কুন্ডলি জ্বালিয়ে দিল,
যাতে মাইলের
পর মাইল এই আলো দেখা যায়। এটা
কৌশলে একটি বিশাল সৈন্যদলের
ইঙ্গিত দিচ্ছিল, যা
ছিল আসলে এক ধরণের ধোঁকাবাজি।
মক্কাবাসীরা এই আলো দেখে ভয়ে
ঘুরে মক্কায় ফিরে গেল।
মক্কাবাসীদের
মোকাবেলা করার আগে মোহাম্মদ
তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা
তথ্য সংগ্রহের জন্য দুজন
গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন,
কিন্তু তাদেরকে
আটক করে হত্যা করা হয় এবং
তাদের মৃতদেহ মোহাম্মদের
জন্য ফেলে রেখে যায়। এর বদলা
নিতে মোহাম্মদ উমাইয়া ইবনে
খালাফের জুমাহ গোত্রের দলছুট
সদস্য আবুল আজ্জা (Abul
Azza) নামে একজন
মক্কানকে বন্দি করেন। তিনি
গভীর ঘুমে ছিলেন এবং মক্কানরা
তাকে ছাড়াই হামরা-আল-আসাদ
ত্যাগ করেছিল। তিনি একজন কবি
ছিলেন, যিনি
বদরের বন্দিদের মধ্যেও ছিলেন।
সেই সময়ে (বদর
যুদ্ধের পর) তিনি
মোহাম্মদকে অনুরোধ করেছিলেন
তাকে যেন হত্যা না করা হয়।
তিনি দরিদ্র ছিলেন এবং তার
অনেকগুলো কন্যা ছিল। মোহাম্মদ
তাকে মুক্তিপণ না নিয়েই ছেড়ে
দেন এই প্রতিশ্রুতিতে যে,
তিনি আর কখনো
তার বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে
নেবেন না, কিন্তু
তিনি মক্কাবাসীদের সাথে উহুদের
যুদ্ধে যোগ দিয়ে প্রতিশ্রুতি
ভঙ্গ করেছিলেন। তিনি আবারো
তার প্রাণভিক্ষা চান,
কিন্তু মোহাম্মদ
তাকে ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি
জানান। তিনি বলেন “তুমি মক্কায়
গিয়ে দাড়ি নাড়তে নাড়তে
বলবে, আমি
মোহাম্মদকে দুইবার ধোঁকা
দিয়েছি!” (২৯)
ইসলামের
আদিগ্রন্থে এই ব্যাক্তির
হত্যাকারীর সম্পর্কে ভিন্ন
ভিন্ন মত আছে। কিছু সূত্র দাবি
করে যে, মোহাম্মদের
চাচাতো ভাই জুবায়ের আবুল
আজ্জাকে হত্যা করেছে;
আর অন্য সূত্র
বলছে যে, বদরে
উকবাহ ইবনে মুয়াইতকে (Uqbah
Muayt at Badr) শিরচ্ছেদ
করা আসিম বিন ছাবিত তাকে হত্যা
করেছে। আবুল আজ্জার মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর হবার পর মোহাম্মদ
তার ছোট সৈন্যদল নিয়ে ইয়াছরিবে
ফিরে আসেন।
একই পরিণতি ঘটে আরেকজন মক্কানের বেলায়, যিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং ইয়াছরিবে পালিয়ে তার প্ৰথম চাচাত ভাই উসমান ইবনে আফফানের (Uthman Affan) বাড়িতে সুরক্ষা চেয়েছিলেন। মোহাম্মদ তাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উসমানের অনুরোধে তিনি লোকটিকে তিনদিন সময় দেন ইয়াছরিব ছেড়ে চলে যেতে। পাঁচদিন পরে যখন মোহাম্মদ হামরা-আল-আসাদ অভিযান থেকে ফিরে আসেন, তিনি জানতে পারেন যে লোকটি এইমাত্র ইয়াছরিব ছেড়ে গেছে। তাকে খুঁজে বের করার জন্য তিনি তার পালকপুত্র জায়েদ ও অন্য একজনকে পাঠান। তারা তাকে ইয়াছরিবের বাইরে থেকে ধরে আনে, একটি গাছের সাথে বেঁধে রাখে এবং তার দেহকে তীর নিক্ষেপের নিশানা অনুশীলনের জন্য ব্যবহার করে। তারপর তার মৃতদেহ থেকে তীর উদ্ধারের পর তারা তার মৃতদেহকে শকুনের জন্য রেখে দেয় (৩০)।
উহুদের
যুদ্ধ কোরআনে প্রবেশ করে
আয়াতের মাধ্যমে, যেখানে
মোহাম্মদ আল্লাহর কণ্ঠে তার
লোকদের শাস্তি দেন, যারা
তার কথা অমান্য করছিল। তীরন্দাজরা
তার কঠোর আদেশ থাকা সত্ত্বেও
তাদের অবস্থান পরিত্যাগ
করেছিল। আয়াতগুলো উল্লেখ
করেছে যে, অন্যরা
আতংকিত হয়ে তাকে মহাবিপদে
রেখেই দৌড়ে পালায় এবং তাকে
রক্ষা করার আবেদন উপেক্ষা
করে। তা সত্ত্বেও মোহাম্মদ
তাদের প্রশংসা করলেন,
কারণ তারা
আল্লাহর পথেই ছিল। তারা এই
যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে রাসুলের
প্রতি ভালবাসা দেখিয়েছে এবং
আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের
প্রমাণ দিয়েছে। আল্লাহ্র
পথে যুদ্ধ করার মধ্য দিয়ে
তারা আল্লাহ আর তার প্রতি
ভালবাসা দেখিয়েছে। কিন্তু
সেই মুহূর্তে এটা যথেষ্ট ছিল
না, এবং
এটা এক ধরনের বিচ্যুতি। আল্লাহ
তাদের দৃঢ়তা পরীক্ষা করতে
চেয়েছিলেন গনিমতের মাল দিয়ে।
তারা যাদের হত্যা করেছে তাদের
গনিমতের মালে তাদের অধিকার
ছিল, কিন্তু
তারা ধৈর্যশীল ছিল না। তারা
পৃথিবীতেই তাৎক্ষণিক তৃপ্তি
কামনা করে, তারা
গনিমতের মালের ভাগবাটোয়ারা
পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। সুতরাং
তারাই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী
ছিল, কিন্তু
আল্লাহ তাদের কয়েকজনকে তাদের
কাঙ্ক্ষিত শহীদের মর্যাদা
দান করেছেন। কেন আল্লাহ ও তার
রাসুলের আনুগত্য করা গুরুত্বপূর্ণ
এই ঘটনা সেই শিক্ষাই অন্যদেরকেও
দিচ্ছে, এবং
যেহেতু এটি একটি শিক্ষা ছিল
তাই এবারের মতো আল্লাহ তাদের
ভুলের মার্জনা করে দিয়েছেন
(৩১)।
উহুদ
যুদ্ধের ঘটনাবলীর আরও একটি
পর্ব তখনো বাকি ছিল। মোহাম্মদ
জানতে পারলেন যে, যুদ্ধের
সময় হারিছ নামের একজন মুমিন
(বিশ্বাসী)
আরেকজন মুমিনকে
হত্যা করেছে। মূলত এটা ছিল
পুরনো একটি ঘটনার প্রতশোধমুলক
নিষ্পত্তি। যুদ্ধের বিভ্রান্তিতে
যাতে এই খুনটি লুকানো যায়,
সেই কারণেই
উহুদ যুদ্ধের সময়ে খুন করা।
কিন্তু তাকে অন্যরা দেখা ফেলে,
এবং হত্যাকান্ডের
কথাটি মোহাম্মদকে জানানো
হয়। এটা ছিল একটা প্রতিশোধমূলক
খুন যা আউস আর খাজরাজের মধ্যেকার
পুরনো দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত।
যে মানুষটিকে হারিছ খুন করেন
তিনি দশবছর আগে তার বাবাকে
খুন করেছিল, যা
একটি গোত্রগত যুদ্ধের সূত্রপাত
ঘটায়। দশবছর ধরে সে তার বাবার
হত্যাকারীর প্রতি ঘৃণার চাষ
করে আসছিল এবং প্রতিশোধ নেবার
জন্য মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষা
করছিল।
হামরা-আল-আসাদ
অভিযান থেকে ফিরে আসার পর
মোহাম্মদ একটি গাধার উপর চড়ে
কুবা গ্রামে যান, যেখানে
খুনি বাস করতেন। মোহাম্মদ
সপ্তাহে একবার কুবায় গিয়ে
মসজিদে নামাজ আদায় করতেন।
এই মসজিদটি ইয়াছরিবে প্রথম
নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু
এটা অন্যান্য সাধারণ দিনের
মতো ছিল না। মসজিদের লোকজন
তাকে দেখে কিছুটা বিস্মিতও
হলেন। মোহাম্মদ যখন লোকজনকে
সারিবদ্ধ নামাজের জন্য
সাজাচ্ছিলেন, তখনই
হারিছ নামাজের জন্য সেখানে
উপস্থিত হন। যখন হারিছ সেই
সারিতে যোগ দিতে গেলেন,
মোহাম্মদ তাকে
থামতে বলেন এবং তাকে খুনের
অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। এরপর
বিশেষ কিছু আয়াত পাঠ করে
হারিছকে ধরে ফেলার আদেশ দিলেন।
হারিছ খুনের কথা স্বীকার
করলেন, কিন্তু
তার কাছে জীবন ভিক্ষা করলেন।
হারিছ বললেন, আল্লাহর
রাসুল যদি তাকে ক্ষমা করেন
তবে তিনি সবকিছু করবেন। তিনি
রক্তমূল্য পরিশোধ করবেন,
দুই মাসের জন্য
রোজা রাখবেন, ক্রীতদাসকে
মুক্ত করবেন এবং দরিদ্রদের
খাওয়াবেন। মোহাম্মদ তাতেও
বিচলিত হলেন না। তিনি তাকে
শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ডর
আদেশ দিলেন। হারিছকে মসজিদের
ফটকের বাইরে নিয়ে যাওয়া
হলো এবং হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে
বাধ্য করা হয়। ধারালো তলোয়ারের
দ্বারা তার জীবনের সমাপ্তি
ঘটানো হলো (৩২)।
লোকটি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল যে, এটি ছিল একটি নতুন জগৎ। আউস এবং খাজরাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব পুরাতন জগতের ছিল। মোহাম্মদ পুরাতন নিবাসীদেরকে এক নতুন নিবাসীতে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন, এবং এটি এখন বিশ্বাসীদের জগত। নতুন গোত্রের সদস্য হওয়ার ফলে সৃষ্ট সম্পর্কের কারণে সব পুরনো সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। যারা নতুন নিবাসের (ইসলামিক নিবাস, ইসলামী বিশ্বাস) সদস্য ছিল না তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং হত্যা করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। সত্যিই, এই যুদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করা এবং একে অপরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মোহাম্মদ দেখিয়েছেন যে, উহুদের পরাজয়ও তার কর্তৃত্ব হ্রাস করেনি। সে এখনো জীবন নিতে পারে - যেটি চুড়ান্ত ক্ষমতা। নতুন গোত্রের কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস রাখে না। লোকটির পরিবার তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চাইবে না, অথবা রক্তমূল্যও চাইবে না। তারাও বিশ্বাসী ছিল, এবং মোহাম্মদের নিয়ম অনুযায়ী তাদের খেলতে হবে - মোহাম্মদের নিয়মই তাদের নিয়ম হতে বাধ্য ।