ভয় অনেক
লোককে মুহাম্মদের ধর্মে যোগ
দিতে বাধ্য করেছিল। প্রতিমা
বিধ্বংসী অভিযান,
মধ্যরাতের
হত্যাকাণ্ড,
বিদেশী
আদিবাসী নেতাদের হত্যা,
ইহুদিদের
একটি পুরো গোত্রকে বহিষ্কার
করা এই সমস্ত পরিণতির ফলে
ধর্মান্তরিত হওয়া বাড়ছিল।
অন্যদের প্রতি যা করেছিলেন
তাদেরও তিনি সেটাই করবেন,
এই
আতঙ্কে তারা তার হাত ধরতে এবং
বিশ্বাসের ঘোষণা তথা শাহাদা
দেয়ার জন্য মসজিদে এসে দাঁড়াল
এবং পাঠ করল :
আল্লাহ
ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং
মুহাম্মদই তাঁর রাসুল!
ধর্মটি
ছড়িয়ে পড়ছিল,
কিন্তু
মুহাম্মদ কর্তৃক সন্ত্রাসবাদকে
ব্যবহারের একটি বিপর্যয় ছিল
এই যে, এটি
পুরোপুরি নতুন একদল বিরোধী
শ্রেণী আর লোকেদের তৈরি করেছিল
যারা বিশ্বাসী হবার ভান করেছে,
কিন্তু
তারা তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত
করে চলছিল। এই লোকেরা কোরআনের
কথা বলত,
প্রকাশ্যে
ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান মেনে
চলত, কিন্তু
তারা এই ছলনার আড়ালে মুহাম্মদকে
অপদস্থ করার চেষ্টা করছিল।
ইয়াছরিবের শুরুর বছরগুলিতে ওদের কপটতা বুঝতে মুহাম্মদের অসুবিধা হয়েছিল, বা তার অনুসারীদের নিয়োগ যে ভয়ভীতির মাধ্যমে হয়েছিল তাও বুঝতে বিলম্ব হয়েছিল। তিনি তার আয়াত এবং ঐশ্বরিক আদেশের প্রতি নিজের বিশ্বাসের দ্বারা এতটাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলেন যে, অন্যরা যখন তার মতো ভাবত না তখন তিনি তা পছন্দ করতেন না। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, অবিশ্বাসীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য আয়াতের সৌন্দর্যই যথেষ্ট। আয়াতগুলির আত্মা তাদের মধ্যে প্রবেশ করবে, তাদের আত্মারা আলোকিত হয়ে উঠবে এবং তারা ঘটনাস্থলেই বিশ্বাসী হয়ে উঠবে। কিন্তু তারপরে তিনি আবিষ্কার করলেন যে, তার অনুসারীরা ভুয়া ছিল। তারা বিশ্বাসের ঘোষণা দেয়ার আগে তার বিরুদ্ধে যেমন ছিল, এখনো তেমন; কিন্তু এখন তারা তার ধর্মকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এদের মাঝে অর্ধ-ডজনের মতো ইহুদি ছিল, যারা মসজিদে তার উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার জন্য বিশ্বাস স্থাপন করেছিল। এ ধরনের লোকদের চিহ্নিত করা এবং তাদের সাথে মোকাবেলা করা মুহাম্মদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তিনি তাদের “ভন্ড” হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন এবং তাদের তিরষ্কার করে অজস্র আয়াত রচনা করেছিলেন এবং দোযখে তাদের অনন্তকাল শাস্তি ভোগের হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছিলেন।
সমস্যাটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলে, মুহাম্মদ সর্বত্র ভণ্ডামি চিহ্নিত করেছিলেন এবং সময়ের সাথে সাথে তিনি 'ভন্ড' এবং 'ভন্ডামি' শব্দটি কেবল ভুয়া বিশ্বাসী এবং বিপর্যয়কারীদের জন্য নয়, যারা তাকে অর্ধেক বিশ্বাস করত বা সন্দেহ করত তাদের বেলায়ও ব্যবহার করতেন। তার মতে, মোনাফেকরা (ভণ্ড বা কপট) এমন ব্যক্তি ছিল যারা নামাজ এড়িয়ে যায়, অন্য মুমিনদের সম্পর্কে খারাপ কথা বলে, কাফেরদের (অবিশ্বাসী) পক্ষে তর্ক-বিতর্ক করে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং পেছনে পেছনে মোহাম্মদের সমালোচনা করে। মোনাফেক তাঁরাও যারা স্বেচ্ছায় জিহাদ করতে অস্বীকার করেছিল বা যারা কেবলমাত্র মাল লুট করার জন্য লড়াই করেছিল, আল্লাহ বা তার রাসুলের প্রতি ভালোবাসা থেকে নয়। এই তকমাটি সমানভাবে সেই লোকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা মুহাম্মদের কোরআনের আয়াতের তেলাওয়াত (আবৃত্তি) করে শুনেছিল কিন্তু ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকার করেছিল, এবং যে সমস্ত মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েও (ইসলাম গ্রহণ) এবং পরে অবিশ্বাসে ফিরে গেছে, তবে তা (ইসলাম ত্যাগের কথা) সকলের কাছ থেকে তারা লুকিয়ে রেখেছিল। একপর্যায়ে তিনি যেকোন ভিন্ন চিন্তাভাবনা, কথা বা কাজ যা তার শিক্ষাকে মেনে চলত না সেগুলোকে ভণ্ডামি হিসেবেই চিহ্নিত করেছিলেন।
অপরাধীদের মোকাবেলা করার জন্য মুহাম্মদ প্রায়শই দলগত চাপ ও অপমানের মুখোমুখি হন।বলা হয় যে, সমবেত প্রার্থনা চলাকালীন সময়ে তিনি এরকম বেশ কয়েকজনকে খুঁজে বের করেছিলেন। একবার তিনি জানতে পারলেন যে, তারা গোপনে এমন কিছু বলেছেন যার দ্বারা তাদেরকে ভন্ড (মোনাফেক) হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। কি বলার কারণে তাদের ওরকম বলা হয়েছিল, আদিগ্রন্থে তা উল্লেখ করা হয়নি। কেবল বলা হয়েছে যা তিনি তাদের সাথে করেছিলেন সেটাই। ঘটনাটি এমন - একদিন মোহাম্মদ মিম্বার (মসজিদের যে স্থানে দাঁড়িয়ে ইমাম ভাষণ প্রদান করেন) থেকে ঘোষণা করলেন যে, এখানে মোনাফেকরা আছে। হ্যাঁ, ভণ্ড, মোনাফেক! তিনি যা শুনেছিলেন তা প্রকাশ করলেন, তারপরে নাম উল্লেখ না করেই তিনি অপরাধীদের স্বেচ্ছায় তাদের ভণ্ডামি স্বীকার করে এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য দোষী হয়ে দাঁড়াতে বললেন।
যখন কেউ দাঁড়াল না, তিনি তাদের নাম প্রকাশের হুমকি দিলেন; তবে তিনি দৃঢ়ভাবে জোর দিলেন যে, তারা তাদের নিজের পাপ স্বীকার করার জন্য ওঠে দাঁড়াক এবং তাদের হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য তার কাছে সুপারিশ করার অনুরোধও করুক। তবুও কেউ যখন দাঁড়াল না, তিনি তাদের নাম ধরে ডাক দিলেন এবং প্রত্যেককে দেখার জন্য তাদের ওঠে দাঁড়াতে আদেশ দিলেন। ঐতিহাসিক ইবনে সাদ উল্লেখ করেছেন, “তারা উঠেছিল, লাঞ্ছিত হয়েছিল এবং তাদের মুখ ঢেকে রেখেছিল" (১)।
মোনাফেকদের মুখোশ উন্মোচনের ক্ষেত্রে, উহুদের (Uhud) অবস্থান ছিল বেশ স্পর্শকাতর। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই শায়খাইনের নিকটবর্তী স্থান থেকে তিনশত অনুসারীসহ চলে আসার সময়ই মুহাম্মদ জানতেন যে, তার সামনে খারাপ কিছু আছে। ধুসর শ্মশ্রুমন্ডিত খাজরাজের মহান নেতা (আবদুল্লাহ ইবনে উবাই) তাকে শক্তিধর মক্কার সেনাদলের সামনে অসহায় ফেলে রেখে গিয়েছিলেন এবং এটাই হয়তো মুহাম্মদের জন্য মারাত্মক হুমকি বা জীবননাশের কারণ হতে পারত। সম্ভবত আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর বাহিনীকে ফিরিয়ে নেয়ার কারণেই মুহাম্মদের প্রাণ হুমকির মধ্যে পড়েছিল। যদি মুহাম্মদ সেদিন নিহত হতেন, তবে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মুহাম্মদ যেখানে নেতৃত্বে ছেড়ে গেছেন সেখান থেকেই তাঁর নিজের নেতৃত্ব শুরু করে ইয়াছরিবকে একত্রিত করার চেষ্টা করতে পারতেন।
আবদুল্লাহর বিশ্বাসঘাতকতা মুহাম্মদকে হতবাক করেছে এবং তাকে গভীরভাবে আহত করেছে। খাজরাজের এই সর্দার তাকে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আর তা সম্ভবত আন্তরিকতার সাথেই দিয়েছিল। তিনি বানু কায়কা গোত্রের (Qaynuqa Jews) ইহুদিদের বহিষ্কারের অল্প কিছুদিনের মধ্যে এবং সে সময়ে কবিদের হত্যাকাণ্ড (মুহাম্মদ কর্তৃক) দেখেই তিনি ধর্মান্তরিত হন। আবদুল্লাহ আশঙ্কা করেছিলেন যে, তার দিকে তলোয়ার তাক করা কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার।
তিনি মুহাম্মদকে হুমকি দেয়ার চেয়ে বরং তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তিনি মানুষের মনোভাব বুঝতে পারতেন, আর তাই মুহাম্মদের মাঝে তিনি এমন এক ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন যিনি স্তুতি পেতে খুবই উদগ্রীব। মুহাম্মদের সুনজরে থাকার জন্য যা করতে হতো তা হলো, কেবল তার চাটুকারিতা করা এবং সেটা করার জন্য যা করার দরকার তা হচ্ছে মুহাম্মদকে বিশ্বাস করানো যে, মুহাম্মদ যে আল্লাহর সাথে কথা বলেন সেটি ব্যক্তি বিশ্বাস করছে। মুহাম্মদের হাত ধরে লোক দেখানো নামমাত্র বিশ্বাস স্থাপনেরো প্রথম দিন থেকেই আব্দুল্লাহ বেশ সপ্রতিভ হয়ে এই চাটুকারিতার খেলাটা শুরু করলেন। এরপরে, তিনি জুমার খুতবার জন্য মসজিদে পৌঁছতেন এবং সামনে তার জন্য সংরক্ষিত জায়গায় দাঁড়াতেন। মুহাম্মদ যখন আয়েশার ঘর থেকে মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং মিম্বারের আসনে বসতেন, তখন আবদুল্লাহ তার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতেন, “হে লোকেরা, তোমাদের সামনে ইনিই তো আল্লাহর রাসুল। ঈশ্বর তাঁর মধ্য দিয়ে তোমাদেরকে সম্মান ও গৌরব দিয়েছেন। ওনাকে সাহায্য সহায়তা দাও এবং ওনার কথা শোনো ও মান্য কর (২)।
কিন্তু উহুদে মুহাম্মদের সঙ্গে না থেকে আবদুল্লাহ তার দল নিয়ে ইয়াছরিবে ফিরে যাওয়ার ফলে সবকিছু খোলাসা হয়ে গেল। মুহাম্মদের কাছে তিনি এখন সবচেয়ে নিচু স্তরের মোনাফেক বনে গেলেন। যুদ্ধের পরেও তিনি ভন্ডামি বজায় রেখেছিলেন। যখন ইয়াছরিব জুড়ে পরাজয়ের কথাটি ছড়িয়ে পড়ে এবং আহত ও হতাশাগ্রস্ত যোদ্ধারা তাদের বংশের দিকে ফিরে যাওয়ার আগেই আবদুল্লাহ মুহাম্মদের নেতৃত্বের প্রকাশ্য সমালোচনা করে বলেছিলেন যে, “মুহাম্মদ আমার কথায় কান দেননি; তিনি সুপরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং দেখুন সেজন্য কী পরিণতি হলো!”
আব্দুল্লাহর পরামর্শ অনুসারে মুসলিমরা যদি ইয়াছরিবে অবস্থান করত তবে আজকের মৃতরা এখনও বেঁচে থাকত এবং ইয়াছরিবে এমন বিয়োগান্তক ঘটনার প্রেক্ষিতে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। লোকেরা খারাপ পরামর্শ, এবং প্রকারান্তরে একজন খারাপ নেতাকেই অনুসরণ করেছে – বোঝাতে চাইলেন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই।
তিনি
যদি মুহাম্মদকে হত্যা করার
ব্যাপারে সত্যই বাধা দিতেন
তবে তিনি হেরে যেতেন। এটি
বুঝতে পেরে আবদুল্লাহ বিষয়গুলো
ঠিক করার (দু'কুল
সামলানোর)
চেষ্টা
করেছিলেন। মুহাম্মদ যখন
মক্কাবাসীদের তাড়া করার
জন্য আরেকটি বাহিনী গঠন করলেন
তখন আবদুল্লাহ মসজিদে উপস্থিত
হয়ে তার সাথে ফিরিয়ে নিয়ে
আসা তার লোকদেরও নেয়ার প্রস্তাব
দিয়েছিলেন,
কিন্তু
মুহাম্মদ তাকে বহিষ্কার
করেছিলেন। তিনি বললেনঃ “যারা
যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কেবল
তারাই যেতে পারবে। যারা উহুদে
গিয়েছিল তারা আল্লাহর দ্বারা
পরিচালিত হয়েছিল এবং সত্যপথ
অনুসরণ করেছিল। যারা যায়নি
তারা মোনাফেক,
এবং
তারা আল্লাহর আরোপিত শাস্তি
তারা ভোগ করবে।”
হামরাউল
আসাদ (রেড
লায়ন)
থেকে
ফিরে আসার পর খাজরাজ গোত্রপতি
আর অন্য মোনাফেকদের সাথে
মুহাম্মদ কি ব্যবহার করবেন
তা ঠিক করছিলেন। সর্বদা
শিরোচ্ছেদ করতে আগ্রহী উমর
তাদের সবাইকে মেরে ফেলার
প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি
যুক্তি দিয়েছিলেন যে,
তারা
কেবল তলোয়ার থেকে বাঁচতেই
“ধর্মান্তরের আশ্রয় নিয়েছে।
ওরা প্রথম থেকেই মোনাফেক ছিল”
(৩)।
মুহাম্মদ অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন
যে, এ
জাতীয় লোকদের হত্যা করা এক
বিপর্যয়কর নীতি হবে,
কারণ
এটি বিশ্বস্তদের নিরাপত্তা
ক্ষতিগ্রস্থ করবে। কেউই আর
নিরাপদ বোধ করবে না,
এমনকি
যারা বিশ্বাসে অবিচল তারাও
নয়। শাহাদার (ইসলাম
গ্রহণ করার কালিমা বা বাক্য)
সুরক্ষা
অলঙ্ঘনীয় হওয়া দরকার।
মুহাম্মদ রায় দিয়েছিলেন
যে, একজন
মুমিনকে হত্যা করা কেবলমাত্র
তিনটি ক্ষেত্রেই ন্যায়সঙ্গত
হতে পারে :
ব্যভিচার,
ধর্মত্যাগ
এবং মুমিনের দ্বারা আরেক
মুমিনের হত্যাকান্ড।
উমরের
হাতে আবদুল্লাহকে ছেড়ে দেয়ার
পরিবর্তে মুহাম্মদ খাজরাজের
আভিজাত্যকে অবমাননাকর পতনের
জন্য প্রস্তুত করেন। এটি
ঘটেছিল যখন আবদুল্লাহ পরের
শুক্রবারের খুতবাতে মুহাম্মদের
প্রতি তার প্রশংসাসূচক বাক্য
যা তিনি বরাবরই করতেন তা উচ্চারণ
করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন।
অনেক লোক হঠাৎ করে চেঁচিয়ে
ওঠে বলল,
“বসে
পড় হে আল্লাহর শত্রু!”
আবু
আইয়ুব,
যিনি
মসজিদটি নির্মাণের সময়
মুহাম্মদকে জায়গা দান করেছিলেন,
তিনি
আবদুল্লাহকে তার দাড়ি ধরে
ভরা উঠোন পেরিয়ে মসজিদের
প্রবেশ অব্দি টেনে নিয়ে
গিয়েছিলেন। এরপর তাকে রাস্তায়
নামিয়ে দিয়ে আবু আইয়ুব
চিৎকার করে বললেন,
“আপনি
এই জায়গার জন্য মোটেও ভালো
নন!”
আবদুল্লাহর
গোত্রের বেশ কয়েকজন লোক সেই
মুহুর্তে মসজিদে ঢুকতে যাচ্ছিল।
তারা তাকে ফিরে আসতে এবং
মুহাম্মদকে তার জন্য আল্লাহর
কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার
অনুরোধ করে। আবদুল্লাহ জবাব
দিয়েছিলেন,
“আল্লাহর
কসম, আমি
চাই না যে সে আমার জন্য ক্ষমা
প্রার্থনা করুক” (৪)।
পরবর্তীতে মুহাম্মদ কোরআনে আয়াত ঢুকিয়ে তাকে আরও তিরষ্কার করেছিলেন: “যখন তাদেরকে বলা হয়ঃ তোমরা এসো, আল্লাহর রাসুল তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন তারা মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং তুমি তাদেরকে দেখতে পাও যে, তারা দম্ভভরে ফিরে যায়। তুমি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর অথবা না কর, উভয়ই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ তাদেরকে কখনও ক্ষমা করবেননা। আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সৎ পথে পরিচালিত করেননা।”(৫)।
এমন
রুক্ষ আচরণ আবদুল্লাহকে হতাশ
করেছে। উহুদে আহত হওয়া
আব্দুল্লাহর মুসলিম পুত্র
সহ কয়েকশো লোক এই অপমান
প্রত্যক্ষ করেছে। আব্দুল্লাহর
পুত্র পেছন দিককার সারিতে
(নামাজের
সারি বা কাতার)
মধ্যে
ছিল এবং তার পিতাকে টেনে বাইরে
নেয়ার সময় সে তার চোখ ঘুরিয়ে
রেখেছিল। অপমানের কথাটি পুরো
উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
আবদুল্লাহ ছিলেন আধ্যাত্মিক
সাফল্যের মানুষ,
আদিবাসীর
মধ্যে প্রথমদিকের লড়াইয়ের
একজন সাহসী যোদ্ধা এবং শান্তি
ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠাকারী এক
ব্যক্তি। তিনি একটি দুর্গ,
উৎপাদনশীল
শস্যক্ষেত এবং খেজুর বাগানের
মালিক ছিলেন এবং উদারতা,
আতিথেয়তা
এবং বুদ্ধিমান পরামর্শের
জন্য খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন,
কিন্তু
সেদিন থেকে তাঁকে দাড়ি ধরে
বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার
প্রতিচ্ছবিই জনসাধারণের মনে
থেকে গেল।
আবদুল্লাহর অবমাননা এবং মোনাফেকি সম্পর্কে কোরআনের আয়াতগুলির একটি সংকলন প্রকাশের ফলস্বরূপ, ডাইনী শিকারের মতো করে অন্যান্য ছদ্মবেশি ব্যক্তিদেরও সনাক্ত করার একটি প্রবণতা শুরু হয়েছিল। কপট বলে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল যে, আন্তরিক ও কপট বিশ্বাসী উভয়ই ভন্ড তকমাটি এড়াতে ধর্মের জন্য চূড়ান্তভাবে কাজ করছিল। জনসমক্ষে এবং ব্যক্তিগতভাবে তারা একে অপরকে ঈশ্বর ও তাঁর রাসুলের প্রতি, বিশেষত তাঁর রাসুলের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা ঘোষণা করত। লোকেরা অতিরিক্ত নামাজ আদায় করত। কেউ কেউ প্রার্থনা করার সময় মাটিতে এমনভাবে মাথা ঠেকিয়ে দিতেন যে, তারা তাদের কপালে স্থায়ী দাগ বা চিহ্ন দিয়ে ফেলে দিয়েছিল - ন্যায়নিষ্ঠ ধর্মসাধকের নিশানা হিসেবে।
অসুস্থ
লোকেরা,
যারা
সাধারণত অজুহাত দিত,
তারাও
বাধ্য হয়ে নামাজ পড়ার জন্য
মসজিদে যেত। অন্যরাও নিজেদের
বিশ্বাসী প্রমাণ করতে এমনকি
মৃত্যুবরণ করতে যুদ্ধে পর্যন্ত
যোগ দিত। ভণ্ড
তকমাটি যেন ছিল একটি তলোয়ার,
আর
এটি তাদের সকলের উপরেই ঝুলছিল।
ইয়াছরিবের বাইরে, মুহাম্মদ তার বিরুদ্ধে সামরিক হামলা ব্যর্থ করার লক্ষ্যে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেন। যখনই তিনি খবর পেতেন যে, কোনও গোত্র তাঁর বিরুদ্ধে হামলা করার পরিকল্পনা করছে, এমনকি তার পশুপালকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে তিনি তৎক্ষণাৎ একটি মারাত্মক আঘাতের মোকাবিলায় তার বাহিনীকে প্রেরণ করতেন। উহুদের পরপরই এমন এক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। প্রথমটি খায়বারের নিকটে উত্তর দিকের একদল বেদুইনদের বিরুদ্ধে ছিল, যারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। এই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন উহুদে আহত হওয়া মুহাম্মদের প্রথম চাচাত ভাই আবু সালামা (Abu Salama)। বেদুইনরা বিনা লড়াইয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল, কিন্তু আক্রমণকারীরা প্রচুর পরিমাণ পশু নিয়ে ইয়াছরিবে ফিরে আসে।
আবু সালামা ফিরে আসার অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ক্ষত থেকে সংক্রমণ হয়ে মারা যান। তার উপরের বাহুতে একটি তীর আঘাত করেছিল এবং অভিযান চালানোর সময় এটির প্রদাহ বেড়ে গিয়েছিল। চারমাস পরে, মুহাম্মদ তার বিধবা স্ত্রী উম্মে সালামাকে (Umm Salama) (৬) বিয়ে করেছিলেন, তার জন্য মসজিদের আরেকটি কক্ষ বরাদ্দ করেছিলেন। এভাবেই তিনি সাওদা, আয়েশা এবং হাফসার পাশের কক্ষের প্রতিবেশি হয়ে ওঠেন। আবু সালামা তার আক্রমণ থেকে ফিরে আসার প্রায় একই সময়ে মুহাম্মদ গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলেন যে, বেদুইনদের আরও একটি দল আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে। এরা ছিল ইয়াছরিবের আরো দক্ষিণে মরুভূমির মানুষ এবং মক্কাবাসীদের সাথে তাদের সন্ধি ছিল। উহুদ যুদ্ধে তারা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং তার আশঙ্কা ছিল যে, তারা বেদুইন আদিবাসীদের নিয়ে একটি জোট গঠন করবে যারা তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি আক্রমণ করবে। বিশাল বাহিনীকে ঝুঁকিতে ফেলার তুলনায় তারা যেহেতু অনেক দুরে ছিল, মুহাম্মদ তাদের নেতা খালিদ বিন সুফিয়ানকে হত্যার জন্য একটি অভিজ্ঞ ঘাতককে নিয়োগ করেছিলেন। খুনি সফল অভিযানের প্রমাণ হিসেবে খালিদের মাথা নিয়ে ইয়াছরিবে নিয়ে আসে। নেতার হত্যার ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে বেদুইনরা পিছু হটেছিল (৭)।
খালিদের হত্যার পরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আগ্রাসন প্রতিরোধের জন্য মুহাম্মদ তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিন্তু খুন হওয়া নেতার সাথে পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত একটি গোত্র মুহম্মদের 'ধর্মপ্রচারকদের' হত্যা করে এর প্রতিশোধ নিয়েছিল। তারা মুহাম্মদের ধর্মের গুণগান করার জন্য এবং ধর্ম শেখানোর জন্য কিছু লোককে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য মুহাম্মদকে প্রলুব্ধ করেছিল। কোনরূপ সন্দেহ না করে মুহাম্মদ তাদের ফাঁদে পা দিলেন এবং একদল ধর্মপ্রচারককে পাঠিয়েছিলেন। কারো মতে, এদের সংখ্যা ছিল ছয়জন আর কারো মতে দশজন যারা প্রেরিত হয়েছিল সংশ্লিষ্ট গোত্রের লোকদের নামাজের নিয়মসমূহ শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং তাদের কোরআন পড়ানোর জন্য। কিন্তু তারা ষড়যন্ত্রকারীদের অঞ্চলে যাওয়ার সাথে সাথেই তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল এবং দলের দু'জন বাদে সবাই মারা গিয়েছিল। যে দুজন বেঁচে গিয়েছিল তাদের একজন ছিলেন খুবায়ের ( Khubayb) এবং অন্যজন দছিন্না নামে একব্যক্তি। তাদেরকে পঞ্চাশটি উটের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের কাছে বিক্রি করা হয়েছিল।মক্কাবাসীরা পরে এই দু'জনকে হত্যা করেছিল, একজনকে শিরোশ্ছেদ করে এবং অপরজনকে ক্রুশবিদ্ধ করে। উমাইয়া ইবনে খালাফের পুত্র সাফওয়ান (Safwan) ব্যক্তিগতভাবে দছিন্নার শিরোশ্ছেদ করেছিলেন, কারণ বলা হয়েছিল যে, আত্মসমর্পণের পরেও বদর নামক স্থানে তার বাবা ও ভাইকে হত্যা করা লোকদের মধ্যে দছিন্না একজন ছিলেন। খুবায়েবকে হত্যা করা হয়েছিল, কারণ তিনি মুহম্মদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোক ছিলেন। তাকে হয় মাটিতে লাগানো ক্রুশের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল বা গাছের সাথে বাঁধা একটা দন্ডে আটকে পেটানো হয়েছিল। মক্কাবাসীরা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে বর্শা মারতেই থাকে। তাঁর শেষ কথাটি ছিল: “হে আল্লাহ, তাদের সংখ্যা গুণে রাখুন এবং তাদেরকে একে একে হত্যা করুন, ওদের একজনকেও ছাড়বেন না!” (৮)।
খুবায়েবকে মৃত্যদণ্ড দেয়ার আগে আবু সুফিয়ান এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মুহাম্মদকে হত্যা করার জন্য কাউকে নিয়োগ দিতে চাইলেন। একজন বেদুইন এই কাজটা নিল, তবে ইয়াছরিবে সে ধরা পড়ে এবং স্বীকার করে যে, আবু সুফিয়ান তাকে প্রেরণ করেছিলেন। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য এবার মুহাম্মদ আবু সুফিয়ানকে হত্যা করার জন্য একজন খুনিকে প্রেরণ করেছিলেন, তবে মুহাম্মদের ঘাতকও আবু সুফিয়ানের বেদুইনের মতোই অদক্ষ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল এবং প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিল। যদিও সে আবু সুফিয়ানকে মারতে পারেনি, তবে মুহাম্মদের নিয়োগকৃত এই খুনি ইয়াছরিবে ফিরে আসার পথেও অনেক 'কাফের' হত্যা করেছিল।
মুহাম্মদ আরও বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন, যখন তিনি ইয়াছরিবের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে একটি আপাতদৃষ্টিতে সহনশীল গোত্রে ধর্মাচরণ শিক্ষাদানের জন্য লোক পাঠানোর পরে তার সত্তরজন প্রচারককে জবাই করা হয়েছিল। খুবায়েব ও তার সঙ্গীদের সাথে যা হয়েছিল তার কারণে মুহাম্মদ আর কোনও প্রচারক প্রেরণ করতে রাজি ছিলেন না, কিন্তু গোত্রের বয়স্ক নেতা যিনি তাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। তাঁরা (মুসলিমরা) অঞ্চলটিতে পৌঁছে তাদের তাঁবু খাটানোর পর স্থানীয় গোত্রদের জোট দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায় এবং তাদের হত্যা করা হয়(৯)। যেহেতু ধর্মপ্রচারকেরা অভিজ্ঞ এবং তাঁরা আপাদমস্তক সজ্জিত যোদ্ধা হয়েই এসেছিল, তাই শত্রুরা তাদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করেনি। তারা দুর থেকে তীরের আঘাতে বেশিরভাগ লোককে হত্যা করেছিল, আর পরে কাছে এসে তীরের আঘাতে যারা আহত হয়েছে কিন্তু মারা যায়নি তাদেরও শেষ করে এবং তীরের আঘাত থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনকে হত্যা করে।
মুহম্মদের একজন সাহাবিই (অনুসারী) কেবল এই আক্রমণ থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। এটি অবস্থানগত কারণে মাওনের কুপের (বিরে মাউ'না) ঘটনা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল।
এই
হত্যাযজ্ঞগুলি মুহাম্মদের
প্রতি বিদ্বেষের গভীরতা এবং
তাকে প্রতিরোধ করার ক্রমবর্ধমান
আরব সংকল্পের পরিচায়ক ছিল।
এই বার্তাটি তাকেও এড়িয়ে
যায়নি। তিনি একেবারে ভেতর
থেকেই ধাক্কা খেয়েছিলেন এবং
বাহ্যিক আগ্রাসন থেকে সাময়িকভাবে
সরে এসে ইয়াছরিবের উপর তার
নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর দিকে
মনোনিবেশ করেছিলেন (১০)।
একই মাসে তিনি ইহুদি গোত্রগুলির
থেকে আরো একটি গোত্রকে আক্রমণ
ও বহিষ্কার করেছিলেন,
তারা
ছিল বানু নাযীর গোত্র। এর
উদ্দেশ্য ছিল ঘৃণা এবং লোভ।
মুহাম্মদ তাদেরকে ঘৃণা করতেন,
কারণ
তারা তাকে প্রত্যাখ্যান
করেছিল,
তবে
তিনি তাদের যা ছিল,
তাই
চেয়েছিলেন। বানু নাযীরদের
অসংখ্য খেজুর গাছ ও খামার ছিল,
তাঁরা
হিজাজের সবচেয়ে সমৃদ্ধ গোত্র
ছিল। মুহাম্মদের সাহাবিদের
(অনুসারী
বা সঙ্গী)
মধ্যে
মুহাম্মদের প্রতি অব্যাহত
আনুগত্য নিশ্চিত করতে এবং
তাঁর ক্রিয়াকলাপগুলির অর্থ
ব্যয় বহন করতে লুণ্ঠনের
প্রয়োজন ছিল। এই আক্রমণটিকে
বৈধতা দেয়ার জন্য তিনি সেই
একই অজুহাত ব্যবহার করেছিলেন,
যা
তিনি একবছর আগে কায়কার ইহুদিদের
উপর হামলার সময়ে করেছিলেন।
তিনি বানু নাযীরদের এমন
পরিস্থিতি তৈরির জন্য অভিযুক্ত
করেছিলেন যার মাধ্যমে
'বিশ্বাসঘাতকতার
আশঙ্কা'
প্রকট
হয়েছিল। যেহেতু বানু নাযীর
গোত্রও মুহাম্মদের পক্ষ হতে
বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা প্রকাশ
করেছিল তাই আল্লাহ তাকে অনুমতি
দিয়েছিলেন যে,
তিনি
তাদের সাথে যে চুক্তি করেছিলেন
তা প্রত্যাখ্যান করতে এবং
তাদের উপরে আক্রমণ করতে (১১)।
তার মাঝে যা বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা কাজ করেছিল সেই ঘটনাটি ঘটেছে বানু নাযীর দুর্গের গেটে। উমর, আবু বকর এবং আলী সহ নেতৃস্থানীয় লোকদের সাথে নিয়ে মুহাম্মদ দু'টি খুনের ঘটনায় ইহুদিদের কাছ থেকে খুনের রক্তপণ (আরবিতে দিয়াত) দাবি করতে দুর্গে গিয়েছিলেন, যেটি মওনার কূপের হত্যাযজ্ঞ থেকে একমাত্র বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির দ্বারা সংঘটিত হয়েছিল (১২)। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে ইহুদিদের ন্যূনতম সম্পর্কও ছিল না, কিন্তু ইসলামের আকরগ্রন্থে লেখা আছে যে, গোত্রগত জোটবদ্ধতার কারণে নিহত পুরুষদের রক্তপণের কিছু অর্থ দেয়ার বাধ্যবাধকতা তাদের ছিল।
কিন্তু ইহুদিরা মুহাম্মদকে তাদের দুর্গের গেটের ভেতর প্রবেশ করতে দেয়নি, তবে তারা মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবিদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য তাদের গেটের কাছে অপেক্ষমাণ রাখে। যখন সাহাবিরা অপেক্ষা করছিল, মুহাম্মদ হঠাৎ চলে গেলেন, এবং আর কখনওই ফিরে আসেননি। উমর ও অন্যান্যরা প্রথমে ভেবেছিল যে তিনি প্রস্রাব করার জন্য গিয়েছেন। তারা অবশেষে তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে মসজিদে অনুসন্ধান করতে গেলেন। তারা তাকে সেখানে রাগান্বিত ও উত্তেজিত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিল। তিনি রেগে গিয়েছিলেন, কারণ ফেরেস্তা জিব্রাইল তাকে ফটকের কাছে অপেক্ষা করার সময় জানিয়েছিলেন যে, ইহুদিরা দুর্গের উঁচু জায়গা থেকে তার উপর থেকে একটি বড় পাথর ফেলে দেয়ার পরিকল্পনা করছিল।সে কারণেই তিনি চলে গেয়েছিলেন। তিনি তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় ভয় পেয়েছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন, কারণ এখন তাদেরকে আক্রমণ করার কারণ পাওয়া গেল। তাদের চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রের দ্বারা তারা নিজেরাই তার সাথে যে ঐক্যমত্য ও চুক্তি করেছিল, তা এখন বাতিল হয়ে গেছে। তিনি আর তাদের হাতে আবদ্ধ হননি (১৩)। তিনি বানু নাযীরদের অবরোধের নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাবার সাথে সাথেই গনিমতের মালের গন্ধ পেতে লাগল মুহাম্মদের সেনাদল, সুতরাং তাদের উদ্দীপ্ত হতে আর বিলম্ব হয়নি। শত শত বিশ্বস্ত অনুসারী তাদের বর্ম এবং তলোয়ার নিয়ে ইহুদিদেরকে ছিন্নভিন্ন করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হলো। দুর্গে অবরোধ করার আগে, মুহাম্মদ অবশ্য ইহুদিদেরকে তাদের একহাজার বছরের বাড়িঘর এবং জমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। একবছর আগে বানু নাযীর গোত্রের কবি কাব বিন আশরাফকে হত্যার কারিগর ইবনে মাসলামাকে তিনি এই বার্তা দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন, “আমার দেশ ছেড়ে যাও। আমি তোমাদের জন্য দশদিনের সময়সীমা মঞ্জুর করেছি। এরপরে যাকেই দেখা যাবে, তার মাথা কেটে ফেলা হবে”(১৪)। মাসলামার মতো কাউকে প্রেরণ করে মুহাম্মদের হুমকি দেয়ার মানে তাদের মনে এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্নই আসতে পারে না যে, মুহাম্মদ যা বলেছে তা সে করবেই। ইহুদিরা জানত যে সে (মাসলামা) কাব বিন আশরাফের হত্যায় জড়িত ছিলেন। আশরাফের মাথা কেটে পাঠানোর মতই, তাকে পাঠানোর মানেই হলো একটি সতর্কবার্তা দেয়া। তবুও তারা চলে যেতে অস্বীকার করেছিল। তাদের মিত্র আবদুল্লাহ উবাই তাদের বলেছিলেন যে, তিনি তাদেরকে যোদ্ধা দিয়ে সাহায্য করবেন। বানু বানু বানু বানু বানু কুরাইযার ইহুদিদের কাছ থেকেও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি আসে।
অবরোধ আরোপ করার আগে, তাদের অঞ্চলের কাঠের বাড়ি এবং গ্রামগুলির মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বানু নাযীররা সুরক্ষার জন্য মূল দুর্গে একত্রিত হয়েছিল। বিপদের সময় আশ্রয়ের জায়গা হিসেবে কাজ করা বড় দুর্গগুলির ভুমিকা ছিল। এগুলিতে সাধারণত খাদ্য এবং অস্ত্র মজুদ করা থাকত এবং ঘন প্রাচীরের মধ্যে পুরো গোত্রের প্রয়োজন সরবরাহের জন্য গভীর কুপ থাকত। মুহাম্মদ চারদিকে বানু নাযীর দুর্গকে ঘিরে রেখেছিলেন। ইহুদিদের কটূক্তি করার জন্য মুহাম্মদ এবং তার অনুসারীরা ইহুদিদের তাদের তীরের নাগালের বাইরে গিয়ে তাদের দেখিয়ে নিয়ম করে নামাজ পড়ত। নেতৃত্ব দেয়ার উদ্দেশ্যে, এক বছর আগে হত্যা করা (মুহাম্মদের নির্দেশে) খাতমা গোত্রের কবি আসমা বিনতে মারওনের একটি উঠোনে মুহাম্মদ তাঁবু স্থাপন করেছিলেন। আযওয়াক (Azwak) নামে একজন ইহুদি তীরন্দাজের তীর তাঁবুতে আঘাত করার পর তিনি তাঁবুটি স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হন। আজওয়াককে ধরে নিয়ে তার শিরোশ্ছেদ করা হয়। অন্ধকারের আড়ালে ক্ষুদ্র একদল যোদ্ধা নিয়ে আজওয়াক কমান্ডো হামলার জন্য বের হয়েছিলেন, কিন্তু আলী তাকে ধরে ফেলেন এবং মুহাম্মদের কাছে তার কর্তিত মুণ্ডু নিয়ে আসেন। মুহাম্মদের কাছে মুণ্ডু রেখে দিয়ে আলী বাকি কমান্ডোদেরও শিকার করলেন এবং আরও মাথা নিয়ে ফিরে এলেন। মুহাম্মদ সেগুলোকে খাতমাসের (Khatmas) একটি কূপে ফেলে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। ইহুদিদের প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার সাথে সাথে, মুহাম্মদ দুর্গের চারপাশে খেজুর গাছগুলো কাটতে বা আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার নিষ্ঠুর পদক্ষেপ নিলেন। ইহুদিদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তিনি এই কাজ করেছিলেন।
তাদের উৎপাদিত ফলের মাঝে খেজুর ছিল বেশ দামী, গাছ রোপন করার পর অনেক বছরের যত্নে এরা ফল দেয়া শুরু করে। ইহুদিরা তাদের প্রিয় গাছগুলিকে এভাবে ধ্বংস হওয়া দেখে যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একজন দূত এসে মুহম্মদের কাছে অযথা ধ্বংসযজ্ঞ করার সম্পর্কে অভিযোগ করেছিল। মুহাম্মদ হেসে বললেন যে, ওদের অপমান ও ক্ষতি করার জন্য এটিই আল্লাহ্র উপায়। তার কয়েকজন অনুসারী এই কাজ না করতে চাপ দিতে থাকে, যারা দেখতে পাচ্ছিলেন যে তাদের লুটের মাল (গনিমত) ধোঁয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিরত হয়েছিলেন, তবে কোরআনের একটি আয়াত দিয়ে তার পুরনো কাজটি জায়েজ করে নিয়েছিলেন (১৫)।
মিত্রদের
সহায়তার প্রত্যাশায় ইহুদিরা
দু'সপ্তাহ
ধরে অবস্থান নিয়েছিল,
কিন্তু
সাহায্য কখনও আসেনি। কায়কা
ইহুদিদের ক্ষেত্রে যেমনটি
হয়েছিল,
আবদুল্লাহ
উবাই তার প্রতিশ্রুতি দিতে
ব্যর্থ হন। তিনি তখন দুর্বল
ছিলেন,
এবং
মুহাম্মদ তাকে মসজিদে অপমান
করায় তিনি এখন আরো দুর্বল
হয়ে পড়লেন এবং পর্যাপ্ত
শক্তিও তিনি জোগাড় করতে
পারেননি। আবদুল্লাহ ইবনে
উবাইয়ের পুত্র ধর্মান্তরিত
হওয়া আবদুল্লাহ ছিল আরেক
বাঁধা,
যেদুর্গ
ঘেরাও করা লোকদের মধ্যে অন্যতম।
অসম্মানিত খাজরাজ নেতা যদি
ইহুদিদের রক্ষা করতে যান,
তবে
তাকে প্রথমে নিজের ছেলের সাথেই
লড়তে হবে।
শেষ
অবধি ইহুদিরা হার মানল,
তবে
মুহাম্মদের কাছ থেকে তাদের
চলে যাওয়ার অনুমতির প্রতিশ্রুতি
অর্জনের পরেই। তিনি অস্ত্র
ছাড়া তাদের উটের উপরে যা কিছু
নিতে পারেন তা তাদের সাথে
নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
তিনি চেয়েছিলেন তারা তাদের
সমস্ত অস্ত্র এবং সামরিক
সরঞ্জাম সমর্পণ করুক। ইহুদিরা
উটের গায়ে তাদের জিনিসপত্র
উঠাতে তিনদিন সময় নিল।
কেউ কেউ মুল্যবান চৌকাঠ এবং থামগুলো পুনরুদ্ধার করতে তাদের বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলেছিল, যা তারা উটের উপরেও বোঝাই করল। তারা ছয়শত উটের একটি বিশাল কাফেলা তৈরি করেছিল। যেদিন তারা চলে গেলেন, রাব্বি-নেতা সাল্লাম হুকায়িক (Sallam Huqayq), কিনানা রাবি (Kinana Rabi) এবং হুয়াই বিন আখতাব (Huyayy Akhtab) ঘোড়ার পিঠে চড়ে কাফেলার সামনের দিকে ছিলেন। নারী এবং শিশুরা উটগুলিতে চড়ে যাচ্ছিল, আর পুরুষরা তাদের পাশে হাঁটছিল। তারা হতাশার পরিবর্তে উৎফুল্ল থেকে তাদের মর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। উট এবং ঘোড়ার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেরা টাম্বুরিন ও বাঁশি বাজাচ্ছিল এবং মেয়েরা আনন্দসূচক গান করছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের কটূক্তি করার জন্য তারা তাদের সম্পদগুলো দেখাতে লাগল। উটের উপর কারুকাজ করা পালকিতে বসা নারী ও শিশুরা তাদের গলায় সোনা ও মুক্তার হার, হাতে ব্রেসলেট পরেছিল। নারীরা তাদের সেরা রেশমির গাউন পরেছিলেন এবং সোনা এবং রৌপ্যের পানপাত্র নিয়েছিলেন।তাদের সোনার ও রৌপ্য নৈশভোজের পাত্রগুলো এত বিখ্যাত ছিল যে, মক্কাবাসীরা কখনও কখনও তাদের উৎসবে সেগুলো ধার নিত। মুহাম্মদ এই লোক দেখানো প্রস্থান দেখে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি তাদের দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরেছিলেন (১৬)। বানু নাযীর পরিবারের কেউ কেউ সিরিয়ার কায়নুকা ইহুদিদের সাথে যোগ দিতে গিয়েছিল, তবে বেশিরভাগই খাইবার (Khaybar) থেকে নব্বই মাইল উত্তরে বসতি স্থাপন করল, যেখানে তারা সম্পত্তির মালিক হল এবং খেজুর চাষে নিজেদের নিয়োজিত করল।
এই
ঘটনা থেকে মুহাম্মদের প্রাপ্তি
ছিল বিশাল। বানু নাযীর আদিবাসীর
সমস্ত দুর্গ,
কাঠের
বাড়ি,
খেজুর
গাছ ও খামার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এতে আরো ছিল সাতটি বড় শস্যক্ষেত,
গাছগাছালির
সমাহার এবং কয়েকটি ছোট ছোট
খামার। ইয়াছরিবের সবচেয়ে
উর্বর অঞ্চলে বানু নাযীরদের
স্থাবর সম্পত্তি কয়েক
বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত
ছিল। গণিমতের মালগুলোও আকর্ষনীয়
ছিল।
এতে পঞ্চাশটি বর্ম, পঞ্চাশ শিরস্ত্রাণ এবং তিনশতত চল্লিশটি তলোয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসলামিক গ্রন্থে অবরোধে অংশ নেওয়া মুমিনদের সংখ্যার বর্ণনা মেলে না, তবে সম্ভবত এটি এক হাজারের কাছাকাছি ছিল। প্রত্যেকেই এর ভাগ নিতে উদগ্রীব ছিল, কিন্তু মুহাম্মদ ভাগবাটোয়ারা সম্পর্কে আগেই ভেবে রেখেছিলেন যে, সবকিছু মক্কার অভিবাসীরা পাবে। মক্কা প্রবাসীদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক বেশি ইয়াছরিবী ধর্মান্তরিতদের বাদ দেয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ মিষ্টি কথা ও চাটুকারিতার সাথে খবরটা ছড়িয়ে দিলেন। তিনি তার ইয়াছরিব সমর্থকদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, এটা আল্লাহর ইচ্ছা।
আল্লাহ
তাকে ফেরেস্তা জিব্রাইলের
মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছিলেন
যে,
কাফেররা
লড়াই না করে হাল ছেড়ে দিলে
মুহাম্মদকেই সবকিছু দেয়া
হবে এবং গণিমতের মালের বিলিবন্টনের
দায়িত্বও তার উপরে,
তিনি
যা ভালো মনে করেন তাই হবে (১৭)।
আর এখন তিনি মক্কাবাসীদের
কাছে সবকিছু দিয়ে দেয়াই
সঠিক মনে করছেন। কারণ,
ইয়াছরিবী
ধর্মান্তরিতরা মক্কার
শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানের
ক্ষেত্রে উদারতা প্রদর্শন
করেছিল। তাদেরকে তারা নিজেদের
মাঝে নিয়ে এসেছিল,
তাদের
সাথে ভাইয়ের মত আচরণ করেছিল
এবং তাদের জন্য সাধের চেয়ে
অনেক বেশি করেছে। তিন বছর ধরে
তারা এই ধরনের আতিথেয়তার
হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল,
তবে
এটি স্পষ্টতই তাদের জন্য একটি
আর্থিক চাপ ছিল। কারও কারও
জন্য এই টানাপোড়েন অন্যদের
চেয়ে বেশি ছিল। মুহাম্মদ
লুটের মালামাল বিতরণের ব্যবস্থা
করেছিলেন,
যা
তাদের দায় থেকে মুক্তি দিল।
মক্কাবাসীরা এখন তাদের নিজের
পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে
এবং তাদের ভাইদের জন্য আর বোঝা
হয়ে উঠবে না। তিনি আল্লাহকে
কোরআনের আয়াত সহকারে নামিয়ে
আনলেন:
“সুতরাং
রাসুল তোমাদেরকে যা দেন,
তা
গ্রহণ কর এবং তিনি তোমাদের
যা থেকে বারণ করেন তা থেকে
বিরত হও। আর আল্লাহকে ভয় কর;
নিশ্চয়
আল্লাহ শাস্তিদানে কঠোর”
(১৮)।
আউস বা খাজরাজের কেউ প্রতিবাদ
করেছিল কিনা তা লিপিবদ্ধ নেই।
যদি এটি আল্লাহর ইচ্ছা হত তবে
কারা আপত্তি করবে?
যদি
তাদের মধ্যে কেউ সত্যিই
অসন্তুষ্ট হত,
তারা
এটিকে নিজের ভেতরেই রাখত। তারা
জানত যে,
তারা
যদি প্রতিবাদ করে তবে তারা
ভন্ড হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার
ঝুঁকি বহন করবে।
নিজে এক পঞ্চমাংশ নেয়ার প্রচলিত নিয়মানুসারে মুহাম্মদ নিজের জন্য সবচেয়ে বড় গাছ আর শস্যক্ষেত বেছে নিলেন, আর তার এক দাসকে দেখভালো করার জন্য নিয়োগ করলেন। আবু বকর, উমর এবং যুবায়েরকে সম্পত্তির অন্যান্য প্রধান অংশ দিলেন, এবং আরেকটা অংশ মক্কার ব্যবসায়ী আবদুল রহমানের (Abdul Rahman) কাছে গেল, যিনি প্রথম দিককার অন্যতম ধর্মান্তরিত ছিলেন। অন্যান্য সম্পত্তি তিনি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করেছিলেন এবং এগুলি বাকী মক্কাবাসীদের মধ্যে ভাগ করেছেন। এমনকি তার প্রাক্তন আবিসিনিয়ার দাসী বারাকা, যিনি জায়েদকে বিয়ে করেছিলেন এবং ওসামার মা ছিলেন তিনিও খেজুর গাছের একটি অংশ পেয়েছিলেন। ইয়াছরিবের ধর্মান্তরিতদের মধ্যে কেবল দু'জন এখান থেকে স্থাবর সম্পত্তি পেল সেটাও বদর ও উহুদে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাদের সমস্ত পরিষেবার কথা এবং চরম দারিদ্র্যের অজুহাত দেখিয়ে। মুহাম্মদ তার অনুসারী লোকদের একটি ছোট খামারের যৌথ মালিকানা দিলেন। চির-বিশ্বস্ত আউস নেতা সাদ বিন মুআযকে নাদিরের নেতা সাল্লাম হকায়কের (Sallam Huqayq) খ্যাতিমান তলোয়ারটি প্রদান করলেন। আদিগ্রন্থে বলা হয়েছে যে, নাদিরের দু'জন ইহুদি তাদের খামার এবং পরিবার রাখার শর্তে ধর্মান্তরিত হয়েছিল। তারা আত্মসমর্পণের আগে দুর্গ থেকে সটকে গিয়েছিল এবং বিশ্বস্ততার শপথ করেছিল। তাদের একজনের নাম ইয়ামিন উমাইর (Yamin Umayr)। আমাহ জাহাশ (Amr Jahash) নামের এক বানু নাযীর ইহুদিকে খুন করে মুহাম্মদ তাকে তার আনুগত্য প্রমাণ করার দায়িত্ব দিয়েছিল। জাহাশের একমাত্র অপরাধটি ছিল যে, সে ভুল সময়ে মুহাম্মদের কল্পনায় প্রবেশ করেছিল। মুহাম্মদ যখন কল্পনা করেছিলেন যে কেউ তার মাথায় বড় পাথর ফেলতে চলেছে, তখন জাহাশের মুখটি তার মনে ভেসে ওঠে।
মুহাম্মদকে খুশি করার জন্য ইয়ামিন কোন একজনকে দশটি সোনার মুদ্রা দিয়েছিলেন এই কাজটি সম্পন্ন করতে। বানু নাযীর ইহুদিদের আত্মসমর্পণের পরে, তবে তাদের চলে যাওয়ার আগে এই হত্যার ঘটনাটি ঘটেছিল। ইসলামিক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে যে, ইয়ামিন যখন মুহাম্মদকে এই হত্যাক্যান্ডটি সম্পন্ন করেছে বলে জানিয়েছিল, তখন “নবী সন্তুষ্ট হয়ে যান” (১৯)।
বানু
নাযীর ইহুদিদের ভাগ্য নিয়ে
কোরআনে “বিলুপ্তি (Banishment
) ” শিরোনামের
একটি সংক্ষিপ্ত অধ্যায়ের
(সুরা)
রচনা
করা হয়েছিল। তার আয়াতগুলিতে
মুহাম্মদের এই পদক্ষেপের
পুনরাবৃত্তি করা হয় এবং
ইহুদিদের বহিষ্কার এবং তাদের
সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার
জন্য জটিল যৌক্তিকতা দেয়া
হয়। প্রথম কয়েকটি আয়াতে
লেখা ছিল:
هُوَ
الَّذِي أَخْرَجَ الَّذِيْنَ كَفَرُوا
مِنْ أَهْلِ الْكِتَبِ مِنْ دِيَارِهِمْ
لأَوَّل الشر لا مَا ظَنَنْتُمْ أَنْ
يُخْرُجُوا وَظَنُّوا أَنَّهُمْ
مَّانِعَتُهُمْ حُصُونُهُمْ مِّنَ اللهِ
فَأَتْهُمُ اللهُ مِنْ حَيْتُ لَمْ
يَحْتَسِبُوا *
وَ
قَذَفَ فِي قُلُوبِهِمُ الرُّعْبَ
يُخْرِبُونَ بُيُوتَهُمْ بِأَيْدِيهِمْ
وَأَيْدِى الْمُؤْمِنِينَ *
فَاعْتَبِرُوا
يَأُولى الأبصار (٢)
وَ
لَوْ لَا أَن كَتَبَ اللَّهُ عَلَيْهِمُ
الْجَلَاءَ لَعَذَّبَهُمْ فِي الدُّنْيَا
وَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابُ النَّارِ
(۳)
ذَلِكَ
بِأَنَّهُمْ سَاقُوا اللهَ وَرَسُولَهُ
، وَ مَنْ يُسَاقَ اللهَ فَإِنَّ اللَّهَ
شَدِيدُ الْعِقَابِ (٣)
আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা কুফরি করেছিল তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে তিনি (আল্লাহ) বের করে দিয়েছিলেন প্রথমবারের মতো। তোমরা ধারণাও করনি যে, তারা বেরিয়ে যাবে। আর তারা ধারণা করেছিল যে, তাদের দুর্গগুলো তাদেরকে আল্লাহ থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু আল্লাহ এমন এক দিক থেকে তাদের কাছে এলেন যা তারা কল্পনাও করতে পারেনি এবং তিনি তাদের অন্তরসমুহে ত্রাসের সঞ্চার করলেন, ফলে তারা তাদের বাড়িঘর আপন হাতে ও মুমিনদের হাতে ধ্বংস করতে শুরু করল।
অতএব হে দৃষ্টিমান লোকেরা তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। আল্লাহ যদি তাদের জন্য নির্বাসন না লিখে দিতেন, তাহলে তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতেই শাস্তি দিতেন, আর পরকালে তো তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি রয়েছেই। এটি এজন্য যে, তারা সত্যিই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধাচরণ করেছিল। আর যে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ শাস্তি প্রদানে কঠোর। (২০)। একই সুরায় বেশকিছু আয়াত আছে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে উদ্দেশ্য করে, তার একটিতে বলা হয়েছেঃ
أَلَمْ
تَرَ إِلَى الَّذِيْنَ نَافَقُوا
يَقُولُونَ لِإِخْوَانِهِمُ الَّذِيْنَ
كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَبِ لَئِنْ
أُخْرِجْتُمْ لَنَخْرُجَنَّ مَعَكُمْ
وَ لَا تُطِيعُ فِيْكُمْ أَحَدًا ابدا ل
وان قوتِلْتُمْ لَنَنْصُرَنَّكُمْ وَ
اللَّهُ يَشْهَدُ أَنَّهُمْ لَكَذِبُونَ
(١١)
لَيْنْ
أُخْرِجُوا لَا يَخْرُجُونَ مَعَهُمْ
وَ لَئِنْ قُوْيَلُوْا لَا يَنْصَرُونَهُمْ
وَ لَئِنْ نَصَرُوهُمْ لَيُوَلُنَّ
الْأَدْبَارَ هُ ثُمَّ لَا يُنْصَرُونَ
(۱۲)
তুমি কি মুনাফিকদেরকে দেখনি যারা আহলে কিতাবের মধ্য হতে তাদের কাফির ভাইদেরকে বলে, 'তোমাদেরকে বের করে দেয়া হলে আমরাও তোমাদের সাথে অবশ্যই বেরিয়ে যাব এবং তোমাদের ব্যাপারে আমরা কখনোই কারো আনুগত্য করব না। আর তোমাদের সাথে যুদ্ধ করা হলে আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।' আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তারা মিথ্যাবাদী (২১,২২)।
সমালোচকদের
হত্যা,
ইহুদি
গোত্রগুলির বিতাড়ন এবং তাদের
সম্পত্তি ছিনিয়ে নেয়ার
মধ্য দিয়ে মুহাম্মদ ইয়াছরিবকে
এক অরাজক অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন,
যেখানে
নৈতিকতার কম্পাসের কোন নির্দেশনা
আর কাজ করত না। তিনি সেটার
নির্দেশক সূচকটিতে এমন জোরালো
ঘুর্নন দিয়েছিলেন যে,
এটি
যখন থামত খারাপ হয়ে যেত ভালো,
আর
ভালো হয়ে যেত 'শয়তান'।