অধ্যায় - ২ ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস - ইসলামিক জিহাদ
নিচে বর্ণিত মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাসসমূহের সংক্ষিপ্ত ধারণা এই পুস্তকের মর্মবাণী বুঝতে সহায়ক হবে ।
মুসলিমরা বিশ্বাস করে যে, ইসলাম হলো নবি ইব্রাহিমের অনুসারীদের সর্বশেষ একেশ্বরবাদী ধর্ম। ইসলামের খোদা বা ঈশ্বর হলেন আল্লাহ, যিনি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদেরও ঈশ্বর । আল্লাহ মানবজাতিকে তাঁর পথ-নির্দেশনা প্রচারের জন্য আদম ও হাওয়া-কে সৃষ্টির পর থেকে পর্যায়ক্রমে এক লাখ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর বা নবি প্রেরণ করেছেন। পয়গম্বর বা নবিগণের এ পরম্পরায় আদম প্রথম, মোহাম্মদ সর্বশেষ । সর্বশেষ নবি মোহাম্মদ সব নবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ । তিনি ছিলেন সর্বকালে মানবজীবনের সর্বোচ্চ পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানুষ। সর্বশেষ ও সর্বসেরা এ নবি ঈশ্বরের পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত স্বর্গীয় প্রত্যাদেশ ‘কোরান’ আনয়ন করেন এবং ঈশ্বরের চূড়ান্তকৃত ধর্ম 'ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করেন । ঈশ্বর-প্রেরিত আগের ধর্মবিশ্বাসগুলো, যেমন ইহুদি ও খ্রিষ্টধর্ম, ইসলামের তুলনায় অসম্পূর্ণ ও হীনতর । অন্যসকল ধর্মকে বাতিল ও প্রতিস্থাপন করার জন্য ইসলামধর্ম প্রেরণ করেছেন এ দাবি করে আল্লাহ কোরানে বলেন: “তিনি (আল্লাহ) তাঁর প্রেরিত নবি (মোহাম্মদ)-কে পথ-নির্দেশ ও (একমাত্র) সত্য ধর্মসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে অন্যসকল ধর্মের উপর তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন' (কোরান ৪৮:২৮)।
ইসলাম দাবি করে যে, সময়ের সাথে ইহুদিরা তাদের ধর্মশাস্ত্রকে বিকৃত বা পরিবর্তিত করেছে (কোরান ২:৫৯)। সুতরাং এটা বাতিল ও পরিত্যাজ্য । এ ব্যাপারে খ্রিষ্ট ধর্মশাস্ত্র কিছুটা ভাল মূল্যায়ন পেয়েছে: এটা এখনও বৈধ, যদিও ইসলামের চেয়ে হীনতর । কোরান দাবি করে যে, খ্রিষ্টানরা তাদের মূল ধর্মগ্রন্থের কিছু অংশ ভুলে গেছে (কোরান ৫:১৪) এবং এর উপদেশ তারা ভুল বুঝেছে । যেমন তারা ভ্রান্তভাবে যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র মনে করে (কোরান ৫:৭২, ১১২:২, ১৯:৩৪-৩৫, ৪:১৭১)। কোরান এটাও দাবি করে যে, খ্রিষ্টানরা ভুলবসত যিশুকে তিনজনের একজন, অর্থাৎ ‘ট্রিনিটি’ বা তিন ঈশ্বর-এর একজন বলে গণ্য করে (কোরান ৫:৭৩, ৪:১৭১)। খ্রিষ্টানরা যদিও ভুলভাবে ধর্মচর্চা করে, তবুও আল্লাহ তাদের ধর্মকে বাতিল করেন নি, তবে আশা করেছেন যে ইসলামের দ্বারা পরিণামে তা বাতিল হয়ে যাবে (কোরান ৪৮:২৮)। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কেমন করে ইহুদিরা তাউরাত (ওল্ড টেস্টমেন্ট) বিকৃত করেছে, কিংবা কীভাবে খ্রিষ্টানরা বাইবেল (নিউ টেস্টমেন্ট)-এর অংশবিশেষ ভুলে গেছে বা ভুল বুঝেছে – আল্লাহ সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য কিংবা সেসব অংশগুলো সংশোধনের জন্য নবি মোহাম্মদকে না পাঠিয়ে, মোহাম্মদের নেতৃত্বে একটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে পৃথিবীতে পাঠান!
The Quranic reference has been included in the parenthesis within the text Quran 48:28 stands for Quranic chapter 48, Verse 28. One of the three most acceptable translations of the Quran, hosted by the University of Southern California (http://www.usc.edu/dept/MSA/quran/), has chosen for linguistic clarity.
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুটো প্রাথমিক ভিত্তির উপর: প্রথমত কোরানে ধারণকৃত স্বর্গীয় বা দৈববাণী এবং দ্বিতীয়ত নবির ঐতিহ্য ও বাণী, যাকে হাদিস বা সুন্নাহ বলা হয় । দৈববাণী হলো মানব জাতির প্রতি ঈশ্বরের নিজস্ব বার্তা, যা আরবি কোরানে অপরিবর্তিত রূপে উপস্থাপিত হয়েছে । মোহাম্মদ-কর্তৃক ইসলামধর্ম প্রচার ও বিস্তার কালে (৬১০-৬৩২ সাল) আল্লাহ তাঁর বার্তাবাহক জিব্রাইলের মারফৎ অল্প অল্প করে তাঁর প্রত্যাদেশগুলো মোহাম্মদের নিকট পৌঁছে দেন । মোহাম্মদ ছিলেন একজন নিরক্ষর মানুষ । প্রত্যেকবার জিব্রাইল ঈশ্বরের ঐশীবাণী নিয়ে এসে মোহাম্মদকে তা পড়ে শোনাতেন, যতক্ষণ না মোহাম্মদের তা মুখস্ত হতো। অতঃপর মোহাম্মদ ঈশ্বরের বাণীসমুহ নির্ভুল রাখার জন্য তাঁর শিক্ষিত শিষ্যদের দ্বারা লিখিয়ে রাখতেন ও তাঁর কিছু প্রিয় শিষ্যদের দ্বারা সেগুলো মুখস্ত করাতেন । নবির মৃত্যুর পর ঐসব প্রত্যাদেশ পুস্ত কাকারে সংকলিত করা হয়, যা 'কোরান' নামে পরিচিত। সুতরাং কোরানে ধারণকৃত বিষয়সমূহ হলো মানবজীবনকে, যেভাবে ঈশ্বর কামনা করেন, ঠিক সেভাবে পরিচালিত করার জন্য তাঁর নিজের বাণী । সেরূপ জীবন যাপনকারী একজন বিশ্বাসী মৃত্যুর পর আল্লাহর স্বর্গে গমন করে সেখানে তাঁর অসীম অনুগ্রহ উপভোগের সুযোগ পাবে ।
ইসলামের দ্বিতীয় উপাদান বলতে গেলে ইসলাম ধর্মের অপর অর্ধাংশ হলো নবির প্রথাগত ঐতিহ্য: অর্থাৎ নবি মোহাম্মদের কথা ও কর্মকাণ্ডসমূহ, যাকে সমষ্টিগতভাবে হাদিস বা সুন্নাহ বলা হয় । ঈশ্বর-প্রেরিত অগণিত নবির মধ্যে যেহেতু মোহাম্মদ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও মানবীয় পূর্ণতার মূর্ত প্রতীক, সুতরাং স্বর্গে আল্লাহর অনুগ্রহ অর্জনের জন্য মুসলিমদেরকে, তথা মানবজাতিকে, নবির মত নিষ্পাপ বা নিখুঁত জীবন- যাপন করতে হবে । আর তার একমাত্র উপায় হলো নবির পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলা ।
ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা নবি মোহাম্মদের মতো জীবন অতিবাহিত করতে পারবে, তাঁরা কোন নরকযন্ত্রণা ভোগ না করে সরাসরি স্বর্গে (বেহেস্তে) প্রবেশ করবে । কিন্তু কোন মুসলিমের পক্ষে মোহাম্মদের নিষ্পাপ জীবনের সমকক্ষ হওয়া প্রায় অসম্ভব । সুতরাং অধিকাংশ মুসলিমকে প্রথমে কিছুকাল ইসলামের নরক বা দোযখের ভয়ঙ্কর অগ্নিকুণ্ডে দগ্ধ হতে হবে। তাদের নরকবাসের সময়কাল নির্ধারিত হবে পার্থিব জীবনে তারা কী পরিমাণ পাপ করেছে তার উপর । অতঃপর তারা স্বর্গে গমন করবে অনন্তকালের জন্য ।
মুসলিমদের মধ্যে আর একটিমাত্র দল নরকের আগুনে দগ্ধ না হয়ে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারবে। এরা হল তাঁরা যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে শহীদ হিসেবে মৃত্যু বরণ করবে, অর্থাৎ তাঁরা যখন জিহাদ বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধে মারা যাবেন (কোরান ৯:১১১; তৃতীয় অধ্যায়ে আরো দেখুন) । অতএব নবি মোহাম্মদের জীবদ্দশায় তাঁর নির্দেশে কিংবা পরিচালনায় যুদ্ধ করতে গিয়ে যে শত শত মুসলিম মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার পরবর্তীকালে শতাব্দীর পর শতাব্দী-ব্যাপী যে লাখ লাখ মুসলিম ইসলামের পবিত্র যুদ্ধে মারা গেছেন এবং এখনও মারা যাচ্ছেন বা ভবিষ্যতে মারা যাবেন তাঁরা সরাসরি ইসলামের স্বর্গে পদার্পণ করবেন। অন্যান্য মুসলিমরা, যারা স্বাভাবিকভাবে মারা যাবে, তাদেরকে আলাহ-কর্তৃক সমগ্র পৃথিবী ধ্বংসের পর 'শেষ বিচারের দিন' পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ঐদিন আল্লাহ নির্ণয় করবেন স্বর্গে গমনের আগে কতকাল তাদেরকে নরকে কাটাতে হবে ।
সুতরাং মুসলিমদের মাঝে নবি মোহাম্মদের জীবনের, অর্থাৎ তাঁর কথা ও কর্মকাণ্ডের সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমকক্ষ হওয়ার একটা সার্বজনীন আকাঙ্ক্ষা থেকে যায়। মুসলিম জীবনের অপর পরম আকাঙ্ক্ষাটি হলো অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ইসলামের পবিত্র যুদ্ধে শহীদ হওয়া, বিশেষত ইসলামের পরিধি সম্প্রসারণের জন্য অমুসলিম-নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড দখলের জন্য যেসব যুদ্ধ । ইসলামের শুরুতে বিকাশমান মুসলিম সম্প্রদায় মদীনায় নবি মোহাম্মদ পরিচালিত জিহাদ-পেশায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিল । সে সকল যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামালের (ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত) উপর নির্ভর করেই তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতো (তৃতীয় অধ্যায় দেখুন) ।
নবুয়তীর তেইশ বছরকাল ধরে মোহাম্মদ আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলেন । সকল পরিস্থিতিতে - তা হোক যুদ্ধে কোন সঙ্কট, যুদ্ধ-বন্দিদের বিষয়ে কোন সমস্যা কিংবা পরিবারের কোন বিবাদ মীমাংসা - জীবনের পদে পদে আল্লাহ মোহাম্মদকে পরিচালিত করতেন । নবির সকল কাজকর্মে আল্লাহ অবিরাম নজর রাখতেন । যখনই মোহাম্মদ কোন ভুল করতেন, তৎক্ষণাৎ আল্লাহ হাজির হতেন পরামর্শ দিতে বা সে ভুল সংশোধন করতে । এরূপে নবুয়তীকালে মোহাম্মদের প্রতিটি কথা ও কাজ ছিল স্বর্গীয় বা দিব্য ভাবে পরিচালিত, অর্থাৎ দিব্য প্রকৃতির । কাজেই ‘সহি মুসলিম’ (a collection of prophetic tradition)-র অনুবাদক ও বিশিষ্ট পণ্ডিত আব্দুল হামিদ সিদ্দিকী সুন্নতকে স্বর্গীয় সৃষ্টি বলে দাবি করে বলেন: '...কোরান ও সুন্নতের উপদেশাবলি কোন মানব শক্তি থেকে উদ্ভূত নয়, এর সবই ঈশ্বরের প্রত্যাদিষ্ট; সুতরাং এগুলো সকল বস্তুগত ও ইহলৌকিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে। *9 এ কারণে ইসলামে নবির সুন্নতসমূহ ধর্মগ্রন্থ কোরান- -বহির্ভূত কিন্তু আধা-স্বর্গীয় হিসেবে বিবেচিত, যা মুসলিমদেরকে অতি সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে ।
মুসলিমদের জন্য নবি মোহাম্মদের জীবনের সমকক্ষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা কেবল একটা সূত্রবদ্ধ সিদ্ধান্ত নয় । আল্লাহ কোরানের নির্দেশ প্রতিপালনের সাথে সাথে নবিকে অনুসরণ করতেও বারবার মুসলিমদেরকে নির্দেশ করেছেন । কোরানে বারংবার বলা হয়েছে: আল্লাহকে (অর্থাৎ কোরানকে) এবং তাঁর প্রেরিত নবিকে (অর্থাৎ সুন্নতকে) মেনে চলো (কোরান ৩:৩২, ৪:১৩,৫৯,৬৯, ৫:৯২; ৮:১,২০,৪৬, ৯:৭১; ২৪:৪৭, ৫১-৫২,৫৪,৫৬; ৩৩:৩৩; ৪৭:৩৩; ৪৯:১৪; ৫৮:১৩; ৬৪:১২)। কাজেই ইসলাম ধর্মে কোরানের নির্দেশাবলি ও সুন্নত হলো প্রায় সমমানের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । যাহোক ইসলামের কিছু আধুনিক ও সুশিক্ষিত কৈফিয়তদাতা, শুধু বিরোধিতার কারণে হোক কিংবা অজ্ঞতার কারণে, আল্লাহর সুস্পষ্ট সতর্কবাণী সত্ত্বেও সুন্নতকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট। তার কারণ হাদিসে বর্ণিত নবির কিছু কিছু সুন্নত বা কার্যকলাপ আধুনিক চেতনা ও মূল্যবোধের কাছে অগ্রহণযোগ্য, এমনকি ঘৃণ্য। তারা কোরানকে ইসলামের একমাত্র সংবিধানরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চান । এখানে উল্লেখ্য যে, নবি মোহাম্মদের মৃত্যুর পর ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিতগণের দ্বারা কোরানের বাণীর সঙ্গে যথাযথ মিল রেখে সুন্নত সংকলিত হয়েছিল, এবং তা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামের বিশেষজ্ঞ (উলেমা)-দের দ্বারা স্বীকৃত হয়ে এসেছে।
---------------
9 Sahih Muslim by Imam Muslim, Translated by Siddiqi AH, Kitab Bhavan, New Delhi, 2004 edition, Vol. I, p. 210–11, note 508.
‘শরীয়া’ বা ‘পবিত্র ইসলামি আইন' হলো ইসলামের আরেকটি অপরিহার্য উপাদান। শরীয়া আইন ইসলামের পৃথক কোন উপাদান নয়, বরং তা কোরান ও সুন্নত থেকেই উদ্ভূত ।
মোহাম্মদ ঈশ্বরের বাণীসমূহ তার শিষ্যদের মাধ্যমে খণ্ডে খণ্ডে লিপিবদ্ধ ও মুখস্ত করালেও তিনি সেগুলোকে পুস্তকাকারে সংকলিত করার প্রয়োজন বোধ করেন নি । এখন যে কোরানকে আমরা চিনি, তা ইসলামের তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসনামলে (৬৪৪-৬৫৬ সাল) সঙ্কলিত করা।
একইভাবে আল্লাহ বারংবার মুসলিমদের বলেছেন, নবি মোহাম্মদকে অনুসরণ করতে তবুও মোহাম্মদ কিন্তু তাঁর কাজ ও অবদান সম্বলিত জীবনী – যা বিশ্ব ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত মুসলিমদেরকে অনুসরণ করতে হবে – তা লিখে কিংবা অন্যদের দ্বারা লিখিয়ে রেখে যাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন । স্পষ্টতঃ ইসলামের খোদাও মোহাম্মদকে তাঁর (খোদার) বাণীসমূহ একটা পুস্তকে (অর্থাৎ কোরান) একত্রিত করতে অথবা নবি মোহাম্মদের আত্মজীবনী (অর্থাৎ সুন্নত) লিখে রেখে যাওয়ার নির্দেশ দিতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। অথচ ইসলাম ধর্মের এ দু'টি মৌলিক উপাদান মুসলিমদেরকে সর্বকালে কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
নবি মোহাম্মদের মৃত্যুর পর কয়েকজন বুদ্ধিমান মুসলিম আল্লাহ ও তাঁর নবির এ দুর্বলতাগুলো উপলব্ধি করেন ও তা পূরণ করতে সচেষ্ট হন । তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, ইসলাম ধর্মকে অবিকৃত ও আদি অবস্থায় রাখতে হলে স্বর্গীয় বাণী ও সুন্নতের পদ্ধতিগত বিন্যাস জরুরি । সুতরাং আল্লাহর পূর্বেকার ধর্মগ্রন্থ 'গপেল' ও 'তোরা' (বাইবেল ও তাউরাত)'র ক্ষেত্রে ঘটা বিকৃতির মতো একই রকম বিকৃতি এড়ানোর জন্য তাঁরা মোহাম্মদের মৃত্যুর প্রায় দুই দশক পর আল্লাহর দৈববাণীগুলো একত্রিত করে কোরান সংকলন করেন ।
অতঃপর অভিজ্ঞ ইসলামিক পণ্ডিতদের দু'টো ধারা ইসলামকে সঠিক পথে রাখার নিমিত্তে পৃথক দু'টো বিশাল কাৰ্য-প্রকল্পে নিয়োজিত হয় । প্রথম প্রকল্পটি ছিল নবির সুন্নত একত্রিত করা। ৭৫০ সালের দিকে ধার্মিক মুসলিম পণ্ডিত ইবনে ইসহাক কর্তৃক নবির প্রথম জীবনী সংকলনের মধ্য দিয়ে তা শুরু হয় । তারপর থেকে বহু বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ও গবেষক নবির জীবনের ওপর অনেক দুঃসাধ্য ও পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার কাজে নিয়োজিত হন। অগণিত মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য তাঁরা হেজাজ থেকে সিরিয়া, পারস্য, মিসর তথা আরবের সর্বত্র পরিভ্রমণ করেন এবং নবির হাজার হাজার কথা, কাজ ও উপদেশ একত্রিত করেন । এদের মধ্যে ছয়জন অত্যন্ত মেধাবী ও দক্ষ হাদিস সংকলক রয়েছেন, যাঁদের সংকলিত হাদিস খাঁটি বা সহি হিসেবে স্বীকৃত:
১. আল-বুখারী (৮১০-৮৭০) সংগ্রহ করেছেন ৭২৭৫টি খাঁটি হাদিস, যাকে বলা হয় “সহি বুখারী” ।
২. মুসলিম বিন আল-হাজ্জাজ (৮২১-৮৭৫), বুখারীর একজন শিষ্য, সংগ্রহ করেছেন ৯২০০টি খাঁটি হাদিস, যাকে 'সহি মুসলিম' বলা
হয় ।
৩. আৰু দাউদ (৮১৭–৮৮৮) সংগ্রহ করেছেন ৪৮০০টি খাঁটি হাদিস, যাকে 'সুনান আবু দাউদ' বলা হয় ।
৪. আল-তিরমিযী (মৃত্যু ৮৯২)।
৫. ইবনে মাজা (মৃত্যু ৮৮৬)
৬. ইমাম নাসাই (জন্ম ২১৫ হিজরী)।
সুন্নত সংকলনের সময়কালে আবির্ভাব ঘটে আরেকটি ধারার অতিশয় মেধাবী ইসলামি পণ্ডিতগণের । তাঁরা কোরানের বাণী ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে মুসলিম সমাজের প্রয়োজনীয় আইনসমূহ সুনির্ধারিতভাবে সূত্রবদ্ধ করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন । এক্ষেত্রে চারজন বিশিষ্ট মুসলিম পণ্ডিতের উদ্যোগে চারটি প্রধান ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইসলামিক আইনশাস্ত্র (জুরিসপ্রুডেন্স) বা 'ফিকাহ্' নামে পরিচিত । তাঁরা হলেন:
১. ইমাম আবু হানিফা (৬৯৯-৭৬৭) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘হানাফি’ আইনশাস্ত্র। দক্ষিণ এশিয়া, তুরস্ক, বলকান অঞ্চল, চীন এবং মিসরের মুসলিমরা এ ধারার অনুসারী।
২. ইমাম মালিক বিন আনাস (৭১৫-৭৯৫) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত 'মালিকী' আইনশাস্ত্র । উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা এবং কয়েকটি আরব দেশের মুসলিমরা এ মতের অনুসারী।
৩.
ইমাম আল শাফী (৭৬৭-৮২০) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘শাফী' আইনশাস্ত্র । দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মিসর, সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া ও ইয়েমেনের মুসলিমরা এ সম্প্রদায়ের অনুসারী।
৪. ইমাম আহম্মদ বিন হাম্বাল (৭৮০-৮৫৫) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘হাম্বালী' আইনশাস্ত্র । সৌদি আরব ও অন্যান্য আরব রাষ্ট্রের মুসলিমরা এর অনুসারী।
বিখ্যাত মুসলিম ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের মতে ফিকাহ্” হলো: ‘আলাহর বিধি-বিধান সংক্রান্ত জ্ঞান, যা ব্যক্তির কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত যারা নিজে থেকেই ইসলামে কোনটা অবশ্যকরণীয় (ওয়াজিব), কোনটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ (হারাম), কোনটা গ্রহণযোগ্য (মানদিউব), কোনটা অননুমোদিত (মাৰুরূহ), অথবা কোনটা শুধু অনুমতি প্রাপ্ত (মুবাহ) সে ব্যাপারে আইন মেনে চলতে বাধ্য।*10
চারটি প্রধান ইসলামি আইনশাস্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং তাঁদের ছাত্ররা ইসলামি আইন ও অনুশাসন সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ তৈরির জন্য তিন শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে অসাধারণ গবেষণা চালান, সামগ্রিকভাবে তাকে পবিত্র ইসলামি আইন বা ‘শরীয়া' বলা হয়। ইসলামের এ আইনশাস্ত্র গুলোর মধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে সামান্য ব্যতিক্রম থাকলেও মৌলিক পার্থক্য একেবারেই নগণ্য ।
--------------------
10 Levy R (1957) The Social Structure of Islam, Cambridge University Press, U.K
ইসলামের খোদা আল্লাহ পরিপূর্ণ ও চূড়ান্ত জীবনবিধানরূপে সমগ্র মানবজাতির জন্য 'ইসলাম' উপস্থাপন করেছেন (কোরান ৫:৩) । অর্থাৎ ইসলাম হলো আল্লাহর প্রত্যাশানুযায়ী মানব জীবনযাপনের জন্য একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ জীবনবিধান । সুতরাং ইসলামি ধর্মবিধানে মানব জীবনের প্রত্যেকটি সম্ভাব্য ঘটনা, পরিস্থিতি ও কর্মের জন্য একটি সমাধান বা দিকনির্দেশনা রয়েছে। জীবনের প্রতিটি অবস্থায় অনুসরণের জন্য শরীয়া'য় রয়েছে একটি স্বর্গীয় আইন, কর্মপ্রণালী ও অনুশাসন – হতে পারে তা খাদ্যগ্রহণ, মলমূত্র ত্যাগ, যৌনকর্ম, নামাজ আদায়, যুদ্ধ করা অথবা অন্য যে কোন বিষয়ে ।
মুসলিম জীবনের সকলক্ষেত্রে শরীয়া আইন পরিব্যাপ্ত - হোক সে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, আর্থিক বা রাজনৈতিক । ইসলামে আধ্যাত্মিক ও ইহলৌকিক বা জাগতিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । ইসলাম হলো মানবজাতির ইহজাগতিক সমস্যার ‘একের ভিতর সব' সমাধান । তুর্কির মুসলিম পণ্ডিত ড. সেদাত লেসিনার দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন: 'ইসলাম শুধু একটি ধর্মই নয়, একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থাও বটে ।” ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এম. উমরউদ্দিন বলেন, ইসলামে ধর্ম ও রাজনীতির সম্পর্ক অবিভাজ্য । তিনি দাবি করেন: ‘সাধারণ অর্থে ইসলাম একটি ধর্ম নয় । ধর্মের কারবার শুধু মানুষের অন্তরের চেতনাকে নিয়ে - যার সাথে সামাজিক কর্মকান্ডের কোন যৌক্তিক সম্পর্ক নেই এমন ধারণা ইসলামে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, সর্বোপরি ইসলামে তা ঘূর্ণিত । ১২ ইসলামের ধর্মীয় অনুশাসন মানবজীবনের সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে এ যুক্তির ওপর জোর দিয়ে তিনি আরো বলেন: “ইসলাম সবকিছুকে আলিঙ্গন করে, একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন যাতে মানবকর্মকাণ্ডের বিধান, স্তর ও মানবিক আচরণের প্রতিটি ক্ষেত্র অন্তর্ভুক্ত ।
সংক্ষেপে কোরান ও সুন্নত হলো ইসলামের দু'টো প্রাথমিক সংবিধান। এ দু'টো প্রাথমিক উৎস থেকেই উদ্ভব ঘটেছে শরীয়া আইনের । কোরান, সুন্নত ও শরীয়া আইন একত্রে ইসলাম ধর্মের পূর্ণাঙ্গ ভিত্তি রচনা করে । এগুলো সকল স্থানে, সর্বকালে ও সকল সমাজে মুসলিম জীবন- যাপনের জন্য অপরিহার্য ও পূর্ণাঙ্গ পথপ্রদর্শক ।