অধ্যায় -১ পবিত্র স্থান
হিজাজের
আকাশ ছিল ধবধবে সাদা,
আকাশের
দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল রাতের
আকাশে আগুন জ্বলছে। হঠাৎ
মরুবাসীরা দেখল,
তলোয়ারের
মতো ঝকঝকে একগুচ্ছ আলো যেন
আকাশ থেকে নিচে পড়ছে এবং
মুহূর্তের মধ্যে সেই আলো
পাহাড়ের পেছনে অদৃশ্য হয়ে
গেল। মরুবাসী সেটি বিস্ময়
নিয়ে দেখলো। দিনের বেলায়
মরুবাসীরা সবসময় তাদের উট
ও ছাগলের জন্য খাদ্য এবং জলের
খোঁজে বের হয়,
কিন্তু
রাতে তাঁরা গোলাকৃতি হয়ে
আগুন জ্বালিয়ে বসে আকাশের
দিকে তাকিয়ে থাকত। বিভিন্ন
গল্প থাকলেও তাদের গল্পের
প্রধান বিষয়বস্তু থাকত
দেবতা/সৃষ্টিকর্তা।
তাদের দেবতাদের অস্তিত্ব ছিল
সর্বত্রই পাথরের গায়ে,
গাছের
বাকলে;
এমনকি
পাহাড়ের গায়েও দেবতারা
থাকত। কিন্তু তাদের কাছে
সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল রাতের
আকাশের চাঁদ -
সাতটি
উজ্জ্বল বস্তু জ্বলজ্বলে
নিস্তব্ধতার চারপাশে ঘুরপাক
করছিল। চাঁদ ও তারাকে তাঁরা
তাদের শাসক মানতো। যদিও মরুবাসী
এর আগেও বিচ্ছুরিত আলো দেখেছেন,
কিন্তু
এবারের আলোটা ছিল অনেক বেশি
উজ্জ্বল!
মরুবাসীরা বিশ্বাস করত, দেবতারা প্রায়ই জিনদের তাড়া করতে এই ধরনের জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড ছুঁড়ে মারে যাতে মরুভুমিতে বসবাসরত মানুষদের উপর জিনরা কেউ প্রভাব ফেলতে না পারে, কিন্তু এবারের আলোর উজ্জ্বলতা দেখে তারা বিশ্বাস করতে থাকে, এটি নিশ্চয়ই ভালো কোন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে!
ভোরের
আলো ফোটার আগেই যাযাবররা পেছনে
পশুপাল নিয়ে উটের পিঠে চড়ে
ঐ পাহাড়ের দিকে রওনা দেয়
যার পেছনে আলো অদৃশ্য হয়ে
গিয়েছিল। যেতে যেতে এক উপত্যকার
সামনে তাঁরা পৌঁছে যায়,
যেখানে
ছিল অনেক কন্টকযুক্ত গাছ।
জলের অভাবে গাছগুলো বড় হয়নি।
ঝোপঝাড়ের মতো অবস্থা হয়েছে।
সেখানে তাদের ছাগল থামিয়ে
নারী এবং শিশুরা বেরি ফল সংগ্রহ
করা শুরু করে।
পুরুষেরা তাদের উটগুলোকে আরো একটু দুরে নিয়ে যায়, যেখানে আকস্মিক বন্যার কারণে একটা মৃতপ্রায় নদীর মতো তৈরি হয়েছে। হঠাৎ এক যুবক উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠল এবং তাঁর চিৎকার শুনে লোকেরা ছুটে এলো। তারা দেখতে পেল নদীর পাড় থেকে মাত্র বিশ কদম দূরে কালো রঙের একটা পাথর অর্ধেক মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউই এই পাথরকে স্পর্শ করার সাহস পেল না। তাদের মধ্যে থেকে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক কাঁপতে কাঁপতে পাথরটিকে স্পর্শ করেন। লোকটি দেখতে ছিলেন ধূসর দাড়িওয়ালা, মাথায় কালো পাগড়ি পরিহিত, আর শরীরের পোশাক ছিল কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর কোমরে গোজা ছিল একটা ছুরি। পাথরটি তিনি হাতে তুলে নিয়ে বাকিদের আদেশ দিলেন তাঁরা যেন তাদের নিজেদের সমান উঁচু একটা স্তম্ভ তৈরি করেন। অতপর পাথরটিকে তার উপরে রাখা হলো। এবার তিনি তাঁর সহযাত্রীদের একত্রিত করলেন এবং নির্দেশ দিলেন স্তম্ভটিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে। সাধারণত আরবরা যদি কোন জিনিস আকাশ (বেহেশত) থেকে প্রাপ্ত মনে করতেন তাহলে তাঁরা এভাবেই প্রদক্ষিণ করতেন। প্রতিটি প্রদক্ষিণের পরই সবাই চিৎকার করে বললেন, ''হে প্রভু আমরা আপনার সেবায় নিয়োজিত! আমরা আপনার সেবায় নিয়োজিত!”
নবী
মোহাম্মদের জন্ম হয়েছিল
মক্কায়,
এই
মক্কা নামটি আসলে কোথা হতে
এলো এটা যদিও নিশ্চিত কোথাও
উল্লেখ নেই,
তবে
কারো কারো ধারণা এটি ইয়েমেনি
ভাষা থেকে এসেছে,
যার
অর্থ 'পবিত্র
স্থান'
(১)।
এই কালো পাথরের কারণে মক্কা
পবিত্র স্থান বলে গণ্য হয়,
তাই
এখানে সহিংসতা নিষিদ্ধ ছিল।
আরবের পশ্চিমে গোত্রে গোত্রে
যেই অন্তঃকলহ বিদ্যমান ছিল
তা থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য
এই ধরণের পবিত্র স্থানের খুবই
দরকার ছিল। তাঁরা বিশ্বাস
করতেন,
যদি
এই পবিত্র স্থানে তাঁরা
সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে তাহলে
দেবতারা তাদের উপর প্রতিশোধ
নেবে। তাই কোন গোত্রের কেউ
যদি আরেকজনের প্রতিহিংসার
শিকার হয় এবং তা থেকে বাঁচার
জন্য মক্কায় আশ্রয় নেয়,
তাহলে
আর তাঁর উপর কোন প্রতিশোধ
নেয়া হতো না,
উল্টো
আশ্রিত ব্যক্তি তাদের বুড়ো
আঙুল দেখাতে পারতেন। তবে
পবিত্র স্থানের বাইরে যদি
তাঁকে পাওয়া যেত তাহলে আর
রক্ষা ছিল না!
এই
সুরক্ষিত এলাকায় বছরের চারটি
মাস ছিল পবিত্র মাস -
একটি
ছিল বসন্তে এবং শরৎকালের পরপর
তিনটি মাস -
যখন
মানুষ প্রতিশোধমুলক সহিংসতার
ভয় ছাড়াই এ জায়গা দিয়ে
ভ্রমণ করতে পারতেন। আরবে
রক্তের বদলে রক্তের যেই প্রচলন
ছিল,
সে
সময়ে এই পবিত্র চারমাস দূরবর্তী
ভূমির মানুষগুলোকে আরবের এই
এলাকায় বাণিজ্য পরিচালনা,
সাংস্কৃতিক
মেলায় অংশগ্রহণ করা এবং
মন্দিরে (কাবা)
তীর্থযাত্রা
করার সুযোগ প্রদান করত। তারা
তাদের প্রিয় দেবতাকে পূজা
করার জন্য আসতেন,
এরমধ্যে
ছিল মক্কার এই কালো পাথরও যাকে
আবার তাঁরা বিশ্বাস করত সকল
দেবতাদের রক্ষক হিসেবে। এটা
যদিও অস্পষ্ট যে,
পাহাড়
দ্বারা বেষ্টিত মক্কা উপত্যকা
কবে থেকে সংকীর্ণ করে হতে শুরু
করে এবং কবে থেকে মানুষ সেখানে
বসতি স্থাপন করে। পৌরাণিক
কাহিনীতে আছে,
এই
কালো পাথরটি আসলে একটি রত্ন
যেটা আল্লাহ সৃষ্টির সময়
বেহেশত থেকে আরব উপত্যকায়
ফেলেন এজন্য যে,
আদমকে
বেহেশত থেকে বিতাড়িত করার
পর তিনি যেন এই কালো পাথর ঘিরে
একটা মন্দির নির্মাণ করতে
পারেন। এই কালো পাথর তাঁর জন্য
হবে পথের দিশা। মুহাম্মদ
কল্পনা করেছিলেন যে,
আদম
এত লম্বা ছিল যে তাঁর মাথা
জান্নাত পর্যন্ত প্রবেশ করে
আল্লাহর সিংহাসন দেখতে পেতেন,
কিন্তু
তিনি যখন এই বেহেশতী পাথর
দিয়ে মন্দির নির্মাণ করলেন,
তারপর
তাঁর আকৃতি হ্রাস পেয়ে ষাট
হাতে গিয়ে ঠেকে। সুতরাং এই
উপত্যকায় বসবাসকারী সকলেই
ছিলেন আব্রাহাম এবং ইসমাইলের
বংশধর,
অথবা
পরবর্তী কিংবদন্তির কারো
বংশধর। (২)
ইতিহাসের
সংরক্ষিত তথ্য থেকে জানা যায়,
আরব
উপত্যকার এই অঞ্চলটি যীশুর
জন্মের অন্তত দুই শতাব্দী আগ
পর্যন্ত জনবসতিহীন,
বসবাসের
অনুপযোগী অরণ্যই ছিল (৩)।
তবে ধারণা করা হয় বেহেশতী
পাথরের সন্ধানের পর এই এলাকাটি
পবিত্র বলে গণ্য হতে থাকে,
আস্তে
আস্তে সেখানে বসতি গড়ে ওঠে।
কালো পাথরটিকে রাখার জন্য
পাথরের স্তূপীকৃত আয়তাকার
মন্দির নির্মাণ করা হয়,
আর
মূল স্তম্ভের একটি কোনায় এই
পাথরটিকে রাখা হয়। উপত্যকার
বেশ কাছের একটি জায়গায় জলের
সন্ধান পাওয়ার পর ছোট কিছু
ভ্রাম্যমাণ গোত্রদের দল ধীরে
ধীরে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন
করে। এবং এই পবিত্র পাথরের
খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার সাথে
সাথে অন্যান্য এলাকা থেকেও
পূজারিরা এই পবিত্র স্থানে
আসতে থাকেন। তীর্থযাত্রা
করতে আসা মানুষগুলো সাতবার
এই মন্দিরের কক্ষপথে ঘুরতেন,
পাথরে
চুম্বন করতেন এবং পশু উৎসর্গ
করতেন। যেহেতু প্রতিনিয়ত
দূরদুরান্ত থেকে মানুষ আসতে
থাকত এই উপাসনা করতে সেহেতু
ক্রমশ মক্কা একটি উদীয়মান
তারকা হয়ে ওঠে যা আশপাশের
অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঈর্ষার
জন্ম দেয়। এক জায়গায় উল্লেখ
পাওয়া যায়,
ইয়েমেন
থেকে আগত একটি দল এই পাথর এবং
পবিত্র স্তম্ভকে তাদের এলাকায়
নিয়ে স্থাপন করার জন্য আক্রমণ
করেন,
যাতে
তীর্থযাত্রীরা তাদের অঞ্চলে
গিয়ে জড়ো হয়। কিন্তু স্থানীয়
গোত্রদের একটি জোট তাদের
মক্কার উপকণ্ঠে অবরুদ্ধ করে
রাখে এবং একটি ভয়াবহ যুদ্ধের
পর তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়।
(৪)
মক্কার
সুনাম যতই বাড়তে থাকে ততই
যেন এক গোষ্ঠী জোর করে আরেক
গোষ্ঠীর উপর শোষণ করতে চাইতে
থাকে। তারপর আরো বৃহৎ গোত্ররা
এলো,
এবং
হয় তারা আগের গোষ্ঠীকে এলাকা
থেকে বিতাড়িত করেছে অথবা
পূর্ববর্তী সকল গোত্রকে
একত্রিত করে শোষণ করেছে।
বিভিন্ন গোত্রের যে নাম পাওয়া
যায় যেমন – আজদ,
(azd), কুদাহ
(Qudah),
খুজাইমা,
কিনানা,
ফিহর,
মুদার,
খুজা,
বকর,
আসাদ,
মাদ,
লাখম,
দিল
এবং আরও অনেক। তাদের সবার
মধ্যে একটি জায়গায় মিল ছিল
আর তা হচ্ছে,
তারা
সবাই ইয়েমেন থেকে আগত মানুষদেরই
বংশধর। কৃষি এবং বাণিজ্যিক
সাফল্যের কারণে যখন তারা
জনবহুল হয়ে পড়ে তখন তারা
ইয়েমেন থেকে এই অঞ্চলে এসে
বসবাস শুরু করে। তবে এদের
মধ্যে ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে
জুরহুম গোত্র। তাদেরকে রহস্যময়
গোত্র বলা হতো,
যারা
খ্রিস্টান ছিল এবং পারস্যের
নিপীড়ন থেকে বাঁচতে হিজাজে
চলে এসেছিল। মক্কায় থাকাকালীন
সময়ে জুরহুম জাতি এই কালো
পাথরের উপাসনা করত না। তারা
মনে করত এটা পৌত্তলিকদের
উপাসনার জন্য,
কিন্তু
অবশেষে উদীয়মান খুজা গোত্র
এই জুরহুম জাতিকে তাড়িয়ে
দেয়। জুরহুমরা মক্কা থেকে
চারশত মাইল দক্ষিণে ইয়েমেনের
শহর নাজরানের আরেকটি খ্রিস্টান
সম্প্রদায়ের সাথে যোগ দেয়।
(৫)
খুজা
গোত্রই প্রকৃতপক্ষে মক্কার
চেহারা পাল্টে দিয়েছিল।
কথিত আছে যে,
এই
গোত্রের কিংবদন্তী নেতা আমর
ইবনে লুহাই (Amr
Ibn Luhayy) আনুষ্ঠানিকভাবে
নাবাতাইন (যা
বতর্মানে দক্ষিণ জর্ডান অঞ্চল)
থেকে
মানবসদৃশ চন্দ্রদেবতা হুবালের
মূর্তি নিয়ে আসেন এবং মক্কার
এই পাথরের মন্দিরকে চাঁদের
মন্দির হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে
ঘোষণা দেন।
লাল
রঙে রাঙিয়ে এক ধরনের রাজকীয়
চেহারা প্রদান করা হুবালকে
গণ্য করা হতো যুদ্ধে বীরত্ব
এবং বিজযের প্রতীক হিসেবে।
হুবাল দেবতাকে মনে করা হতো
সময় নিয়ন্ত্রক এবং ভবিষ্যদ্রষ্টা
হিসেবে। হুবালের এক হাতে
একধরণের ঐশ্বরিক তীর ধরা থাকত।
প্রতি বছরই একজন পুরোহিত এই
তীরটি মাটিতে নিক্ষেপ করতেন
এবং তীরটি যেভাবে মাটিতে পড়ত
তার উপর ভিত্তি করে পুরোহিত
ভবিষৎ বাখ্যা করতেন। আমরের
হুবালকে মন্দিরের দেয়ালের
আয়তাকার স্তম্ভমূল তৈরি করে
তার ভেতরে বসানো হয় এবং এই
মূর্তিটি মুহাম্মদের সময়ের
আগ পর্যন্ত ধাপে ধাপে উন্নতির
মধ্য দিয়ে গিয়ে এটিই মন্দিরের
কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
আগে কখনও বিশ্বাস করা না হলেও,
এরপর
থেকে তারা বিশ্বাস করতে থাকে
যে,
চাঁদ
থেকে খসে এখানে এসে পড়া গোলাকার
কালো পাথরটি চাঁদ দেবতা হুবালেরই
উপহার।
মক্কা
উপত্যকার চেহারা আরেকজন
পরিবর্তন করেন,
তিনি
হচ্ছেন মুহাম্মদের দাদার
দাদা দাদা কুসাই (QUSAY)।
কুসাই একটি ছোট শহরের বাসিন্দা
ছিলেন এবং উচ্চাভিলাষী ছিলেন।
তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান এবং
একই সাথে নিষ্ঠুর। তিনিই আবার
খুজা গোত্রকে ক্ষমতাচ্যুত
করেন এবং মক্কার এই মন্দিরকে
অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত করেন।
কুসাই আসলে মক্কাকে নগর
প্রশাসনের রূপ দেন এবং
মন্দির-কেন্দ্রিক
অর্থনৈতিক স্তম্ভ গড়ে তোলেন।
কথিত আছে,
কুসাই
জন্মগ্রহণ করেন মক্কা উপত্যকায়,
কিন্তু
বেড়ে ওঠেন সিরিয়ার কাছে
থাকা উত্তরের একটি জনজাতির
মধ্যে।
কুসাইর
পিতা ছিলেন কিলাব যিনি তাঁর
জন্মের আগেই মারা গিয়েছিলেন,
এবং
কুসাইর জন্মের পর তাঁর মা
পুনরায় বিয়ে করেছিলেন।
নতুন বর তাঁকে এবং তাঁর নবজাতককে
তাঁর জন্মভূমি উত্তর আরবে
নিয়ে যান। এই এলাকাটি ছিল
কুদাহ গোত্রের (qudahs)
যাদের
পূর্বপুরুষগণ মক্কা উপত্যকার
বাসিন্দাদের মতোই ইয়েমেন
থেকে এসেছিল।
কুসাইর
মা দৃশ্যত কুসাইর পূর্বেকার
পরিচয় তাঁর (কুসাইর)
কাছে
গোপন রেখেছিলেন,
সম্ভবত
এই ভেবে যে তিনি যেন সৎ পিতা
এবং সৎ ভাইদের গোত্রের সাথে
মানিয়ে নিতে পারেন,
কিন্তু
তা আর বেশিদিন গোপন থাকে না।
একদিন কুসাই তার কিশোর বয়সে
পাড়ার ছেলেদের সাথে মারামারিতে
জড়িয়ে পড়ে এবং সে-ই
জয়লাভ করে। তখন পরাজিত
ব্যক্তিরা চিৎকার করে বলল,
"তুমি
আমাদের কেউ না;
তুমি
তোমার জায়গায় ফিরে যাও।
কুসাই
এই কথা শোনার পর তাঁর মায়ের
মুখোমুখি হয়,
এবং
মায়ের তখন তার পারিবারিক
ইতিহাস প্রকাশ করা ছাড়া আর
কোন উপায় থাকে না। কুসাই
জানতে পারল যে তাঁর আসল পিতা
ছিলেন কিলাব,
কিলাবের
বাবা ছিলেন মুররা (murra),
মুররার
বাবা ছিলেন কাব,
কাব
ছিলেন লুয়াইয়ের পুত্র যার
বাবা ছিলেন গালিব এবং গালিব
ছিলেন ফিহরের পুত্র!
এইভাবে
কুসাইর মা তার পূর্বপুরুষদের
নাম বর্ণনা করতে থাকেন এবং
শেষজন পর্যন্ত পৌঁছেন যিনি
ইয়েমেনের উপচে পড়া ভিড়
ছেড়ে যাযাবরদের জীবনযাপন
করতে ইয়েমেন ছেড়ে হিজাজে
আসেন।
মা
তাকে বলেন যে,
তোমার
পূর্বপুরুষরা ছিলেন সম্ভ্রান্ত
পরিবারের। সেখানে তোমার সৎ
বাবার বংশপুরুষরা ছিলেন সাধারণ
গোত্রের এবং দাসদের থেকে এক
স্তর উপরে ছিল তাদের মর্যাদা।
একথা শুনে কুসাই মক্কায় যেতে
আগ্রহ প্রকাশ করেন,
কিন্তু
মা তাকে পবিত্র মাস আসার আগ
পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন
এবং তীর্থযাত্রীদের সাথে
ভ্রমণ করতে বলেন। কারণ যুদ্ধবিরতির
এই তিনমাসে তার যথেষ্ট সময়
থাকবে -
যেহেতু
এটা তীর্থযাত্রার মাস এবং
নিষিদ্ধ মাস,
তাই
এই তিন মাস দক্ষিণ আরব থেকে
তার অঞ্চলে ফিরে আসার জন্য
যথেষ্ট। কিন্তু কুসাই সেখানে
যায় ঠিকই কিন্তু সে কখনও আর
ফিরে আসেনি। মক্কায় পৌঁছানোর
পর,
কুসাই
এই কালো পাথরের মন্দিরের হুবাল
দেবতাকে শ্রদ্ধা জানানোর পরই
মক্কার খুজা গোত্রের নেতা
হুলায়লের (hulayl)
কন্যার
রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে
করে।
কুসাই
ছিলেন শারীরিকভাবে চিত্তাকর্ষক,
বুদ্ধিমান
এবং উচ্চাভিলাষী। যেহেতু
তিনি জন্মগতভাবেই একজন
নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন মানুষ,
তাই
এই উপত্যকায় ঢুকেই তিনি তাদের
অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়ে সম্পৃক্ত
হয়ে পড়েন। তাঁর এই চিত্তাকর্ষক
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে
সকল বিষয়ে তাঁর মতামতকে
হিজাজবাসী গুরুত্বের সাথে
গ্রহণ করতেন এবং দ্রুতই তিনি
একটি গুরুত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর
হয়ে উঠেছিলেন। কুসাইর শ্বশুর
মারা যান,
এবং
মৃত্যুর পর কুসাই তাঁর গোত্রের
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তবে
ইসলামের আদি গ্রন্থে তাঁর
ক্ষমতা গ্রহণের ব্যাপারে দুই
ধরণের তথ্য পাওয়া যায়। যাতে
লেখা,
প্রথমে
কুসাইর শ্বশুর তাঁর মদ্যপ
পুত্র আবু গুবশান (abu
Gubshan) এর
উপর মনক্ষুণ্ণ হয়ে কুসাইর
হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
তবে সম্ভবত কুসাই নিজে ক্ষমতার
জন্য তাঁর মদপ্রেমী শ্যালকের
বিরুদ্ধে একটি সেনা অভ্যুত্থান
মঞ্চস্থ করেন। অতিরিক্ত
মদ্যপানই তাঁর একমাত্র সমস্যা
ছিল না,
বরং
নেতৃত্বদানেও তিনি ছিলেন
অপারদর্শী। তাই তাঁকে কেউ
গোনায় ধরত না। হুলায়লের
সময়কালে স্থানীয় গোত্র এবং
তীর্থযাত্রীরা মন্দিরে উপাসনা
করে কোন অনুদান প্রদান না করে
ফিরে যেতে পারতেন না,
কিন্তু
এখন তারা অনুদান না দিয়ে চলে
যাচ্ছেন। এজন্য কুসাই
তীর্থযাত্রীদের বিরুদ্ধে
ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত
নেন। তিনি একরাতে তাঁর শ্যালককে
মাতাল করে নৃত্য,
মদ,
বাদ্যযন্ত্র
(LUTE)
এবং
কয়েকটি উটের বিনিময়ে ক্ষমতা
ক্রয় করে এই মন্দিরের নিয়ন্ত্রণ
তাঁর শ্যালকের কাছ থেকে নিয়ে
নেন। পরদিন দুজনই এই ভাবনা
নিয়ে জেগে ওঠে যে,
কে
নেবে ক্ষমতা। আবু গুবশানের
দায়িত্ব পড়ে খুজা জাতির
কাছে নিজেকে ব্যাখ্যা করার,
এবং
কুসাইর দায়িত্ব হলো খুজাদের
মধ্যে কেউ যদি তাঁর ক্ষমতা
মেনে না নিয়ে বিদ্রোহ করে
ওঠে তাঁকে দমন করার। কুসাই
যেকোনো ধরনের ষড়যন্ত্র
গুড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুতি
নিতে থাকেন। আরবের কিছু কিছু
গোত্রের সমর্থন তিনি পান।
তিনি তাঁর সৎ ভাইদেরকে সাহায্যের
আবেদন জানিয়ে নিজের কাছে
ডেকে পাঠান,
যাতে
তাঁর দিকেও সংখ্যা বাড়তে
থাকে।
যুদ্ধ
প্রস্তুতি চলতে থাকে এবং
খুজারা ছিলেন সংখ্যায় বেশি।
কোন কোন বর্ণনায় পাওয়া যায়,
কুসাইর
সৎ ভাইয়েরা তিনশত যোদ্ধা
নিয়ে মক্কার দক্ষিণ দিকে
রওনা দেয়,
আবার
কোথাও পাওয়া যায় সৈন্য
সংখ্যা ছিল প্রায় এক হাজার।
কুদাহ গোত্রের এই লোকেরা
(কুসাইয়ের
সৎ ভাইয়েরা)
অবশ্য
ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়েও
তীর্থযাত্রীদের বেশ ধরে মক্কার
উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল।
উল্লেখ আছে,
কুসাই
প্রথমে সূর্য-পুজারি
তীর্থযাত্রীদের মাঝে মিশে
যাবার পরিকল্পনা করেন,
তারপর
সেখান থেকে প্রতিরোধ সংগঠিত
করে খুজাদের উপর হামলা চালানোর
সিদ্ধান্ত নেন।
সেই
সময়ে মূলত দুটি স্বতন্ত্র
তীর্থস্থান ছিল,
একটি
ছিল মক্কার মন্দিরে চাঁদের
পূজা,
অন্যটি
সূর্য দেবতার পূজার স্থান।
সূর্যপূজারিদের যাত্রা শুরু
হতো মক্কা উপত্যকা থেকে বারো
মাইল পূর্বে আরাফাতে। বিস্তৃত
উপত্যকার মাঝখানে ছোট একটি
পাহাড়ে আরোহণ করে তীর্থযাত্রীরা
সূর্যাস্ত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে
থেকে এই রহস্যের প্রতি শ্রদ্ধা
জ্ঞাপন করতেন। আস্তে আস্তে
যখন সূর্য ডুবতে থাকত তীর্থ
দলপতিরা সূর্যকে অনুসরণ করার
জন্য তীর্থযাত্রীদের আদেশ
দিতেন।
তারা
প্রায় দুই ঘন্টার পথ এই সুর্যের
পেছনে হেঁটে বা উটের পেছনে
উঠে ছুটতেন আরাফাত থেকে পশ্চিমে
মুজদালিফার দিকে!
এরকম
করতে করতে তারা মুজদালিফায়
রাতে অবস্থান নিতেন এবং তাঁর
পরের দিন যখন সূর্যোদয় হতো
তখন তারা আনন্দ উদযাপন করতেন!
অতঃপর
সেখান থেকে আরও পশ্চিমে মিনার
দিকে রওনা দিতেন,
যা
মক্কা উপত্যকার সংলগ্ন আরেকটা
উপত্যকা। পাথরের স্তম্ভ যেটাকে
গণ্য করা হতো দুষ্ট জিনদের
আটকানো খুঁটি,
তাঁকে
লক্ষ্য করে তারা পাথর ছুঁড়ে
সামগ্রীর ব্যবহার করে দেয়ালটির
ঘনত্ব বাড়ান এবং দেয়ালকে
আরেকটু উঁচু করেন। তিনি মন্দিরে
একটা দরজা লাগান এবং সেখানে
একটি তালা লাগিয়ে দেন যার
একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকে
শুধুমাত্র কুসাইর উপর। যারাই
এই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে হুবাল
দেবতার উপাসনা করবে তাদেরকেই
অর্থ দিয়ে ঢুকতে হবে,
কারণ
এটিই ছিল তাঁর অর্থনীতির মূল
চাবিকাঠি। বাকি যারা ছিলেন
তারা সবাই বাইরে প্রার্থনা
করতেন,
দেয়ালের
বাইরে পশু উৎসর্গ করতেন।
কুসাইর অভ্যুত্থান শুরু হয় ঐতিহ্যগতভাবে সূর্য দেবতার উপাসক তীর্থযাত্রীদের উপর কর্তৃত্বকারী গোত্রের আধিপত্য ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে। সূর্য দেবতার তীর্থযাত্রীদের দেখভাল করতেন ঐতিহ্যগতভাবে সুফা নামের ছোট বেদুইন গোত্র যাদের অবস্থান ছিল মক্কার পূর্বে।
তীর্থযাত্রীদের মতো সাদা আলখাল্লা পরে, কুসাইর সৎভাই আর তাদের তিনশো অথবা হাজারখানেক যোদ্ধা মিনা উপত্যকা পর্যন্ত সূর্য তীর্থযাত্রায় অংশ নেয়। আকাবা নামক গিরিপথ দিয়ে উপত্যকায় ঢোকার আগ মুহূর্তে, কুসাইর মক্কাস্থ অনুসারী আর আত্মীয়-যোদ্ধারা তাদের পোশাকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা তরবারি বের করে। সুফার নেতাদের উদ্দেশ্যে কুসাই ঘোষণা দেন যে, তিনিই এখন থেকে এটির (তীর্থযাত্রার) দেখভাল করবেন এবং ঘোষণা করেন : “তোমাদের চেয়ে ভালো (তীর্থযাত্রা পালন) করার সুনাম ও দক্ষতা আমাদের আছে” (৭)। সুফারা যখন তাদের দাবি মেনে নিতে নারাজ হয়, তখন যুদ্ধ বেধে যায়। কুসাইয়ের বাহিনী বিজয়ী হয়। বিজয়ী হয়ে সেখান থেকে কুসাই মক্কায় চলে যান যেখানে তিনি খুজা গোত্র এবং এর মিত্রদের সাথে যুদ্ধ করেন। তারাও কুসাইয়ের কাছে পরাজিত হয়।
কুসাই মক্কায় পবিত্র মাসে যে যুদ্ধবিরতির নীতি ছিল তা পুরোপুরি লঙ্ঘন করেছেন, কিন্তু তাঁর সমর্থকরা ভেবে নিয়েছিলেন, তাদের দেবতার আক্রোশ তাদের শত্রুদের উপরেই পড়েছে। তিনি খুজা ও তাদের মিত্রদের লোহিত সাগরের উপকূলীয় এলাকায় চলে যেতে বাধ্য করেন, এবং যেই গোত্রগুলো তাঁকে সমর্থন করেছে তাদের জন্য আশপাশের এলাকা বরাদ্দ করেন। তাঁরা তখন তাদের গোত্রের নাম দেন কুরাইশ! এই কুরাইশ শব্দের উৎপত্তি অস্পষ্ট, তবে কেউ কেউ মনে করেন এর অর্থ ‘যোগদান’, কেননা কুসাই অনেক দূরের সম্পর্ককে একত্রিত করেছিলেন, একই গোত্রের মাঝে (একই গোত্রে রূপান্তর করে)। অন্যরা বিশ্বাস করে যে, এটা হাঙ্গরের থেকে এসেছে, কারণ কুসাই চৌর্যবৃত্তির মতো কূট-রণকৌশল অবলম্বন করতেন।
প্রথমদিকে মক্কাবাসীরা তাঁবু টানিয়ে থাকত। খুজা এবং অন্যান্য পূর্ববর্তী অধিবাসীরা ছিল যাযাবর, যারা পরে একটা স্থায়ী আবাসস্থল গড়ে তুলেছিল। বেশিরভাগই চামড়ার তাঁবুতে বাস করতে সন্তুষ্ট ছিল, কিন্তু তারা তাঁবুর চারপাশে বুক-উঁচু দেয়াল নির্মাণ করত যাতে বালি উড়ে তাঁবুর ভেতরে না ঢোকে। নদীতীরের দুই পাশে মন্দিরের কাছাকাছি অল্প কয়েকটি কাদামাটির স্থায়ী ভবন ছিল। কুসাই প্রথমে রাস্তা নির্মাণ করেন এবং রাস্তা নির্মাণ করতে যা সমানে পান তাই কেটে ফেলেন বা ভেঙ্গে ফেলেন। তিনি তা করতে গিয়ে কাঁটাযুক্ত গাছ কেটে ফেলেছিলেন এবং সবাইকে বললেন, এই গাছগুলোকে নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে ভাল ব্যবহার করলে ভালো হবে, বিশেষ করে ছাদের জন্য ব্যবহার করা যাবে। লোকজন এই কাঁটা গাছগুলোকে পবিত্র বলে বিবেচনা করত, এবং বিশ্বাস করত এদের কাটলে দেবতারা অখুশি হবেন। কিন্তু কুসাই যখন মন্দিরের দেয়ালের সাথে লেগে থাকা গাছও কেটে ফেলেন কিন্তু আকাশ থেকে বজ্রপাত বা অন্য কোনো ঐশ্বরিক শাস্তি তাঁর উপর নেমে আসেনি, তখন লোকেরা তাঁর উদাহরণ অনুসরণ করা শুরু করে, ওগুলো দিয়ে আস্তে আস্তে ঘরবাড়ি নির্মাণ করতে থাকে।
কুসাই তাঁর নিজের জন্য মন্দিরের বরাবর একটা বড় ঘর নির্মাণ করেন এবং ঐ অঞ্চলের বিশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জন্য একটা বড় সভাকক্ষ তৈরি করেন যার প্রধান দরজাটা মন্দিরের দিকে খোলা থাকত। কালো পাথরের এই মন্দিরের কোন ছাদ ছিল না। মন্দিরের চারপাশে বেশ অনেকটা জায়গা ছিল শুধু একজন মানুষের উপাসনার জন্য। কুসাই তখনকার নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার করে দেয়ালটির ঘনত্ব বাড়ান এবং দেয়ালকে আরেকটু উঁচু করেন। তিনি মন্দিরে একটা দরজা লাগান এবং সেখানে একটি তালা লাগিয়ে দেন যার একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকে শুধুমাত্র কুসাইর উপর। যারাই এই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে হুবাল দেবতার উপাসনা করবে তাদেরকেই অর্থ দিয়ে ঢুকতে হবে, কারণ এটিই ছিল তাঁর অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি। বাকি যারা ছিলেন তারা সবাই বাইরে প্রার্থনা করতেন, দেয়ালের বাইরে পশু উৎসর্গ করতেন।
তিনি
আরো একটি পরিবর্তন করেছিলেন।
সূর্য-দেবতার
তীর্থযাত্রীদের জন্য মুজদালিফার
(পাহাড়ের)
উপরে
একটি আলোকবর্তিকা জ্বালানোর
আদেশ দিয়েছিলেন,
যাতে
এই আলোতে তীর্থযাত্রীরা চলাচল
করতে পারে,
যারা
মাঝেমাঝে আরাফাতে অন্ধকারে
হারিয়ে যেত। আরো একটি
গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করেন,
আর
তা হচ্ছে,
সূর্য
উপাসকদের মক্কায় কালো পাথরকে
চুম্বনের মাধ্যমে তাদের
তীর্থযাত্রা শেষ করতে বলেন।
তিনি
বিভিন্ন গোত্রকে আমন্ত্রণ
করেন তারা যেন তাদের প্রিয়
দেবতাদের জন্য এই মন্দিরের
পাশেই মন্দির স্থাপন করেন,
যাতে
করে তারা তাদের বার্ষিক
তীর্থযাত্রা এই অঞ্চলেই করেন।
তিনি তীর্থযাত্রীদের খাদ্য
ও জল সরবরাহ অব্যাহত রাখেন।
এটিকে তিনি পবিত্র কর্তব্য
বলে মনে করতেন,
কিন্তু
এর সঙ্গত কারণও ছিল। তীর্থযাত্রীরা
যদি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্ত
না থাকেন,
তবেই
তো তাঁরা বারবার উপাসনার জন্য
আসবেন!
হুবালকে
যেহেতু ভাগ্যদেবতা মনে করা
হতো তাই অনেকেই আসতেন হুবাল
দেবতার কাছ থেকে টাকা দিয়ে
মন্দিরে ঢুকে পরামর্শ নেয়ার
জন্য। জলের জন্য বিভিন্ন কুপ
থেকে জল তুলে রাখা হতো। কুসাই
গবাদিপশুর উপর করারোপ করেন,
যার
মানে হচ্ছে গবাদি পশুর একটি
অংশ তীর্থযাত্রা মৌসুমের
শুরুতে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর
করতে হবে।
কুসাইকে
একজন ভালো শাসক বলা হতো । তিনি
যদিও শক্ত হাতে রাজ্য পরিচালনা
করতেন,
তবে
তাঁর চল্লিশ বছরের শাসনকাল
বেশ ভালোই ছিল। শুধুমাত্র
ক্ষমতাচ্যুত ব্যক্তিরা বাদে
বাকি সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন।
কুসাই জানতেন কিভাবে শাসন
করতে হয়।
চাঁদ
মন্দিরের রাজস্বের একচেটিয়া
নিয়ন্ত্রণ তিনি তাঁর হাতে
রাখেন,
তীর্থযাত্রীদের
জন্য খাদ্য ও জল সরবরাহ করেন,
এবং
যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতেন। তিনি
দক্ষতার সাথে স্থানীয়
গোত্রসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ
দায়িত্বগুলোকে ভাগ করে দেন।
একটি গোত্র অস্ত্রশস্ত্র এবং
সামরিক প্রশিক্ষণের রক্ষণাবেক্ষন
করত এবং দূরবর্তী গোত্রগুলির
সাথে সম্পর্ক স্থাপন করত,
আর
অন্য গোত্রের উপর দায়িত্ব
ছিল তীর্থযাত্রীদের দেখভাল
করা ও তাদের উপর কর্তৃত্ব
প্রতিষ্ঠা করা। একেবারে বৃদ্ধ
হওয়ার আগ পর্যন্ত কুসাই
সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের উপর
সভা ও সেখানে সভাপতিত্ব করেন,
এবং
সমস্যা হলে সমাধান করতেন।
যদিও জানা যায় না কিভাবে তিনি
কাফেলা ব্যবসা শুরু করেন,
তবে
এটা সত্য এই কাফেলা ব্যবসার
মাধ্যমেই তাঁর বংশধরেরা বিশাল
সম্পদের মালিক হয়।
কুসাইর
সময়ের লোকেরা উট এবং উটের
চালক ভাড়া করতো তাদের যাতায়াতের
জন্য,
এবং
যাতায়াতের পথেই স্থানীয়
মানুষেরা এই উট-কাফেলাকে
সেবা প্রদান করতেন। মক্কায়
কৃষিকাজের জন্য পর্যাপ্ত জল
ছিল না,
সুতরাং
তাদের খাদ্যশস্য অন্য অঞ্চল
হতে রপ্তানি করতে হতো। খেজুর
আসত ইহুদিদের কৃষিভূমি ইয়াছরিব
এবং খাইবার থেকে,
শাকসবজি
এবং ফলমুল আসত মক্কা থেকে
সত্তর মাইল পূর্বের একটি অঞ্চল
-
তায়েফ
থেকে। খাদ্য রপ্তানি করতে
যেহেতু টাকার দরকার ছিল,
তীর্থযাত্রী
এবং পর্যটকদের কাছে চামড়ার
পণ্য এবং উপহার সামগ্রী বিক্রি
করা ছাড়া তাদের অর্থ উপার্জনের
আর কোন উপায় ছিল না। তাই জীবিকা
নির্বাহের একমাত্র উপায় ছিল
কাফেলায় নিম্নস্তরের
কর্মসংস্থানের মাধ্যমে।
পরবর্তীতে কুসাইর বংশধরদের
মাধ্যমে মক্কার চিত্র বদলে
গিয়েছিল।