অধ্যায় - ১৪ ইহুদিদের প্রশ্ন
ইয়াছরিব পৌঁছে মুহাম্মদ (সাঃ) ইহুদিদের সাথে মিলেমিশে থাকার আশা করতেন, যাদেরকে তিনি আহলে কিতাব তথা আসমানি “কিতাবওয়ালা” ভাবতেন। তিনি মনে করতেন তাঁর ধর্ম আসলে তাদেরই ধর্ম, কিন্তু তিনি তা পেয়েছেন বিশুদ্ধ আকারে। এবং তিনি আশা করেছিলেন যে, ইহুদিরা তাঁকে স্বীকৃতি দেবে, দুই হাত দিয়ে স্বাগত জানাবে। এটা অনেকটা দীর্ঘদিন আগে হারিয়ে যাওয়া ভাইদের আনন্দময় পুনর্মিলনের মতোই।
ইহুদিরা তাঁর ব্যাপারে কৌতূহলী ছিল। তিনি উপত্যকায় আসার আগেই তাঁর খবর সারা আরব জুড়ে ছড়িয়েছিল। তাঁরা মুহাম্মদের সম্পর্কে যা শুনেছে তার বেশিরভাগই এসেছে তাদের মক্কার লোকজনের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে, এবং যার সবটাই চাটুকারিতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু এটা বোধগম্য ছিল যে, তিনি তাদের মূর্তিপুজার নিন্দা করেছিলেন। ইহুদিরা নিজেরা তাঁর সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
যখন তিনি আবু আইয়ুবের বাড়িতে ছিলেন, তখন প্রধান ইহুদি গোত্রদের ধর্মযাজক তথা রাব্বীরা তাঁর সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ দেখা করেন এবং বিনীতভাবে তাঁর কথা শোনেন। মুহাম্মদ তাদের সাথে সৌজন্যমুলক ব্যবহার করেন এবং একসাথে সহাবস্থানের সদিচ্ছা দেখান। প্রথমেই তাদের ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, শুধু তাদেরকে তাঁর পাশাপাশি থাকার চিন্তা করছিলেন, যেমনটা দুটি কাফেলা একসাথে পাশাপাশি চলে দুই ভিন্ন গন্তব্যে ঠিক সেরকম। এই লক্ষ্যে তিনি তাঁর অনুসারীদের জেরুজালেমের দিকে মুখ করে প্রার্থনা করার আদেশ দিলেন। যদিও শুক্রবারকে তিনি তাঁর বিশ্রামের দিন হিসেবে বেছে নেন, আর ইহুদিদের ছিল শনিবার। তিনি কিছু ইহুদি রীতিনীতিও গ্রহণ করেন, যেমন প্রায়শ্চিত্তের জন্য রোজা রাখা (Day of Atonement)। ইহুদিদের জন্য এই দিনটি ছিল পবিত্র দিনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ইহুদিদের পবিত্র খাদ্যাভ্যাসের নিয়মকানুন পালন করার জন্য তাঁর অনুসারীদের আদেশ দিলেন। তথাকথিত মদীনার সংবিধানের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের একটি নতুন গোত্রতে পরিণত করেছিলেন, সেখানে তিনি সংযুক্ত করলেন যে ইহুদিরা তাদের নিজেদের ধর্ম স্বাধীনভাবে অনুসরণ করতে পারবে।
তবে ইহুদিদের কৌতূহল দ্রুত বিলীন হয়ে যায় এবং প্রথমে তাঁকে বিনোদন হিসেবে গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে তা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়, যখন মুহাম্মদ দাবি করেন যে তিনি তাদের নবী, সেই মুক্তিদাতা যার জন্য তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে প্রার্থনা করেছিলেন। মুহাম্মদ এ-ও বলেন, তাদের পবিত্র গ্রন্থে তাঁর সমন্ধে শুধু ভবিষ্যদ্বাণীই করা হয়েছে তাই-ই নয়, উপরন্তু ইয়াছরিবের ইহুদিরাও তাঁর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তারা আউস এবং খাজরাজ গোত্রের বিরুদ্ধে একজন মুক্তিদাতার (Messiah) আগমনের মধ্য দিয়ে তাদের দেশ ঈসরাইলে ইহুদিদের পুনর্বাসন করার হুমকি দিত, এটা তিনি স্মরন করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, বরং কয়েক শতাব্দী ধরে আউস ও খাজরাজ গোত্র যে তাদের কাছ থেকে ইয়াছরিবের নিচু ভূমি নিয়ে চাষ করেছে তাও ফিরিয়ে দেবেন। মুহাম্মদের এই দাবি শুনে ইহুদিরা স্তম্ভিত হয়ে গেল! তিনি ছিলেন একজন আরব যার বংশ পরম্পরা ইয়েমেনে খুঁজে পাওয়া যাবে, যেমনটা পাওয়া যাবে আউস এবং খাজরাজ গোত্রেরও। তাদের শাস্ত্রে যেই নবীর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, যেই মুক্তিদাতার (Messiah) কথা বলা আছে, তাঁকে হারুনের (Aaron) বংশধর হতে হবে, তাঁকে ইহুদি হতে হবে। মুহাম্মদ তাহলে এটা কিভাবে জানলেন না? তা সত্ত্বেও মুহাম্মদ জোর দিয়ে বলতে থাকলেন যে, তিনি তাদের শাস্ত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করা নবী। এমনকি তাওরাতে তাঁর নামও উল্লেখ করা হয়েছে; তাঁর শারীরিক বর্ণনাও দেয়া হয়েছে। তাঁর ভুল ভাঙানোর জন্য ইহুদি ধর্মযাজকগণ কষ্ট করে তাদের তাওরাত আরবিতে অনুবাদ করে সূত্র দেখান। যখন মুহাম্মদের সামনে এই সূত্র পড়ে শোনানো হয়, মুহাম্মদ উল্টো ইহুদিদের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলার অভিযোগ আনেন (১)।
ইহুদি ধর্মীয় পণ্ডিতরা তাঁর কাছ থেকে তাদের নবীদের কাহিনী শুনতে চাইলেন। তাঁরা ছিলেন তোরাহ'র (Torah) পণ্ডিত এবং এছাড়া ইহুদি কিংবদন্তিদের নিয়েও তাদের ভালো ধারণা ছিল। বাইবেলে যেই গল্পগুলো পাওয়া যায়, সেই চরিত্রগুলো ইহুদিদের গল্পের অলংকৃত জনপ্রিয় সংস্করণ যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। কিংবদন্তিদের গল্পগুলো লোকজনদের বলা হতো নৈতিকতার আদর্শ হিসেবে দেখাতে, এবং এই গল্পগুলো ধর্মগুরুরা মানুষকে আদর্শিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য ব্যবহার করত। মুহাম্মদের নবীর কাহিনী যতই তাঁরা শুনছিলেন ততই তারা বুঝতে পারলেন যে, সেগুলো তাওরাতের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে। এমনকি তাঁর গল্পেও উল্লেখযোগ্য ত্রুটি ও অসঙ্গতি ছিল (২)।
এমন কি হতে পারে যে, আল্লাহ তোরাহ গ্রন্থকে ইহুদিদের কাছে নাযিল করেছেন, আর তিনি মুহাম্মদের কাছে তাদের লোককাহিনীর একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছেন? নাকি মুহাম্মদ যাদের কাছ থেকে পৌরাণিক কাহিনীগুলো শুনেছিলেন, তাদেরই হয়তো এই চরিত্রগুলো নিয়ে ভুল জ্ঞান ছিল? অথবা হয়তো তারাই সঠিক সংস্করণ বলেছে, কিন্তু তিনি তা পরিবর্তন করছেন, যাতে তাঁর গল্পের সাথে মানানসই করা যায়। নাদির গোত্রের একজন নেতৃস্থানীয় পন্ডিত যার নাম সালাম মিশকাম (Sallam Mishkam) পরিশেষে এই রায় দিলেন যে, “তিনি (মুহাম্মদ) আমাদের কাছে এমন কিছু (গল্প) নিয়ে আসেননি যার মাধ্যমে আমরা তাঁকে চিনতে পারব” (৩)।
মক্কাবাসীরাও যখন তাঁকে সন্দেহ করা শুরু করল মুহাম্মদ তখন রেগে গেলেন। তিনি ইহুদিদের সমালোচনা করে কোরআনের আয়াত নিয়ে এলেন এবং তার দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকেন ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের সামনে তা পাঠ করে শোনাতে থাকেন। তিনি ‘প্রমাণ' হিসেবে বলেন, আল্লাহ যে তাঁর সাথে শুধু কথা বলেন তাই না, বরং আল্লাহ তাঁকে ব্যবহার করছেন ইহুদিদেরকে সতর্ক করে দিতে যে, তাদের কাছে যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তাঁরা বিকৃত করে ফেলেছে। আর তাই তাদেরকে সঠিক পথে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে পাঠিয়েছেন। এমন একটি আয়াতে মুহাম্মদ বলেন, “আর অবশ্যই মুসা তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। অতঃপর তোমরা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করলে। আর তোমরা তো যালিম” (৪)।
আরেকটিতে তিনি বলেন যে তাঁকে নবী হিসেবে প্রত্যাখ্যান করা আসলে ইহুদিদের পুরনো রীতির একটি অংশ, কারণ এর আগেও অনেক নবীকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছে : “অতএব যদি তারা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে, তবে তোমার পূর্বে রাসুলগণকেও মিথ্যাবাদী বলা হয়েছিল যারা স্পষ্ট প্রমাণসমূহ, সহীফা ও আলোকময় কিতাবসহ এসেছিলেন” (৫)।
উপরন্তু মুহাম্মদ তাদের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন : “কোরআনের মত বিস্ময়কর কিছু রচনা করুন অথবা এর কাছাকাছিও কিছু রচনা করে দেখান!” কিন্তু রাব্বী তথা ইহুদি পন্ডিতেরা তাঁকে এড়িয়ে গেলেন। তাঁরা মুহাম্মদের বানোয়াট গল্প যথেষ্ট শুনেছেন। তাঁরা বরঞ্চ অহংকার করে টেবিল তাঁর দিকেই ঘুরিয়ে দিয়ে বললেনঃ বুঝলাম আপনার কাছে আকাশ থেকে একটি কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে ঠিক যেমন তাওরাত অবতীর্ণ হয়েছে মুসার উপর, কিন্তু তা প্রথমে আমাদের কোন এক রাব্বির উপর অবতীর্ণ হওয়া উচিত যিনি সাক্ষ্য দেবেন যে, মুহাম্মদ তাদের একজন নবী। তখন আমরা বিশ্বাস করতাম। মুহাম্মদ জবাবে আরো একটি কোরানের আয়াত বলেন এবং এতে তাঁরা বরং তাঁকে আরও অবিশ্বাস করতে লাগলেন। আয়াতটির বক্তব্য “কিতাবীগণ তোমার নিকট চায় যে, আসমান থেকে তুমি তাদের উপর একটি কিতাব নাযিল কর। অথচ তারা মুসার কাছে এরচেয়ে বড় কিছু চেয়েছিল, যখন তারা বলেছিল, 'আমাদেরকে সামনাসামনি আল্লাহকে দেখাও'। ফলে তাদেরকে তাদের অন্যায়ের কারণে বজ্র পাকড়াও করেছিল। অতঃপর তারা বাছুরকে (উপাস্যরূপে) গ্রহণ করল, তাদের নিকট স্পষ্ট প্রমাণসমূহ আসার পরও। তারপর আমি তা ক্ষমা করে দিয়েছিলাম এবং মুসাকে দিয়েছিলাম সুস্পষ্ট প্রমাণ” (৬)।
মুহাম্মদ দাবি করেন যে, তিনি ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্মের সংস্কার করতে এসেছিলেন। ইহুদি ও খ্রিস্টানদের কাছে যা অবতীর্ণ করা হয়েছিল তা থেকে তাঁরা নাকি বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। মুহাম্মদ এটি আরো এগিয়ে নিতে একবার ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মবেত্তাদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন (৭)। সেখানে তাঁরা নিজেরা নিজেরাই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং এই ঘটনার দ্বারা মুহাম্মদ প্রমাণ করতে চাইলেন যে, তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে এবং তাদের পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন ছিল। মুহাম্মদের জন্য এটা খুবই আনন্দের বিষয় ছিল যে, ইহুদিরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাদের ধর্মকে মিথ্যা বলার জন্য অভিযুক্ত করছে; আর খ্রিস্টানরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাদের মুক্তিদাতাকে (ঈসাকে) হত্যার অভিযোগ এনেছে। ইহুদিরা বলেছে যে, খ্রিস্টানদের জন্য জান্নাতে কোন স্থান নেই, কারণ তারা একজন মিথ্যা নবীকে অনুসরণ করে। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা দাবি করে যে, ঈসার প্রতি বিশ্বাসের মাধ্যমেই কেবল পরকালের সুখ নিশ্চিত হবে। যখন তাদের তর্ক শেষ হয় মুহাম্মদ তাদেরকে দেখিয়ে দেন যে, তারা উভয় পক্ষই দাবি করছে তাদের উপর কিতাব নাজিল হয়েছে, কিন্তু তারা এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি তাই তারা উভয় পক্ষই ভুল। তাঁরা আল্লাহর বাণীকে নষ্ট করে দিয়েছিল, আর সেজন্যই তিনি মুহাম্মদকে সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বের কাছে পাঠিয়েছনে যাতে সত্য উন্মোচন হয় এবং মানুষ সঠিক পথে পরিচালিত হয়। তিনি ঘোষণা করলেন খ্রিস্টানরা ভুল ছিল, কারণ তারা যীশুর সাথে ঐশ্বরিক ক্ষমতা যুক্ত করে কিন্তু তারা নিজেরাই একমত হতে পারেনি, কি এই ঐশ্বরিক ক্ষমতা। তারা বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়েছে এবং প্রত্যেকেই মনে করে তাদেরটাই সত্য পথ। এরচেয়েও বড় যে অপরাধ তারা করছে সেটা হলো, বহুশ্বরবাদীদের মতো তাঁরাও দাবি করেছে যে যীশু ঈশ্বরের পুত্র (৮)।
ইহুদি ও খ্রিস্টান উভয়কে অবাক করে দিয়ে মুহাম্মদ যীশুর মৃত্যুর জন্য ইহুদিদের দায়ী করা থেকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। মুহাম্মদ তাদের বলেন, তারা (ইহুদিরা) যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেনি, বরং যীশুর পরিবর্তে অন্য একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। শেষরাতের খাবারের (The last Supper) সময় যখন যীশুর শত্রুরা তাঁর মৃত্যুর ষড়যন্ত্র করছিল যীশু তখন তাঁর শিষ্যদের মধ্যে থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবককে তাঁর জায়গায় মরতে বললেন এবং তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, তাঁকে জান্নাতে একটি বিশেষ স্থান দেয়া হবে। আল্লাহ স্বেচ্ছাসেবকের চেহারা যীশুর মতো বদলে দিয়েছিলেন। ওই স্বেচ্ছাসেবককে নির্যাতন করা হয় এবং ক্রুশবিদ্ধ করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবককে যখন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আল্লাহ তখন যীশুকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। আর যে ভবনে রাতের শেষ খাবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার ছাদে ফুটো করেই যীশুকে তুলে স্বর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর শিষ্যেরা তা দেখেও চুপ করে ছিলেন। এমনকি মরিয়মও (Mary) এই অদল-বদল দেখে বোকা বনে গিয়েছিলেন (৯, ১০) ।
ইয়াছরিবে মুহাম্মদের আগমনের এক বছরের মধ্যে ইহুদিরা তাঁর সাথে এই বিষয়ে কথা বলা ছেড়ে দেয়। তারা উদ্বিগ্ন ছিল, কারণ তিনি ছিলেন অনমনীয় এবং অদ্ভুত প্রকৃতির। ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগগুলো অর্ধসত্য, বিকৃত, সরাসরি মিথ্যা অথবা গাঁজাখুরি গল্প, যেমন তাঁর যীশুর গল্পটি। তাঁর মত এমন একজনের সাথে কথা বলার কি আছে? মুহাম্মদ দাবি করতেন যে, তিনি সবসময় সঠিক ছিলেন আর তারা সবসময় ভুল ছিল, এবং হাজার তর্ক করেও তাঁকে বোঝানো যেত না। ঠিক মক্কাবাসীরা যেমন করেছিল, তেমনি তারাও প্রকাশ্যে তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে লাগলেন। কাব বিন আশরাফ ( Kab Ashraf) নামের একজন ইহুদি কবি ও বনু নাদির / নযীর ( Nadir) গোত্রের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মুহাম্মদকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর সাথে অন্যান্য ইহুদি কবিরাও যোগ দেন। যখনই তারা মুহাম্মদ বা তাঁর কোন লোকদের মুখোমুখি হতেন, ইহুদিরা “আপনার উপর 'শান্তি' বর্ষিত হোক” এই শুভেচ্ছা বাণীটিতে শান্তির বদল 'মৃত্যু' শব্দ বসিয়ে বলতেন, যার মানে দাঁড়াত – “আপনার উপর মৃত্যু বর্ষিত হোক”।
যখন মুহাম্মদ পরিস্কার বুঝতে পারলেন যে, ইহুদিরা তাঁকে মেনে নেবে না মুহাম্মদ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। তাঁর মৃগীরোগের অভিজ্ঞতা তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিল যে, আল্লাহ তাঁর সাথে কথা বলছিলেন। তাঁর মাথায় যা কিছু আসে তা সবই আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং আল্লাহ কখনো মিথ্যা বলেন না। ইহুদিরা কি ঈশ্বরকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করছে? তারা কিভাবে তাঁকে বুঝতে পারল না যে, তিনি তাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছেন? একপর্যায়ে ইহুদিদের পবিত্র দিনে, তাদের প্রার্থনাস্থলে তিনি এবং তাঁর সমমনা ঘনিষ্ঠদের একটি দল ঢুকে চরমপত্র দেন এই বলে : “হে ইহুদিরা, আপনাদের মধ্যে বারোজন লোক দেখান যারা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ তাঁর প্রেরিত রাসুল। শুধু এটুকু করলেই আল্লাহ আপনাদেরকে ছেড়ে দেবেন এবং স্বর্গে দাখিল করবেন”। তিনি আরও দু'বার একই কথা বললেন, কিন্তু ইহুদিরা চুপ করে রইল। তিনি বললেন, “আপনারা প্রত্যাখ্যান করলেন! আল্লাহর কসম, আমিই শেষ নবী এবং আমিই শেষ নবী এবং আমিই মনোনীত নবী; আপনারা তা বিশ্বাস করেন আর নাই করেন” (১১)।
ইহুদিরা যেহেতু তাদের দাড়ি ছেঁটে গোঁফ রাখত তাই তিনি তাঁর অনুসারীদের ইহুদিদের সাথে পার্থক্য করার জন্য দাড়ি লম্বা করে রাখা এবং গোঁফ ছেঁটে রাখার আদেশ দিলেন। মসজিদে নামাজের মধ্যে তিনি ইহুদিদেরকে ক্রমাগত অভিশাপ দিতেন, ঠিক যেমনি মক্কায় তিনি তাঁর বিরোধীপক্ষের প্রতি ঘৃণার চাষ করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরের প্রতি আহ্বান জানাতেন এভাবেঃ “হে আল্লাহ! তাদের অবিশ্বাস ও ত্রুটির কারণে ইহকালে ও পরকালে তাদের শাস্তি দাও। নিশ্চয়ই তারা জালেম”। প্রায়ই তিনি প্রার্থনা করতেন কোরআনের আয়াত দিয়ে, যার মধ্যে অনেকগুলো রচনাই ছিল বিস্তারিতভাবে অভিশাপের বর্ণনা। তাঁর অনুসারীরা তোতাপাখির মতো তাঁর কথাই পুনরাবৃত্তি করতেন। তিনি তাদের এই ধারণা দিয়েছিলেন যে, মুহাম্মদ যেই আচরণ করছে তা সবসময়ই ইশ্বরের ইচ্ছার প্রতিফলন, তাঁকে সেইভাবে অনুকরণ করা মানে সহজভাবে জান্নাতের পথে ঢোকা। অতএব তাদের প্রার্থনায় বিশ্বাসীরা ইহুদিদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিশাপের পুনরাবৃত্তি করত। তারা কোরআনের আয়াতগুলো মুখস্ত করেছিল, যেগুলিতে ইহুদিদের নিন্দা করা হয়েছে। ক্রমশ মুহাম্মদের ঘৃণা তাদের ঘৃণা হয়ে ওঠে; তাঁর শত্রুরা তাদের শত্রুতে পরিগণিত হয়ে ওঠে ।
মুহাম্মদ যখন ইহুদিদের শয়তান বলা শুরু করলেন, তিনি আর থামেননি। তিনি একটা আক্রমণাত্মক এবং কলঙ্কজনক প্রচারণা চালান। ঘৃণার মাত্রা যখন বাড়তে থাকল, তিনি একজন ইহুদি কিংবদন্তির সাথে একটি গল্প জুড়ে দেন যে, ঈশ্বর একসময় কিছু ইহুদি জেলেকে বানরে রূপান্তরিত করেছিলেন, কারণ তারা বিশ্রামবারের দিন বিশ্রাম না করে আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছিল। তারা চালাকি করে শনিবার একটি মাছের ফাঁদ তৈরি করেছিল এবং রবিবার তা সংগ্রহ করেছিল এবং এই দুষ্ট কাজের জন্য তাদের পুরুষ এবং নারীদের বানরে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। মুহাম্মদ ইহুদিদের উপর কাহিনী ঘুরিয়ে দেন এবং তাদেরকে “বানর” বলতে শুরু করেন। তিনি তাঁর এই কাহিনীর সংস্করণ কোরআনে যোগ করেছেন : “আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল, তাদেরকে অবশ্যই তোমরা জান। অতঃপর আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও” (১২)
সকল আক্রমণাত্মক এবং ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে মুহাম্মদ মূলত ইহুদিদের সামরিক শক্তির পরীক্ষা করছিলেন এবং সেই সময়টুকুতে শুধু তাদেরকে অপমান এবং অপদস্ত করার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছিলেন। তিনটি ইহুদি গোষ্ঠীর প্রত্যেকেরই সাতশত যোদ্ধা নিয়ে ময়দানে যাওয়ার সক্ষমতা ছিল। তিনটি গোত্রের একটির আবার খাজরাজ প্রধান আবদুল্লাহ উবাইয়ের সাথে মিত্রতা ছিল, যিনি এখনো পুরো উপত্যকার নেতৃত্ব দেয়ার আশা ছাড়েননি। যদিও অনেক আউস এবং খাজরাজ মুহাম্মদের কাছে ভিড়েছে, তবে আবদুল্লাহ এখনও শতশত যোদ্ধা নিয়ে মাঠে নামতে পারেন। আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যও মুহাম্মদের পক্ষে ছিল না। ইহুদিরা মক্কাবাসীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছিলেন এবং ইয়াছরিবের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বেদুইন গোত্রদের সাথেও তাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। উপরন্তু, তারা ইয়াছরিবের নব্বই মাইল দুরত্বের এক সমৃদ্ধ অঞ্চল খাইবারের লোকদের সাথে ধর্ম এবং পারিবারিক বন্ধন দ্বারা সম্পর্কিত ছিল। তবে মুহাম্মদের জন্য অন্যতম সুবিধা হচ্ছে, ইয়াছরিবের ইহুদিরা ঐক্যবদ্ধ নয়। পৌত্তলিক গোত্রদের সাথে জোটের কারণে, তারা সাম্প্রতিক আন্তঃগোত্রীয় যুদ্ধে একে অপরের সাথে লড়াই করেছে এবং তাদের মধ্যে তিক্ততাও অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু তিনি ভয় পেতেন যদি তিনি তাদের উত্তেজিত করেন, তাহলে তাঁরা হয়তো একত্রিত হয়ে একটি শক্তিশালী শক্তিতে পরিণত হয়ে তাঁকে পিষে ফেলতে পারবে।
তবে ইহুদিরা মুহাম্মদকে নিয়ে ক্রমশ উদ্বিগ্ন হতে থাকেন। তিনি ইতোমধ্যে ভয়ঙ্কর সহিংসতার লক্ষণ দেখিয়েছেন। প্রথমে দিকেই তাঁর অনুসারীরা মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা ঘটায়, যা শুধুমাত্র তাঁর প্ররোচনায় ঘটে থাকতে পারে। সম্প্রতি, মক্কাবাসী কাফেলার বিরুদ্ধে যে অভিযান চালিয়েছিলেন, তা মূলত তাঁর নিজের লোকদের বিরুদ্ধেই অভিযান। প্রথমে এই অভিযান ছোটমাত্রায় শুরু হয়েছিল, কিন্তু সম্প্রতি তিনি একশত বা দুইশত যোদ্ধা পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর ক্ষমতা পরিষ্কারভাবে বেড়ে চলছে।
মুহাম্মদের উদ্দেশ্য সন্দেহজনক মনে করে ইহুদিরা তাঁর উপর গুপ্তচরবৃত্তি করে। ইসলামিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, তাঁর উদ্দেশ্য জানতে ছয়জন ইহুদি ধর্মান্ধরিত হওয়ার ভান করে, যাতে তাঁরা মসজিদের ভেতর যেতে পারে। এভাবে তাঁরা মুহাম্মদের উপদেশ শুনতে এবং সেখানকার আলোচনা শুনে তা তাদের রাব্বির কাছে পেশ করত। মুহাম্মদ সন্তুষ্ট হলেন যখন তাঁরা তাঁর ধর্ম গ্রহণ করল, এই বিশ্বাসে যে, অবশেষে ইহুদিদের সাথে তাঁর যেই ঝামেলা তা এখন মিটমাট হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষনের মধ্যেই তিনি তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন, যখন তাঁরা নামাজের শুরুতেই ঝিমুচ্ছিল, আর নাক মোছা ও শরীর চুলকাতে ব্যস্ত ছিল। তাঁরা কোরানের আয়াত বিড়বিড় করে বলত। যখন সিজদায় যাওয়ার সময় হলো, তাঁরা অন্য উপাসকদের সাথে সমন্বয় করছিল না। আরও বিরক্তিকর ব্যাপার হচ্ছে, তাঁরা পেছনের সারিতে একসাথে ছিল এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। একবার যখন মুহাম্মদ খুৎবা (শুক্রবারের ভাষণ) দিচ্ছিলেন, তখন তিনি তাদের হাসাহাসি করতে দেখে রেগে ফায়ার হয়ে গেলেন। তাঁরা আন্তরিক (মুখলিস) নয়, সুতরাং তাদেরকে মুনাফিক বলে তিনি অভিযুক্ত করেন এবং তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার আদেশ দেন। মুহাম্মদের অনুসারীরা লাফ দিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং মাটিতে ফেলে মারেন, রাস্তায় টেনে নিয়ে যান। একজনকে তাঁর চুল ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, অন্যজনকে তাঁর দাড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন বিশ্বস্ত চিৎকার করে বলে, “আর কখনো যেন তারা রাসুলের মসজিদের কাছে এসো না, কারণ তোমরা অশুচি” (১৩)!
কোরআনে তাঁর অবস্থান থেকে এটা ধরে নেয়া যেতে পারে যে, মুহাম্মদ এই সময়কার কাহিনীগুলো আব্রাহাম, ইসমাইল ও হাগার (মুসলিমরা বলে হাজেরা) থেকে নিয়েছেন। ইহুদিদের কাছ থেকে স্বীকৃতি না পেয়ে হতাশ হয়ে তিনি তাঁর কাহিনীতে বাইবেলের আব্রাহাম ও তাঁর প্রথম পুত্র ইসমাইলকে মক্কায় স্থানান্তর করে প্রতিশোধ নেন। বাইবেলের আব্রাহাম (ইব্রাহিম), সারাহ, ইসমাইল ও হাগারের পারিবারিক গল্প-উপাখ্যানের পটভূমি একচেটিয়াভাবে লেভান্ত (লেভান্ত বলতে বোঝায় বৰ্তমান ইসরায়েল, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও প্যালেস্টাইনের বিস্তীর্ণ ভূমি) অঞ্চল থেকে সরিয়ে মুহাম্মদ একটি গল্পের নয়া পটভূমি তৈরি করেন। এই গল্পে তিনি বাইবেলের আব্রাহাম, ইসমাইল ও তাঁর মাকে মক্কার উপত্যকায় নিয়ে যান এবং সেখানে তাদেরকে পরিত্যাগ করে চলে যান। এবং এভাবেই মুহাম্মদ ঈসমাইলের বংশধরদের সাথে তাঁর নিজের একটি বংশপরম্পরার যোগসূত্র তৈরি করেন। এই নতুন পরিস্থিতিতে মুহাম্মদ এখন আব্রাহামের সরাসরি বংশধর বনে যান, যে আব্রাহাম ইহুদি বা খ্রিস্টান ছিলেন না, কিন্তু তিনি একেশ্বরেবাদের প্রথম বিশ্বাসী ছিলেন। এবং তাঁর সরাসরি বংশধর হিসেবে মুহাম্মদকে পাঠানো হয়েছে 'আমাদের পিতা ইব্রাহীমের' প্রকৃত বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্য। এভাবেই তিনি তাঁর নিজের মহাকাব্যিক চিত্রনাট্যের নায়ক হয়ে ওঠেন (১৪, ১৫)।
এই নতুন সংস্করণটি কোরানের রচনার মাধ্যমে জীবন্ত রূপ দেয়া হয়েছে এই বলে যে, ইসমাইল ও তাঁর মাকে নির্জন ও জলশূন্য উপত্যকায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। যখন তারা তৃষ্ণায় দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন হাগার জলের খোঁজে দুটি নিচু পাথরের পাহাড়ের মধ্যিখানে দৌড়াতে থাকে। শিশু ইসমাইল মাটিতে আঘাত করে এবং এর ফলে সেখানে জীবন রক্ষাকারী জলের ফোয়ারা বয়ে যায়। অবশেষে অব্রাহাম ফিরে আসেন এবং ইসমাইলকে নিয়ে উপাসনালয় তৈরি করেন। উপাসনালয়ের দেয়ালের উচ্চতা বাড়ার কারণে আব্রাহাম একটি বড় পাথরখন্ডের উপর দাঁড়িয়েছিলেন (নির্মাণ কাজ করেছিলেন)। সেই পাথরটিকে মুহাম্মদ পরে 'আব্রাহামের দাঁড়ানোর স্থান' (মাকামে ইব্রাহিম) বলে অভিহিত করেছিলেন। দাবি করা হয়, সেই পাথরের উপর দাঁড়িয়েই নাকি আব্রাহাম তাঁরা পুত্র ইসমাইলের হাতে মন্দির নির্মাণের পাথর তুলে দিতেন।
মুহাম্মদ যখন তাঁর রচনাটি সম্পন্ন করে ফেললেন, তিনি তাঁর অনুসারীদের 'কিবলা' পরিবর্তন করার আদেশ দিলেন - প্রার্থনার দিক এখন থেকে জেরুজালেমের পরিবর্তে মক্কার দিকে হবে। ইসলামের মৌলিক গ্রন্থসমূহে এই কিবলা পরিবর্তনের ঘটনাটি এভাবে বিবৃত হয়েছে : একদিন মসজিদের প্রার্থনা অধিবেশন (নামাজ) চলাকালীন সময়ে যখন সবাই সেজদারত ছিল, তখনই আল্লাহ মুহাম্মদকে দিক পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেন। সে সময়েই ইবাদতকারীদের (উপাসক) সারির সামনে থাকা মুহাম্মদ হঠাৎ করে উত্তর থেকে দক্ষিণে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন এবং অনুগামীদেরকেও একই কাজ করার আদেশ দিলেন এবং তাদের জানালেন যে, তিনি এইমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে একটি আদেশ পেয়েছেন। এরপর থেকেই অব্রাহাম ও ইসমাইলের বানানো "ঈশ্বরের ঘরের' (কাবা) দিকে মুখ করে প্রার্থনা করার প্রচলন শুরু হয়। এই যে নামাজের দিক পরিবর্তন করা হলো এটি মুহাম্মদের তরফ থেকে ইহুদিদেরকে প্রত্যাখ্যান করার ইঙ্গিত এবং এর ভবিষ্যৎ প্রভাব হবে ভয়ানক!
পরবর্তী কয়েক বছর তিনি তাঁর ইয়াছরিবকে শুদ্ধ করবেন ইহুদি জনসংখ্যা থেকে। তিনি উপত্যকা থেকে দুটি প্রধান গোত্রকে তাড়িয়ে দেবেন এবং তাদের পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে নেবেন। তৃতীয় গোত্রের ভাগ্য আরও খারাপ হবে। ইয়াছরিবে আসার পর যে মুহাম্মদ আব্রাহাম আর মক্কা-কাহিনী রচনা করেছিলেন, তাঁর প্রমাণ ইসলামি আদি গ্রন্থেই পাওয়া যায়। ইবনে কাছির তাঁর কোরানের তাফসীরে লিখেছেন যে, ইয়াছরিবে বসতি স্থাপনের কয়েক বছর পর মুহাম্মদ যখন মক্কায় যাত্রা করেছিলেন উমর তখন মন্দিরের পাশে মাটিতে অর্ধেক গাঁথা বর্গাকার একটি পাথরের দিকে ইঙ্গিত করে মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করেন যে, মন্দির নির্মাণের সময় “আমাদের পিতা আব্রাহাম” যে পাথর ইসমাইলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, এটিই কি সেই পাথর? মুহাম্মদ বলেছিলেন, “হ্যাঁ” (১৬)। উমরের প্রশ্নটি ছিল এক শক্ত প্রমাণ, যা থেকে বোঝা যায় যে, মুহাম্মদ এই গল্পটি মক্কা থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরেই আবিষ্কার করেছেন। উমরের জন্ম হয় মক্কায়, তাঁর বেড়ে ওঠাও সেখানে। পাথরটি যদি মক্কার ধর্মীয় ঐতিহ্যের অংশ হতো তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এটা সম্পর্কে জানতেন। আর মক্কার ধর্মীয় ঐতিহ্যের সূচনা হয়েছে মুহাম্মদের নবী হিসেবে আত্মপ্রকাশেরও দশ প্রজন্ম আগে, ইয়েমেন হতে আগত পূর্বসূরীদের হাত ধরে। উমরের এই প্রশ্ন দেখিয়ে দেয় যে, আব্রাহাম মক্কার (মক্কার সাথে আব্রাহামকে জুড়ে দেয়া) কাহিনীর পটভূমি মুহাম্মদের ইয়াছরিবে আসার পরেই সৃষ্টি করা হয়েছে।
সেই সময় উমর আরো জিজ্ঞাসা করেন, “আমরা কি এটাকে প্রার্থনার স্থান বানাতে পারি?” আল্লাহ নিশ্চয়ই শুনছিলেন, কারণ মুহাম্মদ দ্রুতই একটি আয়াত নিয়ে আসেন : “আর যখন আমি কাবাকে মানুষের জন্য মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ স্থান বানালাম এবং তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থানরূপে গ্রহণ কর" (১৭)। তবে পাথরের একটি গল্প আছে, কিন্তু মুহাম্মদ যা আবিষ্কার করেছেন সেই গল্পটি এটি নয়। পাথরখন্ডটি কাটা ছিল, এবং সম্ভবত ৬০৫ সালে যখন মন্দির পুনর্নির্মাণ করা হয় সেই সময়ই পাথরের অর্ধেকটা মন্দিরের প্রবেশপথের কাছে মাটির নিচে ডুবে গিয়েছিল। সেই বছরই প্রথম মন্দিরের পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং মুহাম্মদ সেই কাজে সাহায্যে করেন, এবং মন্দিরটি ঘনক আকৃতি ধারণ করে। এ সময়ে তাঁকে কাপড় খুলে ফেলার জন্য চাপ দেয়ার ফলে তিনি মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সম্ভবত পাথরটির উপর দাঁড়িয়ে মন্দির নির্মাণের পাথর তোলার পা-দানি হিসেবে তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। মুহাম্মদ হয়তো নিজে খিঁচুনির পর বিব্রতকরভাবে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার আগে বা পরে সহকর্মীদের হাতে পাথর তুলে দিতে এই পাথরটির উপর দাঁড়িয়েছিলেন। উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, পাথরটি পেছনে ফেলে রাখা হয়েছিল এবং গ্রীষ্মের গরমে ছায়ার জন্য এটির উপর মানুষ বসতেন।
মক্কার সবাই এটি সমন্ধে জানত এবং মন্দিরের শীতল ছায়া ফেলার সময় তাঁর উপর মানুষজন বসত। এমনকি মুহাম্মদও এর উপর বসেছিলেন। তুখোড় বিচক্ষণতা দিয়ে তিনি মক্কায় আব্রাহামের কাহিনী তৈরি করে সামান্য একটি পাথরকে মুহাম্মদ পিতৃতান্ত্রিক পাথরে রূপান্তরিত করেন। এবং ছলনাহীন সরল প্রশ্নের মাধ্যমে উমর এই দুটোর কল্পিত উৎসের প্রমাণ আমাদের
কাছে রেখে গেছেন।