অধ্যায় ৮ আমি তোমাকে হত্যা করব!
যদিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, এ সময়ের কাছাকাছি ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে মুহাম্মদ নিজেকে 'আল্লাহর রাসুল' পদে উন্নীত করেন। গুহার অভিজ্ঞতার পর তিনি প্রথমে নিজেকে একজন নবী হিসেবে দেখেছিলেন, যার একমাত্র কাজ ছিল মন্দ কাজ থেকে লোকেদের সতর্ক করা এবং পরকালের আসন্ন বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা। তাঁর তখনকার সীমিত ভূমিকার উপমা এই আয়াতটিঃ “অতএব সতর্ক করুন; কারণ আপনি কেবল একজন সতর্ককারী” (১)।
তবে খুব দ্রুত তাঁর এই নবীর পদবি বা মর্তবা তাঁর কাছে হালকা হয়ে যাচ্ছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের লোকদের সাথে তাঁর যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি অন্যান্য নবীদের সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানছিলেন। এটা ছিল তাঁর একটি চলমান শিক্ষার অংশ, যা তাঁর কল্পনাশক্তি সমৃদ্ধ করত। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন, নবী হিসেবে তিনি অতি সাধারণ, একেবারে পিছিয়ে পড়া। সে সময়ের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত মানুষদের জন্যই কোন না কোন নবীর আনাগোনা ছিল, এবং যুগে যুগে সব মিলিয়ে হাজার হাজার নবীতো হবেই। তবে তাদের মধ্যে ঈশ্বরের বার্তাবাহক বা রাসুলের ভূমিকায় ছিলেন কেবল কয়েকজন, যাদেরকে ঈশ্বর বাছাই করেছিলেন। নোয়া বা নুহ (Noah) ছিলেন রাসুলগণের মধ্যে সর্বপ্রথম। এরপর আব্রাহাম, তারপর মুসা ও যীশু। মুহাম্মদ বিশ্বাস করতেন এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে একজন মরণশীল মানুষকে দেয়া সর্বোচ্চ সম্মান, কেননা একজন রাসুলের ভুমিকা সতর্ক বার্তাবাহকেরও চেয়েও বেশি; ঈশ্বরের অস্তিত্বের ধারণাটি কেবলমাত্র মরুর বুকে বালি ঝড়ে উড়ে যাওয়া বিভিন্ন গোত্রের কাছে নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির কাছেই, কেয়ামত পর্যন্ত। বার্তাবাহকগণ ছিলেন ঈশ্বরের ইচ্ছা প্রেরণকারী; তাদের মাধ্যমে ঈশ্বর মানুষের জন্য পথনির্দেশ দেন, যা অনুসরণ করলে ইহকাল এবং পরকালে ভালো থাকা যাবে।
তাঁর বিশ্বাস সত্য হয়ে ওঠার জন্য তাঁর কাছে এই চিন্তাটুকুই যথেষ্ট ছিল। তিনি ভেবেই নিতেন, যা কিছুই তাঁর মাথায় আসে তা মুলত আসে ঈশ্বরের কাছ থেকে। সুতরাং যখন তাঁর মনে দৃঢ়ভাবে এই ঈশ্বরের ধারণা একটা স্থায়ী রূপ পেল, তখনই তিনি প্রচার করতে থাকলেন, ঈশ্বর তাঁকে অন্যান্য নবীদের চাইতেও উঁচু ও সম্মানজনক স্থানে বসিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁকে দ্বিগুণ সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। তাঁকে পাঠানো হয়েছে সর্বশেষ নবী এবং চূড়ান্ত বার্তাবাহক হিসেবে। এই দাবির যুক্তিটি ছিল সোজাসাপ্টা। তিনি নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পৃথিবীর শেষ সময় সন্নিকটে; কেয়ামত এবং বিচার দিবস আসন্ন ছিল, সুতরাং ঈশ্বরের আর কোনো বার্তাবাহককে নিযুক্ত করার দরকার নেই। তিনি হচ্ছেন এই মতবাদের ইমারতের শেষ এবং চূড়ান্ত ইষ্টক স্বরূপ (২)।
একপর্যায়ে তিনি তাঁকে “ঈশ্বরের প্রেরিত রাসুল” হিসেবে প্রচার করা শুরু করেন। যথাযথভাবে তাঁর অনুগামীরা তাঁকে সেভাবেই সম্বোধন করছিলেন। যখন তারা তাঁর সাথে কথা বলতেন, তাঁকে সম্বোধন করতেন ইয়া রাসুলাল্লাহ বা “ও আল্লাহর রাসুল” বলে। এটা অনেকটা রাজাদের উপাধির মতো, যেমন তাদেরকে ডাকা হয় “মহামান্য” বলে, ঠিক সেরকম। পরবর্তীতে এটি তাঁর প্রতি বিশ্বাস ঘোষণার অংশ হয়ে যায়, এবং ইসলামের প্রথম স্তম্ভ হয়ে যায়; তাঁর উপর বিশ্বাস আনা, যার মাধ্যমে ইশ্বরের ইচ্ছার প্রতি সমর্থন করা হয়, যাতে বলা হয় তিনি এবং একমাত্র তিনি একাই এই সর্বশেষ নবীর সম্মান পেয়েছেন। সর্বশেষ নবীর উপাধি পাওয়ার আগে বা প্রাথমিক যুগে যে কাউকে ধর্মগ্রহণ করতে হলে শুধুমাত্র মুহাম্মদের ধর্মের সদস্য হতে হতো, শুধু মোহাম্মদের হাতকে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে একটি সহজ বক্তব্য বারবার বলতে হত যে, “আমি ঘোষণা করছি, ঈশ্বর ব্যতীত কোন উপাস্য নেই”। কিন্তু মুহাম্মদের মর্যাদায় উন্নতি ঘটবার পর বিবৃতিতে এখন তাঁর বিশেষ ভূমিকাটিও যুক্ত করা হয়েছে। এরপর থেকে ধর্মান্তরিত হতে গেলে ব্যক্তিকে বলতে হতো, “আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ তাঁর রাসুল” (৩)।
মক্কাবাসীরা তাঁকে নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। এই সতর্ককারী-নবী ছিল তাদের জন্য বিপজ্জনক এবং ধ্বংসাত্মক। তাদের এই উদ্বিগ্নতার কারণ ছিল, তিনি অনেক যুবকদের মোহিত করছেন এমনভাবে যে, তাঁরা নিজেদের পরিবারের প্রতিই বৈরী হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মান্তরিত হওয়ার পর বাবা-মাকে বলছে যে, সে এখন থেকে তাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না, কারণ তাঁরা মূর্তিপুজা করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য যেকোন উপাসনা করাই হচ্ছে মস্তবড় পাপা!
মুহাম্মদ তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এটি আসলে ঈশ্বরের আদেশ; যারা মূর্তিপূজা করে তাদের সাথে মেলামেশা করা উচিত নয়। এমনকি, তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কও রাখা যাবে না। মক্কাবাসীরা মুহাম্মদকে যেহেতু হত্যা করতে পারছিল না তাই তারা তাঁর অনুসারীদের মধ্যে যারা কোনো গোত্র থেকে নিরাপত্তা পেত না, কোন গোত্রের সাথে যোগাযোগও ছিল না, তাদের উপরেই আক্রমণ করে মনের ঝাল মেটাত।
রাখাল বালক আব্দুল্লাহ বিন মাসুদ মন্দিরের বাইরে সাহস করে কিছু কোরআন আয়াত শোনানোর পরে তাঁকে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছিল। সেই সময়ে তিনি আরও কয়েকজন তরুণ ধর্মান্তরিতদের সাথে আরকামের বাড়িতে থাকতেন। তাদের মধ্যে একজন একটি পরামর্শ নিয়ে এসেছিল, যদি কোরানের একটি অধ্যায় মন্দিরে গিয়ে কেউ পড়েন, তাহলে হয়ত মক্কাবাসীরা তাদের মতো বিমোহিত হবে এবং বুঝতে পারবে এটা নিশ্চয় আল্লাহর বাণী যা জিব্রাইলের মাধ্যমে মুহাম্মদের কাছে আসে। তবে এমন একজনকে এই কাজটি করতে হবে যার গোত্রগত সুরক্ষা আছে এবং যিনি মক্কার উল্লেখযোগ্য পরিবারের সদস্য। কেউ যখন চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেনি, তখন মাসুদ স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এগিয়ে আসেন। তাঁর বন্ধুরা তাঁকে বিরত করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি একজন দাসীর পুত্র ছিলেন, তাঁর কেউ ছিল না এবং সম্ভবত তাঁর উপর আক্রমণ করা কোনো ব্যাপারই না। এক্ষেত্রেও তাই হল। এটা প্রমাণিত ছিল যে, চারণ কবিরা প্রায়শই টাকার জন্য মক্কায় জনসমাগম করতেন। সুতরাং মন্দিরের সামনে কবিতা আবৃত্তি করার দৃশ্য অস্বাভাবিক ছিল না। যাইহোক, যেই মুহূর্তে মক্কাবাসীরা বুঝতে পারল যে মাসুদ মুহাম্মদের লোক এবং তিনি তাঁর আয়াত তেলাওয়াত করছেন, তখন তাঁর চারপাশে জনতা জড়ো হতে থাকল। মাসুদকে মারধর করে তাঁর নাক দিয়ে রক্ত বের করে দিল। মাসুদ তাঁর রক্তাক্ত নাক নিয়ে গর্বিত হয়ে আরকামের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন (৪)।
এমনকি কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের ধর্মান্তরকারীরাও জনসাধারণের বিক্ষোভ থেকে রেহাই পায়নি। আবু বকর ও তাঁর চাচাত ভাই বণিক তালহা উবায়দুল্লাহ (Talha Ubaydullah) উভয়কেই একসাথে রাস্তায় বেঁধে পেটানো হয় (৫)। তালহার মা মুহাম্মদকে ত্যাগ করার জন্য তাঁর ছেলেকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু যখন তিনি ব্যর্থ হলেন তখন তিনি মক্কাবাসীদের তাঁকে একটি শিক্ষা দেয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন। ইতিহাসে পাওয়া যায় যে, নাওফাল খুয়ালিদ (Nawfal Khuwaylid) (৬) নামে খাদিজার এক ভাই ছিলেন, যিনি মুহাম্মদের ঘোর শত্রু ছিলেন। তিনি তালহা ও আবু বকরকে একসাথে বাঁধেন এবং তাদের ধাক্কা দিয়ে মক্কার রাস্তায় নিয়ে যান। সেখানে বিক্ষুদ্ধ জনতা তাদের দাড়ি ধরে পিটিয়েছিল। তালহার মা ছেলেকে ক্রমাগত বেত্রাঘাত এবং অভিশাপ দিতে থাকেন 'হাশিমি বংশের লোক' এর অনুসারী হওয়ার জন্য (৭)। যুদ্ধবন্দিদের মতো তাদেরকে দিয়ে শহরে প্রদক্ষিণ করানো হয়, তারপর শহরের বাইরের একটি রাস্তায় তাদের ফেলে রেখে চলে যায় ।
অন্যদেরকে পারিবারিক সম্পর্কের কারণে শারীরিকভাবে শাস্তি না দিতে পারলেও জনসাধারণের অবজ্ঞার কারণে তাঁরা গোত্রছাড়াই ছিলেন। মক্কাবাসী নেতাদের মধ্যে একজন আবুল হাকাম মুহাম্মদকে হত্যা করার জন্য আবু তালিবের অনুমতি চেয়েছিলেন। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, উচ্চবংশের কেউ একজন মুহাম্মদের ধর্মকে গ্রহণ করেছে, তখন তিনি প্রকাশ্যে তাঁর মুখোমুখি হলেন এবং তাঁর পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করার জন্য তাঁকে নিন্দা করলেন। তিনি বললেন, “আমরা আপনাকে একটি মোটা মাথার লোক হিসেবে ঘোষণা করব এবং আপনাকে বোকা হিসেবে পরিচিত করব এবং আপনার খ্যাতি নষ্ট করব”। কোনো ধর্মান্ধরিত বেঈমান ব্যক্তি যদি বণিক হতেন, তাহলে আবুল হাকাম তাঁকে সর্বশান্ত করে রাস্তায় ভিক্ষা করতে বাধ্য করতেন। আর যদি নিচু শ্রেণীর মানুষ অথবা দাস শ্রেণীর কেউ হতো, তাহলে তাঁকে তিনি পরাস্ত করে ছাড়তেন (৮)।
প্রতিটি নতুন দলত্যাগের সাথে সাথে মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি মক্কার ঐক্যকে খর্ব করছিলেন। আবুল হাকাম, যিনি তাঁর উদারতা, যুদ্ধে সাহসিকতা এবং একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সাফল্যের জন্য তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন, তিনি মনে করতেন মুহাম্মদ তাদের 'সংস্কৃতি ধ্বংস' করেও পার পেয়ে যাচ্ছে! তিনি এতটাই পাগল হয়ে উঠেছিলেন যে, মুহাম্মদকে যদি মন্দিরের সামনে আবারও প্রার্থনা করতে দেখেন, তাহলে তাঁর মাথায় লাথি দিয়ে বের করে দেয়ার হুমকি দেন। গল্পের একটি সংস্করণে পাওয়া যায়, তিনি পাথর দিয়ে মুহাম্মদের মাথা ফাটিয়ে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। মুহাম্মদ যখন এই হুমকির কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং মন্দিরের দিকে ছুটে আসেন। ক্রোধে মুহাম্মদ এতটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, যাওয়ার পথে তিনি বারবার ধাক্কা খাচ্ছিলেন। তবে মন্দিরে পৌঁছে তিনি একবারে ঠান্ডা হয়ে গেলেন। তিনি আর সহিংসতায় জড়াতে চাইছিলেন না যতটা না তাঁর বিরোধিরা চেয়েছিল, কারণ তিনি জানতেন তিনি সহিংসতায় জড়ালে তাঁর উপর থেকে হাশিমি গোত্র সমর্থন তুলে নিতে পারে এবং শত্রুদের প্রতিশোধকে সমর্থন করতে পারে। তিনি কেবল মন্দিরে গিয়ে উচ্চস্বরে কোরানের আয়াত তেলাওয়াতের (পাঠের) মধ্যেই নিজের কর্মকাণ্ড সীমিত রেখেছিলেন, যদিও এটাও আবুল হাকাম এবং মন্দিরের অর্ধবৃত্তাকার পাটাতনের উপর বসে থাকা অন্যান্য নেতাদের ক্ষুব্ধ করছিল (৯)। মুহাম্মদ এভাবে তাদের গায়ের সাথে একেবারে লেগে থাকতেন এবং তাদের বিরক্ত করাটাকে উপভোগ করতেন। যেহেতু তিনি অতিরিক্ত আগ্রাসন এবং অস্বাভাবিক সহিংসতায় জড়াতে পারতেন (যা পরে আসবে) তাই একটি নিষ্ক্রিয়-আক্রমণাত্মক উপায় বেছে নিয়েছিলেন, যদ্দারা তাদেরকে ক্ষুব্ধ করে তিনি তাঁর ক্রোধ প্রশমন করতেন। এ পরিস্থিতির মধ্যে তিনি তাদেরকে দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ম মেনে ওযু করেন এবং মনোযোগ দিয়ে সালাদ আদায় করেন। এটি ছিল তাঁর মতো করে তাদের প্রতি চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করা বা জ্বালাতন করা, কারণ তিনি জানতেন যে তারা তাঁকে দেখছে। তিনি সকালে মাসুদকে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে আসতেন, যে ছিলেন তাঁর খুবই অনুগত। আবহাওয়া ভালো থাকলে এই সময়টিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মক্কাবাসীরা এই জায়গায় একত্রিত হতো এবং নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করত ও বিশ্রাম নিত। সাবেক রাখাল বালক মাসুদ এক জগ জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন যাতে মুহাম্মদের প্রতিটি প্রদেক্ষপ মেনে ওযু সম্পন্ন হয়। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে কিছু আয়াত আবৃত্তি করে প্রার্থনা শুরু করতেন, অবশেষে রুকু এবং সেজদার মধ্য দিয়ে শেষ করতেন।
সেখান বসে থাকা মক্কাবাসীরা ক্ষোভ ও ক্রোধের মিশ্রণ নিয়ে তাঁর এই প্রার্থনা অবলোকন করত। তাদের ক্ষোভ আরো অতিমাত্রায় বেড়ে যেত এটা ভেবে যে, মুহাম্মদ তাদের জীবনযাত্রার সবচেয়ে বড় প্রতীকের সামনে এসব অপমানজনক কাজ করছেন। মন্দিরটি শুধুমাত্র তাদের বিশ্বাসের সাক্ষ্যই ছিল না, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছিল। দশকের পর দশক, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, তীর্থযাত্রীরা তাদের অনেক দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে এই পবিত্রভূমিতে আসতেন এবং তারা দেবতার কাছে বিভিন্ন বিষয়ে নালিশ করতেন। পবিত্র প্রাঙ্গনে সবসময় শতশত মূৰ্তি ছিল এবং এটি ছিল তাদের সহিষ্ণুতারই নিদর্শন। মুহাম্মদ পবিত্র ভবনের সামনে তাঁর নতুন ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে অসহিষ্ণুতা প্রদর্শন করছে যা তাদের জন্য অপমানজনক। একদিন আবুল হাকামের ক্ষোভ আর ঘৃণা বেড়ে গেল। তিনি মন্দিরের পাটাতনে পাথরের বেদীতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মক্কাবাসীদের সাথে বসেছিলেন। তাঁর সাথে বসে ছিলেন মুহাম্মদের অন্যতম প্রতিবেশী উমাইয়া বংশীয় উকবাহ মুয়াইত (Uqbah Muayt), এবং সম্ভবত তিনি মুহাম্মদের দরজায় মলত্যাগকারীদের মধ্যে একজন। সে মুহাম্মদের উপর পাথর নিক্ষেপে অংশ নিয়েছিল, যার ফলে মুহাম্মদ আরকামের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। উমাইয়া খালাফ গুরুত্বপূর্ণ বনেদি ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের সাথে আরও ছিলেন রাবিয়ার ভাই উতবা, শায়বা এবং কয়েকজন উল্লেখযোগ্য মক্কাবাসী। মুহাম্মদ সেদিন সকালে তাঁর দাস মাসুদ ও তাঁর মেয়ে ফাতিমাকে নিয়ে মন্দিরে এসেছিলেন, যার বয়স তখন প্রায় দশ বছর। মুহাম্মদ পবিত্র হবার জন্য ওযু করছিলেন। আবুল হাকাম উকবাকে পাঠান সম্প্রতি জবাই করা উটের নাড়িভুঁড়ি আনতে। মুহাম্মদ যেই তাঁর প্রার্থনা শুরু করলেন লোকেরা মন্দিরের পাটাতন থেকে নেমে আসে এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, উকবাহ উটের এই নাড়িভুঁড়ি মুহাম্মদের পেছনে ছুঁড়ে মারছে। এই দৃশ্য দেখে সবাই হাসিতে ফেটে পড়ল, এমনকি একে অন্যের উপর ঢলে পড়ল। প্রাক্তন রাখাল ছেলে মাসুদের পক্ষে কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। তিনি যুবক ছিলেন এবং দেখতে অনেকটা হালকা গড়নের ছিলেন। তিনি উকবাহ মুয়াইতের পশুর পাল দেখাশোনা করতেন, তাই তাঁকে ভয় পেতেন।
মুহাম্মদের মেয়ে ফাতিমা এটি দেখে রেগে গেল। সে তাঁর বাবার পিঠ থেকে উটের নাড়িভুঁড়িগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল এবং তাদের নিষ্ঠুর কৌতুকের জন্য লোকগুলিকে অভিশাপ দিল। কিন্তু মুহাম্মদ তাঁর প্রার্থনা চালিয়ে গেলেন। নিখুঁতভাবে করাটাই ছিল সবকিছু, এবং তিনি তাঁর প্রার্থনা শুরু করেছিলেন তা সম্পন্ন করতে হবে যাতে আল্লাহর চোখে মূল্য থাকে। তারচেয়েও বড় কথা, তিনি রাগ দেখিয়ে তাদেরকে সন্তুষ্টি দিতে চাননি। তবে এটাও সত্য, তাঁর ভেতরকার ক্রোধ ক্রমশ উদগীরণের অপেক্ষায় ছিল। ইসলামিক সাহিত্য থেকে এটা পরিষ্কার যে, তাঁর চাপা মেজাজ ছিল। যখনই তিনি অত্যন্ত রেগে যেতেন তখনই তাঁর কপালের মাঝখানে একটা শিরা ফুলে উঠত। মুহাম্মদ তাঁর প্রার্থনা শেষ করে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তিনি মন্দিরের দিকে তাকিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে চিৎকার করে বললেন, “হে আল্লাহ, কুরাইশদের ধ্বংস কর”। তিনি প্রত্যেক লোকের জন্য একই দোয়া করতে লাগলেনঃ “হে আল্লাহ, আবু জাহলকে (আবুল হাকাম) ধ্বংস কর! হে আল্লাহ, উকবাহ মুয়াইতকে ধ্বংস কর। হে আল্লাহ, উমাইয়া খালাফকে (Umayya Khalaf) ধ্বংস কর। হে আল্লাহ, উতবা রাবিয়াকে (Utba Rabia) ধ্বংস কর!” এভাবে বলতেই থাকলেন যতক্ষণ না তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেন (১০)। তিনি বলেন, “মহান আল্লাহর ক্রোধ সেই লোকদের উপর, যারা তাঁর রসুলের উপর এই কাজ করেছে”।
মক্কার নেতারা হাল ছাড়েননি। এর কিছুক্ষণ পরেই মুহাম্মদ আবার মন্দিরে উপস্থিত হন, এবার কালো পাথরের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করেন, চুম্বন করেন। প্রতিবার প্রদক্ষিণ করার সময় তাঁকে মক্কাবাসী গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অতিক্রম করতে হচ্ছিল যারা ওখানে একত্রিত হয়েছিলেন। যখনই তিনি পাটাতনের কাছে আসতেন, তাদের মধ্যে থেকে একজন লোক জোরে তাঁর সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্য করত যাতে তিনি শুনতে পান। একবার ঘোরা শেষ করে মুহাম্মদ তাদের সামনে থামলেন এবং তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “আপনারা কি আমার কথা শুনছেন, হে কুরাইশ? আমার জীবন যার হাতে, তোমাকে জবাই করতে আমি তাঁকেই আনবো!” তিনি এত শীতলভাবে সেই হুমকি দিয়েছিলেন যে, সবাই চুপ করে রইল। অবশেষে তাদের মধ্যে একজন সমঝোতার সুরে বলে উঠলেন, “তুমি বুদ্ধিমান হও না কেন, আবুল কাসিম? তুমিতো কখনো বোকার মতো আচরণ করনি!” (১১)। তিনি চলে যাওয়ার পর মক্কাবাসীরা তাঁর দেয়া হুমকি নিয়ে আলোচনা করে এবং তাঁর উপর আগের চেয়ে অধিক ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
তাঁর কোনো কারণ ছিল না তাদেরকে ভয় প্রদর্শন করার। মুহাম্মদের প্রতি তাদের আচরণও আসলে কোন সমস্যা ছিল না, বরং সমস্যা করছিলেন তিনি নিজে। মুহাম্মদই বরং মন্দিরের দেবতাদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন; তিনিই তাদের জীবনযাত্রাকে উপহাস করেছিলেন; তিনিই তাদের বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করেছেন এবং জাহান্নামের হুমকি দিয়ে অপমান করেছিলেন। আর এখন তিনি আবার তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন, কারণ তিনি যা প্রচার করেছেন তা তাঁরা পছন্দ করে না। তিনি ইতোমধ্যেই তাদের সমাজিক বন্ধনের অনেক ক্ষতি করেছেন, উপরন্তু তিনি এখন আবার হুমকিও দিচ্ছেন! পরদিন মুহাম্মদ যখন স্বাভাবিকভাবে নামায আদায় করতে আসেন তখন মক্কার নেতারা তাঁকে ঘিরে ধরেন। তাদের মধ্যে একজন তাঁর কলার ধরে শ্বাসরোধ করার উপক্রম করে, এবং সম্ভবত অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত যদি আবু বকর তাদের মাঝখানে না চলে আসতেন। তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল যে, মুহাম্মদ বিপদের মধ্যে আছেন। তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং বললেন, “আল্লাহ আমার প্রভু, একথা বলার জন্য কি তোমরা একজনকে মেরে ফেলবে?” তিনি পরে স্বীকার করেন, মক্কাবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে খারাপ আচরণ ছিল এটি (১২)।
মুহাম্মদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্নক আচরণ অনেকটা তাঁর পক্ষেই কাজ করেছে। আরেকট ঘটনার পর তাঁর এক চাচা তাঁর ধর্ম গ্রহণ করেন। গল্পটিতে দেখা যায় যে, আবুল হাকাম সাফা পর্বতের পাদদেশে হেঁটে যাচ্ছিলেন। মুহাম্মদ সম্ভবত সেখানে একটি পাথরের উপর বসেছিলেন অথবা ওপর দিক থেকে আসছিলেন। আবুল হাকাম তাঁর উপর রেগে গেলেন এবং এত উচ্চস্বরে তাঁকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন যে, আশপাশের লোকজন তাদের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছিলেন। তারপর যখন ক্রোধ কমে এলো, আবুল হাকাম মন্দিরে পাটাতনে গিয়ে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে বসলেন। এর অল্পক্ষণ পরেই মুহাম্মদের চাচা হামজা শিকার থেকে ফিরে আসেন। তাঁর ধনুকটি তাঁর কাধের উপরই ছিল। তিনি একজন খ্যাতনামা শিকারি ছিলেন, যিনি তাঁর দিনের অর্ধেক শিকার করে আর বাকি অর্ধেক মক্কায় মদের দোকানে ফুর্তি করে কাটাতেন। তিনি খুব শক্তিশালী এবং বদমেজাজি ছিলেন। সাধারণত যখন তিনি তাঁর সর্বশেষ শিকার থেকে শহরে ফিরে আসতেন, তখন তিনি তাঁর ঘোড়া আর উটটিকে মন্দিরের বাইরে বাঁধতেন। শিকারের জন্য দেবদেবীদের ধন্যবাদ দিয়ে সাতবার মন্দির প্রদক্ষিণ করে কালো পাথরে চুম্বন করতেন। তবে এবার তিনি মন্দিরে যাওয়ার আগেই এক দাসী তাঁকে থামায়, আর মুহাম্মদকে আবুল হাকাম কি বলেছিল তা বলে দেয়। একথা শুনে তিনি প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি দ্রুতগতিতে মন্দিরের দিকে এগিয়ে এক লাফ দিয়ে আবুল হাকামের মাথায় তাঁর হাত থাকা ধনুকটি দিয়ে আঘাত করলেন। আর চিৎকার করে বললেন, “তুমি কি আমাকেও আঘাত করবে যদি আমি তাঁর ধর্ম অনুসরণ করি? এবং সে যা বলে তা বলি? পারলে আমাকে আঘাত করো!” আবুল হাকামের সাথে মাখজুম গোত্রের বেশ কয়েকজন লোক বসেছিলেন। তাঁরা হামজার পায়ের কাছে লাফ দিয়ে পড়লেন, কিন্তু আবুল হাকাম দুরেই বসে রইলেন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “তাঁকে একা থাকতে দাও, কারণ ঈশ্বরের কসম, আমি তাঁর ভাতিজাকে অনেক অপমান করেছি”। হামজা, যিনি পূর্বে মুহাম্মদের ধর্ম সম্পর্কে বেশ উদাসীন ছিলেন, তিনি তাঁর কাছে গিয়ে বিশ্বাস ঘোষণা করলেন। এই ধর্মান্তকরণের মাধ্যমে মুহাম্মদ একজন ভয়ঙ্কর মিত্র লাভ করলেন (১৩)।
এই ঘটনার পর মক্কার নেতারা মুহাম্মদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে নরমপন্থা অবলম্বন করে। এর কিছুদিন পরেই উতবা ইবনে রাবিয়া শান্ত এবং যুক্তিবাদী কণ্ঠে তাঁর সাথে কথোপকথন শুরু করেন, যাতে তিনি তাঁর বিভেদমূলক আচরণগুলো পরিবর্তন করতে রাজি করাতে পারেন। এর জন্য তাঁর রাগকে প্রশমিত করে ফেলতে হয়েছিল, কারণ তাঁর এক পুত্র আবু হুযাইফা মুহাম্মদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি তাঁর পিতার বিশ্বাসকে নিন্দা জানিয়েছিলেন এবং সাফ জানিয়েছিলেন যে, বাবার সাথে আর কোন সম্পর্ক নেই। মুহাম্মদকে মন্দিরের দিকে পিঠ দিয়ে একা বসে থাকতে দেখে উতবা (Utba) সেই পাটাতন থেকে নেমে আসেন যেখানে তিনি অন্যান্য নেতাদের সাথে বসে ছিলেন এবং এরপর মুহাম্মদের পাশে বসলেন। তিনি কথোপকথন শুরু করলেন মুহাম্মদের প্রশংসা করে যে, তাঁর জন্ম সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে এবং এরপর তাঁর পূর্বপুরুষদের নানান ভালো দিক তুলে ধরেন। কিন্তু তিনি তারপর বললেন যে, মুহাম্মদ শেষ পর্যন্ত তাঁর সম্প্রদায়কে বিভক্ত করছেন। উতবা বলেন, তাঁর এহেন কর্ম তাঁর সহকর্মী বা সহযোদ্ধা মক্কাবাসীদের উদ্বিগ্ন এবং বিষণ্ণ করে তুলছে। ইসলামিক সাহিত্যে বলা হয়েছে যে, উতবা একটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিলেন। প্রস্তাবটি হচ্ছে, মুহাম্মদ যদি চান এবং মক্কাবাসীর দেবতাদের অভিশাপ দেয়া বন্ধ করেন তবে মক্কার নেতারা তাঁর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে প্রস্তুত। এভাবে তিনি লাভজনক বিনিয়োগের সুযোগ পেতে পারেন। যদি তিনি নেতৃত্ব চান তাহলে তারা তাঁকে মক্কাবাসীর রাজপুত্র বানাতে প্রস্তুত, এমনকি তাঁকে মক্কাবাসীদের সবার উপর রাজা হিসেবে স্থাপন করতেও তাঁরা রাজি।
তবে বেশিরভাগ পশ্চিমা পণ্ডিতরা এই প্রস্তাবগুলোকে সঠিক নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সে সময় মুহাম্মদ তাদের অস্তিত্বের হুমকির চেয়ে তাদের কাছে বিরক্তিকর বেশি ছিলেন। উতবা সম্ভাব্য আরেকটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন, এবং তা হচ্ছে, মক্কাবাসী তাঁর বিভ্রম দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত চিকিৎসা খরচ বহন করতে রাজি আছেন। মক্কাবাসীরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে, মুহাম্মদ যা করছে তা আসলে তাঁর উপর ভর করে থাকা খারাপ জ্বিনের প্রভাবেই করছে। মন্দির পুনর্নির্মাণের সময় তাঁকে অচৈতন্য অবস্থায় এবং মুখে ফেনা দেখে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই ধারণা সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। জিন ছিল অদৃশ্য সত্ত্বা যা মানবজাতির সাথে সহাবস্থান করত। তারা মানুষের জন্য সহায়কও হতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা বিদ্বেষপূর্ণ। তাঁরা মানুষের জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে যদি তাঁরা কারো মন দখল করতে সক্ষম হতো। আর মুহাম্মদের সাথে থাকা জিন তাঁর মনের দখলে নিয়েছিলেন, এটা অনেকটা নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছিল। উতবার পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল এভাবেঃ “যদি এই ভুত যা আপনার সাথে আছে বা যা আপনি দেখতে পাচ্ছেন, আপনি তাঁর থেকে মুক্তি পেতে না পারেন। আমরা আপনার জন্য একজন চিকিৎসক খুঁজে বের করব এবং আপনাকে সুস্থ করার জন্য আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করবো, কারণ প্রায়ই একটি পরিচিত আত্মা একজন মানুষের উপর দখলদারিত্ব কায়েম করে যতক্ষণ না সে সুস্থ না হয়”। মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের থেকে জিনকে তাড়ানোর জন্য সেরা তান্ত্রিকদের খুঁজে বের করতে সারাদেশ চষে ফেলল। এমনকি তাঁকে সুস্থ করার জন্য যদি সিরিয়া, ইয়েমেন, আবিসিনিয়া গিয়ে কাউকে খুঁজে বের করার প্রয়োজন হয়, তাতেও তাঁরা রাজি! (১৪)।
মুহাম্মদ ধৈর্য ধরে উতবার কথা শুনলেন। কথা শেষ হলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি এখন আমার কথা শুনবেন?” এটা বলেই তিনি তাঁর সাম্প্রতিক একটি রচনা আবৃত্তি করেন, যা তাঁর পূর্ববর্তী রচনার প্রশংসা দিয়ে শুরু হলো “পরম করুণাময় অসীম দয়ালুর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত। এমন এক কিতাব, যার আয়াতগুলো জ্ঞানী কওমের জন্য বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কুরআনরূপে আরবী ভাষায়। সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী” (১৫)।
মুহাম্মদ এরপর নিজেকে একটা অবনমিত অবস্থানে নিয়ে গেলেন যা তাঁকে নিজের কণ্ঠে কিছু কথা বলার সুযোগ করে দেয়। তিনি উতবার দিকে ফিরে তাকিয়ে আবার বললেন, “বল, "আমি কেবল তোমাদের মত একজন মানুষ। আমার কাছে ওহী পাঠানো হয় যে, তোমাদের ইলাহ কেবলমাত্র এক ইলাহ। অতএব তোমরা তাঁর পথে দৃঢ়ভাবে অটল থাক এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাও” (১৬। তারপর আবার তিনি ঈশ্বরের কণ্ঠের অবস্থানে চলেন গেলেন এবং তিনি যেই কথাটি বারবার বলে আসছিলেন তা আবৃতি করলেন যে, মক্কাবাসীরা মূলত ঈশ্বরকে নয়, বরং ঈশ্বরের সৃষ্টির উপাসনা করে। “তোমরা না সূর্যকে সিজদা করবে, না চাঁদকে। আর তোমরা আল্লাহকে সিজদা কর যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন” (১৭)।
উতবা অবাক হয়ে গেলেন। তিনি মুহাম্মদের পাশে এসে বসেছিলেন, তিনি যে মক্কাবাসী সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন সেই বিষয়ে নম্রভাবে আলোচনা করতে। কিন্তু আলোচনার পরিবর্তে তিনি তাঁকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিলেন, যার ফলে তিনি আর কথা বাড়াতে পারেননি। ইসলামিক সাহিত্যে এই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় এবং দাবি করা হয়, উতবা এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে জোর করে সেখান থেকে বের করে নিয়ে যায় এবং বলেঃ “তাঁর জিহ্বার মধু দিয়ে সে তোমাকে মুগ্ধ করেছে!” (১৮)
মুহাম্মদের ধর্মতত্ত্বের প্রভাব থেকে মক্কাবাসীরা মুক্তই থেকে গেল। একবারের জন্যও কেউ তাদের সর্বোচ্চ দেবতার অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক করেনি। তারা জানতেন মহান পালনকর্তা আছেন, কিন্তু তিনি থাকেন দূরবর্তী এবং অজানা জায়গায়। শুধুমাত্র তাঁর কন্যা বা হুবাল এবং অন্যান্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমেই তাঁর কাছে যাওয়া যায়। “আল্লাহ" শব্দটি তাদের ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ ছিল। প্রকৃতপক্ষে, বহুশ্বরবাদীরা তাদের সন্তানদের নাম রাখতেন আবদুল্লাহ, যার অর্থ দাস বা আল্লাহর দাস। মুহাম্মদের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল এক জায়গায়, আর তা হলো, আল্লাহ ছাড়াও মক্কাবাসীরা যেসব দেবতাদের পুজা করতেন, মুহাম্মদ সেসব দেবতাদের স্বীকার করতেন না। তারা মুহাম্মদের দ্বারা তাদের দেবদেবীদের এই 'ভুল চরিত্রকরণে' ক্ষুব্ধ ছিল। তিনি তাদের 'মুর্তিপূজক' বলে অভিহিত করেছেন, যেন তাঁরা বিশ্বাস করত যে এই মূর্তির মাঝে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আছে। অবশ্যই এমন ধারণা করার মতো লোক মক্কায় ছিল, তবে মক্কার বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত মানুষ যারা ছিলেন তাঁরা মনে করতেন, এই পাথর অথবা কাঠের মূর্তি শুধুমাত্র সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করছে, তাদের নিজেদের কোন ক্ষমতা নেই। আল-উজ্জার পাথরের মূর্তির সামনে তাঁরা যখন প্রার্থনা করছেন বা কোন কিছু উৎসর্গ করছেন তখন তারা সেই পাথরের না বরং এই মূর্তিগুলো যে ঈশ্বরের প্রতিনিধিত্ব করছে তারই উপাসনা করছেন। আল্লাহ কিভাবে আল-উজ্জার কাছে প্রার্থনা করাতে কোন অপরাধ খুঁজে পাবেন, যাকে তিনি জীবনশক্তির আধার হিসেবে সৃষ্টি করেছেন? আল উজ্জাকে দেখতে, অনুভব করতে এবং তাঁকে নিয়ে চিন্তা করতেই বা কেন তা দোষের হবে? আল্লাহ কিভাবে রেগে যাবেন আল-লাত দেবতাঁকে উপাসনা করলে যিনি ছিলেন ভালোবাসার দেবী, গাছপালা, পশু থেকে শুরু করে মানুষ যাদের বংশবৃদ্ধি তাঁর কৃপায় হয়? অথবা আল্লাহ কিভাবে রেগে যাবেন পবিত্র হুবাল দেবতাকে পূজা করলে, যিনি তাদের যুদ্ধে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন, যিনি তাদেরকে পথনির্দেশ দিয়েছেন? হুবাল কি আল্লাহর পুত্র ছিল না? যদি কেউ পিতার সামনে তাঁর ছেলের প্রশংসা করে তবে কি পিতা অপমানিত হবেন বা রেগে যাবেন? মক্কার নেতারা মুহাম্মদকে এটি মক্কায় শান্তি ফিরিয়ে আনার স্বার্থে তাঁর যেন বোধের উদয় হয় সে ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন এবং উতবার প্রস্তাবটিও তাঁর সামনে বারবার তুলে ধরতে থাকলেন। মক্কার এক ডজনেরও বেশি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মুহাম্মদের কাছে বার্তা পাঠালেন যে, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে তাঁর সাথে কথা বলতে আগ্রহী। তিনি তাদের সামনে দেখা দিলেন এবং মন্দিরের পাশের পাটাতনে এসে বসলেন। নেতারা শান্তভাবে কথাগুলো আবার বলতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, ইতিপূর্বে কোন আরব তাঁর নিজের আত্মীয়দের সাথে এমন আচরণ করেনি যা তাঁরা মুহাম্মদের সাথে করছে, এবং তাঁরা মুহাম্মদকে টাকা ও ক্ষমতা প্রদান করবেন যদি তিনি তাঁর ধর্মপ্রচার করা থেকে বিরত থাকতে সম্মত হন। একইসাথে তাঁরা তাঁকে প্রেত্মাতাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদান করারও প্রস্তাব করেন।
মুহাম্মদ আবার তাদের প্রস্তাব খারিজ করে দেন এবং তাদেরকে 'বিপথগামী' বলে অভিহিত করেন। তিনি তাদের বলেন, তাঁর উপর কোন প্রেতাত্মা ভর করেনি। আল্লাহ তাঁকে এমন সব আয়াত পাঠিয়েছিলেন, যা তাদের আধ্যাত্মিক কল্যাণের জন্যই দরকার। যদি তাঁরা আল্লাহর কথা শোনে, তাহলে পরবর্তী জীবনে তাদের জন্য ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা হবে। এমনকি এই জীবনেও তাঁরা সুবিধাভোগী হবে। তাদের শুধু শুনতে হবে এবং আল্লাহর প্রেরিত রসুলকে অনুসরণ করতে হবে।
মক্কাবাসীরা তাঁর এই দাবির প্রমাণ করতে বলেন। কারণ তিনি দাবি করছেন, আল্লাহ তাঁর সাথে ফেরেশতাদের মাধ্যমে কথা বলেছেন। এছাড়া এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ তাঁরা খুঁজে পেলেন না। তাই আবুল হাকাম বলে বসলেন, “আমরা তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করি না, কিন্তু তুমি যা প্রচার করছ তা মিথ্যা বলে বিবেচনা করছি” (১৯)। তাদের মধ্যে একজন প্রস্তাব করেন যে, মুহাম্মদ যেন তাঁর দাবির প্রমাণস্বরূপ তাঁর ঈশ্বরকে দিয়ে মক্কার পাহাড় সরিয়ে নদী সৃষ্টি করে দেয় যাতে তাঁরা কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে পারেন। অথবা যেহেতু মুহাম্মদ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, মৃতদের পুনরুত্থানের ঘটনা ঘটবে তাহলে তাঁর উচিত আল্লাহকে বলে তাদের সবার পূর্বপুরুষ কুসাইকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং তাঁকে মক্কার নেতা হিসেবে ফিরিয়ে আনা। আল্লাহ নিশ্চয়ই মুহাম্মদের জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ এবং তা বাগান ও সোনা দিয়ে পূর্ণ করে দেয়ার অনুরোধেও আপত্তি করবেন না? যদি এগুলো সব সৃষ্টিকর্তার পক্ষে বেশি চাহিদা বলে মনে হয়, তাহলে অন্তত তাঁর স্বর্গদূতকে তাদের সামনে তিনি পাঠাতে পারেন, এতেও তাঁরা বিশ্বাস করবেন। তাও যদি করতে ব্যর্থ হন, তাহলে “আকাশকে আমাদের উপর টুকরো টুকরো করে ফেলা হোক, যেমনটা তুমি দাবি কর যে, তোমার প্রভু চাইলে তা করতে পারেন” তাঁরা বললেন
( 20 ) ।
মুহাম্মদ মাফ চাইলেন। তিনি বললেন, আল্লাহকে অলৌকিক কাজের আহ্বান জানানোর জন্য তাঁকে পাঠানো হয়নি, বরং তাঁকে পাঠানো হয়েছে ঈশ্বরের বাণী পৌঁছে দেবার জন্য। তাঁরা হয় তা “গ্রহণ করে সুবিধা গ্রহণ করতে পারে, অথবা তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে এবং আল্লাহর বিচারের অপেক্ষায় থাকতে পারে” (২১)। যদি তাঁরা যদি সত্যিই কোন অলৌকিক কিছু দেখতে চায় তবে যেন তাঁরা কোরআন শোনে, পরামর্শ দেন মুহাম্মদ। কেননা, কোরআন হচ্ছে সেই মুজিযা বা মিরাকল যা তাঁরা দেখতে চেয়েছিল। মুহাম্মদের প্রথম চাচাত ভাইদের মাঝে একজন, আবদুল্লাহ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আব্দুল্লাহ ছিলেন মুহাম্মদের ফুপু আতিকার ছেলে। তিনি মতামত ব্যক্ত করেন এই বলে যে, “ঈশ্বরের কসম, আমি কখনোই বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমি তাকিয়ে থাকা অবস্থায় তুমি মই দিয়ে আকাশে আরোহণ করো, আর যতক্ষণ না চারজন ফেরেশতা তোমার সাথে এসে বলে যে তুমি সত্য কথা বলছ। আর ঈশ্বরের কসম, এমনকি যদি তুমি করোও, তবুও আমার মনে হয় না আমি তোমাকে বিশ্বাস করব" (২২)।
মুহাম্মদের অনমনীয়তায় হতাশ হয়ে মক্কাবাসীরা তাঁর বদনাম করতে এবং নবীত্বের দাবির সত্যতা সম্পর্কে জানতে ইহুদি যাজকদের সাথে পরামর্শ করেন। মক্কাবাসীরা নবীদের সম্পর্কে কিছুই জানত না, কিন্তু ইহুদিরা জানতেন। তাঁরা নাদের আল- হারিছ (Nader al-Harith) এবং মুহাম্মদের দুষ্টু প্রতিবেশী উকবাহ মুয়াইতকে ইয়াছরিবে পাঠান তাদের নবীদের সম্পর্কে ইহুদি ধর্মীয় যাজকদের (রাব্বি) জিজ্ঞাসা করতে এবং মুহাম্মদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করতে। মক্কা থেকে দুইশ ত্রিশ মাইল উত্তরে অবস্থিত ইয়াছরিব কৃষির মরুদ্যান ছিল, যেখানে প্রায় একহাজার বছর ধরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইহুদি কেন্দ্রভূমি ছিল এবং তিনটি প্রধান ইহুদি গোত্রের বাসস্থান ছিল, যাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব পন্ডিত বা যাজক ছিল। মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের নবী হওয়ার দাবি সম্পর্কে যাজকদের বলেন যে, তিনি ইহুদি নবীদের কথা বলছেন। তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছেন, কিন্তু তিনি ইহুদি নন। তাঁকে পরীক্ষা করার কোন উপায় আছে কি? উত্তরে যাজকরা জানান, তিনি যদি নিজেকে তাদের অন্যতম নবী বলে দাবি করে, তাহলে তিনি আসলে প্রতারণা করেছেন। যাজকদের কাছে তিনটি প্রশ্ন রেডি ছিল যেগুলো ইহুদি নবীদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল না এবং এটি ছিল একটি কৌশল। তাঁরা যেহেতু ইহুদি যাজকদের কাছ থেকে এসেছে এবং এসব প্রশ্ন করছে সুতরাং মুহাম্মদ নিশ্চিতভাবেই, এই প্রশ্ন শুনে উত্তর আবিষ্কার করার চেষ্টা করবেন। যাজকরা মক্কাবাসীদেরকে নির্দেশ দেন এই বলে যে, প্রথমে তাঁকে জিজ্ঞেস করুনঃ “প্রাচীনকালে নিখোঁজ যুবকদের কি হয়েছিল?” এই প্রশ্নটি খ্রিস্টান কিংবদন্তি সেভেন স্লিপারসের (Seven Sleepers) সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
বহুশ্বরবাদী বিশ্বাসের প্রতি অসহিষ্ণুতা, মানুষকে ধর্মান্তরিত করা এবং কোরআনকে আল্লাহর বাণী আর তাঁকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেই জাহান্নামের হুমকি দেয়া ইত্যাদি সব কারণে মক্কাবাসীরা মুহাম্মদকে ঘৃণা করতেন। এখানে একজন নেতৃস্থানীয় মক্কাবাসী ব্যবসায়ী মুহাম্মদের পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করছে, যা দেখে আবার অন্যরা মজা নিচ্ছে!
সাতজন ইফেসীয় খ্রিস্টান ( Ephesians Christian) যুবক রোমান সম্রাট ডেসিয়াসের (Decius) অত্যাচার থেকে বাঁচতে একটি গুহায় লুকিয়ে ছিলেন। তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন এবং দুই শতাব্দী পরে জেগে দেখেন রাজা থিওডোসিয়াসের (Theodocius) রাজত্বকাল চলছে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি হচ্ছে, “একজন শক্তিশালী ভ্রমণকারীর পরিচয় নিয়ে, যিনি পৃথিবীর পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় সীমানায় পৌঁছেছিলেন”। তিনি হচ্ছেন আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, যিনি আরবে যুল কারনাইন (Dhul Qarnayn) নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি পশ্চিমে মিশর থেকে পূর্বে ভারত পর্যন্ত বিশ্বের অধিকাংশ রাজ্য জয় করেছিলেন। শেষ প্রশ্নটি ছিল আত্মার প্রকৃতি নিয়ে, “তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, আত্মা কি জিনিস? যদি তিনি উত্তর দিতে পারেন, তবে তাঁকে অনুসরণ করুন”- বললেন যাজকগণ (২৩)। মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের কাছে এই সবগুলি প্রশ্ন উত্থাপন করে, উত্তর দেয়ার জন্য তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে এবং এ-ও বলে যে, প্রশ্নগুলো ইহুদিদের কাছ থেকে এসেছে, যারা বলেছে যে যদি সত্যিই নবী হয় তাহলে সে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবে। এই মুহূর্তে সাড়া দিতে না পেরে মুহাম্মদ তাদের বলেন যে তিনি পরেরদিন তাদের কাছে ফিরে আসবেন, কিন্তু দিনের পর দিন চলে গেছে এবং তারপরেও তারপরেও মুহাম্মদের পক্ষ থেকে কোন উত্তর এলো না। মুহাম্মদের শত্রুরা গর্ব করতে লাগল যে, অবশেষে তাঁর প্রতারণা উম্মোচন করতে পেরেছে। কিন্তু এর পনের দিন পর মুহাম্মদ কোরানের একটি দীর্ঘ সুরা (অধ্যায়) নিয়ে আসেন যার শিরোনাম ‘গুহা’, যেখানে সেভেন স্লিপার এবং যুল কারনাইন উভয় সম্পর্কেই তাঁর জ্ঞান প্রদর্শন করতে দেখা যায় (২৪)।
তিনি সম্ভবত উত্তর খোঁজার জন্য মক্কার খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের কাছে গিয়েছিলেন, অথবা তিনি হয়তো ইয়াছরিবের যাজকদের কাছে কাউকে পাঠিয়েছেন, যাতে উত্তরগুলো বলে দেয়। সম্ভবত যেটা হয়েছে সেটা হলো, মুহাম্মদের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন অনুপ্রবেশকারী উত্তরগুলো শিখে এসে তাঁকে অবগত করেছিল। আত্মা সম্পর্কে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে তিনি এর উত্তর না দিয়ে বলেনঃ “তাঁরা আপনাকে আত্মা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে। বলুন, আত্মা আমার পালনকর্তার বিষয়, এবং এ বিষয়ে আপনার জ্ঞান খুবই সামান্য” (২৫)।
এভাবে লোকদের প্রশ্নকে তিনি পাশ কাটিয়ে যান। ইহুদি যাজকরাও এ ব্যাপারে আর কোন ব্যাখ্যা দেননি। মুহাম্মদকে অসম্মান করার প্রয়াসে ব্যর্থ হয়ে মক্কাবাসীরা তাঁর অনুসারীদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে, তিনি প্রায় পঞ্চাশজন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অনুসারী অর্জন করেছিলেন যাদের এক তৃতীয়াংশই ছিল ক্রীতদাস বা দাসত্ব থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা যাদের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে নিচুস্তরের মানুষ মনে করা হতো। ইসলামিক সাহিত্যে দাবি করা হয়েছে, মুহাম্মদের প্রতি যেসব ক্রীতদাসেরা সুহানুভূতিশীল ছিল তাদেরকে মক্কাবাসীরা মারধর করেছে, বন্দি করেছে এবং খাদ্য ও জল থেকে বঞ্চিত করেছে। কাউকে কাউকে গরম রোদে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে রাখা হতো, অথবা রাস্তায় তাদের মুখ ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো। অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে অনেকে মুহাম্মদের নিন্দা করত এবং তাঁকে অস্বীকার করত। আম্মার (Ammar) একজন মুক্ত দাস ছিলেন, যার মা সুমাইয়া ( Somaya) ভয়ঙ্কর নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন বলে জানা যায়, এবং তাঁকে পুনরায় তাঁর পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু পরে মুহাম্মদের কাছে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং তাঁর প্রতি তাঁর বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “যতক্ষণ না আমি আপনাকে গালিগালাজ করেছি এবং তাদের দেবতাদের সম্পর্কে ভালো কথা বলেছি ততক্ষণ পর্যন্ত তারা আমাকে ছাড়েনি”। এ ধরণের জোরপূর্বক ধর্মান্ধরকরণের প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ একটি পরিস্থিতিগত ও আত্মরক্ষামূলক আয়াত নিয়ে আসেন, যার ফলে এই ধরনের পরিস্থতিতে বিশ্বাসীরা উপরে উপরে (মন থেকে না) তাদের পুর্বের ধর্মে ফিরে যেতে পারেন এবং তাতে তাঁরা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবেন না (২৬)।
ইসলামিক সাহিত্যে বলা হয়েছে যে, আবু বকরের পর্যাপ্ত রৌপ্যমুদ্রা ছিল যা মুহাম্মদ এবং ধর্মান্তরিত নওমুসলিমদের আরকামের বাড়িতে অবস্থান করার জন্য ব্যয় করা হয়েছিল। যদি তিনি জানতে পারতেন যে, কোন নওমুসলিম ক্রীতদাসের সাথে দুর্ব্যবহার বা তাকে নির্যাতন করা হচ্ছে তাহলে তিনি তাকে তাঁর মালিকের কাছ থেকে কিনে নিতেন। তিনি যেসব ক্রীতদাসকে মুক্ত করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বিলাল (Bilal), যিনি মক্কায় আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত ক্রীতদাসদের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি উমাইয়া খালাফের সম্পত্তি (ক্রীতদাস) ছিলেন। বিলাল তাঁর ধর্মান্তরের ব্যাপারে কোনরকম আপোষ করেননি, যদিও খালাফ (Khalaf) তাকে অনেক মারধর করে। খালাফ একদিন বিলালকে প্রখর রোদে ফেলে রাখেন। তিনি তাঁর বুকে একটি ভারি পাথর রাখেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে সেখানে রেখে যাওয়ার হুমকি দেন। ঠিক এমন সময় আবু বকর সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং বিলালকে তাঁর নিজের একজন ক্রীতদাসের বিনিময়ে ছাড়িয়ে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন যে ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিল। তাঁর সেই দাস খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন, সুতরাং খালাফ মেনে নিলেন। মুক্তি পেয়ে বিলাল আরকামের বাড়িতে থাকা অন্য ধর্মান্তরিতদের সাথে যোগ দিলেন। তবে এ ধরনের চাপ তাদের উপর বেড়েই চলছিল এবং এ বিষয়ে মুহাম্মদের কাছে তাঁরা অভিযোগ করত। একদিন মুহাম্মদ দেয়ালের সামনে তাঁর পিঠ ঠেকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তাঁর অনুসারীদের মধ্যে একজন তাঁর কাছে গিয়ে বলেন, তিনি যেন আল্লাহর কাছে অনুরোধ জানান শত্রুদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার যাতে তারা এই দুর্ব্যবহার থেকে অব্যাহতি পায়। মুহাম্মদ রেগে গিয়ে বলেন, পূর্ব যুগেও মানুষের চামড়া হাড়ের সাথে লেগেছিল অথবা তাদের মাথা কেটে দুই ভাগ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা তাদের বিশ্বাসে অনড় ছিল। তিনি তাদের ধৈর্য ধরতে বলেন, কারণ সেই দিন অচিরেই আসবে যখন আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সকলেই আত্মসমর্পণ করবে, এই ধর্ম সর্বত্র থাকবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে হবে না (২৭)।
তবে মুহাম্মদ তাঁর অনুসারীদের স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে অবশেষে তাদেরকে আবিসিনিয়ায় চলে যাওয়ার (হিজরত করার) অনুমতি দেন। সেখানকার খ্রিস্টান শাসক সহনশীল ছিলেন বলে তাঁর খ্যাতি ছিল। রাখাল বালক মাসুদ, মুহাম্মদের মেয়ে রুকাইয়া এবং তাঁর বর উসমান (Uthman), মুহাম্মদের ফুপাত (পিসতুতো ভাই জুবায়ের এবং আরও ডজনখানেক ধর্মান্তরিত যারা তখন আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। তাঁরা খুব গোপনে এই পরিকল্পনা করে দলবেঁধে দেশত্যাগ করেন, কারণ মক্কাবাসীরা জানতে পারলে হয়তো আটকে ফেলবে এই আশঙ্কা ছিল। তাঁরা আজকের সময়ের জেদ্দার কাছের একটি বন্দরের দিকে যাত্রা করেন এবং সেখানে গিয়ে অর্ধেক দিনার দিয়ে লোহিত সাগর পার হয়ে আফ্রিকার একটি বন্দর আকজুম (Akzum) পৌঁছেন যা ছিল আবিসিনিয়ার রাজধানী। এত সতর্কতা সত্ত্বেও, মক্কাবাসীরা তাদের এই পালিয়ে যাওয়ার খবর ঠিকই পেয়ে যায় এবং লোহিত সাগরের দিকে ছুটে যায়, কিন্তু ইতোমধ্যেই তাদের বহনকারী বাণিজ্যিক জাহাজ বন্দর ছেড়ে চলে গেছে।