অধ্যায় - ১৩ আল কায়েদা
দিনের বেলায় লুকিয়ে থেকে এবং রাতের বেলায় যাত্রা করে অবশেষে মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীরা একটি সংকীর্ণ পাহাড়ের পথ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সবুজ ঘেরা মরুদ্যান ইয়াছরিবে পৌঁছলেন।
সময়টি ছিল সেপ্টেম্বরের শেষের দিক। সেখানে বিশাল বাগান ছিল, দেখে মনে হবে প্রায় পঁচিশ বর্গমাইলের পুরো এলাকা যেন পাহাড় এবং প্রাচীন লাভা প্রবাহের কালো দেহাবশেষের মধ্যে চাপা পড়ে আছে।
মুহাম্মদ আগেও এ বিস্তৃত উপত্যকাটি দেখেছিলেন, যখন তাঁর মা তাঁকে নাজ্জার গোত্রের আত্মীয় এবং তাঁর পিতা আবদুল্লাহর কবর দেখাতে সেখানে নিয়ে এসেছিলেন। জানা যায়, সম্ভবত পরেও দুটি কাফেলা নিয়ে সিরিয়ায় সফরকালে ইয়াছরিব ভ্রমণ করেছিলেন মুহাম্মদ - প্রথমে তাঁর চাচা আবু তালিবের সাথে এবং পরে খাদিজার বাণিজ্যিক প্রতিনিধি হিসেবে। অবস্থানগত কারণে ইয়াছরিব উপত্যকাটি উত্তরের দিকে যাওয়া দুটি প্রধান কাফেলা রুটের একটি ছিল।
এ কারণে তিনি সেখানকার ভু-বৈচিত্র্য এবং আদিবাসীদের জটিল সমাজব্যবস্থা সমন্ধে অবগত ছিলেন। ইয়াছরিবের উঁচু ভুমির এই গ্রাম্য জীবনের আড়ালে ছিল বিভক্ত মরূদ্যান, যাতে বিভক্ত এই জনপদের ছোট স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলসমূহে বিশ্বস্ততা, বিশ্বাসঘাতকতা ও আনুগত্যের দোলাচলের জটিল সম্পর্কে গোত্রগুলো বাঁধা পড়ে গেছিল। দক্ষিণ-পূর্ব ইয়াছরিবের উচ্চভূমিতে প্রধান ইহুদি গোত্রসমূহ বাস করত, আর তাদের সাথে সাধারণভাবে অপেক্ষাকৃত ছোট বহুশ্বরবাদী গোত্রগুলোর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সেখানকার মাটি ছিল খুবই উর্বর, আর দুর্গগুলো বিশাল ছিল। পশ্চিম এবং উত্তরের নিম্নভূমিতে প্রধানত ইহুদি গোত্র আওস এবং খাজরাজ গোত্রের অধীনে ছিল। নিম্নাঞ্চল হওয়ার কারণে, মাঝেমাঝে বর্ষাকালে জল উঁচু ভূমির শুষ্ক খাঁড়ি বেয়ে নেমে ক্ষেত এবং বাগানে বন্যার সৃষ্টি করতো। ইয়াছরিব জুড়েই প্রধান গোত্রদের ছোট ছোট দুর্গ এবং খামারবাড়িতে উপগোষ্ঠীরা বাস করতেন, খেজুর গাছ এবং ফসলের মাঠ দ্বারা পরস্পর পরস্পরের থেকে আলাদা থাকত। বড় দুর্গের অনেকগুলোর চারপাশে অনেক গ্রাম ছিল (১)।
যদিও শহরটি বিকেন্দ্রীভূত ছিল, উপত্যকার মধ্যে নাজ্জার ( Najjar) অঞ্চল ছিল সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ, যেটা সেতুর কাছাকাছি উপত্যকার মাঝখানে অবস্থিত ছিল। যদি এটি ইয়াছরিবের কেন্দ্রস্থল হয়ে থাকে, তবে এটি ছিল মুহাম্মদের দাদির মায়ের (great grandmother) বাসস্থান।
একটা সময় মুহাম্মদ উঁচু পাহাড়ের ঢাল থেকে এই বিশাল উপত্যকার যতদুর চোখ যায় তাকিয়ে থাকতেন, ইয়াছরিব রাজনৈতিকভাবে পরিবর্তনের একেবারে চূড়ান্ত শিখরে ছিল। দুই শতাব্দী আগেও এই মরুদ্যানে ব্যাপকভাবে ইহুদিদের বাস ছিল। উপত্যকায় তাদের উপস্থিতি ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের সময়কাল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত, কিন্তু তাদের আধিপত্য কমতে শুরু করে পঞ্চম শতাব্দীর শেষের দিকে যখন মারিবের (Marib) বিখ্যাত বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ইয়েমেন থেকে আরব শরণার্থীরা ইয়াছরিবে চলে আসেন। সেই সাথে আরবদের জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে, জমি ও জলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে বসবাসরত ইহুদিদের সাথে বিবাদও বাড়তে থাকে। আউস এবং খাজরাজের দুটি প্রধান গোত্রতে বিভক্ত আরবরা, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে, কখনও কখনও জমি নিয়ে ঝগড়া করে, অথবা সামান্য একটু বিষয়ে মতের অমিল হলেও লড়াইয়ে জড়িয়ে যেত। একবার একটি ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য একটি যুদ্ধ শুরু হয়, যার ফলে খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটে এবং যা রক্তের বদলে রক্ত নেয়ার চক্রের মধ্যে আবর্তিত হয়। আরবদের উপস্থিতি থেকে বেড়ে ওঠা জোটের ঝামেলার কারণে ইহুদি গোত্ররা কখনও কখনও একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে যেত। সময়ের সাথে সাথে তাদের অঞ্চলটি সংকুচিত হতে থাকে এবং উচ্চভূমির সাথে যুক্ত হয়ে মিশে যায়। মুহাম্মদের আগমনের সময়, অর্ধশতাব্দী ধরে যুদ্ধযুদ্ধ খেলায় তাঁরা ছিল ক্লান্ত এবং আর কোন সংঘাতে জড়ানোর কোন আকাঙ্ক্ষা তাদের ছিল না। সেখানকার গোত্রপতিরা এমন একজন নেতাকে খুঁজছিলেন, যিনি সমগ্র উপত্যকাকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে। এই ভূমিকার জন্য আবির্ভূত হন খাজরাজ শেখ আব্দুল্লাহ বিন উবাই। তিনি দেখতে লম্বা ধুসর দাড়িওয়ালা ছিলেন, খাজরাজের সবচাইতে আকর্ষণীয় দুর্গের এবং পার্শ্ববর্তী খেজুর বাগান এবং ফসলি জমির মালিক ছিলেন। তিনি উচ্চভূমির বুয়াথ (Buath) নামক এলাকায় শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িত প্রতিদ্বন্দ্বিদের মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। গোত্রগুলি তাঁর ভূমিকায় এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তাঁরা আবদুল্লাহ বিন উবাইকে রাজার মুকুট পরিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিল এবং তাঁর জন্য একটি রত্নখচিত মুকুট তৈরি করেছিল। সম্ভবত ইহুদিরাও তাঁর কর্তৃত্ব গ্রহণ করত, কারণ তিনি ইয়াছরিবের তিনটি প্রধান ইহুদি গোত্রের এক গোত্রের কায়নুকা (Qaynuqa) সাথে মিত্রতার সম্পর্ক করেছিলেন, এবং অন্যরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু মুহাম্মদ এসে ইয়াছরিবের রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিলেন, রাজার প্রতি সমর্থনও ভেঙ্গে দিলেন।
মুহাম্মদ ৬২২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরের শেষের এক উত্তপ্ত দিনে উপত্যকায় অবতরণ করেন। তাঁর অনুসারীরা জানতে পেরেছিল, মুহাম্মদ আবু বকরকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে পালিয়েছেন, কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে তাঁকে না দেখতে পেয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তারা যেহেতু জানত তিনি এই পাহাড়ি পথেই উচ্চভূমির দিকে আসবেন, তাই বিশ্বাসীরা প্রতিদিন সকালে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর আশায় বাইরে বেরিয়ে পড়ত, কিন্তু যখন গরমে অসহ্য হয়ে যেত, তখন ঘরে ফিরে আসত। উঁচুভূমির অনেক দক্ষিণে কুবা (Quba) নামক এলাকায় এক ইহুদি তাঁর খামারবাড়ির ছাদ থেকে প্রথম মুহাম্মদকে দেখেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে আরব, এই যে তোমাদের মহান মানুষ তোমরা যার অপেক্ষা করছ” (২)!
তীব্র রোদে, উটের উপরে থাকা মুহাম্মদ ও আবু বকরকে ক্রমশই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। অবশেষে যখন অশ্বারোহেরা গ্রামে প্রবেশ করলেন, বিশ্বাসীরা চিৎকার করে বলে উঠল “আল্লাহু আকবর!” এবং তাদের শুভেচ্ছা বার্তায় ভাসিয়ে দিলেন। প্রত্যেকেই তাদের বাড়িতে আগতদের যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তারা কেউই মুহাম্মদকে দেখেনি এবং তারা নির্ধারণ করতে পারছিলেন না উভয়ের মধ্যে কে মুহাম্মদ, তবে মুহাম্মদ যখন তাঁর উটের পিঠ থেকে নামছিলেন, আবু বকর তখন তড়িঘড়ি করে খুব দ্রুত রোদ থেকে বাঁচাতে মুহাম্মদের মাথায় একটা ছাতা মেলে ধরেন। মুহাম্মদ অবশেষে কুলছুম (Kulthum) নামের একজন বয়স্ক ধর্মান্তরিত ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান করেন, যিনি ছিলেন আউস গোত্রের একজন সদস্য। এদিকে আবু বকর একটি উচ্চভূমিতে অবস্থিত খাজরাজ পরিবারের কাছ থেকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
এর আগে উমর (Umar) এবং অন্যান্য বিতাড়িত মক্কাবাসীদের আশ্রয় দেয়া কুলছুমের বাড়িটি অভিবাসীদের জন্য একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কুলছুমের বাড়ি থেকে চার মাইল দূরত্বের খেজুর বাগান, শস্যক্ষেত এবং ফলের বাগান দিয়ে ঘেরা ইয়াছরিবের মরুদ্যানের প্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল মুহাম্মদের প্রথম যাত্রাবিরতি। অল্প সময়ের জন্য কুবাতে (৩) থাকাকালীন সময়ে বিশ্বাসীদের নিয়ে মুহাম্মদ নামাজের নেতৃত্ব দিতেন, আয়াত পাঠ করতেন, সমর্থকদের কাছ থেকে পরিদর্শন গ্রহণ করতেন এবং নতুন ধর্মান্ধরিতদের কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করতেন। তিনি কুবায় একটি মসজিদের নির্মাণের জায়গাও খুঁজে বের করেন।
তীব্র রোদে, উটের উপরে থাকা মুহাম্মদ ও আবু বকরকে ক্রমশই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। অবশেষে যখন অশ্বারোহেরা গ্রামে প্রবেশ করলেন, বিশ্বাসীরা চিৎকার করে বলে উঠল “আল্লাহু আকবর!” এবং তাদের শুভেচ্ছা বার্তায় ভাসিয়ে দিলেন। প্রত্যেকেই তাদের বাড়িতে আগতদের যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তারা কেউই মুহাম্মদকে দেখেনি এবং তারা নির্ধারণ করতে পারছিলেন না উভয়ের মধ্যে কে মুহাম্মদ, তবে মুহাম্মদ যখন তাঁর উটের পিঠ থেকে নামছিলেন, আবু বকর তখন তড়িঘড়ি করে খুব দ্রুত রোদ থেকে বাঁচাতে মুহাম্মদের মাথায় একটা ছাতা মেলে ধরেন। মুহাম্মদ অবশেষে কুলছুম (Kulthum) নামের একজন বয়স্ক ধর্মান্তরিত ব্যক্তির বাড়িতে অবস্থান করেন, যিনি ছিলেন আউস গোত্রের একজন সদস্য। এদিকে আবু বকর একটি উচ্চভূমিতে অবস্থিত খাজরাজ পরিবারের কাছ থেকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন।
এর আগে উমর (Umar) এবং অন্যান্য বিতাড়িত মক্কাবাসীদের আশ্রয় দেয়া কুলছুমের বাড়িটি অভিবাসীদের জন্য একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। কুলছুমের বাড়ি থেকে চার মাইল দূরত্বের খেজুর বাগান, শস্যক্ষেত এবং ফলের বাগান দিয়ে ঘেরা ইয়াছরিবের মরুদ্যানের প্রাণকেন্দ্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল মুহাম্মদের প্রথম যাত্রাবিরতি। অল্প সময়ের জন্য কুবাতে (৩) থাকাকালীন সময়ে বিশ্বাসীদের নিয়ে মুহাম্মদ নামাজের নেতৃত্ব দিতেন, আয়াত পাঠ করতেন, সমর্থকদের কাছ থেকে পরিদর্শন গ্রহণ করতেন এবং নতুন ধর্মান্ধরিতদের কাছ থেকে শপথ গ্রহণ করতেন। তিনি কুবায় একটি মসজিদের নির্মাণের জায়গাও খুঁজে বের করেন।
মুহাম্মদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর দাদীর দাদীর (great grandmother) এলাকায় নাজ্জার গোত্রের মধ্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এবং তিনি ও তাঁর অনুসারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে প্রবেশের একটা পরিকল্পনা করেন যা সেখানে যাওয়ার আগেই প্রচার করেন। নির্ধারিত দিনে মুহাম্মদ তাঁর উটের পিঠে আরোহণ করেন এবং বিশিষ্ট অনুসারীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাত্রা শুরু করেন। সেই যাত্রায় তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন নাজ্জার অশ্বারোহীদের একজন সশস্ত্র প্রহরী।
তাঁরা তো প্রতিদিন এমন একজনকে দেখতে পেতেন না, যাকে ঈশ্বর স্বর্গে নিয়ে গিয়েছেন বলে দাবি করেন। ইয়াছরিবের সবাই তাঁর সম্পর্কে গল্প শুনেছিলেন যে, 'তিনি এমন কিছু দেখেছেন যা আর কেউ দেখেনি এবং যা আর কেউ শোনেনি। তাঁর কাছে ঈশ্বরের বাণী প্রেরণ করা হয়; তিনি ছিলেন একজন বিনয়ী, অশিক্ষিত কিন্তু পবিত্র বান্দা, যাকে দিনে পাঁচবার প্রার্থনা করার নির্দেশনা দেয়ার জন্য প্রভুর সামনে ডেকে পাঠানো হয়েছিল এবং সংক্ষিপ্ত জীবন শেষেই তাঁকে জান্নাতে দাখিল করানো হবে। রাস্তায় জনতা ভিড় করল এবং অনেকে ছাদে উঠে পর্যন্ত তাঁকে দেখতে চাইল। কেউ কেউ চিৎকার করে বলল, “মুহাম্মদ এসেছেন!” অন্যেরা চিৎকার করে বলল, “আল্লাহু আকবর, আল্লাহর রাসুল এসেছেন!”
লোকজন তাঁর উটের পাশে, পেছনে দৌড়তে লাগল। কেউ কেউ তাঁকে তাদের সাথে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু তিনি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে, তাঁর উট ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত এবং কোথায় থামতে হবে ঈশ্বর সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আবদুল্লাহ উবাইয়ের দুর্গের পাশ দিয়েই তাঁর গন্তব্যে পৌঁছুলেন, সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, তিনিই একদিন ইয়াছরিবের রাজা হবেন। কিন্তু খাজরাজের যুদ্ধবাজ নেতা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “যারা আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আপনি তাদের খোঁজেন এবং তাদের সাথেই থাকুন” (৪)।
ধর্মান্তরিতরা যখন আনন্দে মেতে ছিল, ইয়াছরিবের অনেকেই সমস্যার গন্ধ পাচ্ছিল। তাঁর অনুসারীরা তখনও একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিল এবং মূলত প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ। ইয়াছরিবে বসবাসকারী বিশ হাজার মানুষের মধ্যে (৫) অর্ধেকই ছিল ইহুদি। মুহাম্মদ হিসেব কষে মক্কাবাসী অভিবাসীসহ তিনশত থেকে পাঁচশত জনের মতো বিশ্বাসী পেলেন। যদিও সংখ্যায় অনেক কম ছিল, তাঁরা স্বভাবে ছিল উগ্র এবং মুহাম্মদের আগমনের আগে তাঁরা প্রতিমা ভাংচুর করতে গিয়েছিল। তাঁরা বাড়িতে ঢুকে অবিশ্বাসীদের মূর্তি ধ্বংস বা চুরি করত যা তারা অব্যাহত রেখেছে মুহাম্মদের আগমনের পরও। এই ধরনের আক্রমনাত্মক আচরণ বেশি দেখা ওই সমস্ত তরুণদের ভেতর যাদের পিতামাতা পৌত্তলিকই রয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামিক ইতিহাসে একজন শেখের ছেলের কথা বলা হয়েছে, যিনি তাঁর পিতার একটি মূর্তিকে বদল করে একটি মৃত কুকুর প্রতিস্থাপন করেছিলেন এবং মুর্তিটিকে ছুঁড়ে ফেলেন। এটি ছিল দেবী মানাতের মূর্তি, পরে তিনি মাটিতে সেটি পুঁতে ফেলেন (৬)। এই ধরনের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে, বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকেই মুহাম্মদের আগমনকে উদ্বেগের সাথে দেখেন।
নাজ্জার অঞ্চলে ঢুকে মুহাম্মদ দাদীর দাদির উত্তরসূরিদের (great grandmother) গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তবে সেখানে থাকার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর পরিবর্তে তিনি তাঁর উটকে ছেড়ে দিলেন, একসময়ে উটটি আকাবায় তাঁর এক অনুসারী আবু আইয়ুবের (Abu Ayyub) দোতলা খামারবাড়ির সামনে এসে থামে। সম্ভবত এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত, কারণ আবু আইয়ুব দ্রুতই বাড়ি থেকে বের হয়ে মুহাম্মদের উট থেকে মালপত্র নামিয়ে ভেতরে ঢোকাচ্ছিল। মুহাম্মদকে ঘিরে ধরা লোকজন তাদের সাথে থাকার জন্য চিৎকার করতে থাকেন, মুহাম্মদ হাত নেড়ে তাদেরকে বলেন, “একজন মানুষ সেখানেই যাবে বাহক উট যেখানে তাঁকে নিয়ে যায়”। কিন্তু তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বাড়ির ভেতরে জিনিসপত্র সাজিয়ে তিনি জনতার সাথে কথা বলতে বেরিয়ে আসেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি আমাকে ভালোবাসেন?” যখন লোকেরা চিৎকার করে বলে উঠল “হ্যাঁ, ঈশ্বরের রাসুল”, মুহাম্মদ তখন চোখের জল আটকাতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আর আমি, ঈশ্বরের কসম, আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি! ঈশ্বরের কসম, আমি আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি”(৭)!
আবু আইয়ুবের বাড়িতে মুহাম্মদ একটু স্থির হবার পর তিনি একটি একটি স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সমন্বিত বাসস্থান এবং মসজিদ থাকবে। এ লক্ষ্যে তিনি আবু আইয়ুবের বাড়ি বরাবর আবু বকরের দেয়া টাকা দিয়ে একটি খোলা জমি ক্রয় করেন। জায়গাটির এককোণে পৌত্তলিক সমাধিস্থান, কিছু খেজুরের গাছ এবং একটি ঝুপড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না। পরবর্তী সাতমাস ধরে, ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিত এবং মক্কাবাসী হিজরতকারীরা মিলে পাথর এবং মাটি দিয়ে একটি বাড়ি তৈরি করেন। সম্পূর্ণ কাঠামোটি দশ ফুট উঁচু দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং প্রাঙ্গণটি একশত পঞ্চাশ ফুটের মত দৈর্ঘ্য ছিল। উপরন্তু, এর এক পাশ ধরে, বাইরের দিকে মুখ করা বেশ কয়েকটি কামড়া তৈরি করা হল। প্রার্থনার জন্য কোণায় একটা জায়গা প্রস্তুত করা হয়েছিল, যার স্তম্ভ হিসেবে তাল গাছের গুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে, যার ছাদটি তালগাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। একটি ধর্মপ্রচারকের পাটাতন নির্মিত হলো, এবং প্রার্থনাকারীদের নামাজের জন্য খেজুর পাতায় বোনা মাদুর বিছিয়ে দেয়া হলো। সম্পূর্ণ দালানটি একাধিক কাজ করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল। এটি ছিল মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবারের জন্য একটি বাসস্থান, বিশ্বাসীদের জন্য একটি প্রার্থনার জায়গা, নতুনদের জন্য ধর্মপ্রচারের কেন্দ্র এবং প্রশিক্ষণের জন্য একটি মক্তব। এটি শীঘ্রই মুহাম্মদের ঘাঁটি হবে, যেখানে তিনি আল-কায়েদা বাহিনী গঠন করবেন, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য।
নির্মাণের এই সময়টাতে তিনি আবু আইয়ুবের বাড়ির নিচের তলার বসবাসের ঘরটি তাঁর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেক মানুষ তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছে, এর মধ্যে একদল লোক তাঁর কাছে এসেছিল, তাঁর সাথে শহরের বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এবং ইয়াছরিবের গোত্রীয় জোটের জটিলতা সম্পর্কে অবগত করতে। মুমিনগণ এসেছিলেন তাঁর কাছ থেকে নির্দেশনার জন্য এবং তাদের মধ্যে বিবাদের মধ্যস্থতা করার জন্য তাঁরা মুহাম্মদকে অনুরোধ করেন। মুহাম্মদের আগমনের কয়েকমাসের মধ্যে ওই অঞ্চলের প্রধানের মৃত্যু হয়, যিনি ছিলেন তাঁর দাদীমহের বংশধর এবং তারপরই তিনি নাজ্জার গোত্রের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নাজ্জার গোত্রের নেতারা মুহাম্মদের কাছে এসে তাঁকে নতুন শেখ নিয়োগ দিতে বলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকেই নিয়োগ দেন। এই ভূমিকা তাঁকে বিভিন্ন খাজরাজ গোত্রের আদিবাসী পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন দেয়।
এই প্রারম্ভিক মাসগুলোতে তাঁকে অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয়। এসবের মধ্যে ছিল অনেক মক্কাবাসী অভিবাসীরা যারা ইয়াছরিবের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং ইয়াছরিবীদের অধিকাংশই তাদেরকে বিদেশি হিসেবে বিবেচনা করত। অনেকেই যারা মক্কায় তাদের মালিকানাধীন সবকিছু রেখে ইয়াছরিবে চলে এসেছিল তাদের সুরক্ষা দিতে ও দারিদ্র্যতা কমাতে মুহাম্মদ ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদের সাথে মক্কাবাসী অভিবাসীদের জুটি বেঁধে একটি কর্মসূচী শুরু করেন যার নাম দেন “ভ্রাতৃত্ব”। আবু বকর ইয়াছরিবে পৌঁছানোর পর উচ্চভূমির খাজরাজ পরিবারের প্রধানদের সাথে জুটি বেঁধেছিলেন। তিনি তাঁর নতুন ভাইদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন যে, তিনি তাদের এই ভাইয়ের মধ্যে একজনের ছোট মেয়েকে বিয়ে করলেন। ইয়াছরিবী ধর্মান্তরিতদের মধ্যে একজন এই ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে এতটাই চরম পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, সে তাঁর এক স্ত্রীকে আনন্দের সাথে মক্কাবাসী এক নতুন ভাইয়ের কাছে উৎসর্গ পর্যন্ত করতে চাইল। “আমার দুই স্ত্রী আছে। দেখুন আর ভাবুন, আপনি যাকে পছন্দ করেন আমি তাঁকে তালাক দিয়ে দেবো!” – বলছিলেন তিনি (৮)
-
তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়াও, একই সাথে মুহাম্মদ নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে একটি আদেশ জারি করেন যে, তাঁর ধর্মে বিশ্বাসীরা এখন থেকে বৈচিত্র্যময় ইয়াছরিবীদের মাঝে একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে থাকবে, আর তিনি হবেন তাদের নেতা। যদিও বিশ্বাসীরা ইয়াছরিব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কিন্তু এখন একচেটিয়াভাবে মুহাম্মদের কর্তৃত্বের অধীনে চলে এলো সবাই। অনুসারীদের মধ্যকার সকল দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য তাঁর কাছেই আসতে হবে, এমনকি সংঘাতের মাঝে যদি কোন একটি দল অবিশ্বাসী (কাফের) থাকে তবুও। তিনি এই নতুন বহুগোত্রীয় সম্প্রদায়কে এক ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীর নীতির সাথে যুক্ত করেছেন যেখানে তাদের একজনের উপর হামলার মানে দাঁড়াবে তাদের সবার উপর হামলা। এই নতুন সম্প্রদায়কে ছেঁটেছুটে তৈরি করার পাশাপাশি মুহাম্মদ ইয়াছরিবের পৌত্তলিক গোত্রদের বিচ্ছিন্নকরণ এড়িয়ে যান। নতুন এই সমাজ গঠনের প্রাক্কালে মুহাম্মদ ইয়াছরিবের পৌত্তলিকদের বিরোধিতা করার নীতি সুচতুরভাবে এড়িয়ে যান, এমনকি তখন তিনি তাঁর নতুন অনুসারীদেরকে গোত্রগত প্রথাকে সম্মান করার নির্দেশনা জারি করেন। গোত্রে গোত্রে চলমান রক্তপণ (দিয়ত) প্রথা ও রাজনৈতিক মিত্রতামুলক চুক্তিসমূহ মেনে চলতেও তিনি নির্দেশ দেন, যতক্ষণ না তারা নতুন এই নীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করে। তিনি ইহুদিদের জন্যও দরজা খুলে দিলেন। তাঁর প্রবল ইচ্ছে ছিল যেন ইহুদিরা তাঁর ধর্মে যোগ দেয়। এবং প্রথমদিকে তিনি সহিষ্ণুতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের দলে আনার চেষ্টা করেন। সময়ের সাথে সাথে সাংগঠনিক আদেশগুলো সংশোধন এবং আধুনিকীকরণের মধ্য দিয়ে যায় এবং অবশেষে ৪৭টি ধারা যুক্ত করে একটা চূড়ান্ত রূপ দেয়। চুড়ান্ত সংস্করণ, যাকে সাধারণত “মদীনার সংবিধান/মদিনা সনদ” বলা হয়। এটির মাধ্যমে মূলত ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় (৯)।
লোকজন তাঁর উটের পাশে, পেছনে দৌড়তে লাগল। কেউ কেউ তাঁকে তাদের সাথে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু তিনি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে, তাঁর উট ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত এবং কোথায় থামতে হবে ঈশ্বর সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আবদুল্লাহ উবাইয়ের দুর্গের পাশ দিয়েই তাঁর গন্তব্যে পৌঁছুলেন, সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, তিনিই একদিন ইয়াছরিবের রাজা হবেন। কিন্তু খাজরাজের যুদ্ধবাজ নেতা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “যারা আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, আপনি তাদের খোঁজেন এবং তাদের সাথেই থাকুন” (৪)।
ধর্মান্তরিতরা যখন আনন্দে মেতে ছিল, ইয়াছরিবের অনেকেই সমস্যার গন্ধ পাচ্ছিল। তাঁর অনুসারীরা তখনও একটি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ছিল এবং মূলত প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ। ইয়াছরিবে বসবাসকারী বিশ হাজার মানুষের মধ্যে (৫) অর্ধেকই ছিল ইহুদি। মুহাম্মদ হিসেব কষে মক্কাবাসী অভিবাসীসহ তিনশত থেকে পাঁচশত জনের মতো বিশ্বাসী পেলেন। যদিও সংখ্যায় অনেক কম ছিল, তাঁরা স্বভাবে ছিল উগ্র এবং মুহাম্মদের আগমনের আগে তাঁরা প্রতিমা ভাংচুর করতে গিয়েছিল। তাঁরা বাড়িতে ঢুকে অবিশ্বাসীদের মূর্তি ধ্বংস বা চুরি করত যা তারা অব্যাহত রেখেছে মুহাম্মদের আগমনের পরও। এই ধরনের আক্রমনাত্মক আচরণ বেশি দেখা ওই সমস্ত তরুণদের ভেতর যাদের পিতামাতা পৌত্তলিকই রয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামিক ইতিহাসে একজন শেখের ছেলের কথা বলা হয়েছে, যিনি তাঁর পিতার একটি মূর্তিকে বদল করে একটি মৃত কুকুর প্রতিস্থাপন করেছিলেন এবং মুর্তিটিকে ছুঁড়ে ফেলেন। এটি ছিল দেবী মানাতের মূর্তি, পরে তিনি মাটিতে সেটি পুঁতে ফেলেন (৬)। এই ধরনের আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে, বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকেই মুহাম্মদের আগমনকে উদ্বেগের সাথে দেখেন।
নাজ্জার অঞ্চলে ঢুকে মুহাম্মদ দাদীর দাদির উত্তরসূরিদের (great grandmother) গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন, তবে সেখানে থাকার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর পরিবর্তে তিনি তাঁর উটকে ছেড়ে দিলেন, একসময়ে উটটি আকাবায় তাঁর এক অনুসারী আবু আইয়ুবের (Abu Ayyub) দোতলা খামারবাড়ির সামনে এসে থামে। সম্ভবত এটা ছিল পূর্বপরিকল্পিত, কারণ আবু আইয়ুব দ্রুতই বাড়ি থেকে বের হয়ে মুহাম্মদের উট থেকে মালপত্র নামিয়ে ভেতরে ঢোকাচ্ছিল। মুহাম্মদকে ঘিরে ধরা লোকজন তাদের সাথে থাকার জন্য চিৎকার করতে থাকেন, মুহাম্মদ হাত নেড়ে তাদেরকে বলেন, “একজন মানুষ সেখানেই যাবে বাহক উট যেখানে তাঁকে নিয়ে যায়”। কিন্তু তিনি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বাড়ির ভেতরে জিনিসপত্র সাজিয়ে তিনি জনতার সাথে কথা বলতে বেরিয়ে আসেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করেন, “আপনারা কি আমাকে ভালোবাসেন?” যখন লোকেরা চিৎকার করে বলে উঠল “হ্যাঁ, ঈশ্বরের রাসুল”, মুহাম্মদ তখন চোখের জল আটকাতে পারলেন না। তিনি বললেন, “আর আমি, ঈশ্বরের কসম, আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি! ঈশ্বরের কসম, আমি আপনাদের সবাইকে ভালোবাসি”(৭)!
আবু আইয়ুবের বাড়িতে মুহাম্মদ একটু স্থির হবার পর তিনি একটি একটি স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সমন্বিত বাসস্থান এবং মসজিদ থাকবে। এ লক্ষ্যে তিনি আবু আইয়ুবের বাড়ি বরাবর আবু বকরের দেয়া টাকা দিয়ে একটি খোলা জমি ক্রয় করেন। জায়গাটির এককোণে পৌত্তলিক সমাধিস্থান, কিছু খেজুরের গাছ এবং একটি ঝুপড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না। পরবর্তী সাতমাস ধরে, ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিত এবং মক্কাবাসী হিজরতকারীরা মিলে পাথর এবং মাটি দিয়ে একটি বাড়ি তৈরি করেন। সম্পূর্ণ কাঠামোটি দশ ফুট উঁচু দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং প্রাঙ্গণটি একশত পঞ্চাশ ফুটের মত দৈর্ঘ্য ছিল। উপরন্তু, এর এক পাশ ধরে, বাইরের দিকে মুখ করা বেশ কয়েকটি কামড়া তৈরি করা হল। প্রার্থনার জন্য কোণায় একটা জায়গা প্রস্তুত করা হয়েছিল, যার স্তম্ভ হিসেবে তাল গাছের গুড়ি ব্যবহার করা হয়েছে, যার ছাদটি তালগাছের ডালপালা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। একটি ধর্মপ্রচারকের পাটাতন নির্মিত হলো, এবং প্রার্থনাকারীদের নামাজের জন্য খেজুর পাতায় বোনা মাদুর বিছিয়ে দেয়া হলো। সম্পূর্ণ দালানটি একাধিক কাজ করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছিল। এটি ছিল মুহাম্মদ ও তাঁর পরিবারের জন্য একটি বাসস্থান, বিশ্বাসীদের জন্য একটি প্রার্থনার জায়গা, নতুনদের জন্য ধর্মপ্রচারের কেন্দ্র এবং প্রশিক্ষণের জন্য একটি মক্তব। এটি শীঘ্রই মুহাম্মদের ঘাঁটি হবে, যেখানে তিনি আল-কায়েদা বাহিনী গঠন করবেন, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য।
নির্মাণের এই সময়টাতে তিনি আবু আইয়ুবের বাড়ির নিচের তলার বসবাসের ঘরটি তাঁর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহার করেন। অনেক মানুষ তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছে, এর মধ্যে একদল লোক তাঁর কাছে এসেছিল, তাঁর সাথে শহরের বিভিন্ন ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য এবং ইয়াছরিবের গোত্রীয় জোটের জটিলতা সম্পর্কে অবগত করতে। মুমিনগণ এসেছিলেন তাঁর কাছ থেকে নির্দেশনার জন্য এবং তাদের মধ্যে বিবাদের মধ্যস্থতা করার জন্য তাঁরা মুহাম্মদকে অনুরোধ করেন। মুহাম্মদের আগমনের কয়েকমাসের মধ্যে ওই অঞ্চলের প্রধানের মৃত্যু হয়, যিনি ছিলেন তাঁর দাদীমহের বংশধর এবং তারপরই তিনি নাজ্জার গোত্রের আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নাজ্জার গোত্রের নেতারা মুহাম্মদের কাছে এসে তাঁকে নতুন শেখ নিয়োগ দিতে বলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকেই নিয়োগ দেন। এই ভূমিকা তাঁকে বিভিন্ন খাজরাজ গোত্রের আদিবাসী পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ আসন দেয়।
এই প্রারম্ভিক মাসগুলোতে তাঁকে অনেক সমস্যার সমাধান করতে হয়। এসবের মধ্যে ছিল অনেক মক্কাবাসী অভিবাসীরা যারা ইয়াছরিবের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং ইয়াছরিবীদের অধিকাংশই তাদেরকে বিদেশি হিসেবে বিবেচনা করত। অনেকেই যারা মক্কায় তাদের মালিকানাধীন সবকিছু রেখে ইয়াছরিবে চলে এসেছিল তাদের সুরক্ষা দিতে ও দারিদ্র্যতা কমাতে মুহাম্মদ ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদের সাথে মক্কাবাসী অভিবাসীদের জুটি বেঁধে একটি কর্মসূচী শুরু করেন যার নাম দেন “ভ্রাতৃত্ব”। আবু বকর ইয়াছরিবে পৌঁছানোর পর উচ্চভূমির খাজরাজ পরিবারের প্রধানদের সাথে জুটি বেঁধেছিলেন। তিনি তাঁর নতুন ভাইদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন যে, তিনি তাদের এই ভাইয়ের মধ্যে একজনের ছোট মেয়েকে বিয়ে করলেন। ইয়াছরিবী ধর্মান্তরিতদের মধ্যে একজন এই ভ্রাতৃত্ববন্ধনকে এতটাই চরম পর্যায়ে নিয়ে যায় যে, সে তাঁর এক স্ত্রীকে আনন্দের সাথে মক্কাবাসী এক নতুন ভাইয়ের কাছে উৎসর্গ পর্যন্ত করতে চাইল। “আমার দুই স্ত্রী আছে। দেখুন আর ভাবুন, আপনি যাকে পছন্দ করেন আমি তাঁকে তালাক দিয়ে দেবো!” – বলছিলেন তিনি (৮)
-
তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা ছাড়াও, একই সাথে মুহাম্মদ নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে একটি আদেশ জারি করেন যে, তাঁর ধর্মে বিশ্বাসীরা এখন থেকে বৈচিত্র্যময় ইয়াছরিবীদের মাঝে একটি স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে থাকবে, আর তিনি হবেন তাদের নেতা। যদিও বিশ্বাসীরা ইয়াছরিব জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কিন্তু এখন একচেটিয়াভাবে মুহাম্মদের কর্তৃত্বের অধীনে চলে এলো সবাই। অনুসারীদের মধ্যকার সকল দ্বন্দ্ব সমাধানের জন্য তাঁর কাছেই আসতে হবে, এমনকি সংঘাতের মাঝে যদি কোন একটি দল অবিশ্বাসী (কাফের) থাকে তবুও। তিনি এই নতুন বহুগোত্রীয় সম্প্রদায়কে এক ঐক্যবদ্ধ গোষ্ঠীর নীতির সাথে যুক্ত করেছেন যেখানে তাদের একজনের উপর হামলার মানে দাঁড়াবে তাদের সবার উপর হামলা। এই নতুন সম্প্রদায়কে ছেঁটেছুটে তৈরি করার পাশাপাশি মুহাম্মদ ইয়াছরিবের পৌত্তলিক গোত্রদের বিচ্ছিন্নকরণ এড়িয়ে যান। নতুন এই সমাজ গঠনের প্রাক্কালে মুহাম্মদ ইয়াছরিবের পৌত্তলিকদের বিরোধিতা করার নীতি সুচতুরভাবে এড়িয়ে যান, এমনকি তখন তিনি তাঁর নতুন অনুসারীদেরকে গোত্রগত প্রথাকে সম্মান করার নির্দেশনা জারি করেন। গোত্রে গোত্রে চলমান রক্তপণ (দিয়ত) প্রথা ও রাজনৈতিক মিত্রতামুলক চুক্তিসমূহ মেনে চলতেও তিনি নির্দেশ দেন, যতক্ষণ না তারা নতুন এই নীতির সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করে। তিনি ইহুদিদের জন্যও দরজা খুলে দিলেন। তাঁর প্রবল ইচ্ছে ছিল যেন ইহুদিরা তাঁর ধর্মে যোগ দেয়। এবং প্রথমদিকে তিনি সহিষ্ণুতার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের দলে আনার চেষ্টা করেন। সময়ের সাথে সাথে সাংগঠনিক আদেশগুলো সংশোধন এবং আধুনিকীকরণের মধ্য দিয়ে যায় এবং অবশেষে ৪৭টি ধারা যুক্ত করে একটা চূড়ান্ত রূপ দেয়। চুড়ান্ত সংস্করণ, যাকে সাধারণত “মদীনার সংবিধান/মদিনা সনদ” বলা হয়। এটির মাধ্যমে মূলত ধর্মতত্ত্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় (৯)।
[মুহাম্মদের মসজিদ ছিল তাঁর আল-কায়েদা, যার মানে তাঁর অভিযানের ভিত্তি। এটি ইয়াছরিবে পৌঁছানোর পর নির্মিত হয় এবং এটি ছিল প্রার্থনার জায়গা, তাঁর বাসস্থান, মতবাদ প্রচারের কেন্দ্র এবং তাঁর সদর দপ্তর যেখান থেকে যুদ্ধের সূচনা করেছেন। প্রথমে মক্কাবাসী শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং পরে ইয়াছরিবের ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, যারা তাঁকে তাদের নবী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল।]
মুহাম্মদ ইয়াছরিবে আসার সাতমাস পর মসজিদ প্রাঙ্গনটি খোলা হয়। তিনি সেখানে তাঁর পরিবারের জন্য জায়গা বরাদ্দ করেন, তাঁর চাচাত ভাই আলীকে একটি কক্ষ দেয়া হল এবং মুহাম্মদের মেয়েদের জন্য আলাদা কক্ষ রাখা হল। রক্ষণশীল সাওদার জন্য আরেকটা কক্ষ দেয়া হল।
এটি শেষ করার পর মুহাম্মদের প্রথম কাজ ছিল, নয় বছর বয়সী আয়েশাকে তাঁর কাছে নিয়ে আসা। তিন বছর আগে আবু বকরের আশীর্বাদে আয়েশাকে তিনি বিয়ে করেন। আবু বকর খাজরাজের উঁচু ভূমিতে তাঁর নতুন শশুরবাড়িতে আয়েশাকে নিয়ে বাস করছিলেন।
নির্ধারিত দিনে মুহাম্মদ সেই বাড়িতে গেলেন। আবু বকরের বাড়ির ভেতরে যখন তিনি বিবাহকে পরিপূর্ণতা দানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আয়েশাকে তাঁর মা ডেকেছিল। সে তখন উঠোনে বন্ধুদের সাথে খেলছিল এবং দৌড়ে বাড়ি পৌঁছানোর কারণে ছোট্ট আয়েশা হাপিয়ে ওঠে। তার মা তাকে শান্ত করার জন্য দরজায় বসিয়েছিলেন। আয়েশা পরে এই ঘটনাটি স্মরণ করেছিল এভাবে : “মা একটু জল নিয়ে আমার মুখ এবং মাথা মুছে আমাকে ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের ঘরের ভেতরে একটি বিছানায় ঈশ্বরের রাসুল (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) ছিলেন, পুরুষ ও মহিলা সহ আনসার (Ansar) তথা সাহায্যকারীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি বসে ছিলেন । তিনি আমাকে কোলে বসিয়ে বললেন, “এরা তোমার পরিবার; ঈশ্বর তোমাকে তাদের দ্বারা এবং তাদেরকে তোমার দ্বারা মঙ্গল করুন”। পুরুষ এবং মহিলারা তখন লাফ দিয়ে উঠে চলে গেল।
সাওদার মত, আয়েশারও মসজিদে তাঁর নিজস্ব কক্ষ ছিল। এটি ছিল মুহাম্মদের জন্য নির্মিত একটি কক্ষ, যা সরাসরি ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে নির্মিত মঞ্চটির (আরবিতে বলা হয় মেহরাব) পেছনে তৈরি করা হয়েছিল। ঘরের ভেতর দিয়ে একটি দরজা এবং জানালা ছিল, যার মাধ্যমে তিনি সহজেই সেই মঞ্চে প্রবেশ করতে পারতেন। মঞ্চ আর রুমটি একটা পর্দা দ্বারা আলাদা করা হয়েছিল। আয়েশা তাঁর সঙ্গে সংগ্রহের পুতুল নিয়ে এসেছিল, এবং মুহাম্মদ কখনও কখনও তাঁর সাথে পুতুল খেলতেন, এবং খেলার সাথীদের তাঁর সাথে খেলার অনুমতি দিতেন। মসজিদ খোলার সাথে সাথে বিভিন্ন সাংগঠনিক সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে বাধ্যতামূলক নামাজের সময় মানুষকে সময়মত হাজির করা ছিল ঝামেলার। ভোরের প্রার্থনায় সময় যারা দেরি করে আসতেন তাদের নিয়ে মুহাম্মদ সমস্যায় ছিলেন। ততদিনে মুহাম্মদ মানুষকে নামাজের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো শুরু করেছেন অনুসারীদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা জাগিয়ে তোলার জন্য, কিন্তু একইসাথে তিনি জানিয়েছিলেন যে, যখন তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তখন আসলে ফেরেশতারাও তাদের অনুকরণ করে।মসজিদের ভেতরে ঢুকে আঁটসাঁটভাবে দাঁড়িয়ে, সিজদার মাধ্যমে গাদাগাদি করে নামাজ শেষ করাটা অনেকটা কষ্টের বিষয় হয়ে গিয়েছিল। সমস্যার সমাধানের জন্য মুহাম্মদ উপরের ঐশ্বরিক আদেশের অপেক্ষা করেননি, অধিকন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। এই অস্থিরতার কারণ অনুমান করা অসম্ভব নয় – মানুষ নিজেরাই সময় অনুমান করে নামাজে আসত। এ সমস্যার সমাধান করতে কেউ একজন প্রার্থনার সময় ঘোষণা করার জন্য ঘণ্টা বাজানোর পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু মুহাম্মদ তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটা অনেকটা খ্রিস্টানদের আচারের মত হতো, আর তিনি শব্দকে ঘৃণা করতেন। আরেকজন শিংগা বাজানোর পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু মুহাম্মদ সেই ধারণাকে অপছন্দ করেছিলেন, কারণ এটি তাঁকে ইহুদিদের কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্যরা আগুন জ্বালানোর কথা বলেছিল। কেউ কেউ একসাথে হাততালি দেয়ার কথাও বলেছিল। অবশেষে একজন নামাজের জন্য ছাদের উপরে উঠে ডাক দেয়ার পরামর্শ দিলেন, মুহাম্মদ এ ধারণাটি পছন্দ করলেন।
নামাজের আহ্বানের ডাকের মূল কারণ পুনঃপুনঃ মনে করিয়ে দেয়া - "ঈশ্বরই সর্বশ্রেষ্ঠ, ঈশ্বরই সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, ঈশ্বর ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। নামাজে পড়তে আসো। মুক্তিতে আসো। ঈশ্বরই সর্বশ্রেষ্ঠ। ঈশ্বর ছাড়া আর কোন উপাসক নেই"। এই কথাগুলো দুইবার নামাজের সময় ঘোষণা করতে হবে, এবং তারপর সবাই জড়ো হবার পর তৃতীয়বারের মতো আবার ঘোষনা করা হতো। বিলাল ছিলেন দৃঢ় কণ্ঠস্বরের অধিকারী। উমাইয়া বিন খালাফের প্রাক্তন কৃষ্ণাঙ্গ দাস বিলালকে (Bilal) এই প্রার্থনার ঘোষক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। একটি শৃঙ্গ নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত, তিনি প্রতিদিন সকালে একটি পার্শ্ববর্তী ভবনের ছাদে উঠতেন এবং ঘোষণা করার জন্য ভোরের প্রথম আলো দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। অন্যান্য বাধ্যতামুলক প্রার্থনার সময়েও এটির পুনরাবৃত্তি করতেন।
প্রার্থনার জন্য এভাবে ডাক দেয়া দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান নিয়ে এলো। উপরন্তু, এটি মুহাম্মদকে বিনামূল্যে প্রচারের একটি নিরবিচ্ছিন্ন সুযোগ প্রদান করল। তাতে প্রতিটি নামাজের জন্য তিনবার বা দিনে পনেরবার তাঁর পরিচিতিমুলক নাম “আল্লাহর রাসুল” এর পুনরাবৃত্তি করা হবে। মসজিদ থেকে বেশ দূরত্বে থাকা লোকজন সবাই এই আওয়াজ শুনতে পেল, তাঁরা চাক বা না চাক। এটা একজন প্রচারপ্রার্থীর জন্য স্বপ্নপূরণের মতো, যা বারবার নিরবিচ্ছিন্ন আর বিনামূল্যে প্রচার করছে।
যখনই তাঁর আল-কায়েদা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং ইয়াছরিবে নিরাপদে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান সৃষ্টি হয়ে গেল, মুহাম্মদ আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ অনুসারীদের নিয়ে তাঁকে অস্বীকার করা সবার বিরুদ্ধে সামগ্রিক ও বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ শুরু করলেন, যা মাত্র সাতমাস আগে আকাবাতে শুরু করেছিলেন। এ পর্যায়ে মক্কাবাসীরা তাঁর লক্ষ্যবস্তু, এবং তিনি তাদের কাফেলাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান শুরু করেন, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হতে পারেননি। প্রথম ঘটনাটি ঘটে ৬২৩ সালের মার্চ মাসে, যখন তিনি জানতে পারেন যে, আবুল হাকামের নেতৃত্বে একটি বিশাল কাফেলা লোহিত সাগর বরাবর সিরিয়া থেকে ফিরছিল। এটা ছিল প্রধান বার্ষিক কাফেলা। তিনশত ব্যবসায়ী, প্রহরী এবং উটের চালকরা সোনা ও রূপার মুনাফা বহন করে এবং দুই হাজার উটের পিঠে শতশত টন পণ্য বহন করে আসছিল (১১)।
ত্রিশজন মক্কাবাসীকে নিয়ে মুহাম্মদ একটি দল তৈরি করেন এবং তিনি তাঁর চাচা হামজাকে এই দলটির পরিচালনার দায়িত্ব দেন, এবং হামজাকে আদেশ দেন কাফেলা আক্রমণ করতে। কেউ প্রতিরোধ করলেই তাকে হত্যা করতে বলেন এবং কাফেলা নিয়ে ইয়াছরিব ফিরতে বলেন। সফল হলে এটি মক্কাবাসীদের পঙ্গু করে দেবে, মুহাম্মদের কার্যকলাপকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তহবিল প্রদান করবে এবং মক্কাবাসী অভিবাসীদেরকে সমর্থনের যে বোঝা ইয়াছরিব ধর্মান্তরিতদের উপর চাপানো হয়েছে তা থেকে তাঁরা মুক্ত হবেন।
হামজা ও তাঁর যোদ্ধারা দ্রুতগামী উটের পিঠে সওয়ার হয়ে ইয়াছরিব থেকে দ্রুত বের হয়ে জুহাইনা (Juhayna) গোত্রের এলাকায় অবস্থান নেন। তাঁরা জানতেন, লোহিত সাগরের দিক থেকে একটি কাফেলা এই দিকেই আসছে। কিন্তু অভিযানটি ব্যর্থ হয়। মক্কাবাসীরা যথেষ্ট সময় পায় রক্ষণাত্মক অবস্থায় কাফেলা ঘিরে রাখার। কাফেলা ভ্রমণের সূত্রে মক্কাবাসীদের কাছ থেকে কর সংগ্রহকারী জুহাইনার গোত্রপ্রধান বিরোধী শক্তির মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ না করতে দুই পক্ষকে রাজি করান, আর এভাবে এই অচলাবস্থার পরিসমাপ্তি ঘটান। ফলে হামজা খালি হাতে ইয়াছরিবে ফিরে আসেন এবং আবুল হাকামের কাফেলা দক্ষিণে চলতে থাকে।
পরবর্তী কয়েকমাসে মুহাম্মদ মক্কাবাসী কাফেলার বিরুদ্ধে আরো অভিযানকারী দল প্রেরণ করেন, কিন্তু কোনটাই সফল হয়নি। এসবের মধ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়া একটি কাফেলা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা দেন দক্ষ তীরন্দাজ মুহাম্মদের মামাতো ভাই সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, যিনি দশবছর আগে একটি উটের চোয়াল দিয়ে একজন মক্কাবাসীর মাথা ফাটিয়েছিলেন। কিন্তু কাফেলায় থাকা লোকেদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় ওয়াক্কাস ও তাঁর সঙ্গীরা পিছিয়ে গেলেন। অন্যান্য অভিযানগুলোও ব্যর্থ হয়েছে, কারণ কাফেলাগুলো ইতোমধ্যেই বিপজ্জনক এলাকা অতিক্রম করে তাদের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছিল। সাফল্য না পাওয়ার হতাশায় মুহাম্মদ নিজে বেশ কয়েকটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন, কিন্তু সেসবও ব্যর্থ হয়। ইয়াছরিবের দক্ষিণে অবস্থিত আল-আবওয়ার কাছে উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে থাকা একটি কাফেলায় হামলা চালানোর জন্য একবার তিনি দুইশত লোককে নেতৃত্ব দেন যেখানে তাঁর মাকে সমাহিত করা হয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে খালাফ সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেছেন। যাইহোক, এই যাত্রা একেবারে অপচয় হয়নি। ফিরে আসার পথে মুহাম্মদ তাঁর যোদ্ধাদের সমর্থনে এতদঞ্চলের একটি বেদুইন গোত্রের সাথে একটি 'অনাক্রমণ চুক্তি' করেন।
-
একমাত্র আক্রমণ যা থেকে মুহাম্মদের কিছু গণিমতের মাল অর্জিত হয়েছে - আর মুহাম্মদের জন্য তা একটা ধাক্কাও ছিল – সেটি ছিল তায়েফ থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাওয়া একটা ছোট বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ। সেই কাফেলায় চামড়াজাত পণ্য, আঙ্গুরের রস, মদ বোঝাই করা ছিল। মুহাম্মদ যখন কাফেলাটির প্রস্থানের তারিখ জানতে পারেন তখন তিনি তাঁর চাচাত ভাই আবদুল্লাহ বিন জাহশকে প্রধান করে কিছু মক্কাবাসী যোদ্ধাকে একত্র করে আটজনের একটি দল নিযুক্ত করলেন ওই কাফেলা আক্রমণ করতে। কিন্তু মুহাম্মদ এই আক্রমণ ফাঁস হওয়া নিয়ে এতটাই ভীত ছিলেন যে, তিনি জাহশকে (Jahsh) সিল মেরে একটি আদেশপত্র হাতে দেন এবং তাদের চলে যাওয়ার দু'দিন পরেই সেটি খোলার আদেশ দেন। সিলমুক্ত করে চিঠিটি খোলার পরই কেবল জাহশ জানতে পারে যে, তাদের আল-উজ্জার অভয়ারণ্য নাখলার (Nakhla) দিকে এগিয়ে যেতে হবে, যেখানে রাস্তাটি দক্ষিণে তায়েফের দিকে নেমে গেছে এবং সেখানে কাফেলার উপর হামলার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করবে। সেখানে পৌঁছানোর আগে জাহশ তাঁর দু'জন লোককে হারিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস। যে উটের উপর সাদ ছিল সেটি দৌড়ে চলে যায়, আর সেটাকে পুনরুদ্ধার করতে সাদ এবং অন্য একজনের পেছনে পড়ে থাকতে হয়েছে। কাফেলাটি ছিল সহজ বাছাই - চারজন তরুণ আরোহী একডজন মাল বোঝাই পশুর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। জাহশ তীর দিয়ে একজনকে হত্যা করে, আরও দু'জনকে ধরে ফেলে, আর চতুর্থজন পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা পণ্যবোঝাই পশু এবং বন্দিদের নিয়ে ইয়াছরিব ফিরে আসেন (১২)।
পবিত্র রজব মাসের (যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস) শেষদিনে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় যখন মক্কাবাসীদের নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল না। যদিও মুহাম্মদের পৌত্তলিক বিশ্বাস চর্চার কোন কারণ ছিল না, কিন্তু তাঁর মক্কান শত্রু এবং ইয়াছরিবে থাকা বিরোধীরা এই লঙ্ঘনের (পবিত্র মাসের) উপলক্ষ ব্যবহার করে তাঁর বিরুদ্ধে লোকদের খেপিয়ে তোলে। ইয়াছরিবে ধর্মান্তরিতদের অনেকেই যারা বহুঈশ্বরবাদী শেকড় থেকে খুব বেশি দুরে ছিল না, তারাও চিন্তিত হয়ে পড়ে, আর জাহশ (Jahsh) ও তাঁর লোকদের সমালোচনা করে। মুহাম্মদ অবশেষে এই বিতর্কের নিষ্পত্তি করেন - মক্কাবাসীদের উপর দোষারোপ করে তিনি কোরআনের আয়াত রচনা করেন এরূপ : They had refused to listen to the words of Allah that had been transmitted to them through his messenger, and they had offended Allah by driving him and his followers out of Mecca; therefore they were fair game for Allah's vengeance even during the sacred months (১৩)।
মক্কাবাসীরা বন্দিদের মুক্তিপণের জন্য অর্থ পাঠিয়েছিল, কিন্তু মুহাম্মদ প্রথমে তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। কারণ, ওয়াক্কাস ও তাঁর অশ্বারোহী সঙ্গী এখনো নিখোঁজ। তিনি মক্কাবাসীদের সতর্ক করে দেন যে, যদি দেখা যায় যে তাঁর সৈন্যদের বন্দি করা হয়েছে অথবা হত্যা করা হয়েছে, তাহলে তিনি প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তাঁর হাতে অসহায় বন্দিদের হত্যা করবে। উমর সবসময় তলোয়ার হাতে অবিলম্বে (কাফেরদেরকে) জাহান্নামে পাঠানোর প্রস্তাব দিতেন। একজন বন্দী বারবার তাঁর মাথা কেটে ফেলার কথা শুনে এতই মর্মাহত ছিল যে, সে ভয়ে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করে এবং বলে – “আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইশ্বর নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত রাসূল!” নিখোঁজ দুই ব্যক্তি অবশেষে ইয়াছরিবের দিকে ফিরে আসে, জলশূন্যতায় বিধ্বস্ত হয়ে। তাঁরা তাদের উট পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং পায়ে হেঁটে তাদের ইয়াছরিবে ফিরে আসতে হয়েছিল। অবশিষ্ট বন্দী যিনি ধর্মান্তরিত হননি তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় এবং তিনি মক্কায় ফিরে যান।
-
এই পর্বের চুড়ান্ত ঘটনাটি ঘটে যখন মুহাম্মদ চুরি করা পণ্য আক্রমণকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেন, আর নিজের জন্য এক পঞ্চমাংশ রাখেন। এটাই ছিল মোহাম্মদ কর্তৃক খুমুস (khumus) নেয়ার প্রথম উদাহরণ, অর্থাৎ মুহাম্মদ নিজে বিশ শতাংশ যুদ্ধলব্ধ সেই লুটের পণ্য গ্রহণ করেন। সময়ের সাথে সাথে, অভিযান এবং যুদ্ধ থেকে সম্মিলিত লুণ্ঠন একটি সম্রাটের ভাগ্য নির্মাণ করবে, মুহাম্মদ এবং তাঁর অনুসারীদের অনেকেই এত ধনী হয়ে যাবেন যা তাঁরা স্বপ্নেও কল্পনা করেননি।