অধ্যায় ৪ সুরক্ষাদাত্রী
ইসলামের আদি গ্রন্থে পাওয়া যায়, আবু তালিব ছিলেন একজন সাধারণ বৃদ্ধ, ঘর ভর্তি তাঁর বাচ্চাকাচ্চা ছিল, যাদেরকে তিনি ঠিকমত খাওয়াতে পারতেন না। তবে এটা সম্ভবত হয়েছিল অতিরিক্ত খরার কারণে। যেহেতু ফসল হতো না, তাই খাদ্যের অভাব প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিল। হালিমা উল্লেখ করেন, মুহাম্মদকে পালক নেয়ার পর অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে। যখনই মুহাম্মদ খাবারের সময় অনুপস্থিত থাকতেন, খাবারে কোন বরকত থাকত না, ফলে সকলেই ক্ষুধার্তই থেকে যেতেন। আর মুহাম্মদ উপস্থিত থাকলে তখনি খাবারের এত বরকত হতো যে ভরপেটে খেয়ে সবাই মাদুর থেকে পেট ঘষতে ঘষতে তৃপ্তির ঢেঁকুর দিতে দিতে উঠতেন। এমনকি সবাই খেয়েও খাবার বেঁচে যেত!
আবু তালিব ধনী ছিলেন না, কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে, তাঁর পরিবারের সবাইকে খাওয়ানোর জন্য তাঁর ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল। আবদুল মুত্তালিবের বেঁচে থাকা পুত্রদের মধ্যে তিনিই ছিলেন বড় এবং বিশিষ্ট, যার ফলে তিনিই হাশিমি বংশের প্রধান ছিলেন এবং মন্দিরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কর্তা ছিলেন। কোন একসময় তিনি মন্দিরের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর ছোটভাইকে দিয়ে দেন, আর তিনি নিজে ব্যবসায় মনোযোগ দেন। হাশিমি গোত্রের প্রধান হবার কারণে সবাই তাঁকে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি ব্যবসায় ভালো করতে পারবেন। তিনি ছিলেন বিনয়ী স্বভাবের, যার ফলে তিনি চুক্তি সম্পাদনের বেলায় অত তীক্ষ্ণ স্বভাবের ছিলেন না, তাই তিনি অপরপক্ষকে অনেক বেশি ছাড় দিতেন। এককথায় তিনি ছিলেন দোদুল্যমান স্বভাবের। তবুও এটা সন্দেহ করার কোন কারণ নেই যে, ঐ সময়ে তিনি তাঁর নিজের সন্তান এবং ‘বাড়তি ঝামেলা' মুহাম্মদকে নিয়ে তাঁর বড় পরিবারের খাবার জোগাতে অক্ষম ছিলেন।
মুহাম্মদ আবু তালিবের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে মন্দিরের কাছে ছোট একটি ঘরে থাকতেন। বড় ছেলে তালিব (Talib) ছিল মোহাম্মদের সমসাময়িক। আকিল ( Aqil) এবং জাফর (Jafar) ছিলেন ছোট। আলী, যিনি পরে মুহাম্মদের ধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং ভবিষ্যতের খলিফা হয়ে উঠবেন, তিনি তখনো জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁর বেশ কয়েকটি মেয়ে ছিল জুমানা (Jumana), তাইতা (Tayta) এবং ফখিতা (Fakhita)। তৃতীয়জনকে সবাই তাঁর মায়ের নামে ফাতিমা বলে ডাকতেন, পরে তাঁর নাম হয়ে যায় উম্মে হানি তথা হানির মা। মুহাম্মদ যখন কিশোর বয়সে, তখন তিনি উম্মে হানির প্রেমে পড়েন। তিনি তাঁর চাচার কাছে উম্মে হানিকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেন। যদিও আরবে রক্তের সম্পর্কের ভেতর বিয়ে বৈধ ছিল, কিন্তু চাচা তাঁকে নাকচ করে দেন। এটা সম্ভবত মুহাম্মদ যেহেতু আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী ছিলেন না সেজন্য। অধিকন্তু, তিনি মাখজুম গোত্রের (Makhzums) এক সফল ব্যবসায়ীর সাথে হানির বিয়ে ঠিক করেন। এই মাখজুম গোত্র কুসাইর বংশ থেকেই আগত। আবু তালিবের মা ছিলেন সেই গোত্রের মেয়ে, এবং ছিলেন আবু তালিবের প্রথম চাচাতো বোন। ফখিতার বিয়ে শেষমেশ মাখজুম গোত্রেই হয়, যার ফলে মুহাম্মদের হৃদয় ভেঙে যায়।
ইসলামিক উৎসসমূহে, সেই সময়ে আমরা মুহাম্মদের তেমন কোন কর্মসংস্থানের উল্লেখ পাই না। শুধু দেখতে পাওয়া যায় যে, তিনি কাফেলা বাণিজ্যে সক্রিয় ভূমিকা রাখতেন। তাও শুধুমাত্র একটা কাফেলা অভিযানের কথা পাওয়া যায়, মূলত এই কাফেলা যাত্রায়ই মুহাম্মদকে খাদিজার সাথে মিলিত হবার এবং পরবর্তীতে পঁচিশ বছর বয়সে তাঁকে বিয়ের পথকে সুগম করেছিল। ইবনে সাদ লেখেনঃ মুহাম্মদ সক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থানের সন্ধান করেননি, এজন্য তাঁর চাচা তাঁকে তীব্র নিন্দা করেছিলেন। তিনি মনে করতেন মুহাম্মদের এখন কাজের সন্ধান করা উচিত। তিনি তাঁকে একটি ব্যবসার সন্ধান দেন এবং তাতে লেগে থাকার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, "আমি গরিব মানুষ, আমরা কঠিন দিন পার করছি, খাদিজা বিনতে খুওয়ালিদ (Khadijah bint Khuwaylid) তাঁর পণ্য নিয়ে সিরিয়ায় লোক পাঠায়, তুমি যদি তাঁর কাছে গিয়ে বলো যে তুমি এই কাফেলায় যেতে চাও, সে তোমাকে গ্রহণ করবে”(১)। আবু তালিব ইতিমধ্যে কাজের জন্য সবকিছু প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। যখনই তিনি জানতে পারলেন যে, খাদিজা কাফেলার জন্য লোক খুঁজছে তিনি পাহাড়ের পথ ধরে খাদিজার বাড়িতে গিয়ে তাঁর ভাতিজাকে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।
সমস্ত গ্রন্থের বিবরণ অনুসারে খাদিজা ছিলেন এক ব্যতিক্রমী নারী। ছিলেন বুদ্ধিমতি, সুন্দরী এবং ধনী। তিনি মক্কার বণিক খুওয়ালিদের (Khuwaylid ) কন্যা ছিলেন। কিছু কিছু বিবরণ অনুসারে, খুওয়ালিদকে পবিত্র যুদ্ধের সময় হত্যা করা হয়েছিল। আবার অনেকেই দাবি করেন, খাদিজা-মুহাম্মদের বিবাহের সময় খুওয়ালিদ বেঁচে ছিলেন। খাদিজা মূলত এই বাণিজ্য তাঁর বাবার কাছ থেকে শিখেছিলেন। তিনি সিরিয়া এবং ইয়েমেনের প্রধান বাণিজ্যিক কাফেলার অর্থের জোগান দিতেন। তিনি সম্ভবত পশ্চিম আরবের ছোট ছোট অঞ্চলগুলো যেমন তায়েফ, নাজরান এবং ইয়াছরিবেও বাণিজ্য করতেন (২)। যদিও এটা কোথাও পাওয়া যায় না তিনি কি ধরনের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। মক্কায় তখন অন্যান্য ব্যবসার মধ্যে কেউ চামড়ার তৈরি জিনিস, আবার কেউ কেউ খনিজ পণ্য, কেউ আবার উট ও গাধা বিক্রি করতেন। জুদান (Judan) নামের একজন ছিলেন যিনি দাসদাসী বিক্রি করতেন।
তারা বাণিজ্য থেকে ফিরে আসার সময় বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য যেমন কাঠ, সুগন্ধি, শুকনো খাবার ইত্যাদি নিয়ে আসতেন, যা আবার মক্কাবাসীদের কাছে বিক্রি করে লাভবান হতেন। যা বিক্রি হতো না তা গুদামজাত করে রাখতেন পরবর্তী কাফেলার জন্য। উল্লেখ আছে, খাদিজার বয়স ছিল চল্লিশ বছর। তিনি পূর্বের বরর সাথে দুই বা তিন সন্তানের জন্ম দেন। তন্মধ্যে প্রথম সন্তান তাঁর বরর মৃত্যুর সময়ই মারা যান, আরেকজন তাঁর তালাকের পর মারা যান। তাঁকে অনেক ধনী মক্কাবাসী বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠান, তিনি তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
পঁচিশ বছর বয়সে মুহাম্মদ দেখতে মোটামুটি ছিলেন। লম্বায় ছিলেন মধ্যম আকারের, প্রশস্ত কাঁধ, মাথাটা ছিল বড়, মুখ ছিল গোলাকৃতির এবং মুখ ছিল দাড়ি ভর্তি। সেই সময়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তিনি কালো বা সাদা পাগড়ি পড়তেন, অবশিষ্ট কাপড় একটু লেজের মতো ঝুলিয়ে রাখতেন, যাতে মরুভূমির বালুর ঝড়ের সময় তিনি টেনে মুখ ঢাকতে পারেন। তবে সাধারণত তিনি এই কাপড়টুকু তাঁর কাঁধের উপর রাখতেন অথবা তাঁর পিঠের পেছনে ঝুলতে থাকত। তাঁর চোখ সবসময় রক্তাক্ত থাকত, তবে সেটা নেশার কারণে নয়। তিনি খুবই দ্রুতগতিতে হাঁটতেন। তিনি বাস্তব চিন্তার চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্নবাজ, কম কথা বলার মানুষ ছিলেন। তিনি নিজে কম কথা বলতেন তবে মনযোগ নিয়ে অন্যদের কথোপকথন শুনতেন। তিনি কথা শোনার সময় অন্যের চোখে খুব কমই তাকাতেন, বরঞ্চ তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন। তিনি বেশিরভাগ সময় বিষাদগ্রস্ত থাকতেন, এটা সম্ভবত তাঁর স্নায়বিক সমস্যার কারণেই হতো, যা তাঁর সারাটা জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাঁর চরিত্রের আকর্ষণীয় বিষয় ছিল তাঁর শিষ্টাচার এবং সততা, যা তাঁকে সুপরিচিতি দান করে।
হালিমার কাছে থাকার সময়কালে তিনি ভালো আরবি শিখেছিলেন, যার ফলে তিনি খুব ভালো আরবি বলতে এবং মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা দিতে পারতেন ।
এটা নিশ্চিত যে, মুহাম্মদ এবং খাদিজার মধ্যে বেশ জানাশোনা ছিল। মুহাম্মদের ফুপু সাফিয়া তখন খাদিজার ভাইদের মধ্যে একজন যার নাম আওয়াম ( Awwam) তাঁকে বিয়ে করেছিলেন, এদের একটা সন্তানও হয়। এর ফলে খাদিজা ও মুহাম্মদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্কও তৈরি হয়। আবু তালিবের সুপারিশের পর খাদিজা মুহাম্মদকে ডেকে পাঠালেন এবং তাঁর একজন কর্মী হিসেবে নিযুক্ত করলেন। মুহাম্মদ তাঁর উটের পিঠে চড়ে সিরিয়ার উদেশ্যে রওনা দিলেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য একজন দাস তাঁর সঙ্গে দেয়া হলো। ইসলামের ইতিহাসে শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ সিরিয়ায় গিয়ে বিচক্ষণতার সাথে দর কষাকষির মাধ্যমে খাদিজার বিনিয়োগ দ্বিগুণ করা ছাড়া তেমন কোনো প্রশংসাপূর্ণ কাজের বিবরণ পাওয়া যায় না এবং সাহিত্যে এই যাত্রাপথ সম্পর্কে তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিবরণও নেই। মুর (Muir) অনুমান করেন যে, মুহাম্মদ সম্ভবত গাজার তীরবর্তী ভূমধ্যসাগর বন্দর পর্যন্ত পৌঁছে ছিলেন। এই বন্দরটিতে মক্কাবাসীরা ঘনঘন যাতায়াত করতেন, এমনকি কোরানে জাহাজ নিয়ে একটি আয়াত পর্যন্ত আছে: “like Mountains Riding Furious seas,”। নিজ চোখে ঝড়ো ভূমধ্যসাগর এবং সমুদ্রের অস্থিরতা দেখেই তাঁর পক্ষে এমন কাহিনী রচনা সম্ভব হয়েছিল ।
তাঁর সফরের বিশ্বাসযোগ্য বিবরণের পরিবর্তে আমরা বরং ভবিষ্যতে মুহাম্মদের নবী হয়ে উঠার বর্ণনাই দেখতে পাই। উদাহরণস্বরূপ, মুহাম্মদের কাফেলা যখন সিরিয়ার এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর ঘরের কাছে থামল, নাস্তর (Nastur) নামের এক প্রবীণ প্রজ্ঞাবান লোক তাঁর সান্নিধ্যে আসলেন। নাস্তরের কাছে বেশকিছু প্রাচীন খ্রিস্টধর্মের আকর গ্রন্থ ছিল, যেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা একজন নবীর আগমনের বিবরণ মোহাম্মদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেখানে উল্লেখ ছিল, খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থের ভবিষ্যতের একজন নবী আসবেন যিনি একটি গাছের নিচে বসবেন। যখন মুহাম্মদ তাঁর উট থেকে নেমে সেই গাছের ছায়ায় বসলেন, তখন তাঁর দিকে এই সন্ন্যাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ হয়। তাঁকে দেখার পর সন্ন্যাসী উত্তেজিত হয়ে খাদিজার দাসকে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। দাস তাঁকে জানান, "তিনি পবিত্র কুরাইশ গোত্রের বংশধর। নাস্তর (Nastur) তাঁকে বলেন, “একমাত্র নবী ছাড়া কেউ এই গাছের নিচে বসেনি"। এই সন্ন্যাসী আবার জিজ্ঞেস করেন, "তাঁর চোখ লালচে কী না? দাস উত্তর দেন, “হ্যা! সবসময়ই লালচে থাকে"। আরেক সংস্করণে পাওয়া যায়, এই সন্ন্যাসী ঘোষণা করেছিলেন যে, মুহাম্মদ কেবল একজন নবীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন নবীদের মধ্যে "সর্বশেষ" এবং তাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মুহাম্মদকে সর্বশেষ নবী হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ইসলামিক ইতিহাসে এ-ও লেখা আছে, মুহাম্মদের সাথে থাকা দাস দেখতে পেলেন, মরুভূমির উত্তাপ থেকে বাঁচাতে দুইজন স্বর্গদূত মুহাম্মদকে ডানা দিয়ে ছায়া দিচ্ছিলেন ।
মোহাম্মদের জীবনী লেখকগণ মুহাম্মদ আর খাদিজার বিবাহটিকে একটা ঐশ্বরিক রূপ দিতেই বিভিন্ন দেবদূতের অবতারণা করেছেন। একজন প্রহরী ইতোমধ্যেই সিরিয়া থেকে কাফেলার আগমনের খবর নিয়ে আসেন। পুরো শহরের সবাই তাদেরকে সম্ভাষণের জন্য জড়ো হন। খাদিজা আর বেশ কয়েকজন মহিলাসহ তাঁর পাহাড়ের বাড়ির ছাদে অপেক্ষা করতে থাকেন, যেখান থেকে তিনি পরিষ্কার টাউন হল দেখতে পেতেন। সেই বিকেলে ক্লান্ত কাফেলার বহর, সশস্ত্র প্রহরী, অগুনিত পণ্যবাহী উটের বহর শহরে ঢুকে টাউন হলের সামনে থামে, যেখানে মানুষ স্বাগত জানানোর জড়ো হয়েছিল। উটের বহর থেকে বের হয়ে মুহাম্মদকে খাদিজার বাড়ির দিকে যেতে দেখা গিয়েছিল। মুহাম্মদ যখনই খাদিজার বাড়ির নিকট পৌঁছলেন, তখনই খাদিজা দেখলেন, দুজন স্বর্গদূত মুহাম্মদকে ছায়া দিচ্ছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা মহিলাদের এই দৃশ্য দেখালেন, তারাও এটা দেখে আশ্চর্যান্বিত হলো ।
মুহাম্মদের সাথে আসা ভৃত্যটি সুসংবাদ দিতে সবার আগে খাদিজার ঘরের অভিমুখে রওয়ানা দিয়েছিলেন। সেই দাস খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর বলা সব কথা, আর তাঁর ফিরতি পথে নিজের চোখে দেখা মুহাম্মদের উপর ফেরেশতাদের ছায়া ফেলার ঘটনা খাদিজাকে বলেছিল। খাদিজা এসব শুনে নিশ্চয়ই আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে একজন নবী আসবেন; প্রকৃতপক্ষে, সমগ্র আরবেই এমন একজন নির্বাচিত নবীর কথা সবাই শুনে আসছিল, যিনি নতুন ধর্ম নিয়ে আসবেন। জীবনীগ্রন্থে এমনটাই লেখা। আর এই সেই নির্বাচিত লোক, যে সফর শেষে দ্বিগুণ মুনাফা নিয়ে তাঁর বাসায় হাজির হলেন । খাদিজার মনে এই ভাবনাই কাজ করছিল যে, ইনিই সেই ব্যক্তি যাকে তিনি বাণিজ্য মিশনে পাঠিয়েছিলেন এবং যিনি অধিকতর লভ্যাংশ নিয়ে ফিরে এসেছেন! খাদিজা খুশি হয়ে চুক্তির চেয়েও দ্বিগুণ মূল্য পরিশোধ করেছিলেন। চারটির পরিবর্তে আটটি উট প্রদান করেন এবং বিব্রতকর অবস্থা এড়ানোর জন্য মুহাম্মদের কাছে তাঁর বান্ধবী নাফিসাকে (Nafisa) পাঠান। নাফিসা নানান গল্প করতে করতে মুহাম্মদকে বলেন, তাঁর যেহেতু পঁচিশ বছর হয়েছে এটা তাঁর বিয়ের বয়স। মুহাম্মদ তাঁকে উত্তর দেন, "আমার বিবাহ করার কোনো উপায় নাই"। নাফিসা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, "যদি দেখতে সুন্দর, পর্যাপ্ত অর্থ উপার্জন করে, ধন সম্পদের মালিক, মর্যাদাপূর্ণ কোন নারীর কাছ থেকে বিবাহের প্রস্তাব পান, আপনি কি তবে তা গ্রহণ করবেন?" মুহাম্মদ তখন বুঝতে পারেন নাফিসা আসলে খাদিজার কথা বলছেন। মুহাম্মদ জবাবে বলেন, "কিভাবে সম্ভব!" নাফিসা উত্তর দেন, "চিন্তা করবেন না, সব ব্যবস্থা করব" (৭)। অতঃপর মুহাম্মদ তাঁর চাচাকে তাঁর বিয়ের প্রস্তাবের ব্যাপারে জানান। বিয়ে ছিল তখন গোত্রীয় বিষয়; রীতিনীতি অনুসরণ করার চল ছিল। ইসলামিক ইতিহাসের এক জায়গায় পাওয়া যায়, খাদিজার বাবা তখন জীবিত ছিলেন না। আবু তালিব তাঁর ভাই হামজা এবং আব্বাসকে নিয়ে খাদিজার চাচা আমর (Amr) এর ঘরে যান বিয়ের কথাবার্তা বলতে। যৌতুক হিসেবে তারা পঁচিশটি নারী উট ধার্য করেন যা ছিল পাঁচশো দিরহামের সমতুল্য এবং অর্ধেক অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। এই অনুষ্ঠানের বিশদ বিবরণ পাওয়াস যায় না, তবে সম্ভবত মুহাম্মদের হাশেমী গোত্র এবং খাদিজার আসাদ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক উপস্থিত ছিল। খাদিজার চাচা উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে তাদের বিয়ে পড়ান। একটা উট এবং এক বা দুটো ছাগল জবাই করে অতিথিদের খাওয়ানো হয়। আবার আরেক সংস্করণে দেখতে পাওয়া যায়, তাদের বিবাহ এত সহজে সংঘটিত হয়নি। খাদিজার বাবা খুওয়ালিদ (Khuwaylid) তখনও বেঁচে ছিলেন। মুহাম্মদের মক্কায় স্থায়ী কোন ব্যবস্থা না থাকায় খাদিজার বাবা এই বিবাহের পুরোপুরি বিরোধিতা করেছিলেন। মোহাম্মদের অর্থ ছিল খুব সামান্য পরিমাণের এবং তাঁর নিকটাত্মীয়রাও অর্থবান ছিলেন না। মক্কায় তাঁর চেয়ে অনেক ভালো অর্থবান এবং সম্ভ্রান্ত ঘরের প্রস্তাব আসত খাদিজার জন্য। তবে সত্য হচ্ছে, খুওয়ালিদ এ সমস্ত প্রস্তাবকে না করে দিতেন। ইসলামিক ইতিহাসে আরো পাওয়া যায় যে, খাদিজা তাঁর বাবাকে মদ্যপান করিয়ে তাঁকে মাতাল করলে তিনি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তখন খাদিজা তাঁকে সুন্দর ডোরাকাটা একটা পোষাক পরিয়ে, গায়ে সুগন্ধি মাখিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে বাকি অনুষ্ঠান তিনি নাক ডেকে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেন। হুঁশ ফিরলে গায়ের পোষাক ও সুগন্ধি, এত খাবারের আয়োজন দেখে তিনি উপলক্ষ জানতে চান। খাদিজা জবাব দেন, "আপনি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদের সাথে আমার বিবাহ দিয়েছেন"। তিনি জবাব দেন, "না, আমি এই কাজ করিনি। মক্কার সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা তোমাকে চেয়েছে, আমি না করে দিয়েছি" (৮)। অন্য আরেক জায়গায় পাওয়া যায়, খাদিজা ও মুহাম্মদ দু'জনেই খুওয়ালিদকে মাতাল করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তারপর তাঁকে একটি সুন্দর পোশাক পরিয়ে এবং তাঁর মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা দেন। পিতা বুঝতে পারলেন যে, তাঁর সাথে কি করা হয়েছে। তিনি রাগান্বিত হয়ে তলোয়ার হাতে নিয়ে মারতে উদ্যত হন। তবে মুহাম্মদের আত্মীয়স্বজনেরা এসে তাঁকে থামান এবং শেষপর্যন্ত বুঝিয়ে তাঁর মেয়ের বিয়ের অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন (৯)। মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের বিবাহটি এইভাবে ব্যাখা করা যায়ঃ মুহাম্মদের জীবনের পূর্বকালীন ঘটনা, যেমন তাঁর মায়ের কাছ থেকে বঞ্চিত হওয়া, তারপর তাঁর পালক মায়ের কাছ থেকে প্রত্যাখান এবং আকস্মিক মায়ের মৃত্যু তাঁর ভেতর শুন্যতার তৈরি করেছিল যা পুরণ করতে খাদিজার মতো কোন একজন চরিত্র তাঁর জীবনে দরকার ছিল। খাদিজা তাঁর মা এবং স্ত্রীর ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ফেরেশতাদের কল্পকাহিনী ছাড়া আর কিভাবে এই আকর্ষণের ব্যাখ্যা করা যেতে পারে? এ জাতীয় আবেগময় অনুভূতির আদানপ্রদান অবশ্যই মনের অবচেতন স্তরে ঘটে থাকে। সচেতন অবস্থায় মুহাম্মদ অবশ্যই এই সম্পর্কের হিসেব-নিকেশ করেছিলেন এবং এটি তাঁর জন্য একটা ভালো ফলাফল বয়ে আনবে, নিশ্চিতভাবেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। খাদিজা সম্পদশালীর হবার কারণে এটা নিশ্চিত ছিল যে, মুহাম্মদকে তাঁর চাচার উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভর করতে হবে না। এরপর থেকে তিনি জানতেন যে, তিনি সম্পদের প্রাচুর্যের মধ্যেই থাকবেন। খাদিজার সামাজিক খ্যাতিও তিনি ব্যবহার করতে পারবেন, যেটা তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
খাদিজা-মুহাম্মদের বিয়ে হয় ৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে। সংসার করেন পঁচিশ বছর। খাদিজা-মোহাম্মদের চার কন্যাসন্তান, দুই বা তিন পুত্রসন্তান ছিল। ছেলেদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে এই ব্যাপারে একমত যে, তাঁর ছেলেসন্তান খুব অল্প বয়সে মারা যায়। তাঁর বড় পুত্রের নাম ছিল কাসিম। মুহাম্মদকে সবাই আবুল-কাসিম (Abu al-Qasim) নামে ডাকতেন, যার অর্থ কাসিমের পিতা। কিন্তু কাসিম তাঁর দ্বিতীয় জন্মদিনে পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এই নিষ্ঠুর ঘটনা মুহাম্মদের জীবনকে আবার অবসাদে ঢেকে দেয়। মুহাম্মদের জীবনী লেখকরা সহ পরবর্তীতে পশ্চিমা লেখকদের সবাই, তাঁর জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনারগুলোর প্রতি তেমন কোন নজর দেননি! অথচ বারবার মুহাম্মদের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার দ্বারা তিনি আসলে ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। বিষাদগ্রস্ত স্বভাবের মুহাম্মদের জীবনে একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা, বিশেষ করে কাসিমের মৃত্যু তাঁকে জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলি সম্পর্কে ভাবিত করে এবং তাঁর সময়কালের ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর তাঁর সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে। তাঁর শেষ ছেলেও মারা গিয়েছিলেন, কিন্তু চার মেয়ে জীবিত ছিলেন। তারা ছিলেন জয়নাব (Zaynab), রুকায়াইয়া (Ruqaya), উম্মে কুলছুম (Umm Kulthum) এবং ফাতিমা (Fatima)।
খাদিজা নিয়মিতই গর্ভধারণ করেছিলেন এবং একের পর এক সন্তানের জন্ম দিয়ে গেছেন। মোহাম্মদের ফুফুর একজন দাসী সর্বদাই ধাত্রীর কাজটি করতেন। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ছেলের জন্য দুটো ছাগল এবং মেয়ে হলে একটি করে ছাগল কোরবানি করতেন। বাচ্চা জন্মের আগে আগে খাদিজা দুধমাতা নিযুক্ত করতেন। তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তারা হালিমার মতো মাতা ছিলেন না যারা বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে নিয়ে দুরে কোথাও বসবাস করতেন। সম্ভবত এই দুধমাতারা তাদের পরিবারের নিকটবর্তী বাসিন্দা বা খাদিজা-মুহাম্মদ পরিবারের কর্মচারী, দাসীদের মধ্যে ছিলেন। দাসদাসী, ঘরের ধরণ আর আসবাবের মধ্যে পার্থক্য ছাড়া, তাঁর বাড়ির ভেতরকার পরিবেশের সাথে অন্যান্য পরিবারের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। বাচ্চারা উঠোনে আর সিঁড়িতে একে অন্যকে তাড়া করে ফিরত খেলার ছলে। গালিচার ইঁদুরগুলি কার্পেট মোড়ানো মেঝেতে লুকাত আর তাদের অভিভাবকরা তাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করত। সম্পদশালী খাদিজার বাড়িতে সর্বদাই শ্বশুরবাড়ির লোকজন অথবা বন্ধুবান্ধবদের আসা-যাওয়া থাকত। বাড়িটি খাদিজার ব্যবসায়িক অফিস হিসেবেও ব্যবহার করা হতো। এখানে বসেই বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হতো এবং চুক্তি সম্পাদন হতো। মুহম্মদ এরপর আর কোন কাফেলা ভ্রমণে অংশ নিয়েছিলেন কি না জানা না গেলেও, ব্যবসায়িকভাবে তিনি জড়িত ছিলেন তা জানা যায়। খাদিজাকে বিয়ের মাধ্যমে মুহাম্মদ মক্কাবাসী নানান বিষয়ে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন, এবং অনেকেই তাঁর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাইতেন। এটা আরো পরিষ্কার হয়ে যায়, যখন তাঁর পালক মাতা হালিমা যিনি তাঁকে পথিমধ্যে রেখে চলে গিয়েছিল, তিনিও তাঁকে দেখতে চলে আসেন। হালিমা যে অঞ্চলটিতে থাকতেন, খরার কারণে পশুপালন বা ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। হালিমার অনেক পশু মারা যায়, তাই হালিমা তাঁর কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন। মুহম্মদ খাদিজার সাথে এ বিষয়ে তাঁর মতামত চাইলে খাজিদা তাঁকে চল্লিশটি মেষ দেন এবং একটি উট ভর্তি করে জিনিসপত্র দেন। এ থেকে বোঝা যায়, মুহামদ যদি নিজে এই গবাদিপশুর মালিক হতেন, তাহলে হয়তো খাদিজার মতামত ছাড়াই তাঁকে সাহায্য করতেন।
খাদিজার পূর্ববর্তী বিবাহের সন্তান এবং মুহাম্মদ-খদিজার নিজেদের বাচ্চাদের পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি ছেলের দায়িত্ব মুহাম্মদ নিয়েছিলেন; যারা পরবর্তীতে তাঁর ধর্মের প্রসারে মূল খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলেন। তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন আবু তালিবের কনিষ্ঠ পুত্র আলী। ভবিষ্যতের খলিফা এই আলীর জন্ম হয়েছিল মুহাম্মদ ও খাদিজার বিবাহের কয়েক বছর পরে। জীবনীগ্রন্থে পাওয়া যায়, আলীর জন্ম হয়েছিল ছাদবিহীন মন্দিরের অভ্যন্তরে ৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে। উল্লেখ আছে, মুহাম্মদ-খাদিজা আলীকে দেখতে আসার পরই নবজাতক আলী চোখ খুলে তাকান। আলীর পিতা-মাতা তাঁর নাম জায়েদ বা আসাদ রাখতে চেয়েছিলেন, মুহাম্মদ তাকে আলী নামে অভিহিত করেন। আলী নামটি এসেছিল আল্লাহ নাম থেকে। মক্কার এই আল্লাহ দেবতা ছিলেন সকল দেবতাদের মধ্যে উপরের মর্যাদার, যার কাছে সমস্ত দেবতারা পরাধীন ছিলেন। এই নামটি ধারণ করার আরেকটি কারণ ছিল এই যে, আলীর মা আলীকে মন্দিরের ভেতর জন্ম দিয়েছিলেন।আলী তার পিতামাতার সাথে পাঁচ কি ছয় বছর পর্যন্ত ছিল, তারপরই সে নবী মুহাম্মদের দেহরক্ষীতে পরিণত হয়। খরা ও দুর্ভিক্ষের সময়কালে হালিমা ঠিক যেই কারণে মুহাম্মদের কাছে সাহায্যের জন্য আসেছিলেন, ঠিক একই কারণে আলীকে সম্ভবত মুহাম্মদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল তার বাবা । আবু তালিবের পক্ষে তাঁর বড় পরিবারকে খাবার জোগাড় প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তাই তিনি মুহাম্মদকে অনুরোধ করেন আলীকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে। আবু তালিবের আরেক ভাইয়ের অবস্থা একটু ভালো থাকায়, তিনি তাঁর আরেক ছেলে, ১৫ বছর বয়সী জাফরকে ঐ ভাইয়ের কাছে দিয়ে দেন।
মুহাম্মদের ঘরে আরেক সদস্য ছিল, যে ছিল ক্রীতদাস। নাম জায়েদ। জায়েদ ছিল ইয়েমেনের খ্রিস্টান গোত্রের। ডাকাত দল যখন জায়েদ যে কাফেলায় ছিল সে কাফেলা আক্রমণ করে, তখন তারা আটবছর বয়সী জায়েদকে বন্দি করে। বলা হয় জায়েদ ছিলেন মিশ্র জাতির সন্তান, অর্ধেক আবিসিনিয়ান, অর্ধেক আরব, এবং আফ্রিকান বৈশিষ্ট্যযুক্ত ছিলেন। জায়েদকে ওকাযের (Ukaz) মেলায় উঠানো হয় দাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য, এবং জায়েদকে খাদিজার ভাগ্নে হাকিম দেখতে পায়। হাকিম ছেলেটি কিনে খাদিজাকে উপহার হিসেবে দেয়। মুহাম্মদও বালকের প্রতি বেশ আগ্রহী হয়েছিলেন, কারণ তিনি যে কাজগুলি দিয়েছিলেন তা খুবই মনোযোগের সাথে সম্পাদন করত জায়েদ। তাঁর স্বভাব ছিল খুবই মায়াবী, এবং আরও একটি কারণ ছিল এই যে, জায়েদ ছিল আবিসিনিয়ার-খ্রিস্টান বংশোদ্ভূত। সে তার ধর্ম সম্পর্কে অল্প কিছু জানত এবং মুহাম্মদের সাথে এই নিয়ে কথা বলত। খাদিজা তাকে মুহাম্মদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, যিনি তাকে ছেলের মতো বড় করেছিলেন। তাদের মধ্যে যে সত্যিকারের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যখন জায়েদের পিতা হারিছা (Haritha) সাত বছর পর খোঁজ পেয়ে ছেলেকে কিনে ফেরত নেয়ার জন্য অর্থ নিয়ে মক্কায় হাজির হন। কিন্তু মুহাম্মাদ মুক্তিপণের অর্থ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। জায়েদকে তার পিতার কাছে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়েছিলেন, তবে সিদ্ধান্তটি ছেড়ে দিয়েছিলেন জায়েদের উপর। ততদিনে মুহাম্মদের সাথে জায়েদের একটা গভীর বন্ধন গড়ে উঠেছিল, যে তাঁর দাস হওয়া সত্ত্বেও ভাল ব্যবহার পেয়েছিল, আর তাই তার কাছে নিজের বাবাই এখন প্রায় অপরিচিত। ফলশ্রুতিতে, জায়েদ মুহাম্মদের সাথেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এর জবাবে মুহাম্মদ জায়েদকে নিয়ে কাবাঘরে নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন যে, তিনি জায়েদকে তাঁর পুত্র হিসেবে গ্রহণ করছেন। এরপর তিনি জায়েদ ইবনে মুহাম্মদ বা 'মুহাম্মদের পুত্র জায়েদ' নামে পরিচিত হয়েছিলেন।
তারপর আরেক সদস্য ছিলেন জুবায়ের। জুবায়ের মুহাম্মদের ফুফু সাফিয়া এবং খাদিজার ভাই আউওয়ামের (Awwam) পুত্র ছিলেন, যিনি মুহাম্মদ-খাদিজা বিবাহের আগের বছর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যেহেতু অল্প বয়সে তার বাবা মারা গিয়েছিলেন, জুবায়ের প্রায়শই খাদিজার বাড়িতে আসতেন এবং দীর্ঘমেয়াদে থাকতেন। আরও একটা কারণ ছিল, তার মা তার উপর গুরুতর নির্যাতন করতেন। সাফিয়া একজন বদমেজাজি মহিলা ছিলেন। তিনি শৃঙ্খলা পছন্দ করতেন, তাই প্রায়শই ছেলেকে বীভৎস মারধর করতেন। নওফাল নামের এক চাচা একবার তাঁর এই বীভৎসতার সাক্ষী হয়েছিলেন এবং তাদের বংশের মুরুব্বিদের কাছে এ সম্পর্কে অভিযোগ করেছিলেন। সাফিয়া জোর গলায় বলেছিলেন, উনি যা করছেন তা তাঁর ছেলের ভালোর জন্য করছেন। তিনি বলেন: “যে বা যারা মনে করে যে আমি জুবায়েরকে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মারছি, তারা আসলে ভুল করছেন, তাঁকে আমি মারধর করি এজন্য যাতে সে জ্ঞানী ও সাহসী হয়ে বড় হয় এবং শত্রুদের পরাভূত করে সম্পদের মালিক হয়” (১৪)। এর ফলস্বরূপ, জুবায়ের অনেকটা সহিংস চরিত্রের হয়। উল্লেখ পাওয়া যায়, সে এক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সাথে লড়াইয়ের জড়িয়েছিল। জুবায়ের লোকটিকে এত শক্তভাবে ঘুষি দিয়েছিল যে, লোকটির হাত ভেঙে যায়। সম্ভবত লড়াইটি সেই শুরু করেছিল। লোকজন যখন সাফিয়ার কাছে বিচার নিয়ে আসে, মনে হতে থাকে সাফিয়া বরং ছেলের এই আচরণে গর্বিতই! সাফিয়া তাদেরকে উল্টো জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আপনারা জুবায়েরকে কেমন দেখলেন, সাহসী নাকি কাপুরুষ?"
পরবর্তীতে তিন যুবক - আলী, জায়েদ এবং জুবায়ের শেষ পর্যন্ত মুহাম্মদের অভ্যন্তরীণ বৃত্তের মূল সদস্য হয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর যোদ্ধাদের মধ্যে এই তিনজনই সবচেয়ে বেশি উগ্র বলে গণ্য হয়েছিল। এছাড়াও পরিবারের আরেকজন সদস্য ছিলেন বারাকা (Baraka), তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ার ক্রীতদাসী এবং মুহাম্মদের বাবার দাসী। তিনি ছয় বছর বয়সী মুহাম্মদের সাথে ছিলেন। যখন মায়ের মৃত্যু হলো তখন মুহাম্মদকে তিনি দেখাশুনা করতেন। যার ফলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে উঠেছিলেন এবং পুরো সময়টা তিনি আবু তালিবের সাথে কাটিয়েছিলেন। মুহম্মদ তাঁকে খুব পছন্দ করতেন, প্রায়শই তাঁকে মা বলে ডাকতেন।
খাদিজার সাথে বিয়ের পর তিনি তাঁকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং এরপর বারাকা ইয়াছরিবের এক লোকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সেখানেই চলে যান। তিনি এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, যার নাম ছিল আইমান (Ayman)। বাচ্চার জন্মের পরপরই তাঁর বর মারা যান এবং এরপরই তিনি মক্কায় তাঁর সন্তানকে নিয়ে তাঁর প্রাক্তন প্রভুর কাছে আবার ফিরে আসেন। পরে মুহাম্মদ জায়েদকে বারাকার সাথে বিয়ে করার জন্য রাজি করিয়েছিলেন, যদিও তখন তাঁর বয়স জায়েদের বয়সের দ্বিগুণ ছিল। তাদের ঘরে একটা পুত্রসন্তান জন্ম হয়, যার নাম ছিল ওসামা। এই ওসামাই পরবর্তীতে মুহাম্মদের অনুসারীদের মধ্যে অন্যতম ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন।
৬০৫ খ্রিস্টাব্দে, মুহাম্মদ যখন পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী ছিলেন, বন্যার জলের কারণে চাঁদের মন্দির অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবার ফলে এই মন্দিরটির সংস্কার করা অতি জরুরি হয়ে পড়ে। সাধারণত মক্কায় ভারি বৃষ্টিপাত ছিল বিরল ঘটনা। কিন্তু মাঝেমধ্যে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতের কারণে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হতো, যার ফলে জল উপত্যকা দিয়ে নদীর তলদেশে যেত। যেহেতু মন্দিরটি নদীর তীরেই ছিল, সুতরাং এই ধরণের বন্যায় মন্দিরটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কুসাইর (Qusay) পর এই মন্দিরটির আর সংস্কার করা হয়নি, কিন্তু মন্দিরটি ছাদহীনই ছিল, আয়তক্ষেত্রাকার প্রাচীরগুলো একতলা বিল্ডিংয়ের উচ্চতার সমান ছিল। সে বছর হঠাৎ বন্যায় দেয়ালগুলির একটি ভেঙে গেলে, মক্কার শক্তিমানেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে এটিকে মাটি থেকে পুনর্নির্মাণ করা দরকার, এবং মন্দিরটি যেহতু শহরের বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল তাই এটির সংস্কার করা জরুরি। তার মানে, মন্দির এবার ছাদবিশিষ্ট হবে।
পুনর্গঠন প্রকল্পটি ছিল একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগ। মক্কার প্রায় চল্লিশ মাইল পশ্চিমে লোহিত সাগরের কাছে একটি মাছের পল্লী এবং ছোট্ট একটি বন্দর ছিল। সেখানে জেদ্দার নিকটবর্তী বাইজেন্টাইন বণিক জাহাজের ধ্বংসাবশেষ ছিল, এই মন্দিরের সংস্কারে তা ব্যবহৃত হয়েছিল। মক্কাবাসীরা এই ধ্বংসাবশেষ ক্রয় করে, তা খণ্ড খণ্ড করে মক্কায় নিয়ে আসে। মক্কায় নির্মাণের জন্য কাঠের সরবরাহ কম ছিল এবং এর সাথে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং সরঞ্জামও ছিল না। সুতরাং মন্দিরের সংস্কার কাজের জন্য তারা ওই জাহাজের ক্যাপ্টেন বাউকামকে (Baqum) নিয়োগ দিয়েছিল, কারণ তিনি ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি। তবে মক্কাবাসীদের নির্মাণ সামগ্রী জোগাড় করা ছাড়াও মন্দির পুনর্নির্মাণের দ্বারা যদি তারা দেবতাদেরকে অসন্তুষ্ট করেন, সেই ভয়ও ছিল বিদ্যমান। তাই তারা প্রার্থনার আয়োজন করেছিলেন। মখজুম (Makhzum) গোত্রের প্রধান এবং শীর্ষস্থানীয় মক্কাবাসীদের একজন তাদের হাতে কুড়াল তুলে নিলেন এবং দেবতাদের আশ্বস্ত করে একটি প্রার্থনা করেছিলেন যে, ভালো উদ্দেশ্য নিয়েই তারা এই কাজ করছেন। তারপরই দেয়ালের এক অংশ তারা ভেঙে ফেললেন। তারা দেখতে পেলেন, আকাশ থেকে একগুচ্ছ আলো পড়ল। ভাবলেন, হুবাল দেবতা তার ক্রোধ এইভাবেই প্রকাশ করেছেন। মক্কার অধিবাসীদের কেউই ভয়ে পরদিন সকাল অবধি ওয়ালিদের (প্রথম ভাঙ্গার কাজ তিনিই করেছিলেন) সাথে কাজে যোগ দিতে সাহস করেনি, কিন্তু তারা এর পরেরদিন তাঁকে জীবিত এবং সুস্থই দেখতে পেলেন, আর সকলে তখন তাঁর সাথে কাজে যোগ দিলেন।
কুরাইশ গোষ্ঠীর সকলেই সাধ্যমত অর্থ এবং জনবল সরবরাহ করে প্রকল্পে অংশ নিয়েছিল। মুহাম্মদ পাশের পাহাড় থেকে পাথর নিয়ে এসে কাজে অংশ নিয়েছিলেন। বাউকামের (Baqum) নির্দেশ অনুযায়ী, বড় পাথরগুলিকে ছাঁটাই করে ব্লক আকারের তৈরি করা হয়েছিল দৃঢ়ভাবে আটকে রাখার জন্য। ভবিষ্যতে বন্যায় যাতে আবার নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য মাটি থেকে আট ফুট উচ্চতায় পাথরের পাটাতন তৈরি করা হয়েছিল। দেয়ালগুলি গোড়ার দিকে একগজের চেয়েও বেশি পুরু করা হয়েছিল এবং সম্পূর্ণ কাঠামোটি প্রায় চল্লিশ ফুটের মত উঁচু করা হয়েছিল। মেঝেটি তৈরি করার সময় মক্কাবাসীরা কালো পাথরটি স্থাপনের বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ল। পবিত্র পাথরটিকে খুব সাবধানে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, নতুন প্রাচীরের কোণে। এটি পুনরায় স্থাপন করা দরকার। মাটি থেকে পাঁচফুট উঁচুতে পাথরটিকে রাখার জন্য একটি কুলুঙ্গি প্রস্তুত করা হয়েছিল। মক্কাবাসীরা একমত হতে পারছিলেন না কোন গোত্র এই কালো পাথরটিকে স্থাপনের দায়িত্ব পালন করবেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, কেননা মক্কাবাসী প্রায়ই মতভেদের একপর্যায়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। শেষপর্যন্ত সালিশে বসে সবাই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, হাশিমী প্রতিবেশী থেকে বেরিয়ে আসা প্রথম ব্যক্তিটি সিদ্ধান্ত নিবে বিষয়টি কীভাবে নিস্পত্তি করা হবে। সেই ব্যাক্তিটিই ছিলেন মুহাম্মদ এবং তিনিই ন্যায়সঙ্গত সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর আচ্ছাদনটি মাটিতে রেখে তাদেরকে কালো পাথরটি ওটার মাঝখানে রাখার জন্য বলেছিলেন। তাঁরপরে প্রতিটি দল আচ্ছাদনটির একটি কোণ ধরেছিল। তারা একসাথে পাথরটি তুলেছিল যাতে এটি কুলুঙ্গিতে বসানো যায়। মুহম্মদকে পাথরটি ঠেলে জায়গমতো বসানোর সম্মান দেয়া হয়েছিল। ছাদের জন্য তারা উদ্ধারকৃত কাঠগুলি ব্যবহার করেছিলেন। ছাদটিকে ধরে রাখতে জাহাজের মাস্তুল থেকে থেকে ছয়টি স্তম্ভ কাটা হয়েছিল । শেষ কাজ হিসেবে, মোটা দরজা অব্দি একটি পাথরের সরু সিঁড়ি তৈরি করা হলো। সমাপ্ত হওয়ার পরে, মন্দিরটি প্রায় ঘনকের আকার ধারণ করে। যার ফলে মক্কাবাসীরা এটি "কাবা" নামে অভিহিত করেছিল। কাবা মানে ঘণাকার। এই প্রথম মক্কার মন্দিরের সাথে এই কাবা শব্দটির ব্যবহার করা হয়। নতুন মন্দিরে উত্তর-পশ্চিম দেয়ালের পাশে নির্মিত একটি অর্ধবৃত্তাকার পাথরের মেঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই মন্দিরটির মেঝেও একই উচ্চতায় নির্মিত হয়েছিল। মক্কাবাসীরা প্রথমে এটি দালানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছিল, যা দেখতে কিছুটা প্রথম দিকের খ্রিস্টীয় চার্চের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়ে উঠত। মুহাম্মদ পরে মন্তব্য করেছিলেন যে, অর্থ ও নির্মাণ সামগ্রী শেষ হয়ে যাওয়ায় এই বিভাগটি বাদ দেয়া হয়েছিল । এর পরিবর্তে মেঝের উপরে অল্প উচ্চতায় পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ লোকদের জন্য বৈঠকের স্থান হয়ে উঠেছিল। প্রচণ্ড গ্রীষ্মের মাসগুলিতে ছায়ার জন্য শামিয়ানা টানানো হতো।
এই কাবা নির্মাণকালে মুহাম্মদ আরও একবার মৃগীরোগের শিকার হয়েছিলেন। এটি ঘটেছিল যখন তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে নগ্ন হওয়ার জন্য চাপ দেয়। তৎকালীন সময়ে নির্মাণকর্মীদের মধ্যে এই অনুশীলনটি প্রচলিত ছিল। ভারি পাথর বহন করার সময় তাদের কাঁধ রক্ষা করার জন্য শ্রমিকরা তাদের কোমরের কাপড়টি খুলে একটা ঘন বালিশের মতো বানিয়ে কাঁধে রাখতেন যাতে পাথর বহনের সময় এটি কুশন হিসেবে কাজ করে। অত্যন্ত লাজুক মুহাম্মদ তাঁর কাপড় খুলতে নারাজ ছিলেন, তবে তাঁর চাচা আবু তালিব এবং আব্বাস উভয়ই তাঁকে অন্য সবার মতো করতে বলেছিল। মানসিক চাপের কারণে তিনি কাপড় খোলার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান, যা আসলে ঘটেছিল মৃগীরোগের কারণে। তিনি কতক্ষণ অচেতন ছিলেন তা জানা যায়নি কিন্তু যখন তিনি হুঁশ ফিরে পান তখন চিৎকার করেছিলেন, “আমার কোমরের চাদর! আমার কোমরের চাদর!” এবং খুব দ্রুত কাপড়টি আবার পরে নেন। জীবনীকারকরা এটি একটি ঐশ্বরিক ঘটনা হিসেবে প্রমাণ করেছেন, যেখানে মুহাম্মদের এই কাজ দ্বারা শালীনতার একটি শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। তিনি কোথাও থেকে এমন একটি আওয়াজ শুনতে পান, যেখানে তাঁকে আদেশ দেয়া হয়ঃ "তোমার নগ্নতা থেকে সাবধান থেকো!" তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি একটি কণ্ঠস্বর শুনেছেন, এটা যদি সত্য হয় - আর এটা প্রথমবার শুনেছেন বলে দাবি করেছেন এটা আসলে তাঁর শ্রবণাঙ্গীয় ভ্রম (auditory hallucination) যা মৃগীরোগের আরেকটি লক্ষণের প্রমাণ বহন করে। মুখ বাঁচাতে মুহাম্মদ দাবি করেছিলেন যে তিনি পিছলে পড়ে গেছেন, কিন্তু অচেতন অবস্থায় যে লোকেরা তাঁর মুখ দেখেছিল তারা জানতেন এটি নিছক পিছলে যাওয়ার দুর্ঘটনা না। মুহাম্মদ আর কখনও নিজের শরীর কাউকে দেখাননি। প্রকৃতপক্ষে তাঁর পরবর্তী স্ত্রীগুলির মধ্যে একজন উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর সাথে বসবাসের দীর্ঘ সময়কালে তিনি একবারও তাঁর গোপনাঙ্গ দেখেননি (২০)।
মুহাম্মদ তাঁর শরীর এবং কর্মের জন্য অত্যন্ত লজ্জা পেয়েছিলেন, বিশেষ করে মলত্যাগ সম্পর্কে বহু উপাখ্যান পাওয়া যায়। ধনী বা দরিদ্র মক্কার কারো বাড়িতে স্যানিটারি সুবিধা ছিল না এবং বেশিরভাগ লোকেরা ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কাজ সারতেন। সম্ভবত তারা গণশৌচাগার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, কিন্তু তাতে কোন গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হতো না। আদি গ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায়, মুহাম্মদ প্রাকৃতিক কাজ সারতে অনেক সময় নিতেন, যদিও মক্কার বাইরে যেতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। আসলে তিনি এই কাজের জন্য বহুদুরে চলে যেতেন যাতে কেউ দেখতে না পায়। মুহাম্মদের এই ঘটনার সাথে শালীনতার বিষয়টিকে যুক্ত করে এমন গল্প তৈরি হয়েছে, যা অনেক সময় এইরকম হাস্যরসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন একদিন সবার দৃষ্টির আড়ালে যেতে একটা জায়গা খোঁজার সময়, মুহাম্মদ শুনতে পেলেনঃ “হে আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” । এটা শুনে মুহাম্মদ বিচলিত হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগলেন খোঁজার জন্য তাঁকে এই কথা কে বলেছে
তারচেয়েও হাস্যকর বিষয় ছিল, জীবনী বর্ণনাকারীরা বলেছেন, মুহাম্মদ মলত্যাগের সময় গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য প্রকৃতির সাহায্য নিয়েছিলেন। একটি উদাহরণে পাওয়া যায়, একবার যখন তিনি কোন গোপন স্থান খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তখন তিনি তাঁর সাথে আসা একজন রাখাল বালক, ইবনে মাসুদকে কয়েকটি গাছের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “যাও এবং তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বল যে, আল্লাহর রাসুল আমাকে আপনাদের কাছে প্রেরণ করেছেন। আপনারা একত্রিত হোন যতক্ষণ না তিনি আপনাদের পেছনে প্রাকৃতিক কাজ শেষ করেন”। ইবনে মাসুদের নির্দেশনানুসারে গাছগুলো ঠিক তাই অনুসরণ করেছিল, রক্ষাকারী হিসেবে একত্রিত হয়ে মুহাম্মদের গোপনীয়তা রক্ষা করেছিল। গল্পে দেখা যায় যে, যখন তাঁর কাজ শেষ হয়েছিল, গাছগুলি আবার আগের অবস্থানে ফিরে গেল ।
মুহাম্মদের জীবনের প্রথম বছরগুলির ইতিহাস খুব বেশী পৌরাণিক কাহিনী দ্বারা মিশ্রিত এবং যার ফলে তাঁর শৈশব ও মাঝবয়সের একটা সামগ্রিক জীবনচরিত অঙ্কন করা কঠিন। অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সাথে আমরা তাঁর কর্মসংস্থানের বিষয়ে জানতে পারি না। তিনি কি শুধু বৈবাহিক পরিমন্ডলেই অবদান রেখেছিলেন, নাকি তিনি স্ত্রীর সম্পদের উপর বেঁচে ছিলেন? ইসলামিক ইতিহাসবিদরা একজন সহনশীল ব্যক্তির চিত্র উপস্থাপন করেছেন, তবে এই চিত্রটি পরবর্তী মুহাম্মদের তুলনার সাথে মেলে না। কেননা, পরবর্তীতে এমন একজন ব্যক্তির গল্প আমরা পাই, যারাই তাঁকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে বা বিশ্বাসের বিরোধিতা করেছে তাঁর উপরই তিনি বর্বর নির্যাতন করেছেন এবং তাদের জন্য এক নিষ্ঠুর অত্যাচারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। একটি শিশু যদি একজন মানুষের পিতা হয়, তাহলে পিতাকে নিয়ে লিখনিসমুহে সেই শিশুর বর্ণনা উপেক্ষিত হতে পারে না।
সম্মিলিত ধর্মীয় আকর গ্রন্থগুলো থেকে অন্তত এটা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে উপসংহারে আসা যায় যে, খাদিজা মোহাম্মদের সাথে থাকার সময় এবং তাঁর জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত মুহাম্মদের বন্ধু, সমর্থক ছিলেন। ছিলেন সকল কাজের উৎসাহদাতা, অর্থের জোগানদাতা এবং সুরক্ষক। মানসিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে নড়বড়ে অবস্থানের কারণে খাদিজার মত একজন শক্তিশালী, সংবেদনশীল নারী মুহাম্মদের খুব প্রয়োজন ছিল। খাদিজার সাহায্য ছাড়া হয়ত তাঁর ধর্ম কখনোই মক্কার উপত্যকার সংকীর্ণ সীমার বাইরে যেতে পারত না।