অধ্যায় - ১৫ আপনার মাঝেই কসাই
ইয়াছরিবের বাইরে মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা লুটতরাজের সংস্কৃতি চালু করেছিল। মক্কার অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে, সেই সাথে তাঁর নিজের বাহিনীর সদস্যদের অর্থের ব্যবস্থা ও তাঁর আন্দোলনের অর্থনৈতিক উন্নতির স্বার্থে মুহাম্মদ মক্কার প্রতিটি বাণিজ্য কাফেলায় আক্রমণ করতেন। অধিকাংশ বহেরাগত মক্কাবাসী দরিদ্র ছিল, তাঁরা দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত। ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদের সাথে ভাতৃত্ববন্ধন তাদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করেছিল, কিন্তু সাথে তাদের আর্থিক সমস্যার বোঝা ইয়াছরিবী ধর্মান্তরিতদের কাঁধে চেপে বসেছিল। মুহাম্মদকে বিশ্বাস করলে পারলৌকিক শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, কিন্তু তাঁর অনুসারীদের আরও প্রতিশ্রুতির দরকার ছিল। তাদের নগদ অর্থের দরকার, আর তা দরকার ছিল খুব দ্রুতই।
মুহাম্মদের ইয়াছরিবে আসার ষোল মাস পরে বড় ডাকাতির একটা সুযোগ আসল, যখন মুহাম্মদ জানতে পারলেন যে, তাঁর একসময়কার মক্কান নিকট প্রতিবেশী আবু সুফিয়ান একটা বড় বাণিজ্য কাফেলার দায়িত্ব নিয়ে মক্কা থেকে সিরিয়া যাচ্ছেন। মুহাম্মদ তখন একদল বাহিনী পাঠালেন সেটার খোঁজ নিতে, কিন্তু তাঁর কাছে কাফেলা সম্পর্কিত তথ্যটি কয়েকদিনের পুরনো হওয়ার কারণে কাফেলাটি ফস্কে যায়। কাফেলাটি ইতিমধ্যেই ইয়াম্বুর (Yambu) তীর ধরে উত্তর দিকে চলে গেছে। তারপরও, যেটা উত্তর দিকে গেছে তা আবার দক্ষিণ দিকে আসবে। ফেরত আসার সম্ভাব্য সময় হিসেব করে কাফেলাটিকে খুঁজে বের করতে মুহাম্মদ তালহাকে (Talha) পাঠালেন, যাকে মক্কাবাসীরা একসময় আবু বকর এবং সাঈদের সাথে বন্দি করেছিল। সাঈদ ছিলেন আব্রাহামের ধর্মের প্রথম অনুসন্ধানী জায়েদের ছেলে। লোহিত সাগরের পথ ধরে চলতে থাকা এই কাফেলার অবস্থান অবশেষে তাঁরা জানতে পারল। এরপর ইয়াছরিবে ছুটে গিয়ে তাঁরা মুহাম্মদকে সেই কাফেলার লোকসংখ্যা, উট আর উটের উপর বোঝাই করা বস্তার পরিমাণ দেখে মালামালের হিসেব জানালেন।মুহাম্মদ এই কাফেলা আক্রমণের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের আহবান করে বললেনঃ “এই কাফেলায় আছে মক্কাবাসীদের সম্পদ, হয়ত ঈশ্বর এটি তোমাদের জন্য গনিমতের মাল হিসেবে মঞ্জুর করবেন” (১)। তিনি তাঁর অনুসারীদের বললেন, এই ডাকাতির আক্রমণ হল জিহাদ - আল্লাহর নামে যুদ্ধ। এখানে কেউ মারা গেলে তার জন্য পুরষ্কার হিসেবে আছে নিশ্চিত বেহেশত, আর যদি কেউ বেঁচে যায় তার জন্য আছে এই লুটের মালের (গনিমতে মাল) অংশ।
মক্কাবাসী দেশত্যাগীদের মধ্য থেকে সদস্য নেয়ার পরেও এমন বিশাল এক কাফেলার পুরোটা দখলে নিতে মুহাম্মদের আরো লোকবলের দরকার হলো, তাই তিনি ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদেরও এই অভিযানে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করলেন। গনিমতের মাল কিংবা বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সহসাই তিনশত লোক জোগাড় করে ফেললেন, যাদের তিন চুতর্থাংশই ছিল ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিত; কিন্তু তাদের মাঝে মাত্র সত্তরটি উট আর দুটি ঘোড়া ছিল। তাদের যার যা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ছিল সব নিয়ে এলো – তীর, ধনুক, ঢাল-তলোয়ার, ছোরা, আংটা ইত্যাদি। তাদের কারো কারো শিরস্ত্রাণ ও বর্ম ছিল। বলা হয়ে থাকে, মুহাম্মদের খুব কাছের পরামর্শদাতাদের একজন এই আক্রমণে আপত্তি জানিয়েছিলেন, কেননা তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে যাদেরকে সমগ্র মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাঁর অনন্য ঐশ্বরিক উদ্দেশ্যে মনোনীত করেছেন। কিন্তু মুহাম্মদ তাঁর এই আপত্তি খারিজ কর দেন।
মুহাম্মদের নেতৃত্বে ছোট সৈন্যবাহিনী, ইয়াছরিব থেকে প্রায় আশি মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কাফেলার বিরতিস্থল, সবুজে ঘেরা একটা জলাশয়ের স্থান বদরের (Badr) উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল, যা জলের প্রাচুর্য আর নারিকেল গাছের সুশীতল ছায়ার জন্য কাফেলার মাঝে জনপ্রিয় ছিল। সিরিয়া, ইয়াছরিব আর মক্কার পথের সংগমস্থল হওয়ায় মুহাম্মদ বিশ্বাস করলেন, আবু সুফিয়ানের কাফেলার সম্ভাব্য গন্তব্য এখানেই হবে। অনুমান সঠিক হল, যখন দুজন গুপ্তচর উটকে জল খাওয়াতে নিয়ে গেলেন তারা সেখানে থাকা দাসীদের মধ্যকার কথাবার্তায় জানতে পারল যে মক্কার বহরটি আগামী দুই-একদিনের মধ্যেই এসে পৌঁছবে।
আবু সুফিয়ান ততক্ষণে আক্রমণের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তিনি সিরিয়া ছাড়ার আগেই জেনে গিয়েছিলেন যে, উত্তরদিকের যাত্রার সময় মুহাম্মদ তাঁর কাফেলাটি আটকে রাখতে চায়েছিলেন এবং সুফিয়ানকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, তিনি ফেরার পথে মুহাম্মদ এখানে ডাকাতি করার পরিকল্পনা করছেন। তিনি মক্কায় সতর্ক ঘন্টা বাজানোর জন্য দ্রুতগতির একজন দূতকে প্রেরণ করলেন। মক্কাবাসীদের একত্রিত করতে খুব একটা সময় লাগেনি। ফিরতি কাফেলাটি বড় অংশীদার এবং ছোট অনেক বিনিয়োগকারীর প্রায় পঞ্চাশ হাজার সোনার দিনারের পণ্যদ্রব্য আর মুনাফা নিয়ে যাচ্ছিল, যা এমনকি আজকের যুগেও একটি সৌভাগ্যের ব্যাপার। তিনদিনের মধ্যে মক্কাবাসীরা নয়শত পঞ্চাশজন লোকের একটি বাহিনী জড়ো করে আবুল হাকামের নির্দেশে উত্তর দিকে যাত্রা করে।উট এবং যুদ্ধের ঘোড়াগুলি প্রস্তুত করার সময় হাকাম বললেন, “মুহাম্মাদ কি মনে করেছে যে, নাখলাতে তাঁর সহযোগীরা যা নিয়েছিল, তা সে আমাদের কাছ থেকেও নিতে পারবে? সে এইবার বুঝতে পারবে, আমরা আমাদের কাফেলা রক্ষা করতে পারি কিনা!” (২) আরো উত্তরে গিয়ে আবু সুফিয়ান নিরাপদ দূরত্বে কাফেলাটি থামালেন এবং মক্কার সেনাবাহিনীর অপেক্ষায় থাকলেন, আর মুহাম্মদের বাহিনীর খোঁজ করতে দূত প্রেরণ করলেন। তিনি নিজে গভীর রাতে বদর সফরে এসে, মুহাম্মদের প্রেরণ করা গুপ্তচর সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। তাদের উটচলার পথে পড়ে থাকা গোবরগুলিতে ইয়াছরিবে জন্মানো বিশেষ ধরণের খেজুরের অবশিষ্ট দেখে তিনি তাদের উপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। বদরের হ্রদ ঘেরা মরুদ্যানের দিকে যাত্রার পরিবর্তে তিনি কাফেলাকে একটি পাহাড়ের পথ পেরিয়ে লোহিত সাগরে নিয়ে পৌঁছেছিলেন এবং দক্ষিণ উপকুলটি অনুসরণ করেছিলেন। জোর করে দু'দিন পদযাত্রার পরে তিনি মুহাম্মদের কাছ থেকে অনেক দূরে কাফেলা সরিয়ে নিতে পারলেন। কাফেলাটির নিরাপত্তা একবার যখন নিশ্চিত হয়ে গেল তখন তিনি আবুল হাকামকে এই বার্তা পাঠালেন যে, তারা বিপদমুক্ত এবং সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর মক্কায় ফিরে যাওয়া উচিত।তবে আবুল হাকাম এই অগ্রগতি সম্পর্কে জানার পর পিছু হটতে অস্বীকার করেছিলেন। তারা যদি এখন লড়াই না করে মক্কায় ফিরে যায় তাহলে এটা তাদেরকে দুর্বল প্রতিপন্ন করবে এবং মুহাম্মদ আরও আক্রমণ চালিয়ে মক্কার বাণিজ্যকে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। খালি হাতে ফিরে কিছুই লাভ হবে না, সবকিছু হারিয়ে যেতে পারে। তিনি মুহাম্মদকে হত্যা বা ধরে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং তারা যদি তাঁকে জীবিত ধরতে পারে, তবে তাঁকে শৃঙ্খলে বেঁধে মক্কায় ফিরিয়ে আনবে। যদি দেখা যায় যে, মুহাম্মদ যুদ্ধ থেকে পালিয়েছে তবে তাঁরা তিনদিন বদরে ভোজনে কাটাবে এবং পূর্বনির্ধারিতভাবে বিজয় উদযাপন করবে।
মক্কার সমস্ত নেতা তাঁর মতো যুদ্ধের জন্য আগ্রহী ছিলেন না। রাবিয়া ভাইদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বণিকরা মক্কায় ফিরে যাওয়া ভালো বলে মনে করেছিলেন। উতবা ইবনে রাবিয়া যুক্তি দিলেন যে, তাঁরা কাফেলা রক্ষার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন এবং কাফেলাটি এখন যেহেতু নিরাপদ তাই তিনি আর এগিয়ে যাওয়ার কোনও যৌক্তিকতা দেখছেন না।যদি তাদের বিশ্বাস অনুসারে মুহাম্মদ মিথ্যাবাদী এবং প্রতারক হয়ে থাকে, তবে অন্যান্য আরবরা খুব শীঘ্রই তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে তাঁকে হত্যা করবে। আবুল হাকাম তাঁকে কাপুরুষ বলে অভিযুক্ত করেন। তিনি (উবা) যুদ্ধ করতে চাননি তার একমাত্র কারণ ছিল, তাঁর পুত্র আবু হুযায়ফা মুহাম্মদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁর পুত্রকে হত্যা করা হবে বলে তিনি ভয় পেয়েছিলেন।
আবুল হাকাম একটি সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এভাবে যে, তারা এই বিশ্বাসঘাতকদের কাউকে হত্যা করার চেষ্টা করবে না বরং কেবল তাদের ধরে মক্কায় ফিরিয়ে আনবে। হয়ত তাঁরা এখনও পুনর্বাসিত হতে পারে এবং তাদের পুর্বপুরুষদের ধর্মে ফিরে আসতে পারে। তবে রাবিয়া ভাইরা এই লড়াই না করার পক্ষে তর্ক করতে থাকে। তারা নিশ্চিত ছিল যে, এতে কোন ভালো ফল আসবে না।
এই তর্ক একধরনের হট্টগোলে পরিণত হয়। সেই রাতে দুটি ছোট গোত্র তাদের সাথে একশত যোদ্ধা নিয়ে সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিল। শেষ পর্যন্ত আবুল হাকাম উমাইয়া বিন খালাফ এবং অন্যান্য নেতাদের সমর্থনে রাবিয়া ও তাদের গোষ্ঠীগুলির সাথে তর্কাতর্কিতে বিজয়ী হন এবং যেই সংখ্যক সেনাদল অবশিষ্ট ছিল তাদের নিয়ে বদরের দিকে অগ্রসর হন। মুহাম্মদ বদর থেকে মাত্র একদিন দূরে থাকতেই মক্কা সেনাবাহিনী সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। সিধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিলেন - প্রস্তুতি নিয়েছিলেন মক্কার সম্পদ লুণ্ঠন করার, কিন্তু এখন মক্কাবাসীদের অস্ত্রের মুখোমুখি হতে হচ্ছে! সম্ভবত মুখ না হারিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার উপায় সন্ধান করতে তিনি তাঁবুতে একটি সভা আহ্বান করেছিলেন এবং তাঁর শীর্ষ লোকদের কাছ থেকে পরামর্শ চেয়েছিলেন। আবু বকর এবং উমর একটি অপ্রতিরোধ্য মক্কা বাহিনীকে মোকাবিলার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, তবে দু'জন নেতৃস্থানীয় ইয়াছরিবী সাদ বিন মুয়াদ ও মিকদাদ (Miqdad) যুদ্ধের সমর্থনে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছিলেন। একটি আবেগময় বক্তৃতায় সাদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ আল্লাহর নির্দেশিত এবং তিনি কোনও ভুল করতে পারেন না। যদি মুহাম্মদ তাদেরকে যুদ্ধ করতে বলেন তবে তা-ই সই, কারণ আল্লাহ তা'আলা মুহাম্মদকে যুদ্ধ করতে বলেছিলেন। “আমরা আপনাকে বিশ্বাস করি” - সাদ বললেন। “আমরা আপনার সত্যকে ঘোষণা করি, এবং আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি যা এনেছেন তা সত্য এবং আমরা আপনাকে কথা দিয়েছি, আর শোনার ও মেনে চলার অঙ্গীকার করেছি; কাজেই আপনি যেখানে ইচ্ছে সেখানে যান, আমরা আপনার সাথে আছি। এবং ঈশ্বরের শপথ, আপনি যদি আমাদেরকে এই সমুদ্রটি অতিক্রম করার অনুরোধ করেন এবং আপনি এটিতে নিমজ্জিত হন, আমরাও আপনার সাথে ডুবে যাব; একজন মানুষও পেছনে পড়ে থাকবে না। আমরা আপনার শত্রুর সাথে আগামীকাল দেখা করার প্রস্তাবকে অপছন্দ করি না। আমরা যুদ্ধে অভিজ্ঞ, লড়াইয়ে বিশ্বাসী” (৩)।
তারপরই মুহাম্মদ যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং দৃঢ় সংকল্পের সাথে নিজেকে এতে নিয়োগ করেছিলেন। ইরাকী ভ্রমণকারীর বেশ ধারণ করে তিনি এবং তাঁর বেশ কয়েকজন সহযোগী উপত্যকায় চড়ে বেড়িয়েছেন এবং পথে লোকজনকে থামিয়ে মক্কার সেনাবাহিনী সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন (8)। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মক্কাবাসীরা বিশালাকার বালির ঢিবিগুলোর পেছনে শিবির স্থাপন করেছে। তাঁর বাহিনীতে ফিরে এসে তিনি তাঁর চাচাত ভাই আলী, জুবায়ের, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস এবং অন্যান্যকে জলের এবং আরও তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠালেন। তিনি মক্কার সেনাদলের আকার এবং গঠন সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন, তবে তিনি এই কাফেলার অবস্থান সম্পর্কেও জানতে আগ্রহী ছিলেন এই ভেবে যে, তাহলে হয়ত মক্কা সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপের আগেই সেখানে আক্রমণ করার সুযোগ পাবেন।
অসংখ্য বদরের কুপগুলির মধ্য থেকে একটিতে মক্কাবাসীদের জন্য চামড়ার ব্যাগগুলি পূরণ করার জন্য জল নিতে আসা ছেলেদেরকে মুহাম্মদের চাচাত ভাইরা ধরে ফেলল। তারা তাদের শিবিরে ছেলেদেরকে নিয়ে এসে মারধর করল, যেখানে মুহাম্মদ নামাজ আদায় করছিলেন। মারধরের কারণে তারা মুখ খুলল। বালকরা মক্কাবাসী বাহিনীর সঠিক সংখ্যাটি জানত না, কেবল জানত একথা যে তাদের খাবারের জন্য প্রতিদিন নয় থেকে দশটি উট জবাই করা হয়। সেখান থেকে মুহাম্মদ মক্কাবাসী বাহিনীর আকারটি কমপক্ষে নয়শ থেকে এক হাজারের মধ্যে অনুমান করেছিলেন। ছেলেরা কাফেলা সম্পর্কে কিছুই জানত না, কারণ তারা মক্কার সেনাবাহিনীর সাথে ছিল (কাফেলার সাথে নয়)। ছেলেগুলি যখন সেনাদলের নেতাদের নামসমূহ বলল, মুহাম্মদ আনন্দিত হয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই মুহাম্মদের প্রতিশোধের তালিকায় ছিল। “মক্কা তাঁর কলিজার একটুকরো তোমাদের দিকে ছুঁড়ে ফেলেছে!” মুহাম্মদ তাঁর চাচাত ভাইদেরকে বলেছিলেন (৫)।
বদর উপত্যকাকে জানতেন, এমন একজন ইয়াছরিব ধর্মান্তরিতের পরামর্শ নিয়ে মুহাম্মদ মক্কাবাসীদের অবস্থানের নিকটতম একটি ঝর্নার কাছে শিবির স্থাপন করেছিলেন। এটি একটি বিচক্ষণ পদক্ষেপ ছিল, কারণ এটি মরূদ্যান থেকে বদরের প্রধান ঝর্নাগুলোর দিকে যাওয়ার পথে মক্কাবাসীদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মুহাম্মদের লোকেরা তাদের প্রয়োজনের পর্যাপ্ত জল ধরে রাখার জন্য একটি চামড়ার জলাশয় তৈরি করেছিলেন। অবস্থানটিও একটি চতুর নির্বাচন ছিল, কারণ মক্কাবাসী অশ্বারোহীদের আক্রমণে বাধা দেয়ার জন্য যথেষ্ট বড় পাথর দ্বারা এই এলাকাটি বিস্তৃত ছিল। এছাড়াও মুহাম্মদ তাঁর শিবির এমনভাবে স্থাপন করেছিলেন, যাতে সকালের সূর্যের আলো অগ্রসরমান মক্কাবাসীদের চোখ বরাবর পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রের একটা পরিপূর্ণ চিত্র সম্পর্কে নিজেকে ধারণা দিতে এবং শত্রুদের ছোঁড়া তীরের পরিসীমা থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে কাছাকাছি কিছুটা উঁচু স্থানে তাঁর জন্য একটি ছাউনি তৈরি করা হয়েছিল, যেখান থেকে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবেন। দক্ষ যোদ্ধার মতো অভয় দেয়া এবং জান্নাতের পুরষ্কার সম্পর্কে প্রচারণার পরেও মুহাম্মদের ভেতর ভয় ছিল। ওদের প্রতি একজনে বিপরিতে মক্কাবাসীদের সংখ্যা ছিল তিনজন, আর মক্কাবাসীরা ভালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। তিনি এখন মারা যাওয়ার মতো সম্ভাবনার মুখোমুখি হলেন, এবং তিনি মারা গেলে তাঁর ধর্মও সম্ভবত হারিয়ে যাবে। কথিত আছে যে, তিনি রাতের বেশিরভাগ সময় নামাজে কাটাতেন, প্রায়শই কাঁদতেন এবং মক্কাবাসীদেরকে অভিশাপ দিতেন এবং তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তাদের ধ্বংস করতে আল্লাহকে বলেছিলেন।
সেই রাতে বৃষ্টি হয়েছিল এবং মুহাম্মদের লোকেরা তাদের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি তাদেরকে যথারীতি প্রার্থনার জন্য ডাকলেন এবং ভেজা মাটিতে নামাজ আদায় করলেন। যখন চারদিকে আরো ফর্সা হল, তিনি তাদের সারিবদ্ধ লাইন ধরে দাঁড় করালেন। যদিও মুহাম্মদের সেনারা শত্রুভাবাপন্ন কিছু গোত্রের সাধারণ লোকদের মিশ্র দল ছিল, কিন্তু প্রার্থনার শারীরিক আচার-অনুষ্ঠানগুলি তাদের মধ্যে সুসজ্জিত সামরিক বাহিনীর ন্যায় শৃঙ্খলা আর জোশের তৈরি করেছিল। মুহাম্মদ সর্বদা নামাজের সোজাসুজি সারি বিন্যাসে জোর দিতেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ফেরেশতা এই পদ্ধতিতেই প্রার্থনা করেছিলেন। তারা একযোগে যেন তাদের প্রার্থনা রুটিনগুলি করতে পারে সেদিকে তিনি জোর দিয়েছিলেন, যার ফলে সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য সারিবদ্ধ অবস্থান এখন প্রায় স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যাচ্ছে। একটি ড্রিল সার্জেন্টের (Drill sergeant) মতো, তিনি সারিগুলির উপরে এবং নিচে যাওয়া আসা করছিলেন, এবং যে কাউকে লাইনের বাইরে দেখলেই তীরের ধারালো ডগা দিয়ে গুঁতো দিতেন। সাওয়াদ (Sawwad) নামের এক ব্যক্তি তাঁর শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়েছিল, বাহিনী হতে সরে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছিল। মুহাম্মদ তাঁকে তীরটি ধরিয়ে দিলেন এবং জামাটি খুলে তাঁর পেটটি উন্মোচিত করলেন, এবং স্বতস্ফুর্তভাবে বললেন, “এগিয়ে যাও, এটি দিয়ে আমাকে আঘাত কর!” প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে, লোকটি তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়ে অস্ত্র ছুঁড়ে মারলেন এবং হাঁটু গেড়ে বসে মুহাম্মদের খালি পেটে চুমু খেলেন। কেন এমনটি করল মুহাম্মদ তাঁকে জিজ্ঞেস করলে লোকটি বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আপনি যা ঘটতে যাচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছেন। আমি চেয়েছিলাম আপনার সাথে আমার শেষ যোগাযোগটি যেন আপনার ত্বককে স্পর্শ করে হয়"।মুহাম্মদ তাঁর আত্মবিশ্বাসের প্রতি আস্থা রাখার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন এবং তাঁর জন্য একটি প্রার্থনা করলেন (৬)।
ততক্ষণে মক্কাবাসীরা বাতাসে তাদের পকাতা উড়িয়ে এবং হুবাল, আল-উজ্জা এবং আল-লাতের মূর্তিগুলি উঁচু খুঁটিতে তুলে প্রদর্শন করে ঘোড়ায় চড়ে এবং পায়ে হেঁটে বালির টিলার দিকে এগিয়ে আসছিল। তারা শীঘ্রই মুহাম্মদের বিপরীতে তাদের নিজস্ব লাইন তৈরি করে দাঁড়ালো, ধনুকের তীরের আওতার বাইরে। কিন্তু এতে করে মক্কানদের অনেকেই তৃষ্ণার্ত পড়ে, কেউ কেউ ছিল চরম হতাশায় নিমজ্জিতও। এর আগের রাতেই মুহাম্মদের লোকেদের কারণে তাঁরা কেবল তাদের জল সরবরাহকারী ছেলেগুলোকেই নয়, তাদের জলের থলে এবং উটগুলিও হারিয়ে ফেলেছিল। মুহাম্মদের সামরিক শিবিরের অবস্থানটি উপত্যকার জলের উৎস থেকে মক্কাবাসীদের বিচ্ছিন্ন করেছিল। এই জলের সংকট মক্কাবাসীদের উপর কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তাদের মধ্য থেকে একটা দল তাদের দলীয় শৃংখলা ভেঙে ফেলে আর মুহাম্মদের লোকদের তৈরি করা চামড়ার জলাশয়ের দিকে দৌড়ে যায়, যা মুহাম্মদের যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই ছিল। মুহম্মদ তাদের জল পান করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার মূল কারণ ছিল এই দলের একজন ছিলেন খাদিজার ভাগ্নে হাকিম ইবনে হিজাম, যে ব্যক্তি জায়েদ ইবনে হারিছা নামের এক দাসকে বাজার থেকে কিনে খাদিজাকে দিয়েছিল। তারা জলপানের পর তাদের বহরে ফিরে আসার পরে, আবুল হাকামের মাখজুম গোত্রের আসওয়াদ (Aswad) নামে এক ব্যক্তি দৌড়ে জলাশয়ের দিকে ছুটে গেল, কিন্তু সে মুহাম্মদের প্রতিশোধের তালিকায় ছিল এবং তাঁকে দয়া দেখানো হয়নি।
মুহম্মদ তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করার জন্য হামজাকে ইঙ্গিত দিলেন। জল খেতে নামার আগে হামজা আসওয়াদের একটি পা কেটে ফেলেছিল এবং আসওয়াদ শেষবারের মতো জল খাওয়ার জন্য তাঁর শরীরকে কোনমতে কুয়োর টেনে নিয়ে যাওয়ার সময়েও হামজা তাঁকে অনুসরণ করে। এরপর হামজা পেছন দিকে তাঁর পিঠে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল। আসওয়াদের রক্তাক্ত লাশটি জলের নিচের দিকে মুখ করে ভেসে রইল।
সত্যিকারের লড়াই শুরু হওয়ার ঠিক আগে মুহাম্মদের একটি মৃগীরোগের খিঁচুনি হল। যুদ্ধ শুরুর আগে আগে তাঁর লোকদের লাইনে দাঁড় করিয়ে তদারকি করার সময়কালীন মানসিক চাপ তাঁর স্নায়ুর পক্ষে খুব বেশি ছিল, যা একপর্যায়ে বিগড়ে গিয়ে এই খিঁচুনির সুত্রপাত হয়। তিনি লক্ষণগুলি জানতেন – ঠান্ডা ঘাম হওয়া, মাথার ভেতরে ভারি অনুভুতি, ঘণ্টা বাজানোর শব্দ এবং গলা চেপে ধরা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া। কঠোর প্রার্থনায় খিঁচুনিকে দূরে রাখার প্রয়াসে তিনি ছাউনির দিকে ছুটে গেলেন, পেছন পেছন শঙ্কিত আবু বকরও ছুটলেন। তিনি অনেক সময় ধরে প্রার্থনা করতে থাকলেন যে, একান্ত অনুগত আবু বকর পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। “যথেষ্ট হয়েছে, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আপনার পালনকর্তাকেও অধৈর্য্য করে ফেলছেন (৭)।
মুর্ছা যাওয়ার আগে মুহাম্মদ আবু বকরকে আদেশ দিয়ে বললেন : “আমি তোমাকে আদেশ না দেয়া পর্যন্ত লড়াই শুরু করো না। যদি তারা কাছাকাছি আসে তীর দিয়ে তাদের লক্ষ্যভ্রষ্ট করবে, তবে তরবারিগুলি বের করবে না যতক্ষণ না তারা তোমার উপর প্রবল হয়”। খিঁচুনি বাড়ার সাথে সাথে মুহাম্মদের মুখ লাল হয়ে গেল এবং তাঁর ঠোঁট বিদঘুটে রকম বেঁকে গেল। আবু বকর তলোয়ার উচিয়ে মুহাম্মদকে পাহারা দিতে লাগলেন এবং কাউকে তাঁর কাছে যেতে দিলেন না, এমনকি উমর বা সেনাপতিদেরও না, যারা আদেশ পাবার জন্য ছাউনিতে ছুটে এসেছিল। আবু বকর তাদের সবার দিকেই তলোয়ার তাক করে মুহাম্মদের নির্দেশের কথা পুনর্ব্যক্ত করলেন।
খিঁচুনি পর্বের শেষে মুহাম্মদ যেন ভাবের এক উঁচু স্তরে চলে গেলেন। তাঁর মস্তিষ্কের টেম্পোরাল লোব তাঁর মনে আর দৃষ্টিতে এক ধরণের তীব্র আনন্দানুভূতির খোরাক জুগিয়েছে, এবং এটা তাঁর খুবই দরকার ছিল। তিনি জিব্রাইল ফেরেশতাকে বেহেশত ও পৃথিবীর মাঝামাঝি কোনো এক স্থানে একটি ঘোড়ায় চড়তে দেখেছিলেন, এবং তাঁর ঘোড়া সেখানে যুদ্ধের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফেরেশতা, যেমন কাফেরদের শত্রু মিকাইল (Michael) এবং শিংগা বাজানোর ফেরেশতা ইস্রাফিল (Israfil) ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া ঝকঝকে সাদা পোশাকের ফেরেশতাদের বিশাল বহরকে নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন। তলোয়ার উঁচিয়ে ঈমানদারদের পক্ষে লড়াই করার জন্য তারা নিচে নেমে আসছিলেন – জিব্রাইলের নিজের এক হাজার সহ তাদের সারির ডানদিকে মিকাইলের এক হাজার ফেরেশতা, বামে ইস্রাফিলের আছে আরো এক হাজার ফেরেশতা (৮)।
বিভ্রান্তির আচ্ছন্নতায়, প্রভুর সহায়তার আনন্দময় সংবাদটি লোকদের কাছে চিৎকার করে বলতে মুহাম্মদ তাঁর ছাউনি থেকে ছুটে গেলেন। ফেরেশতাদের মনোবল চাঙ্গা করা ঐশ্বরিক কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এবং সংখ্যায় একেবারে ছোট সেনাবাহিনীর উচ্চপদের ও সাধারণ সেনাদের মাঝে যথেষ্ট সাহসের সঞ্চার করল।আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য লড়াই করে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য বেহেশতের, আর বেঁচে যাওয়াদের জন্য গণিমতের মালের প্রতিশ্রুতির কথা মুহাম্মদ ব্যক্ত করলেন। ঈমানদারগণ ইতিমধ্যে এই পুরষ্কার সম্পর্কে জানত; এ কারণেই তারা এই অভিযানের জন্য স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করেছিল, কিন্তু নবীর কাছ থেকে সেকথা আবার শুনতে পেয়ে তাদের মনোবল আরও সুদৃঢ় হল। ঘোড়ার পিঠে সওয়ার এবং পায়ে দাঁড়ানো শিরস্ত্রাণে ঢাকা মক্কাবাসী সৈন্যদের সমাবেশ যেন একটি শক্তিশালী প্রাচীর হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল। আবিসিনিয়ার অনেক ভাড়াটে সৈন্যসহ স্থলভাগের সেনারা নাঙ্গা তলোয়ার আর তীর-ধনুক হাতে সুসজ্জিত ছিল। মক্কাবাসীদের যুদ্ধায়োজনের ঐক্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অভ্যন্তরীণ কোন্দল। এমনকি সৈন্যদের সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে রাখার পরেও মক্কার নেতারা আগের রাতে হওয়া তাদের ঝগড়া চালিয়ে যান। উৎকট সুগন্ধি মাখা লৌহবর্মের পোশাক পরে আবুল হাকাম যুদ্ধের ঘোড়ায় সওয়ার হলেন, এর আগে অস্ত্রশস্ত্র গুছানোর সময় তাঁর সাহস সম্পর্কে উতবাকে একটু খোঁচাও করে দিলেন। “তোমার ফুসফুস ভয় দিয়ে তোমার পেট ভরে ফেলেছে” তিনি উতবাকে বললেন। ক্ষুব্ধ হয়ে উতবা আবুল হাকামের ঘোড়ার সামনের পায়ে আঘাত করে ঘোড়ার রগ কেটে করে দেয়, আর তাতে ঘোড়াটি নিচে পড়ে যায়। এরপর মুখে ভেংচি কেটে আবুল হাকামকে অন্যদের মত পায়ে হেঁটে লড়াই করার করতে বললেন উতবা (৯)।
নিজের সাহসিকতা প্রমাণের জন্য উতবা তাঁর ছেলে ওয়ালিদ এবং তাঁর ভাই শাইবাকে নিয়ে মক্কাবাসীদের সারি থেকে সামনের দিকে এসে শত্রুদেরকে সম্মুখ সমরের আহ্বান জানালেন। তিন তরুণ ধর্মান্তরিত ইয়াছরিবী তাদের সারি থেকে সামনে এসে দাঁড়াল, কিন্তু উতবা অভিযোগ করলেন যে, তাঁরা পদমর্যাদায় দিক থেকে তাদের সমান নয়। একজন মক্কান সেনানায়ক হিসেবে তিনি সমমর্যাদার যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে চাচ্ছেন। ততক্ষণে মুহাম্মদ তাঁর মৃগীরোগজনিত খিঁচুনি থেকে বের হয়ে এসেছেন এবং তাঁর বাহিনীর সৈন্যদের সামনে-পেছনে ছোটাছুটি করে ফেরেশতাদের দেয়া প্ৰতিশ্ৰুতিসমূহ চিৎকার করে বলছিলেন। মক্কাবাসীদের দেখে নিতে মুহাম্মদ হামজা, আলী এবং অন্য এক নিকটাত্মীয়, আগের বছরের এক কাফেলা অভিযানের নেতা উবায়দা বিন হারিছকে নির্দেশ দিলেন। তাঁরা মুখ ও মাথা লোহার শিরস্ত্রাণে ঢেকে বাইরে বের হয়ে এলেন, যা তাদের একপ্রকার ছদ্মবেশ প্রদান করল। এবং কেবল উতবা জানতে চাইলে তাঁরা তাদের পরিচয় প্রকাশ করলেন। এটি একটি অসম লড়াই ছিল। বয়স্ক উতবা ও শায়বা বীর হলেও, শারীরিকভাবে সমর্থ ছিলেন না। শিকারের দক্ষতা এবং উত্তপ্ত মেজাজের জন্য খ্যাতিমান হামজা ষাটের কাছাকাছি বয়সেও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। হিংস্র ক্ষিপ্রতার সাথে তিনি দ্রুত উতবাকে মেরে ফেলেন, আর আলী দেখতে ছোটখাটো হলেও পেশীবহুল হাত আর শরীরকে কাজে লাগিয়ে উতবার পুত্র ওয়ালিদকে হত্যা করেন। শায়বা তাঁর একটি পা হারিয়েও উবায়দার চেয়ে ভালো করছিল, কিন্তু হামজা ও আলী শায়বাকেও কুপিয়ে হত্যা করে।
উভয়পক্ষেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত বা আহত হয়েছে। উবায়দাকে মুহাম্মদের ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তাঁর সামনে তাঁকে শুইয়ে দেয়া হয়েছিল, তাঁর বিচ্ছিন্ন পা থেকে রক্ত ঝরছে। মুহাম্মদ তাঁকে তাঁর পায়ে মাথা রাখার অনুমতি দিলেন যাতে ঈশ্বরের রাসুলকে স্পর্শ করার মধ্য দিয়ে তাঁর মৃত্যু সম্মানিত হয়। উবায়দা রক্তক্ষরণের ফলে মারা গেলে মুহাম্মদ ঘোষণা দেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি একজন শহীদ” (১০)।
এ পর্যায়ে, যুদ্ধটি পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। উভয়পক্ষই তীর ছুঁড়তে ছুঁড়তে পস্পরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বেশ ঘনিষ্ট হয়ে সারিবদ্ধভাবে থাকায়, মুহাম্মদের যোদ্ধারা তীরের আঘাত থেকে নিজেদের ভালো করে রক্ষা করতে পারছিল। খুব শীঘ্রই দুই পক্ষের সব সৈন্য একাকার হয়ে লড়াই করে যেতে লাগল, যা হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গেল। তলোয়ার উচিয়ে একে অপরের শিরস্ত্রাণ, বর্মে আঘাত করে যেতে লাগল। বর্শা লোহার পাত ভেদ করে মাথার খুলিতে গিয়ে আছড়ে পড়ছিল।
এটি ছিল দেবতাদের যুদ্ধক্ষেত্র। ঐশ্বরিক মা আল-উজ্জা, প্রজনন শক্তির দেবী আল-লাত এবং পৌরুষদীপ্ত দেবতা হুবালের সাথে মুহম্মদের প্রতিশোধপরায়ণ এক ঈশ্বরের সাথে সংঘর্ষ, যে ঈশ্বর মুহাম্মদের উপর বিশ্বাস না রাখা সকলের জন্য চিরস্থায়ী শাস্তি নিয়ে আসছিলেন।
সংখ্যায় মক্কাবাসীরা ছাড়িয়ে গেলেও, মুহাম্মদের লোকেরা উগ্র আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান ছিল। গণিমতের মাল বা জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের উন্মত্ত করে তোলা হয়েছে। রক্ত এবং নিজ তলোয়ারের দক্ষতায় উচ্ছ্বসিত আলী রণাঙ্গন জুড়ে ঝড় তুলে একের পর এক লোককে হত্যা করে যাচ্ছিলেন। তিনি হাজিজ, নুবায়ে, আমির, জায়েদ, উমায়ের, মাসুদ, আবদুল্লাহ, ইয়াজিদ, আমওয়াজ সহ আরও অনেককেই হত্যা করেছিলেন। তাঁর হাতে নিহত হওয়া কয়েকজন ছিলেন স্বনামধন্য মক্কাবাসী নেতা, যেমন আবু সুফিয়ানের পুত্র হানজালা (Hanzala)। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে আলী আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবন্দিকেও হত্যা করেছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন খুওয়ালিদের পুত্র এবং খাদিজার সৎ ভাই নওফাল (Nawfal), যিনি একবার তাঁর মা সাফিয়ার প্রহার থেকে জুবায়েরকে উদ্ধার করেছিলেন। মুহাম্মদ যখন জানতে পারলেন তাঁর চিরশত্রু এই শ্যালককে আলী হত্যা করেছে তখন তিনি চিৎকার করে বললেন, “আল্লাহু আকবার! সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর (নওফাল) বিষয়ে আমার প্রার্থনার জবাব দিয়েছেন”(১১)। এই যুদ্ধ ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, চাচাত ভাইয়ের বিরুদ্ধে আরেক চাচাত ভাই, ছেলের বিরুদ্ধে বাবাকে মুখোমুখি দাড় করিয়েছিল। বলা হয়, আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ এতটাই উন্মত্ত ছিল যে, সে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইবনে জাররাহকেও হত্যা করেছিল। মক্কার ধর্ম পরিত্যাগ এবং মুহাম্মদের পছন্দ অনুসারে তাঁর সাথে যোগদানের কারণে, যুদ্ধে ঘৃণার বহিপ্রকাশ হিসেবে আবদুল্লাহ তাঁর দিকে তীর ছুঁড়েছিলেন। পথ অবরুদ্ধ না করা পর্যন্ত আবু উবায়দা তাঁর পিতাকে এড়াতে সক্ষম হন। দুজনের মাঝে সংক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর, পুত্র তাঁর তলোয়ারটি পিতার উপর চালিয়ে দেয়। আরও বলা হয় যে, মুহাম্মদের ধর্ম অস্বীকার করার কারণে যুদ্ধের সময় আবু বকরও তাঁর এক পুত্রকে হত্যার উদ্দেশ্যে তীর ছুঁড়েছিলেন, কিন্তু পুত্র তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গিয়েছিল।
লোকদের তাঁর কারণে মরতে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে মুহাম্মদের এক অনন্য প্রতিভা ছিল। লড়াইয়ের এক চূড়ান্ত সময়ে, নবীন এক ঈমানদার তাঁর হুকুমদাতার (মুহাম্মদ) ছাউনিতে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “সমর্পণকারীদের এমন কী করা উচিত যা আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করতে পারে?”
মুহাম্মদ যখন বলেছিলেন, “তাদের উচিত শিরস্ত্রাণ বা লৌহবর্ম ছাড়াই শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া” যুবকটি তখন তাঁর শরীর থেকে লৌহবর্মটি খুলে ফেলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণ পর মারা যায় (১২)।
যুদ্ধ থেকে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকা আরেকজন যুবক মুহাম্মদকে চিৎকার করে বলতে শুনল : “যে সমস্ত লোক সাহসের সাথে লড়াই করে এবং পিছপা না হয়ে অগ্রসর হয় আল্লাহ তাদের স্বর্গে প্রবেশ করিয়ে দেবে”। এ কথা শুনে লোকটি চিৎকার করে বলল, “দুর্দান্ত! দুর্দান্ত! আমার ও জান্নাতের মধ্যেকার যা কিছু আছে, তা কি আমাকে মেরে ফেললেই ঘুচে যাবে?” এরপর তিনি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন এবং মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত লড়াই করলেন (১৩)।
মুহাম্মদের হিটলিস্টের শীর্ষে ছিলেন আবুল হাকাম। মুহাম্মদের সমস্ত যোদ্ধারা জানতেন যে, তিনি তাদের প্রধান লক্ষ্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর গোষ্ঠীপতিরা তাঁকে ধর্মান্ধদের ছোবল থেকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু মুহাম্মদের লোকেরা তাঁকে পাকড়াও করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তারা যখন মক্কাবাসীদের বাহিনীর মাঝে ছেদ দেখতে পেল, তাদের মধ্যে তিনজন আবুল হাকামের জন্য একটা হিংস্র আক্রমণের পরিকল্পনা করল। আবুল হাকাম একজন বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে যতটা সাহসের সাথে লড়াই করতে হয় ঠিক সেভাবেই তরুণ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। তাঁর পুত্র ইকরিমা তাঁর বাবাকে রক্ষা করে তাঁর পাশে থেকেই লড়াই করছিল, তবে আক্রমণকারীদের মধ্যে একজন আবুল হাকামের এক উরুর মাঝ বরাবর কেটে ফেলে মারাত্মক জখম করেছিল। ইকরিমা আক্রমণকারীটির বাহু কেটে ফেলল, একটা পাতলা মাংসের উপর হাতের বাকি অংশটা ঝুলে ছিল। কথিত আছে যে, আহত ব্যক্তিটি তাঁর হাত নিজে ছিঁড়ে ফেলেছিল এবং যতক্ষণ না ব্যথা এবং রক্তের ক্ষয় তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়তে বাধ্য করে, ততক্ষণ সে লড়ে গেছে।
মুহাম্মদ উঁচু পর্যবেক্ষণ চৌকি থেকে মৃতদেহগুলির স্তুপ করা দেখছিলেন। তিনি ছিলেন সেই যাদুকরের শিক্ষানবিশের মতো, যিনি আবেগ দিয়ে শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এমন বর্বর দৃশ্যপট তাঁকে উত্তেজিত করল, কিন্তু এই শক্তি তাঁর বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কোনও ঝুঁকি তিনি নিলেন না। প্রহরী হিসেবে তাঁকে ঘিরে ছিলেন উমর, আবু বকর, সাদ বিন মুয়াদ, মিকদাদ এবং অন্যান্য প্রমুখ তাঁর শীর্ষ অনুচররা। এই অভিযানের দুটি মাত্র ঘোড়া যা বাঁধা ছিল ছাউনির বাইরে। যদি এই উপত্যকা রক্ত দিয়ে ভরে উঠত এবং রক্ত যদি ক্রমাগত বাড়তেই থাকত এবং তাঁর চারপাশটা ঘিরে ফেলত, তবে তিনি এবং আবু বকর একলাফে সেগুলোর উপর সওয়ার হয়ে দ্রুত পালিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন।
যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী ছিল তা লিপিবদ্ধ নেই, তবে এটি মুহাম্মদের জন্য অপ্রতিরোধ্য বিজয় হিসেবেই শেষ হয়েছিল। তাঁর অনুসারীরা নিশ্চিত ছিল যে, তাঁরা যদি নিহত হয়, দক্ষ এক বাহিনীকে যদি তাঁরা পিটিয়ে মেরে ফেলে এবং মক্কার সেনাদলের বেশিরভাগ অংশ যদি পালিয়ে যায় তবে তাঁরা জান্নাতবাসী হবে। যুদ্ধের ময়দানের বাঁদিকে ছিল সত্তর মক্কাবাসীর মৃতদেহ যার বেশিরভাগই নেতাদের। আরও সত্তর মক্কাবাসীকে বন্দী করা হয়েছিল। মুহাম্মদের মাত্র চৌদ্দজন সৈন্য মারা গিয়েছিল।
লড়াই শেষ হয়ে গেলে বিশ্বস্ত চাকর আর একসময়ের রাখাল ছেলে আবদুল্লাহ বিন মাসুদকে মুহাম্মদ আবুল হাকামের মৃতদেহ সন্ধানের জন্য প্রেরণ করেছিলেন। মুহাম্মদ মাসউদকে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তাঁকে চিহ্নিত করতে যদি সমস্যা হয় তবে তাঁর হাঁটুর উপর একটি দাগ দেখতে। বাল্যকালে, মুহাম্মদ একটা ভোজসভায় নিজের জায়গা করে নিতে আবুল হাকামকে একটা বেঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়েছিলেন। এতে আবুল হাকামের হাঁটু পাথরের মেঝেতে ঘষা খেলে স্থায়ী ক্ষতের তৈরি হয়। মাসুদ যখন তাঁকে পেল মক্কার এই নেতা তখনও বেঁচে ছিলেন। তিনি একটা কাঁটাঝোপের মাঝে চিৎ হয়ে শুয়েছিলেন। রক্তক্ষরণে তিনি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে, নিজের আত্মরক্ষার জন্য তলোয়ারটি তোলার শক্তিও তাঁর ছিল না। তাঁর প্রতি মাসুদের ব্যক্তিগত ঘৃণা ছিল, কারণ তিনি সেই মক্কাবাসীদের একজন ছিলেন যিনি একবার মাসুদকে মন্দিরের সামনে মুহাম্মদের আয়াত পাঠ করার জন্য মারধর করেছিলেন। আবুল হাকাম তাঁকে চিনতে পেরে বললেন, “তুমি সেই ছোট্ট রাখাল ছেলে, আজ দুনিয়ায় মাথা তুলে আছো”। মাসুদ তাঁর শিরস্ত্রাণ ছিঁড়ে ফেলল এবং মাথা কেটে ফেলল। সে মুহাম্মদের কাছে ছিন্ন মাথাটি নিয়ে তাঁর পায়ের কাছে রাখলেন। মুহাম্মদ এতটাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, তিনি বেহেশতের দিকে হাত তুললেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, আবুল হাকামের মৃত্যু তাঁর কাছে 'আরবের সেরা উট' অপেক্ষা উৎকৃষ্ট (উপহার)। তারপর তিনি দু'রাকাত নামাজ পড়লেন এবং মাসুদকে আবুল হাকামের রৌপ্য-নির্মিত কারুকার্যময় হাতলসহ তলোয়ারটি রাখার জন্য দিলেন, যা বংশ পরম্পরায় পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে গেছে (১৪)।
মক্কার মন্দিরের পাটাতন থেকে মুহাম্মদকে প্রায়শই জমিদারসুলভ টিটকারী দেয়া মক্কার ব্যবসায়ীদের মধ্যে একজন উমাইয়া বিন খালাফকে আত্মসমর্পণের পর হত্যা করা হয়। তাঁর প্রাক্তন দাস বিলাল (Bilal) তাঁকে এবং তাঁর ছেলেদেরকে বন্দিদের মাঝে চিহ্নিত করেছিল। উমাইয়া একবার বিলালকে বেশ উত্তপ্ত মরুর মাঠে আটকে রেখেছিল এবং মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করার জন্য তাঁর বুকে একটি ভারি পাথর রেখেছিল। খালাফকে হেফাজতে দেখে বিলাল চিৎকার করে বলে উঠল, “আরে, এখানে তো বহুশ্বরবাদীদের নেতা উমাইয়া বিন খালাফ আছে দেখছি! সে বাঁচলে আমি বেঁচে থাকব না” (১৫)! উমাইয়া এবং তাঁর ছেলেদের দ্রুত ঘিরে ফেলা হলো। কারারক্ষী তাদের রক্ষার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাঁকে একপাশে ঠেলে দেয়া হয় এবং উমাইয়া ও তাঁর ছেলেদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
মুহাম্মদ এমনভাবে এত চমৎকার বিজয় উদযাপন করেছিলেন যে, যেন কেবল মুহাম্মদেরই এমনটা করার কথা। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন, এবং তিনি আরও প্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন। নামাজের পরে তিনি বন্দি উটগুলিকে তাঁর লোকদের ভোজ দেয়ার জন্য জবাই করার আদেশ দেন। প্রার্থনা ও ভোজের আয়োজনের ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাঁর কারণে যারা “শহীদ” হয়েছে তাদের কবর দেয়ার পাশাপাশি মক্কার মৃতব্যক্তিদেরও স্থানের (দেহ রাখার) ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর প্রতিশোধের তালিকায় যারা ছিলেন, তাদের জন্য তিনি এক বিশেষ শেষকৃত্যের আয়োজন করেছিলেন। স্থানীয় লোকদের ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহৃত একটি পরিত্যক্ত কুপে মৃতদেহগুলি ফেলে দেয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের তিনদিন পরে লাশগুলোর কবর দেয়া হয়েছিল এবং তীব্র গরমের ফলে মৃতদেহগুলি ফেঁপে উঠে পচতে শুরু করে। নিজের উটের পিঠে বসে মুহাম্মদ এই আয়োজনের দেখভাল করেন। আবু বকর মৃত ব্যক্তিদের নামগুলো সব একবারে ঘোষণা করলেন। হাত ও পা ধরে ঝুলিয়ে লাশগুলোকে কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। উতবার পুত্র আবু হুযায়ফা তথায় উপস্থিত ছিলেন। যখন আবু বকর তাঁর পিতার নাম ডাকলেন তখন লাশটি গর্তে নিক্ষেপ করার আগে মুহাম্মদ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, তিনি তাঁর বাবার মৃত্যুর জন্য দুঃখ পেয়েছেন কিনা! হুযায়ফা জোর দিয়ে বললেন যে, তিনি দুঃখিত নন। তিনি তাঁর পিতাকে জ্ঞানী, সংস্কৃতমনা এবং পুণ্যবান হিসেবে মনে করতেন, কিন্তু তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং তাই তিনি তাঁর নিজের ধ্বংস ডেকে এনেছেন। “আমি আশা করেছিলাম ইশ্বর তাঁকে ইসলামের পথে পরিচালিত করবেন। যখন এটি ফসকে গেল এবং আমি দেখলাম যে, তিনি এটি গ্রহণ করেননি তখন আমি বিরক্ত হয়েছিলাম" হুযায়ফা বলেন (১৬)।
একমাত্র মক্কাবাসী যাকে গর্তে ফেলে দেয়া হয়নি তিনি হলেন উমাইয়া বিন খালাফ। এর কারণ, তিনি এতটাই মোটা ছিলেন যে তাঁর শরীরটা তোলার চেষ্টা করার সময় তাঁর হাত-পা শরীর থেকে আলাদা হয়ে আসে। পরবর্তীতে কাদা আর পাথরচাপা দিয়ে তাঁকে কবর দেয়া হয়।
যখন শেষ মৃতদেহগুলি গর্তে ফেলে দেয়া হয়েছিল মুহাম্মদ উটের উপরে থেকে তাদের সমাধিতে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলেছিলেন : “তোমাদের কি ইচ্ছে করে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করতে?” যখন উমর ইশারা করলেন যে তিনি আসলে মৃতদের সাথে কথা বলছেন, মুহাম্মদ জবাব দিলেন যে, তারা কবরের নিচে থাকলেও শুনতে পাচ্ছে। ওমর যেমনটা শুনতে পাচ্ছে, তারাও ঠিক তেমনিভাবেই তাঁকে শুনতে পাচ্ছে (১৭)।
শত্রুদের প্রতি ঘৃণা তাঁকে পোড়াতে লাগল। গভীর রাতে লোকেরা তাঁকে উদ্ভ্রান্তের মত বলতে শুনত : “হে উতবা, হে শাইবা, ও উমাইয়া, হে আবু জাহল! আমার পালনকর্তা আমাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার সত্যতা আমি পেয়েছি। “তোমাদের দেবতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা কি সত্য বলে তোমরা খুঁজে পেয়েছ?” (১৮)।
শুধু মৃতদেহ ছাড়াও তাঁর অনেক কিছু নিষ্পত্তি করার আছে। বন্দিদের ভাগ্য নির্ধারণ এবং যুদ্ধের মুনাফা বিতরণ করা। কাফেলাটি দখল করতে সক্ষম হলে তারা যে মালসামান অর্জন করতে পারত সে তুলনায় তাঁরা যুদ্ধে খুব কমই মালসামান পেয়েছিল, তবে 'আল্লাহর অনুগ্রহের' প্রমাণ এখনও পাওয়া যাচ্ছে! অস্ত্র এবং যুদ্ধের সরঞ্জামাদি ছাড়াও লুটপাটের বস্তুর মাঝে ছিল একশত পঞ্চাশটি উট বোঝাই পণ্য, দশটি ঘোড়া এবং তাঁবু, পোশাক এবং বালির ঢিবির অন্যপাশে তাদের শিবিরে ফেলে রাখা বিবিধ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।
লুটের মাল বিতরণ করা একপ্রকার দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। তিন শতাধিক লোক দাবি ও পাল্টা দাবি করছিল। বিভ্রান্তির জন্য মুহাম্মদই দায়ী ছিলেন। যুদ্ধ চলার সময় এক বার্তাবাহককে তিনি প্রেরণ করেছিলেন এই ঘোষণা দিতে যে, “যাকে যে হত্যা করবে, সে তাঁরই লুটের মাল ও যুদ্ধবন্দী পাবে, সে তার মালিক হবে”। যে যোদ্ধারা হত্যা করেছিল বা বন্দি করেছিল তারা ছিল প্রাথমিক সুবিধাভোগী, তবে সবাইই হত্যা করতে বা কোন শত্রুকে ধরতে সক্ষম হয়নি, যেমন মুহাম্মদকে নেতৃত্বের আসনে ঘিরে রাখা তাঁর লোকেরা। তাদের কি কিছু পাওয়া উচিত নয়? অন্যান্য সমস্যাগুলি ছিল : তাদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল যে, তাদের কিছু বন্দিদের অযথা হত্যা করা হয়েছিল, যেমন উমাইয়া বিন খালাফ এবং তাঁর পুত্র যাদেরকে বিলালের উস্কানিতে হত্যা করা হয়েছিল।
---------------------------
[মক্কার উপদেষ্টাদের প্রধানের ছিন্ন মাথা যখন মুহাম্মদের সামনে নিয়ে আসা হয়, তিনি তখন উল্লাস করেছিলেন। মক্কাবাসীরা তাঁর নাম দিয়েছিল আবুল হাকাম, যার অর্থ বিদগ্ধ সিদ্ধান্তদাতা, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে আবু জাহল (Abu Jahl) তথা পাগলামির জনক নামে ডাকতেন। মুহাম্মদের আক্রমণ থেকে মক্কার কাফেলা রক্ষার লড়াইয়ে তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। যুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর পেয়ে মুহাম্মদ তাঁর এক চাকরকে আবুল হাকামের লাশ সন্ধান করতে পাঠিয়েছিলেন। যখন চাকরটা তাঁকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পেল, তখন সে তাঁর মাথা কেটে মুহাম্মদের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, যিনি মক্কার নেতার মৃত্যু কামনা করে তাঁর প্রার্থনার জবাব দেয়ার জন্য ঈশ্বরের শুকরিয়া আদায় করেছিলেন।]
---------------------------
আলী ও উমরও সমস্যা সৃষ্টি করেছিলেন, কারণ তারা যুদ্ধবন্দিদের মালিকদের কাছ থেকে কিছু ঘৃণ্য (তাদের দৃষ্টিতে) বন্দিদের ধরে নিয়েছিলেন এবং তাদের পরে জবাই করে খুন করেছিলেন। কৌশল করে বলতে গেলে, আলী এবং উমর এই হত্যাকাণ্ডের জন্য গনিমতের মাল দাবি করতে পারেন। ঐ বন্দিদের আটককারীরা নয়, বরং তাঁরা দুজন গণিমতের মাল লাভ করেছিলেন। জটিলতা আরও বেড়েছে এখন, কারণ নিহত বন্দিদের মুক্তিপণের মুল্য থেকে যুদ্ধবন্দিদের ন্যায়নিষ্ঠ মালিকেরা বঞ্চিত হচ্ছে। মৃত লোকদের তো কোন মুল্য নেই (সুতরাং তাদের মুক্তিপণও নেই)। এরপর ছিল ফেরেশতাদের সমস্যা। ফেরেশতারা যাদের মেরেছে তাদের গনিমতের মাল কে পাবে? মুহাম্মদের কিছু যোদ্ধা শপথ করে বলেছিলেন যে, তাঁরা যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতা দেখেছেন। একব্যক্তি পাওনা লুটের মাল দাবি করার জন্য মুহাম্মদের কাছে তিনজন মক্কাবাসীর কাটা মাথা নিয়ে আসে, কিন্তু সে তাদের মধ্যে কেবল দু'জনের মাথা কেটে ফেলার কথা স্বীকার করেছে। “তৃতীয়টির ক্ষেত্রে আমি দেখলাম, এক লম্বা সাদা মানুষ তাঁর মাথায় আঘাত করেছে এবং এটি আলাদা হয়ে আমার সামনে গড়িয়ে পড়েছে, আর আমি এটি তুলে নিয়েছিলাম” সে বলল। মুহাম্মদ বলেছিলেন, “তিনি ছিলেন ফেরেশতাদের একজন" (১৯)।
মুহাম্মাদ এ সমস্ত ঝগড়া-বিবাদে এতটাই বিরক্ত হয়ে গেলেন যে, তিনি সমস্ত লুটের মাল ও বন্দিদের একত্র করে তাঁর হাতে সমর্পণ করার নির্দেশ দিলেন। তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিলেন যে, আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং দেখেন। কেউ যদি কিছু লুকোয়, এমনকি একটি জীর্ণ কম্বল থেকে শুরু করে একটি সুতোও এবং যদি সে ধরা পড়ে তবে এই জীবনে মুহাম্মদের এবং পরের জীবনে ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কার কী মালামাল প্রাপ্য তা নির্ধারণ করার জন্য দৈনিক পাঁচবার নামাজ এবং অন্যান্য প্রার্থনা আয়োজনের মাঝেই দুটি দিন তিনি ব্যয় করে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত তিনি সলোমনের (Solomon) প্রজ্ঞাময় পথ অবলম্বন করলেন, অর্থাৎ তিনি লুটের মালের এক পঞ্চমাংশ নিজের জন্য রাখলেন এবং অন্য সবার মাঝে ন্যায়সঙ্গত বণ্টন করে দিলেন। যে দু'জন লোক যুদ্ধের জন্য কিছু ঘোড়া নিয়ে এসেছিল তাদেরকে যোদ্ধাদের জন্য ঘোড়াগুলোর গুরুত্ব ও সেগুলোর দেখভালের খরচ বিবেচনা করে ভাগে প্রাপ্ত মালামালের অতিরিক্ত অংশ দেয়া হয়েছিল।
বন্দিরাই সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল। মুহাম্মদ প্রথমে উমরের সাথে একমত হয়েছিলেন যে, তাদের সবার মাথা কেটে ফেলা উচিত। তবে, যখন বন্দিদের একত্র করা হয়েছিল এবং মুহাম্মদ তাদের মাঝে নিকটাত্মীয়দের দেখেছিলেন, তখন একটি সমস্যা দেখা দিল। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন সর্বদা সহানুভূতিশীল কিন্তু নিরপেক্ষ তাঁর চাচা আব্বাস, আরও ছিলেন মুহাম্মদের জামাতা তথা খাদিজার ভাগ্নে এবং মুহাম্মদের কন্যা যয়নবের বর আবুল আস। মুহাম্মাদ ইয়াছরিবে পালিয়ে যাওয়ার পরে আবুল আস মক্কায় তাঁর স্ত্রী জয়নাবের সাথে ছিলেন। আলীর বড় ভাই আকিলও (Aqil) বন্দিদের মধ্যে ছিল। যদিও আকিল সর্বদা মুহাম্মদের নবুওয়াতের (নবী হওয়া) দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং মুশরিক ছিল, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁর সাথেই আবু তালিবের ঘরে বেড়ে উঠেছিলেন এবং আকিল তখনও তাঁর নিকট ভাইয়ের মতো ছিলেন। নিকটাত্মীয়দের বাঁচিয়ে রেখে মুহাম্মদের কি বাকি সবাইকে তলোয়ার দিয়ে হত্যা করা উচিত?
মুহাম্মদ পরামর্শের জন্য তাঁর শীর্ষ লোকদের ডাকলেন। ওমর, সাদ বিন মুআয এবং মিকদাদ ছিল কট্টরপন্থী - বন্দিদের মাথা কেটে ফেলতে হবে, তাদের পরামর্শ ছিল। তারা যুক্তি দিয়েছিল যে, বন্দিরা আল্লাহর ও তাঁর রাসুলের শত্রু, সুতরাং কাউকেই রেহাই দেয়া উচিত নয়। উমর উদাহরণ সৃষ্টি করার জন্য এতটাই এগিয়ে গেছিলেন যে, বন্দিদের মধ্যে থাকা তাঁর নিকটাত্মীয়দের মাথা তিনি নিজেই কেটে ফেলেছিলেন। আর তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, আলীও এবার তাঁর ভাই আকিলের (Aqil) মাথা কেটে ফেলে খুশি হবেন। আকাবা অঙ্গীকারের একজন আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা শিরশ্ছেদের বিকল্প হিসেবে পরামর্শ দিয়েছিলেন এরূপ : বনের মাঝে সমস্ত বন্দিদের একটি গাছে বেঁধে রাখুন এবং সেই বনে আগুন জ্বালিয়ে দিন। তবে আবু বকর অশ্রুসজল চোখে তাদের ক্ষমার জন্য আবেদন করেছিলেন এবং এই ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন যে, বন্দিরা মৃতের চেয়ে আরও বেশি মূল্যবান, কেননা মক্কাবাসীরা তাদের ফেরত নেয়ার জন্য বেশ ভালো অর্থ প্রদান করবে। আবুল হাকামকে শিরোচ্ছেদ করার কারণে অভিজ্ঞ ও দাড়িওয়ালা নেতাদের মাঝে আবদুল্লাহ বিন মাসুদও একটা অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন। হালকাপাতলা গড়নের এই তরুণ আবদুল্লাহ বিন মাসুদও বন্দিদের ব্যাপারে নমনীয় ভাব প্রকাশ করলেন। সুহাইল নামে একজন ব্যবসায়ী যিনি অতীতে তাঁর সাথে সদয় আচরণ করা এক বন্দির প্রতি নমনীয় ছিলেন। পরামর্শকদের কথা শোনার পরে মুহাম্মদ তাঁর তাঁবুতে ফিরে গেলেন এবং তাঁর মনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব নিতে দিলেন। তিনি নবী এবং ফেরেশতাদের নিয়ে তাঁর মস্তিষ্কের মাঝে একটা কল্পনার জগৎ তৈরি করেছিলেন এবং তিনি তাদের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী হিসেবে তাদের সাথে নিজের মনোজগতে বাস করতেন (২০)। তারা তাঁর রক্তমাংসের সাথীদের মতোই ছিলেন। নবীদের কাহিনীসমূহ, বা সেই গল্পগুলোতে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর জন্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করেছে এবং তাঁর চিন্তার একটা ভিত্তি দিয়েছে। বাইরের জগতের ঘটনাবলী ব্যাখ্যা করতে আর গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে তিনি প্রায়শই এসব গল্পের পুনর্গঠিত সংস্করণ ব্যবহার করতেন।
অবশেষে তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে মুহাম্মদ আবু বকর এবং উমর উভয়ের পক্ষে চটকদার কথা বলেছিলেন। তিনি তাদের বললেন যে, তাঁরা দুর্দান্ত পরামর্শ দিয়েছেন! তাঁরা প্রাচীন নবীদের মতো ছিলেন এবং কার্যতঃ তাঁরা সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্গদূতের ভাইদের মত ছিল। আবু বকর, প্রকৃতপক্ষে ফেরেশতা মিকাইলের সাথে আবু বকরের অনেক মিল আছে, যার কাজ হচ্ছে লোকদের প্রতি প্রভুর সন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং তাদের জন্য ঈশ্বরের ক্ষমা প্রকাশ করা। তিনি ইব্রাহিমের মতোও ছিলেন, যাকে তাঁর লোকেরা একবার চুল্লিতে ফেলে দেয়ার পরও তাদের সাথে মধুর চেয়েও মিষ্টি ব্যবহার করতেন। অবশ্যই তিনি কোমল যীশুর মতো ছিলেন, যিনি ঈশ্বরের প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে তাঁর ক্ষমাশীলতার প্রশংসা করেছিলেন। অন্যদিকে, উমর ছিলেন ফেরেশতা জিব্রাইলের মতো যার কাজ ছিল ঈশ্বরের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা এবং যারা ঈশ্বরের প্রতিষ্ঠিত সীমালঙ্ঘন করেছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিশ্চিত করা। ওমর নূহের মতোও ছিলেন, যিনি ঈশ্বরের পথ থেকে বিচ্যুত লোকদের বিরুদ্ধে পাথরের মতো কঠোর ছিলেন। মুসার সাথেও ওমরের সাদৃশ্য রয়েছে, যিনি একজন কট্টরপন্থী ছিলেন। মুহাম্মাদ মুসার মুখের কথারই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন : “হে রব, তাদের ধনসম্পদ ধ্বংস করুন এবং তাদের অন্তরকে শক্ত করুন, যতক্ষণ না তারা মর্মন্তুদ যন্ত্রণা দেখে বিশ্বাস স্থাপন করবে” (২১)।
এভাবে তাদের প্রশংসা করার পরে, মুহাম্মদ আল্লাহর সিদ্ধান্তটি পেশ করলেন। এটি ছিল আবু বকর এবং উমর উভয়ের জ্ঞানের মিশ্রণ : অনেকের জন্য মুক্তিপণের মাধ্যমে ক্ষমা, তবে তাদের জন্য রয়েছে মৃত্যু যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সীমা অতিক্রম করেছেন। ঐতিহ্যবাহী সূত্রগুলি জানিয়েছে যে, সত্তরজন বন্দিকে বদর থেকে ধরে নেয়া হয়েছিল, তবে তাঁর মাঝে মাত্র উনপঞ্চাশ জন ইয়াছরিবে যেতে পেরেছিল। ইয়াছরিব নেয়ার সময়ে দুজন ব্যক্তিকে হত্যার কথা আমরা জানতে পারি - নাদের আল হারিছ এবং উকবা ইবনে আবু মুয়াইত। তাঁরা উভয়েই অপরাধীদের তালিকার শীর্ষে ছিল। প্রাচীন লোকদের কল্পকাহিনী হিসেবে মুহাম্মদের নবীওয়ালা গল্পগুলিকে উপহাস করার জন্য এবং পারস্যের রাজা-বাদশাহ ও নায়কদের সম্পর্কে আরও আকর্ষণীয় গল্প বলে মুহাম্মদকে বিদ্রূপ করার জন্য মুসলিমরা নাদেরকে ঘৃণা করত। এই বিদ্রূপ মুহাম্মাদকে এতটাই বিরক্ত করেছিল যে, তিনি কোরআনে বেশ কয়েকবার (আয়াত নাজিল করে) তাঁকেও পাল্টা বিদ্রূপ করেছেন! আর উকবা হলেন সেই মক্কাবাসী যিনি মন্দিরের সামনে প্রার্থনা করার সময় মুহাম্মদের পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি তুলে দিয়েছিলেন যা মক্কার অন্যান্য নেতাদের মাঝে অট্টহাস্যের সৃষ্টি করেছিল এবং সেজন্য মুহাম্মদ তাদের সকলকে ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলেন।
বদলা নেয়ার প্রথম ধাপের বিরতিতে, নাদেরের মাথা কেটে ফেলার জন্য মুহাম্মদ আলীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মিকদাদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, কেননা এতে বন্দিকারী হিসেবে মিকদাদ নাদেরের মুক্তিপণ হারাবে। মিকদাদ সারাংশে বলেছিলেন, “আরে তা করবেন না, সে আমার বন্দী!” পিঠের পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় নাদেরকে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং এরপর আলী নাদেরের ঘাড়ে তাঁর তলোয়ার চালিয়ে দিয়েছিলেন। মাথাটি এত তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে গেছিল যে, নাদেরের শরীর লুটিয়ে পরার আগেই তাঁর মাথাটি মাটিতে পড়েছিল। মুহাম্মদ মিকদাদকে তাঁর মৃত্যুর জন্য পরকালে আল্লাহর পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রশান্ত করেছিলেন। পরের দৃশ্যপটের বিরতিতে উকবার শিরশ্ছেদ করা হয়। মুহাম্মদ যখন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিলেন তখন উকবা তাঁর প্রাণে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে বলেছিলেন, “তাহলে আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করবে কে?” মুহাম্মদ গর্জন করে বললেন “জাহান্নাম!” এরপর তাঁকে জবাই করার জন্য আসিম বিন ছাবিত নামের এক ধর্মান্তরিতকে ইঙ্গিত দিলেন।
-----------------------
[মুহম্মদ কখনও অপমানের কথা ভুলতেন না। এখানে, মুহাম্মদের প্রথম চাচাত ভাই আলী বদর যুদ্ধে বন্দিদের একজন নাদের আল হারিছের শিরশ্ছেদ করছেন। মুহাম্মদের সাথে ঈশ্বর কথা বলেন, মুহাম্মদের এই দাবিটির জন্য নাদের মক্কায় প্রায়শই তাঁকে বিদ্রূপ করতেন।নাদের তাঁকে আশেপাশে অনুসরণ করতেন এবং যে লোকদের সাথে মুহাম্মদ দেখা করেছিলেন তাদের কাছে পারস্যের মহাকাব্যের গল্পগুলি আবৃত্তি করার প্রস্তাব দিতেন। তাদেরকে বলতেন, পারস্যের গল্পগুলি মুহাম্মদের নবী বিষয়ক গল্পের চেয়েও চটকদার।]
-----------------------
মুহাম্মদ যুদ্ধ নিয়ে একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় রচনা করেছিলেন, কোরানে প্রথম কোন যুদ্ধের ইশতেহার। জঙ্গিবাদী আয়াত সমুহের মধ্যেঃ “আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনার অবসান হয় এবং দীন পুর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। তবে যদি তারা বিরত হয় তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ তারা যা করে সে বিষয়ে সম্যক দ্রষ্টা” (২২) এবং, “আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব বাহিনী প্রস্তুত কর, তা দ্বারা তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদেরকে” (২৩)। 'যুদ্ধের ফজিলত' (The Spoils of War) বোঝানোর জন্য নাজিল করা এই সুরায় মুহাম্মদ তাঁর ধর্মকে লুটপাট অনুমোদনের জন্য একটি সংগঠিত অপরাধমূলক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি এর আয়াতগুলিতে লুণ্ঠিত মালামাল বিতরণের জন্য তাঁর সাধারণ নীতিও ঘোষণা করেছিলেন এভাবে : তিনি (মুহাম্মদ) ভবিষ্যতের সকল গনিমতের মালের এক পঞ্চমাংশ নেবেন, আর বাকি সব মাল মুমিনদের মধ্যে বিলিবন্টন করা হবে। তোমরা যুদ্ধে যা গনিমতের মাল পেয়েছ তা “ভোগ করো”। বিশ্বাসীদের তিনি বলেছিলেন, এটা “হালাল এবং উত্তম” (২৪) মক্কাবাসীরা বিভিন্ন কারণে বদরের যুদ্ধে হেরে যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এর সবচেয়ে স্পষ্ট কারণ ছিল তাদের নেতারা ঝগড়াটে এবং যুদ্ধে অদক্ষ বয়স্ক ব্যবসায়ী যারা তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা যদি বিচক্ষণ হতেন, তাহলে মুহাম্মদ নিজেই যে ভূখণ্ডটির সুবিধা দিয়েছিল তা দেখতে পেতেন এবং তাঁকে বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস করার কৌশল চিন্তা করতেন। তাঁরা যদি ধুর্ত ও নির্মম হতেন তবে ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই আক্রমণের জন্য শত্রুপক্ষের একজোট হয়ে নামাজ পড়ার সুযোগটা নিতে পারতেন, আর মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীরা প্রার্থনায় মগ্ন থাকার নাজুক সময়টাতে মারাত্মক বিধ্বংসী হামলা চালাতে পারতেন। তবে মক্কার নেতারা ছিলেন প্রবীণ, যারা গোত্রগত যুদ্ধের পুরনো নিয়মগুলি দ্বারা পরিচালিত হতেন যা ছিল মূলত - আক্রমণ এবং সাহসের সাথে লড়াই করা, তারপর শত্রুরা স্থির হতে চায় কিনা তা দেখার জন্য আক্রমণ থামিয়ে দেয়া এবং তারা যদি তা করে তবে টাকার বিনিময়ে জীবন ফিরিয়ে দেয়া।
মক্কাবাসীরা আরো একটি কারণে সম্ভবত পরাজিত হয়েছিল, আর তা হচ্ছে, তারা কীসের বিরুদ্ধে লড়ছিল সেটি বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিল। তারা আগে কখনও মানসিক বিকৃতিসম্পন্ন মৃগীরোগীর মোকাবেলা করেনি। সমাজে পৃথকভাবে এই দুই উপকরণের সাথে তাদের পরিচয় থাকলেও, একই ব্যক্তির মাঝে দুটোর সন্নিবেশ তারা দেখেনি। তারা মৃগীরোগ সম্পর্কে জানত। এটি তখন আজকের মতোই একটা সাধারণ অসুখ ছিল, তবে সেই সময়ে এটির আলাদা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল - ক্ষতিকর জিন তথা দানবের হাতছানিই এটির কারণ। ঠিক যেমনটা হালিমা সন্দেহ করেছিলেন, একেবারে ছোটবেলায় তাঁর যত্নে থাকা মুহাম্মদের প্রথম খিঁচুনির সময়ে। সেরকম একটা সমাজে মৃগীরোগীরা গ্রহণযোগ্য হলেও, প্রায়শই গণক, জাদুকর এবং ভীতিকর ও ঘৃণাযোগ্য অবস্থায় তাঁরা বেড়ে উঠত। মক্কাবাসীদের মানসিক বিকৃতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্বেরও অভিজ্ঞতা ছিল। কেনই বা তাদের সেই অভিজ্ঞতা হবে না, সেই সমাজে তো মুহাম্মদের খালা সাফিয়া তাঁর পুত্র জুবায়েরকে জীবনের বাস্তবতার জন্য প্রস্তুত করতে মারাত্মকভাবে মারধর করত এবং খাত্তাব তার প্রতিটি ইচ্ছা লঙ্ঘনের জন্য নির্মমভাবে তাঁর পুত্র উমরকে মারধর করত! আরব সমাজের এ জাতীয় উপকরণগুলো প্রায়শই চিরস্থায়ী রক্তাক্ত সংঘাতের কারণ ছিল, যা গোত্র এবং গোত্রসমূহদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল। এই উভয় উপাদানই ব্যক্তি মুহাম্মদের সাথে একত্রে মিশ্রিত হয়েছিল। তাঁর মৃগীরোগ তাঁকে বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করেছিল যে, ঈশ্বর তাঁর সাথে কথা বলেছেন। তাঁর মানসিক বিকৃতি তাঁকে এমন লোকদের হত্যা করতে পরিচালিত করেছিল যারা এসব বিশ্বাস করে না।
তৃতীয় উপাদানটি ছিল তাঁর কথার জাদুময়তা। তিনি তাঁর কথার জালে অজ্ঞদের আটকে ফেলে তাঁর বিভ্রমকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাদের সামনে এক মনোজাগতিক পৃথিবী অঙ্কন করেছিলেন এবং এটিকে বাহ্যিক পৃথিবীর চেয়েও তাদের কাছে আরও বাস্তবিক করে তুলেছিলেন। এই কল্পিত বিশ্বের প্রতি বিশ্বাস দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে মুহাম্মদের অনুসারীরা বদরের প্রান্তরে নিজেদের মধ্যকার কসাইকেই সামনে নিয়ে এসেছিল, যেমনটা তিনি প্রায়শই প্রার্থনা করতেন।
মক্কায় থাকাকালীন মুহাম্মদ কখনও সহিংসতা করার হুমকির বাইরে যাননি, কারণ এরচে বেশি কিছু করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এখন তাঁর সেই শক্তি চলে এসেছে।