মুহাম্মদ যখন মক্কাবাসী কাফেলা আক্রমণ করতে চলে গেলেন তখন ইহুদি ও ইয়াছরিবের বহুঈশ্বরবাদীরা (তাঁরা তখনও ধর্মান্তরিত হননি) ভীত হয়ে পড়লেন। যখন তিনি মক্কান সেনাদলের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ফিরে এলেন তখন তাঁরা আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়লেন। উকবাহ ইবনে মুয়াইতের শিরশ্ছেদের দিন মুহাম্মদ তাঁর বিজয় ঘোষণা করার জন্য ইয়াছরিবে দুজন বার্তাবাহী পাঠান। সকালের গরমের মধ্যেই মুহাম্মদের ব্যক্তিগত উটের উপর চড়ে জায়েদ বিন হারিছা ইয়াছরিবের নিম্নভূমিতে সংবাদ (বিজয়ের) ছড়িয়ে দিলেন, অন্যদিকে আবদুল্লাহ বিন রাওয়াহা যিনি সকল যুদ্ধবন্দিদের বেঁধে জঙ্গলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য মুহাম্মদকে অনুরোধ করেছিলেন তিনি ইয়াছরিবের উচ্চভূমিতে সংবাদটি নিয়ে আসেন। মসজিদের উঠোনে গিয়ে উটের পিঠ থেকেই জায়েদ বিজয়ের ঘোষণা দিলেন, “সাহায্যকারীরা (আনসার) আনন্দ করুন, আল্লাহর রাসুল ভালো আছেন এবং তিনি মুশরিকদের বন্দি এবং হত্যা করেছেন”। যখন তিনি মৃত মক্কাবাসীদের নাম একে একে বলতে শুরু করলেন, তখন বিশ্বাসীরা আল্লাহু আকবর বলে আনন্দাশ্রু বর্ষণ করল! শিশুরা রাস্তা এবং অলিগলি দিয়ে দৌড়াচ্ছিল আর চিৎকার করে বলছিল, “শয়তান আবু জাহেল মারা গেছে!” (১)। এভাবেই তাঁরা আবুল হাকামকে মুহাম্মদের দেয়া ডাকনামটি বারবার উল্লেখ করছিল। ইহুদি ও পৌত্তলিক আরবরা এই কথা শুনে এতই অবাক হন যে, তাঁরা প্রথমে তা বিশ্বাস করতেই অস্বীকৃতি জানান। তারা ভেবে নেন যে, জায়েদ যেহেতু মুহাম্মদের উটে চড়ে এসেছেন তাঁর মানে এটিই প্রমাণ যে, মুহাম্মদকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছে। এটা এক ধরণের কৌশল হবে হয়তো। একজন বহুশ্বরবাদী জায়েদের নয় বছরের ছেলে ওসামার দিকে লক্ষ করে বললেন, “তোমার মনিবকে হত্যা করা হয়েছে, এবং তাঁর সাথে যারা আছে তাদেরকেও”! ছেলেটি দৌড়ে তাঁর বাবার কাছে গিয়ে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করল। জায়েদ তাঁকে বললেন, এটা মিথ্যা কথা। মুহাম্মদ সত্যিই বিজয়ী হয়েছেন এবং তাঁর সৈন্যদল এবং তাদের বন্দিদের নিয়ে আগামী এক বা দু'দিনের মধ্যেই তিনি ইয়াছরিবে পৌঁছবেন। ছেলেটি দৌড়ে বহুশ্বরবাদী লোকটির কাছে ফিরে গিয়ে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ করে বললো, “আমরা আপনাকে আল্লাহর রাসুলের সামনে আনবো, আর তিনি আপনাকে মেরে ফেলবেন!” (২) মুহাম্মদের মৃত্যুর গুজব সত্যি বলেই মনে হচ্ছিল এবং তা নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে গিয়েছিল। শেষমেশ একজন ক্ষুব্ধ অনুসারী রাস্তায় নেমে এসে অবিশ্বাসীদের এবং যারা গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণের হুমকি দিয়ে তবেই তাদের থামাতে
সক্ষম হন।
মুহাম্মদ পরেরদিন সকালে এসে পৌঁছেন। তাঁর বিজয়ী যোদ্ধাদল এবং তাদের হতভাগা বন্দিরা একদিন পরে আসে। যখন তিনি নাজ্জার এলাকা প্রবেশ করলেন তখন সেই সে লিকলিকে শরীরের ওসামাকেও উটের পিঠে তুলে তাঁর সাথে বাকি পথ নিয়ে আসেন। যখন তিনি তাঁর মসজিদে পদার্পণ করলেন তখন তাঁর থেকে দূরত্ব বজায় রাখা শক্তিশালী গোত্রের নেতারাও তাঁকে এই যুদ্ধে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে চলে এসেছিলেন। মুহাম্মদ তাঁর সাথে সুহায়েল বিন আমর নামের একজন বন্দিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁর স্ত্রী সাওদার ঘরটিকে তাঁর জন্য জিন্দানখানা হিসেবে তৈরি করলেন। মক্কাবাসী এই গুরুত্বপূর্ণ নেতা সুহায়েল ছিলেন সাওদার সাবেক দেবর; এবং তিনিই সেই ব্যক্তি যার কাছে মুহাম্মদ প্রথম সুরক্ষা দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তায়েফ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর, এখন থেকে চার বছর আগে।
সুহায়েল যদিও মুহাম্মদের ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, তবে তাঁর ভাই সাকরান বিন আমর মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ায় দ্বিতীয় অভিবাসী দলের একজন। সাকরান বিন আমর পরে সেখানেই মারা যান। সুহায়েল বদরে ধরা পড়ে, কিন্তু জোরপূর্বক তাদের যখন ইয়াছরিবে নেয়া হচ্ছিল সেই দল থেকে পালিয়ে যায়। মুহাম্মদ আদেশ দেন, যে তাঁকে খুঁজে পাবে সে যেন তাঁকে সেখানেই মেরে ফেলে। কিন্তু এরপর যখন তাকে গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকতে দেখা যায় তখন মুহাম্মদ তাকে তাঁর উটের কাছে নিয়ে আসেন এবং তাকে ঘাড়ের পেছনে হাত বেঁধে দিয়ে ইয়াছরিবের পথ পাড়ি দিতে বাধ্য করেন। মুহাম্মদের এই অতিথির (?) জন্য আয়োজনের কথা সাওদাকে জানানোর সুযোগ ছিল না। যখন তিনি তাঁর বন্দিকে নিয়ে মসজিদে পৌঁছেন সাওদা তখন বদরে নিহত দুই যুবকের পরিবারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সাওদা বাড়ি ফেরার পর চমকে উঠলেন দেখে যে তাঁর প্রাক্তন দেবর তাঁর ঘরের এক কোণে হাঁটু গেড়ে বসে আছে! তাঁর হাত এখনো ঘাড়ের পেছনে দড়ি দিয়ে বাঁধা। তিনি তাঁকে তাঁর ডাকনাম ধরে সম্বোধন করে বললেন, “হে আবু ইয়াজিদ, তুমি তাহলে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছিলে! তুমি কি একটা মহৎ মৃত্যুকে বরণ করতে পারতে না?” (৩)।
মুহাম্মদ যুদ্ধের পরের মাসের বেশিরভাগ সময় মুক্তিপণের লেনদেনের জন্য সময় ব্যয় করেন। উচ্চমুল্যের বন্দিরা তাদের মুক্তির জন্য চার হাজার দিরহাম প্রদান করে, যা প্রায় ত্রিশ পাউন্ড খাঁটি রূপার সমান। সুহায়েল যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ বন্দী ছিলেন, পুরো মূল্য পরিশোধ করতে তাঁকে বাধ্য করা হয়। একজন মক্কাবাসী, যিনি তাঁর মুক্তির সমঝোতা করতে ইয়াছরিব পৌঁছেছিলেন এবং যতক্ষণ না সুহায়েল মক্কা থেকে মুক্তিপণের টাকা পাঠান ততদিন পর্যন্ত তাঁকে জিম্মি করে রাখা হয়। কিছু অসহায় শিক্ষিত বন্দী ছিল, তাদের ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদের সন্তানদের পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়। মুহাম্মদের চাচা আব্বাস তাঁর মুক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ প্রদান করেন। মক্কার কাফেলা বাণিজ্যের প্রধান বিনিয়োগকারী ছিলেন আব্বাস। অর্থনৈতিকভাবে তিনি ভালো অবস্থানে ছিলেন এবং তিনি স্বর্ণপ্রেমী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। সেই সময়ে তিনি চল্লিশজন ক্রীতদাসের মালিক ছিলেন, যাদেরকে বিভিন্ন আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের কাজে নিয়োগ করেছিলেন। ইসলামের মৌলিক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, তাঁকে চল্লিশটি স্বর্ণের আউকিয়া (awqiyyas) দিতে বাধ্য করা হয় যা একশো পঁচাত্তর আউন্স সোনার সমতুল্য; যার মাধ্যমে তাঁর ও তাঁর বেশ কয়েকজন ভাগ্নে এবং তাঁর কর্মচারীদের মুক্তি নিশ্চিত করা হয় (৪)।
যুদ্ধের গণিমতের মাল ভাগ বাটোয়ারার মতো মুহাম্মদ মুক্তিপণের পরিমাণ থেকেও নিজের জন্য এক পঞ্চমাংশ রাখেন, আর বাকি অংশ বন্দিকারীদের মধ্যে বিতরণ করেন। সবচেয়ে কঠিন ঝামেলায় পড়েন তাঁর জামাতা আবুল আসের মুক্তিপণ নিয়ে যে ছিল খাদিজার বোন হালার পুত্র। হেরা পর্বতে মৃগীরোগের অভিজ্ঞতার একবছর আগে মুহাম্মদ তাঁর বড় মেয়ে জয়নবকে আবুল আসের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও জয়নব তাঁর পিতার ধর্ম গ্রহণ করেন, তবে মুহাম্মদ ইয়াছরিবে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তাঁর অবিশ্বাসী বরের সাথে মক্কায় থেকে যান। ইসলামের ইতিহাসের বইয়ে পাওয়া যায়, তারা একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। যখন জয়নবের কাছে তাঁর বরের আটকের খবর পৌঁছে তখন তিনি বরের মুক্তিপণের জন্য বাবার কাছে টাকা পাঠান এবং কয়েক স্তরবিশিষ্ট একটি গলার হারও সঙ্গে পাঠান। হারটি তাঁর মা খাদিজা তাঁকে বিয়ের উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। অবশেষে মুহাম্মদ তাঁর জামাইকে ছেড়ে দেন এই শর্তে যে, মক্কায় পৌঁছেই তিনি জয়নবকে ইয়াছরিবে পাঠিয়ে দেবেন এবং এটাও মেনে নেবেন যে, তিনি যেহেতু মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দেননি তাই তাদের বিয়েও অবৈধ হয়ে গেছে।
মক্কায় ফিরে আবুল আস তাঁর স্ত্রীকে বলেন যে, তাদের আলাদা হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই এবং তিনি তাঁর ভাইকে বলেন জয়নবকে পাহারা দিয়ে ইয়াছরিবে নিয়ে যেতে। তবে শেষ মুহূর্তে মক্কাবাসীরা যখন তাঁর চলে যাওয়ার কথা জানতে পারলেন তারা এসে হস্তক্ষেপ করলেন। তাঁরা জয়নবের চলে যাওয়াকে অপমান হিসেবে দেখছেন। তাঁর বাবা তাদের ডজন ডজন লোককে হত্যা করেছিল এবং মুক্তিপণের জন্য আরো অনেককে আটকে রেখেছিল, তাই তাঁরা জয়নবকে জিম্মি হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিল। সে সময় জয়নব গর্ভবতী ছিলেন, এবং এই টানাটানির ভেতর তিনি উট থেকে পড়ে যান। এর ফলে তাঁর গর্ভপাত হয়। আবু সুফিয়ান, যিনি মক্কার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ছিলেন, অবশেষে তাঁকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন। তিনি মুহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন বাবার কাছ থেকে কারও কন্যা আটকে রাখার সঠিক সময় সেটা নয়। মুহাম্মদ পরে একটি অভিযানকারী দলকে মক্কায় পাঠান এই আদেশ দিয়ে যে, যারা তাঁর মেয়েকে জোর করে ফেরত পাঠাতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটিয়েছে তাদের যেন পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু মুহাম্মদের প্রেরিত হামলাকারীরা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হবার একদিন পর তিনি আবার খবর পাঠান যে, তিনি তাদের জীবিত পুড়িয়ে মারার ব্যাপারে মন পরিবর্তন করেছেন। কারণ, আল্লাহ নির্দেশিকা দিয়েছেন, “শুধু তাদেরকে মেরে ফেলো (আগুন দিয়ে নয়), কেননা আল্লাহ ছাড়া আগুনে পুড়িয়ে শাস্তি দেবার অধিকার আর কারোর নেই” (৫)।
বদরের পরাজয়ের সংবাদ মক্কার শহরকে ভেঙ্গে ফেলেছিল। সবাই সবার সাথে সম্পর্কিত ছিল। কারো ছেলে, কারো ভাই, কারো বাবা, কারো চাচাত ভাই বা কেউ তাঁর চাচাকে হারিয়েছে। আবু সুফিয়ান যদিও তাঁর একপুত্র এবং অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে হারিয়েছেন, কিন্তু তিনি তাঁর শোককে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং জনগণকে শোক না করার পরামর্শ দেন যাতে দুঃখ কমে না যায়। দুঃখ কমে গেলে তা তাদের প্রতিহিংসার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তিকে কেড়ে নেবে। এই কথা শুনে এক অন্ধলোক যিনি যুদ্ধে তাঁর তিনটি ছেলেকে হারিয়েছেন তাঁর এক দাসের সাথে শহর ছেড়ে পাহাড়ে চলে যান, যাতে সেখানে তিনি গোপনে শোক পালন করতে পারেন। তিনি তাঁর সাথে মদ নিয়ে এলেন এবং মাতাল হওয়ার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়েন এবং যন্ত্রনায় মাথার উপর বালি তুলে ঢেলে দিচ্ছিলেন। প্রায় একই সময়ে উপত্যকায় কান্নার ঢেউ উঠল এবং তাঁর কাছেও আওয়াজ আসছিল। মক্কাবাসীরা আবু সুফিয়ানের উপদেশ উপেক্ষা করেছিল, যার ফলে শহর জুড়ে তাদের শোক ছড়িয়ে পড়েছিল।
অন্ধ লোকটি দাসকে তদন্তের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। দাস ফিরে এসে তাঁকে মিথ্যা বলল - এক মহিলার উট মারা গিয়েছে, তাই কাঁদছে। শোক করা থেকে থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে মক্কার নারীরা তাদের চুল কেটে ফেলল আর গলি ও রাস্তায় পর্দা মধ্যে লাগিয়ে দিল, যাতে মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের প্রিয়জনের জন্য শোক প্রকাশ করতে পারে। নিহতদের একটি প্রিয় উট বা ঘোড়া আনা হতো এবং তারা মাথানত করে তাঁর চারপাশে দাঁড়িয়ে এবং একহাত প্রাণীর উপর স্থাপন করত, যাতে সেই পশুর মাধ্যমে মৃতদের আত্মার সাথে সংযুক্ত হতে পারে।
তবে যারা শোক করতে অস্বীকার করেছে তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ, যিনি মুহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কারণ তাঁর ছেলে হানজালা, তাঁর পিতা উতবা, তাঁর ভাই ওয়ালিদ এবং তাঁর চাচা শায়বাকে মুহাম্মদ হত্যা করেছিলেন। যখন একজন মহিলা তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কাঁদবে না তোমার ঘরের মানুষের জন্য?” তিনি উত্তরে বললেন, “ঈশ্বর আপনার গলা বন্ধ করুক! আমি যদি তাদের জন্য কাঁদি তবে তা মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গী আর খাজরাজের নারীদের কাছে পৌঁছাবে। তাতে তারা আমাদের দুর্ভাগ্যের জন্য আনন্দিত হবে না? না, ঈশ্বরের কসম, যতক্ষণ না আমি মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের প্রতিশোধ নিচ্ছি” (৬)।
মুহাম্মদের উপর প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত হিন্দ তাঁর বরের সাথে ঘুমাতে অস্বীকার করেন এবং আবু সুফিয়ান প্রকাশ্যে জীবনের সুখ ত্যাগ করেন যতক্ষণ না তিনি মক্কার শক্তিমত্তা দেখাতে পারেন। মুক্তিপণের টাকা পরিশোধ করামাত্রই যুদ্ধবন্দিরা মক্কায় ফিরে আসে। আবু সুফিয়ান দুইশত লোকের সমন্বয়ে একটি অভিযান সংগঠিত করেন এবং তাদেরকে নিয়ে ইয়াছরিবের উত্তর দিকে যান। তারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পর্বতমালার ভেতর দিয়ে ইয়াছরিবের উচ্চভূমিতে প্রবেশ করার জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, যেখানে অধিকাংশই ইহুদি দুর্গ অবস্থিত ছিল। আবু সুফিয়ান প্রথমে তাঁকে এবং তাঁর লোকদের ঢুকতে দেয়ার জন্য বনু নযীর গোত্রের অন্যতম নেতা হুয়াই বিন আখতাবের (Huyayy ibn Akhtab) দুর্গের দরজায় ধাক্কা মারেন, কিন্তু তিনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। উপরন্তু তিনি তাদেরকে তাঁর দুর্গের নিকটবর্তী আরেক দুর্গে থাকা প্রধান রাব্বি এবং নেতা সালাম মিশকামের ( Sallam Mishkam ) কাছে নিয়ে গেলেন। এই ভদ্রলোক তাঁর জন্য দরজা খুলে দেন এবং খাবার ও মদ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। অন্যান্য রাব্বিদের মধ্যে সালামও মুহাম্মদের সাথে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক করেছিলেন এবং পরে তাঁকে উপহাস করেছিলেন। আবু সুফিয়ান মুহাম্মদকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু একমাত্র যে উপায়ে তা করা সম্ভব সেটা হলো তাঁকে মসজিদের ভেতরে আক্রমণ করা, কিন্তু সেটি (মসজিদ) ছিল নাজ্জার অঞ্চলের কেন্দ্রে। অন্ধকারের আড়ালে থেকে অতি সন্তর্পণে তিনি এবং তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনী সনাক্ত হওয়ার আগেই মসজিদে পৌঁছাতে পারবেন হয়তো, কিন্তু সালাম তাঁকে সতর্ক করে দেন যে, তারা যদি মুহাম্মদকে হত্যা করতে সক্ষমও হন তাঁর মানে এই না যে তাদের মধ্যে সবাই জীবিত অবস্থায় ইয়াছরিব থেকে বের হতে পারবেন। এটা একটা আত্মঘাতী অভিযান হবে।
আবু সুফিয়ানের এই অভিযানের জন্য কিছু একটা করার দরকার ছিল। সালাম তাদেরকে তুলনামুলক সহজ একটি লক্ষ্যবস্তু দেখিয়েছেন, আর তা হচ্ছে, উচ্চভূমির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত মুহাম্মদের একজন অনুসারীর মালিকানাধীন একটি খামার। রাতের শেষে দিন এলে সকালেই মক্কান বাহিনী খামারে আক্রমণ করে খামারের মালিক ও একজন দাসকে হত্যা করে। তারা ঘরবাড়ি, যবের ক্ষেত ও খেজুর বাগানে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং মুহাম্মদের সৈন্যরা তাদের বিরুদ্ধে গঠিত হবার আগেই পালিয়ে যায়। মুহাম্মদ বেশ কয়েকদিন ধরে এই বাহিনীর পেছনে ধাওয়া করেন, কিন্তু আবু সুফিয়ান মরুভূমির মধ্য দিয়ে পালিয়ে যান।
বদরের বিজয় মুহাম্মদকে তাঁর ইয়াছরিবী শত্রুদের মুখোমুখি হওয়ার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। বদর থেকে ফিরে আসার পরপরই তিনি কবিদের হত্যার পরিকল্পনা করেন, যারা তাঁকে উপহাস বা সমালোচনা করেছিলেন। তাদের (কবিতার) প্রভাব তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলছিল। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, কিন্তু গুজবের প্রতি মনোভাব কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হতো, অনেকটা আজকের দিনের সম্পাদকীয়ের মত। ইহুদি কবি এবং পৌত্তলিক কবিরা তাদের কবিতা দিয়ে মুহাম্মদের বিরোধিতা করছিলেন, তাঁকে বহেরাগত বলে আখ্যায়িত করছিলেন এবং মুহাম্মদের হাতে ইয়াছরিবের ক্ষমতা তুলে দেয়ায় তারা ইয়াছরিবের লোকদের প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। মুহাম্মদ সিদ্ধান্ত নিলেন এদের মোকাবেলা করার চেয়ে খুন করাই সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
[কে আমাকে মুক্ত করবে...? যখনই তিনি কাউকে খুন করতে চাইতেন, মুহাম্মদ মসজিদের ভেতরেই সেই আততায়ীকে নিয়োগদান করতেন। খুনিরা খুন করে ফিরে তাঁর কাছে জানাত যে, হত্যাকাণ্ড সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মুহাম্মদ এই বলে খুনির ভালো কাজের জন্য সবার সামনে প্রশংসা করতেন, “এটি আল্লাহর পথে (আল্লাহর জন্য)”]
প্রথম কবি যাকে হত্যা করা হয় তিনি হচ্ছেন আবু আফাক (Abu Afak) নামের একজন বৃদ্ধ শেখ, যিনি বদরের আগেও ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা দিয়ে মুহাম্মদকে বিরক্ত করেছিলেন। মুহাম্মদ বিজয়ী হয়ে ফিরে আসার পর শেখ একটি কঠোর কবিতা রচনা করেন, যার মাধ্যমে তিনি ইয়াছরিবের পূর্বপুরুষদের প্রশংসা করে মুহাম্মদকে অপসারণের আহ্বান জানান। মুহাম্মদ যখন কবিতাটি শুনলেন তখন তিনি মসজিদের এক সমাবেশে একজন খুনিকে অনুরোধ করলেন এই বলে : 'কে আমার হয়ে এই বদমাশের মোকাবেলা করবে?” (9)
বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নাজ্জার গোত্রের একজন ধর্মান্তরিত এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে। শেখ আবু আফাক তাঁর বাড়িরই উঠোনে ঘুমিয়ে ছিলেন, এই ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর মধ্যে সেই আততায়ী তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলেন। একই নিষ্ঠুরতার সাথে হত্যা কর হয় মারোয়ানের (Marwan) কন্যা আসমাকে, যিনি শক্তভাবে মতামত ব্যক্ত করতেন এবং ঠোঁটকাটা জবাব দিতেন। আসমার পূর্বেকার কাহিনী অসম্পূর্ণ, তবে তিনি সম্ভবত একজন ইহুদি ধর্মান্তরিত অথবা ইহুদিদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ শর্তে একটি গোত্রের অন্তর্গত ছিলেন; কারণ তিনি একটি ইহুদি দুর্গের কাছেই বাস করতেন। আবু আফাকের হত্যাকাণ্ডে ভীত হওয়ার পরিবর্তে তিনি ইয়াছরিবের গোত্রদের নিয়ে রাগান্বিত হয়ে কবিতা রচনা করেন। একজন বহিরাগতকে তাদের উপত্যকার দায়িত্ব দেয়া জন্য তিনি ইয়াছরিবের লোকদের তিরস্কার করেন। তিনি লেখেন : “মালেক, নাবিত, আওস ও খাজরাজের লোকগুলা মরুকগে! তোমরা এমন একজন অচেনা আগন্তুকের আনুগত্য করছ যে তোমার মধ্যের কেউ না!” (৮)। এই কবিতাটির মাধমে তিনি তাঁর লোকদের সমালোচনা করে বলেন, মুহাম্মদ কিভাবে তাদের নেতা আবু আফাককে হত্যা করে পার পেয়ে গেল? তিনি এই রচনার মাধ্যমে তাঁর গোত্রের পুরুষদের আহ্বান জানান মুহাম্মদকে যেন হত্যা করা হয়।
আবু আফাকের রচনার মতই মুহাম্মদ আসমার কবিতার উপর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মসজিদের সমাবেশে তিনি চরম ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন, এই মহিলার এত বড় সহস যে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ক্ষতি করতে চাইছে? এখন তাঁর মৃত্যু অনিবার্য! তিনি গর্জন দিয়ে বলেন, “মারওয়ানের মেয়ের হাত থেকে কে আমাকে মুক্ত/রক্ষা করবে?" (৯)
আসমার বরের গোত্রের একজন সদস্য মুহাম্মদের পায়ে লাফিয়ে পড়লেন। তিনি আংশিক অন্ধ হওয়ার কারণে সতর্ক করতে অন্ধকার রাতে তিনি আসমার বাড়িতে যেতে পারেননি। বলা হয়, যখন মুহাম্মদের নিযুক্ত আততায়ী আসমার বাড়িতে প্রবেশ করে, আসমা তাঁর ছোট বাচ্চাদের সাথে ঘুমাচ্ছিল এবং তাঁর কোলে একটি নবজাতক শিশুও ছিল। ঘাতক শিশুটিকে একপাশে সরিয়ে দেয় এবং আসমার পেটের ভেতর তরবারি ঢুকিয়ে দেয়। ভোরের নামাজের সময় মুহাম্মদকে আসমার হত্যাকাণ্ডের খবরটি দেয়া হলো। মুহাম্মদ যখন ঘাতককে দেখলেন তখন তাকে কাছে আসার জন্য ইশারা দিলেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কি মারওয়ানের মেয়েকে মেরেছো?” আততায়ী বলল, 'হ্যাঁ, ও আল্লাহর রাসুল, আপনি আমার কাছে আমার বাবার চেয়েও প্রিয়”। ঘাতক চিন্তিত ছিল এই ভেবে যে, তাঁর এই কাজ হয়তো আল্লাহকে ক্ষুব্ধ করেছে, কিন্তু মুহাম্মদ তাঁকে বলেছিলেন এই কাজের জন্য যেন সে দুশ্চিন্তা না করে। “এমনিকি দুটি ছাগলও তাঁর (আসমার) জন্য তাদের মাথা একে ওপরের সাথে খুটাবে না” বললেন মুহাম্মদ (১০)। মুহাম্মদ তাঁর নামাজের ঘরে ঢুকে এই কাজের বর্ণনা দেন এবং হত্যাকারীর ভুয়ষী প্রশংসা করে বলেন, সে এমন এক পুরুষ যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে!
আকস্মিকভাবে অথবা ইচ্ছা করে, যেটাই হোক আততায়ী আসমার শেষকৃত্যের সময় গোরস্থানের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শোকার্ত পরিবারের এক সদস্য তার দিকে আঙ্গুল তুলে তাকে খুনি হিসেবে দেখিয়েছিলেন। সে তখন তাদের কাছে সগর্বে চ্যালেঞ্জ করে বলে, যদি তোমরা এই ব্যাপারে কিছু করতে চাও তবে করতে পারো। সে তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলে যে, যদি তারা মুহাম্মদকে অপমান করে তবে তাদেরও একই পরিণতি হবে। আরেকটি কবিতা দিয়ে এই ঘটনার সমাপ্তি ঘটে। এ সময় মুহাম্মদ ইয়াছরিবের একজন কবি হাসসান বিন ছাবিতকে তাঁর জনসংযোগ প্রতিভা কাজে লাগানোর জন্য নিয়োগ করেন। তিনি যখন মুহাম্মদের একজন মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব নিলেন তখন তাঁর প্রথম রচনাবলীর (কবিতা) মধ্যে একটিতে আসমার হত্যাকারীর প্রশংসা করা হয়েছে। হাসসান লেখেন : “একজন গৌরবময় বংশোদ্ভূত, পবিত্র মানুষকে তাঁর চলাচলের সময়, সে (আসমা) উত্তেজিত করে তুলেছিল। তাই ভোরের আলো ফোটার আগেই, আততায়ী তাঁর (আসমার) রক্তেই তাঁকে রাঙিয়ে দিয়েছে, এবং এজন্য তিনি কোন অনুশোচনাও অনুভব করেননি” (১১)।
সমালোচকদের হত্যা করার পাশাপাশি, মুহাম্মদ তাঁর ঘনিষ্ঠ ইহুদি প্রতিবেশী কায়নুকাস (বনু কাইনুকা) থেকে শুরু করে ইয়াছরিবের ইহুদিদের বিরুদ্ধে এক ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযান ও গণহত্যার প্রথম পর্যায়ের কর্মসূচী শুরু করেছিলেন। মক্কায় নামাজের দিক পরিবর্তন এবং একটি নতুন আব্রাহাম গল্পকাহিনীর আবিষ্কারের সাথে সাথে মুহাম্মদ ইঙ্গিত দেন যে, তিনি তাদের ধর্মের সাথে তাঁর সকল প্রকার যোগসূত্র ছিন্ন করেছেন। কিন্তু তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়াই যথেষ্ট ছিল না। বদর যুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ পরে তিনি তাদের দুর্গের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে এবং সমগ্র গোত্রটিকে একটি শেষ হুঁশিয়ারি দেন : হয় মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দেয়া হোক, অথবা “ঈশ্বর” তাদের উপর প্রতিশোধ নেবে, ঠিক যেমন তিনি মক্কাবাসীদের উপর প্রতিশোধ নিয়েছেন তাঁকে সত্যের বাহক হিসেবে প্রত্যাখ্যান করার জন্য। “তোমরা জানো যে আমি একজন নবী, তোমাদের জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে - তোমরা তা তোমাদের পবিত্রগ্রন্থে এবং তোমাদের সাথে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞায় দেখতে পাবে আমার কথা” বলেন মুহাম্মদ (১২)।
মুহাম্মদের মসজিদ থেকে দুই মাইল দুরে, ইয়াছরিবের উপরাংশে যাওয়ার পথে পাহাড়ি ঢালের চূড়ায় এবং প্রধান নদীগুলোর অন্যতম একটির উপরে বিশেষ কৌশলগত অবস্থানে নির্মিত সেতুর কাছে চারতলা বিশিষ্ট কায়নুকা দুর্গটি অবস্থিত ছিল। বনু নযীর এবং বনু কুরাইজা গোত্রের ইহুদিরা সম্পদশালী হয়েছিল কৃষির কারণে। অন্যদিকে কায়নুকার ইহুদিরা ছিলেন স্বর্ণকার, কারিগর, অস্ত্র প্রস্তুতকারক এবং ব্যবসায়ী। দুর্গের সামনে তাদের বাজার ছিল এবং পুরো আরব জুড়েই তাদের নিখুঁত গয়নার জন্য সুখ্যাতি ছিল। তারা খাজরাজের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছিল এবং বিগত দশকের বেশ কয়েকটি আন্তঃগোত্রীয় যুদ্ধে তাদের পক্ষ নিয়েছিল। তাদের সাথে যোদ্ধারা একাধিকবার খাজরাজের বহুশ্বরবাদী নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাইকে বিজয় এনে দিয়েছে। মুহাম্মদ যখন তাঁর শেষ হুঁশিয়ারি ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন দুর্গের ভেতর থাকা নেতারা বেরিয়ে আসলেন তাঁকে যুক্তি দেখাতে। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, মুহাম্মদ তাওরাতে যে দাবি করেছেন সেটা আসলে ভিত্তিহীন - তাদের পবিত্রগ্রন্থে তাঁর সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এমনকি মুহাম্মদ নিজে ইহুদিও নন, তাহলে তিনি কিভাবে তাদের নবী হতে পারেন? তাঁরা মুহাম্মদকে একটি অনাগ্রাসন চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যার ধারামতে তাঁরা যদি মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ নাও করেন তবুও সেই চুক্তি ভঙ্গ হয় না (১৩)। একপর্যায়ে একজন ইহুদি নেতা রেগে গিয়ে বললেন: “নিজেকে প্রতারিত করবেন না, কারণ আপনি যাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন তাদের যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব ছিল এবং আপনি সেই সুযোগটিই গ্রহণ করেছেন। আপনি যদি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন, তাহলে আপনি আমাদের সত্যিকারের পৌরুষ দেখতে পাবেন!” (১৪)
যেকোন চুক্তি যদি মুহাম্মদের উপকারে লাগত তাহলে তা তিনি মেনে নিতেন, কিন্তু যখন আর উপযোগী হতো না তখন সেগুলোকে তিনি বাতিল করে দিতেন। অনাগ্রাসন চুক্তির সমাধান তিনি টেনেছিলেন একটি কোরানের আয়াত রচনা করে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে চুক্তি প্রত্যাখ্যান করার অনুমতি দেয়া দিয়েছিলেন। যদি তিনি অন্যপক্ষের কাছ থেকে 'বিশ্বাসঘাতকতার ইঙ্গিত' পান, তাহলে সেই চুক্তি তিনি ভঙ্গ করতে পারেন। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন : “আর যদি তুমি কোন কওম থেকে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা কর, তাহলে (তাদের চুক্তি) তাদের দিকে সোজা নিক্ষেপ কর, নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের পছন্দ করেন না” (১৫)।
[মারওয়ানের মেয়ে আসমার হত্যাকাণ্ড। মুহাম্মদ তাঁকে মৃত দেখতে চেয়েছিলেন একটি কবিতাঁর কারণে, যেটাতে তিনি একজন বয়স্ক শেখকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াছরিবের গোত্রগুলির সমালোচনা করেছিলেন। মুহাম্মদকে নিয়ে তিনি ব্যাঙ্গাত্মক শ্লোক রচনা করেছিলেন। মুহাম্মদ মসজিদে আততায়ী নিযুক্ত করেন, যে গভীর রাতে তাঁর বাড়িতে ঢুকে তাঁর ভেতর তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয় যখন সে তাঁর পাঁচ সন্তানের সাথে ঘুমিয়েছিল, যার মধ্যে একটি নবজাতকও ছিল। শুধুমাত্র নবজাতক শিশুটিকে এখানে দেখানো হয়েছে। ]
এখন কায়নুকার ইহুদিদের সাথে তাঁর কৃত চুক্তি বাতিল করার জন্য কেবল বলতে হবে যে, তিনি তাদের নিয়ে সংশয়ে আছেন। কায়নুকা বাজারের একটি মজার ঘটনা তাঁকে তাঁর প্রয়োজনীয় সেই অজুহাতও দিয়েছে। ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতকে বিয়ে করা এক বেদুইন তরুণী কায়নুকার একজন স্বর্ণকারের কারিগরের কাছে তাঁর একটু ছোট স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে বিক্রি করার জন্য। যখন সে তাঁর সাথে সেটির মূল্য নিয়ে দেনদরবার করছিলেন তখন একজন ইহুদি পেছন থেকে উঠে এসে তাঁর স্কার্ট এমনভাবে বেঁধে দিল যে, যখন সে উঠে দাঁড়াল তখন তাঁর নিতম্ব উন্মুক্ত হয়ে গেল। তরুণীর অস্বস্তি দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। মুহাম্মদের একজন অনুসারী কি ঘটেছে তা কাছ থেকে দেখছিলেন এবং তিনি অপরাধীকে হত্যা করে ফেলেন। প্রতিশোধ নিতে একদল ইহুদি তাঁকেও ঘিরে ফেলে এবং হত্যা করে। এই ঘটনাই যথেষ্ট ছিল মুহাম্মদের ঘোষণা দেয়ার যে, “আমি বনু কায়নুকাকে নিয়ে ভীত” (১৬, ১৭)।
একইদিনে তিনি কায়নুকার দুর্গ অবরোধ করার জন্য শতশত অনুসারীকে একত্রিত করেন। ইহুদিরা ভেতরে ব্যারিকেড করে প্রার্থনা করল যে, তাদের মিত্ররা তাদের উদ্ধার করতে আসবে, কিন্তু সেই সাহায্য আসেনি। পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে মুহাম্মদ গণিমতের মালের প্রতিশ্রুতি ব্যবহার করে আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে অবরোধে যোগ দিতে উৎসাহিত করেন। স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা যথেষ্ট বেড়ে যায়, যা দেখে কেউই কায়কাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এমনকি অন্যান্য ইহুদি সম্প্রদায়ও সাহায্য পাঠায়নি। তাদের নিকটতম অ-ইহুদি মিত্র ছিল আবদুল্লাহ বিন উবাই, কিন্তু তাঁর ক্ষমতা মুহাম্মদের তুলনায় কমে গিয়েছিল এবং তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, হস্তক্ষেপ করবেন না। কারণ, এতে তাঁর কোন স্বার্থ নেই। ইহুদিরা দুই সপ্তাহ ধরে আটকে ছিল, কিন্তু বাইরের সাহায্য না পেয়ে হতাশ হয়ে অবশেষে তাঁরা মুহাম্মদের দয়ার উপর নিজেদের সঁপে দিলেন। দয়া দেখানোর জন্য মুহাম্মদ ছিলেন ভুল ব্যক্তি। তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি তাদের ঘৃণা করতেন এবং তাদের ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত এর প্রয়োজনীয়তা অনুমান করে তিনি বদরে একটি আয়াত রচনা করেছিলেন, যেখানে তিনি গণহত্যা করার জন্য নিজেকে নিজেই আল্লাহর আশীর্বাদ দিয়েছিলেন : “কোন নবীর জন্য সঙ্গত নয় যে, তার নিকট যুদ্ধবন্দি থাকবে যতক্ষণ না তিনি যমীনে (তাদের) রক্ত প্রবাহিত করেন” (১৮)।
যখন আত্মসমর্পণকারী ইহুদিরা দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন তাদের বেঁধে রাখা হয় এবং উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যে, মুহাম্মদ তাদের সবাইকে শিরোচ্ছেদ করতে চাইছেন। যদিও আবুদুল্লাহ বিন উবাই সামরিকভাবে তাদের উদ্ধার করতে আসেননি, কিন্তু তিনি দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং মুহাম্মদের কাছে তাদের সাথে ভালো আচরণ করার দাবি জানান। মুহাম্মদ যখন তাঁকে উপেক্ষা করলেন, তখন খাজরাজের প্রধান সেনাপতি (আবদুল্লাহ বিন উবাই) মুহাম্মদের জামা টান দিয়ে চেপে ধরে চিৎকার করে তাদের ছেড়ে দিতে বললেন। মুহাম্মদ রাগে লাল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ধুর, আমাকে করতে দাও!” আবদুল্লাহ বললেন, “না, ঈশ্বরের নামে বলছি, যতক্ষণ না তুমি আমার মিত্রদের সাথে ভালো ব্যবহার কর, আমি তোমাকে যেতে দেব না। বর্মবিহীন চারশত লোক এবং তিনশত বর্ম পরা, যারা আমাকে আরব এবং অনারবদের থেকে সমানভাবে রক্ষা করেছে, আর তুমি এক সকালে এসে তাদের মেরে ফেলবে? ঈশ্বরের নামে বলছি, আমি নিরাপদ বোধ করছি না এবং ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে আমি শঙ্কিত!” মুহাম্মদ অবশেষে হার মানলেন আর এর উত্তরে বললেন, “আচ্ছা তোমার কথাই সই, যত্তসব!” (১৯)
মুহাম্মদ কায়কাদের বহিষ্কার করেন এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন, যার মধ্যে রয়েছে তাদের দুর্গ, কাঠের বাড়ি, ব্যবসা, কারিগরি সরঞ্জাম এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র। তিনি তাদেরকে কেবল তাদের উট এবং ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কিছু জিনিসপত্র সাথে নিতে দিলেন। তিনি তাদের কয়েকদিন সময় দিয়েছিলেন সবকিছু গুছিয়ে নিতে এবং প্রায় একহাজার বছর ধরে বাস করা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে। যাত্রার দিন তাদেরকে শহরের বাইরে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেতে মুহাম্মদ তাঁর এক আনুসারীকে আদেশ দিলেন। যখন তারা উপত্যকার সীমা অতিক্রম করল, তখন লোকটি তাদের আরও এগিয়ে যেতে বলল। এরপর লোকটি তাদের বলল, “যত দূরে যাবে ততই ভালো এবং আর ফিরে আসবে না”। তাদের মধ্যে কেউ খায়বারে (Khaybar), কেউবা আরেকটি ইহুদি মরূদ্যান ওয়াদি আল-কুরায় (Wadi al-Qura) চলে গেলেন। তাদের অধিকাংশই অবশেষে সিরিয়ায় স্থানান্তরিত হয় এবং ইহুদি সম্প্রদায়ে বসতি স্থাপন করে।
এদিকে মুহাম্মদ লুটের মালামাল সব মসজিদের উঠোনে নিয়ে স্তুপ করে রাখেন। তিনি তাঁর জন্য নির্ধারিত পঞ্চমাংশ হিসেবে প্রথমে অস্ত্র বেছে নেন, নিজের জন্য তলোয়ার, বর্শা এবং বর্ম নির্বাচন করেন যেসবের আবার যুদ্ধে বেশ খ্যাতি থাকার কারণে নামকরণও করা হয়েছিল। অবশিষ্ট মালামাল তিনি তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে বিতরণ করেছিলেন। বিতরণ করে তিনি মুমিনদের বললেন, “যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মুমিনদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারা আল্লাহর দলের, তারাই বিজয়ী” ( 20 ) ।
কায়নুকা ইহুদিদের বহিষ্কারের পর কবি-সমালোচকদের হত্যা অব্যাহত থাকে। মুহাম্মদের হত্যা তালিকায় শীর্ষে ছিলেন কাব আশরাফ ( Kab Ashraf)। তিনি একজন ধনী সুগন্ধি ব্যবসায়ী ছিলেন, মায়ের দিক থেকে তিনি অর্ধেক ইহুদি, যিনি নযীর গোত্রের ছিলেন। বদরের যুদ্ধের আগে তিনি মুহাম্মদকে বারবার আক্রমণাত্মক কবিতা দিয়ে অপমান করেছিলেন। তাঁর কবিতা অন্যান্য সমালোচকরাও গ্রহণ করেছিলেন। মুলত তিনি যা লিখতেন তার সার ছিল এরূপ : মুহাম্মদ হচ্ছে একজন বহেরাগত যে উপত্যকার জীবন বিঘ্নিত করছেন এবং তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা উচিত। বদরে মক্কাবাসী পরাজয়ের পর খেপাটে আশরাফ মক্কায় গিয়ে তাদের উভয়েরই শত্রু মুহাম্মদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে আহবান করেন। তিনি তাদের চাটুকারিতার সাথে প্রশংসা করে বলেন যে, তাদের ধর্ম মুহাম্মদের চেয়ে ভালো : “আপনারা অধিক ধর্মপরায়ণ এবং সত্যপথ প্রদর্শনকারী”। যে সকল মক্কাবাসীরা যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গিয়েছে আশরাফ তাদের জন্য কবিতা রচনা করেন মক্কাবাসীদের প্রশংসা করে। তিনি তাদের যোদ্ধাদের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেন এবং মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
মুহাম্মদ যখন তাঁর কবিতা সম্বন্ধে জানতে পারলেন তখন তিনি শুধু আশরাফের বিরুদ্ধেই নয়, বরং তাঁকে যে সকল মক্কাবাসী আশ্রয় দিয়েছিল তাদের সবার উপর দমন অভিযান চালান। মুহাম্মদের নিযুক্ত কবি হাসসান বিন ছাবিত আশরাফের আশ্রয়দাতাদের “প্রতারণার ক্রীতদাস” এবং “শিক্ষিত বানর” বলে অভিহিত করেছিলেন। একে অন্যের বিরুদ্ধে তারা অপমানজনক কবিতার পঙক্তি নিক্ষেপ করতে থাকে, অবশেষে মুহাম্মদের করা অপমানই জয়ী হয়। যদিও আশরাফ মক্কাবাসীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিল, কিন্তু ছাবিতের কুখ্যাত কবিতার মাধ্যমে মক্কাবাসীরা এত অপমানিত হয়েছিল যে, তারা আশরাফের আতিথেয়তা শেষ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে আশরাফ চলে যেতে বাধ্য হয়। যখন তিনি ইয়াছরিবে ফিরে আসলেন, ইতিমধ্যে আবু আফাক ও আসমাকে খুন করা হয়ে গেছে এবং আশরাফ তাঁর প্রাণের ভয় পাচ্ছিলেন। যখন মুহাম্মদ তাঁর প্রত্যাবর্তনের কথা জানতে পারেন তিনি মসজিদের সমাবেশ থেকে একজন আততায়ী নিয়োগ করেন। এবারের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন মুহাম্মদ বিন মাসলামা (Muhammad ibn Maslama) নামে একজন বদরের যোদ্ধা, যিনি মুহাম্মদের জন্য এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে একলাফে রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি একটু চিন্তিত হলেন, এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করতে কিছু কৌশলগত সমস্যা আছে যার সম্মুখীন আগের আততায়ীরা হয়নি। তাদের শিকারদের কাছে পৌঁছানো তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল, কিন্তু আশরাফ একটি নিচু পাহাড়ের উপরে নির্মিত কাঠের দুর্গে বাস করতেন। এবং কবি যেহেতু জানতেন যে তাঁর জীবন বিপন্ন, তিনি সহজে তাঁর দুর্গের দেয়ালের বাইরে যেতেন না। তাঁকে বাইরে আনতে গেলে প্রলুব্ধ করতে হবে, কিন্তু মাসলামা এই নিয়ে চিন্তিত ছিলেন কারণ প্রতারণা করলে আল্লাহ হয়তো তাঁর উপর ক্ষুদ্ধ হতে পারেন। যখন মুহাম্মদ তাঁকে কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা করতে বলেন, তখন মাসলামা তাঁর সাথে আরো চারজন উৎসাহী সাহায্যকারী খুঁজছিলেন, যার মধ্যে একজন ছিলেন আশরাফের পালিত ভাই যার নাম আবু নাইলা (Abu Naila )। এই পালিত ভাই আশরাফের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছিলেন এই বলে যে, তিনি মুহাম্মদের প্রতি অসন্তুষ্ট। মুহাম্মদকে কর প্রদানের মাধ্যমে তাদের অনুসারীরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছেন এবং এটা এতটাই কঠিন হয়ে গিয়েছে যে, তাদের খাদ্যের জন্য পর্যাপ্ত টাকা থাকছে না। তিনি এবং তাঁর আরো কয়েকজন লোকের পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য জরুরি ঋণ প্রয়োজন। সে কি দয়া করে তাদের সাহায্য করবে? ঋণের বিপরীতে তারা তাদের অস্ত্র এবং বর্ম তাঁর কাছে বন্ধক রাখতে ইচ্ছুক। আবু নায়লা বুঝতে পারছিলেন প্রলুব্ধতা আসলেই কাজ করছে যখন আশরাফ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে তুমিও তাঁর উপরে বিরক্ত?” (২১)
হত্যাকাণ্ডের রাতে ষড়যন্ত্রকারীরা মসজিদে মুহাম্মদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের পরিকল্পনার কথা জানায়। তিনি তাদের কবরস্থান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন এবং বলেন, “আল্লাহর নামে যাও”। প্রলোভন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেছে। যখন অন্য লোকেরা অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তখন মাসলামার পাশে থাকা আবু নাইলা আশরাফকে রাস্তায় তাঁর সাথে দেখা করার জন্য ডাকলেন। আশরাফ তাঁর চুলে সুগন্ধি লাগিয়ে ঋণের অর্থ প্রদান করতে বেরিয়ে এলেন। তিনি কেবলমাত্র তাঁর স্ত্রীর সাথে বিছানায় গিয়েছেন, যাবার আগে তারা আশরাফের দামি সুগন্ধি মেখে নিয়েছিলেন। আবু নায়লা এই সুগন্ধির প্রশংসা করলেন এবং আশরাফের সুগন্ধি চুলের ভেতর দিয়ে আঙ্গুল ঢুকিয়ে স্পর্শ করছিলেন। ঠিক এরপরই আবু নাইলা আশরাফের মাথাটা তাঁর চুল ধরে পেছনে টেনে ধরলেন আর অন্যদের সংকেত দিলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন “আল্লাহর শত্রুকে মেরে ফেলো!” মাসলামা আশরাফের পেটে একটা ছুরি ঢুকিয়ে নিচের দিকে ছিঁড়ে ফেলল যাতে তাঁর অস্ত্রগুলো বেরিয়ে এলো। তবে কিছু ইতিহাসের সংস্করণে তাঁর মাথা কেটে ফেলা হয়েছে এমন কথা পাওয়া যায়, হয় ছুরি দিয়ে অথবা তলোয়ার দিয়ে কাটা হয়েছে (২২)। ইহুদিরা তাদের খুঁজতে লোক পাঠাতে পারে সেই ভয়ে তাঁরা বাইরের তুলনামুলক নির্জন মাঠের পথ দিয়ে মসজিদে ফিরে আসে, সঙ্গে আশরাফের কাটা মাথাটাও তাদের সাথে নিয়ে আসে। তারা মসজিদে পৌঁছতে পৌঁছতে ভোর হয়ে গেল এবং মুহাম্মদ তখন ফজরের নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি যখন তাদের শুভেচ্ছা জানালেন তাঁরা তখন আশরাফের কর্তিত মাথাটি তাঁর পায়ের কাছে ফেলে দিল (২৩)। শত্রুর মৃত্যুর জন্য মুহাম্মদ আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের হয়ে ভালো কাজের জন্য খুনিদের প্রশংসা করলেন।
ইসলামি মৌলিক গ্রন্থে তাঁর মাথা দিয়ে কি করা হয়েছে তা পাওয়া যায় না; সম্ভবত এটা একটা বর্শার উপর সেটা বাঁধা ছিল যাতে সবাই দেখতে পারে। জানা যায় যে, ফজরের নামাজের পর মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের সকল ইহুদিদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে বলেন : “যে ইহুদি তোমাদের হাতের নাগালে পড়বে, তাঁকেই মেরে ফেলবে!” (28)
ইহুদিরা নিজেদেরকে দুর্গে আটকে রাখে। তাঁরা ভয় পায় যে, শীঘ্রই তাদের অবরোধের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু মুহাম্মদের এই খুনের প্রকাশ্য নির্দেশিকা সত্ত্বেও সেসময় শুধু একজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন - সুনায়না (Sunayna) নামের একজন ইহুদি ব্যবসায়ী। মুহাইইয়িসা (Muhayyisa) নামের এক ধর্মান্তরিত লোক যে সুনায়নার ব্যবসায়িক সহযোগী ছিল সে তাঁকে বাড়ি বের হতে প্রলুদ্ধ করে এনে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। খুনির বড় ভাই যে ধর্মান্তরিত ছিল না, সে তাঁকে প্রচণ্ড মারধর করে বলে : "তুমি তাঁকে মেরে ফেললে যার সম্পদ খেয়ে তোমার পেটের চর্বি হয়েছে?” মুহাইয়িসা তাঁর কর্মোৎসাহের গভীরতা উন্মোচন করে বললো, “যিনি হত্যা করার আদেশ আমাকে দিয়েছেন তিনি যদি আপনাকেও মেরে ফেলার আদেশ দিতেন তাহলে আমি আপনার মাথাও কেটে ফেলতাম”। ইসলামিক গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই কথার শোনার পর সুনায়নার বড়ভাই আলো দেখতে পেলেন এবং বললেন, “ঈশ্বরের কসম, যে ধর্ম আপনাকে এই রকম বানিয়ে ফেলতে পারে সেটা সত্যিই বিস্ময়কর!” এরপর তিনি শীঘ্রই ইসলামে দীক্ষিত হলেন (২৫)।
যখন কিছু ইহুদি এবং বহুশ্বরবাদীরা অভিযোগ করেন যে, হত্যা করার মতো কোন অপরাধ আশরাফ করেননি তখন মুহাম্মদ সতর্ক করে দেন যে, যদি কেউ তাঁকে অপমান করে ভবিষ্যতে তাঁকেও “তলোয়ারের নিচে রাখা হবে” (২৬)। এই হত্যাকাণ্ড ইয়াছরিব এবং এর বাইরে ত্রাস ছড়িয়ে দেয় এবং মুহাম্মদের পোষা ক্রমবর্ধমান উগ্রবাদিদের হাত থেকে নিজেদের প্রাণ এবং নিজেদের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য বহুশ্বরবাদীদের অনেকেই দলবেঁধে নামে মাত্র মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দেয়। এমনকি আসমা বিনতে মারওয়ানের বর্ধিত পরিবারও যোগদান করেছে, কারণ তাঁরাও মুহাম্মদের 'ধর্মের ক্ষমতা' (২৭) দেখেছে। জীবনের ভয়ে খাজরাজ প্রধান আবদুল্লাহ বিন উবাই, যার ইয়াছরিবের রাজা হবার কথা ছিল তিনিও ধর্মান্তরিত হন। মক্কায় প্রারম্ভিক বছরগুলোতে মুহাম্মদ মাত্র একশ বা ততোধিক বিশ্বাসী লাভ করেছিলেন। একের পর এক হত্যাকাণ্ড এবং কায়নুকা ইহুদিদের বহিষ্কার সংঘটিত হবার কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর ধর্মের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে। ইয়াছরিবের প্রায় সব অ-ইহুদি জনসংখ্যার অনেকটাই এখন তাঁর দলে অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সন্ত্রাসই এখন সবচে বিশ্বাসযোগ্য ধর্মপ্রচারক।