নিজের দত্তক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার ছয়মাস পার না হতেই মুহাম্মদ আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করেন, ইনি ছিলেন জুয়াইরিয়া (Juwayriya)। মুহাম্মদ তার গোত্রের লোকদেরকে পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে এক অভিযানের মাধ্যমে পরাস্ত করেন। উম্মে কিরফা (Umm Qirfa) হত্যাকাণ্ডের কয়েকমাস পরে মুহাম্মদ মুস্তালিক (Mustaliq) অভিযান করেন। মুহাম্মদ খবর পান যে, লোহিত সাগরের কাছে ইয়াছরিবের দক্ষিণ-পশ্চিমে যাযাবরদের একটি জোট তার উপর হামলার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। তারা মুস্তালিক গোত্রের একজন গুরুত্বপুর্ণ নেতা আল-হারিছের নেতৃত্বে তৈরি হচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে যেকোন সামরিক হামলার পরিকল্পনা ধুলিসাৎ করে দিতে পুর্বের মতই মুহাম্মদ এবারও প্রথমেই আক্রমণ করে বসেন।
সাতশো লোকের একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ইয়াছরিব থেকে চারদিনের যাত্রা পথে একটি জলাশয়ের দিকে রওনা দিলেন। যাওয়ার আগে বিরোধীপক্ষের শক্তি সম্পর্কে অবগত হতে মুহাম্মদ একজন গুপ্তচরকে পাঠিয়েছিলেন। মুস্তালিকরাও মুহাম্মদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য একজন গুপ্তচর পাঠায়, কিন্তু তাকে ধরে ফেলা হয় এবং মুহাম্মদের সামনে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। গুপ্তচরকে নতুন ধর্ম গ্রহণ করার শর্তে প্রাণ বাঁচানোর প্রস্তাব দেয়া হয়। যতক্ষণ না তার পুরো গোত্র এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করে তিনিও ততক্ষণ এই ধর্ম মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান, যা ছিল মারাত্মক ভুল। কাঁধ বাঁকিয়ে মুহাম্মদ তাকে শিরোচ্ছেদ করার ইঙ্গিত দিলেন।
শিরোশ্ছেদের খবর যাযাবরদের কাছে পৌঁছে গেল। মুহাম্মদের সাথে যুদ্ধ করলে নিজেদের ভাগ্যে কি ঘটতে পারে সে কথা চিন্তা করে কিছু বেদুঈন অংশীদাররা মুস্তালিক গোত্রকে পরিত্যাগ করল, সুতরাং আসন্ন শত্রুদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে মুস্তালিক একা হয়ে গেল। মুহাম্মদ শীঘ্রই দুর্ধর্ষ যুদ্ধজয়ের সংকল্প নিয়ে হাজির হলেন, বললেন “হে বিজেতারা হত্যা করো, হত্যা!” (১) মুস্তালিকরা সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ মোকাবেলা করে, কিন্তু মুহাম্মদের যোদ্ধাদের সংখ্যা তাদের চাইতে অনেক বেশি, সুতরাং তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিছু সুত্রমতে, যুদ্ধটা কোন পূর্ব পরিকল্পিত লড়াই ছিল না, বরং একটি আকস্মিক আক্রমণ ছিল যা মুহাম্মদ ভোরের দিকে শুরু করেন। এটা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, মুস্তালিক যোদ্ধাদের মধ্যে দশজন নিহত হয়েছে, কিন্তু মুহাম্মদের একজন অনুসারী মারা গিয়েছিল, যে মক্কার বংশোদ্ভূত ছিল। তার মৃত্যুটি ঘটেছিল নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি থেকে - একজন বিশ্বাসী তাকে মুস্তালিক গোত্রের মনে করে ভুল করে তীর ছুঁড়ে মারে, ফলে সে মারা যায়।
গনিমতের
মালের দিক থেকে,
এই
হামলাটির সাফল্য ছিল বেশ ভালো।
তাদের তাঁবু,
অন্দরমহলের
সকল সামগ্রী ছাড়াও দুই হাজার
উট ও পাঁচ হাজার ভেড়া ও ছাগল
জব্দ করা হয়। ছয়শত লোককে
আটক করা হয় এবং তারা মুসলমানদের
দাসদাসীতে পরিণত হয় (২)।
যাওয়ার আগে মুহাম্মদ গণিমতের
মাল বিতরণের জন্য একজন
তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন,
এবং
প্রত্যেক যোদ্ধার দায়িত্ব
ছিল তার লুণ্ঠিত বস্তুকে
ইয়াছরিবে নিয়ে যাওয়া।
বন্দিরাও এখন গলিমতের মালের
অন্তর্ভুক্ত,
এবং
তাদেরকে বিভক্ত করা হয়েছিল।
ততদিনে মুহাম্মদ আদেশ জারি
করছিলেন যে,
অবিশ্বাসী
নারীরা বন্দি হলে তাদের বিয়েও
বাতিল হয়ে যাবে (৩),
সুতরাং
দাসী হিসেবে এসব মেয়েরা এখন
মুহাম্মদ ও তাঁর অনুসারীদের
যৌনতার জন্য ন্যায্য ক্ষেত্র।
এইভাবে নারী ও মেয়েদের তাদের
বর, পিতা,
চাচা,
ভাই
ও সন্তানদের থেকে আলাদা করে
ফেলা হয় এবং মুহাম্মদের
যোদ্ধাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া
হয়। একবার তারা নির্ধারিত
মালিকদের (মুসলিমদের)
দখলে
চলে এলেই,
নারী
এবং মেয়েদের তাঁবুতে টেনে
নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়।
মুহাম্মদের এক যোদ্ধাকে বলতে
শোনা যায়,
“তখন
আমাদের জন্য যৌনতাবিহীন থাকা
অত্যন্ত কঠিন ছিল!”
(৪)
তবে বন্দি নারীরা তাদের হাতে (বন্টিত হয়ে) আসার সাথেই হানাদাররা একটি সংকটের সম্মুখীন হন এবং একটি ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন – যদি তারা মিলিত হবার পর এই নারীরা গর্ভবর্তী হয়ে যায়? তারা কি তাহলে নারীদের যোনিপথের বাইরে বীর্যপাত (আজল) করবে, যাতে গর্ভবতী হওয়া থেকে ঠেকানো যায়? এই বিষয়টি তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল, কেননা তারা এই নারীদের দিয়ে মুক্তিপণ আদায় করার জন্য গোত্রবাসীদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু তারা গর্ভবতী হয়ে গেলে মুক্তিপণের মূল্য কমে যাবে। তারা এই বিষয়ে একটি দিকনির্দেশনার জন্য মুহাম্মদের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ এটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পর মুহাম্মদ তাদের এটা নিয়ে ভাবতে নিষেধ করলেন, আর বললেনঃ “যদি নারীরা গর্ভবতী হয় তাহলে সেটা হওয়ারই কথা ছিল, এবং এটি আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়েছে” (৫)।
বন্দিদের মধ্যে ছিলেন মুস্তালিকদের প্রধানের কন্যা জুয়াইরিয়া (Juwayriya)। জুয়াইরিয়াকে একজন যোদ্ধাকে পুরস্কার হিসেবে দেয়া হয়, কিন্তু পরে মুহাম্মদই তাকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই সাহাবিও তাতে সম্মতি দেন। এই গল্পের দুটি সংস্করণ পাওয়া যায়। একটিতে পাওয়া যায়, জুয়াইরিয়া যার মালিকানায় পড়েছেন তার সাথে একটি চুক্তি করেন যিনি নয় আউন্স সোনার বিনিময়ে জুয়াইরিয়াকে মুক্তি দিতে সম্মত হন। কিন্তু এতটা অর্থ না থাকায় জুয়াইরিয়া মুহাম্মদের তাঁবুতে গিয়ে তার সাহায্য কামনা করেন। এটা উল্লেখ করতে হবে যে, তিনি গোত্রপ্রধানের কন্যা ছিলেন। মুহাম্মদ তাঁর দুই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে এসেছিলেন - আয়েশা ও উম্মে সালমা - এবং আয়েশা তার সঙ্গে ছিল যেই মুহূর্তে জুয়ারিয়া তার তাঁবুর প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলেন। প্রায় তের বছর বয়সী আয়েশা যখন জুয়ারিয়াকে দেখল তখন সে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল। মুহাম্মদের মনোযোগ আকর্ষণের আরেকজন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়তো সে দেখতে পাচ্ছে। এবং তার ঈর্ষা সত্যই হয়ে গেল যখন মুহাম্মদ তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
মুহাম্মদ জিজ্ঞেস
করলেন,
“তুমি
কি আরো ভালো কিছু পছন্দ
করবে?"
জবাবে
তিনি বললেন,
“সেটা
কি হতে পারে হে আল্লাহর
রাসূল?”
প্রতিউত্তরে
মুহাম্মদ বললেন,
“আমি
নিজেই তোমার সবকিছুর দায়িত্ব
নেব এবং তোমাকে বিয়ে করব।”
ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থ অনুসারে,
তিনি
তখন সেখানেই তার প্রস্তাব
গ্রহণ করেন”(৬)।
আরেকটি সংস্করণে পাওয়া যায়, সম্ভবত এটিই ছিল আসল কাহিনী যে, ইয়াছরিবে এই বিয়ের প্রস্তাবটি একমাসেরও বেশি সময় পরে ভেসে ওঠে, এবং এটি একটি চুক্তির একটি অংশ ছিল যে, বিয়ের বিনিময়ে মুহাম্মদ জুয়াইরিয়ার সমস্ত আত্মীয়দের মুক্ত করে দেবেণ। জুয়াইরিয়া তাঁর গোত্রের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলেন। ততদিনে মুস্তালিক বন্দিদের কয়েকজনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। নারী ও শিশুদের ছয়টি উটের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছিল। জুয়াইরিয়ার বাবা প্রথমে সম্মত হওয়া নয় আউন্স স্বর্ণের পরিবর্তে একপাল উট নিয়ে ইয়াছরিবে এসেছিলেন মেয়ের মুক্তিপণ হিসেবে। জুয়াইরিয়া তাঁর বাবাকে এই চুক্তির ব্যাপারে মুহাম্মদের সাথে কথা বলতে বললেন এবং সেই সময় মুহাম্মদ মসজিদের একটি ঘরে আয়েশার সাথে ছিলেন। আয়েশা পরে এই ঘটনার কথা স্মরণ করেন এইভাবে : “তিনি ছিলেন একজন মিষ্টি, সুন্দরী রমণী, যে কেউ তার দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যাবে। তিনি তার চুক্তির ব্যাপারে আল্লাহর রাসুলের কাছে আসেন সাহায্য চাইতে। আল্লাহর কসম, যখনই আমি তাকে আমার কক্ষের দরজায় দেখতে পেলাম তখনই আমি তাকে অপছন্দ করলাম, এবং আমি জানতাম যে আমি যা দেখেছি তা সেও (মুহাম্মদ) তার মধ্যে দেখতে পাবে” (৭)। জুয়ারিয়া মুহাম্মদকে বিয়ে করেন এবং তার সকল আত্মীয়স্বজন যাদের এখনো মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়ানো হয়নি তাদের মুক্তি দেয়া হলো। ধর্ষিত নারীদের তাদের বরের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং বন্দি মেয়েদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। জুয়াইরিয়াই একমাত্র তাদের সাথে ফিরে না গিয়ে পেছনে পড়ে থাকেন। তিনি তার লোকদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বলে পরবর্তীতে ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, তিনি মুহাম্মদকে তাকে স্পর্শ করতে দেননি। যখনই মুহাম্মদ তার কক্ষে আসতেন তখনই তিনি প্রার্থনার ভান করতেন। তিনি যখনি দরজায় টোকা দিতেন, দরজা খোলার আগে তিনি সেজদার ভঙ্গিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তেন এবং কোরআনের আয়াত বিড়বিড় করতেন, আর মুহাম্মদ তখন দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যেতেন। যদি তিনি কয়েক ঘন্টা পরেও ফিরে আসতেন তবুও দেখতে পেতেন যে, জুয়াইরিয়া তখনো প্রার্থনায় মগ্ন।
[উম্মে কিরফা হত্যাকাণ্ড। তিনি সেই গোত্রের একজন বিশিষ্ট নারী যে গোত্রের লোকেরা মুহাম্মদের লুটেরাদের সাথে লড়াই করেছিল, তাদের কয়েকজনকে হত্যা বা আহত করেছিল। প্রতিশোধ হিসেবে মুহাম্মদ জায়েদকে কিরফার গোত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক অভিযানের নেতৃত্ব দিয়ে পাঠান। উম্মে কিরফাকে আটক করা হয় এবং জায়েদ তার শরীরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মেরে ফেলার আদেশ দেয়। তাকে দুটি উটের মাঝখানে বেঁধে ফেলা হয় এবং উটগুলোকে দুইদিকে দৌড়ানোর ফলে তার দেহ দুইভাগে ছিঁড়ে যায়।]
মুস্তালিক
অভিযানে কিছু অপ্রত্যাশিত
ঘটনাও ঘটে,
তার
মধ্যে অন্যতম হলো প্রতিশোধমুলক
হত্যাকান্ড। যখন গনিমতের মাল
বিতরণ চলছিল,
তখন
ভুলক্রমে হত্যা করা এক মুমিনের
ভাই মিকইয়াস (Miqyas)
মক্কা
থেকে এসে দাবি করে যে,
সে
মুহাম্মদের ধর্মের অনুসারী।
সে তার ভাইয়ের অন্যায়ভাবে
হত্যার জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে
রক্তমূল্য দাবি করে। মুহাম্মদ
তাকে রক্তমুল্য দেয়ার পরও
কিছুদিন সেখানে সে ঘুরঘুর
করে যতক্ষণ পর্যন্ত না তার
সফরের প্রকৃত উদ্দেশ্য সামনে
আসে। এক সুযোগে সে তার ভাইয়ের
হত্যাকারীর গলা কেটে মক্কায়
পালিয়ে যায় (৮)।
পানি নিয়ে মক্কাবাসী মুসলিম ও ইয়াছরিবী মুসলিমদের মধ্যে এবার লড়াই শুরু হয়। খরার কারণে মুস্তালিক কুপের পানির স্তর নিচে নেমে গিয়েছিল এবং যা অবশিষ্ট ছিল তা পেতে প্রতিযোগিতা ছিল অনেক বেশি। লড়াই শুরু হয় যখন প্রতিটি দলের লোকেরা কুয়োর মধ্যে বালতি নামিয়ে দেয় এবং সবার বালতির রশিতে প্যাঁচ লেগে যায়। তারা সেখান থেকে শুধু একটা বালতি তুলতে সক্ষম হলো এবং তারা একে অপরকে ধাক্কা দিতে লাগল। এর মধ্যে দেশপ্রেমিক এক মক্কাবাসী ইয়াছরিবের এক ধর্মান্ধরিতের নাক ফাটিয়ে রক্ত বের দেয় যার ফলে উভয়পক্ষ একে অন্যের সাথে তলোয়ার নিয়ে মুখোমুখি হয়। উভয়পক্ষের নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত করা হয় এবং অবশেষে তাদের মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, তারা নতুন ধর্মের ভাই ভাই এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি তাদের পারস্পরিক ভালোবাসার মাধ্যমে একসাথে এক বন্ধনে জড়িয়ে আছে। এই লড়াই একটি গুরুতর জটিলতার সৃষ্টি করে যখন আবদুল্লাহ বিন উবাই মক্কাবাসীদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করেন। তিনি এবং তার ডজনখানেক খাজরাজ (Khazraj) বন্ধু দুর থেকে পুরো বিষয়টি দেখেছিলেন এবং তারা দেখেন যে, মক্কার এই লোকই প্রথমে এই লড়াই শুরু করেছে। আবদুল্লাহ মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে বললেন, তারা অশ্লীল, তারা গুন্ডামি করে, সবসময় লড়াই শুরু করার জন্য প্রস্তুত থাকে। তিনি তাদের “জালাবিব (jalabibs)” বলে উপহাস করেন, যা মক্কাবাসীদের পরিধেয় একধরনের এলেমেলোভাবে বোনা লম্বা ঢোলাঢালা জামা ছিল। কিন্তু মূলত এটিকে ত্যানা অর্থে ব্যবহার করা হতো। তিনি আরো বলেন, ইয়াছরিবের লোকেরা ত্যনাকে তাদের উপত্যকায় ঢুকতে দিয়ে বোকামি করেছে। এখন এরা তাদের ঘরেই খাচ্ছে; উল্টা তাদের ধাক্কা দিয়ে সব দখলে নিচ্ছে। ইয়াছরিবীদের এই ত্যনাগুলার সাথে মিলে যুদ্ধ করতে ব্যবহার করা হচ্ছিল, এবং যার ফলে তাদের জনসংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে কিন্তু এদিকে আবার আগত ত্যানার সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। আবদুল্লাহ বিন উবাই তার গোত্রবাসীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা নিজেদের উপর এটি এনেছ! তোমরা তাদেরকে তোমাদের দেশে বসতি স্থাপন করতে দিয়েছ, এবং এখন তোমাদের ধনসম্পদই তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হচ্ছে! তোমরা যদি তাদের থেকে দূরে থাকতে তাহলে আল্লাহর কসম, তারা তোমাদের এখান থেকে অন্য দেশে চলে যেত! তিনি শেষে বললেন, ইয়াছরিবে ফিরে গিয়ে এই পরিস্থিতি বদলে দেয়ার এটাই মোক্ষম সময় “যারা শক্তিশালী তারা দুর্বলদের তাড়িয়ে দেবে” (৯)।
খাজরাজ গোত্রের সাথে ছিল জায়েদ বিন আরকাম নামের এক কিশোর, যে একজন মুমিন। সে তাদের কথোপথন শুনেছে, সে দৌড়ে গিয়ে তার চাচাকে এ ব্যাপারে বলতে লাগল। চাচা মুহাম্মদের কাছে গেলেন। মুহাম্মদ ছেলেটিকে তলব করলেন, সরাসরি তার কাছ থেকে শুনতে চাইলেন। প্রথমে মুহাম্মদ তাকে বিশ্বাস করেননি এবং প্রশ্ন করেন যে, সে সঠিক শুনেছে কিনা। কিন্তু ছেলেটি শপথ করে বলে, সে সত্য বলছে এবং আশা করে যে আল্লাহও মুহাম্মদকে অবগত করবেন। সত্যি হলে এটি গুরুতর অভিযোগ ছিল, কারণ আবদুল্লাহ বিন উবাই মূলত মুহাম্মদের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহের আহ্বান জানিয়েছিলেন। উপরন্তু, ছেলেটি যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এটি প্রমাণিত হয় যে, আবদুল্লাহ একজন ভুয়া বিশ্বাসী, তথা মোনাফেক। যেদিন থেকে আব্দুল্লাহকে তার দাড়ি ধরে মসজিদ থেকে টেনে বের করে দেয়া হয়েছে, তারপর থেকেই আবদুল্লাহ সবাইকে তার আন্তরিকতা বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি নামাজ আদায় এবং আচার-অনুষ্ঠানে দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি মুহাম্মদের প্রশংসা করে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন। কিন্তু মক্কাবাসীদের সম্পর্কে তার কুমন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, তার হৃদয়ে ভণ্ডামির “রোগ” ছিল। মুহাম্মদের শীর্ষ ব্যক্তিরা যাদের বেশিরভাগ মক্কা থেকে ছিল, আবদুল্লাহ সম্পর্কে তাদের ধারণা খুব একটা ভালো ছিল না, বিশেষ করে তিনি যখন তাদের "ত্যানা” বলে অপমান করেছিলেন। উমর বরাবরের মতই তার মাথা কেটে ফেলার প্রস্তাব দিলেন। যদি কম প্রভাবশালী কেউ হতো তাহলে মুহাম্মদ হয়তো উমরকে তাই করতে বলতেন, কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উবাই একজন গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী ছিল। তাকে হত্যা করলে বিরোধীপক্ষ বিদ্রোহ করতে পারে, এবং যেহেতু তারা মরুভূমিতে ছিল যেখানে মুহাম্মদ সাহায্যের জন্য অন্য কারো উপর ভরসা করতে পারেননি। উপরন্তু, তারা শত্রু গোত্র দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন যারা অপেক্ষায় ছিল মুহাম্মদের বিরুদ্ধে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। কিছু খাজরাজ ধর্মান্তরিত মুহাম্মদকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানালেন। ছেলেটির হয়তো ভ্রম হয়েছে। তারা বলতে চাচ্ছিলেন, সে ভুল শুনেছে। এবং এমনকি যদি সত্যও হয়, তবুও মুহাম্মদের আবদুল্লাহকে ঘিরে বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত। ইয়াছরিবীরা তাকে শাসক বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, কিন্তু মুহাম্মদ তার নতুন ধর্ম নিয়ে এসে তাকে টপকে উপরে ওঠে গেলেন। তার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।
আবদুল্লাহ শীঘ্রই জানতে পারেন যে, আরকাম ছেলেটি মুহাম্মদকে তাদের কথোপকথনের কথা জানিয়েছে এবং তাকে হত্যা করার কথা আলোচনা হয়েছে। তিনি বুঝতে পারেননি, যে ছেলেটি তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনে এবং আবদুল্লাহর মতই ছেলেটির বাবাও একই গোত্রের সে কিভাবে এরূপ মুহাম্মদের ধর্মের দৃঢ় বিশ্বাসী ও চোগোলখোর হবে! বুঝলে তিনি হয়তো তার কথা নিয়ে আরেকটু সাবধানী হয়েই বলতেন। এই কথা শুনে তড়িঘড়ি করে তিনি মুহাম্মদের তাঁবুর দিকে গেলেন এবং তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন কুয়োর কাছে একটা মারামারি হয়েছিল। মক্কাবাসী অভিবাসীরা এটা শুরু করেছিল, এবং যখন তারা ইয়াছরিবী বিশ্বাসীদের একজনকে ঘুষি মেরেছিল তখন তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন, এবং এর ফলে তিনি কিছু বাজে মন্তব্য করেণ ঠিক কিন্তু ছেলেটি সেসবের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। মুহাম্মদ তাঁর জিহাদি দলকে যুদ্ধচৌকি এবং তাঁবু ভেঙ্গে ইয়াছরিবের দিকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দিলেন এই ভেবে যে, এতে করে তাদের এই ঘটনার উপর থেকে মনোযোগ ভিন্নদিকে ঘুরবে। মানুষ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, এবং তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে কেউ হয়তো আবদুল্লাহকে হত্যা করে ফেলবে এবং তারপর সেখানে আবার তিনি মিত্রতার ঝামেলায় পড়ে যাবেন। চৌকি ও তাঁবু ভাঙা সবসময়ই সময়সাপেক্ষ কাজ ছিল। তাঁবু নামিয়ে মালপত্র উটের উপর তোলা, যুদ্ধলব্ধ মাল উটের উপর ভালো করে বাঁধা এবং এর সাথে খাদ্য ও পানিও সুরক্ষিতভাব রাখতে হবে। পুরুষ বন্দিদের একসাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হবে এবং ধৃত গবাদিপশুগুলোকে একত্রিত করতে হবে। অনুসারীদের চাপের মধ্যে রাখতে মুহাম্মদ দুপুরের নামাজের ঠিক পরেই প্রচন্ড গরমের মধ্যেই রওনা দেয়ার আদেশ দেন। মরুভূমিতে বের হওয়ার জন্য এটা অস্বাভাবিক সময় ছিল এবং এটি দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মদ আবদুল্লাহর পরিস্থিতি নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সারারাত মিছিলের মতো লম্বা সারি মেনে তার পুরো দল যাত্রা করতে থাকে। পরদিন সকাল হতেই ক্লান্ত হয়ে পথিমধ্যে যাত্রাবিরতি নিয়ে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। এই ধরনের শাস্তিমূলক যাত্রায়ও, মুহাম্মদের মনে আবদুল্লাহ বিষয়টি জীবিত ছিল। বন্দিদের এবং বাজেয়াপ্ত গবাদিপশু নিয়ে যখন সেনাদল মুস্তালিক এলাকা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি তার উটের ছন্দময় আওয়াজের সাথে ধ্যানে মগ্ন। আল কাসওয়া (al-Qaswa) নামে একটা সাদা উটের পিঠে চড়ে তিনি তার প্রিয় পাহাড়ে চড়ছিলেন। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তা তার মাথায় আসতে থাকে। কথাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়, আবার তা সাজানোও হচ্ছিল মনে মনে, এবং একপর্যায়ে এগারোটা আয়াতের একটা স্তবকে তা মিশে গেল। এবারের আলোচ্য বিষয় ছিল বিশ্বাসের ভেকধারী মোনাফেকদের নিয়ে, এবং এটির মাধ্যমে আবদুল্লাহর ঘটনাকে আবারও পুনরুদ্ধার বা পুনর্নির্মাণ করা হয়। যদিও তার নাম নেয়া হয়নি, তবে এটা ছিল আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ। আবদুল্লাহ একজন ভেকধারী বিশ্বাসী ছিলেন। আল্লাহর অভিশাপ তার উপরে ছিল!
আরকাম
ছেলেটি মুহাম্মদের পেছনে
যাচ্ছিল। সে মুহাম্মদকে
ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পতিত হতে
দেখেছিল এবং বিস্মিত হয়েছিল
যে, সে
হয়তো বিস্ময়কর মুহুর্তের
সাক্ষী হতে যাচ্ছে যেই মুহূর্তে
আল্লাহ তাঁর রাসুলের সাথে
কথা বলবে। সে শীঘ্রই তা জানতে
পেরেছিল,
কারণ
মুহাম্মদ যখন তার রচনায়
সন্তুষ্ট হলেন তখন ধ্যানমগ্ন
অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে উটের
পিঠ থেকে ঘুরে আরকামকে কাছে
এগিয়ে আসতে বললেন। ছেলেটি
তার পাশের উট থেকে মুহাম্মদের
দিকে ঝুঁকলে মুহাম্মদ তার
কান এত জোরে ধরলেন যে,
সে
তার উটের আসন থেকে প্রায় পড়ে
যাচ্ছিল। মুহাম্মদ তাকে বললেন
“বৎস, তোমার
কান ঠিকই আছে,
আল্লাহ
তোমার দেয়া সংবাদকে নিশ্চিত
করেছেন” (১০)!
তখনো
ছেলেটির কান ধরাই ছিল,
আর
মুহাম্মদ তার চারপাশের
অশ্বারোহীদের দিকে ফিরে খবর
দিলেন যে,
ছেলেটা
আবদুল্লাহ বিন উবাই সম্পর্কে
যা বলেছিল তা সত্য ছিল। আল্লাহ
এইমাত্র এটা নিশ্চিত করেছেন!
যখন
তার উট ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছিল,
মুহাম্মদ
যথেষ্ট জোরে আয়াত পাঠ করলেন,
যাতে
সবাই শুনতে পারে (১১)।
নতুন অধ্যায় রচিত হলো “মোনাফেক” শিরোনামে যা অবশেষে মুহাম্মদের দলে থাকা সকল পদমর্যাদার লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এবং তখন সবাই নিশ্চিতভাবে জানতে পারল যে, আল্লাহই আব্দুল্লাহকে একজন মিথ্যাবাদী হিসেবে বিবেচনা করেন। যদিও আবদুল্লাহর উদ্দেশ্যে রচিত আয়াতগুলোতে ভণ্ডামি সম্পর্কে একটি সাধারণ বিবৃতি প্রদান করাই ছিল মুল উদ্দেশ্য, কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে যে ঘৃণা উস্কে দিয়েছিল তাতেই এটি (সুরা) ইন্ধন জোগাল। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় পরদিন যখন সকালে সেনাদল বিশ্রামের জন্য থামল। মুহাম্মদ একটি গাছের ছায়ায় এক তরুণ কৃষ্ণাঙ্গ দাসের কাছ থেকে পিঠে মালিশ নিচ্ছিলেন, তখন উমর তার কাছে এসে আবার আবদুল্লাহকে হত্যার প্রস্তাব দিলেন। উমর বললেন যে, যদি আল্লাহর রাসুল তাকে এই কাজ করতে দিতে না চান, তাহলে তিনি অবশ্যই মাসলামাকে (Maslama) তাকে হত্যা করতে বলতে পারেন, অথবা আব্বাদ ইবনে কুড়ির (Abbad ibn Bishr) বা অন্য কোন অভিজ্ঞ গুপ্তঘাতককে হত্যা করতে আদেশ দিতে পারেন। কিন্তু মুহাম্মদ তাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, “উমর, যদি লোকে বলতে শুরু করে যে মুহাম্মদ তার অনুসারীকে হত্যা করেছে তাহলে সেটা কেমন হবে” (১২)?
উমরই
এই কাজে একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক
ছিলেন না। আবদুল্লাহ বিন উবাইর
ছেলে আবদুল্লাহ জুনিয়রও
(Abdullah Jr.) তাকে
হত্যার প্রস্তাব দেয়। তার
যুক্তি ছিল জটিল এবং বেশ
বিদঘুটে,
তবে
মুহাম্মদ যে বিদঘুটে পৃথিবীর
জন্ম দিয়েছিলেন,
তার
যুক্তি সেই পৃথিবীতে অবশ্য
মানানসই ছিল। আবদুল্লাহ
জুনিয়র যুক্তি দেখায় যে,
তাঁর
আশঙ্কা হচ্ছে যদি অন্য কেউ
তার বাবাকে হত্যা করে তাহলে
সেই খুনিকে সে হত্যা করতে
বাধ্য হবে,
কিন্তু
সে জানে যে সে অবশ্যই আরেকজন
বিশ্বাসীকে হত্যা করার জন্য
জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
অতএব, নরকে
যাওয়া এড়াতে তাকেই তার
বাবাকে হত্যা করতে হবে। সে
মুহাম্মদকে বলল “যদি আপনি
এটা করতে চান,
তাহলে
আমাকে এটা করতে আদেশ দিন। আমিই
আপনার কাছে তার কাটা মাথা
নিয়ে আসব” (১৩)।
মুহাম্মদ আবারো তাতে না করলেন।
“আসুন আমরা তাকে বিনয় দিয়ে
মোকাবেলা করি এবং যতক্ষণ তিনি
আমাদের সাথে আছেন,
আমরা
তার সঙ্গে থাকি” – মুহাম্মদ
বললেন। হত্যা করার পরিবর্তে
আবদুল্লাহপুত্র তার বাবাকে
অপমান করে ইয়াছরিবে প্রবেশের
উপর বাধা সৃষ্টি করলেন। বাবা
উপত্যকার দিকে এগিয়ে আসার
সময় লম্বা একটি দলের সম্মুখভাগে
ছিলেন। পুত্র তার পিতার পথে
তার উট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল
এবং বলল,
“আল্লাহর
কসম, আল্লাহর
রাসুল আপনাকে অনুমতি না দেয়া
পর্যন্ত আপনি প্রবেশ করবেন
না” (১৪)।
আব্দুল্লাহপুত্র মুহাম্মদের
জন্য অপেক্ষা করতে খাজরাজ
সর্দারকে জোর করতে থাকে,
মুহাম্মদ
পেছনের সারিতে ছিলেন। মাথা
নেড়ে মুহাম্মদ তাঁকে এগিয়ে
যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
ফিরে আসার সময় মুহাম্মদ আরো গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হন যখন আয়েশা একদিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। যখনই তিনি অভিযান যেতেন, তিনি তার সঙ্গে এক বা দুই স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন। স্ত্রীরা উটের উপর পাতা আসনে বসে যাত্রা করত। তাদের ভূমিকা ছিল মুহাম্মদকে যৌনসন্তুষ্ট রাখা এবং খাদ্য প্রস্তুত করা, তাঁবু পরিষ্কার রাখা। কিন্তু যখন তারা ইয়াছরিব থেকে একদিনের দুরত্বে ছিলেন, লম্বা সারির মিছিল যখন বিশ্রামের জন্য থামলো, তিনি বুঝতে পারলেন আয়েশা তার উটের উপর আসনটাতে ছিল না। তাকে কোথাও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। উধাও হয়ে গেছে! সবকিছু স্তম্ভিত হয়ে গেল। মুহাম্মদ ভাবতে লাগলেন, এখন কি করা উচিত। যারা তাকে উটের উপর বসার আসনটাতে তুলেছেন সেই লোকদের তিনি জিজ্ঞাসা করলেন। আয়েশাকে বহনকারী পালকিটি একটি খুঁটির নিচে বাঁধা ছিল, আর চারজন লোক হাঁটু গেড়ে বসে চারকোনা ধরে উটের উপর তুলে দিত। পুরো বাঁধনটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছিল যাতে খুলে না যায়।
তারা ভেবেছিল সে পালকির ভেতরে আছে, কিন্তু এটা যেহেতু পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিল, তাই তাদের নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় ছিল না। তারা ধরেই নিয়েছিল যে, আয়েশা পালকির ভেতরে ছিল। তাছাড়া সে অল্পবয়সী যেহেতু তরুণী ছিল এবং তার ওজনও খুব বেশি ছিল না তাই বোঝার উপায়ও ছিল না। মুহাম্মদ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করতে থাকেন। তিনি বুঝলেন, আয়েশা খুব দৌড়াতে পারে এমনটা নয়। তাছাড়া এই মরুভূমির মাঝখানে কোথায় পালিয়ে যাবে? আর সে পালিয়েই বা যাবে কেন? একমাত্র যে ব্যাখ্যা তার মনের ভেতর তৈরি হলো তা হচ্ছে, আয়েশাকে হয়তো ভুলক্রমে পেছনে ফেলে চলে এসেছেন তাঁরা। আয়েশাকে খুঁজতে লোক পাঠাতে হবে, কিন্তু এটার আর দরকার পড়েনি। যখন তিনি লোকজনকে এই কাজের জন্য নিযুক্ত করতে যাচ্ছিলেন তখন দূরে একটি উট দেখতে পেলেন এবং কাছে আসতেই তারা দেখতে পেলেন যে, উটের উপরে একটি ছোট পর্দা আবৃত একজন বসে আছে এবং পায়ে হেঁটে একলোক দড়িবাঁধা উটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। একলা দলচ্যুত এ দুজনেরই মুহাম্মদের সেনাদলর নিকট পৌঁছতে কিছুটা সময় লেগেছিল, এবং কাছে আসতেই তারা সবাই দেখতে পেল যে, উটের উপর যিনি বসা তিনি আয়েশা আর উটের নেতৃত্বে ছিলেন সাফওয়ান নামের এক যুবক।
বিব্রত আয়েশা মুহাম্মদকে ব্যাখ্যা করেছেন আসলে কি ঘটেছে। তিনি বললেন, আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে পেছনে ফেলে রেখে এসেছে সবাই। মুহাম্মদ সূর্য ডুবে যাওয়ার পরই রওনা দেয়ার আদেশ দিয়েছিলেন এবং যাত্রা শুরু হওয়ার আগে তিনি (আয়েশা) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পার্শ্ববর্তী মরুভূমিতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তার মায়ের দেয়া বিয়ের উপহার মূল্যবান জাফর হারটি তার ঘাড় থেকে পড়ে গেছে। সেটিকে খুঁজতে আবার সেখানে ফিরে গেলেন। ততক্ষণে সেনাদল তাকে রেখে চলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আয়েশা যেটি করেছেন, নিজেকে ঢেকেঢুকে বসে ছিলেন এবং আশা এবং প্রার্থনায় ছিলেন যে, শীঘ্রই ফাঁকা কোন পালকি হয়তো তিনি পাবেন যা তাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। একপর্যায়ে দক্ষিণ বেদুইন আদিবাসীদের থেকে আগত তরুণ ধর্মান্তরিত সাফওয়ান, যে নিজেও মুস্তালিক অঞ্চল থেকে ছেড়ে সেনাদলর চলে যাওয়ায় পেছনে পড়ে গিয়েছিল সেও উটের পিঠে করে সেদিকেই আসছিল। যখন আয়েশা তাকে দেখতে পেলেন তার মুখ ঢেকে রেখেছিলেন, কারণ ততদিনে মুহাম্মদ পুরো মুখে পর্দা রাখার আদেশ দিয়েছেন।
সাফওয়ান
আস্তে আস্তে উটকে হাঁটু গেড়ে
বসাল, তাকে
উটের উপরের আসনে উঠে বসতে
সাহায্য করল এবং কোনো বাক্যবিনিময়
ছাড়াই উটটিকে সেনাদলের চলার
পথের দিকে নিয়ে গেল। কিন্তু
পরদিন সকালে তারা আবার সবকিছুতে
গতি ফিরে পেল। সেই সন্ধ্যায়
যখন সেনাদল আবার মুহাম্মদের
নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করল
তখন আয়েশা তার পালকিতে চড়লেন
এবং একদিন পর তারা ইয়াছরিবে
ফিরে এলেন। আয়েশা এই বিষয়টি
নিয়ে আর চিন্তা করেননি যতক্ষণ
না তার এক খালা কয়েক সপ্তাহ
পরে এসে তাকে জানালেন যে,
চারিপাশে
গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে,
সাফওয়ানের
সাথে আয়েশা ঘুরে বেড়িয়েছে।
তিনি সেই মুহূর্তের আগে পর্যন্ত
এই গুজব সম্পর্কে কিছুই জানতেন
না। ইয়াছরিবে ফিরে আসার পরই
আয়েশা অসুস্থ হয়ে পড়েন
এবং তার কামরায় আবদ্ধ হয়ে
ছিলেন,
কিন্তু
তারপর তাঁর বাবার বাড়িতে
চলে আসেন যাতে তার মা তার
পরিচর্যা করতে পারে। ব্যাপারটা
তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে যে,
মানুষ
তার সাথে অদ্ভুত আচরণ করছিল,
এমনকি
মুহাম্মদও। অতীতে তিনি যখন
অসুস্থ হতেন মুহাম্মদ তাকে
সান্ত্বনা দিতেন,
দেখভালো
করতেন,
কিন্তু
এখন তিনি শুধু দরজায় মাথা
ঢুকিয়ে তার পরিচর্চাকারীকে
জিজ্ঞেস করেন “সে কেমন আছে?”
এইবার
যখন আয়েশা মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস
করেন যে,
তিনি
এই অসুস্থ অবস্থায় তার
বাবা-মায়ের
কাছে যেতে পারবেন কিনা তখন
মুহাম্মদের উত্তর ছিল “তুমি
যা চাও তাই করো”।
এমনকি
তার বাবা-মাও
তার সামনে অস্বাভাবিকভাবে
চুপচাপ ছিল এবং তার দিকে দুঃখের
চোখে তাকিয়ে থাকত,
যেন
সে মৃত্যুশয্যায় ছিল। একদিন
প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে
তিনি তার একজন খালার সাথে
বাইরে গেলেন। সেই সময়ের
নারীরা দলবেঁধে এভাবেই প্রাকৃতিক
কাজ সারতে যেতেন। মূলত তারা
ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে
বা আঁকাবাঁকা গিরিপথের মাঝে
বয়ে চলা কোন খাঁড়িতে গিয়ে
মলত্যাগ করতেন। ফেরার পথে
তার খালা হোঁচট খেয়ে প্রায়
মাটিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম
হলেন। খালা এর জন্য মিসতাহ
নামের তার ছেলেকে অভিশাপ দেয়া
শুরু করলেন। মিসতাহ একজন
গুরুত্বপূর্ণ বদরী (যারা
বদর যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের
বদরী সাহাবি বলা হয়)
বদরী
হওয়ার কারণে সাহাবিদের মধ্যে
বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
আয়েশা জিজ্ঞেস করলেন তিনি
কেন মিসতাহকে ব্যক্তিকে অভিশাপ
দিচ্ছেন। খালা বললেন,
“বোকা
মেয়ে,
তুমি
কি শুনতে পাওনি সে কি বলেছে?”
(১৫)।
তখনই সবকিছু বেরিয়ে এলো - মিসতাহ এবং অন্যরা অভিযোগ করছিল যে, আয়েশা সাফওয়ানের সাথে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল, যা হারাম (নিষিদ্ধ) কাজ এবং আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। এমন অপরাধের শাস্তি হচ্ছে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা। নিকট অতীতে পর্দাপ্রথা আরোপের আগে, এমনকি তারপরেও নাকি আয়েশা এবং সাফওয়ানকে একসাথে কথা বলতে দেখা গেছে। তাহলে আয়েশা পুরো রাতভর নিখোঁজ, এবং পরদিন সকালে সাফওয়ানের সাথে লোকের মাঝে হাজির, এটা দিয়ে তবে লোকে কি ধারণা করবে? সম্ভবত সবাই যাতে আবদুল্লাহ বিন উবাইর উপর থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেয় সেই আশায় উবাই ইয়াছরিবে ফিরে আসার আগেই এই গুজব শুরু করেছিলেন। কিন্তু এখন অন্যরাও এই গুজব ছড়াচ্ছে, বিশেষ করে মিসতাহ, যিনি নিজেই অলস এবং বেঁচে থাকার জন্য আবু বকরের উপর নির্ভর করত। এই গুজব ছড়িয়ে দিতে মুহাম্মদের পঞ্চম স্ত্রী ও জয়নাবের বোন হামনার ( Hamna) হাতও ছিল। মুহাম্মদের নিয়োজিত কবি হাসান থাবিট (Hassan Thabit) সাফওয়ান সম্পর্কে কিছু উস্কানিমুলক পংক্তি রচনা করে পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তুলেছিল।
তার সমন্ধে সবাই কি বলছে তা জানার পর আয়েশা এত কান্নাকাটি করেন যে, যেন “আমার কলিজা এখনই ফেটে যাবে!”- পরে তিনি এভাবেই ঘটনা সম্পর্কে বলেছিলেন। নিজেকে রক্ষা করতে আয়েশা আর কিইবা বা করতে পারে যখন সবার আচরণ এতটা জঘন্য, আর ওরা এত বাজে গুজব ছড়াচ্ছে তার নামে? এমনকি আয়েশা পরিস্থিতি বোঝার আগেই তাকে তালাকের সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য মুহাম্মদ গোপনে তদন্ত শুরু করেন। তিনি আলী এবং জায়েদের ছোট ছেলে ওসামাকে ডেকে আয়েশা সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাইলেন। আলী আয়েশাকে একটি উটের নিচে (আঁস্তাকুড়ে) নিক্ষেপ করার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন : “মেয়েলোক অনেক পাওয়া যায় এবং আপনি সহজেই একটা স্ত্রীকে বদলে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন”। অবশ্য আলী আয়েশার ব্যাপারে মানহানিকর কিছু বলতে পারল না (১৬, ১৭)। ওসামা আয়েশার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। মুহাম্মদ বিভিন্ন মানুষকে ডাকলেন তাদের মতামত চাওয়ার জন্য। এদের মধ্যে একজন ছিলেন বারীরা নামে এক ক্রীতদাসী, যিনি আয়েশার সাথে ছিলেন। যখন তাকে মুহাম্মদের সামনে আনা হলো, আলী তাকে মারধর করে বলেন “আল্লাহর রাসুলের কাছে সত্য কথা বল”। নিজেকে আলীর কাছ থেকে আলগা করে নিয়ে সে বলল, “আমি আয়েশার মাঝে কোন দোষ খুঁজে পাইনি, শুধুমাত্র আমি ময়দা মলার সময় যদি তাকে তা দেখতে বলতাম, এসে দেখতাম সে ঘুমিয়ে গেছে। যার ফলে মাঝে মাঝে পোষা ভেড়া এসে তা খেয়ে ফেলত” (১৮)।
সত্য যাই হোক না কেন, তার সম্পর্কে যে বিদ্বেষপূর্ণ গুজব ছড়িয়ে পড়েছে তা মুহাম্মদকে দুর্বল এবং অসহায় করে তুলেছে। ভাবা যায়, আল্লাহর রাসুলের তেরো বছরের স্ত্রীর অন্য কারো সাথে পরকিয়া করছে?! যেভাবেই হোক এ ঘটনার ইতি টানতে হবে। মুহাম্মদ এখন যতদূর বলতে পারেন, আবদুল্লাহ বিন উবাই সেই ব্যক্তি যিনি পরচর্চা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তিনি এই ক্ষেত্রে তেমনই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে থাকলেন, মরুভুমির যাত্রাপথে উবাইয়ের উভ্যুত্থানের চেষ্টার খবর জেনে ঠিক যেমনটা ছিলেন তিনি। যদিও বিন উবাইয়ের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল কিন্তু তবুও তার খানিকটা প্রভাব ছিল তখনো; এবং তাকে নির্মূল করার পরিণাম হয়তো খারাপই হবে। সুতরাং এমন ঝুঁকি নেয়াটা কি ঠিক হবে? পানি কোন দিকে গড়ায় তা পরীক্ষা করতে মুহাম্মদ এবার ভরা মজলিশে বিন উবাইয়ের বিষয়টি তোলেন।
যদি আবদুল্লাহ বিন উবাইকে হত্যা করার প্রতি ব্যাপক সমর্থন থাকে, অথবা যদি এ কারণে তীব্র বাধার সম্মুখীন হতে তাহলে শাহাদাকে (আব্দুল্লাহকে, বা তাঁর ইসলাম গ্রহণের ভনিতাকে) অভিশপ্ত করা হবে। আর তখন হয়ে যাবেন কেবল ইতিহাস (নিহত হলেই)। মজলিস শুরুর সাথেই মুহাম্মদ আয়েশাকে সমর্থন করে বক্তৃতা শুরু করেন যে, তিনি তার মধ্যে খারাপ কিছুই পাননি। এমনকি সাফওয়ানের প্রতি তার সমর্থনমূলক কথাও ছিল যে, তিনি তাকে “একজন পুরোদস্তর ধার্মিক” বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর সমালোচকদের থেকে মুক্তি পেতে তিনি একজন স্বেচ্ছাসেবককে আহ্বান জানান, ঠিক যেমনটা তিনি বদরের পরে করেছিলেন, যারা তাকে তাদের কবিতা দিয়ে উপহাস করেছিল। তিনি বললেন : “কে আমাকে সেই লোকের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেবে, যে লোক আমার পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেছে”(১৯)? মুহাম্মদ আবদুল্লাহর নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু সবাই বুঝতে পেরেছিল যে, তিনি খাজরাজ প্রধানের দিকে ইঙ্গিত করছেন। ইতিবাচক সাড়া পাওয়া শুরু করলেন মুহাম্মদ। আউস গোত্রের অন্যতম প্রধান নেতা সাদ বিন মুয়ায দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন যে, অপরাধী যেই গোত্রের হোক না কেন তিনি তার মাথা কেটে ফেলাকে সমর্থন করবেন – চাই সে আউস বা খাজরাজ যে গোত্রেরই হোক। সাদ কার্যত বললেন, “আপনি কেবল আদেশ করুন, আমরা তা মেনে চলবো।” কিন্তু তারপর তা দক্ষিণে যেতে শুরু করল। সাদ বিন উবাদা (Sad Ubada) নামের একজন গুরুত্বপূর্ণ খাজরাজ নেতা এবং আবদুল্লাহর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও মিত্র এবার লাফ দিয়ে উঠলেন। তিনি চেঁচিয়ে বললেন যে, আউস গোত্রকে কখনোই খাজরাজের কাউকে হত্যা করতে দেয়া হবে না। খাজরাজীরাই তাকে রক্ষা করবে। এরপর তিনি সাদ বিন মুয়াযের দিকে ঘুষি দেখিয়ে বলল, “খোদার কসম, আপনি এই কথাগুলো বলতে পারছেন কারণ আপনি জানেন যে সে খাজরাজ থেকে এসেছে। তিনি যদি আউস গোত্র থেকে আসত তাহলে আপনি এভাবে কথা বলতেন না”(২০)। তারপর সাদ বিন মুয়াযের প্রথম চাচাতো ভাই আউস গোত্রের সাদও যোগ দেয় এবং বলে যে, তারাও সত্যি সত্যি তাকে হত্যা করার আদেশ পালন করবে। সে সাদ বিন উবাদাকে লক্ষ করে বলে, “তুমি একজন মোনাফেক, আর তাই তুমি মোনাফেকদের পক্ষে তর্ক করছো” (২১)।
তারা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে গেলেন, নিজেদের মধ্যে কলহ বাঁধালেন। নামাজের জায়গা ছেড়ে সবাই উঠানে গেলেন এবং পরিস্থিতি ভয়ানক দিকে মোড় নিচ্ছিল, ঠিক মুহাম্মদ যেমনটা আশংকা করেছিলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যদি তাদের সাথে তলোয়ার থাকত - মসজিদে অস্ত্র নিয়ে ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল - তবে তারা তক্ষুনি একে অন্যকে শেষ করে দিত, এবং মাটি রক্তে লাল হয়ে যেত। মুহাম্মদ মজলিশ থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে থামানোর জন্য চিৎকার করলেন, (সাহাবিরা থামছেই না) কিন্তু অবশেষে তাকেই লড়াইয়ের মধ্যখানে নেমে আসতে হল লড়াই থামানোর জন্য।
বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত সমাধান প্রয়োজন এবং যত তাড়াতাড়ি হবে ততই ভালো হয়। ততদিনে অবশ্য আয়েশা তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে সরাসরি বয়ান কক্ষের পেছনের কক্ষ যেটা (মুহাম্মদ কর্তৃক তাঁর জন্য নির্ধারিত ঘর) এসে বাস করতে থাকেন। আয়েশা ছিলেন এই ঝড়ের মূল কারণ, যা এইমাত্র নামাজের জায়গা ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছিল, এবং আয়েশাও নিশ্চয়ই প্রতিটি শব্দ শুনেছেন! জামাত ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর মুহাম্মদ মসজিদের পর্দা ঠেলে ভেতরের ঘরে ঢুকলেন। আয়েশা এবং তার এক বান্ধবী কাঁদছিলেন। মুহাম্মদ সেখানে বসলেন, আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন “আয়েশা, তুমি জানো মানুষ কি বলাবলি করছে। যদি তুমি সত্যিই কোন পাপ করে থাকো তাহলে আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহর কাছে তওবা কর। আল্লাহ তার বান্দাদের তওবা কবুল করেন” (২২)। মুহাম্মদের নিজের মনেও কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। যদি সে দোষ স্বীকার করে, তাহলে তাকে ঈশ্বর ক্ষমা করবেন, কিন্তু তাকে পার্থিব শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী ব্যভিচারীদের (বিবাহিত হলে) পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে হয়।
মুহাম্মদ বেশ কয়েক বছর আগেই তাঁর অনুসারীদের মধ্যে নজির স্থাপন করেছিলেন, যখন ব্যভিচারে লিপ্ত দুই ইহুদিকে তার সামনে আনা হয়েছিল। বদরের আগে এই ঘটনা ঘটেছিল, এবং তখনও তার সাথে ইহুদিরা কথা বলত। সম্ভবত অপরাধীরা একটি সাধারণ গোত্রের ছিল যার উপর মুহাম্মদের এখতিয়ার ছিল, অন্যথায় তাদের বিচার ইহুদি আদালতেই করা হতো (২৩)। মুহাম্মদ ইহুদি রাব্বিদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিভাবে তারা এই ধরনের পরিস্থিতির (ব্যভিচার সংক্রান্ত) মোকাবেলা করে? তারা ব্যাখ্যা করে যে, নবীদের দিনগুলোতে ব্যভিচারীদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হতো, কিন্তু তারপর দেখা গেল এক রাজার কন্যা ব্যভিচারে লিপ্ত হল। রাজা কন্যাকে পাথর মারতে পারলেন না, ফলে শাস্তি কমিয়ে দোষীদের চাবুক মারা হয়েছিল এবং চুড়ান্ত অপমানের জন্য তাদের মুখ ছাই দিয়ে কালো করে দেয়া হয়েছিল, এবং তাদের একটি গাধার পিঠে চড়িয়ে শহর জুড়ে হাঁটানো হয়েছিল। রাব্বিরা মুহাম্মদকে বলেন, এটিই পুরুষ ও নারীর শাস্তি হওয়া উচিত। মুহাম্মদ তাদের শাস্ত্র দেখতে চাইলেন। তারা তাদের তওরাত তার কাছে নিয়ে এলো এবং সেখান থেকে তাদের একজনকে তা পড়তে বাধ্য করলেন। যখন তিনি পড়ছিলেন, রাব্বি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদের উপর হাত রাখলেন এবং এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সেখানে আরেকজন ইহুদি পন্ডিত যে দলত্যাগ করে মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করেছিল সে সেই অধ্যায়টি রাব্বিকে জোরে জোরে পড়তে বাধ্য করল যেখানে নবীদের দ্বারা আরোপিত শাস্তি সম্পর্কে বলা আছে। শাস্তি ছিল পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা, আর তাই মুহাম্মদ ঐ দুজন ইহুদি ব্যভিচারীদের ব্যাপারে একই আদেশ দিলেন। অপরাধীদের মসজিদের প্রধান ফটকের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মারা না যাওয়া পর্যন্ত একদল লোক তাদের উপর পাথর ছুঁড়তে থাকে। সুতরাং একই শাস্তি আয়েশার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে (ব্যভিচার প্রমানিত হলে)। মুহাম্মদ কয়েক সপ্তাহ ধরে আয়েশার বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন।
হাতাহাতির কারণে নামাজের জায়গাটি তছনছ হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ সামান্য মাথা ঘোরা এবং উদ্বেগ অনুভব করতে শুরু করলেন যা খিঁচুনির সাধারণত আগে হয়ে থাকে, সেই সাথে তার মাথায় চাপও বাড়তে থাকে। তিনি আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তার চোখ লাল হয়ে গেছে। মুহাম্মদের চোখ ছলছল করছে এটা ভেবে যে, তার এই সুন্দর তরুণী বধুর চেহারা শেষপর্যন্ত পাথরের আঘাতে থেতলে যাবে, ঠিক যেমনট হয়েছিল ইহুদি অপরাধীদের মুখগুলো। এটি ভাবতেই তার মাথা ঘোরা এবং উদ্বেগ আরো বেড়ে যাচ্ছিল। আয়েশা তেরো বছর ধরে তার জীবনে আছে। তিনিই প্রথম আয়েশার জন্মের পর তার বাবা-মাকে অভিনন্দন জানান এবং তিনিই প্রথম শিশুটিকে কোলে তুলে নেন। তার সাথে অনেক মূল্যবান স্মৃতি আছে, যেমন তিনি তার সাথে মসজিদের উঠোনে দৌড়াদৌড়ি করতেন, এবং সবার বিনোদনের জন্য তাকে জিতিয়ে দেয়া হতো। সে খুব খেলাপ্রিয় ছিল, যেমন মুহাম্মদ যখন মাঝরাতে বিছানায় বসে অতিরিক্ত নামাজ পড়তেন। আয়েশা তখন আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকতেন। মুহাম্মদ একবার তাকে নামাজ চলাকালীন ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন যাতে তিনি বুঝতে পারেন যে, নামাজের সময় এভাবে পা ছড়িয়ে দিয়ে নামাজে ব্যঘাত ঘটানো উচিত না। তিনি শেষপর্যন্ত তার (মুহাম্মদের শিশু-স্ত্রী) কাছে এটি একটি খেলা ছিল। তারপর থেকে আয়েশা দেয়ালের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে চিবুকে হাঁটু টেনে বসে থাকত, খিলখিল করে হাসতে থাকত, মুহাম্মদ যখন সেজদায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতেন তখনই সে তার হাঁটু প্রসারিত করে দিত, সেজদা শেষ হলেই হাঁটু টেনে তার চিবুক পর্যন্ত ধরে রাখত, আবার যখন সেজদা থেকে ওঠে দ্বিতীয় সেজদা দিতে মুহাম্মদ প্রস্তুত হতেন তখনই সে তার পা আবার প্রসারিত করে দিত। তার সাথে বিছানায় থাকাকালীন কোরআনের অনেক আয়াত মুহাম্মদের কাছে এসেছিল। কি সংখ্যক রচিত হয়েছিল সেই সংখ্যাটা বলতে হয়ত তার কষ্ট হবে, কিন্তু সেটা তার অনন্য স্ত্রীদের সাথে থাকার সময়ের চেয়ে পরিমাণে বেশি ছিল।
খিঁচুনি শুরু হওয়ার লক্ষণগুলো ক্রমশ বাড়তে থাকে যখন মুহাম্মদ আয়েশার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মনে হচ্ছিল আয়েশা তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার মাথায় চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আয়েশা সেখানে উপস্থিত তার পিতামাতার কাছে তার আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার আহ্বান করলেন, কিন্তু তার মা বলেন, “আল্লাহর কসম, আমরা জানি না তাঁকে (মুহাম্মদকে) কি জবাব দিতে হবে”। অবশেষে আয়েশা বললেন, “আপনি যেইজন্য আমাকে আল্লাহর কাছে তওবা করতে বলেছেন, আমি সেইজন্য তওবা করবো না। আমি শপথ করে বলছি, আমি ভালো করেই জানি যে, লোকে যা বলছে তা যদি আমি নিশ্চিত করি যেখানে আল্লাহ জানে আমি নির্দোষ, তার মানে যা ঘটেনি তা আমি নিশ্চিত করলাম। আর যদি তারা যা বলছে তা আমি অস্বীকার করি, তাহলে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না” (২৪)।
মুহাম্মদ
সুবিধামতো খিঁচুনির ভান করতে
পারতেন যেমনটা করেছিলেন তিনি
আয়েশার সাথে,
তারই
ঘরে, কয়েকমাস
আগে একই বিছানায় তার পালকপুত্রের
প্রাক্তন স্ত্রী জয়নাবকে
বিয়ে করার অনুমতির কথা আল্লাহর
তরফ থেকে পেয়েছেন বলেছিলেন।
কিন্তু এবারেরটা ভনিতা ছিল
না। এর আগের অস্বস্তি এবং
মাথার ভিতর যে চাপ অনুভূতিতে
অগ্রসর হয়েছিল তা প্রচন্ড
ভয় শেষে তাকে এক ধরনের চরম খানুভূতি এনে দিল,
তিনি
ভেবেছিলেন যেন তিনি ঐশ্বরিক
সংস্পর্শে ছিলেন।
তারপর তার শরীরের কম্পন শুরু হলো, যেটা আসলে সেই আগের মতোই তার মস্তিষ্কের টেম্পরাল লোব হতেই উদ্ভুত। আবু বকর ও তার স্ত্রী আয়েশা এই উপসর্গগুলো জানতেন। তাদের কাছে এটির ব্যাখ্যা ছিল। আবার মুহাম্মদের সাথে আল্লাহ তার যোগাযোগ স্থাপন করছেন। তারা সেখানে একটি মহান ঘটনার সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য সৌভাগ্যবান মনে করে রোমাঞ্চিত হলেন। আয়েশা কখনও নিজেকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেননি যে, আল্লাহ তার সম্পর্কে কথা বলবেন। কিন্তু এটা পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ, ঠিক যেমন মক্কা থেকে পালানোর সময় আল্লাহ আবু বকরকে মুহাম্মদের সফরের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। এই সম্মান আবু বকরকে এতটাই বিগলিত করেছিল যে, তিনি এটা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
এখন
আল্লাহ তার সম্পর্কে তার
রাসুলের সাথে কথা বলছে!
ছোট
আয়েশা আল্লাহর উপর ভরসা
করলেন। এখন তার রায় ছাড়া
আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মুহাম্মদ
আয়েশার বিছানায় প্রসারিত
হয়ে শুলেন। তারা তার মাথার
নিচে একটা চামড়ার বালিশ দিলেন
এবং তাকে তার পোশাক দিয়ে ঢেকে
দিলেন। ইসলামিক ইতিহাস গ্রন্থের
কোথাও উল্লেখ নেই তার এই অবস্থা
কতক্ষণ স্থায়ী ছিল,
কিন্তু
যখন তিনি তা থেকে মুক্তি পেলেন
তিনি এরপর ওঠে বসলেন। কপাল
থেকে ঘাম মুছতে মুছতে হেসে
বললেন,
“আনন্দ
করো, আয়েশা!
আল্লাহ
তোমাকে নির্দোষ প্রমাণিত
করেছেন”(২৫)।
তিনি তার কাছে আসা আয়াতের
পুনরাবৃত্তি করলেন,
খুব
সম্ভবত তার মাথায় দিনের পর
দিন এই কথামালা ঘুরপাক খাচ্ছিল।
তিনি আয়েশার বিরুদ্ধে গুজব
ছড়ানোর জন্য আরেক আয়াত দিয়ে
নিন্দা জানিয়েছিলেন,
এবং
এর সাথে আরো সাধারণ কিছু আয়াত
যুক্ত ছিল,
যাতে
গুজব ছড়ানোকে নিষিদ্ধ করা
হয়েছে এবং মিথ্যা সাক্ষ্যকে
পাপ বলে একটি কঠোর শাস্তির
আওতায় আনা হয়েছিল যা ছিল
আশিটি বেত্রাঘাত। তিনি ওঠে
দাঁড়িয়ে বিশ্বাসীদের একটি
সমাবেশের আহ্বান জানালেন এবং
সমাবেশ থেকে তার রচিত আল্লাহর
বাণী পাঠ করলেন। তার ঐশ্বরিক
এই বাণী যেন জিহ্বায় চাবুক
মেরে দিচ্ছে :
لَوْ
لَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ
وَالْمُؤْمِنَتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْرًا
لى و قَالُوا هَذَا إِفْرٌ مُّبِينٌ (۱۲)
আউস এবং খাজরাজের মধ্যে পরিস্থিতি ঠিক করার জন্য মুহাম্মদ ব্যক্তিগত উদ্যেগে আন্তঃগোত্রীয় নৈশভোজের আয়োজন করেন। প্রথমবারের এই ধরনের আয়োজনে মুহাম্মদ আউস নেতা সাদ বিন মুয়াদকে হাতে ধরে সাদ বিন উবাদার বাসভবনে নিয়ে যান, যিনি একদল খাজরাজীর সাথে বসে ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই উবাদা খাবার এনে হাজির করলেন। এবং উভয়পক্ষই মাংসের বাটিতে হাত রেখে অন্যের সাথে শান্তির সমঝোতা করল। কয়েকদিন পরে মুহাম্মদ সাদ বিন উবাদাকেও হাত ধরে সাদ বিন মুয়াযের গোত্র-প্রাঙ্গণে নিয়ে গেলেন, যেখানে তিনিও তার একদল লোকের সাথে বসে ছিলেন। আবার সেখানে খাবার পরিবেশন করা হলো।
বিষয়টি সমাধানের জন্য মুহাম্মদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইতোমধ্যে ঘটা একটি ঘটনা আরেকটি নয়া জটিলতার দিকে মোড় নেয়া শুরু করেছে। সাফওয়ান হাসসানকে (হাসসান মুহাম্মদের সভাকবি ছিলেন) হত্যা করার চেষ্টা করে। হাসসানের রচিত কবিতাগুলোর মধ্যে সাফওয়ানকে নিয়ে উপহাস রয়েছে। শুধুমাত্র চাবুক মেরেই হাসসানকে মুক্তি দেয়ায় তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। সাফওয়ান বরাবরই আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছেন যে, তিনি কেবল দিনের আলোতে শুধুমাত্র আয়েশার সাথে উটে চড়ে এসেছেন যেটি পুরো সেনাদল এবং মুহাম্মদ দেখেছেন, সুতরাং তাদের মধ্যে কিছুই ঘটেনি। যদি তারা সত্যিই অভিযুক্ত হত, তাহলে কি তারা এ ব্যাপারে এত স্বচ্ছ থাকত? কিন্তু তার এই আত্মপক্ষ সমর্থন হাসসানকে মুগ্ধ করেনি, তাই তার সম্পর্কে কবিতা লেখে এবং গুজবে কান দেয়। সাফওয়ান তাকে একটি খাজরাজী সভায় খুঁজে বের করে, এবং লোকজন নিরস্ত্র করার আগেই হাসসানের দিকে তলোয়ার দিয়ে একটি কোপ বসিয়ে দেয়। সাফওয়ান চেঁচিয়ে হাসানের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় বলেছিল, “এই যে তোমার জন্য আমার তলোয়ারের ধার! যখন তুমি আমার মতো একজন মানুষকে ব্যঙ্গ কর তখন প্রত্যুতরে কোন কবিতা তুমি পাবে না (২৭)! হাসসান গুরুতর আহত হন। যখন মুহাম্মদ এটা জানতে পেরেছিলেন তিনি সাফওয়ান এবং হাসসান উভয়কেই মসজিদে নিয়ে আসেন। উভয় পক্ষের কথা শোনার পর তিনি রায় দিলেন, “সাফওয়ানকে বন্দি কর, এবং যদি হাসসান মারা যায় তাহলে তাকেও মেরে ফেল” (২৮)।
খাজরাজীরা আয়েশার ঘটনায় যথেষ্ট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে এবং হাসসানের উপর চাপ সৃষ্টি করে সাফওয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ প্রত্যাহার করে নিতে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে। মুহাম্মদও তাতে রাজি হলেন, হাসসানকে বললেন, “নিজের আঘাতের ব্যাপারে যত্ন নিও” (২৯)। আরেকটু মিষ্টি ঢালতে তিনি তার ভাড়াটে কবির জন্য একটি দুর্গ এবং একটি বাগান গিফট করলেন, যা ইহুদি বানু নাযীর গোত্রের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। প্রথমে এই জায়গাটা অন্য একজনকে গনিমতের মাল হিসেবে পুরস্কৃত প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু সে তা মুহাম্মদের হাতেই ফেরত দিয়েছিল যাতে তিনি এটিকে দাতব্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
অনেক
দশক পরে,
অবশেষে
আয়েশা তার সম্বন্ধে চুড়ান্ত
রায়টি পেতে সক্ষম হন :
“ইবনুল
মুয়াত্তাল (সাফওয়ান)
সম্পর্কে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং জানা
যায় যে সে নপুংশক ছিল,
সে
নারীদের সংস্পর্শে আসত না।
এরপর সে শহীদ হয়। তার উপর
আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বর্ষিত
হোক” (৩০)।