মুহাম্মদের উদ্ভাবনী মনের চাতুর্যের ফলস্বরূপ, ধূলিমলিন মক্কার অতি সাধারণ ঘনক আকৃতির এই মন্দিরটি সকল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। তিনি চোখ বন্ধ করলেন, এবং কল্পনায় দেখতে পেলেন আল্লাহর চকচকে সিংহাসন সরাসরি মন্দিরের উপরেই রয়েছে। তার কাছে এটা ধর্তব্যের বিষয় ছিল না যে, তার সময়কাল থেকে দুই শতাব্দী আগেও, কুসাইর যুগে মন্দিরটি স্তূপীকৃত পাথরের একটি আয়তক্ষেত্রাকার প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। এর দেয়াল টপকে ছাগল পর্যন্ত ঢুকে যেতে পারত। কুসাইরও দুই শতাব্দী আগে মক্কা ছিল একটি জনবসতিহীন উপত্যকা যেটা কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় দিয়ে আবৃত ছিল। কুসাইর দুই শতাব্দী পরে মুহাম্মদের জন্মের সময়, মন্দিরটি শুধুমাত্র একটি ছাদবিহীন উঁচু আয়তক্ষেত্রাকার পাথরের প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল। তার কল্পনায় কাবা এখন আল্লাহর মন্দির হয়ে ওঠে। সৃষ্টির শুরু থেকে এটি এক বা একাধিক আকারে বিদ্যমান ছিল, যখন এটি স্বর্গ থেকে একটি উজ্জ্বল রত্নাকারে অবতীর্ণ হয়। আদমের হাতে তা উপাসনার স্থানে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু এখন তা পতিত জায়গা। এই পাথরটি এখন স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করা মানুষের হাতে পতিত হয়েছে, এবং এটিকে যেকোন মুল্যেই তাদের হাত থেকে উদ্ধার করতে হবে এবং যারা এক স্রষ্টা ছাড়া আর কারোরই পুজা করে না তাদের কাছেই এটিকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
খন্দকের যুদ্ধে মক্কাবাসীদের বিশাল সেনাশক্তির মুখোমুখি হওয়ার এক বছর পর মুহাম্মদ মক্কায় একটি দুঃসাহসিক তীর্থযাত্রা (উমরাহ) করতে চাইলেন। এটি ছিল সাহসী পদক্ষেপ, তবুও তিনি দাবি করেছেন যে এটি এখন থেকে এক আল্লাহর ঘর, যদিও প্রতীকীভাবে সাতবার কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছিলেন, তার শত্রুরা তার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে ছিল, কিছুই করার ছিল না। তীর্থযাত্রীর সাদা পোশাকে নিজেদের আবৃত করে তিনি পবিত্র মাসগুলোর প্রথমটিতে পনেরো শত লোক এবং কোরবানির জন্য উটের বহর নিয়ে রওনা হন এবং মক্কাবাসীদের চ্যালেঞ্জ করলেন যদি পারে কিছু করে দেখাতে।
ইসলামিক আদিগ্রন্থে মনে করা হয় যে, তীর্থযাত্রার অনুপ্রেরণা মুহাম্মদের স্বপ্নের মাধ্যমে এসেছে। তিনি স্বপ্নে দেখলেন তিনি তার মাথা মুণ্ডন করে মন্দিরে প্রবেশ করছেন এবং নিজ হাতে “বাড়ির” (কাবার) চাবির তোড়া ধরে আছেন। যদি তিনি সত্যিই এমন স্বপ্ন দেখে থাকেন তবে সেটি ছিল মূলত মক্কাবাসীদের ইয়াছরিব আক্রমণ নসাৎ করার পর থেকেই তিনি যা মনে মনে ভেবেছিলেন, তারই প্রতিফলন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তার এখন সক্ষমতা আছে এবং তিনি আরবদের ধর্মীয় রীতিনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মক্কায় তীর্থযাত্রা করে ফিরে যেতে পারেন। পবিত্র মাসে মক্কাবাসীরা কী তার বা তার সাথীদের উপর আক্রমণ করার সাহস করবে, যখন তিনি এবং তার লোকেরা পবিত্র সাদা পোশাক পরিহিত থাকবেন? তারা কি তাকে হত্যা করার সাহস করবে যখন তারা অন্য সব আরবদের উপাসনা করার জন্য এই মাসে অনুমতি দিয়ে থাকে?
যদিও তার পবিত্র মাসের ঐতিহ্যগত সুরক্ষার অলিখিত চুক্তির কথা মাথায় ছিল, তবুও মুহাম্মদ কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। তার অনুসারীরা সশস্ত্র ছিল এবং অশ্বারোহী যোদ্ধাও সঙ্গে আনা হয়েছিল। তারা যখন দক্ষিণে অগ্রসর হল, তখন তিনি বিভিন্ন বেদুইন আদিবাসী, বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের সমানভাবে তাদের সাথে যোগদানের আমন্ত্রণ জানিয়ে সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও মুহাম্মদ মক্কাবাসীদের অনেক ক্ষতি করেছিলেন, তবুও তারা মুহাম্মদকে বোকা মনে করত এবং বিশ্বাস করত না যে তিনি জীবিত অবস্থায় আবার ফিরে যেতে পারবেন। কেউ কেউ এই ভয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, তার উদ্দেশ্য ছিল এদেরকে ক্ষণিকের জন্য রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করবে। যাত্রার একপর্যায়ে মুহাম্মদের লোকেরা তীর্থযাত্রীদের সাদা পোশাক পরিধান করে তার নেতৃত্ব অনুসরণ করতে থাকল। তিনি তার পোশাক ইয়াছরিব ছাড়ার আগেই পরেছিলেন, কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে ইয়াছরিব ও মক্কার মধ্যবর্তী যাত্রাবিরতিতে এটি পরিধান করার নিয়ম ছিল। বেশিরভাগ লোক সেই যাত্রাবিরতির স্থান যেখানে পোশাক বদলাবেন সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল।
তীর্থযাত্রীর অনুষঙ্গ হিসেবে শুধু দুটি সাদা চাদরে নিজেকে মোড়ানো নয়, যার এক অংশ ডান কাঁধের উপর পেঁচিয়ে থাকে এবং অন্য কাঁধটি খালি রাখা হয়, বরং আরো অনেক বিষয় নিষিদ্ধ, যেমনঃ যৌনতা করা, পাগড়ি পরা থেকে বিরত থাকা, এবং দাড়ি গোঁফ, চুল, এমনকি নখ পর্যন্ত না কাটা ।
ধর্মীয় পবিত্রতার এই কঠোরতা পৌত্তলিক তীর্থযাত্রীদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ছিল, কিন্তু মুহাম্মদ তার এই তীর্থযাত্রার সময়ে কিছুটা পরিবর্তন আনতে অতিরিক্ত নিয়মকানুন যুক্ত করেন। আগের নিয়মকানুনকে ওলটপালট করা ছিল তার অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণের একটি মাধ্যম। এবং তিনি কখনোই কোন বিষয়ে নতুন কিছু আইন যুক্ত করার সুযোগ হাতছাড়া করেননি, তা যতই তুচ্ছ বা নগণ্য হোক না কেন। উদাহরণস্বরূপ, মক্কা ভ্রমণের সময় তিনি খাওয়ার জন্য প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ করেন, কারণ এতে প্রাণী হত্যা করতে হবে এবং তীর্থযাত্রীদের জন্য হত্যা করা হারাম ছিল। শুধু তীর্থযাত্রা শেষ হওয়ার পরই কোরবানির পশুদের হত্যা করার অনুমতি ছিল। তবে তিনি বন্যপ্রাণী বা পোকামাকড়ের বেলায় ব্যতিক্রম আদেশ দিয়েছিলেন। ইঁদুর, শকুন, বিচ্ছু এবং পাগলা কুকুরদের যেকোন সময় হত্যা করার কথা বলেছিলেন, কারণ তারা তাদের জন্য ক্ষতিকর ছিল, আক্রমণ করতে পারে যখন তখন।
তবে শিকারের বিরুদ্ধে তার কঠোরতা বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যার জন্য বিশ্বাসীরা আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যা চাইতে বাধ্য হন। একরাতে যাত্রাবিরতির সময়, মরুভূমির কিছু বাসিন্দা যারা তীর্থযাত্রার অংশ ছিল না, তারা তিনটি বড় গিরগিটি নিয়ে মুহাম্মদের শিবিরে প্রবেশ করে এবং তারা মুহাম্মদের তীর্থযাত্রীদের সাথে আনন্দ উপভোগ করার সময়ে তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে তার উপর তাদের এই মাংসগুলো রান্না করতে চায়। তারা গিরগিটিগুলোকে রোস্ট করল, মুহাম্মদের তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে মাংস ভাগ করে খাওয়ার প্রস্তাব দিল, কিন্তু মুহাম্মদের তীর্থযাত্রীরা তা স্পর্শ করতে অস্বীকার করল যতক্ষণ না মুহাম্মদ আল্লাহর সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করে তাদের জন্য কোনো ফয়সালা দেন। অবশেষে মুহাম্মদ ঘোষণা করলেন, “খাও, কারণ যা তোমাদের জন্য (উদ্দেশ্যে) শিকার করা হয়নি তা খাওয়া অনুমোদিত। কিন্তু যখন তোমরা ইহরাম বাধা অবস্থায় থাকো (ধর্মীয় পবিত্রতার অবস্থা) তখনও অবশ্যই শিকার করা অথবা তোমাদের জন্য যা কিছু শিকার করা হয় তার সবকিছু এড়িয়ে চলতে হবে” (১)। একই ধরনের আরেকটা ঘটনা ঘটে যখন আরেকজন বিশ্বাসী যে তখনো পর্যন্ত তীর্থযাত্রার পোশাক পরেনি, তাই সে একটি বন্য গাধার মৃতদেহ নিয়ে শিবিরে ঢোকে। সে নতুন আইন সম্পর্কেও অজ্ঞাত ছিল, তাই শিকার করতে গিয়েছিল। যখন সে তার শিকার করা মৃত গাধাটি নিয়ে বন্দিশিবিরে এল, সে বুঝতে পারল যে, অন্যরা মুহাম্মদের পরামর্শ ছাড়া এর মাংস খাবে না। গিরগিটির মতো (আইনের রং বদলকারী) মুহাম্মদ এবারো ফুরসত বা অব্যাহতি দিলেন এই বলে যে, শিকারী যেহেতু এখনো তীর্থযাত্রীর মর্যাদা গ্রহণ করেনি, এবং কোন তীর্থযাত্রী যেহেতু তাকে এই শিকারে যেতেও বলেনি তাই এই মাংস খাওয়া বৈধ। তিনি মুমিনদের আশ্বস্ত করলেন যে, এই মাংস খাওয়ার জন্য তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে পোড়ানো হবে না। মুহাম্মদ তার নিজের জন্য ওই গাধার মাংস থেকে সিনার অংশ রেখেছিলেন এবং নিজে তা ভোজনও করেছিলেন।
এরপর ইয়াছরিবের দক্ষিণে অবস্থিত গ্রাম আল-আবওয়াতে (al-Abwa) একটি উকুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যেখানে মুহাম্মদের মাকে সমাহিত করা হয়েছিল। সেখানেও মোহাম্মদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে। কাব বিন উজরা নামের একজন বিশ্বাসী ছিলেন যিনি যাত্রার শুরুতেই তীর্থযাত্রীর পোশাক পরেছিলেন। তিনি একটি রান্নার পাত্রের নিচে চুলোয় ফুঁক দিচ্ছিলেন। মুহাম্মদ লক্ষ্য করলেন যে, তার মাথার চুলে উকুন হাঁটছে। যদিও তীর্থযাত্রা শেষ না হওয়া পর্যন্ত শরীরের কোন পশম বা চুল কাটার কোন নিয়ম ছিল না, কিন্তু উকুনের সংক্রমণ থেকে বাঁচতে তিনি নিজের তৈরি আইনের ব্যতিক্রম করেন এবং কাবকে তার মাথা ন্যাড়া করার আদেশ দেন, আর এর বদলে (চুল কাটার কারণে) কাব বিন উজরাকে রোজা রাখতে বা কিছু দান করার ফরমান দেন। এই হুকুমটি শীঘ্রই কোরআনের একটি আয়াতের অংশ হয়ে ওঠে। কাব তার জীবনের বাকি দিনগুলোতে গর্ব করে বলতেন যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজেই তার মাথায় চুলকানির (এবং উকুনের) বিষয়টি খেয়াল করেছেন (২)। যেহেতু এত বড় আল্লাহ তার মতো এত ক্ষুদ্র এক মানুষকে উকুন থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন সুতরাং সেই খুশিতে উকবা এক বেদুইনের কাছ থেকে একটি ভেড়া কিনে সেটিকে রঙিন রশি দিয়ে বেঁধে এবং তার গলায় রং-বেরঙের মালা দিয়ে সাজিয়ে সেটিকে আনন্দের সাথে কোরবানি (উৎসর্গ) করেন।
মুহাম্মদ এখন একজন বিধায়ক, শিক্ষক এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় বিশ্বাসীদের মনের মধ্যে আবির্ভূত হন। তার নিয়মকানুন, আয়াত এবং তার আচার-আচরণ তার হৃদয়ের আলোকবর্তিকা হিসেবে জ্বলজ্বল করত, যে আলোকবর্তিকা মানুষকে জান্নাতে পৌঁছার পথ দেখাবে। তার এমন সব ভাবনাগুলো প্রকাশ করতেও তিনি লজ্জাবোধ করেননি। দক্ষিণের যাত্রাপথে বিরতির সময় তিনি তার লোকদের একটি বাবলা (acacia) গাছের তলা পরিষ্কার করতে বলেন, যাতে তার ছায়ায় বসে তাদের উদেশ্যে তিনি উপদেশ বিতরণ করতে পারেন। যখন একদল তীর্থযাত্রী তার চারপাশে ভিড় জমায় তখন তিনি একটি বিবৃতি প্রদান করেন, যেটি তার কথার আতিশয্যের কারণেই বিস্ময়কর ছিল। তিনি বলে উঠলেন : “হে বান্দারা, প্রকৃতই আমি তোমাদের নিকট এক উপহার রেখে যাচ্ছি। আমি তোমাদের হাতে যা ছেড়ে যাচ্ছি তা তোমাদের পথভ্রষ্ট করবে না, আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং নবীর সুন্নাত”। তিনি তার রচিত কোরআন ও তার সুন্নাতকে, তথা তার কাজকর্মের উদাহরণকেই আদর্শ হিসেবে বুঝিয়েছিলেন ( 3 ) ।
যখন মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারল, তখনো তারা নিশ্চিত ছিল না যে কি হতে যাচ্ছে। মুহাম্মদ ইতোমধ্যে তার এই ধরনের ঘোষণার জন্য বিখ্যাত ছিলেন যে, তাহলে কি এই যাত্রা প্রতারণার যুদ্ধের জন্য? এটা কি একটা কৌশল ছিল তবে? তাদের পূর্বপুরুষ কুসাইর সম্মিলিত স্মৃতি ছিল তাদের মনে, যিনি তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে শত শত বিদেশী যোদ্ধাকে লুকিয়ে মক্কায় নিয়ে গিয়ে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছিলেন। কুসাই ও তাঁর কুরাইশ গোত্র পবিত্র মক্কা অঞ্চলকে খুজাদের কাছ থেকে মন্দিরের তীর্থযাত্রার রীতিনীতি সহ দখল করে নিয়েছিলেন। কুসাই প্রতারণার প্রতিভু ছিল। মুহাম্মদ কি কুসাইর ষড়যন্ত্রেরই পুনরাবৃত্তি করতে চাইছেন?
মক্কাবাসী নেতারা তাকে পবিত্র এলাকায় (হারাম এলাকা) প্রবশে বাধা দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলে। তারা মক্কার সীমানার প্রায় দশ মাইল দুরেই সব দিক থেকে মক্কার পথে ঢোকায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল। মুহাম্মদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য পর্বতমালার উপর গুপ্তচর পাহারা বসিয়েছিল এবং তার পথ আটকে দিতে এবং প্রয়োজনে তাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে ওয়ালিদের ছেলে খালিদের নেতৃত্বে দুইশোজনের এক অশ্বারোহী বাহিনী পাঠিয়েছিল। উপরন্তু, মক্কাবাসীরা বাড়িতে বাড়িতে একটি রক্ষণাত্মক বাহিনীও গঠন করে এবং যুদ্ধের ক্ষেত্রে মক্কাবাসীদের সাহায্যের জন্য আঞ্চলিক মিত্রদের কাছেও খবর পাঠায়।
মুহাম্মদ মক্কার রক্ষণাত্মক অবস্থার খবর নিয়ে ফিরে আসা এক গুপ্তচরের কাছ থেকে খালিদের অশ্বারোহী বাহিনীর কথা জানতে পেরেছিলেন। সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য মুহাম্মদ একটি স্থানীয় বেদুইনকে ভাড়া করেন যিনি তাকে এবড়োথেবড়ো পাহাড়ের উপর দিয়ে পবিত্র এলাকার সীমানার বাইরে, মক্কার ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত হুদাইবিয়া সমভূমির দিকে নিয়ে যায়। এই ফাঁকিবাজি সত্ত্বেও, তাকে এবং তার লোকজনকে সহজেই মক্কাবাসীরা চিনে ফেলে। যেহেতু তীর্থযাত্রীরা সাদা পোশাক পরিহিত ছিল, তাই দূর থেকে দেখতে মনে হচ্ছিল পাহাড় থেকে সাদা রঙের লম্বা ভারি কিছু বাদামী মরুভূমির সমভূমিতে বেয়ে আসছিল। কিন্তু খালিদ মুহাম্মদকে ছেড়ে দিলেন। বলা হয় যে, এই সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকার কারণ হচ্ছে খালিদও সেই সময় পক্ষ (ধর্ম) পরিবর্তনের কথা চিন্তা করছিলেন। মুহাম্মদকে আক্রমণ করার বদলে তিনি তার গতিবিধি সরেজমিনে দেখে তা জানাতে মক্কায় ফিরে গেলেন।
মুহাম্মদ হুদাইবিয়াতে একটি পানির গর্তের পাশে শিবির স্থাপন করেন এবং মক্কাবাসীদের পক্ষ থেকে কি হতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। কয়েকদিন পর খুজাদের একটি দল যাদেরকে কুসাইর গোত্র মক্কা থেকে দুই শতাব্দী আগে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, তারা মুহাম্মদের তাঁবুর সামনে হাজির হয়। আঠারো মাস আগে মুহাম্মদ মুস্তালিক নামে খুজাদের একটি শাখাকে আক্রমণ করে তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন খুজা গোত্রবাসীই এখন মুহাম্মদকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। তারা এখন কাজ করছে মুহাম্মদের চোখ ও কান হিসেবে, যাদের বিস্তৃতি ছিল উত্তর-পশ্চিমে মরুভূমি অঞ্চল থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত। মক্কাবাসীদের সাথে তাদের ইতিহাসের কথা মাথায় রেখে খুজারা আতঙ্কিত না হয়ে বরং এখন মুহাম্মদের ব্যাপারে অনুকুল অবস্থান গ্রহণ করেছে। মুহাম্মদের সাথে দেখা করতে আসা লোকদের মধ্যে ছিলেন খুজাদের সুস্পষ্টভাষী নেতা বুদায়েল বিন ওয়ারাকা যিনি মুহাম্মদকে তার আসল উদ্দেশ্য আসলে কি তাই জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলেন। মুহাম্মদ তাকে ব্যাখ্যা করেছেন যে, তার কোন ঝামেলা বাধানোর ইচ্ছে নেই। তার একমাত্র উদেশ্য হচ্ছে ছোটখাটো তীর্থযাত্রার আয়োজন করা, এবং তীর্থযাত্রা শেষ করেই চলে যাওয়া। এটা পরের মাসে শুরু হওয়া বার্ষিক প্রধান তীর্থযাত্রা (হজ্ব) থেকে আলাদা ছিল এবং সেই সময় সারা আরব থেকে লোকজন এখানে আসত। বছরের যেকোন সময় ছোট ছোট তীর্থযাত্রা (উমরা) করা যেত, তবে তা কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো। যেমন সাতপাক দেয়া, কালো পাথর চুমো দেয়া, সাফা এবং মারওয়া পর্বতের মাঝে আরো সাতবার দৌড়ানো, তারপর মাথা কামিয়ে, প্রাণী উৎসর্গের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা। এই ধর্মীয় আচারগুলো শতাব্দী আগে বিকশিত হয়েছিল যখন থেকে তারা বিশ্বাস করা শুরু করেছিল যে, এই কালো পাথর চাঁদ দেবতা হুবালের কাছ থেকে একটি বিশেষ উপহার। মুহাম্মদ তাকে (খুজা গোত্রপতিকে) বলেন যে, তিনি শুধু এসেছেন মক্কার মন্দিরের ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে, তবে সেটি করবেন আল্লাহর নামে। মক্কাবাসীরা যদি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায় তবে তিনিও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন।
বুদায়েল মক্কাবাসীদের কাছে মুহাম্মদের এই বার্তা নিয়ে যান, কিন্তু তারা যেহেতু জানত খুজা গোত্রের লোকেরা মুহাম্মদের অধীনে চলে গেছে তাই তারা বুদায়েলের কথার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আর সেজন্যই মক্কাবাসীরা অন্য একটি গোত্রের একজনকে হুদাইবিয়াতে মুহাম্মদের কাছে পাঠায় মুহাম্মদকে প্রশ্ন করে তার মতলব বোঝার জন্য। তিনি মুহাম্মদকে কিছু প্রশ্ন করার পর সেই তথ্য নিয়েই মক্কায় ফেরেন যা বুদায়েলের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে মিলে যায়। এরপরেও সন্তুষ্ট হতে না পেরে তারা তাদের আবিসিনীয় বেদুইন সেনাপতি হুলাইস আলকামাকে (Hulays Alqama) পাঠায়। যখন মুহাম্মদ জানতে পারলেন যে, তার কাছে আলকামাকে পাঠিয়েছে এবং মুহাম্মদ জানতেন যে, এই বেদুইন একজন ধর্মপ্রাণ পৌত্তলিক তখন যেই না হুলাইস কাছাকছি চলে এলেন মুহাম্মদ যাত্রাপথে কোরবানির জন্য রাখা একটি উটকে নানা রঙে সজ্জিত করে পথিমধ্যে বেঁধে রাখেন। যেন এটি দেখে বোঝা যায় যে, এটিকে সত্যিই তীর্থযাত্রায় বলিদানের জন্য রাখা হয়েছে। বলা হয় যে, যখন হুলাইস এই পশুটিকে দেখলেন তিনি নিশ্চিত হলেন, মুহাম্মদ উপাসনার জন্যই এসেছে, সুতরাং মুহাম্মদকে প্রশ্ন করে বিরক্ত না করেই তিনি মক্কায় ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি মন্দিরের সভামঞ্চে মক্কাবাসী নেতাদের কাছে তার পর্যবেক্ষণের কথা জানান। মক্কাবাসীরা এই কথা আসলে শুনতে চায়নি। তার এই তথ্যটি শোনার পর মক্কাবাসী এক নেতা রীতিমত তাকে অপমান করে বললেনঃ “তুমি শুধু একজন বেদুইনই, তবে কান্ডজ্ঞানহীন!” উত্তরে হুলেইস বলেন, “যে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে তাকে কি তাহলে সেটি করা থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে?” ( 8 )
মক্কাবাসীরা রেগে গিয়েছিল। এটা পরিষ্কার ছিল যে, মুহাম্মদ তাদেরই ধর্মীয় রীতিনীতি ব্যবহার করে তাদের উপর একটি সুবিধা লাভ করতে চাচ্ছে। তিনি পবিত্র মাসের নিরাপত্তার সুবিধা ব্যবহার করছেন, যদিও তিনি নিজে সেই ঐতিহ্যের প্রতি সামান্য শ্রদ্ধাও পোষন করতেন না। আর তাদের তাদের সহিষ্ণুতার প্রতিও তার কোন শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। তিনি তাদের খোলা মনকে এখন নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন কেবল। মন্দিরটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত – যেখানে যার ইচ্ছে পুজা করতে পারত, কিন্তু মুহাম্মদ শুধু তার নিজস্ব একমাত্র ঈশ্বরের ধারণাটি সহ্য করতেই রাজি ছিলেন, আর কারোর না। মক্কাবাসী এখন একটি সংকটের সম্মুখীন হয়েছে - তারা কি মুহাম্মদকে সহ্য করবে, যা মুলত ছিল তার অসহিষ্ণুতাকেই সহ্য করা? একজন নেতা বললেন, “তিনি কখনোই আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এখানে আসতে পারবেন না, এবং যাতে আরবরা কখনও বলতে না পারে যে আমরা তাকে অনুমতি দিয়েছি” (৫)।
এবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে তায়েফের এক নাগরিক উরওয়া ইবনে মাসুদকে পাঠায় তারা, যে উরওয়ার মা ছিলেন মক্কাবাসীদের একজন। আর উরওয়া ইবনে মাসুদ ছিল তায়েফের একজন নেতার ছেলে (পিতৃপরিচয়ে)। উরওয়ার বাবা দশ বছর আগে মুহাম্মদকে তায়েফ শহর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। উরওয়া ছিলেন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ, মুহাম্মদের দ্বারা ভীত হবার পাত্র নন। উরওয়া মুহাম্মদের সামনে আড়াআড়ি পা করে বসলেন এবং দৃঢ়ভাবে মক্কাবাসীদের অবস্থানের কথা জানিয়ে উল্লেখ করলেন যে, তারা ইতোমধ্যেই একটি যুদ্ধের (সম্ভাব্য) জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। মুহাম্মদকে মক্কায় ঢুকতে হলে তাদের সাথে লড়াই করতে হবে এবং এর ফলাফল তার জন্য অনুকূল হবে না। মুহাম্মদের তাঁবুর লোকজনের দিকে তাকিয়ে উরওয়া তাদের প্রশ্ন করলেন যদি কোন সংঘর্ষ হয় তাহলে তারা মুহাম্মদের পাশে দাঁড়াবেন কিনা? তারপর মুহাম্মদকে বললেন, “ঈশ্বরের কসম, আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে এরা আগামীকালই তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে!” এই কথা শুনে আবু বকর মুহাম্মদের চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ হলেন। আবু বকর জানতেন যে উরওয়া তায়েফের, তাই তিনি চিৎকার করে বললেন : “যাও আল-লাতের স্তন চুষতে যাও! আমরা তাকে পরিত্যাগ করি, সত্যিই!” (৬) উরওয়া অনড় ছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে, তিনি মুহাম্মদকে ইয়াছরিবে ফেরত পাঠাতে পারবেন, কিন্তু মুহাম্মদ অবিচল ছিলেন। তিনি ও তার লোকেরা মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে এসেছিলেন এবং তারা শান্তিপূর্ণভাবেই তা করতে চেয়েছিলেন। তারা যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তারাও লড়াই করবে। যাইহোক, শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য তিনি মক্কাবাসীদের একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব করতে প্রস্তুত ছিলেন যেটি কোন আক্রমণের/ডাকাতির ভয় ছাড়াই সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার সুযোগ করে দেবে।
উরওয়া খুব বিচক্ষণ ছিলেন। মুহাম্মদের সাথে থাকাকালীন তিনি পর্বেক্ষণ করেছেন তার প্রতি তার অনুসারীরা কতটা শ্রদ্ধাশীল। তার অনুসারীরা যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলে তখন তারা গলার স্বর নিচু করে কথা বলে এবং সরাসরি তার দিকে তাকায় না। তিনি যেই আদেশ দেন তা বিলম্ব না করেই পালন করে। একপর্যায়ে যখন মুহাম্মদ একটি বাটিতে হাত ধুলেন, লোকেরা যা অবশিষ্ট ছিল তা নিয়ে গেল এবং তাতে হয় তারা নিজেদের হাত ডুবিয়ে দিলেন অথবা পান করলেন। যখনই তিনি থুথু ফেললেন কেউ কেউ তাদের হাত বের করে দিত যাতে মুহাম্মদ তার হাতের উপর থুথু ফেলতে পারে, তারপর সেই থুতু সে তার গায়ে মাখিয়ে নেয় এবং অন্যদের সাথেও ভাগাভাগি করে। উরওয়া এটি ছাড়াও বিস্মিত হল যে, মুহাম্মদ তার ধর্মের দিকে আরো একজন হিংস্র দুর্বৃত্তকে কাছে টেনেছেন যিনি ছিলেন তারই ভাতিজা মুগিরা (Mughira), তারই ভাই শুবার (Shuba) ছেলে। মুহাম্মদের সাথে আলোচনা করার সময় উরওয়া মুহাম্মদের কাছাকাছি এসে তার দিকে ঝুঁকে মুহাম্মদের দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন। এটি একটি আরব্য প্রথা ছিল যা অসম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে করা হতো। যখনই তিনি এটি করলেন, ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ পরা একজন যোদ্ধা যার মুখ এবং চোখ ছাড়া সবকিছুই ঢাকা ছিল, হাতে তলোয়ার ধরে চেঁচিয়ে বলল “আল্লাহর রাসুলের মুখ থেকে হাত সরাও, না হলে তুমি তা আর জীবিত ফিরতে পারবে না!” (৭)। উরওয়ার কাছে কণ্ঠস্বরটি পরিচিত শোনালো। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য শিরোস্ত্রাণের পেছনে কে কথা বলছে জিজ্ঞেস করলেন। মুহাম্মদ তাকে অত্যন্ত খুশি হয়ে জানালেন যে, এটা তার ভাতিজা মুগিরা। উরওয়া স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন! তার ভাতিজা একজন পলাতক গণহত্যাকারী ছিল। সে এবং তার একটি অনুগত দল তায়েফের আশেপাশের কিছু লোককে ডাকাতি করার পর হত্যা করে, যার ফলে তায়েফের দুই প্রধান গোষ্ঠীর মধ্যে রক্তের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সে তেরোজন তায়েফ ব্যবসায়ীর একটি দলের সাথে মিশরে যায়। মিশর থেকে আরবে ফেরার পথে যখন তারা ঘুমিয়ে ছিল তখন মুগিরা তার এই তেরোজন সঙ্গীকে হত্যা করে এবং তাদের কাছে থাকা সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। মুগিরা শেষমেশ ইয়াছরিবে গিয়ে মুহাম্মদ এবং তার ধর্মের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। মুহাম্মদ এখন তাকে তার কাজের ছেলে এবং দেহরক্ষী হিসেবে ব্যবহার করছেন।
উরওয়া মক্কায় ফিরে এসে যা দেখেছে তা মক্কাবাসীদের জানালেন, এবং মক্কাবাসীদের মুহাম্মদের সাথে এক ধরনের চুক্তিতে রাজি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। এরপর তিনি বললেন : “আমি এমন লোকদের দেখেছি যারা কোন কারণেই তাকে পরিত্যাগ করবে না, আর তাই আপনারা নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত নিন" (৮)
মক্কাবাসীরা অবশ্য মুহাম্মদের প্রস্তাবে কোন সাড়া দেয়নি। যখন তিনি তাদের কাছ থেকে কোন সাড়াশব্দ পেলেন না তখন তিনি খুজা গোত্রের একজন বেদুইনকে মক্কাবাসীদের কাছে পাঠালেন। তিনি উরওয়াকে যে বার্তা দিয়েছিলেন তার পুনরাবৃত্তি করতেই পাঠালেন, অর্থাৎ তিনি শুধু মন্দিরে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে চান। কিন্তু মক্কাবাসীরা সেই বার্তাবাহকককে কিছু বলার আগেই মারধর করল। বলা হয় যে, আবুল হাকামের পুত্র ইকরিমা বার্তাবাহকের উটের সামনের পায়ের অংশ কেটে ফেললেন, তবে আবিসিনীয় সৈন্যদের এক সেনাপতির হস্তক্ষেপ তাকে হত্যা করা থেকে বিরত থাকেন এবং সে বেঁচে যায়। মক্কাবাসীরা তার সাথে যে অভদ্র আচরণ করেছিলেন তাতে এই সেনাপতি খুবই বিচলিত ছিলেন। তিনি ও তার কয়েকজন সৈন্য বেদুইনকে ঘিরে তাকে শহরের বাইরে নিয়ে গেলেন। অসহায় দূত তার ব্যর্থ মিশনের কথা জানানোর পর মুহাম্মদ তার অভ্যন্তরীণ গন্ডির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোক উসমানকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তিনি মক্কার অন্যতম বিশিষ্ট পরিবারের সদস্য ছিলেন। মক্কাবাসীরা তার কথা হয়তো শুনতে পারে। তিনি তাকে মক্কাবাসী প্রবাসীদের একজন প্রহরী সহ প্রেরণ করেন, আর সেই প্রহরী একইসাথে তার নিজ পরিবারের সাথেও দেখা করতে চেয়েছিলেন। উসমান শহরের কাছে আসতেই তার এক পরিচিতের সাথে দেখা হয় যিনি তাকে তার উটের পেছনে চড়িয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষা দেন। তিনি উসমানকে প্রথমে মন্দিরের মঞ্চের পাটাতনে নিয়ে গেলেন যেখানে উমাইয়া বিন খালাফের ছেলে আবু সুফিয়ান, সাফওয়ান এবং অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা একত্রিত ছিল। তিনি তাদেরকে মুহাম্মদের বার্তা বললেন, কিন্তু আবু সুফিয়ান তাকে জানান যে মক্কাবাসীরা আগের অবস্থানেই আছে - মুহাম্মদকে মক্কায় ঢোকার জন্য কোনো অনুমোদন দেয়া হবে না। কিন্তু তারা সৌজন্য দেখাতে উসমানকে মন্দিরের চতুর্দিকে তাওয়াফ (আবর্তন) করার অনুমতি দেয়া হবে বলে জানায়। উসমান তা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বললেন, “আল্লাহর রাসুলের আগে আমি কখনোই এই আবর্তনে যেতে পারব না” (৯)।
সেই উত্তেজনাপূর্ণ অবস্থা আরো বেসামাল হয়ে উঠল যখন ইকরিমা তার নিজের উদ্যোগে সত্তরজন অশ্বারোহীর একটি দল নিয়ে মুহাম্মদকে হয়রানি করতে এবং তার কিছু অনুসারীকে জিম্মি করতে মুহাম্মদের শিবিরের দিকে রওয়ানা দিল, কিন্তু তার চেষ্টা বুমেরাং হয়ে যায় যখন কয়েকজন মক্কাবাসীকেই পাকড়াও করে মুহাম্মদের সৈন্যরা। মুহাম্মদের পাঠানো খুজা গোত্রের দূতকে আক্রমণ করার পরই ইকরিমা তার নিজ উদ্যোগে কারো সাথে পরামর্শ না করেই তার অশ্বারোহী বাহিনী সমেত রওনা দিয়েছিল। মক্কাবাসী নেতারা যখন মন্দিরের পাটাতনে বসে উসমানের সাথে কথা বলছিল তখনই কেবল তারা জানতে পারল মক্কাবাসী জিম্মিদের কথা (যাদের একটু আগে মুহাম্মদের সেনারা আটক করেছে)। মক্কাবাসীরা তৎক্ষণাৎ উসমান ও তার সংগে থাকা লোকদের গ্রেফতার করে ফেলে এবং তাদের জিম্মি করে রাখে। দ্রুত মুহাম্মদের শিবিরে গুজব পৌঁছায় যে, উসমান ও তার সঙ্গীদের হত্যা করা হয়েছে। মুহাম্মদ যুদ্ধ করার শপথ নেন, কিন্তু সম্ভবত উরওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীটিও স্মরণে আনেন যে, যুদ্ধ লাগলে মুহাম্মদের সৈন্যরা তাকে ফেলে চলে যেতে পারে। মুহাম্মদ প্রত্যেক তীর্থযাত্রীর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি চাইলেন যে, তারা যুদ্ধ করে যাবে, তাতে যদি তাদের মৃত্যু হয় তবুও। একজন ঘোষককে শিবিরে পাঠালেন এবং তিনি ঘোষণা করলেন যে ‘পবিত্র আত্মা' বা জিব্রাইল মুহাম্মদের উপর নেমে এসেছেন, যিনি এখন তাদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং তার কাছে গিয়ে 'আল্লাহর নামে' অঙ্গীকারনামা দিতে বলছেন (১০)। অঙ্গীকার (বায়াত) গ্রহণের জন্য মুহাম্মদ একটি বাবলা গাছের ছায়ার নিচে বসেছিলেন। কয়েক ঘণ্টা ধরে তীর্থযাত্রীরা সবাই তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে এবং একের পর এক তার হাত ধরে যুদ্ধ লাগলে তার পাশে থেকে লড়াই করার শপথ নেয়। তারা প্রতিজ্ঞা করে যে, মুহাম্মদের উদ্দেশ্যকে তাদের জীবন দিয়ে হলেও তারা রক্ষা করবে।
অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন, এই অঙ্গীকারের কোন প্রয়োজনই ছিল না। যখন তিনি সুহায়েল বিন আমরকে শিবিরের দিকে আসতে দেখলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যে উসমানের মৃত্যুর খবরটি আসলে মিথ্যা ছিল। যদি তা সত্য হতো তবে মক্কাবাসীরা তাদের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে তার কাছে পাঠাতো না। মুহাম্মদ তাকে একজন যুক্তিসঙ্গত মানুষ হিসেবে চিনতেন, তাই মক্কাবাসীরা তাকে পাঠানোর উদেশ্য হচ্ছে তারা সমঝোতা করতে চায়। সুহায়েল ছিল মুহাম্মদের স্ত্রী সাওদার সাবেক দেবর, যাকে বদরের যুদ্ধে বন্দি করা হয়েছিল এবং মসজিদে সাওদার কক্ষে কিছু সময়ের জন্য বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মুহাম্মদ এখন নিশ্চিত হলেন যে, মক্কাবাসীদের উপর তার এখনো নিয়ন্ত্রণ আছে, কারণ তাদের অনেক নেতার মৃত্যুতে মক্কাবাসীরা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া যুদ্ধ করতে সৈন্য পাঠানোর জন্য বিপুল আর্থিক খরচের সম্মুখীন হওয়াতে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল তারা। তাদের এই অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার কারণ ছিল সিরিয়ার সাথে তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যে মুহাম্মদের হস্তক্ষেপ বা বাধাদান করা।
যখন সুহায়েলকে মুহাম্মদের তাঁবুতে আনা হলো, মুহাম্মদকে তার ঘনিষ্ঠ লোকেরা ঘিরে ধরে ছিল। তারা সবাই পা জোড়া করে বসে ছিল। মুহাম্মদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল শিরোস্ত্রাণ সহ মুখোশ পরা সাধারণ যোদ্ধারা। যোদ্ধারা সুহায়েলকে সবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বাধ্য করল এবং তাদের একজন তাকে সতর্ক করে দিল যে, সে যেন 'আল্লাহর নবীর' সাথে কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর উঁচু না করে। সুহায়েল প্রথমে মুহাম্মদের শিবিরের বিরুদ্ধে মক্কাবাসীদের হয়রানির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন যে, যারা তাদের হয়রানি করেছে তাদের মক্কায় কোন স্থান নেই। তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাদের মতামতও গ্রহণ করা হবে না। মুহাম্মদ বন্দিদের অদল-বদল করতে সম্মত হন। উসমান ও তার সঙ্গীদের বিনিময়ে তিনি মক্কাবাসী বন্দিদের ফেরত দেবেন বলে দেন।
বন্দিদের বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার পর সুহায়েল ও মুহাম্মদ একটি চুক্তিতে মনোনিবেশ করেন যেটা হুদাইবিয়ার চুক্তি নামে পরিচিত। শর্ত অনুযায়ী, মুহাম্মদকে ঐ বছর মক্কায় প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না, কিন্তু পরের বছর তিনি ফিরে আসতে পারবেন। মক্কাবাসীরা তাকে পরের বছরের একই মাসে তীর্থযাত্রার অনুমতি দিল, কিন্তু তাকে সেটিও তিনদিনের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে, এবং তাকে এবং তার অনুসারীদের শুধুমাত্র তলোয়ার কোষে রেখে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে। অন্য কোন অস্ত্র অনুমোদিত হবে না। উপরন্তু, উভয়পক্ষ দশ বছরের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, এবং যুদ্ধবিরতির এই চুক্তির মাধ্যমে মক্কাবাসীরা সিরিয়ায় তাদের বাণিজ্য পুনরায় শুরু করার অনুমতি পাবে। অধিকন্তু, চুক্তির মাধ্যমে এই অঞ্চলের গোত্রগুলির মধ্যেকার গোপন চুক্তি এবং জোটবদ্ধ হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। গোত্রবাসী যাদের খুশি তাদের সাথে যুক্ত হতে পারবে, তবে এটি অবশ্যই প্রকাশ্যে করতে হবে (১১)।
চুক্তিতে মক্কাবাসী তরুণদের মক্কায় ফিরিয়ে আনার উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল, যারা তাদের বাপ-দাদার ধর্ম ত্যাগ করে মুহাম্মদের সাথে ইয়াছরিবে যুক্ত হয়েছিল। তবে মক্কাবাসীরা মক্কায় আশ্রয় নেয়া ইযাছরিবিদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য না - এই ধারাটি যুক্ত ছিল কারণ মক্কাবাসী তরুণদের মধ্যে সুহায়েলের ছেলে আবু জান্দালও ছিল।
এই সমস্যার শুরু হয়েছিল প্রায় দুই দশক আগে, মুহাম্মদ যেদিন থেকে তার ধর্মপ্রচার শুরু করেন। মক্কাবাসী অন্যান্য বিদ্রোহী যুবকদের মতই সুহায়েলও তার ছেলেকে বন্দি করে রেখেছিলেন যখন সে মুহাম্মদের ধর্ম ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছিল। তারা শর্তাবলীর বিষয়ে সম্মতিতে আসার পর মুহাম্মদ আলীকে চুক্তিটিকে চামড়ার কাগজে লিখতে বলেন। কিন্তু সুহায়েল উদ্বোধনী শব্দের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। আলী লিখতে শুরু করেন : “অসীম দয়ালু, পরম করুণাময় আল্লাহর নামে। এই হচ্ছে শান্তিচুক্তি যা আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ উপসংহার টেনেছেন।”
সুহায়েল বললেন, “আমরা যদি জানতাম যে আপনি ঈশ্বরের রাসুল, তাহলে আমরা তো আপনাকে মন্দিরে যেতে বাধা দিতাম না এবং আপনাদের সাথে যুদ্ধ করতাম না”। তিনি মুহাম্মদকে বরঞ্চ 'আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ' এটি লিখতে বললেন। মুহাম্মদ বললেন, “আল্লাহর কসম! তোমরা আমাকে বিশ্বাস না করলেও আমি ঈশ্বরের রাসুল”। কিন্তু শেষমেষ সুহায়েলের কথাই থাকে (১২)।
মুহাম্মদের অনুসারীরা এই চুক্তিতে অসন্তুষ্ট ছিল, বিশেষ করে উমর। তারা এতটা পথ এসেছিল, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যে তারা তীর্থযাত্রা পালন করতে পারবে, কিন্তু এখন তাদের ইয়াছরিবে ফিরে যেতে হবে। অথচ মুহাম্মদের স্বপ্নের কারণেই তীর্থযাত্রার সুত্রপাত ঘটে, যেখানে তিনি দেখেছেন যে তিনি মন্দিরে প্রবেশ করছেন। উমর এবার মুহাম্মদ এবং আবু বকরের কাছে অভিযোগ করেন যে, তিনি মনে করেন এই চুক্তির মাধ্যমে পৌত্তলিকদের উপকার করা হয়েছে এবং নিজেদের ধর্মকে খর্ব করা হয়েছে। তিনি তীব্র ভাষায় বললেন, “আমরা কি তাহলে বিশ্বাসী নই এবং তারা কি অবিশ্বাসী নয়? আমাদের মৃতরা কি জান্নাতে নেই এবং তাদের মৃতরা কি জাহান্নামে নেই? আমরা কীভাবে এমন লোকদের সাথে চুক্তি করতে পারি যাদেরকে আমাদের হত্যা করা উচিত?” মুহাম্মদ তাকে থামিয়ে দিলেন। যদিও আপাতদৃষ্টে এই চুক্তিটি মক্কাবাসীদের জন্য আরো উপকারী বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তিনি আসলে তার জন্য এই চুক্তিকে বিজয় হিসেবেই দেখেছেন। তিনি যা আশা করেছিলেন তারচেয়ে অনেক বেশি এই ভ্রমণ থেকে পেয়েছেন। তিনি ইয়াছরিবের উত্তর দিকের ইহুদি গোত্রগুলি এবং উত্তর- পূর্বের পৌত্তলিক আদিবাসীদের থেকে ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিলেন। তিনি গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছিলেন যে, খাইবারের ইহুদিরা ফাদাকের ইহুদি, ওয়াদি আল-কুরা এবং অন্যান্য উত্তরাঞ্চলীয় ইহুদিদের সাথে জোট বেঁধেছে। শক্তিশালী গাতফানরা এবং অন্যান্য যাযাবর গোত্রবাসীও তার বিরুদ্ধে জোট করছে। যদি তারা কখনো তাদের বাহিনীকে একত্রিত করে ফেলে তাহলে তারা মুহাম্মদকে পিষে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাই মক্কাবাসীদের সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি তাকে তার উত্তরের শত্রুদের উপর মনোনিবেশ করতে সাহায্য করবে।
মুহাম্মদের চিন্তা ছিল বিস্তৃত যা উমর বুঝতে পারেননি। তীর্থযাত্রীরাও অসন্তুষ্ট হন। মুহাম্মদ হুদাইবিয়া থেকে যখন সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার আদেশ দিলেন তখন তীর্থযাত্রীরা আরো বেশি অসন্তুষ্ট হলো। তীর্থযাত্রায় বাকি ছিল তাদের দাড়ি, গোঁফ এবং চুল কাটা; কোরবানির পশু জবাই করা, এবং তারপরেই তারা তাদের স্বাভাবিক কাপড়চোপড় পরে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে। বিরোধীপক্ষের লোকজন যারা চুক্তি করতে এসেছিল মুহাম্মদ পথে তাদেরকে একটু এগিয়ে দিলেন, তারাও চলে গেল। মাথার চুল কামানোর পর মুহাম্মদ চিৎকার করে বললেন, “আল্লাহর নামে, যিনি সবচেয়ে মহান” (১৩, ১৪ )। এরপর বর্শা দিয়ে তার উৎসর্গ করার জন্য রাখা উটের গলাটি কেটে ফেললেন। তার উদাহরণ অনুসরণ করে তীর্থযাত্রীরাও অন্যান্য কোরবানির উট জবাই করল, এবং তারা সারাদিন সেগুলোকে রোস্ট বা ভেজে মাংস খেল। ফেরার পথে উমর মুহাম্মদের সাথে চুক্তি নিয়ে তর্ক করার জন্য আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এই ভয়ে যে, তিনি হয়তো মুহাম্মদের সাথে তর্কের জন্য জাহান্নামের আগুনে নিজেকে নিক্ষেপ করলেন! যদিও তিনি বেশ বদমেজাজি ছিলেন তবুও মুহাম্মদের উপস্থিতিতে তিনি অস্বাভাবিকভাবে নিচু স্বরে কথা বলতেন এবং মাঝেমাঝে এত নিচু কণ্ঠে কথা বলতেন যে, মুহাম্মদ উমরকে আরো জোরে কথা বলতে বলতেন। যখন চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ বা এর দুরভিসন্ধি তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, তখন তার ভীতি হারিয়ে গেল এবং আসল উমরকে দেখা গেল। তিনি শুধু যে জোরে জোরে এবং আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছিলেন তাই শুধু নয়, তিনি অভদ্র আচরণও করেছেন। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ যাকে আল্লাহ তার দূত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তার সাথেই অভব্য আচরণ করেছেন!
এখন উমর ভীত হয়ে পড়লেন যে, আল্লাহ হয়তো তার অভদ্র আচরণের জন্য তাকে মোনাফেক, নকল বিশ্বাসী বলে অভিহিত করে আয়াত ‘প্রেরণ করবেন', এবং অনন্তকাল নরকের আগুনে পোড়ানোর জন্য উমরের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলবেন। উমরের উদ্বেগ প্রকাশ পায় যখন তীর্থযাত্রীদের দীর্ঘ সারি উত্তরদিকে ঘোড়া বা উটের উপর আরোহণ করছিল। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার আশঙ্কা আরও বেড়ে গেল যখন তাঁর উট মুহাম্মদের উটের কাছাকাছি এবং একই কদমে হাঁটার পরও মুহাম্মদ তাঁকে উপেক্ষা করলেন।
এটি তিনবার ঘটল যা উমরকে আতঙ্কিত করে তোলে। মনে হচ্ছিল যেন তার পেট থেকে সবকিছু তার গলায় ওঠে আসছে। তিনি নিজেই নিজেকে বললেন, “তোমার মা তোমাকে হারিয়েছে হে উমর!” (১৫)
উমর তার উটকে দীর্ঘ সেই সারির মাথায় যেতে প্ররোচিত করলেন যাতে তার বিরুদ্ধে যখন ঐশ্বরিক নিন্দার আয়াত আসবে সেসব তার কানে অন্তত না আসে। এই কথা ভাবার বেশ কিছুক্ষণ পরই একজন ঘোষক তার নাম ধরে ডাকলেন যে, মুহাম্মদ তাকে ডেকেছেন। তিনি মনে মনে বলেন, “এইবার শেষ!” এবং তার উটকে মুহাম্মদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। কিন্তু যখন তিনি মুহাম্মদের কাছে পৌঁছলেন উমর বুঝতে পারলেন যে, মুহাম্মদ তার কল্পনাশক্তি উমরের কাছ থেকে দুরে সরিয়েছেন যথাযথ কারণেই। মুহাম্মদ উমরের সালামও শোনেননি, কারণ তিনি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করছিলেন! তিনি এখন উমরকে আনন্দের সাথে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, “হে উমর, আমার কাছে একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যা সূর্য ওঠার চেয়ে আমার কাছে প্রিয় (১৬)। তিনি হুদাইবিয়া ত্যাগ করার পর থেকে একটি নতুন অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটি পাঠ করেন : “নিশ্চয়ই আমি তোমাকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেছি” (১৭)। তিনি আরো বললেন, ঈশ্বর তাকে ক্ষমা, সাহায্য ও ভালো আচরণের এক আনন্দময় বন্ধন দিয়েছেন, আর তিনি তার অনুসারীদের মহত্ত্বের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যারা ঈশ্বর ও তার রাসুলের অনুগত।
কোরআনের এই শব্দগুলো মুহাম্মদের কাছে পৌঁছেছে, এই কথা তীর্থযাত্রীদের কানেও পৌঁছে গেছে। মুহাম্মদ সেটা আবৃত্তি করছেন, লোকজন তাদের উটগুলোকে থামিয়ে মোহাম্মদের কাছে দ্রুত এলো আবৃত্তি শুনতে। মুহাম্মদের তেলাওয়াতের অধিকাংশই ছিল আদর্শ রচনা, যা এমন : মুমিনরা অনন্ত জান্নাতে একটি স্থান অর্জন করবে যার নিচ দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে, অন্যদিকে মোনাফেক ও বহুশ্বরবাদীরা যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অস্বীকার করেছে তাদের জন্য অনন্ত আগুন নির্ধারিত থাকবে। তিনি তীর্থযাত্রার প্রধান ঘটনাগুলো পুনরায় তুলে ধরলেন। তিনি সেসব লোকদের সমালোচনা করেছেন যারা তার সাথে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং তার অজুহাত নিয়ে ঠাট্টা করেছে। তিনি তাদের প্রশংসা করলেন যারা হুদাইবিয়াতে তার পক্ষে মৃত্যুবরণ করার অঙ্গীকার করেছে। তিনি বললেন যে, আল্লাহ তাদেরকে মক্কায় যুদ্ধ করা থেকে দুরে রেখেছেন কারণ শহরে হয়ত নিরপরাধ, গোপনে বিশ্বাসীরা লুকিয়ে আছে যারা নিহত হতে পারে। এরপর ঐশ্বরিক বাণী শোনালেন, “যদি তারা বিচ্ছিন্ন থাকত, তাহলে আমি অবশ্যই কাফেরদেরকে মর্মান্তিক শাস্তি দিতাম” (১৮)। মুহাম্মদের পবিত্র মন্দিরে প্রবেশের স্বপ্ন ভবিষ্যতে কোন এক সময়ে পূরণ হবে - আল্লাহ চাইলে, অবশ্যই হবে।
কোরআনের এই অধ্যায়ে যা আশ্চর্যজনকভাবে নতুন সংযোজন ছিল তা হলো জিহাদের ঘোষনা। জিহাদ এখন থেকে বাধ্যতামূলক। এর আগে যুদ্ধে যাওয়া ছিল ঐচ্ছিক কাজ এবং অনেকে তা এড়িয়ে গিয়েছিল। তাই সামনে যুদ্ধে না যাওয়ার একমাত্র অজুহাত হবে অন্ধত্ব, বিশেষ অসুবিধা এবং অসুস্থতা। মুহাম্মদ এই দাবিকে বেহেশতে যাবার চাবির সাথে তুলনা করে বলেছেন, যারা তার যুদ্ধ করার আদেশ পালন করে যুদ্ধে যাবে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে জান্নাত; আর যারা অমান্য করবে তাদের শাস্তি হবে জাহান্নামে। তিনি হুদাইবিয়াতে যারা তার হয়ে যুদ্ধ করতে অঙ্গীকার করেছিল তাদেরকে আসন্ন গনিমতের প্রতিশ্রুতি দেন, এই প্রতিশ্রুতিটি বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তি করেন কোরআন দিয়ে এভাবে - “আল্লাহ শীঘ্রই তাকে একটি বড় প্রতিদান দেবেন”(১৯) এবং সেখানে তিনি "অনেক মুনাফা অর্জন করবেন” (২০) এবং “আল্লাহ তোমাদেরকে অনেক বড় কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা তোমরা শীঘ্রই অর্জন করবে” (২১)।
এটা সম্ভবত তার জীবনের সেরা বিচক্ষণতা প্রদর্শন। তিনি তার প্রিয় নারী উট কাসওয়ার উপর বসেছিলেন। তিনি তার উটের সাথে শান্ত সুরের মুর্ছনায় কথা বললেন যা তার পালক মাতা হালিমার কাছ থেকে শিখেছিলেন, তার শক্তিশালী কণ্ঠস্বর অনেক দূরে পর্যন্ত শোনা গেল। পনেরোশত লোক উপস্থিত ছিল, সম্ভবত তার মধ্যে অর্ধেক সত্যিকারের বিশ্বাসী ছিল। বাকিরা ছিল দর্শকের মতো যারা তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি বা পুরোপুরি অবিশ্বাস বা অস্বীকার করেনি। অনেকেই তাদের সর্বোত্তম স্বার্থ ও সুবিধা নেয়ার জন্য নামমাত্রই মুহাম্মদের ধর্মে যোগ দিয়েছিল, এবং এরা ছিল সুযোগসন্ধানীও যারা দূর থেকে ভালো অর্থ উপার্জনের একটি সুযোগের গন্ধ পেয়েই দলে ভিড়েছিল। কিন্তু সত্যিকারের বিশ্বাসীদের জন্য, এটি ছিল জাদুকরী মুহূর্ত। এর আগে তারা তাদের প্রিয় নবীকে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করতে দেখেনি, কিন্তু এখানে সেটিই তাদের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আল্লাহ এখন মুহাম্মদের মাধ্যমে মানুষের সাথে যোগাযোগের ঐশ্বরিক ইচ্ছা প্রকাশ করছেন! তাদের মধ্যে যারা যত বেশি কল্পনাপ্রবণ ছিল তাদের যেন দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল যে, আকাশ থেকে আলোর রশ্মি নেমে আসছে, আকাশের ফেরেস্তারা তা নামিয়ে দিচ্ছে। এটা বলাই যায়, তারা একটি রোমাঞ্চকর অনুভুতি অনুভব করেছিল, বিশেষ করে মুহাম্মদ যখন তাদের জন্য গনিমতের মালের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিলেন।
খুব দ্রুত মুহাম্মদের এই চুক্তির পরীক্ষা দিতে হয় যখন আবু বাসির (Abu Basir) নামের মক্কার এক যুবক ধর্মান্ধরিত হয়ে ইয়াছরিবের মসজিদে এসে মুহাম্মদের কাছে আশ্রয় চায়। মক্কাবাসীরা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে আটকে রেখেছিল, কিন্তু সে পালিয়ে পায়ে হেঁটে ইয়াছরিবে পৌঁছে যায়। মক্কাবাসীরা মুহাম্মদের কাছে একজন পুরষ্কার-লোভী (মদিনা থেকে ওদের লোক ধরে আনতে পারলে পুরষ্কার) বার্তাবাহককে পাঠিয়ে আবু বাসিরকে ফেরত চায়, এবং হুদাইবিয়া চুক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। মুহাম্মদের আর কোন উপায় থাকল না তাকে ফিরিয়ে না দিয়ে। পুরষ্কার-লোভী লোকটি আবার আবু বাসিরের উপর নজর রাখতে তার সাথে একজন মুক্ত দাসকে (যে দাস দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে) সাথে নেন। কিন্তু শহর থেকে মাত্র দশ মাইল দুরে, আবু বসির পুরষ্কার-লোভীর কাছ থেকে তার তলোয়ারটি ছিনিয়ে নিয়ে তাকে হত্যা করে বসে। মুক্ত দাসটি তার জীবন নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আবু বাসির দাসের পেছনেও ধাওয়া করে, কিন্তু দাসটি দৌড়াতে দৌড়াতে মসজিদের মধ্যে ঢুকে মুহাম্মদের দয়া ভিক্ষা করেন। খুনি আবু বাসির তার শিকারের (নিহতের) জিনিসপত্র নিয়ে নিহতের উটে চড়েই কিছুক্ষণ পরেই হাজির হয়। সে মুহাম্মদকে বলে যে, সে সত্যিকারের বিশ্বাসীদের মতো আচরণ করেছে এবং মুহাম্মদকে সে তার প্রাপ্ত মাল থেকে এক পঞ্চমাংশ দেয়ারও প্রস্তাব দেয়, কিন্তু মুহাম্মদ তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন “যদি আমি এক পঞ্চমাংশ নিই, তাহলে তারা ভাববে যে আমি তাদের সাথে আমার চুক্তি ভঙ্গ করেছি” (২২)। যখন ভীত মুক্ত দাসটি আবু বাসিরকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কিছু করতে নারাজ হয়, তখন মুহাম্মদ আবু বাসিরকে ইয়াছরিব থেকে নির্বাসিত করে দেন। এখন সে একজন বিতাড়িত। আবু বাসির এরপর লোহিত সাগরের উপকূলে গিয়ে দ্রুত একজন দুর্ধর্ষ ডাকাত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে এবং শীঘ্রই সুহায়েলের ছেলে আবু জান্দাল সহ আরও সত্তর জন তরুণ মক্কাবাসী এই দলত্যাগীদের সাথে যোগ দেয়। তারা আবু বাসিরকে তাদের নেতা হিসেবে নিযুক্ত করে, দিনে পাঁচবার একসাথে প্রার্থনা করে, মক্কাবাসীদের কাফেলা আক্রমণ করে এবং তাদের হাতের কাছেই যাদের পায় তাদের সবাইকে হত্যা করে। পরিস্থিতি এতটাই হয়ে ওঠে যে মক্কাবাসীরাই শেষপর্যন্ত মুহাম্মদের কাছে আহবান করে তাদের সবাইকে তার কাছেই ফিরিয়ে নিতে - চুক্তি যাই হোক না কেন। মুহাম্মদ তাদের ফিরিয়ে নিলেন (২৩)।
আরেকটি পরীক্ষা আসে যখন মক্কা থেকে ধর্মান্তরিত একজন নারী ইয়াছরিবে পালিয়ে আসে এবং আশ্রয় চায়। তিনি ছিলেন উকবাহ ইবনে আবু মুয়াইতের কন্যা, যে উকবা একসময় নামাজরত অবস্থায় মুহাম্মদের পিঠে উটের নাড়িভুঁড়ি ছুঁড়ে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পর মুহাম্মদ উকবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। মেয়েটির দুই ভাই দ্রুত সময়ের মধ্যে ইয়াছরিবের এসে তাদের বোনকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান, কিন্তু মেয়েটি ভনিতা করে বলেন : “হে আল্লাহর রাসুল, আমি আমার ধর্ম নিয়ে আপনাদের কাছে পালিয়ে এসেছি, তাই আমাকে আপনি রাখেন এবং আমাকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেবেন না। তারা আমাকে ধর্মপালনে বাধা দেবে এবং আমাকে কষ্ট দেবে। ব্যথা নেয়ার মতো আমার আর ধৈর্য নেই। আমি একজন নারী এবং নারীরা দুর্বল, আপনি সেটা জানেন (২৪)।
একজন বিশ্বস্ত নারীকে পৌত্তলিকদের আস্তানায় ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর মুহাম্মদ একতরফাভাবে হুদাইবিয়া চুক্তির শর্তাবলী পরিবর্তন করলেন, যেখান থেকে নারীদের জোরপূর্বক প্রত্যাবাসন বাদ দেন। তিনি তার সমর্থনে নতুন কোরআনের নতুন অধ্যায় বা সুরা নিয়ে আসেন যা পরবর্তীতে আল মুমতাহিনা বা 'The Woman to Be Examined' কোরআনে সংযুক্ত হয়। মুহাম্মদ সেখানে তার আল্লাহর কণ্ঠে বলেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের কাছে মু'মিন মহিলারা হিজরত করে আসলে তোমরা তাদেরকে পরীক্ষা করে দেখ। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে অধিক অবগত। অতঃপর যদি তোমরা জানতে পার যে, তারা মুমিন মহিলা, তাহলে তাদেরকে আর কাফিরদের নিকট ফেরত পাঠিও না।” (২৫)
মসজিদে তার নতুন আয়াত প্রকাশ করার পর মুহাম্মদ নারীর ভাইদের জানান যে তিনি দুঃখিত, কিন্তু তিনি আল্লাহর আইন মেনে চলতে বাধ্য এবং তার বোনকে ইয়াছরিবে রাখতে বাধ্য। তবে একই অধ্যায়ের আরেকটি আয়াতে তিনি মক্কাবাসীদের ইয়াছরিব থেকে পালিয়ে যাওয়া বিবাহিত নারীদের তাদের কাছে রাখার অনুমতি দেন তবে যদি তারা এর জন্য বিবাহিত নারীদের পরিত্যক্ত বরদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন। এই আয়াতটি উমরের দুইজন স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। অবশ্যই উমরের স্ত্রীরা উমরের উপর এবং একইসাথে মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি বিরক্ত হয়ে মক্কায় পালিয়ে যায় এবং ইয়াছরিবে ফিরে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। উমর তাদের তালাক দিয়ে দেন। পরবর্তীতে এ দুজনের মধ্যে একজন আবু সুফিয়ানের এক ছেলে মুয়াবিয়াকে বিয়ে করেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী, উমরকে ক্ষতিপুরনের জন্য কখনোই দেনমোহরের অর্থ দেয়া হয়নি।