অধ্যায় ৩ খিচুনি
দু'জন মুহাম্মদ রয়েছে - একজন বাস্তবের মুহাম্মদ আর অন্যজন কল্পনা তথা পৌরাণিক কাহিনী-সর্বস্ব মুহাম্মদ। কল্পকাহিনীর মুহাম্মদ ছাড়া প্রকৃত মুহাম্মদের স্থায়িত্ব নেই।
সময় ও স্থানের বিবরণ ব্যতীত, পৃথিবীতে মুহাম্মদের আগমন অন্য যেকোনো মানুষের চেয়েই আলাদা ছিল না। কুঁড়েঘরের নোংরা মেঝেতে, কাঁচা চামড়ার মাদুরের ওপর আমিনা মুহাম্মদকে প্রসব করেন। আর এই কঠিন পরীক্ষায় তাঁকে তাঁর গোত্রের অন্যান্য মহিলারা সাহায্য করেছিল। নাভিরজ্জুটি কেটে দেয়া হলো। তারপর সদ্যোজাত শিশুটিকে পরিষ্কার করে একটি নরম তোয়ালেতে জড়িয়ে নিয়ে মায়ের অপেক্ষমান বাহুতে তুলে দেয়া হলো।
গল্পে (মিথ) আছে যে, মুহাম্মদের জন্মের সাথে তার ভবিষ্যতে নবী হওয়ার আলামত হিসেবে এক উজ্জ্বল আলো উপস্থিত হয়েছিল। গর্ভবতী আমিনা স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাঁর দেহ থেকে একটি আলো বেরিয়ে এসেছে যা তাঁকে "সিরিয়ার ভূমিতে বসরার দুর্গ" দেখার সুযোগ দেয় যাকে ধরা হয় মুহাম্মদের ভবিষ্যৎ বিজয়ের আলামত হিসেবে।
জন্মের পরে, আমিনা বিশ্বকে আলোকময় হতে দেখেন এবং বলেন "তারাগুলি আমার এতোটাই কাছে এসে পৌঁছেছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল সেগুলো যেন আমার উপরেই পড়ছে।" মুহাম্মদ এমনভাবে জন্ম নিলেন, যেন এইমাত্র গোসল করা, যার নাভিরজ্জুটি ইতিমধ্যেই কাটা হয়েছে। দুনিয়াতে প্রবেশের পরে অন্যান্য বাচ্চাদের মত কোন অনুনয় বা কান্নাকাটি না করে বরং তিনি জন্ম নিয়েছিলেন আল্লাহর কাছে সিজদারত অবস্থায়।
মোহাম্মদীয় যুগে রচিত, মুহাম্মদ সম্পর্কিত বিশেষ লেখাসমূহে, মুহাম্মদের জন্ম নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়, যেখানে মোটাদাগে সত্য প্রকাশ পেয়েছে। সে সমস্ত লেখায় আরো উঠে এসেছে কিভাবে একেবারে জন্মের পরে থেকেই মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত, অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে মুহাম্মদকে যেতে হয়েছে। মুহাম্মদের জন্মের কিছুদিন পরেই তাকে একজন সেবিকার মাধ্যমে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
পরবর্তী চার-পাঁচ বছর মায়ের সাথে আর তার যোগাযোগ হয়নি। সে যুগে প্লেগ রোগে মৃত্যুহার অনেক বেশি ছিল; তাই এই রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা পেতে, বিশেষ করে মরুভূমিতে জন্ম নেয়া শিশুদের খুব দ্রুত অনেক দূরে সরিয়ে রাখার রেওয়াজ ছিল।
বেশ কয়েক বছর পর, শারীরিক ও মানসিকভাবে পুষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিজ মা ও পরিবারের সাথে থাকতে দেয়া হতো না। যেকোন পরিস্থিতিতে এমন রেওয়াজ মোটেও স্বাভাবিক হতে পারে না। দীর্ঘ বিরতির পর প্রকৃত মায়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হলেও, এতে শিশুদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হতো; স্বাভাবিক মনোবিকাশ যথেষ্ট বাধাগ্রস্ত হতো।
এটা ধরে নেয়া যায় যে, মূলত সন্তান প্রতিপালনে অক্ষম কিংবা অনিচ্ছুক দম্পতির ক্ষেত্রে এই চলটা বেশি ছিল। আব্দুল মুত্তালিবের সর্বশেষ স্ত্রীর সন্তান হামজা ও সাফিয়ার বেলায় এমনটা হয়েছিল বলে কোন প্রমাণ পাওয়া না। এরা বয়সে মুহাম্মদের সমসাময়িক ছিল। এটা বলাই যায় যে, আমিনা তাঁর নিজ সন্তানকে লালনপালনে সক্ষম ছিলেন না, বা সম্ভবত ইচ্ছুক ছিলেন না। এমনটা হওয়ার পেছনে মা আমিনার সেই একই রোগ, তথা মৃগীরোগ থাকাকেই কারণ মনে করা যেতে পারে, যেই স্নায়বিক জটিলতা পরবর্তীতে মুহাম্মদের জীবনের গন্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
পুরনো ইতিহাস ঘেঁটে আরো জানা যায়, মুহাম্মদের দাদা আবদুল মুত্তালিব মুহাম্মদের জন্মের পরপরই একজন পালক মাতার খোঁজে বেরিয়ে পরেন। মুহাম্মদের চাচা আবু লাহাবের (যে পরবর্তীতে তাঁর চরম শত্রুতে পরিণত হন) একজন দাসীকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য সাময়িকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়, যতক্ষণ না পাকাপোক্ত আরেকজন কাউকে পাওয়া গেছে। অবশেষে, মক্কার দক্ষিণ-পূর্বে তিনদিনের দুরত্বে, এক যাযাবর গোত্রের বাসভূমি তায়েফ নিবাসী এক বেদুইন মহিলা হালিমা পালক মাতার দায়িত্ব নেন। কথিত আছে, হালিমা ছাড়াও ঐ গোত্রের আরো কিছু মহিলা জীবিকার তাগিদে শহরের অন্যান্য জায়গায় এই পালক মাতার কাজ করে গেছেন।
দুধমাতা হিসেবে হালিমা একেবারেই আদর্শ ছিলেন না। তিনি ছিলেন শুকনো, এমনকি নিজের সন্তানকেও ঠিকমতো দেখভালে অক্ষম। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনানুসারে জানা যায়, হালিমা বলেছেন, দুর্ভিক্ষের সময় একই এলাকার আরো দশজন মহিলা সহ তাঁরা মক্কায় আসেন; পালকমাতা হয়ে দীর্ঘমেয়াদে জীবিকার তাগিদে। হালিমা একটা ধুসর-সাদা গাধার পিঠে চড়ে আসছিলেন। তাঁর কোলে ছিল দুধের শিশু; আর তাঁর বর আরেকটা শুকনো উটের সওয়ারী হয়েছিলেন। তাঁর সাথে আরো চলে একপাল ছাগল। হালিমা ঠিকমতো খেতে পারতেন না, তাই তাঁর বুকের দুধ পর্যাপ্ত ছিল না। পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে সাথে আনা উট, গাধা আর ছাগলগুলোও পর্যাপ্ত দুধ দিতে পারত না।
আমিনা এই সকল মহিলার কাছেই মুহাম্মদকে প্রতিপালন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাঁকে নিরাশ করেছিল। তাদের আশঙ্কা ছিল, বিধবা আমিনা ঠিকমতো ওদের পারিশ্রমিক দিতে পারবে না। কারণ, তাঁর নিজের আর্থিক অবস্থা অন্যদের চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না। কোনও বাচ্চাকে খুঁজে না পেয়ে, আর নিজের গোত্রের কাছে অপমানিত হওয়া থেকে বাঁচতে হালিমা মুহাম্মদকে দেখভাল করার দায়িত্ব নেন।
পৌরাণিক কাহিনী তথা কল্পবিশেষজ্ঞরা এখানে অতিরঞ্জিত করে বলে : মক্কা যাওয়ার পথে হালিমা ও তাঁর ভ্রমণসঙ্গী বর, দুর্বল উট, ছাগল সহ অন্যান্য মহিলারা বেশ পেছনে পড়ে যায়! এতে বেশ হট্টগোল দেখা দেয়। তবে মুহাম্মদকে নিয়ে ফিরে আসার পথে দেখা যায় হালিমার গাধাটি সহ সব পশু বেশ প্রানচঞ্চল, হৃষ্টপুষ্ট ও বিস্ময়করভাবে দুধেল হয়ে উঠে। এমনকি হালিমার বক্ষ স্ফীত হয়ে তিনি নিজেই এতটাই দুগ্ধবতী হয়ে ওঠেন যে, মুহাম্মদ ছাড়াও নিজের সন্তানকে দুগ্ধদানে আর কোন সমস্যাই তাঁর হয়নি।
এসব দেখে মহিলাদের সবাই বেশ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। হালিমার বর তখন বলে বসেনঃ "হালিমা, তুমি কি জানো তোমার সাথে এক ঐশ্বরিক সৃষ্টি নিয়ে যাচ্ছ?" হালিমা প্রত্যুত্তরে বলেনঃ "ঈশ্বরের কৃপায়, আমিও তাই আশা করি"। কাফেলার অন্য নারীরা বলে ওঠে: “হালিমা ঝামেলা করো না, আমাদের জন্য দাঁড়াও”।
ইতিহাসবিদদের মতানুসারে ঐ সৌভাগ্যবান শিশু মুহাম্মদ পরবর্তী আরো দু'বছর তাদের ভাগ্য খুলে দিয়েছিল। একই গোত্রের অন্যান্য পশুদের চেয়ে হালিমার পশুগুলো বেশ পুষ্ট ছিল। এসব দেখে আশাপাশের সবাই তাদের পশুগুলোকে হালিমার পশুদের সাথে একই জায়গায় চড়াতে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। কিন্তু তাতে কিছুই হলো না! হালিমা দু'বছর পর মুহাম্মদকে দুগ্ধপান থেকে বিরত করেন এবং মক্কায় নিয়ে যান।
যদিও, হালিমা দম্পতি মুহাম্মাদকে ফেরত নিয়ে যেতে চাইছিল না পাছে তাদের সৌভাগ্য ফুরিয়ে আসে। একটি মত অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে যে, হালিমা আমিনার কাছে মুহাম্মদকে ফিরিয়ে নিতে দেরি করেন, কারণ আমিনাকে তিনি এই বলে বোঝাতে সক্ষম হন যে, মুহাম্মদ ফিরে আসলে মক্কায় আবারো প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। আরেকটি সূত্র বলছে, আমিনা নিজেই প্লেগের কথা চিন্তা করে মুহাম্মদকে আবারও তাদের সাথে পাঠিয়ে দেন।
যাযাবর শিবিরে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই মুহাম্মদ প্রথম খিঁচুনির শিকার হয়, যা তার শরীরে ও দৃষ্টির মাঝে গভীর যন্ত্রণা নিয়ে আসে। এই ঘটনা সে বুঝে উঠতে পারেনি, কখনো ভুলতেও পারেনি! পরবর্তীতে সে তার অনুসারীদের বলেছিল যে, বাচ্চাদের সাথে খেলা করার সময় তিনজন ফেরেশতা তাকে দেখা দেয়। এদের মাঝে একজন তাকে মাটিতে শুইয়ে দেয়। তারপর তার পেট চিড়ে এর মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কিছু একটা খুজঁতে থাকে। শেষে হাত বের করে নিয়ে আসে, সবকিছু ধুয়ে পরিষ্কার করে আবার তার পেতের ভেতর রাখে।
এই গল্পটি বারবার বলার একপর্যায়ে সে সবাইকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, ফেরেশতা তাকে দশজন লোকের বিপরীতে ওজন করে, কিন্তু এতে মুহাম্মদের ওজনই বেশি ছিল। পরে একশত, এমনকি একহাজার লোকের ওজনের চেয়েও মুহাম্মদের ওজন বেশি বলে ফেরেশতা দাবি করে। সে আরও বলে, ফেরেশতা নাকি সবাইকে এটাও বলে যে, পুরো সম্প্রদায়ের ওজন এক করলেও মুহাম্মদের চেয়ে কম হবে।
খিঁচুনি উঠলে, মুহাম্মদের খেলার সাথীরা তাঁবুতে গিয়ে হালিমাকে খবর দিয়ে সতর্ক করত, বলত মুহাম্মদ অস্বাভাবিক আচরণ করছে। খবর শুনে যখন পালক মা-বাবা কাছে যেত, তখন দেখতে পেত সে দাঁড়িয়ে আছে, তবে মুখটা ফ্যাকাশে। হালিমার বর বুঝে নিতেন, মুহাম্মদের এইমাত্র একটা খিঁচুনি হয়ে গেছে, আর সে ভয় পেয়েছে। প্রাচীনকালে খিঁচুনিকে শয়তানের আছর বলে ভাবা হতো। খিঁচুনি, মুখ দিয়ে ফেনা বের হওয়া, অদ্ভুত কথাবার্তা ইত্যাদির আর কি কারণ থাকতে পারে? "সম্ভবত শয়তান তাকে অল্পতে ছেড়ে দিয়েছে; আরো খারাপ কিছু ঘটার আগেই বরং তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া যাক" - হালিমার বর হালিমাকে এভাবেই বোঝাচ্ছিলেন।
মুহাম্মদকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে হালিমা দম্পতি মক্কা চলে আসেন। কিন্তু, তাদের দেখে আমিনা অবাক হয়ে তাদের এভাবে মক্কা চলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন! জানতে চাওয়ার জোরাজুরিতে হালিমা দম্পতি মুহাম্মদের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। তারা ভয় পাচ্ছিলেন, এই কারণে মুহাম্মদের উপর খারাপ কিছু না ঘটে যায়। আমিনা জানতে চাইলেন, মুহাম্মদের উপর কোনো দৈত্য/জীন ভর করেছিল কি না। আমিনার অভিব্যক্তিতে বোঝা গেল, এমন ঘটনার সাথে আমিনা পরিচিতই ছিলেন। তিনি হালিমা এবং তাঁর বরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুহাম্মাদকে তাদের সাথে মরুভূমিতে আবারও ফেরত পাঠালেন।
মুহাম্মদের উপর ঘটে যাওয়া সকল ঘটনাকে অলৌকিক ব্যাপার হিসেবে ইসলামের অনুসারীরা মনে করে; সেটা মুহাম্মদের সাথে স্বর্গীয় কারো বা কিছুর সাক্ষাতের মতো বাহ্যিক ঘটনা অথবা তার নিজের একেবারে গভীরের ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতা, যা- ই হোক না কেন।
যদিও, সকল প্রকার সাক্ষ্যপ্রমাণ, উপস্থিত অন্যান্যদের প্রতিক্রিয়া আর চিকিৎসাবিজ্ঞান দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করা যেতেই পারে যে, স্নায়বিক এই রোগ দুর্ভাগ্যবশত মুহাম্মদ বয়ে বেড়াচ্ছিল এবং এটা সম্ভবত মা আমিনা থেকেই উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া।
মুহাম্মদের ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকে জানা যায়, পালকমাতা হালিমা তাকে সারিয়ে তুলতে এক দৈবজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আর এখানেই আরেকধাপ কল্পকাহিনীর অবতারণা ঘটে, যাতে বলা হয় সেই দৈবজ্ঞ হঠাৎ তাঁর বাহু প্রসারিত করে মুহাম্মাদকে জড়িতে বলতে থাকে "ওহে আরববাসী, এসো, এদিকে এগিয়ে এসো। আল লাত, আল উজ্জার উদ্দেশ্যে এই বালককে হত্যা করো, সেই সাথে আমাকেও! সে যদি বেচেঁ থাকে, সে যদি বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত হয়, সুনিশ্চিতভাবেই তোমাদের ধর্মকে পরাভূত করবে; তোমাদের আর তোমাদের পূর্বপুরুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে এমন একটি ধর্ম সে আনতে যাচ্ছে, যা তোমরা এখনও শোনোনি, জানতেও পারোনি”।
মুহাম্মদ পাঁচ বছর বয়স অব্দি হালিমার সাথে ছিল; বিশেষ করে রোগব্যাধিতে ভোগায় হালিমা তাকে খুব কাছাকাছি রাখতেন। এভাবেই চলছিল, কোনো একদিন হালিমা দেখতে পেলেন, আকাশে কালো একটা মেঘের আচ্ছাদন মুহাম্মদকে ঘিরে রেখেছে, "মুহাম্মদ হাঁটলে ওটাও এগুতে থাকে, সে থেমে গেলে মেঘটাও থেমে যায়"। এতে হালিমা ও তাঁর বর এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, তারা মুহাম্মাদকে তাঁর জন্মদাত্রী মা আমিনার কাছে তুলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো।
মুহাম্মদকে ফিরিয়ে দেয়ার কাজটি সহজেই সম্পন্ন হয়নি। একটা সময় তাকে তার প্রকৃত মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু, একেবারে জন্মের পর থেকেই সে জেনে আসছিল হালিমাই তার জন্মদাত্রী মা। তাই, বেশ কয়েক বছর পর যখন পালকমাতা হালিমা দম্পতি মুহাম্মাদকে তার প্রকৃত জন্মদাত্রী আমিনার কাছে ফিরিয়ে দিতে চাইল তখন তার মাঝে তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া হলো। সে একজন অপরিচিত কাউকে মা বলে ভাবতে পারল না, বরং তায়েফে হালিমার গোত্রের সাথে থেকে যেতে চাইল। এমনকি মুহাম্মদ মক্কার কাছাকাছি পৌঁছলে সুযোগ পেয়ে তার পালক মা-বাবা থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেল। সবাই তার খোঁজ করতে লাগল। অবশেষে মক্কার এক উঁচু জায়গায়, মক্কা থেকে তায়েফে যাওয়ার সংযোগপথে, ওয়ারাকা তাকে খুজেঁ নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে ওয়ারাকা একটা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন, এবং নিউ টেস্টামেন্টের একটা অংশ আরবিতে অনুবাদ করেন।
তবে, মক্কা থেকে তায়েফে যাওয়ার পথে মুহাম্মাদ কান্না করেছিল কিনা, কিংবা সে কি উদ্ভ্রান্তের মতো তায়েফের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল কিনা, তাঁকে ওখান থেকে ধরে আনতে জোরাজুরি করতে হয়েছিল কিনা, নাকি তাকে তার মতোই যেতে দেয়া হয়েছিল তা আর জানা যায়নি!
ওয়ারাকা মুহাম্মাদকে মন্দিরে তার দাদার কাছে নিয়ে আসলেন। সেখানে আব্দুল মুত্তালিব তাকে কাঁধে নিয়ে মন্দিরের চারপাশে ঘুরলেন, তার জন্য প্রার্থনা করলেন। অবশেষে তাকে আমিনার কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।
মায়ের কাছে আসার একবছর পর মা আমিনার মৃত্যু হলে মুহাম্মদ আবারও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়। মুহাম্মদের মা মুহাম্মদকে সাথে নিয়ে মক্কার উত্তরে দশদিনের ভ্রমণ-দূরত্বের শহর ইয়াছরিবে মুহাম্মদের মামার সাথে সাক্ষাত করতে যান। এরপর আবিসিনিয়ার দাসী বারাকা সহ মুহাম্মদ ও তার মা দুটি উটের পিঠে চড়ে ওই স্থান ছেড়ে চলে যান। তারা একমাস আত্মীয়ের বাসায় থাকেন। মুহাম্মদ পরে বলেছিল, এই আত্মীয়ের বাসায় কিভাবে সে ওখানের একটা পুকুরে সাঁতার কেটেছিল, বাচ্চাদের সাথে খেলেছিল, পায়রা উড়িয়েছিল। সেখানেই মুহম্মদকে তার বাবা আব্দুল্লাহর কবর দেখানো হয়। ফিরতি যাত্রাপথে মুহাম্মদের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ইয়াছরিবের দক্ষিণে আল আবওয়া শহরে মৃত্যবরণ করেন। আমিনাকে ওখানে কবর দেয়ার কথা ছাড়া আমরা আর তেমন কিছু জানা যায়নি। পরবর্তীতে দাসী বারাকা মা-হারা এতিম মুহাম্মাদকে মক্কায় নিয়ে আসে। সেখানে সে তার দাদা মুত্তালিবের প্রহরী হয়। আমরা জানিনা, মৃত্যুর সময় মুহাম্মদ তার মায়ের কাছে ছিল কিনা।
তবে মৃতদেহকে কাপড়ে জড়িয়ে, মাটির গভীরে কবর দিয়ে পুনরায় মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে সে নিশ্চয়ই দেখেছে। আমরা কেবলমাত্র তার ভেতরের তীব্র শোক, আবেগ, দুমড়ে মুচড়ে যাওয়াটাই উপলব্ধি করতে পারি। ফিরে পাওয়া আর পুনরায় হারিয়ে ফেলার দোলাচলে শিশু মুহাম্মদ যেন দুলতে থাকে।
দাদার আশি বছর বয়সে মুহাম্মাদ তাঁর কাছে আসে। দাদা আর মাত্র দুই বছর বেঁচেছিলেন। সম্ভবত জন্মের প্রথম ছয়টি বছর কাছে না পাওয়ায়, তিনি মুহাম্মদকে খুবই স্নেহ করতেন, তাঁর নিজের সন্তানদের চেয়েও বেশি। মুহাম্মদের দাদা তাকে "আমার ছেলে" বলতেন। বয়স বাড়তে থাকলে ছেলেরা তাকে মন্দিরের মেঝেতে দিনের বেলায় বিশ্রাম নিতে মাদুর বিছিয়ে দিত। আব্দুল মুত্তালিবের ছেলেরা তাঁর বিছানার কাছাকাছি বসে থাকত, যতক্ষণ না তিনি ওখানে আসতেন। মুহাম্মদ ছাড়া আর কেউ বিছানার উপর বসার সাহস করত না। আর মুহাম্মদ নিজেকে সৌভাগ্যবান ভেবে, দাদা এসে না থামানো পর্যন্ত এক পা তুলে বিছানার উপর লাফাতে থাকত, যাতে তার চাচারা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। লাফানো শেষে মুত্তালিব তাকে পাশে বসিয়ে আদর করে পিঠ চাপড়ে দিতেন।
মন্দিরের হর্তাকর্তা আর জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে মুত্তালিব মন্দিরের ইতিহাস, শৌর্যবীর্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি মুহাম্মদকে মন্দিরের গুরুত্বের কথা বলে গেছেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে বেদিতে স্থাপন করা দেবতাদের পাথর আর কাঠের প্রতিমূর্তিগুলো সম্পর্কেও অবহিত করেছেন। মন্দিরের প্রাত্যহিক কাজেও দাদা মুত্তালিব মুহাম্মদকে সাথে নিয়ে যেতেন। বয়স ও অভিজ্ঞতায় ঋগ্ধ মুত্তালিব একটা সময় কেবল প্রশাসনিক কর্মকর্তার মতো মন্দিরে অন্যান্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকতেন। এছাড়াও, তীর্থযাত্রার মৌসুমে পুন্যার্থীদের খাবার, পানীয় জলের ব্যবস্থা ইত্যাদির দিকেও নজর রাখতেন। পুরোহিতের মতো প্রার্থনাকালীন সময়ে মন্দিরের চারদিকে প্রদক্ষিণ করার নেতৃত্বেও তিনি থাকতেন।
এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, মুত্তালিব যতদিন বেচেঁ ছিলেন, বাৎসরিক ধর্মীয় রেওয়াজ, আচার-অনুষ্ঠান ঘিরে আয়োজিত বিশাল কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রব্যক্তি ছিল এই মুহাম্মদ; মন্দিরের প্রাত্যহিক কাজের কথা তো বলাই বাহুল্য। যা পরবর্তীতে তার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
মুহাম্মদের বয়স যখন আট বছর তখন তার দাদা মুত্তালিব মারা যান। ধর্মীয় নেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায়, মৃত্যুর পর যথাযথ মর্যাদার সাথে তাঁর শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যেখানে শহরের গন্যমান্য নেতাদের সমাবেশ ঘটে। মুত্তালিবের ছয় মেয়ের প্রত্যেকেই মৃত্যুর আগে তাঁর জন্য প্রশস্তিসূচক কবিতা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ করেছিল, এতে আব্দুল মুত্তালিবের চোখে জল চলে এলো। সেই একই কবিতা তাঁরা কবরের পাশে দাঁড়িয়েও পাঠ করল। মুহাম্মদ তার দাদার কফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে কান্না করতে লাগল। এই অল্পবয়সে আরও একবার জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও ভোগান্তিতে সে শোকাভিভূত হয়ে পড়ল।
যদিও মুত্তালিবের প্রভূত ক্ষমতা ও সম্মান ছিল, তা সত্ত্বেও মৃত্যুর পর অসংখ্য বংশধরদের জন্য তেমন কিছুই রেখে যেতে পারেননি। মুহাম্মদ সেই অভাবগ্রস্তই রয়ে গেল। মক্কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো কুসাইর সময়ের চেয়ে পাল্টে গেল, যখন ধর্মীয় ও প্রগতিশীলতার সকল ক্ষমতা এক ব্যক্তির মাঝে অর্থাৎ কুসাইর হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কয়েক প্রজন্মের ধারাবাহিকতায়, কুসাইর পৌত্র আবদ শামস ও তাঁর পুত্র উমাইয়ার উত্তরসুরী ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক সাফল্য তাদের ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক করে তোলে। অপরদিকে মন্দিরের দেখভাল, প্রার্থনা ইত্যাদি করতে থাকা হাশিমের বংশধরদের আয়- রোজগার ও প্রভাব ক্রমেই কমতে থাকে। নগরীর প্রশাসনিক ও সামরিক নেতৃত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ পদসমুহ ব্যবসায়ী পরিবারের হাতে ছিল। বিদেশ হতে বাণিজ্য কাফেলায় নিয়ে আসা মুদ্রার বস্তা আর মূল্যবান দ্রব্যাদির তুলনায়, তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা একেবারেই নগন্য ছিল। মন্দির থেকে শুরু করে কুরাইশ পরিষদের সভাকক্ষ পর্যন্ত আব্দুল মুত্তালিবের উল্লেখযোগ্য অবস্থান ছিল। কিন্তু সম্পদশালী অন্যান্য সভাসদের ভিড়ে তিনি ছিলেন বড়ই একা।
আব্দুল মুত্তালিব মারা যাওয়ার আগে, মুহাম্মদের দেখভাল করার দায়িত্ব তার বড় ছেলেদের একজন আবু তালিবের কাছে তুলে দেন। ছোট ভাই আব্বাসের কাছে হস্তান্তরের আগ পর্যন্ত, আবু তালিব ছোট করে মন্দিরের দেখাশোনা করত। আদি গ্রন্থে আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমাকে ভালো মনের মানুষ বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়ে থাকে, তারা বেশ উদারহস্তেই মুহাম্মদের দেখাশোনা করত। সম্ভবত তারা অন্যদের চেয়ে বেশ ভালো করেই জানত যে, মুহাম্মদ ছোটবেলা থেকেই অবহেলা, বঞ্চনার শিকার। ইতিমধ্যে তাঁরা তার খিঁচুনি তথা মৃগীরোগ সম্পর্কে জেনে গেছে। তাই দয়াপরবশ হয়ে তারা দুহাত দিয়ে মুহাম্মদকে আগলে রাখত শয়তানের আছর থেকে বাঁচাতে। চাচী ফাতিমা পরবর্তীতে তাঁর মা হয়ে ওঠেন। মুহাম্মদ ফাতিমার এই উষ্ণ স্নেহ-মমতার কথা মনে রেখেছিল।
বালক মুহাম্মদের উপর বয়ে যাওয়া নানান মানসিক আঘাত আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্নায়ুরোগের ফলশ্রুতিতে, সে অনেকটাই অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্বের এবং সেই সাথে অতিশয় লাজুক, ভদ্র ও শালীন আচরণের অধিকারী হয়ে উঠে। দিনের অধিকাংশ সময় সে পাহাড়ের ঢালে চাচাদের ও পরে ভাড়ায় ছাগলের পাল চড়িয়ে কাটাত। পশু চড়ানো ছিল একেবারেই নিরীহ একটা পেশা, মক্কার একেবারে প্রান্তিক হতদরিদ্র লোকদের মাঝে এটার প্রচলন ছিল। তাকে খুব সামান্যই বেতন দেয়া হতো। কখনো বা ঝাউগাছের বীজ, বা কখনো মরুর ঝোপঝাড় থেকে তুলে আনা কালো ফল দিয়েই তার খাবাবের চাহিদা মিটত। পাহাড়ের উপরে উঠে সে যখন নিচে শহরের কেন্দ্রে ছাদবিহীন মন্দির, সকলের ব্যস্ততা, ছুটোছুটি, নদীর দু'পাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শহরের স্বচ্ছল অধিবাসীদের পাথর আর মাটির তৈরি কয়েকতলা বাড়িগুলো দেখত। কিংবা অন্যদিকে পাহাড়ের গা বেয়ে তৈরি করা দরিদ্রদের কাদামাটির কুঁড়েঘর দেখতে পেত, তখন সে ভাবত যদি কখনো নিজের ভাগ্য ফেরানো যায়, নিজের অবস্থা উঁচুতে তোলা যায়! পরবর্তীতে সে তার অনুসারীদের কাছে এই বলে মুখরক্ষা করেছিল যে, এ যাবৎ আসা সকল নবীই ছাগল চড়িয়েছে।
আদিগ্রন্থে মুহাম্মদের তরুণ বয়সে আরো দুটি খিঁচুনির বিবরণ পাওয়া যায়। এর একটিতে দেখা যায়, কোন এক রাতে সে তার ছাগলগুলো আরেকজন পশুপালকের জিন্মায় রেখে ফুর্তি করার জন্য শহরের একটা বাজে জায়গায় মদের সরাইখানায় যায়। কিন্তু, শহরের উপকন্ঠে পৌঁছাতেই দুর থেকে গানবাজনার শব্দ তার কানে আসে। তখন সে গান শুনতে ওখানেই বসে পড়লো। একপর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকে। পরদিন সকালে যখন তার জ্ঞান ফিরে, সূর্যের আলো এসে ততক্ষণে তার মুখ ঝলসে দিচ্ছিল। আরো একবার এধরনের ঘটনা ঘটল, সেবারও একই গান সে শুনতে পেল। মুহাম্মদ তার এই মুর্ছা যাওয়াকে ঐশ্বরিক ইচ্ছে হিসেবেই প্রচার করেছে, যেখানে অসভ্যতার নিকৃষ্টতম স্তরে পতিত হওয়া থেকে সে দৈবশক্তির ইচ্ছায় বেঁচে গিয়েছিল। তুর্কি বংশোদ্ভূত নিউরো সাইকিয়াট্রিস্ট দ্যদে কারকুট (Dede Korkut) এর ভাষ্যমতে, মুহাম্মদের এই সমস্ত ঘটনাবলী ছিল মূলত মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব নামক একটা বিশেষ অংশের বিচ্যুতি হতে সৃষ্ট শ্রবণজনিত ভ্রম। (১৫)
তরুণ অবস্থায়ও মুহাম্মদ অন্তত একটি বড় কাফেলায় সফর করেছিল। কয়েকটি সূত্র থেকে জানা যায়, বারো বছর বয়সেই মুহাম্মদ তাঁর চাচার সাথে, বিশাল সংখ্যক ব্যবসায়ী নিয়ে দক্ষিণ সিরিয়ার বসরা নগরীর উদ্দেশ্যে বাণিজ্য অভিযানে বের হয়। শুরুতেই এই যাত্রায় মুহাম্মদকে নেয়া হয়নি। কিন্তু আবু তালেব কাফেলা নিয়ে চলা শুরু করতেই মুহাম্মদ তাঁর পা ধরে রাখে ও তাঁকে নিতে আকুতি জানায়। সফরে যাওয়ার জন্য মুহাম্মদের যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, আসলে সে তাঁর চাচা আবু তালেবের কাছ থেকে আরো তিনমাস দূরে থাকতে চাইছিল না। এদিকে আবু তালেবের মন গলল, আর মুহাম্মদ সুউচ্চ উটে তার চাচার পেছনে গিয়ে বসলো। এরপর উত্তরের পথে যাত্রা শুরু হলো।
আল্লাহর নবী হিসেবে মুহাম্মদের ভবিষ্যত মহানুভবতার ধারণা দিতে, পরবর্তী লেখকেরা এই সফরকে ভিত্তি হিসেবে ধরে নেয়। বিদগ্ধ খ্রিস্টধর্মযাজক বাহেরা (Bahira) এটা উল্লেখ করেছেন। যাত্রাপথে একটা সন্ন্যাসী মঠের সামনে মুহম্মদের কাফেলা এসে পৌঁছলে, সফরসঙ্গীদের ভীড়ের মাঝে মুহাম্মদকে খুঁজে পেতে বাহেরা ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগল। কথিত আছে, এই বাহেরার হাতে পূর্বসূরিদের কাছ থেকে পাওয়া একটা পবিত্র গ্রন্থে, একজন নবীর আগমনের বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছিল। আর মুহাম্মদই সেই নবী, যে তাঁর সামনে এসে উপস্থিত! "এই সে বিশ্বের অধীশ্বর, বিশ্বের বুকে প্রেরিত পুরুষ, যাকে ঈশ্বর আমাদের প্রতি দয়া করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন"-বাহেরা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগল। "পর্বতের চুড়া পার হয়ে আসার সময় আমি টের পেলাম যে, এই কাফেলার মাঝেই নবী মুহাম্মদ আছে"-- হতচকিত হয়ে পড়া সফরসঙ্গীদের বাহেরা বলতে লাগল। এমন কোন পাথর বা বৃক্ষরাজি ছিল না, যারা মুহাম্মদের উদ্দেশ্যে সেজদা করেনি। এরপর বাহেরা আবু তালেব সহ সবাইকে ইহুদিদের ব্যাপারে সতর্ক করে দিল। বাহেরা বলল, ইহুদিরা মুহাম্মদের খবর জানতে পারলে ওর অনেক ক্ষতি করবে।
ঠিক এই মুহুর্তে, বিপুল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এক ঘোড়সওয়ারী তাদের দিকে আসতে লাগল। তবে, বাহেরা তাঁকে পটিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন। এই কাহিনীর আরেকটি জায়গায় উল্লেখ আছে, সেই ধর্মযাজক পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন।
পৌরাণিক কল্পকাহিনীর বাইরে চিন্তা করলে দেখা যায়, এই সফর মুহাম্মদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যলাভের উৎস ছিল বলা যায়। উত্তর দিকে চলতে থাকা এই সফর তাঁকে মৃত সাগরের দিকে নিয়ে থাকতে পারে। যাত্রাপথে সে দেখতে পেয়েছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত রোমান শাসন, পরিত্যক্ত কাফেলার অনেক নগরী, মানুষের গৌরবহীন ক্ষণস্থায়ী জীবনের বাস্তবতা। এই সফরের প্রতি পদে পদে ছিল শিক্ষার উপকরণ। মক্কার ব্যবসায়ীদের রাতের বেলায় গোলাকার চক্রের মতো তাদের উটকে ঢেকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করা, পেট্রা নগরীর পথে যেতে যেতে পাথরের দেয়ালে প্রাচীন শ্মশানগুলো কিংবা জেরুজালেমে রোমানদের পরিত্যক্ত মুক্তমঞ্চ, সেইসাথে এসমস্ত স্থানের ইতিহাস নিয়ে, বহু বৃদ্ধ আর অভিজ্ঞ বণিকদের নানান রকম গল্প বলা ----. সবটাই ছিল শিক্ষার উর্বর ক্ষেত্র। রাতের বেলায় তাবু খাটিয়ে চামড়ার বালিশে মাথা রেখে শুয়ে, আর আগুন জ্বেলে সবাই মিলে বসে আড্ডায় এইসব জায়গা নিয়ে নানারকম আলাপ ছাড়া আর কিইবা তাঁর করার ছিল। যখন তারা সফর শেষে বসরায় পৌছালো, সেখানকার প্রাচীন গির্জা আর আরব খ্রিস্টানদের দেখতে পেয়ে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছিল।
নয়নাভিরাম গির্জা, ঘণ্টার ধ্বনি, সাথে কালো লম্বা পোষাকে আবৃত যাজক পাদ্রিদের সমবেত প্রার্থনা সে দেখেছিল। সেখানে কি সে ধর্মীয় বাণী শুনেছিল? খ্রিস্টীয় কোন নবীর আগমন-বার্তা পেয়েছিল? বিখ্যাত ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর (William Muir) এর ভাষ্যমতে, মুহাম্মাদের কাছে সবচেয়ে মনে দাগ কাটার বিষয় ছিল: "তাঁরই মত দেখতে, আরবের সকল গোত্র, সম্প্রদায়ের সবাই একই ধর্মীয় রেওয়াজ ও রীতিনীতি পালন করছে "।
মুহাম্মদের মক্কায় ফিরে আসার সময়কালে, আঞ্চলিক গোত্রসমূহের মধ্যকার খন্ডযুদ্ধ দানা বেঁধে উঠে, যা দক্ষিণ-পশ্চিম আরবের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করেছিল। এই বিরোধের সূত্রপাত ঘটে মক্কা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পূর্বে, ওকায নামক মেলায়। প্রতি বছরের শরতে, এই মেলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক আয়োজনে সমগ্র আরববাসীর সমাগম হতো এখানে।
নিষিদ্ধ মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে, মক্কা ও তায়েফের আল-লাত সহ অন্যান্য পবিত্র স্থানসমুহে তীর্থযাত্রার আগে আগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হতো। ঘোড়া, উটের দৌড় প্রতিযোগিতা সহ কবিতা পাঠের আসর এই মেলার অংশ ছিল। এটা সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, বাজিকর, শারিরীক কসরতকারী ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের মিলনমেলা ছিল। দাসদাসী সহ যেকোনো প্রাণী বা জিনিস এখানে বেচাকেনা হতো। খ্রিস্টধর্মের প্রচারকরা এখানে সবার সাথে মিশে যেত, আর আগ্রহীদের যিশুখ্রিস্টের বাণী প্রচার করত। এটা বিশ্বাস করা হয় যে, এই আসরে মুহাম্মদ নাজরান থেকে আগত এক বিখ্যাত খ্রিস্টীয় বিশপের ধর্মপোদেশমূলক বক্তৃতা শুনতে পেয়েছিল। একদিন মেলায় ঋণগ্রস্ত উগ্র স্বভাবের বদমেজাজি এক লোকের আগমন ঘটল। তাঁর কাছে অন্য গোত্রের একজন ধার নিয়ে ফেরত দেয়নি। পরে লোকটা মেলায় একটা বানর বিক্রি করতে এসেও ঠকেছে, ক্রেতা তাঁর টাকা দিয়ে যায়নি! তাই সে ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল: "আমি যার কাছে যে টাকা পাই, তাঁর বানরের সাথে আমার বানর কে অদলবদল করবে "?
অথবা বলা হয়, কোন এক পরিস্থিতিতে সে দেনাদার আর তাঁর দশ পূর্বপুরুষদের অভিশাপ দিতে লাগল। একপর্যায়ে অন্য একজন ব্যক্তি তরবারি বের করে তাঁর বানরটির মাথা কেটে ফেলল। এরপর সেখানে তরবারির ঝনঝনানি ও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার শুরু হয়। যদিও বিবাদের প্রকোপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছিল, কিন্তু পরে আবারও সে বছরই এক গোত্রের সাথে অন্য গোত্রের আরেক সংঘাত দানা বেঁধে উঠে। এর প্রতিটাই ছিল পবিত্র মাসের পবিত্রতা মেনে চলার রেওয়াজের সুস্পষ্ট লংঘন। আরেকটা সংঘাতের শুরু হয়েছিল এভাবে - কোন এক বাচাল, আর সম্ভবত মাতাল কবি অন্যান্য গোত্রের লোকদের পরিহাস করে বলছিল যে, সারা আরবে তাঁর গোত্রটিই সেরা। তখন অপমানিত গোত্রের একজন এসে তাঁর উপর তলোয়ার চালিয়ে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে আরেকটি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের সৃষ্টি হয়। অন্য আরেকটি অসন্তোষের ঘটনা ঘটে, যখন এক লাবণ্যময়ী যুবতীকে অন্য গোত্রের ছেলেরা অপমান করে। ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল এভাবে যে, যুবতী মেয়েটি ঐ ছেলেদের আপত্তিকর আহবান সাড়া দেয়নি, আর তাদের কথামতো মুখের সামনের আবরণ খুলে চেহারা দেখাতে অসম্মতি জানায়। এর বদলা নিতে ছেলেগুলো মেয়েটার অজান্তেই তাঁর জামার পেছনের অংশ মাটির সাথে আটকে দেয়। ফলে মেয়েটি বসা অবস্থা থেকে দাঁড়াতে গেলে শরীরের নিন্মাংশ অনাবৃত হয়ে পড়ে। ছেলেরা জোরে হেসে বলতে থাকে তুমি তোমার মুখ আমাদের দেখতে দাওনি, আর এখন তোমার শরীরের পেছনটা আমরা দেখে নিলাম
তলোয়ার বের করে ঐ মেয়েটার গোত্রের লোকজন তখন বখাটে ছেলেগুলোকে শায়েস্তা করতে আসে। এরকম প্রতিটি সংঘাতে গোত্রের অধিপতিদের হস্তক্ষেপে রক্তপাত বন্ধ করা হতো। ব্লাড মানির বিনিময়ে মৃতের বা অঙ্গহানির ক্ষতিপুরণ নেয়া হতো। এগুলো ছিল পবিত্র মাসের নিয়মনীতির মারাত্মক লংঘন। তা সত্ত্বেও, সেসব মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো, কারণ মেলায় পূর্বপরিকল্পিত না হয়ে সংঘাতগুলো স্বতস্ফুর্ত বিবাদ থেকেই হতো। ওকায মেলায় (Ukaz) সবারই আর্থিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থ জড়িত ছিল, কিন্তু সেটা রক্ষার জন্য নিয়মকানুন মেনে চলারও দরকার। নেতৃবৃন্দ পরে সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভবিষ্যতে ওকাযে অংশ নিতে আসা সবাইকে মেলায় প্রবেশের পুর্বে তাদের অস্ত্র, মেলা কমিটির কাছে জমা দিতে হবে।
অবশ্য এই নতুন নিয়মও পবিত্র মাসে সংঘটিত চতুর্থ আর সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাতকে আটকাতে পারেনি। শুরুটা হয়েছিল একটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে, যেখানে দুটি প্রধান গোত্রের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়, আর তরুণ মুহাম্মদও তাতে জড়িয়ে পড়ে। একটা প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল। কুরাইশ গোত্রের সহযোগী কিনানা গোত্রের কোনো এক লোক যার সাথে আবার কুরাইশ নেতাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল সে অন্য এক বেদুঈন নেতাকে হত্যা করে, কারণ ঐ বেদুঈন নেতা হেরার রাজার সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে কিছু পণ্য ওকাযের মেলায় পরিবহনের এক লোভনীয় প্রস্তাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। এ কারণে কাজটি কিনানা গোত্রের হাতছাড়া এবং তাতে কিনানা গোত্রের লোকটি অপমানিত বোধ করে এবং তাঁর সম্মানে লাগে। সম্ভবত, একদল সহযোগী নিয়ে সে তাঁর হতভাগা শত্রু হাওয়াজিন গোত্রের (Hawzin) এক বংশধরের উপর চড়াও হয়। সে তাঁকে হত্যা করে, আর যে বাধা দিতে আসে তাকেও হত্যা করে। সে নিহতের সব পণ্য চুরি করে ও পালিয়ে খাইবারে চলে যায়। কিন্তু, ওকায থেকে বের হয়ে যা যা হয়েছিল তা জানিয়ে সে কিনানা আর কুরাইশ নেতাদের কাছে বার্তা পাঠায়।
কুরাইশ নেতারা ততক্ষণাৎ এসবের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে মিটিং ডাকল। তাদের গোত্রীয় নীতি ছিল এমন : "আমরা সবাই একজনের জন্য (লড়ব) আর একজন সবার জন্য (লড়ব)"। যদিও এতে তাদের কোন হাত ছিল না, তবুও পবিত্র মাসে এই নিকৃষ্ট হত্যাকান্ডের কারণে তারা শক্তিশালী হাওয়াজিনদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। হত্যাকারী ছিল কিনানা গোত্রের, কিন্তু কুরাইশরাও কিনানা গোত্রের সহযোগী ছিল। তাই তাঁরা কিনানাদের সমর্থন দিয়েছিল। অপ্রস্তুত অবস্থায় উভয় গোত্র দ্রুত তাদের পণ্যসামগ্রী, তাঁবু আর পরিবারকে উটের পিঠে তুলে নিল। শেষমেশ ধাওয়া খেয়ে উভয় গোত্রই মক্কার পবিত্রভূমির দিকে দৌড়ে পালায়।
পবিত্র ভূমিতে আসার পর কিনানা ও এর সহযোগী কুরাইশরা পলায়নকারীদের উপহাস করতে লাগল। তারা জানত, ধাওয়াকারীদের এতটা সাহস নেই যে পবিত্রভূমির সীমানা লঙ্ঘন করে তাদের আক্রমণ করবে। দু'পক্ষই পরবর্তী বছরে একটা নিরপেক্ষ জায়গায় যুদ্ধ করতে সংকল্প ব্যক্ত করল। তাদের যুদ্ধের কারণে ওকায মেলা বাতিল হয়ে গেল। দুই বৃহৎ শক্তির অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর মধ্যকার চুড়ান্ত যুদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত, পরবর্তী চার-পাঁচ বছর ধরে বিচ্ছিন্ন লড়াই ও খন্ডযুদ্ধ চলতে লাগল। মুহাম্মদ তীরন্দাজ হিসেবে দক্ষতার সাথে প্রতিপক্ষের উপর তীর নিক্ষেপ করত। যুদ্ধক্ষেত্রে দু'পক্ষের বিরাট সংখ্যক সৈন্যদের মৃতদেহ পড়ে থাকায় নেতারা যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নিল। যুদ্ধশেষে উভয় পক্ষের মৃতদেহ গননা করে দেখা গেল কুরাইশদের নামমাত্র সৈন্য নিহত হলো। তাদের অপেক্ষা অতিরিক্ত মৃত সৈন্যদের সংখ্যা হিসেব করে তারা বিপক্ষ দলের ক্ষতিপুরণ দিল ।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে, মুহাম্মদ যুদ্ধক্ষেত্রে চৌকষ সামরিক দক্ষতা অর্জন করেছিল। বিভিন্ন যুদ্ধ শেষে, অভিজ্ঞ বয়োবৃদ্ধ সেনাপতিদের সাথে আলাপ করে মুহাম্মদের সামরিক জ্ঞান বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিল, যা যুদ্ধের মাধ্যমে পরবর্তীতে তাঁর শাসন বিস্তৃত করার কাজে ভুমিকা রেখেছিল।
যখন আব্রাহা ও তাঁর আবিসিনীয় সৈন্যরা মক্কাভিমুখে যাত্রা করেছিল বিখ্যাত সেই "হস্তি যুদ্ধের" বিশ বছর পর চুড়ান্ত এক ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। আব্দুল মুত্তালিবের কয়েক ডজন নাতি-নাতনিদের মধ্য অন্যতম মুহাম্মদের বয়স ছিল তখন বিশ। কিন্তু মুহাম্মদ ছিল এতিম, দরিদ্র হাশিমী বংশের একজন ধারক মাত্র। এছাড়া মক্কাবাসীর কোন কর্মকাণ্ডে সে আসলে গোনায় ধরার মতো কেউ ছিল না।
বিয়ের পর সবকিছুই পাল্টে যায় ।