অধ্যায় ৬ মক্কার একীভূত একেশ্বরবাদ
যদি তুমি নবী হতে চাও, তোমাকে কিছু বলতে হবে।
মুহাম্মদের শক্তিশালী স্নায়বিক অভিজ্ঞতা, আর পরবর্তীতে ঈশ্বর কর্তৃক নবী মনোনীত হবার বিশ্বাস, তাঁকে ধর্ম বিষয়ে আরো বেশি না জানার সংকটে ফেলে দেয়, যার ফলে ধর্মের সাধারণ কথাগুলো জানতে, তাঁর বেশ কয়েকবছর সময় লেগে যায়। ধর্মীয় জ্ঞান সংগ্রহের শুরুটা হয়েছিল আগে থেকেই, যখন ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মানুসারী বিদেশি বণিকদের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে, আর মক্কায় সেইসব ধর্ম পাঠ করা বন্ধু, বিশেষ করে জায়েদ ও ওয়ারাকারের সান্নিধ্য তাঁকে সাহায্য করেছিল। পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশার মাধ্যমে, তাঁর নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে, যারা তাঁকে বৃহত্তর অর্থে একেশ্বরবাদের ধারণা পেতে সাহায্য করেছে। তাঁর মাঝে কিছু কিছু বিষয় কোরানের মতবিরোধী হয়ে উঠে। এই সবকিছুই মুহাম্মদকে মিশ্র ধারণা দেয়। ইতিমধ্যে তিনি জায়েদিজমে (Zaydism) বিশ্বাসী ছিলেন। আর এখন, নবী হিসেবে ঈশ্বর তাঁকে বিশেষ কাজে পাঠিয়েছেন---এই বিশ্বাস তাঁকে নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রতিষ্ঠায় আরো গুছিয়ে উঠতে উজ্জীবিত করেছিল।
জায়েদের একেশ্বরবাদ বিষয়ক চিন্তাভাবনা, মুহাম্মদের কাজকে সহজ করে একটা কাঠামো হিসেবে কাজ করেছিল, যেখানে জায়েদ দেখিয়েছিল, আব্রাহামের মূল একেশ্বরবাদী ধর্মের বাণী থেকে সরে গিয়ে, ইহুদি ও খ্রিস্টীয় ধর্ম কিভাবে স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি করেছিল।আব্রাহামের উপাস্য এক ঈশ্বর ছাড়া, আর কোনো ঈশ্বর ছিল না, তিনি ছিলেন সমস্ত সৃষ্টির সূচনাকারী এবং নিয়ন্ত্রণকারী। তিনি দেখিয়েছেন, কিভাবে ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে, কঠিনতম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে, আব্রাহামের ঈশ্বরে অবিচল বিশ্বাস রাখতে হয়।
জায়েদ ইহুদি ও খ্রিস্টান বিশ্বাসের সংমিশ্রণে যেই কবিতা লিখতেন, মুহাম্মদ প্রথম দিকে সেগুলো তাঁর ধর্মে ব্যবহার করেছিলেন। এটির মূলত দুটো ভিত্তি ছিল: সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ স্রষ্টার বিরুদ্ধে অপরাধকে পাপ বলে বিবেচিত হওয়া, এবং পরকালের বিশ্বাস, যেখানে পুরষ্কার হিসেবে রয়েছে স্বর্গপ্রাপ্তি বা শাস্তিস্বরূপ জাহান্নাম। মুহাম্মদ মৃতদেহের পুনরুত্থান এবং সৃষ্টিকর্তার সামনে পাপ-পুণ্যের হিসেবের জন্য দাঁড় হবার মতবাদের ধারণাগুলি গ্রহণ করেছিলেন। এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রতি বাধ্যতা বা অবাধ্যতার ভিত্তিতে পুরষ্কার বা শাস্তির সিদ্ধান্ত নেবেন। মুহাম্মদের এই মতবাদে, সবচাইতে গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হতো, যখন কেউ আসল ইশ্বরের জায়গায় মিথ্যা দেবতাদের পূজা করত।
মুহাম্মদ এই সিদ্ধান্তেও উপনীত হয়েছিলেন যে, পুনরুত্থিত দেহটি শারীরিক হতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে কীভাবে জাহান্নামের শাস্তি দেয়া হবে কিংবা স্বর্গের পুরষ্কারগুলি মৃতব্যক্তি কীভাবেই বা উপভোগ করবে? যেহেতু মুহাম্মদের কল্পনার ঈশ্বর সবকিছু সৃষ্টিতে সক্ষম, মৃত্যুর পরেও তিনি অবশ্যই মানুষকে শারীরিক আকারে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম। এই ধারণাগুলির মধ্যে মূল কথাটি হচ্ছে, মুহাম্মদ মনে করতেন তাঁর দাবিটিই একমাত্র সত্য দাবি এবং তাঁর সৃষ্টিকর্তা স্পষ্ট আরবি ভাষাতেই বাণী পাঠাচ্ছেন।
আরব পৌত্তলিকদের কাছে পাপ ও পরলোক নিয়ে ধারণা ছিল ভিন্ন। তাদের কাছে পাপ বলতে গোত্রের রীতিনীতি লঙ্ঘন করাকে বোঝাত। তাদের সেই রীতিনীতি লঙ্ঘন করলেই তার পরিণতি সাথে সাথেই ভোগ করবে, এমনটাই তারা মনে করত। একজন অবশ্যই দেবতাকে ক্রুদ্ধ করতে পারে, তবে পরিণতিগুলিও অস্থায়ী ছিল। তাদের দেবতারা অদৃশ্য রাজ্যে বাস করতেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের উপর তারা একটি রহস্যময় প্রভাব ফেলতেন। তারা যেমন ভালোবাসার সত্ত্বা ছিলেন, ঠিক তেমনি ছিলেন ভয়ংকর হস্তক্ষেপকারী। যদি কেউ দেবতাদের ক্রোধান্বিত করে, তাহলে তাকে অবশ্যই জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে, তবে তা ভোগ করবে এই জীবনেই। পৌত্তলিকরা দেবতাদের আশীর্বাদ প্রাপ্তির জন্য উপাসনা করত এবং প্রায়শ্চিত করে শুদ্ধ হবার জন্য রক্ত (কোরবানি) ত্যাগ করত। পৌত্তলিকরা পরকালীন বিশ্বাস বলতে তাদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে বুঝত, পরকালীন পুরষ্কার বা শাস্তিতে নয়। এটি ছিল একটি অনির্ধারিত অবস্থা। তাদের পরকালীন বিশ্বাসের নমুনা দেখতে পাওয়া যেত যখন কেউ মারা যেতেন, ওই মালিকের প্রিয় উটকে তার কবরের উপর বেঁধে রাখতেন। এটি ছিল তাদের পুরনো প্রথা। প্রচন্ড রোদে যখন উটটি তৃষ্ণায় মারা যেত, তখন মনে করা হতো মৃত লোকটি স্বর্গে যাবে। পৌত্তলিক আরবরা তাদের কবিতার মধ্য দিয়ে বংশধরদের হৃদয়ে বাস করতে চাইতেন, এভাবে তারা স্থায়ী খ্যাতির মাধ্যমে অমরত্ব চাইতেন।
অলীক বার্তা শোনার পর মোহাম্মদের ভেতর যে গুরুতর উদ্বেগের তৈরি হতো, তা থেকে স্বস্তি পেতে তিনি ক্লান্তিকর পরিশুদ্ধি এবং প্রার্থনার নিয়ম তৈরি করেছিলেন, যা পরবর্তীতে তাঁর ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। তিনি বলেছেন, তিনি যখন হেরা পর্বতের পাদদেশে ছিলেন তখন ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁর কাছে মানুষের রূপে উপস্থিত হয়ে তাঁকে এই কাজ শিখিয়েছিলেন। ইসলামিক ইতিহাসে পাওয়া যায়, ফেরেশতা জিব্রাইল তাঁর পায়ের গোড়ালি মাটিতে পুঁতে দেন, যেখান থেকে একটি ঝর্ণার সৃষ্টি হয়। ওখান থেকে জল ব্যবহার করে ফেরেশতা তাঁকে পবিত্রতা শেখান যে, এইভাবে করলে তাঁর উপাসনা সর্বশক্তিমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। অতঃপর জিব্রাইল তাঁর সামনে নামাজ আদায় করেন, ঠিক যেভাবে করলে তাঁর নামাজ কবুল হবে (১)। ওযুর মাধ্যমে পুতপবিত্র করার নিয়ম শুরু হয় হাত এবং মুখে ধোয়া দিয়ে; নাকে জল ঢুকিয়ে শ্বাস নেয়ার মাধ্যমে নাসিকা পরিষ্কার করা এবং প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের করা, এরপর মুখ ধোয়া, ডান হাতটি কনুই পর্যন্ত, বাঁ হাতও একইভাবে তিনবার ধৌত করা, তারপর ভেজা হাত দিয়ে মাথা, কান এবং ঘাড় মাসাহ করা (মোছা) তাঁরপরে বাঁ হাত একই নিয়মে এবং প্রতিটি পদক্ষেপ তিনবার সম্পাদন করা হয় ওযুতে। এরপর ভেজা হাতে দিয়ে মাথা, কান এবং ঘাড় মোছা, এই রীতিতেই চলতে থাকে। ডান পা দিয়ে শুরু করে তিনবার এবং পরে বাঁ পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত উভয় পা ধুয়ে পরিষ্কারের মাধ্যমে এই পবিত্রতার কাজ শেষ হয়। নামাজের নিয়মও সমভাবেই বিস্তারিত বলা হলো; শরীর সামনের দিকে নেয়ার সময় বাহুগুলো আর শরীরের নড়াচড়া একেবারে সুনির্দিষ্ট হতে হবে, এবং কপাল মাটিতে স্পর্শ করার সময় হাত এবং পায়ের আঙ্গুলগুলিকে যথার্থভাবে রাখতে হবে, নামাজের সিজদায় যাওয়ার আগে প্রথমে হাঁটুতে হাত দিয়ে নিচু হতে হয়, তারপর একই গতিতে উটের মত হাঁটুতে ভর করে বসে থাকতে হয়। মুহাম্মদ খুব শীঘ্রই দিনে পাঁচবার করে সপ্তাহে সাতদিন এইভাবে পবিত্র হয়ে প্রার্থনা করতেন। প্রায়শই তিনি স্বেচ্ছায় রাতের অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর পায়ের গোড়ালি ফুলে যেত। মুহাম্মদ বলতেন, যদি তাঁর অনুসারীরা ঠিকমত এই পবিত্রতার মাধ্যমে প্রার্থনা না করেন তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে তাঁর ইবাদত অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হবে (২)। আধ্যাত্মিক পরিশোধন ও প্রার্থনায় মুহাম্মদ যে পরিমাণ সময় ব্যয় করতেন, তা এটাই ইঙ্গিত করে যে, তাঁর এই প্রার্থনা শুধু সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা করার জন্যই ছিল না, বরঞ্চ তারচেয়ে বেশি কিছু। এই আচরণগুলো এটাই ইঙ্গিত করে, তিনি একটি মারাত্মক সন্দেহবাতিকগ্রস্ততার (Obsessive Compulsive Disorder) রোগে ভুগছিলেন, যার শেকড় ছিল তাঁর উদ্বেগজনিত (anxiety) রোগের মধ্যে। তাঁর এই ধরনের আচার-আচরণ এতটাই তাঁকে গ্রাস করত যে, তাঁকে এ রোগের চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। Obsessive Compulsive Disorder কে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ঃ "anxiety disorder characterized by intrusive thoughts that produce uneasiness, apprehension, fear, or worry, and by repetitive behaviors aimed at reducing the associated anxiety, or by a combination of such obsessions and compulsion” (৩)। একই কাজ বারবার করার মধ্য দিয়ে রোগী এক ধরনের স্বস্তিলাভ করে, যার ফলে উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হয়। সম্ভবত এটা বলা যায়, মুহাম্মদের উদ্বেগজনিত রোগের কারণে তিনি হীনমন্যতা, অপরাধবোধ এবং লজ্জাজনক অনুভূতিতে ভুগতেন। তাঁর কারণ হয়ত নিহিত ছিল তাঁর জীবনের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, যেই স্মৃতিগুলি তাঁকে তাড়া করে ফিরত। তাঁর নিজের ভেতরকার চিন্তাগুলোই আবার অভ্যন্তরীণ কণ্ঠের মাধ্যমে তিনি শুনতে পেতেন। যেহেতু তিনি প্রতিনিয়ত নেতিবাচক আত্মপোলদ্ধিতে ভুগতেন, যার ফলে ক্রমাগত সৃষ্টিকর্তার কাছে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করতেন, মূলত তাঁর মধ্যকার 'মানসিক ভুত' থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তিনি মরিয়া হয়ে যেতেন (৪)। নিউরোলজির জার্নালে দেখা যায়, মৃগী রোগীদের অনেক লক্ষণের মধ্যে স্ব-পুনঃসংশোধনের দিকে ঝোঁক থাকে। অতিরিক্ত ধর্মভীরু, অতিরিক্ত নৈতিকতার দিকে এরা ঝুঁকে যায়। এর মাধ্যমে, ইহুদি-খ্রিস্টানে ঈশ্বরের ধারণার প্রতি মুহাম্মদের আকর্ষণ ব্যাখ্যা করা যায়।
যিনি মুহাম্মদের অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত চিৎকার করতেন, সেটাই ঈশ্বর। ইশ্বরকে সন্তুষ্ট করার যেকোনো একটা উপায় তার খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু তাঁর এই ঐশ্বরিক ইচ্ছে পুরণের বিধানগুলো কী?
এখন যেহেতু তিনি আল্লাহর নবী, আর তাড়াতড়ি উনি একজন আজ্ঞাবাহক প্রেরিত পুরুষে উন্নীত হবেন, তিনি তাই নিজেকে এবং বিশ্ববাসীকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন, তাঁর ভেতরকার এই চিৎকারকারী ইশ্বর আসলে কি চান? পরবর্তী তেইশ বছর ধরে প্রথমে সংক্ষিপ্ত কবিতার আকারে, পরে দীর্ঘ ছড়া-গদ্য রচনার মাধ্যমে তাঁর ধারণাগুলোকে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, এইগুলো তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে পেয়েছেন। শ্রোতারা বিশ্বাস করেছিলেন, আল্লাহই মূল কোরানের রচয়িতা, আল্লাহই কয়েক বছর ধরে ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে বিভিন্ন আয়াত মুহাম্মদের কাছে হয় ব্যক্তিগতভাবে নিয়ে আসতেন, অথবা অলৌকিক উপায়ে "হস্তান্তর" করতেন। মুহাম্মদের কাছে অনেক আয়াত আসত যখন তিনি মৃগীরোগে ভুগতেন। কখনও সেগুলো তাঁর সত্যিকার খিঁচুনির সময়ে আসত, আর কখনওবা তিনি খিঁচুনির ভান করার সময় এসব আসত, যখন তিনি নিজেকে কম্বলে জড়িয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর এই কাঁপুনি থামত। কিছু সময় যেকোনো একটা বিষয় নিয়ে ভাবতেন, আর সেই ভাবনাটাই নতুন আয়াত হিসেবে নাজিল হতো, সত্যিকার অথবা ভান ধরা খিঁচুনিরত অবস্থায়। সামগ্রিকভাবে কোরানের সুরার ধরণ দেখলে বোঝা যায়, এটা এমন একজনের কাজ, যিনি জানতেন তিনি কী করছেন।
তাঁর প্রথম দিককার রচনাগুলোর একটিতে, যাকে মূল কোরআন তথা আবৃত্তির মুখবন্ধ বা প্রস্তাবনা বলা হয়, তাঁর ভেতরকার প্রখর উপলব্ধি ফুটে এভাবেঃ -
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব। যিনি পরম করুণাময় অতি দয়ালু। বিচার দিনের মালিক। আপনারই আমরা ইবাদাত করি এবং আপনারই নিকট আমরা সাহায্য চাই। আমাদেরকে সরল পথ দেখান। পথের হিদায়াত দিন। তাদের পথ, যাদের উপর আপনি অনুগ্রহ করেছেন। যাদেরকে নিয়ামত দিয়েছেন।যাদের উপর (আপনার) ক্রোধ আপতিত হয়নি এবং যারা পথভ্রষ্টও নয় (৫), (৬)।
এটা সাধারণত বোঝা যায়, সর্বক্ষমতাবান সৃষ্টিকর্তা তাঁর ঐশ্বরিক ইচ্ছাগুলোকে হস্তান্তর করতে শুধুমাত্র আবৃত্তিকেই একমাত্র মাধ্যম মনে করবেন না। কিন্তু এটি বুঝতে হবে যে, সর্বময় সৃষ্টিকর্তার ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে মুহাম্মদের মতো একজন আরবের কাছে একমাত্র এটিই ছিল মাধ্যম। যেহেতু আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কবিতা ছিল আরবদের সাংস্কৃতিক আবেগের জায়গা যার মাধ্যমে তারা তাদের ভাব প্রকাশ করতেন। বিখ্যাত কবিরা ছিলেন সেই যুগের মঞ্চ তারকা, মানুষ তাদেরকে সেলেব্রিটি হিসেবে দেখত, আর কম প্রতিভাবনরা তাদের নকল করত।
কাব্যিক প্রতিভাকে উদযাপনের মাধ্যমে তারা তাদের গোত্রীয় মূল্যবোধগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতেন। কবিতাকে তখন ব্যবহার করা হতো বংশের প্রশংসা করতে, অন্য বংশের নিন্দা করতে, সাহসী কাজের ও মৃতদের প্রশংসা করতে, সর্বোপরি তাদের হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে।
জায়েদের মতো মুহাম্মদও তাঁর ধারণাগুলিকে কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন, তবে মুহাম্মদের আয়াতগুলো থাকত বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে। যার ফলে তিনি আরবের ঐতিহ্যবাহী যে কাব্যিক রূপ, তাঁকে ভেঙে দিয়েছিলেন। কিছু কাব্যিক রচনা ছিল জ্ঞানসম্পন্ন এবং পরীক্ষামূলক, কেনইবা তা হবে না, কারণ এটা ছিল একজন সর্বোচ্চ 'দয়ালু' সৃষ্টিকর্তার বাণী (৭), যার মূল বিষয় ছিল ঐশ্বরিক পুরষ্কার এবং শাস্তি। এই রচনাতে মুহাম্মদ শ্রোতাদের কানে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে শ্রোতাদের অনেক কিছু থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করেছেন। এই বিরত করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে কবিতার প্রতিটি ছত্রে, এভাবে শ্রোতার উত্তেজনা চরমে তুলে শেষে রাগমোচনের মতো করে আয়াতের মাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দিতেন, যেমনঃ বিশ্বাসীরা বেহেস্তে কালো চোখের কুমারীদের সাথে অনন্তকাল সঙ্গমে লিপ্ত থাকতে পারবে। জায়েদের চেয়ে ভাষাশৈলীতে তিনি শুধু চালাক ছিলেন তাই নয়, বরঞ্চ ছিলেন ভালো কৌশলীও। তিনি জানতেন যে, তাঁর বর্ণিত কথায় একজন ঐশ্বরিক কর্তৃপক্ষের দরকার ছিল যেটা জায়েদের অভাব ছিল। জায়েদ শুধু নশ্বরতার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে তাঁর মতামত দিতেন। মুহাম্মদ তাঁর সৃষ্টিকে দেখতেন একজন সৃষ্টিকর্তার বাণী হিসেবে যা ফেরেশতা জিব্রাইলের মাধ্যমে তাঁর কাছে পাঠানো হতো। তাই তাঁর কথার মূল্য ছিল অনেক উঁচুতে, কারণ এটি মুহাম্মদের কথা ছিল না। তিনি আল্লাহর কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে “আমরা” বা “আমাদের” এই শব্দগুলোর মাধ্যমে নিজেকে পটভূমিতে নিয়ে এসেছিলেন (৮)। মুহাম্মদের কণ্ঠস্বর কেবল তখনই শোনা যেত, যখন তিনি নিজেই জিব্রাইলের মাধ্যমে আল্লাহকে বলতে নির্দেশ দিতেন, যা তাঁর মনুষ্য কণ্ঠে শুনতে পাওয়া যেত। এই হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি শুরু হতো 'বলুন' শব্দের দ্বারা। শ্রোতারা যখনি “বলুন” শব্দটি শুনতে পেত তখনই বুঝত হবে, আল্লাহ তাঁকেই যেন মাইক্রোফোনটি দিচ্ছেন! এই (হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার) যন্ত্রের মাধ্যমে কোরআন সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের বাণীর মর্যাদা অর্জন করেছিল।
সেই যুগের সহজ সরল মানুষের অন্তর থেকে শুরু করে পরবর্তী যুগের মানুষেরা বিশ্বাস করতেন/করেন, আকাশ থেকে তাদের জন্য পৃথিবীতে গলার আওয়াজ নেমে এসেছে।
যদিও মুহাম্মদের উল্লেখযোগ্য একটি প্রতিভা ছিল মৌখিক প্রতিভা, তবে এই প্রতিভা তাঁর প্রথম দিককার জীবনে ছিল কি না তা অন্তত ইসলামিক আদিগ্রন্থ থেকে জানা যায় না।
ইতিহাসবিদ মুর (Muir) অনুমান করেছেন, মুহাম্মদ তাঁর বৌদ্ধিক জীবন শুরু করেছিলেন হয়ত তাঁর গুহায় হ্যালুসিনেসনের অভিজ্ঞতার আগেই। যেখানে তিনি 'বন্য ও অনুভুতিযুক্ত কবিতা” আর ‘মানবজাতির এবং রাষ্ট্রের জন্য ছন্দময় আত্নকথন' চিন্তা করেছেন।
তাঁর এই কাব্যিক প্রতিভা নিশ্চয়ই তাঁর পরিবারের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই সময়কার রচনাগুলোর বেশিরভাগ অংশই আল্লাহর ভয়েসের ছাঁচে হয়তো খাপ খায়নি, তাই হয়ত তা হারিয়ে গেছে। মুর মনে করতেন, যা কিছু টিকেছিল তা হয় মুহাম্মদ অথবা তাঁর অনুসারীরা পরবর্তীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল (৯)।
মুহাম্মদের ধর্মের প্রথম নিয়োগ ছিল তাঁর স্ত্রী খাদিজা। ইসলামিক ইতিহাসে লেখা আছে, ফেরেশতা জিব্রাইলের যখন মুহাম্মদের কাছে এসে তাঁকে পবিত্র করার এবং প্রার্থনা করার কৌশল শিখিয়ে দিয়ে গেলেন, তিনি তখন খাদিজার কাছে ছুটে এসেছিলেন এবং তাঁকেও তা শিখিয়েছিলেন। তারপরে তিনি তাঁর রচিত কয়েকটি আয়াত পুনরাবৃত্তি করে তাঁর সাথে সালাত আদায় করলেন। শীঘ্রই পরিবারের আরো দু'জন সদস্য তাদের সাথে যুক্ত হলেন, প্রথমজন হচ্ছেন আবু তালিবের পুত্র আলী, যাকে মুহাম্মাদ চার বছর আগে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এখন দশ বছর বয়সী স্বাস্থ্যবান আলী মুহাম্মদ ও খাদিজা নামাজ পড়ার সময় তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে লাগল তারা কী করছে? মুহাম্মদ যখন তাঁকে ব্যাখ্যা করলেন এবং তাঁকে তাঁর সাথে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ করেন। আলী জানায়, সে তার বাবার সাথে আগে কথা বলবে।
মুহাম্মদ তাঁকে আবু তালিব বা অন্য কারও কাছে প্রকাশ না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন, কারণ তিনি জায়েদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাক্ষী ছিলেন। তা ছাড়াও তিনি প্রকাশ্যে যাওয়ার জন্য তখনও প্রস্তুত ছিলেন না। মোহাম্মদ জায়েদের মতো পৌত্তলিকতার চর্চাকে শুধু নিন্দা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি, বরঞ্চ তাঁর পরিকল্পনা ছিল মূলত আরো সুদুরপ্রসারী। মক্কাবাসীদের ধর্মের বিপরীতে একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রস্তাব দেয়ার জন্য তাঁর আরো চিন্তাভাবনা, আরও আয়াতের দরকার ছিল। এর একদিন বা একমাস পরে, যদিও সময়সীমাটা পরিষ্কার পাওয়া যায় না, আলী মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করলেন যে নতুন ধর্মে যোগদানের জন্য তার কী করতে হবে? তিনি বলেন- “তোমরা সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই; আল-লাত এবং আল-উজ্জাকে বাতিল কর এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের ত্যাগ কর”। আলীর ধর্মান্তরের কিছু পরে, জায়েদ, প্রাক্তন খ্রিস্টান দাস যাকে মুহাম্মদ ছেলে হিসেবে দত্তক নিয়েছিলেন, তিনিও তাঁর বিশ্বাসের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন। কথিত আছে, জায়েদ ধর্ম গ্রহণ করার আগে মুহাম্মদ এবং আলী দুজনেই বিকেলে শহরের বাইরে এমন জায়গায় চলে যেতেন যেখানে তাদেরকে কেউ দেখবে না এবং সেখানে তারা লুকিয়ে তাদের প্রার্থনা আদায় করতেন। তবে একদিন আবু তালিব তাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা যে ধর্ম পালন করছ দেখি সেটা কোন ধর্ম?" মুহাম্মদ তাঁকে বলেন, “আল্লাহ আমাকে মানবজাতির জন্য একজন রাসুল হিসেবে প্রেরণ করেছেন।
আপনি আমার চাচা, আপনার সত্যটা জানার অধিকার সর্বাগ্রে, আমি আপনাকে সত্যের পথে ডাকছি, এবং আপনাকে হেদায়েতের দিকে আহবান করছি”। আবু তালিব মুহাম্মদকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন যে, তিনি তাঁর পিতামাতার ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। তবে তিনি তাঁর ছেলের আনুগত্যের বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি এবং তাদেরকে হাশিমীয় বংশের সুরক্ষার প্রস্তাব দিয়েছিলেন (১০)।
প্রাথমিক দিকে সাফল্য পেলেও, মুহাম্মদ পরে তার নিকটাত্মীয়দের থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হন। তবে ইসলামিক সাহিত্যে তাঁর চার মেয়ে - ফাতেমা, জয়নব, রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমকে ধর্মান্ধরিত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ইতিহাসে পাওয়া যায়, বেশ কয়েক বছর গোপন রাখার পর যখন তিনি তাঁর ধর্ম নিয়ে প্রকাশ্যে আসেন, তখন মুহাম্মদ ফাতিমাকে সবার সামনে তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মুহাম্মদের পরিবারের বাইরে প্রথম ধর্মান্তরিত ছিলেন তাঁর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর। তিনি কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন, যিনি মুহাম্মদের মৃত্যুর পরে মুমিনদের (বিশ্বাসী) জন্য প্রথম শাসক হয়ে উঠেন। তাঁরা দুজন সম্ভবত কয়েক দশক ধরে পরিচিত ছিলেন।
ইসলামিক সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ যখন আবু তালিবের সাথে সিরিয়ায় বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে গিয়েছিলেন, আবু বকরও সেই কাফেলার সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে উভয় ব্যক্তিই পবিত্র ধর্মযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মক্কার বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলে একটি সমিতিও গঠন করেছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে মুহাম্মদ বহেরাগতদের সাথে সৎভাবে বাণিজ্য করার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, আবু বকরও সেথায় উপস্থিত ছিলেন, কারণ তাঁর তাইম (Taym) গোত্রটি ছিল এই সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক। শারীরিকভাবে আবু বকর দেখতে অনেক সুদর্শন ছিলেন। তাঁর গায়ের রং ফর্সা ছিল, শরীরের গড়ন ছিল মধ্যম আকৃতির, খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল, দেখতে একটু কুঁজো ছিলেন। তাঁর চোখ দুটো ছিল ভাসা ভাসা, কপালটি চওড়া গণিতবিদের মতো। বংশপরিচয় সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক, তাই গুরুত্বপূর্ণ মক্কাবাসীদের প্রায় সবার বংশপরিচয়, এমনকি কুসাইর সময়কাল এবং তাঁরও আগে পর্যন্ত জানতেন। এই ধরণের জ্ঞানের সাথে সাথে তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যাও দিতে পারতেন, যেটা ছিল একধরণের বাড়তি পাওনা। ইতিহাসবিদ অ্যালোজ স্প্রেঞ্জারের (Aloys Sprenger) মতে, যদিও আবু বকরের মৌলিক ধারণাগুলো ত্রুটিযুক্ত ছিল, তবুও তিনি ছিলেন মুহাম্মদের আদর্শ মিত্র, কারণ বন্ধু হিসেবে তিনি ছিলেন আদর্শ চরিত্রের (১১)।
খাদিজার শহরেই আবু বকরের একটি ঘর ছিল, মক্কার মানদণ্ডে সেটা অনেকটা ভালোই ছিল। তাই মুহাম্মদ যখন বিয়ের পর খাদিজার কাছে থাকা শুরু করলেন, তখন তারা দুজনই আবার প্রতিবেশী হয়ে গেলেন।
আরো একটা বিষয়ে তাদের ঘনিষ্ঠতা বেশ দৃঢ় হয়েছিল, সেটা হচ্ছে কবিতার প্রতি আগ্রহ। জানা যায়, বার্ষিক যে ওকায মেলা হতো, আবু বকর সেখানে সাহিত্য প্রতিযোগিতার নিয়মিত প্রতিযোগী ছিলেন। তিনি একবার আবৃত্তি শোনার পরই পুরো কবিতা স্মরণ রাখতে পারতেন, মুহাম্মাদেরও এমন দক্ষতা ছিল বলে ধারণা করা হয়। সখ্যতা আরো বাড়তে থাকে, যখন আবু বকর বুঝতে পারলেন মূর্তির প্রতি তিনি যেই প্রার্থনাই করছেন তা আর পুরণ হচ্ছে না। তাদের দুজনেরই আলোচনার বিষয় ছিল ধর্ম, তারা দুজনেই ক্রমশ মক্কার প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন, আস্তে আস্তে পৌত্তলিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন।
হেরা পর্বতের গুহায় অবস্থানকালে মুহাম্মদ যখন স্নায়বিক প্রভাবে জর্জরিত হচ্ছিলেন, আবু বকর সেই সময়ে সিরিয়াতে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। পরে মক্কা চলে আসার সময় লোকমুখে জানতে পারেন, মুহাম্মদ নতুন একটা ধর্ম নিয়ে আসতে যাচ্ছেন। সেই কৌতুহল থেকে বকর মুহাম্মদের সাথে দেখা করতে গেলেন। স্বভাবতই মুহাম্মদ আয়াত নাজিল হওয়ার অভিজ্ঞতা, আর সেই অভিজ্ঞতা ঘিরে তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন।
হয়তো সমালোচনার ভয়ে মুহাম্মদ তাঁর কাব্য প্রতিভার কথা পরিবারের নিকটবর্তী লোকজন ছাড়া আর কাউকে বলেননি। এখন ঐশ্বরিক আদেশ আর ক্ষমতার কথা ভেবে, কবিতার নির্ভুলতা নিয়ে সচেতন হওয়ায়, তাঁর সাম্প্রতিক সময়ে রচিত কয়েকটি কবিতা বকরকে আবৃত্তি করে শোনান। তারপর প্রার্থনার নিয়মসমূহ তাঁকে দেখান। তিনি এখন থেকে হয়ে ওঠেন আল্লাহর অনুসারীদের সংগ্রাহক, অন্যান্য সকলকে আবু বকরের মতোই আল্লাহর উপাসনার পথে নিয়ে আসাই তাঁর কাজ।
ব্যক্তিত্বের বিচারে আবু বকর ছিলেন এমন একজন, যার কাছে সহজেই পৌঁছে যাওয়া যেত। তিনি মুহাম্মদের মতোই ছিলেন নীতিবান, মক্কার অন্যান্যদের মতো মদ্যপান, জুয়াখেলা, কিংবা নারী নিয়ে ফুর্তি ইত্যাদিতেও তাঁর আগ্রহ ছিল না। তিনি ছিলেন বেশ সমুন্নত ব্যক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সৎ, স্পষ্টবাদী। তিনি বেশ আবেগীও ছিলেন; আঘাত পেলে কাঁদতেন, আনন্দে হাসতেন, ক্রোধে ফেটে পড়তেন। কুটিলতা ও মেকী স্বভাবের বিপরীতে সহজেই তিনি মানুষকে বিশ্বাস করতেন। যার কারণে মুহাম্মদের চমৎকার কথায় তিনি সহজেই পটে গিয়েছিলেন। তাছাড়া মুহাম্মদের আবৃত্তি করা ছড়াগুলোর এমনই গুণ ছিল যে, এরকম গুণযুক্ত কবিতা এর আগে তিনি শোনেননি। ছড়াগুলো শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে দিয়েছিলেন। বলা হয়, আবু বকর খুব সহসাই ধর্মান্তরিত হয়ে যান; মুহাম্মদের দৃঢ় বিশ্বাস যেন বকরেরই বিশ্বাসে পরিণত হয়।
আবু বকর একাই নতুন এই ধর্মের অনুসারী খুঁজতে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি মুহাম্মদের অনেক নিকটতর আত্মীয়-স্বজন, যেমন সাফিয়ার পুত্র জুবায়ের, যিনি প্রথমে সংশয় দেখিয়ে দুরত্ব তৈরি করেছিলেন, তাঁকে সহ প্রায় একডজন লোককে নতুন ধর্মের প্রতি প্রভাবিত করেছিলেন। মুহাম্মদ বিষয়টি এত তাড়াতড়ি প্রকাশ্যে আনতে চাননি, কিন্তু আবু বকর মুহাম্মদের কথা তাঁর নিকটাত্মীয়দের কাছে এবং যাদের সাথে তিনি ব্যবসা করতেন, তাদের কাছে বলা শুরু করেন এবং প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তারাও অবশ্যই অন্যের সাথে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিল। মক্কার মতো ছোট্ট একটি শহরে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুব কঠিন ছিল।
ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায়, ধর্মে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী, অলৌকিক ঘটনাবলী ও স্বপ্ন এসব কিছুও ভূমিকা রেখেছে। যেমন, আবু বকরের এক চাচাত ভাই তালহার সাথে ঘটেছিল, যিনি পরবর্তীতে লুন্ঠনের মাধ্যমে ধনী ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠেন এবং আব্দুল্লাহ মাসুদ যিনি ছিলেন একজন রাখাল বালক, তিনিও পরবর্তীতে কোরআন তেলাওয়াতকারী ও ফিকাহবিদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। প্রায় বিশ বছর বয়সী তালহা ভবিষ্যদ্বাণী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সিরিয়ার একটি কাফেলা যাত্রা থেকে ফেরার সময় তিনি বসরার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কাছে একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসী ছুটে এসে একজন নবীর আগমনের কথাই বলেননি, তিনি তাঁকে বলেন যে, “নবী ইতিমধ্যেই চলে এসেছে!” চরম উদ্দীপনা নিয়ে সন্ন্যাসী তখন তালহাকে দ্রুত মক্কায় ফিরে আহমদ নামের লোকের কথা শুনতে বলেন। এই আহমদ হচ্ছে আব্দুল মুত্তালিবের নাতি আর আব্দুল্লাহর পুত্র যিনি তাঁর নবুয়্যত (নবীগিরি) ঘোষণা করবেন। তিনি আরো বলেন: “এ মাসেই তিনি হাজির হবেন, তিনি নবীদের মধ্যে শেষ নবী” (১২)। কাহিনীটি এভাবে আছেঃ তালহা আবু বকরের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, মুহাম্মদই সেই ভবিষ্যদ্বাণীটির লোক যার কথা সন্ন্যাসী তাঁকে বলেছেন। তিনি তাঁকে নতুন ধর্মের মূল বিষয়গুলি সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে মুহাম্মদের কাছে নিয়ে গেলেন। তালহা সাথে সাথে ধর্ম গ্রহণ করলেন। এই সেই তালহা যিনি পরবর্তীতে মুহাম্মদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মাসুদের ধর্ম গ্রহণের পেছনে ছিল অলৌকিক ঘটনা। ইতিহাসে পাওয়া যায়ঃ মুহাম্মদ এবং আবু বকর মক্কার পাদদেশে হাঁটছিলেন, তখন এই কিশোর মাসুদ ছাগল চরাচ্ছিল। তৃষ্ণার্ত হয়ে মুহাম্মদ কিশোরকে বলেন তাঁকে একটা ছাগল থেকে দুধ এনে দিতে। মাসুদ জানায় সে মালিকের অনুমতি ছাড়া দুধ দিতে পারবে না। মুহাম্মদ তাঁকে তখন ছোট একটি ছাগল তাঁর কাছে আনতে বলেন, যেটার তখনও দুধ দেয়ার মতো বয়স হয়নি। মুহাম্মদ ছাগলটির স্তনে হাত ছোঁয়ানোর পরই স্তন দুধে ফুলে উঠল। সেই দুধ দিয়ে তৃষ্ণা মিটানোর পর মুহাম্মদ বললেন, “সঙ্কুচিত হও" এবং ছাগলের স্তন আগের জায়গায় চলে গেলো। এই দৃশ্য দেখে মাসুদ এত চমকিত হয়ে যায় যে, তাঁর কিছুদিন পরই সে ধর্ম গ্রহণ করে (১৩)।
খলিফা উসমান ইবনে আফফান (Usthman ibn Affan) ধর্মান্ধরিত হবার পেছনে ছিল স্বপ্নের ভূমিকা। ইসলামি সাহিত্য চৌত্রিশ বছর বয়সী উসমানকে পাওয়া যায় একজন ধনী ও সুদর্শন কিন্তু বিনয়ী একজন হিসেবে। যখন তিনি সিরিয়ায় একটি বাণিজ্যিক সফর থেকে ফিরছিলেন তখন তিনি স্বপ্নে একটি কণ্ঠ শুনতে পান, যেখানে তাঁকে কেউ বলছে, “ওহে, যারা ঘুমিয়ে পড়েছ তারা জেগে উঠো! মক্কায় আহমদ নামের একজন নবী হাজির হয়েছেন!” (১৪)। তালহার মতো উসমানেরও আবু বকরের সাথে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল, তাই মক্কায় ফিরে এসে তিনি তাঁকে স্বপ্নের কথাটি জানান। এটির অর্থ আবু বকরের জন্য একটি কেকের টুকরোর মতো ছিল। যিনি ওসমানকে তাঁর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছিলেন এভাবেঃ এই 'আহমদ' হচ্ছেন বাস্তবে মুহাম্মদ, 'সত্যের প্রেরিত' হিসেবে আল্লাহ তাঁকে সম্মানিত করেছেন, ফেরেশতার মাধ্যমে সত্যের বাণী দিয়ে প্রেরণ করেন। আবু বকর উসমানকে ধর্মান্তরিত করেন। তারপর তাঁকে মুহাম্মদের কাছে নিয়ে যান চুক্তির বাকিটা সম্পাদন করার জন্য। আবু বকরের মতো একজন মিত্র যার অনেকের সাথে সংযুক্তি ছিল, মানুষকে ধর্মান্তরিত করতে বিশাল সহায়ক ভুমিকা পালন করেছেন। ইতিহাসবিদ স্প্রেঞ্জারের (Sprenger) মতে, মুহাম্মদের নিয়োগের সাফল্যের পেছনে আরেকটি কারণ ছিল, সেই সময়ে অলরেডি একেশ্বরবাদী ধারণা বিদ্যমান ছিল এবং তাই ধর্মপ্রচার করার সময়টা একটু অনুকুল ছিল (১৫)। তিনি যদি এক শতাব্দী আগে তাঁর বার্তা নিয়ে আসতেন, তিনি হয়ত কোথাও পৌঁছতে পারতেন না। এক শতাব্দী আগে এলে তাঁর মতবাদ অপ্রাসঙ্গিক রয়ে যেত। সেই সময়ে বিশ্বের সর্বত্র একেশ্বরবাদ দ্রুত অগ্রসর হয়েছিল। চারপাশের একেশ্বরবাদী চর্চার সমুদ্রে মক্কা ছিল বহু-ইশ্বর উপাসনার জন্য একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মে একেশ্বরবাদী ধারণাগুলি হিজাজের উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমের অনেকাংশে উপস্থিত ছিল। ইয়েমেনকে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং জোরোস্ট্রিয়ানরা ক্রমান্বয়ে শাসন করেছেন। মক্কার দক্ষিণে দশদিনের দুরত্বের বড় শহর নাজরানে গুরুত্বপূর্ণ খ্রিস্টান উপস্থিতি ছিল। পশ্চিমা আরবে ইয়াছরিব, খাইবার এবং ফাদাকে কমপক্ষে সহস্রাব্দ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বা পুরোপুরি ইহুদিদের বাস ছিল। লোহিত সাগরের ওপারে আবিসিনিয়ানদের খ্রিস্টান সাম্রাজ্য ছিল। উত্তরে, সিরিয়া এবং মিশর সহ ভূমধ্যসাগরের পুরো প্রান্তটি খ্রিস্টানদের ছিল। গাসসানীয় (Ghassanids) এবং লখমিডের (Lakhmids) আরব রাজ্যগুলি – বাইজেন্টাইন এবং পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল এবং তারা উত্তর আরব পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। বহু দেবতায় বিশ্বাসের পাশাপাশি, জ্যোতিষীদিদের প্রতি বিশ্বাস এবং দেবদেবী ও শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিমাগুলির উপর বিশ্বাস সর্বত্রই হ্রাস পাচ্ছিল। মক্কাবাসীরা বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে স্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হতে দেখেছেন।
সুতরং তারা হয়ত বেশ কয়েকটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটাকে গ্রহণ করে নিতেন, হয়তোবা ঘনকাকৃতি মন্দিরটি একটি গির্জায় রূপান্তরিত হয়ে যেত।
প্রথমদিকে ধর্মান্তরিতদের মাঝে বুদ্ধিমান কিছু মক্কান তরুণ ছিলেন, যারা বিভিন্ন সময়ে বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে একেশ্বরবাদী তত্ত্বের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তারা ইতিমধ্যেই তাদের নিজেদের নতুন ধর্মের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করেছিলেন এবং নতুন আরও ধারণা গ্রহণ করতে উম্মুখ হয়ে ছিলেন। অন্যান্য প্রাথমিক ধর্মান্তরিতদের মধ্যে ছিল খ্রিস্টান দাসরা। মুহম্মদের ধর্মের সাথে তাদের আপাতদৃষ্টিতে তেমন বেশি পার্থক্য ছিল না এবং তারা আরো বেশি আগ্রহী (নতুন কিছু জানতে) ছিলেন। মুহাম্মদের অনুসারীরা ধর্ম গ্রহণের শর্তে তাদেরকে দাসজীবন থেকে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই সময়কালে মুহাম্মদ খুব কম তাঁর কাব্যিক রচনা করেছেন, সব মিলিয়ে হয়ত একডজন হবে। কয়েকটা বাদে সেগুলোর বেশিরভাগই দশ লাইনের কম ছিল। স্কলাররা এই সময়টিকে 'অন্তর্বর্তীকাল' বলে আখ্যায়িত করেছেন, যা তিন বছর স্থায়ী হয়েছিল। আকারে ছোট বা মাঝারি যাই থাক না কেন, এই রচনাগুলোতে ইসলামের মূল যে বিশ্বাস তা ফুটে উঠেছে। যেমন কেয়ামতের দিন দৈহিক পুনরুত্থান ঘটবে আল্লাহর সামনে, যিনি বিচার করে পুরষ্কার হিসেবে জান্নাত বা শাস্তির জন্য জাহান্নাম প্রদান করবেন এবং আল্লাহর প্রতি অনুগত্য প্রকাশের পুরষ্কার হিসেবে জান্নাতবাস এবং আনুগত্যহীনতার শাস্তি হিসেবে দোজখবাস দেবেন।
কিয়ামত (মহাপ্রলয়) নিয়ে মুহাম্মদের ধারণা ছিল একেবারেই তৎক্ষণাৎ। এই বিষয়টিতে তিনি সময় নিয়ে কাজ করেননি, এখানে একটি আয়াত এবং সেখানে একটি আয়াত।তিনি একলাফে কিয়ামতের ধারণাটি প্রচার করেছেন। তিনি বলতেন, কেয়ামত সন্নিকটে, তিনি বলতেন সেদিন শীঘ্রই আসবে যেদিন পৃথিবী ও পর্বতমালা কাঁপবে এবং পর্বতমালা বালির স্তূপে পরিণত হবে (১৬)।
He has God rubbing his hands in anticipation of squeezing divine fingers around the necks of resurrected disbelievers, particularly the necks belonging to the rich folk of Mecca: "And let me alone with the gainsayers, rich in the pleasures of this life; and bear thou with them a little while; for with Us are strong fetters, and a flaming fire, and food that choketh, and a sore torment."17 Muhammad has God grabbing people by the hair-by "the lying sinful forelock!"(18) -and summoning the guards to Hell to come for them.
শুরু থেকেই তাঁর জাহান্নামের রূপটি ছিল করুণ। ইসলামিক ইতিহাসের এক জায়গায় পাওয়া যায়, একবার তাঁর ভয়ঙ্কর হেলুসিনেশনের পর তিনি তাঁর স্ত্রী খাদিজার কাছে দৌড়ে যান। তিনি তারপর কম্বলের নিচ থেকে বের হয়ে মানুষজনকে সতর্ক করেন এই বলে, “লোকেরা যদি আল্লাহকে রাগন্বিত করে, তাহলে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে”। ঈশ্বরের কণ্ঠে মুহাম্মদ ঘোষণা করেছেন: “আর কে তোমাকে জাহান্নামের আগুন সম্পর্কে বলবে? (১৯)। সর্বোপরি, এই জাতীয় আয়াতগুলি দ্বারা এটাই প্রকাশ করে যে, তাঁর ভেতর রাগী একটা মানুষ বাস করত, যে অভ্যন্তরে বসে অগ্ন্যুৎপাতের জন্ম দিচ্ছিল। নিঃসন্দেহে, তাঁর রাগের অনেক কারণ ছিল। তিনি জীবনে অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সম্ভবত তাঁর এই নির্যাতনের কথাও হয়তো ইসলামিক সাহিত্যে সেভাবে ফুটে ওঠেনি, অধিকন্তু তাঁর জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া অনেক কিছুই ছিল দুর্ভাগ্যজনক, যা তাঁর প্রাপ্য ছিল না। তাই হয়তো তাঁর ভেতর সবসময়ই এক রাগান্বিত সত্ত্বা বাস করত। এখন যেহেতু এই রোগটি ঐশ্বরিকভাবে একটা নাম পেয়ে গেছে, তাই তাঁর রাগের একটা বৈধতা পেয়ে গিয়েছিল। এই সময়কালে তিনি সীমিত কাব্যিক রচনা করতে পেরেছিলেন, যেটাকে আসলে “রাইটার্স ব্লক” বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। যার ফলে তিনি হতাশায় ভুগতেন। তাঁর বাড়িতে একটি ছোট ঘর ছিল, যা তিনি প্রার্থনা ও ধ্যানের জন্য ব্যবহার করতেন। মুলত একটিই ছিল অফিস কক্ষ, যেখানে তিনি প্রাথমিক কোরানের অনেক আয়াত রচনা করেছিলেন। তাঁর যখন খিঁচুনি হতো, তখন আয়াত রচনা করতে পারতেন না। যেহেতু তাঁর মৃগীরোগের সাথে নিজের আধ্যাত্নিকতার একটা সম্পর্ক খুঁজে পেতেন, তিনি আসলে সেই অভিজ্ঞতা লাভের জন্য বারবার সেই কক্ষের ভেতর যেতেন। কিন্তু তা আর তাঁর কাছে আসত না। তিনি যখন কিছুতেই রচনা করতে পারছিলেন না, তখন গভীর হতাশায় পড়ে গেছেন। ইসলামিক সাহিত্যে দেখতে পাওয়া যায়, তিনি সেই সময়ে পাহাড়ে উঠতেন আত্মহত্যা করার জন্য। রাশিয়ার ঔপন্যাসিক দস্তয়েভস্কি (Fydor Dostoevsky), যিনি নিজেও মৃগীরোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং একবার মুহাম্মদকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন যে, মুহম্মদের এই রোগের অভিজ্ঞতা যদি তাঁর নিজের রোগের মতো কিছু হয় তাহলে সেই সময় তিনি “সত্যিই জান্নাতেই ছিলেন!” (২০)। দস্তয়েভস্কি তাঁর এই রোগের অভিজ্ঞতাকে একটি 'সুখের অনুভূত' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা তিনি কখনো তাঁর স্বাভাবিক অবস্থায় অনুভব করেনি, এবং যা কল্পনায়ও আনতে পারতেন না। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনি নিজের সাথে বিশ্বের সম্প্রীতি অনুভব করতেন, অসাধারণ সুখানুভুতি পেতেন। তিনি বলেন, সেই এক সেকেন্ডের অনুভুতির জন্য মানুষ হয়ত তাঁর জীবনের দশ বছর দিতে রাজি হবে (২১)।
আত্মহত্যা করা থেকে মুহাম্মদকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র তাঁর বন্ধু, শত্রু বা তাঁর স্ত্রীর প্রতি ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যের জন্য। তিনি ভাবতেন, তিনি এভাবে মারা গেলে তাদেরকে বিদ্রূপ মন্তব্য শুনতে হবে। যদি সেই সময়ের লিপিবদ্ধ ঘটনা সব সত্য হয়ে থাকে, তাহলে আমরা দেখি ইহুদিরা যেহেতু দেখল তাঁর কাছে মাসের পর মাস কোন আয়াত আসছে না, তখন তাঁকে নিয়ে হাস্যরসাত্মক কথা বলত। তারা বলত, “আপনার আত্না নিশ্চয়ই আপনাকে দ্রুত ত্যাগ করেছে!” (২২)। এইটুকুই মুহাম্মদের দরকার ছিল। আল্লাহ তাঁর কৃপণতা থেকে বের হয়ে আসলেন, মুহাম্মদের টেম্পোরাল লোবে বৈদ্যুতিক ঝড় শুরু হলো। অন্যদের এই ব্যঙ্গাত্মক দাবিকে ভুল প্রমাণ করতে রচনা হয়ে গেল এই লাইনগুলোঃ “আপনার পালনকর্তা আপনাকে ত্যাগ করেননি এবং তিনি অসন্তুষ্টও হননি। ভবিষ্যতে আপনার সবকিছু অতীতের চেয়ে ভালো হবে, শেষপর্যন্ত আপনার পালনকর্তা আপনার প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং আপনি সন্তুষ্ট হবেন" (২৩)।
এই সুরাগুলোতে আল্লাহ তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কিভাবে তাঁকে পেয়েছেন এতিম হিসেবে, তাঁকে একটি বাড়ি দিয়েছেন এবং শেষপর্যন্ত তাঁকে ধনী মহিলার সাথে বিবাহের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করেছিলেন যার জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এই স্নায়বিক মহৌষধ শেষ হবার সাথে সাথে তাঁর আয়াত রচনাও শেষ হয়ে যায়। মুহাম্মদও তাঁর আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন যে, প্রভু তাঁর সাথে ছিলেন। তিনি শীঘ্রই আরও আয়াত রচনা করতে শুরু করলেন, যেগুলো তাঁর কাছে জিব্রাইলের মাধ্যমে আসত। তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন, তিনি হচ্ছেন আব্রাহামিক ঈশ্বরের সর্বশেষ নবী, যাকে আল্লাহ সত্য ধর্ম দিয়ে প্রেরিত করেছেন।